দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত, সুস্থ রাখার উপায় How to keep oral cavity healthy

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত, সুস্থ রাখার উপায় How to keep oral cavity healthy

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত, সুস্থ রাখার উপায়গুলো কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১। দাঁত ও মুখ নিয়মিত পরিষ্কার করা
২। খাদ্যাভ্যাস ঠিক করা
৩। পানাহার জনিত বদ অভ্যাস কমানো বা পরিহার করা
৪। দাঁতের ডাক্তার দ্বারা দাঁতের রোগ প্রতিরোধক কিছু কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা করানো।

১। দাঁত ও মুখ নিয়মিত পরিষ্কার করা (Cleaning the oral cavity regularly)

দাঁত ও মুখ নিয়মিত পরিষ্কার করাটাই দাঁতের রোগের থেকে বাঁচার প্রধানতম উপায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে দাঁতের রোগের প্রাথমিক কারণ দাঁতে লেগে থাকা ডেন্টাল প্লাকের জীবানু। যেহেতু দাঁতের কিছুই ঝরে পড়ে না, তাই জীবানু দাঁতের সাথে লেগেই থাকে।

এই ডেন্টাল প্লাক-জীবানুর সাথে শরীরের ভিতর বা রক্তের কোন সংস্রব না থাকাতে সিস্টেমিক (Systemic) জীবানুনাশক (Antibiotics) প্লাক-জীবানুর কোন ক্ষতি করতে পারে না।

জীবানুগুলো প্লাকের ভিতরে এমন ভাবে লেগে থাকে যে বাইরের সাথে কোন রকম যোগাযোগ থাকে না, তাই নানা রকম কেমিক্যাল ব্যবহার করে এগুলোর ক্ষতি করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। নানা রকম কেমিক্যালস-এর মধ্যে আছে টুথপেষ্ট, মাউথ ওয়াস (Mouth Wash) প্রভৃতি।

প্রথমে আসুন টুথপেষ্টের কথায়। হাজার হাজার বছর আগে থেকেই টুথপেষ্টের ব্যবহারের কথা জানা যায়। হাজার বছর ধরে বিজ্ঞান সম্মত ভাবে টুথপেষ্ট তৈরী না হয়ে হোত কুসংস্কারপূর্ণ পদ্ধতিতে।

যেমন নানা রকম জীবের জীব-দেহের অংশ এতে যোগ করা হোত। যদিও কখন কখন কিছুটা যৌত্তিকতা থাকতো পেষ্ট তৈরীতে।

আধুনিক যুগে টুথপেষ্টে নানা রকম কেমিকেলস দিয়ে তৈরী হয়। এর মধ্যে একটি উপাদান হলো ফ্লোরাইড (Fluoride)। ফ্লোরাইড দাঁতের সংস্পর্শে আসলে এটা দাঁতের সাথে আটকে যায় (Precipitate)। এই আটকে থাকা ফ্লোরাইড দন্তঃক্ষয় রোগকে কিছুটা প্রতিরোধ করে।

তাই যখন দন্তঃক্ষয় রোগ হওয়ার প্রবনতা বেশী থাকে (ছোটবেলা থেকে টিনএজ পর্যন্ত এবং বেশী বয়স্কদের) তখন ফ্লোরাইড-এর ব্যবহার দন্তঃক্ষয় রোগ কমায়। এখন এই ফ্লোরাইড কি ভাবে ব্যবহার করবো? এটা জরুরী, কারণ বেশী ফ্লোরাইডের ব্যবহার ফ্লোরোসিস নামক অন্য রোগ তৈরী করে।

আমরা সাধারণত তিন ভাবে এর ব্যবহার করে থাকি। একটি হলো খাওয়ার পানিতে ফ্লোরাইড যোগ করা; দ্বিতীয়টি হলো টুথপেষ্টে যোগ করা এবং শেষেরটি হলো ডাক্তারদের দ্বারা এটা প্রয়োগ করা। আমাদের দেশে খাওয়ার পানিতে নির্দিষ্ট মাত্রায় এবং নিয়মিত ফ্লোরাইড মিশানো প্রায় অসম্ভব।

আর এটা নিয়ে কারো চিন্তা-ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তাহলে রইলো টুথপেষ্টে ব্যবহার ও ডাক্তারদের দ্বারা প্রয়োগ। ডাক্তারদের দ্বারা প্রয়োগ ব্যয় সাপেক্ষ।

তাই সর্বজনের জন্য রইলো টুথপেষ্টের মাধ্যম্যে ফ্লোরাইড ব্যবহার করা। তাই টিনএজ পর্যন্ত ছেলেমেয়ে ও বেশী বয়স্কদের ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেষ্ট ব্যবহার করা উচিত।

কিন্তু ফ্লোরাইডের ব্যবহার মাড়ির রোগের প্রতিরোধে কিছুই কাজে লাগে না এবং টিনএজ পর্যন্ত ছেলেমেয়ে ও বেশী বয়স্কদের বাইরের সাধারণের জন্যও খুব একটা উপকারে আসে না।

যদিও আজকাল মাড়ির রোগ প্রতিরোধ বা চিকিৎসায় সহায়তার উদ্দেশ্যে টুথপেষ্টে ট্রাইকোলোসান (Tricolosan), জিংক সাইট্রেট (Zinc Citrate) নামক এক ধরণের এন্টিসেপ্টিক যুক্ত করা হয়।

বিশেষ কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই টুথপেষ্ট কিছুটা কাজে লাগতে পারে কিন্তু সাধারণের জন্য তেমন একটা প্রয়োজন নাই। তবে টুথপেষ্ট মুখে একরকম ফ্রেশনেস (Freshness) ও সুগন্ধ তৈরী করে বলে এর ব্যবহার করা যেতে পারে।

কিন্তু মনে রাখতে হবে যে শুধুমাত্র এর ব্যবহার, মাড়ির রোগ এবং সাধারণ বয়স্ক লোকদের দন্তঃক্ষয় রোগ প্রতিরোধে তেমন কোন ভুমিকা রাখেনা। তাই অযথা বেশী দামের টুথপেষ্ট বাড়তি কোন সুবিধা দেয় না।

এছাড়া টুথপেস্টে নানারকমের পদার্থ যোগ করা হয় দাঁতকে মজবুত করার জন্য বা দাঁতের রোগের প্রতিকার হিসাবে।

কিন্তু এগুলো বিজ্ঞাপণের ভাষা। এর তেমন সত্যতা নাই। আপনি টুথব্রাশ ব্যবহার না করে শুধুমাত্র টুথপেষ্ট ব্যবহার করুণ, দেখবেন আপনার কোনই উপকার হবে না। বরং আপনার দাঁতের রোগ বাড়তে থাকবে।

মোদ্দা কথা হলো বাচ্চা ও বেশী বয়স্কদের জন্য ফ্লোরাইডযুক্ত যে কোন টুথপেষ্ট ব্যবহার করতে হবে এবং বাকিরা ফ্লোরাইডযুক্ত পেষ্ট বা অন্য যে কোন পেষ্ট ব্যবহার করলেই হবে।

বিশেষ কিছু মানুষ যাদের জেনেটিক বা হরমোন জনিত অথবা অন্য কোন কারণে মাড়ির রোগের প্রবনতা বেশী তাদের জন্য ট্রাইকোলোসান ও জিংক সাইট্রেট সমৃদ্ধ পেষ্ট কিছুটা উপকার করতে পারে।

তবে সব ক্ষেত্রেই দাঁতের প্লাক সঠিক ভাবে মেকানিক্যাল ক্লিনিং (mechanical cleaning)-এর সাথেই পেষ্টের ব্যবহারের উপকারের প্রশ্ন জড়িত। কারণ মেকানিক্যাল ক্লিনিং না হলে টুথপেষ্টের একক তেমন কোন রকম উপকার নাই।

টুথপেষ্টের মতো মাউথ ওয়াশ-এর ব্যবহারের ইতিহাসও অনেক পুরাতন। পেষ্টের মতোই এর তৈরীতেও নানা রকম কুসংস্কার জড়ানো থাকতো। বিশেষ করে মূত্রের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয় ছিলো।

এ যুগে মাউথ ওয়াশও বিজ্ঞান সম্মত ভাবেই তৈরী হয়। সাধারণতঃ তিন ধরণের মাউথ ওয়াশ (mouth-wash) পাওয়া যায়। আমাদের দেশেও ইদানিং এর সবগুলোই তৈরী করে বাজারজাত হচ্ছে।

এগুলো হচ্ছে ক্লোরহেক্সিডিন (Chlorhexidine)-যুক্ত, এসেনসিয়াল ওয়েল (essential oil)-যুক্ত এবং পোভিডন আইওডিন (povidone iodine)-যুক্ত। এর মধ্যে ক্লোরহেক্সিডিনযুক্ত মাউথ ওয়াশের প্লাক প্রতিরোধ (Anti-plaque Activity) ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে ভালো।

যদিও এর স্বাদ ভাল না এবং দাঁতের রঙ নষ্ট করতে পারে। সে তুলনায় এসেনসিয়াল ওয়েল সমৃদ্ধ মাউথ ওয়াশ দাঁতের রঙ নষ্ট করে না কিন্তু এর এন্টি-প্লাক ক্ষমতা ক্লোরহেক্সিডিনের তুলনায় কম। পোভিডন আইওডিনের এন্টি-প্লাক ক্ষমতা সবচেয়ে কম।

তবে এটার স্বাদ খারাপ না এবং এটা দাঁতের রঙ নষ্ট করে না। পোভিডন আইওডিন যুক্ত মাউথ ওয়াশ হাইপোথাইরইডিজম রোগীদের ব্যবহার করা যাবে না।

মাউথ ওয়াশ সাধারণের জন্য খুব জরুরী না। এটা তাদের জন্য প্রয়োজন যারা ঠিক মতো দাঁত পরিষ্কার করতে পারে না। যেমন প্রতিবন্ধী, শারীরিকভাবে খুব অসুস্থ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন না করতে পারা রোগী ইত্যাদি।

এ ছাড়া যারা অনেক দিন ধরে মাড়ির রোগে ভুগছে তারা অন্য চিকিৎসার সাথে সাথে মাউথ ওয়াশ মাঝে মাঝে ব্যবহার করতে পারেন।

তাহলে টুথপেষ্ট বা মাউথ ওয়াশ-ই ডেন্টাল প্লাক পরিষ্কারের আসল কথা নয়। আসল কথা বাদ দিয়ে কেন তাহলে টুথপেষ্ট আর মাউথ ওয়াশ-এর প্রসঙ্গ প্রথমে আনলাম?

এটা এই জন্য যে ডেন্টিষ্টরা রোগী বা সাধারণের কাছ থেকে এদুটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশী প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। যেমন কোন পেষ্ট ব্যবহার করবো?

বা আমি তো অনেক দামী পেষ্ট ব্যবহার করি। কোন মাউথ ওয়াশ ব্যবহার করবো? কত দিন ব্যবহার করবো? ইত্যাদি।

তাহলে ডেন্টাল প্লাক পরিষ্কারের আসল কথা কি? আসল কথা হলো দাঁতে লেগে থাকা পাতলা প্রলেপ (Pellicle) বা ডেন্টাল প্লাক ঘষে পরিষ্কার করা (Mechanical cleaning)।

কি ভাবে ঘষে পরিষ্কার করা যায়? হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ নানা ভাবে দাঁত পরিষ্কার করার চেষ্টা করছে। গাছের ছোট ডাল ব্যবহার করে দাঁত পরিষ্কার করাও হাজার বছর ধরে মানুষ চালিয়ে যাচ্ছে।

দাঁত পরিষ্কার করার জন্য হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নামাজের আগে নিয়মিত গাছের ছোট ডাল (মেশওয়াক, Meshwak) দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতেন।

এছাড়া নানা রকমের ঘষার পাউডার (Abrasive Powder) মানুষ শত শত বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে। যেমন লবন গুড়া করে পাউডার, কয়লা গুড়া করে পাউডার, পোড়া মাটি বা ছাঁই এবং নানা রকম ধাতুর বা ধাতুর লবনের পাউডার ইত্যাদি।

মজার ব্যাপার হলো এখনও অনেক মানুষ এগুলো ব্যবহার করে যাচ্ছে। এ গুলোর ব্যবহার ঐ সময়ের জন্য যথেষ্ট ভালো ছিলো।

কিন্তু আধুনিক সময়ে গাছের ছোট ডালের পরিবর্তে টুথব্রাশ, ঘষার পাউডারের পরিবর্তে টুথপেষ্ট বা খুব মিহি করে তৈরী করা নানা রকম ধাতুর লবনের পাউডার মানুষ ব্যবহার করছে।

এখন পর্যন্ত ঘষে দাঁত পরিষ্কারের সহজ উপায় হলো টুথব্রাশ ব্যবহার করা। আমরা আমাদের নিজেদের গবেষণায় দেখেছি যে অন্য যে কোন কিছুর চেয়ে টুথব্রাশ ব্যবহার করলে (সঠিক বা বেঠিক যে পদ্ধতিই হোক না কেন) মাড়ির অবস্থা যথেষ্ঠ ভালো থাকে।

কথা হলো টুথব্রাশ টি কেমন হবে? এটা কি হাতের দ্বারা (Manual) না মেশিনের দ্বারা (Electrical) চালিত হবে? টুথব্রাশের ব্রিশলের (Bristle) সাইজ (Size) কেমন হবে? বড় মাথা না ছোট মাথা? আকারই (Shape) বা কেমন হবে?

উচু-নিচু না সমান? ব্রিশলগুলো নরম হবে না শক্ত হবে? ব্রিশলের মাথা গোল (Rounded) হবে না চোখা (Slanted) হবে? একটি ভালো এবং কার্যকর টুথব্রাশের জন্য এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা দরকার।

মেশিন চালিত টুথব্রাশের ব্যবহারে বেশী পরিষ্কার হবে এরকম কিছু নাই। তবে সময় কিছুটা বাঁচতে পারে। বিশেষ করে সকালে যাদের অতিরিক্ত তাড়া থাকে। তাই হাতের দ্বারা ব্যবহৃত টুথব্রাশই (যেটা আমরা সবসময় ব্যবহার করি) যথেষ্ঠ।

টুথব্রাশ হবে ছোট মাথার। আমাদের দেশে বাজারে যে টুথব্রাশ বিক্রি হয় তার প্রায় সবই বড় এবং তাই ব্যবহারের অনুপযোগী। ছোট বলতে কত ছোট? এর সাইজ হবে ১ ইঞ্চি বা ১ ইঞ্চির কম।

অনেকে মনে করে এটা ছোটদের ব্রাশ। কিন্তু ছোটদের ব্রাশ হবে ১ ইঞ্চির বেশ কম, হ্যান্ডেল হবে ছোট আর ব্রিশল হবে অতি নরম (Ultra soft)। কেন ছোট টুথব্রাশ ব্যবহার করতে হবে?

কারণ ছোট টুথব্রাশ না হলে পিছনের একটি বা দুটি দাঁত পর্যন্ত ব্রাশ পৌঁছায় না, বিশেষ করে যাদের একটু ভারী গাল (Fatty Check)। তাই নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করার পরও শেষের দাঁতগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

বড় ব্রাশ দিয়ে দাঁতের ভিতরের দিক পরিষ্কার করা দূরূহ (Difficult)। এ ছাড়া ছোট মাথার টুথব্রাশ নিয়ন্ত্রণ সহজ (Easy to handle) তাই ব্যবহারও সহজ। সুতরাং আমাদের ছোট মাথার টুথব্রাশই ব্যবহার করতে হবে।

এখন আসা যাক ব্রিশলের আকারের বিষয়ে। ব্রিশলগুলো উচু-নিচু (Zigzag) অথবা সমান (Plain) হতে পারে। দুটিই সমান কার্যকর। তাই এর যে কোন একটি হলেই চলবে। এ ছাড়া ব্রিশলগুলোর মাথা হবে গোল (Rounded) কারণ চোখা (Slanted) হলে মাড়িতে ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত

শক্ত ব্রিশলের টুথব্রাশ সম্পূর্ণভাবে অনুপযোগী এবং ক্ষতিকর। কিন্তু আমাদের দেশের বাজারের বেশীর ভাগ টুথব্রাশের ব্রিশল শক্ত। আগে মাঝারি নরম (Medium Soft) ব্রিশলের টুথব্রাশ ব্যবহারের কথা বই-পত্রে লেখা থাকতো;

কিন্তু এখন শুধুমাত্র নরম (Soft) বা কখনও কখনও (Ultra Soft) ব্রিশলের টুথব্রাশের কথাই বলা হয়। কিন্তু কেন নরম ব্রাশ? তার আগে বলে নেই কেন শক্ত ব্রাশ না। দাঁতের উপরের বা খাওয়ার তল (Occlusal Surface) এই ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করা যায়।

কিন্তু দাঁতের বাইরের ও ভিতরের দিকে শক্ত ব্রাশ ব্যবহারে দাঁত ও মাড়ির সংযোগ স্থলে (Neck) ক্ষয় করে ফেলে এবং দাঁতে শিরশির আরম্ভ হয়।

শক্ত ঘষা ঘষিতে মাড়ি দাঁতের গোড়ার দিকে সরে যায় এবং দাঁতের গোড়া বের হয়ে দেখতে খারাপ হয়ে যায়। সর্বোপরি শক্ত ব্রাশ এই জায়গাগুলো ভাল ভাবে পরিষ্কারও করতে পারে না।

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত

তাই শক্ত ব্রাশ একদম না। মাঝারি নরম টুথব্রাশ কমবেশী একি ঝামেলা তৈরী করে। তাই এটাও পরিত্যাজ্য। নরম ব্রাশের প্রথম সুবিধা হলো এটা সব দিক ভালো ভাবে পরিষ্কার করতে পারে।

সব দিক বলতে দাঁতের দুই দিকের (Buccal and lingual Surface) মাড়ির একটু ভিতর পর্যন্ত, দুই দাঁতের মাঝখান, ও খাওয়ার বা উপরের তল। সত্যি বলতে এই জায়গাগুলোতেই ডেন্টাল প্লাক জমে বেশী।

এ ছাড়া নরম বলে কিছুটা মাড়ির ম্যাসাজ (Gum Massage)ও হয় যেটা মাড়ির রোগের চিকিৎসার অঙ্গ। নরম ব্রিশল বলে দাঁতের ক্ষয়ও করে না এই ব্রাশ। তাই সবার জন্যই নরম ব্রিশলের ব্রাশ ব্যবহার করা উচিৎ।

তা হলে মূল কথা হলো দাঁত পরিষ্কার করার জন্য দরকার একটি ছোট মাথার নরম ব্রিশলযুক্ত টুথব্রাশ যেটার ব্রিশলগুলো উচু-নিচু অথবা সমান হতে পারে। প্রশ্ন উঠে একটা ব্রাশ কত দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যেতে পারে?

সাধারণ ভাবে একটি ব্রাশ তিন মাস পর্যন্ত ব্যবহার করার কথা বলা হয়। তবে কিছু কম বা বেশী সময়ও ব্যবহার করা যেতে পারে ব্রাশের অবস্থার উপর বিবেচনা করে। ব্রাশের ব্রিশলগুলো বেকাতেরা বা নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত টুথব্রাশটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত

ফিরে আসা যাক টুথপেষ্টের কথায়। টিন-এইজ বয়স পর্যন্ত ও বেশী বয়স্কদের জন্য ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেষ্ট ব্যবহার করা ভালো। বাকিদের যে কোন টুথপেষ্ট ব্যবহার করলেই চলবে। অযথা বেশী দামের টুথপেষ্ট অপ্রয়োজনীয়।

যাদের বিভিন্ন কারণে মাড়ির রোগের প্রবনতা বেশী তাদের আমরা প্রথমে শুধুমাত্র পানি দিয়ে ব্রাশ ভিজিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতে বলি, ব্রাশ করার শেষের দিকে তিনি জীবাণুনাশক (Anti-septic) টুথপেষ্ট ব্যবহার করতে পারে।

অথবা এক বেলা ব্রাশ শুধু মাত্র পানি দিয়ে ভিজিয়ে আর অন্য বেলা পেষ্ট দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা যেতে পারে।

অল্প বয়স্ক বাচ্চাদের দাঁতের যত্ন (Milk teeth care):

বাচ্চাদের দুধ দাঁতের সঠিক ও পূর্ণ যত্ন নিতে হবে। আগেই লিখেছি যে, অনেক মায়েরা মনে করেন যে এই দাঁতগুলো তো পড়েই যাবে তবে এগুলোর এত যত্নের কি প্রয়োজন।

কিন্তু দুধ দাঁত পড়ে নুতন স্থায়ী দাঁত উঠার সময় সাধারণ ভাবে ছয় বছর থেকে বার বছর। তাই এর আগেই দুধ দাঁতে যদি দন্তঃক্ষয় রোগ হয় ও এর থেকে দন্তঃমজ্জার প্রদাহ এবং আরো পরে হাড়ের প্রদাহ হয় তবে বাচ্চাটির কষ্টের শেষ থাকে না।

আগেই উল্লেখ করেছি যে এর চিকিৎসাও জটিল। তাই দুধ দাঁতের যথেষ্ট যত্ন নিতে হবেই। এখন কি ভাবে যত্ন নিবেন? দাঁত সম্পূর্ন ভাবে মুখে উঠার সাথে সাথেই দাঁত পরিষ্কার করতে হবে।

প্রথম প্রথম আঙ্গুলে সুতির পাতলা কাপড় পেঁচিয়ে ওই আঙ্গুল দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা যেতে পারে। বাচ্চা একটু বড় হলে খুব নরম টুথ-ব্রাশ (Ultra soft) দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতে হবে।

প্রথমে বাচ্চাকে দিবেন, ও নিজেই পরিষ্কার করবে; শেষে আপনি নিজে করিয়ে দিবেন। অবশ্যই আরম্ভ থেকেই রাতে দাঁত পরিষ্কার করার অভ্যাস তৈরী করবেন। এখন কোন পেষ্ট ব্যবহার করবেন কিনা? বা পেষ্ট ব্যবহার করলে কোন টা?

সুতির কাপড় পেঁচানো আঙ্গুলে কোন পেষ্ট লাগাবেন না, শুধু পানি দিয়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে পরিষ্কার করলেই চলবে। টুথ-ব্রাশে পেষ্ট লাগাতে পারেন। আজকাল বাচ্চাদের নানা রকম পেষ্ট বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।

তার যে কোন একটা ব্যবহার করলেই হবে। তবে খুব অল্প পরিমান পেষ্ট ব্রাশে লাগাবেন। বাচ্চা বারবার পেষ্ট খেয়ে ফেলে বা পেষ্ট ব্যবহারে ঝামেলা হলে শুধুমাত্র পানি দিয়ে ব্রাশ ভিজিয়ে দাঁত পরিষ্কার করলেও যথেষ্ট হবে।

বাচ্চাদের খাওয়ার অভ্যাস সম্মন্ধে অতি প্রয়োজনীয় দু’ চার কথা না বললেই নয়।
প্রত্যেক বাচ্চাই সাধারণ খাবারের সাথে সাথে মায়ের বুকের দুধ বা বোতলের দুধ অথবা দুটোই খেয়ে থাকে। কিন্তু আন্তরিক চেষ্টা চালাতে হবে যেন রাতে দুধ মুখে নিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস না হয়।

এটা বোতলের দুধের জন্যও যেমন বুকের দুধের জন্যও তেমন। যদি মায়েরা এটা করতে না পারেন তবে অবশ্যই দুধ খাওয়ার পরে একটু পানি খাইয়ে দিবেন যাতে দাঁতে লেগে থাকা দুধ কিছুটা হলেও ধুয়ে যায়।

বোতলের দুধ দেড় বছর বয়সে ছাড়িয়ে দিবেন এবং মায়ের বুকের দুধ দুই বা আড়াই বছরে ছাড়িয়ে দিবেন। এর বদলে গ্লাসে বা বাটিতে দুধ খাওয়ার অভ্যাস করাবেন।

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত

চকলেট বা কোল্ড ড্রিঙ্ক অথবা সহজে দাঁতে লেগে থাকে নরম খাবার নিজেরা কিনে না দেওয়ার চেষ্টা করবেন। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবীরা উপহার হিসাবে কিনে দিলে বাচ্চারা খেতে পারবে। উদ্দেশ্য হলো কম খাওয়ানোর। তবে খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস করতে পারলে খুব ভালো।

বাচ্চাদের শর্ত দিবেন যে “তুমি খেতে পারো তবে খাওয়ার পর দাঁত ব্রাশ করতে হবে”। এটা যদি সম্ভব না হয় তবে খাওয়ার পর কুলি করতে বলবেন, নিজেদের পক্ষে যেন খাওয়ার পর পানি খায়। এতেও দাঁতে লেগে থাকা চকলেট কিছুটা ধুয়ে যাবে।

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত

তাদের ফল খাওয়ার অভ্যাস তৈরী করাবেন। নিজেরা ফল খাবেন তা হলে বাচ্চারাও ফল খাবে। ফল বলতে আংগুর, আপেলই না। আমাদের দেশের যে কোন রকম ফলই খেতে পারেন।

বাচ্চাদের দাঁতের যত্নে তাই:
১। রাতে খাওয়ার পর ছোট মাথার টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত ব্রাশ করার অভ্যাস তৈরী করতে হবে।
২। মিষ্টি জাতীয় ও নরম খাবার কম খাওয়াতে হবে। খেলে খাওয়ার পর কুলি করার অভ্যাস করাতে হবে।
৩। ফল খাওয়ার অভ্যাস বাড়াতে হবে।
৪। রাতে দুধ খাওয়ার পর পানি খাওয়াতে হবে।

বেশী বয়স্কদের দাঁতের বিশেষ যত্ন (Tooth care for old persons):

বাংলাদেশের মানুষের এখন গড় আয়ু সত্তর বছরের কিছু উপরে। পয়ষট্টি বা তার উপরের বয়সের লোক সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫%। সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে হার্ট-এটাক/স্ট্রোক, রোড এক্সিডেন্ট বা ক্যান্সারে মানুষ মারা না গেলে ৭০ বছরের বেশ উপরেই মানুষজন বেচে থাকে।

বিশেষ করে মহিলারা। এখন এই বেশী বয়স্ক জনগোষ্ঠীর দাঁতের কি কি রোগ হতে পারে? কি ভাবেই বা এই রোগগুলোর প্রতিরোধ বা প্রতিকার করা যেতে পারে? গ্রামের বেশী বয়স্ক কম শিক্ষিত মানুষ দাঁতের অযত্নে, নানা কুসংস্কারে এবং অপ-চিকিৎসায় সব দাঁত বেশ আগেই হারায়।

এবং দাঁত না থাকার কারণে নানা ভাবে ভুক্তে থাকে। এদের প্রসঙ্গে এখানে কিছু লিখছি না। কিন্তু যাদের দাঁত থেকে যায় দাঁতের বাড়তি যত্ন তাদের নিতেই হবে। কারণ অনেকেই এই বয়সে অন্য নানা রোগে ভুগে থাকে। চলা ফেরা কমে যায়।

তাই দাঁতের রোগের চিকিৎসা পাওয়াটাও শারীরিক ভাবে কষ্টসাধ্য। ব্যয় সাপেক্ষ তো বটেই। বেশী বয়সে মাড়ির রোগে, বেঠিক ভাবে শক্ত ব্রাশ ব্যবহারে বা বয়সের কারণে দাঁতের গোড়া (Root) বের হয়ে যায়।

দাঁতের গোড়ার বাইরের দিকে থাকে সিমেন্টাম (Cementum)। এটা সাধারণ অবস্থায় হাড় ও মাড়ি দিয়ে ঢাকা থাকে। কিন্তু দাঁতের গোড়া বের হয়ে গেলে এই সিমেন্টামও বের হয়ে যায়। এজন্য কখন কখন দাঁত শিরশির করতে পারে।

কিন্তু যেটা সবচেয়ে ঝামেলার সেটা হলো এই দাঁতের গোড়ায় (সিমেন্টামে) নতুন করে দন্তঃক্ষয় রোগ আরম্ভ হয়। এই সময়ে দন্তঃক্ষয় রোগ খুব তাড়াতাড়ি আরম্ভ হয় এবং খুব তাড়াতাড়ি বড় ও গভীর হয়ে যায়।

এর জন্য দন্ত-মজ্জার প্রদাহ, হাড়ের প্রদাহ (Inflammation) তো হতেই পারে। কিন্তু আর একটা ঝামেলা হয় দাঁত হঠাৎ করে গ্রীবা (Neck) থেকে ভেঙ্গে যায়। তখন এর চিকিৎসা আরো জটিল হয়ে পরে। তাই এসময় দাঁতের বেশ যত্ন নিতে হবে।

যত্ন বলতে ভালো ভাবে এবং খেয়াল করে ব্রাশ করতে হবে যেন দাঁতের গোড়া পরিষ্কার হয়। বিশেষ করে গোড়ার ভিতরের দিকটা। এসময় ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেষ্ট যথেষ্ট প্রয়োজন।

এছাড়া যদি অন্য কোন অসুবিধা না থাকে তবে খাওয়ার পর আঁশযুক্ত ফল খাওয়া বা নিদেন পক্ষে একটু পান-মশলা চিবানো। এতে দাঁতের গোড়া বেশ পরিষ্কার হয়।

এছাড়া যাদের বেশ কয়েকটি দাঁত না থাকলে সম্ভব হলে তা বাঁধিয়ে বা অন্য কোন ভাবে প্রতিস্থাপন (Replace) করে নিতে হবে। না হলে অন্য দাঁতগুলোর উপর বাড়তি চাপ পরে দাঁতগুলো অতিরিক্ত ক্ষয় হয়ে যাবে অথবা নড়ে যাবে।

যাদের এক দিকে নীচের দাঁত আছে কিন্তু ওই দিকেরই উপরের দাঁত নাই এবং আর এক দিকের উপরের দাঁত আছে কিন্তু নীচের দাঁত নাই।

অথবা উপরের কোন দাঁতই নাই কিন্তু নীচের বেশ কিছু দাঁত আছে বা নীচের দাঁত নাই কিন্তু উপরের বেশ কিছু দাঁত আছে তাদের দুই চোয়ালের দুরত্ব কমে যায় এবং এক চোয়ালের দাঁত অন্য চোয়ালের মাড়িতে লেগে মাড়িতে ঘাঁ করে ফেলে।

দেখতে খারাপও হয়ে যায়। তাই আগে থাকতেই পড়ে যাওয়া বা ফেলে দেওয়া দাঁত গুলো প্রতিস্থাপন করতে হবে, যাতে এই অবস্থা তৈরী না হয়।

তাই বেশী বয়স্কদের জন্য তিনটি উপদেশ

১। দিনে দুবেলা (রাতে সহ) ফ্লোরাইডযুক্ত টুথ-পেষ্ট ও ছোট মাথার নরম টুথ-ব্রাশ দিয়ে ভালো ভাবে দাঁত পরিষ্কার করুন যাতে দাঁতের গোড়াও পরিষ্কার হয়।

২। খাওয়ার পর আঁশযুক্ত ফল খান বা পান-মশলাজাতীয় কিছু একটা খান যাতে গোড়া কিছুটা পরিষ্কার হয়।

৩। আগে থাকতেই পড়ে যাওয়া বা ফেলে দেওয়া দাঁত গুলো সময় মতো প্রতিস্থাপন করতে হবে।

হবু মা বা যারা মা হতে চান তাদের দাঁতের বাড়তি যত্ন (Tooth care for pregnant women):

অন্তঃসত্বা অবস্থায় হবু মায়েদের নানা রকম হরমোনজনিত ভারসাম্যহীনতা থাকতে পারে।

কিছুটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে পারে। তাই এই সময়কালে দাঁতের রোগ যেন না হয়। কারণ এই সময়ে দাঁতের চিকিৎসায় বিধিনিষেধ থাকে। বিভিন্ন ঔষধ সেবনে নিষেধ থাকে। বিশেষ করে ব্যথার ঔষধ ও এন্টি-বায়োটিক।

এক্স-রে করার বিধি-নিষেধও থাকে। অন্তঃসত্বা মহিলাদের সবচেয়ে সাধারণ সমস্যা মাড়ি থেকে রক্ত পড়া, মাড়ির কোথাও কোথাও বেশ ফুলে যাওয়া (Pregnancy Epulis)। আগেই লিখেছি এ রোগের প্রধান কারণ ডেন্টাল প্লাক।

এর সাথে যোগ হয় হরমোনজনিত কারণ। দুটো মিলে খুব অল্পতেই মাড়ি থেকে রক্ত পড়া আরম্ভ হয়, মাড়ি ফুলে যায়।

দাঁত ও মুখ রোগ মুক্ত

এর প্রতিরোধ দুইটি। একটি হলো অন্তঃসত্বা হওয়ার প্রস্তুতি পর্বে যে অবস্থা ডেন্টাল প্লাক ধরে রাখায় সাহায্য করে সেগুলো দূর করা। যেমন ডেন্টাল ক্যালকুলাস (Calculus)। এটা আগে থাকতেই ডাক্তারের সাহায্যে পরিষ্কার করে নিতে হবে।

আর জরুরীটি হলো সেই পুরানো কথা, টুথ-ব্রাশ দিয়ে ভাল ভাবে দাঁত পরিষ্কার করতে হবে যেন দাঁতে কোন রকম প্লাক না জমে। তা হলেই মাড়ি থেকে রক্ত পড়বে না এবং মাড়ি ফুলবে না। আর এটা হলে অল্প ওজনের বাচ্চা হওয়া বা সময়ের আগে বাচ্চা হওয়ার ঝুঁকিও কমবে।

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা জানানো প্রয়োজন। অন্তঃসত্বা কালীন সময়ে যেন কোন রকম দন্ত-মজ্জার বা মুখের হাড়ের প্রদাহ বা ইনফেকশন না হয় সেই অবস্থা তৈরী করা।

যেমন দাঁতে দন্তঃক্ষয় (Dental Caries) রোগ থাকলে আগে থেকেই চিকিৎসা করিয়ে নেয়া; আক্কেল দাঁতের (Wisdom Tooth) সমস্যা থাকলে তারও চিকিৎসা করিয়ে নেয়া।

অন্তঃসত্বা কালীন সময়ে হাড়ের প্রদাহ বা দন্ত-মজ্জার প্রদাহ হবু মায়ের জন্য যথেষ্ট কষ্টের ও ঝুঁকিপূর্ণ। এর চিকিৎসাও ঐ সময়ে যথেষ্ট জটিল।

২। খাদ্যাভ্যাস ঠিক করা (Correction of food habit):

দন্তঃক্ষয় রোগ (Dental caries)-এর বিস্তারের সাথে নগরায়ন (Urbanization) ও আর্থিক উন্নতির যোগ আছে। নগরায়নের সাথে নানা রকম নরম খাবার (Soft Food)-এর সম্পর্ক।

যেমন চকলেট, টফি, বিস্কুট, মিষ্টি, জাংক ফুড (বার্গার, হট ডগ, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই), কোল্ড ড্রিঙ্ক শহরের ছেলে-মেয়েদের খাবার এবং শহরেই বেশী বিক্রি হয়। আর্থিক উন্নতির সাথে যোগ বলতে এগুলো কেনার সক্ষমতা।

তাই শহরের ছেলে-মেয়েদের বা হাট-বাজারের কাছের ছেলে-মেয়েদের দন্তঃক্ষয় রোগ বেশী হয়। জাপানে আর্থিক উন্নতির সাথে সাথে দন্তঃক্ষয় রোগ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। পঞ্চাশ-এর দশক থেকে আশির দশকের প্রারম্ভ পর্যন্ত দন্তঃক্ষয় রোগ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে।

পরে জাপান (Japan) সরকারের মুখের স্বাস্থ্য রক্ষার নানা সচেতনামুলক কার্যক্রম চালু করাতে দন্তঃক্ষয় রোগের সংখ্যা নামতে নামতে ২০০৭ সালে সত্তর-এর দশকের চেয়ে চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসে।

পশ্চিমা বেশীর ভাগ দেশগুলোর ব্যাপারেও একি রকম ঘটনা ঘটে এবং ওরা মুখের স্বাস্থ্য সচেতনার মাধ্যমে জাপানের থেকে বেশ আগেই দন্তঃক্ষয় রোগ অনেক কমিয়ে আনে। বাংলাদেশে এখনকার অবস্থা জাপানের পঞ্চাশ দশকের মতো।

দেশের আর্থিক উন্নতি হচ্ছে, সাথে সাথে খাওয়ার অভ্যাস পাল্টাচ্ছে, কিন্তু মুখের স্বাস্থ্য সচেতনা বাড়ছে না। তাই এখন থেকে মুখের স্বাস্থ্য সচেতনা না বাড়াতে পারলে দাঁতের নানা রোগ এবং সাথে সাথে অন্যান্য নানা রোগও বাড়তে থাকবে।

আমরা জানি যে আমাদের দেশে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস ও নানা রকম ক্যান্সার অনেক বেড়ে গেছে। এর সাথে খাদ্যাভ্যাসের একটা যোগ থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা। তাই কিছুটা স্বাস্থ্য সম্মত খাদ্যাভ্যাস তৈরী করা প্রয়োজন।

খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা যথেষ্ঠ কষ্টকর। তাই ছোটবেলা থেকে চেষ্টা করলে খাদ্যাভ্যাস কিছুটা পরিবর্তন সম্ভব। এখানে পরিবার ও প্রাইমারি স্কুলের ভুমিকা অপরিসীম। নরম খাবার (Soft Food) খাওয়ার প্রবনতা কমানো ও ফল খাওয়ার অভ্যাস বাড়ানোর মধ্য দিয়ে এটা কিছুটা সম্ভব।

এছাড়া নরম খাবার খাওয়ার পর দাঁত মাজার অভ্যাস তৈরী করা, না হলে কুলি করা, নিদেন পক্ষে পানি খাওয়ার অভ্যাস তৈরী করা। এই অভ্যাসে ডেন্টাল প্লাক তৈরী হওয়ার প্রবনতা কমবে।

৩। পানাহার জনিত বদ অভ্যাস কমানো বা পরিহার করা (Avoid certain bad habits):

দুইটি বদ অভ্যাস অন্যান্য রোগের মতো দাঁতের রোগেরও ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এর একটি হলো ধুমপান ও অন্যটি তামাকসহ পান খাওয়া। এছাড়া তামাক দিয়ে বানানো গুল ব্যবহার করাও দাঁতের জন্য ক্ষতিকর।

হার্টের রোগের মতোই ধুমপায়ীদের, ছেলেদের, বয়স্কদের, ডায়াবেটিকদের, দুশ্চিন্তাগ্রস্থদের দাঁতের মাড়ির রোগ বেশী হয়। ধুমপায়ীরা সরাসরি দাঁতের মাড়ির রোগে ভোগেন না। কিন্তু ডেন্টাল প্লাকের জন্য মাড়ির রোগ হলে ধুমপায়ীদের পেরিওডন্টাল লিগামেন্ট ও হাড় খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হতে থাকে।

ফলে দাঁতের গোড়া ফুলে যায় ও দাঁত নড়তে থাকে। এছাড়া ধুমপায়ীদের মাড়ির রোগের চিকিৎসার সফলতা অনেক কমে যায়। সহজে মাড়ির রোগ ভাল হয় না। তামাকসহ পান খাওয়া মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

যারা অতিরিক্ত পান খায় তাদের দাঁতের উপরের অংশ খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয় হতে থাকে। পরবর্তীতে তাদের দাঁতের শিরশিরাণি বাড়তে পারে, সাথে হতে পারে দাঁতের মাড়ির রোগ ও অন্যান্য জটিলতা।

আমরা নিজেরা পরিক্ষা করে দেখেছি যে ধুমপায়ী ও যারা নিয়মিত পান খায় তাদের মাড়ির রোগ অনেক বেশী হয়। এই পরিক্ষার ফল বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

তাই এই দুইটি বদ অভ্যাস পরিহার করা উচিৎ। এটা করতে পারলে নানা রকম ক্যান্সার ও অন্যান্য রোগ থেকে বাচা যাবে। একি সাথে দাঁতের রোগের (বিশেষ করে মাড়ির রোগ) হাত থেকেও বাঁচা যাবে।

৪। দাঁতের ডাক্তার দ্বারা দাঁতের রোগ প্রতিরোধক কিছু কিছু প্রাথমিক চিকিৎসা করানো (Primary dental treatment):

যদি আশে পাশে দাঁতের ডাক্তার থাকে এবং ব্যয় করার সক্ষমতা থাকে তবে বাচ্চাদেরকে ৬ মাসে একবার বা নিদেন পক্ষে বছরে একবার দাঁতের ডাক্তার দিয়ে দেখানো দরকার।

আগেই লিখেছি যে, উপরের দাঁতের নীচের তল (Occlusal Surface) ও নীচের দাঁতের উপরের তল (Occlusal Surface) এমন ভাবে উচু-নীচু (Pits and Fissures) থাকে যে খাওয়ার সময় ঠিক ঠিক মতো ফিট (Fit) হয়, বেশী নড়াচড়া করতে না পারে এবং খাদ্যকনা ঠিক মতো চিবানো হয়।

অনেক বাচ্চার দাঁতের এই খাওয়ার তল (Occlusal Surface)-এর উচু-নিচুর নিচুটা বেশ গভীর (Deep) থাকে, অনেকটা গর্তের মতো। এটা মূলতঃ বংশগত। এখানে সহজেই খাদ্যকনা আটকিয়ে যায় এবং এখান থেকে দন্তঃক্ষয় রোগ আরম্ভ হয়।

যদি এই নীচুর গভীরতা কমানো যায় তবে খাবার আর আটকাবে না, দন্তঃক্ষয় রোগও সহজে হবে না। দাঁতের ডাক্তাররা এটা করতে পারে খুব সহজেই। এক ধরণের হালকা তরল বস্তু (Fissure Sealant) আছে যা লাগালেই ঐ বেশী নীচু জায়গা পূরণ হয়ে যায়।

এতে গভীরতা কমে যাওয়ায় খাবার আটকায় কম এবং ঐ বস্তুগুলোর দন্তঃক্ষয় রোধ করারও (Anti-carious activity) ক্ষমতা থাকে, যেটা একটা বাড়তি সুবিধা। উন্নত দেশগুলোতে এই ব্যবস্থা স্কুলেই করা হয়।

ওই দেশ গুলোর প্রাথমিক স্কুলে নিয়মিত মুখ ও দাঁতের পরিচর্যার শিক্ষা দেওয়া হয় এবং প্রাথমিক চিকিৎসাও দেয়া হয়। যেটা আমাদের দেশে একেবারেই নাই। তাই যাদের সামর্থ আছে তাদের নিজেদের তাগিদেই এটা করিয়ে নেয়া প্রয়োজন।

একি সাথে দাঁত ও মুখের পরিচর্যা কি ভাবে করতে হয় তাও শিখে নেওয়া দরকার। সামর্থবান লোকদের ছেলে মেয়েদের প্রয়োজন মত দাঁতের ডাক্তার দ্বারা প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে নিতে হবে।

Read More: দাঁত ও মুখের স্বাস্থ্য পরিচর্যা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top