নেক আমল বই #3 ইলম অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

নেক আমল বই

নেক আমল বই, ইলম শিক্ষা করার বিবরণ
‘ইলম দু’প্রকার। যথা : দুনিয়াবী ‘ইলম ও দ্বীনী ইলম। দুনিয়াবী ইলম শিক্ষা না করলে ইহকালীন উন্নতি হাছিল হয় না, আর দ্বীনী ইলম শিক্ষা না করলে পরকালীন উন্নতি হাছিল হবে না। ইহকাল অস্থায়ী আর পরকাল চিরস্থায়ী। মানুষ ইহকাল লাভের জন্য দুনিয়াবী ‘ইলম লাভ করার নিমিত্ত হাজার হাজার টাকা খরচ করতে রাজী কিন্তু চিরস্থায়ী পরকালের মুক্তিলাভের জন্য দ্বীনী ইলম শিক্ষা করতে টাকা খরচ করতে রাজী হয় না। সমাজের এ অবস্থার কারণ দ্বীনী ‘ইলমের অজ্ঞতা এবং পরকালের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস না থাকা।

অথচ দ্বীনী ‘ইলম শিক্ষা করার ব্যাপারে হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন – “প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ‘দ্বীনী এলেম শিক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য (ফরয)।” এ ফরয ত্যাগ করলে দোযখে শাস্তি ভোগ করতে হবে। হানাফী মাযহাবের প্রসিদ্ধ ফতোয়ার কিতাব শামীর ১ম খণ্ডের ৪০ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে, “দ্বীনী ইলম দরকার পরিমাণ শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরযে আইন, অপরের উপকারের জন্য প্রয়োজনের বেশি শিক্ষা করা ফরবে কিফায়া, বিদ্যার সাগর হওয়া মুস্তাহাব।” উল্লিখিত বর্ণনায় বুঝা গেল একশত জনের মধ্যে একশত জন মুসলমান নর-নারীর উপরই দ্বীনী ইলম শিক্ষা করা ফরয। এ ‘ইলম শিক্ষা করা প্রথম প্রকারের ইবাদাত। বুখারী শরীফের একটি হাদীসে আছে, রাসূলে কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন- “সমস্ত রাত জেগে থেকে নফল ইবাদাত করার চেয়ে এক ঘণ্টাকাল ‘ইলম শিক্ষা করা উত্তম।”

বর্তমান জমানার মুসলমান সমাজ দ্বীনী ইলম শিক্ষার ফরয তরক করে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলছে এবং তাদের সন্তান-সন্ততিদেরকে দ্বীনী ইলম শিখাতে অনিচ্ছুক। মোটকথা নিজেরাও ফরয ইলম শিক্ষা করা থেকে বিরত থেকে জীবনটা নষ্ট করছে, সন্তান-সন্ততিদের জীবনটাও নষ্ট করে ফেলছে। এক্ষণে পরকালের শাস্তি হতে মুক্তি পেতে হলে নিজেদেরকে দ্বীনী ইলম শিক্ষার ফরয আদায় করতে হবে এবং নিজ সন্তানদেরকেও দ্বীনী ইলম শিক্ষার করব আদায় করাতে হবে। সন্তানদেরকে দ্বীনী ইলম শিক্ষা দিলে মৃত্যুর পর কবরে থেকে দোয়া পেতে থাকবে এবং হাশরের মাঠে পুরস্কার স্বরূপ নূরের টুপি এবং রুমাল পাওয়ার আশা আছে।

দ্বীনী ইলম শিক্ষা করতে গিয়ে যদি কেউ মারা যায়, তাহলে তাদের মর্যাদা খুবই উচ্চস্তরে হবে, এ ব্যাপারে পবিত্র হাদীস শরীফে ঘোষণা হয়েছে। হযরত রাসূলে কারীম (সা) ইরশাদ করেন- “ যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলাম তাজা করার জন্য ‘ইলম শিক্ষা করে আর এমতাবস্থায় সে মারা যায়, তাহলে বেহেশতের মধ্যে তার এবং নবীদের মধ্যে কেবল একটি মাত্র স্তরের ব্যবধান হবে।” অর্থাৎ নবুওয়াতের স্তর ব্যতীত সে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবে !

বুখারী এবং মুসলিম শরীফের এক হাদীসে আছে, রাসূল কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন – “মহান আল্লাহ্ পাক যার মঙ্গল বা কল্যাণ কামনা করেন তিনি তাকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। আমি উক্ত ‘ইলম বণ্টনকারী মহান আল্লাহ্ উক্ত ‘আলেমকে তা বুঝার শক্তি দান করেন।”
ইলমে দ্বীন শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলে কারীম (সাঃ) আরও ঘোষণা করেন—“দ্বীনী ইলম শিক্ষা করতে সুদূর চীন দেশে যেতে হলেও সেখানে গিয়ে দ্বীনী ইলম শিক্ষা কর।”

প্রকাশ থাকে যে, শামী কিতাবের ১ম খণ্ডের ৪০ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, শরী’আতের ‘ইলম দু’ভাগে বিভক্ত। যথা ঃ ফিক্কাহ যা শারীরিক ‘ইবাদাত আর তাসাওউফ যা অন্তর পরিশুদ্ধির বিদ্যা। সুতরাং উভয় প্রকার ইলমই প্রয়োজন পরিমাণ শিক্ষা করা ফরয।

নেক আমল বই, ঈমানের বিবরণ

ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোন অদৃশ্য বস্তুতে বিশ্বাস স্থাপন করা। আর পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে দৃশ্যমান এ বিশ্বের মাঝে সকল সৃষ্টি যেমন—জ্বিন মানুষ, গ্রহ-নক্ষত্র, চন্দ্র-সূর্য, জীব-জানোয়ার, সাগর- মহাসাগর, কীট-পতঙ্গ, গাছপালা যা কিছু আমরা দেখতে পাচ্ছি এ সবের পালনকর্তা এবং তার সৃষ্টি সম্পর্কে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। তিনটি বিষয়ের মাধ্যমে ঈমানের প্রতিফলন ঘটে থাকে । যথা ঃ ১। মুখে স্বীকার করা, ২। অন্তরে সে কথা বিশ্বাস করা, ৩। কাজের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা এবং এসব কিছু বাস্তবায়নের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর রিসালাতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা।

কোন লোক যখন (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ) “আল্লাহ্ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।” এ পবিত্র বাক্যটি মুখে উচ্চারণ করল এবং অন্তরেও বিশ্বাস স্থাপন করল, এরপর যথাযথভাবে হুকুমসমূহ সে পালন করল তখনই সে ব্যক্তি মু’মিন হল । আল্লাহ্, রাসূল, ফিরিশ্তা, তাক্বদীর, কিয়ামাত, বেহেশত, দোযখ ইত্যাদি বিষয়াবলী সত্য বলে বিশ্বাস স্থাপন করল এবং সে অনুযায়ী ‘আমল করারও অঙ্গীকার করল, যার মাধ্যমে তার বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তি প্রমাণিত হয়।

কারণ মুখে স্বীকারের সাথে কাজের মিল না থাকলে সেটি নিছক মুখের বুলি মাত্র। কোরআনের পরিভাষায় এটি কালিমা ত্বাইয়্যেবাহ। কালিমা এমন একটি খোদায়ী আহ্বান যা প্রতিটি মু’মিনের জীবনে নিয়ে আসে নিরাপত্তা, স্বস্তি ও প্রশান্তি । ঈমান হল একটি বিরাট গাছের মত । যার শিকড় মাটির নিচে আর শাখা-প্রশাখা সমূহ আকাশে ছড়িয়ে আছে। প্রভুর আদেশে সে সর্বদা তার ফল দিয়েই যাচ্ছে। মূলকথা হল কালিমার সকল ‘আমলই হল ঈমানের দাবি। ঈমানের শাখা-প্রশাখা সত্তরেরও অধিক।

এর মধ্যে সর্বোচ্চটি হল “কালিমা ত্বাইয়্যেবাহ” মুখে উচ্চারণ করা। আর সর্বনিম্নটি হল “কষ্টদায়ক বস্তুসমূহ রাস্তা হতে দূরে সরিয়ে ফেলা।” আর লজ্জাশীলতা হল ঈমানের শাখাসমূহের মধ্যে একটি অন্যতম শাখা। আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং তাঁর আনুগত্যের প্রতি নিজেকে সোপর্দ করার নামই হল অদৃশ্য বিশ্বাস বা “ঈমান বিলগায়েব।”

ঈমান বিলগায়েবের মোটামুটি দু’টি দিক রয়েছে। যথা :
১। নিরাকার, আকৃতি-প্রকৃতিহীন আল্লাহ্র স্বত্ত্বা এবং অস্তিত্বের স্বীকৃতি, তাঁর পবিত্র নামসমূহ এবং গুণাবলীসমূহের স্বীকৃতি। এরপর তাঁর যাবতীয় আদেশ-নিষেধসমূহ মেনে চলার অঙ্গীকার, যাকে বলা হয় “ঈমানে মুজমাল”।

২। (ক) আল্লাহ্র স্বত্ত্বা এবং তাঁর অস্তিত্বে স্বীকৃতি। (খ) সকল ফিরিশতাদের প্রতি স্বীকৃতি। (গ) আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি স্বীকৃতি। (ঘ) রাসূলগণের প্রতি স্বীকৃতি। (ঙ) কিয়ামতের প্রতি বিশ্বাস। (চ) ভাগ্যের ভালো-মন্দ আল্লাহ্ পক্ষ হতে হয়ে থাকে এ কথার প্রতি বিশ্বাস। (ছ) মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত হওয়ার প্রতি বিশ্বাস করা, একে বলা হয় “ঈমানে মুফাচ্ছাল”।

মানুষ তার ইহজীবনের কর্মকাণ্ডসমূহ সম্পর্কে পরকালীন জীবনে জবাবদিহীতার কথাকে স্মরণ করে যাবতীয় কাজ সমাধা করবে। দুনিয়ার জীবনে তাওহীদ, রিসালাত ও ভালো-মন্দের দিকটা আল্লাহ্র দরবারে পেশ করে আখিরাতের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করাই উচিত। মানুষের অন্তরে পরকালীন জবাবদিহীতার গুরুত্ব যদি সম্যকভাবে স্থান না পায় তবে তার জীবন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য ।

ঈমানের কঠিন অগ্নি পরীক্ষা হচ্ছে, আমরা কোন বস্তুকে স্বচক্ষে দেখব না অথচ তার প্রতি আমাদের দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হবে এটি অত্যন্ত দৃঢ় মানসিকতার পরিচায়ক। মহান আল্লাহ্র কুদরতের নিদর্শনাবলী আমাদের সম্মুখে ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয় । যা আমাদেরকে হতাশাগ্রস্ত অবস্থা হতে উদ্ধার করতে পারে।
এতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এবার ঈমানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্বের প্রতি কোরআন এবং হাদীসের কয়েকটি উদ্ধৃতি দেয়া হল ।

জান্নাত প্রাপ্তির জন্য একান্ত শর্ত হল ঈমান। এ ব্যাপারে হাদীস শরীফে রাসূলে কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেছেন – “যার হাতে আমার জীবন সে পাকজাতের কসম, তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।”

অন্য এক হাদীসে রাসূলে কারীম (সাঃ) ইরশাদ করেন – “কাফির ব্যক্তিরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না, আর কোন মু’মিন বান্দা দোযখে প্রবেশ করবে না।”
উল্লিখিত হাদীস সমূহের আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মহান আল্লাহ্ এবং তদীয় রাসূলের উপর যারা আদৌ বিশ্বাস স্থাপন করবে না, তারা কখনও বেহেশতের সুখ-শান্তি ভোগ করতে পারবে না। আর যারা মহান আল্লাহ্ এবং তদীয় রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের নির্দেশিত পথে পরিচালিত হয়েছে, তারা কখনও দোযখের শাস্তি পাবে না। সুতরাং মানব জাতির উচিত তারা যেন মহান আল্লাহ্ এবং তদীয় রাসূলের নির্দেশিত পথে নিজেদের জীবন পরিচালনা করে জীবনকে ধন্য করে।

কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ্ ঘোষণা দিবেন—“হে আমার বান্দাগণ! আজকের এ কঠিন দিনে তোমাদের ভীতসন্ত্রস্ত হবার কোন কারণ নেই। তোমরা যদি আমার নির্দেশাবলীর ওপর আনুগত্য প্রকাশ করে থাক, তাহলে তোমাদের স্ত্রীগণকে নিয়ে আজকের দিনে তোমরা আনন্দের সাথে চির শান্তিময় রমণীয় স্থান বেহেশতের উদ্যানে প্রবেশ কর।”

অন্য আয়াতে আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করেন – “আর যারা ঈমান গ্রহণের পর নেক কাজসমূহ সম্পাদন করেছে তারাই জান্নাতবাসী। উক্ত জান্নাতে তারা চিরস্থায়ীভাবে অবস্থান করবে। মহান আল্লাহ্ অন্য আয়াতে ঘোষণা করেন— “যারা ঈমান এনেছে এবং তার সাথে শির্ক করেনি তারাই সুখ-শান্তি এবং নিরাপত্তার অধিকারী এবং তারাই সৎপথপ্রাপ্ত।”

ঈমান প্রধাণত দু’প্রকার। যথা : ১। ঈমানে মুজমাল (সংক্ষিপ্ত ঈমান) ২। ঈমানে মুফাচ্ছাল (বিস্তারিত ঈমান) নিম্নে এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা করা হল ।

নেক আমল বই, আল্লাহর উপর ঈমান

দৃশ্যমান এ বিশ্বভুবনে অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে যা মানুষের পক্ষে গণনা করা খুবই কষ্টসাধ্য। এসব জীব-জন্তু, গাছ-পালা কে সৃষ্টি করেছেন? কেন সৃষ্টি করছেন? কে তাদের লালন-পালন করেন? এতসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে গবেষক ও সাধু ব্যক্তিগণ মহান আল্লাহ্র অসীম কুদরতের অনেক প্রমাণ ও পরিচয় পেয়ে থাকেন । আল্লাহ্ পরিচয়ের জন্য সাধারণ দৃষ্টিতে আমাদের একান্ত পরিচিত কতিপয় প্রাণীসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই আল্লাহ্র কুদরত ও শক্তির পরিচয় পাওয়া যাবে। এ জন্য সহজ হল, যে ব্যক্তি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করে যে, এক সময়ে (জন্মের পর) যে নিতান্ত অসহায় ছিল।

যার কোনরূপ চলার শক্তি ছিল না, নড়াচড়ার শক্তি ছিল না, সে কথা বলতে পারত না । ধীরে ধীরে সে ছোট্ট শিশুটি বড় হয়ে চলাফেরা করে একদেশ হতে অন্যদেশে ঘুরে বেড়াতে পারে এবং অত্যন্ত বাকপটু হয়ে থাকে। তার এসব কাজের জন্য নিশ্চয়ই একজন পালনকর্তা, ত্রাণকর্তা, মুক্তিদাতা অবশ্যই রয়েছেন। আর তিনিই হচ্ছেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ্ তা’আলা ।

মহান আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্টিজগতের মধ্যে এক বিচিত্র সৃষ্টি হচ্ছে উট। যে মরুভূমিতে কোন প্রাণী টিকতে পারে না অথচ সে মরুভূমিতে বিনা কষ্টে উট চরে বেড়ায় এবং অনেক বড় বড় বালুকাময় মরুভূমিতে মালামালের বোঝা নিয়ে পাড়ি জমায়। এরা নিজের ইচ্ছামত নাকের ছিদ্র বন্ধ করতে এবং খুলতে পারে। মাঝে মধ্যে যখন মরুভূমিতে ধুলির ঝড় আরম্ভ হয় তখন উট নিজেদের নাকের ছিদ্র বন্ধ করে রাখে যাতে করে ধুলা-বালি নাকের ভেতর প্রবেশ করতে না পারে। উটের পিঠে আরোহণ করে মানুষ এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলে যেতে পারে। মহান আল্লাহ্ তাদের পায়ের পাতা খুব নরম তুলতুলে করে দিয়েছেন।

যাতে বালির উপর চলাচল করার সময় তাদের পা আটকিয়ে না যায়। অনেক সময় এরা মরুভূমি পাড়ি দিয়ে ১০/১৫ ঘণ্টা পর্যন্ত পথ অতিক্রম করে থাকে। এ দীর্ঘ সময়ে পানি না পেলে তারা পিপাসায় কাতর হয়ে যায়। মহান আল্লাহ্ এ প্রাণীটির পাকস্থলির পার্শ্বে আলাদা একটি থলে দান করেছেন, উটেরা সে থলের মধ্যে পানি জমা করে রাখে।

মরুভূমিতে চলার সময় কাতর হয়ে গেলে তারা ঐ থলেতে সঞ্চিত পানি হতে পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করে। উট যেমন অনেক বড় ধরণের প্রাণী তেমনি তাদের খাদ্য-খাদকও অনেক বেশি। উটের চোয়াল খুবই শক্ত। এজন্য এরা মরুভূমিতে শক্ত বাবলা গাছের ডালসমূহ বিনাকষ্টে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ পাক উট সম্পর্কে ঘোষণা করে বলেন—“তারা কি দেখে না যে, কত কায়দা কৌশল করে উটকে সৃষ্টি করা হয়েছে?” (সূরা গাশিয়া)

পবিত্র কোরআন শরীফে মহান আল্লাহ্ তা’আলা জন্তু-জানোয়ার সম্পর্কে উল্লেখ করে বলেন, যার সংক্ষিপ্তসার হল – “মহান আল্লাহ্ তা’আলা চতুষ্পদ জীবসমূহকে সৃষ্টি করেছেন। যা হতে তোমরা শীতের বস্ত্র তৈরি করে থাক এবং আরও অনেক উপকার পেয়ে থাক। এসব প্রাণীসমূহ হতে কতকের গোত তোমরা খেয়ে থাক। সন্ধ্যা বেলায় চারণভূমি হতে এসব জন্তুসমূহকে নিরাপদ আশ্রয়ে এনে রাখ। আর সকাল বেলায় যখন আবার সেগুলোকে মাঠে চরানোর জন্য নিয়ে যাও তখনকার সে দৃশ্যটি কতই না সুন্দর দেখায়।

কোন কোন পশু তোমাদের ভারী বোঝাসমূহ এক শহর হতে অন্য শহর-বন্দরে পৌঁছায়ে দেয় অথচ সেখানে পৌঁছতে তোমাদের অনেক কষ্ট হত। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য অত্যন্ত মেহেরবান। তিনি তোমাদের জন্য উট, হাতি, ঘোড়া, ইত্যাদি প্রাণীসমূহ সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা সেগুলোতে আরোহণ করতে পার। আর সেগুলো তোমাদের জন্য সৌন্দর্যের উপকরণও বটে। আর তিনি এমন বহু প্রাণী সৃষ্টি করেছেন, যাদের সম্পর্কে তোমরা কিছুই অবগত নও।”
অসংখ্য, অগণিত পশু-পাখি দ্বারা মানুষ নানাভাবে উপকৃত হয়ে থাকে।

জ্ঞানী লোকদের জন্য এতে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। পাখিরা আকাশে উড়ে বেড়ায়, পাখিদের উড়ার মধ্যেও মহান আল্লাহ্র সৃষ্টির নিদর্শন ও কুদরতের প্রমাণ পাওয়া যায়, এ ব্যাপারে উল্লেখ হয়েছে – “তারা কি তাদের মাথার উপর উড়ন্ত পাখিসমূহকে দেখে না? যে পাখিরা উড়ার সময় ডানা বিস্তার করে থাকে। আবার কখনও ডানা গুটিয়ে থাকে, মহান আল্লাহ্ তা’আলাই ঐ সমস্ত পাখিসমূহকে এভাবে শূন্যে চলার শক্তি দান করেছেন।” (সূরা মূলক)

আর এক ধরনের ক্ষুদ্র জীব মৌমাছি। এদের অস্তিত্ব এবং সাংগঠনিক কার্যাবলী দেখে সত্যিই আশ্চর্য হতে হয়। এসব ছোট্ট মৌমাছিরা দলবদ্ধভাবে বাসা বেঁধে মহান আল্লাহ্র সৃষ্ট বিভিন্ন গাছের পাতা, ফল-ফুলসমূহ হতে রস আহরণ করে বাসায় এনে জমা করে যা মধু আকার ধারণ করে। এরপর এক বিশেষ পদ্ধতিতে নির্দিষ্ট সময়ে ঐ মৌমাছির বাসা কেটে সে মধুর চাকা আহরণ করে পরিশুদ্ধ করে রোগমুক্তির জন্য পান করে থাকে। এছাড়া এ মধু দ্বারা রুটি, ‘আলামীনের কুদরতের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। মুড়ি ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশিয়ে খায়।

এর ভেতরেও মহান আল্লাহ্ রাব্বুল মহান আল্লাহ্ সৃষ্টির সেরা আশরাফুল মাখলুকাতের খিদমতের জন্য ১৮ হাজার মাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন। মানুষ স্বীয় জ্ঞান, বুদ্ধি ও বিবেকের দ্বারা এসব হতে বিভিন্নভাবে নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। যেমন—গাছ-গাছালি, তরু-লতা, শাক-সব্জি ইত্যাদি গাছ-গাছালীতে সুন্দর সুন্দর সুশোভিত বাগান সাজিয়ে রেখেছেন। এসব তরু-লতা ও শাক-সবজিসমূহের কোনটিকে মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ।

আবার কোনগুলো ঔষধ হিসেবে, আবার কোনগুলো দিয়ে কাঠ তৈরি করে বিভিন্ন প্রকারের আসবাবপত্র তৈয়ার করে থাকে । এসবের ভেতরেও মহাপরাক্রম- শালী কুদরত ওয়ালা আল্লাহ্র কুদরতের অসীম নিদর্শন পাওয়া যায়। উল্লিখিত আলোচনা হতে বুঝা গেল যে, আসমান, জমিন, নদী-নালা এবং এসবের মধ্যে যা কিছু বিচরণ করছে এ সবের নিয়ন্ত্রণকারী একমাত্র মহান আল্লাহ্ পাক । আল্লাহ্ এক এবং অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। সুতরাং এতসব শক্তিমান, কুদরতওয়ালা মহান আল্লাহ্ই একমাত্র উপাসনা পাওয়ার যোগ্য, তিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য হতে পারে না ।

এছাড়া বিশ্বভুবনের যেদিকেই তাকাবে সেদিকেই মহান আল্লাহর সৃষ্টিসমূহের নিদর্শন আমাদের সামনে ভেসে ওঠে। পাহাড়-পর্বতে আমাদের চক্ষুর অন্তরালে, জনারণ্যে, সমুদ্রের তলদেশে অসংখ্য জীব-জন্তুর অস্তিত্ব রয়েছে। সেসব প্রাণীরাও নিজ নিজ আহার পাচ্ছে, বংশ বৃদ্ধি করছে, শত্রুর আক্রমণ হতে নিজেদেরকে রক্ষা করছে। একটি ক্ষুদ্র প্রাণীও না খেয়ে থাকে না, সদা-সর্বদাই তাদের প্রতিপালক সৃষ্টিকর্তা তাদের খাদ্য দান করছেন। সারকথা, জীব-জন্তু ছোট হউক কিংবা বড় হউক কেউই আল্লাহ্র রহমত হতে বঞ্চিত নয়।

নেক আমল বই, ফিরিশতাদের উপর বিশ্বাস স্থাপন

মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন মাটি, পানি, আগুন ও বাতাসের সমন্বয়ে মানুষ সৃষ্টি করেছেন । জ্বিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে আগুনের শিখা দিয়ে । আর ফিরিশ্তাগণকে সৃষ্টি করেছেন নূর দিয়ে। আল্লাহ্র সৃষ্টিকুলের মধ্যে ফিরিশতাদের সৃষ্টি একটু ব্যতিক্রমধর্মী। কারণ ফিরিশ্তারা কোন পুরুষও নন আর মহিলাও নন। এনাদের পানাহার, তন্দ্রা, নিদ্ৰা কিছুই নেই ।

সর্বদা এনারা মহান আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন এবং আল্লাহ্র নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন । এনাদের আকৃতি-প্রকৃতি কোন মানুষেরই জানা নেই, এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেন – “মহান আল্লাহ্ তা’আলা ফিরিশ্তাগণকে দু’তিন, চার ডানাবিশিষ্টভাবে সৃষ্টি করে স্বীয় সংবাদ বাহকরূপে নিয়োজিত করেছেন। আবার যখন ইচ্ছা করেন তখন তাদের আকৃতি-প্রকৃতি নিজ ইচ্ছায় পরিবর্তন করে থাকেন।” –সূরা ফাত্বের

ফিরিশ্তাগণের মোট সংখ্যা কত তা একমাত্র মহান আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত আর কেউ জানে না ! দায়িত্ব এবং মর্যাদার দিক দিয়ে সকল ফিরিশ্তা এক সমান নয়। ফিরিশতাগণের মধ্যে চারজন ফিরিশ্তাই সর্বপ্রধান। যেমন – ১। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) ২। হযরত মীকাঈল (আঃ) ৩। হযরত আযরাঈল (আঃ) ও 8 । হযরত ইস্রাফীল (আঃ)। নিম্নে এনাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হল ।

১। হযরত জিব্রাঈল (আঃ) : তিনি এত দ্রুতগতি সম্পন্ন যে, চোখের পলকে শত-সহস্র মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে পারেন। মহান আল্লাহ তা’আলার পক্ষ হতে নবী ও রাসূলগণের নিকট ওহীসমূহ পৌঁছায়ে দেয়াই ছিল তাঁর কাজ । আমাদের প্রিয়নবী হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর নিকট তিনি অসংখ্যবার আল্লাহ্র নির্দেশে এসেছিলেন। এ ব্যাপারে পবিত্র হাদীস শরীফ হতে জানা যায়, হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর একান্ত পরিচিত হযরত দাহিয়াতুল কালবী নামক সাহাবীর আকৃতিতেই বেশির ভাগ আগমন করেছেন।

বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাসেই তিনি বেশির ভাগ রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর দরবারে আসা-যাওয়া করতেন। হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায়, পবিত্র রমজান মাসে হযরত জিব্রাঈল (আঃ) রাসূলে কারীম (সাঃ)-কে এক খতম কোরআন মজিদ পাঠ করে শুনাতেন। আর এক খতম রাসূলে কারীম (সাঃ) জিব্রাঈল (আঃ)-কে পাঠ করে
গুনাতেন।

হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর নিকট হযরত জিব্রাঈল (আঃ) যে ওহী নিয়ে আসতেন তৎকালীন কাফির মুশরিকরা এ কথা বিশ্বাস করত না; বরং তারাও এ ব্যাপারে নানারূপ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। কাফিরদের এরূপ উক্তির জবাবে মহান আল্লাহ্ তা’আলা পবিত্র কোরআনে এর সত্যতা সম্পর্কে ঘোষণা করেন— “হে কাফির অবিশ্বাসীগণ! পবিত্র কোরআন মাজীদকে তোমরা রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর মনগড়া কথা বলে মনে করে থাক। প্রকৃতপক্ষে এটি রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর মনগড়া কথা নয়; বরং তা একজন মহা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন দূতের কথা। উক্ত দূত হযরত জিব্রাঈল (আঃ) অত্যন্ত শক্তিশালী । যিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে ‘আরশে আযীম হতে বাণীসমূহ নিয়ে এসে রাসূলে কারীম (সাঃ)-এর নিকট পৌছায়ে দিয়ে থাকেন।”

২। হযরত মীকাঈল (আঃ) : ইনি মহান আল্লাহ্ পক্ষ হতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। যেমন—(ক) তিনি আকাশ হতে মহান আল্লাহ্র আদেশক্রমে মেঘসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যখন যেখানে মেঘ-বৃষ্টি, ঝড় ইত্যাদি হওয়া দরকার মহান আল্লাহ্র নির্দেশে সে কাজ সমাধা করেন। (খ) মহান আল্লাহ্ তা’আলা কর্তৃক নির্ধারিত রিযিকসমূহ সৃষ্ট জীবের মধ্যে বণ্টন করে থাকেন।

৩। হযরত ‘আযরাঈল (আঃ) : হযরত আযরাঈল (আঃ) মহান আল্লাহ্র পক্ষ হতে আদিষ্ট হয়ে যাবতীয় সৃষ্টিকুলের রূহ কবজ করার দ্বায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। তিনি মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের ‘আরশের নিচে সিদরাতুল মুনতাহা নামক একটি বরই (কুল) গাছের নিচে বসে আছেন, ঐ গাছের পাতায় সমস্ত প্রাণীদের নাম-ঠিকানা সবকিছুই সুন্দরভাবে লেখা রয়েছে। কোন প্রাণীর হায়াত যখন শেষ হয়ে যায়, তখন ঐ বরই গাছের একটি পাতা হযরত ‘আযরাঈল (আঃ)-এর সম্মুখে ঝরে পড়ে। তখন সে নাম-ঠিকানা অনুযায়ী যে প্রাণীর রূহ যেভাবে কবজ করার কথা লেখা থাকবে, ঠিক সেভাবেই কবজ করে থাকেন।

৪। হযরত ইস্রাফীল (আঃ) ঃ ইনি মহান আল্লাহ্র নির্দেশে সিঙ্গা মুখে নিয়ে অপেক্ষা করছেন এবং নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে উক্ত সিঙ্গায় ফুঁৎকার দিলেই কিয়ামাতের ধ্বংসলীলা আরম্ভ হয়ে যাবে। এছাড়া আরও কয়েকজন ফিরিশ্তার দায়িত্ব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করাহল ।

(ক) কিরামান-কাতিবীন বা সম্মানিত লিখকগণ ঃ মানব জাতি এবং জ্বিন জাতিসমূহের দৈনন্দিন জীবনের সকল প্রকার কর্মকাণ্ড লেখার জন্য মহান আল্লাহ্র পক্ষ হতে একদল ফিরিশ্তা নিযুক্ত আছেন। এসব ফিরিশতাদ্বয় মানব ও জ্বিন জাতির প্রত্যেকের দু’কাঁধে নিয়োজিত হয়ে তাদের দৈনন্দিন জীবনের পাপ-পুণ্যসমূহ লিপিবদ্ধ করে রাখেন, যা পরবর্তীতে হাশরের মাঠে মানুষ তাদের কৃতকর্মের ফলাফলরূপে দেখতে পাবে।

(খ) মুনকার এবং নাকীর : এ দু’জন সম্মানিত ফিরিশ্তা মহান আল্লাহর পক্ষ হতে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে কবরবাসীকে প্রশ্নোত্তর করবেন। যে সকল কবরবাসী মুর্দাগণ তাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হবেন তাদের আত্মাকে “ইল্লীয়্যীন” বা সুখময় স্থানে রাখা হবে। আর যারা তাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবে না তাদের আত্মাকে সাত তবক জমিনের নিচে “সিজ্জীন” বা দুঃখময় স্থানে রাখা হবে এবং এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে।

(গ) রুমাত ফিরিশতা : উল্লেখ্য যে, মুনকার ও নাকীর ফিরিশতাদ্বয় কবরে প্রশ্নোত্তর করার জন্য আসার পূর্বে কবরবাসির নিকট “রুমাত” নামক একজন ফিরিশতা আসবেন এ ব্যাপারে হাদীসে উল্লেখ আছে—“হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন— একদা রাসূলে কারীম (সাঃ) আমাকে ডেকে বললেন, হে ইবনে সালাম! জেনে রেখ কবরে মুনকার-নাকীর নামক ফিরিশতাদ্বয়ের পূর্বে “রুমাত” নামক একজন ফিরিশ্তা আসবেন যার চেহারা হবে খুবই আলোকোজ্জ্বল।

তিনি কবরে এসে মুর্দাকে উঠায়ে বসায়ে বলবেন, “হে কবরবাসী! তুমি তোমার জীবনের যাবতীয় কর্মের হিসাব লিপিবদ্ধ কর।” তখন কবরবাসী অজুহাত পেশ করে বলবে যে, কলম কোথায়? কাগজ কোথায় যে আমি এসব লিখে দেব? তখন সে “রুমাত” নামক ফিরিশ্তা বলবেন, তোমার কাফনের কাপড়কে কাগজ, হাতের আঙ্গুলকে কলম এবং মুখের থুথুকে কালিরূপে ব্যবহার কর। আদিষ্ট হয়ে কবরবাসী তার জীবনের সকল পুণ্য কার্যাবলী লিপিবদ্ধ করবে কিন্তু পাপের কথা সে লিখতে চাইবে না। এরপর এক গুনাহরাশি সমূহও লিখবে।

পর্যায়ে ফিরিশতার ধমকে এবং গুরুজের আঘাতে সে কবরবাসী নিজের জীবনের এরপর তাকে বলা হবে, হে কবরবাসী! তোমার হাতের সীল দ্বারা এতে মোহরাংকিত করে দাও। নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে কবরবাসী ভাই করবে। এরপর উক্ত কাপড়খানি মুর্দার গলায় পেঁচিয়ে দিয়ে উক্ত “রুমাত” নামক ফিরিশতা চলে যাবেন। এরপর প্রশ্ন-উত্তরকল্পে মুনকার এবং নাকীর নামক ফিরিশতাদ্বয় কবরে আসবেন।

রিওয়ান ফিরিশতা : বেহেশতবাসীদের যাবতীয় সেবার কাজে ইনি নিয়োজিত রয়েছেন। ইনি বেহেশতের অন্যান্য ফিরিশতাগণের প্রধান হিসেবে যাবতীয় কাজের সমাধান দেবেন।

মালেক ফিরিশ্তা : ইনি দোযখের যাবতীয় শাস্তি দেয়ার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। দোযখের অন্যান্য ফিরিশ্তাগণের প্রধান হিসেবে তিনি যাবতীয় শাস্তি প্রদানের নির্দেশ দেবেন ।

পূর্বেই বলা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ্র অগণিত, অসংখ্য ফিরিশ্তা বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রয়েছেন যাদের নাম কিংবা সংখ্যা কারও জানা নেই ৷ সুতরাং উল্লিখিত গুণাবলীর সাথে সম্পৃক্ত ফিরিশ্তাগণের প্রতিও আমাদেরকে অবশ্যই ঈমান রাখতে হবে। কারণ ফিরিশতাগণের প্রতি ঈমান স্থাপন করাও প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ঈমানের অঙ্গ হিসেবে ফরয ।

নেক আমল বই, আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি বিশ্বাস

মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ পাক দুনিয়ার আদি মানব হযরত আদম (আঃ) হতে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত অসংখ্য নবী ও রাসূলগণকে মানব জাতির হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে যেসব বিধানসমূহ দান করেছেন সেগুলোকে আসমানী কিতাব বলে। পবিত্র হাদীস শরীফের বর্ণনায় সেসব আসমানী কিতাবসমূহের সংখ্যা ১০৪ খানা বলে প্রতীয়মান হয়। এসবের মধ্যে ৪ খানা কিতাব ও বাকি ১০০ খানা সহীফা বলে প্রসিদ্ধ ।

এসব আসমানী কিতাবসমূহের মূল বক্তব্য ছিল মহান আল্লাহ্র একত্ববাদ এবং উল্লিখিত বিধি-বিধানসমূহ মানুষ তাদের স্বীয় বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটায়ে ইহকালীন জীবনে শান্তি ও পরকালীন জীবনে মুক্তি লাভের পথ সুগম করা। সুতরাং যারা এসব বিধি-বিধানসমূহ সঠিকভাবে বিশ্বাস করেছে তাদের

জন্য রয়েছে চির শান্তিময় রমনীয় স্থান বেহেশত উদ্যান, আর যারা এগুলোকে অবিশ্বাস করেছে তাদের জন্য রয়েছে ভীষণ কষ্টদায়ক শান্তির স্থান দোযখের
আগুন । আসমানী কিতাবসমূহের প্রতি তৎকালীন অমুসলিম কাফির সম্প্রদায়ের লোকেরা সন্দেহ প্রকাশ করে এগুলোকে যাদুকরের যাদুক্রিয়া বলে অভিহিত করত। তখন মহান আল্লাহ্ তা’আলা ঐ সকল অমুসলিম কাফিরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ করে ঘোষণা দিলেন – “কোরআনের সূরাসমূহের মত তোমরা নিজেরাও দশটি সূরা রচনা করে হাজির কর এবং এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ্ তা’আলাকে ছাড়া তোমাদের অন্য কোন সহযোগীকে ডেকে নাও।” কিন্তু তৎকালীন আরবের কোন লোক এ চ্যালেঞ্জ মেনে নেয়ার সাহস পেল না।

তখন মহান আল্লাহ্ পুনরায় ঘোষণা করলেন—“হে অবিশ্বাসী কাফির সম্প্রদায়গণ! আমার বান্দা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর আমি যে বাণীসমূহ নাযিল করেছি এতে যদি তোমাদের কোনরূপ সন্দেহ থাকে, তবে তোমরা কোরআনের মত একটি সূরা রচনা কর। নবী মুহাম্মদ (সাঃ) উম্মি হয়ে যদি এমন একটি গ্রন্থ রচনা করতে পারেন বলে তোমাদের ধারণা হয়ে থাকে, তাহলে তোমরাও অনুরূপ একটি সূরা রচনা করে দেখাও দেখি! তোমরাত সকলেই নামকরা বড় বড় কবি-সাহিত্যিক। দশটি সূরার চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম—দশটির প্রয়োজন নেই, একটি মাত্র সূরা রচনা করে দেখাও!” এবারও আরবের কোন লোক অগ্রসর হবার সাহস পেল না ৷

তখন মহান আল্লাহ্ পুনরায় ঘোষণা দিলেন – “যদি তাদের দাবীসমূহ সত্য হয় তাহলে তারা কোরআনের কোন বাক্যের সমতুল্য একটি বাক্য মাত্র রচনা করুক।”
উল্লেখ্য যে, মহান আল্লাহ্র এতসব ঘোষণায় সাড়া দিয়ে তৎকালীন মক্কা-মদীনার অবিশ্বাসী কাফির সম্প্রদায়ের পণ্ডিতরা একটি সূরা তো দূরের কথা, একটি বাক্য পর্যন্ত রচনা করতে পারেনি। অথচ তারা সকলেই তৎকালীন সময়ের খ্যাতিমান পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ হিসেবে পরিচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত কাফিররা এ কোরআনের উপর বিশ্বাস না করলেও একথা স্বীকার করেছে যে, এ কোরআন কোন মানব রচিত গ্রন্থ নয় বরং এটি ঐশী বাণী ।

মহান আল্লাহ্র পক্ষ হতে প্রেরিত ১০৪ খানা কিতাবের মধ্যে পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, ১০০ খানা সহীফা বা ছোট কিতাব। বাকী ৪ খানা বড় কিতাব। নিম্নে এগুলো কোন নবীর উপর নাযিল হয়েছিল তা সংক্ষেপে আলোচনা করা হল ।

১০০ খানা সহিফা যথাক্রমে-
হযরত আদম (আঃ)-এর উপর দশখানা ।
হযরত শীস (আঃ)-এর উপর পঞ্চাশ খানা ।
হযরত ইদ্রীস (আঃ) এর উপর ত্রিশখানা ।
হযরত ইব্রাহীম (আঃ)-এর উপর দশখানা ।

৪ খানা কিতাব যথাক্রমে –
১। তাওরাত : এ আসমানী কিতাবখানা হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর পরিপূর্ণভাবে লিখিত আকারে, সিনাই নামক পর্বতে নাযিল হয়েছিল। হযরত মূসা (আঃ)-এর অনুসারীগণকে বণী ইসরাঈল সম্প্রদায় বলা হয় ।

২। যাবূর ঃ এ আসমানী কিতাবখানা নাযিল হয়েছিল তৎকালীন সময়ের বাদশাহ এবং নবী হযরত দাউদ (আঃ)-এর উপর। পবিত্র হাদীস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে—হযরত দাউদ (আঃ) এত সুন্দর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন যে, যাবূর কিতাব যখন তিনি তিলাওয়াত করতেন তখন পশু-পাখি, জ্বিন-ইনসান এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত তাঁর তিলাওয়াত শুনার জন্য অধির আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করত।

৩। ইঞ্জীল : এ আসমানী কিতাবখানা হযরত ঈসা রুহুল্লাহ (আঃ)-এর উপর নযিল হয়েছিল। তাঁর অনুসারী সম্প্রদায়কে ‘ঈসায়ী বা খ্রিস্টান বলে আখ্যায়িত করা হয় ৷

৪। কোরআন ঃ এ আসমানী কিতাবখানা সর্বশেষ নবী ও রাসূলগণের সর্দার বা সাইয়্যেদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর উপর নাযিল হয়েছিল। এটি সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব বলে খ্যাত। এ পবিত্র কোরআন মাজীদের মধ্যে উল্লেখিত ১০০ খানা সহীফা এবং অন্য তিনখানা কিতাবের মূল বিষয়বস্তুসমূহ বিদ্যমান। এ কিতাবখানা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য তাদের সকল প্রকার বিধি-বিধান এবং সকল সমস্যার সঠিক সমাধান দানকারী একটি নির্ভরযোগ্য কিতাব।

যেসব লোক এ কিতাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এর সর্বময় বিধি-বিধান অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তি জীবন, সামাজিক ও পারিবারিক সর্বক্ষেত্রে পরিচালিত করবে সে সব লোক ইহকালীন জীবনে পরম সুখ-শান্তি এবং পরকালীন জীবনে অনাবিল শান্তির নীড় সুখময় স্থান বেহেশ্ত উদ্যান লাভ করে নির্ভরশীল । ধন্য হতে পারবে। মানব জাতির ইসলামী জীবন-বিধান এ কিতাবের উপরই সকল প্রকার আসমানী কিতাবসমূহকে মহান আল্লাহ্র বাণী হিসেবে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু মহা পবিত্র কোরআন মজীদ অবতীর্ণ হবার পর পূর্ববর্তী সকল কিতাবসমূহের হুকুমসমূহ পালনবিধি রহিত হয়ে গেছে।

এ ছাড়া তাওরাত ও ইনজীল কিতাবের অনুসারীগণ পরবর্তীতে তাদের স্বপক্ষীয় করে তোলার জন্য কিছু কিছু আয়াত পরিবর্তন করেছিল। কিন্তু মহান আল্লাহ্র অশেষ অনুগ্রহে পবিত্র কোরআনকে কেউ পরিবর্তন করতে পারেনি আর কিয়ামত পর্যন্ত চেষ্টা করেও তা পারবে না। কেননা এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন—- “নিশ্চয়ই এ কিতাবের বাণীসমূহ আমি নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণ করব।” সুতরাং যার হিফাযতের দায়িত্ব মহান আল্লাহ্র হাতে ন্যাস্ত তাতে কোনরূপ পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।

উল্লিখিত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হল, আসমানী কিতাবসমূহের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ঈমানী পরিচায়ক হিসেবে প্রতিটি মুসলমানের জন্য একান্ত
ফরয।

নেক আমল বই, রাসূলগণের উপর বিশ্বাস

মানুষ সৃষ্টির সেরা শ্রেষ্ঠ জীব। কিন্তু এ মানব গোষ্ঠীর প্রকাশ্য শত্রু হল বিতাড়িত শয়তান । মানুষ মহান আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগী করবে এটাই সর্বকাল ও সর্বযুগের নিয়ম। কিন্তু চিরশত্রু শয়তান তা কোনমতেই হতে দেবে না। সুতরাং সে বিভিন্নরূপ ধারণ করে এবং প্রলোভন দেখিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করে। মানুষ যাতে বিতাড়িত শয়তানের প্রলোভনে পড়তে না পারে, সেজন্য মহান আল্লাহ তা’আলা মানুষের হিদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন।

নবী-রাসূলগণ মহান আল্লাহ্র পক্ষ হতে কিতাবপ্রাপ্ত হয়ে সে অনুযায়ী লোকদেরকে চলার জন্য নির্দেশ দিতেন। ঐ কিতাবসমূহের মধ্যে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সকল প্রকার বিধি-বিধানসমূহ লিপিবদ্ধ ছিল। নবী-রাসূলগণের চরিত্র ছিল অত্যন্ত নিখুঁত যা সাধারণ মানুষের জন্য অনুকরণীয় ছিল। তাঁদের মন-মানসিকতা ছিল সাধারণ মানুষের জন্য খুবই উদার এবং দয়ায় পরিপূর্ণ। যার কারণে নবী-রাসূলগণ অনেক নির্যাতিত হয়েও মানুষের কল্যাণ এবং তাদের হিদায়াতের জন্য দোয়া করে গেছেন ।

পয়গাম্বরগণের সকলেই মর্যাদার দিক দিয়ে সমান নন। কারো কারো মর্যাদা কারো কারো চেয়ে বেশি ছিল। তবে সবচেয়ে মর্যাদাশালী হলেন আমাদের প্রিয় নবী সাইয়্যেদুল মুরছালীন, যাঁর উপাধি খাতামুন্নাবিয়্যীন। তিনিই দুনিয়ার শেষ নবী, তাঁর পরে আর কোন নবী এ দুনিয়াতে আগমন করবেন না। কারণ কিয়ামত পর্যন্ত যত লোকজন আসবেন তাদের সকলেরও তিনি নবী।

তিনি মহান আল্লাহ্র বাণী পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত বাণীসমূহ নিজ জীবনে প্রতিপালন করে এবং সে অনুযায়ী মানুষ আল্লাহর আদেশসমূহ পালন করার সুবিধার জন্য স্বীয় হাদীসের মাধ্যমে কিয়ামত, হাশর-নশর, বেহেশত-দোযখ ইত্যাদি সকল বিষয়েরই বর্ণনা করে গেছেন। সুতরাং তাঁর অবর্তমানে নায়েবে রাসূলগণ এসব বিষয়াবলি সম্পর্কে লোকদেরকে পথ প্রদর্শন করবেন।

হযরত আদম (আঃ) হতে সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ে একলাখ চব্বিশ হাজার মতান্তরে দু’লাখ চব্বিশ হাজার পয়গাম্বর অবতীর্ণ হয়েছিলেন। নবী-রাসূলগণের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন নবী-রাসূলগণ যথাক্রমে ঃ হযরত আদম (আঃ), হযরত শীষ (আঃ), হযরত নূহ (আঃ), হযরত ইদ্রিস (আঃ), হযরত ইব্রাহীম (আঃ), হযরত ইসমাইল (আঃ), হযরত ইসহাক (আঃ), হযরত ইয়াকুব (আঃ), হযরত ইউসুফ (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), হযরত সুলায়মান (আঃ), হযরত সালেহ (আঃ), হযরত লূত (আঃ), হযরত শুআইব (আঃ), হযরত মূসা (আঃ), হযরত হারুন (আঃ), হযরত উযায়ের (আঃ), হযরত যাকারিয়া (আঃ), হযরত ইয়াহ্ইয়া (আঃ), হযরত হুদ (আঃ), হযরত ইউনুস (আঃ), হযরত ইলিয়াস (আঃ), হযরত জুলকিফল (আঃ), হযরত ঈসা (আঃ) এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ।

উল্লেখ্য যে, সকল নবীগণই মহান আল্লাহর পক্ষ হতে এসেছেন তাই সকল নবীগণের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা ইসলামী পরিচায়ক হিসেবে সকল মুসলমানের জন্য একান্ত ফরয।

Read More

Scroll to Top