1 প্রেমের গল্প | প্রেমের পরশ

প্রেমের গল্প | প্রেমের পরশ

প্রেমের গল্প, আরে মহি তুই?
মহি জি.পি.ও.’র উল্টোদিকের ফুটপাতে একটা কাস্টোমারের নিকট রেডিমেড সার্ট বিক্রি করার সময় অনেক আগের অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে সেদিকে তাকিয়ে অবাক। দোস্ত তুই বলে সালাম বিনিময় করে নোমানকে জড়িয়ে ধরে মিলে বলল, একটু দাঁড়া কাস্টোমারকে বিদেয় করি। তারপর কাস্টোমারের দিকে তাকিয়ে বলল, নেবেন ভাই, সার্টটা?

প্রেমের গল্প | প্রেমের পরশ

কত দাম?
একদাম নব্বই টাকা।
সত্তর টাকায় দেবেন।
না।

কত হলে দেবেন ঠিক করে বলুন।
বললাম তো একদাম-নব্বই টাকা। বেশি দাম চাইলে কম করতে পারতাম। কাস্টোমার সুমনের সঙ্গে তার দুবছরের বড় বোন মিমি ছিল। সে ইংরেজিতে সুমনকে বলল-সী-দেন, আই টোল্ড ইউ টু গো রমনা ভবন, বাট ইউ আর ইন্টারেস্টেড টু পারচেজ ফ্রম ফুটপাত।

নাউ ফেস দা সিচুয়েসান।
তারপর মহির দিকে তাকিয়ে বলল, এই ছোকরা, আর পাঁচ টাকা দিচ্ছি, দিলে দাও। সম্বোধনটা মহি গায়ে মাখল না। মিমির দিকে না তাকিয়েই বলল, আমি দামাদামি করে বেচাকেনা করি না। আপনাদের ইচ্ছে হলে নেন, তা না হলে রেখে দেন।

মহির কথা শুনে মিমি একটু রাগের সঙ্গে সুমনের হাত থেকে জামাটা থাবা মেরে নিয়ে বেতের বাক্সের উপর রেখে বলল, চল, তোকে আমি রমনা ভবন থেকে কিনে দেব। তারা রমনা ভবনে অনেক দোকান ঘুরল। কিন্তু ঐ ডিজাইনের জামা পেল না।

শেষে বেরোবার মুখে একটা দোকানে গেল। দোকানে ফিকস্ট প্রাইস লেখা প্লাস্টিকের বোর্ড
আলমারীর সঙ্গে সাঁটা রয়েছে। সার্টের দাম একশ টাকা দেখে সুমন বলল, দেখলি তো, একই জিনিস এখানে কত বেশি দাম। চল ফুটপাতের ঐ ছেলেটার কাছ থেকে কিনব।

মিমি রাজি হল না। বলল, ফুটপাতে ভালো লোকেরা কেনাকাটা করে না। এখান থেকেই নিই। এদের কাছে তো একটু বেশি দাম হবেই। এদের খরচ কত। সুমন বলল, তা বলে জেনে-শুনে বেশি দিয়ে কিনবি? না, আমি ফুটপাতে ঐ ছেলেটার
কাছ থেকে নেব।

এই জামাটা একই রকমের হলে কি হবে, আমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। মিমি আর কি বলবে, ছোট ভাইয়ের জিদ জানে। ভাবল, যদি জোর করে এখান থেকে কিনি, তবে হয়তো রাগে জামাটা পরবেই না। আজ মিমি ছোট ভাইকে নিজের টাকায় একটা সার্ট কিনে দেবে বলে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে।

অগত্যা তারা আবার মহির কাছে ফিরে আসতে লাগল।কাস্টোমার চলে যেতে মহি নোমানকে বলল, দোস্ত কবে ফিরলি? আমি তোদের বাসায় কিছুদিন আগে গিয়েছিলাম। খালাম্মা বললেন, তুই কয়েকদিনের মধ্যে ফিরবি।

কথা বলতে বলতে মহি তার পাশে দাঁড়ান একজন উগ্র আধুনিকার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নোমানের দিকে তাকাল।
নোমান বলল, এক সপ্তাহ হল ফিরেছি। এসেই পরের দিন তোদের বাসায় দেখা করতে যাব ভেবেছিলাম; কিন্তু মা বলল, আগে বৌ নিয়ে আয়, তারপর যেখানে খুশী যাস।

গতকাল বৌকে নিয়ে এসেছি। কালকে তোদের বাড়িতে সাথে করে নিয়ে গিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেব ঠিক করেছিলাম, তা আর হল না। পাশের মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল, আমার খালাতো বোন নাহিদা। এখন অবশ্য তোর দোস্তের বৌ।

মহি হেসে উঠে বলল, তুই সেই আগের মতো রয়ে গেছিস। বৌকে নিয়েও ইয়ার্কি। নোমান বলল, নিজের বৌকে নিয়ে করব না তো অন্যের বৌকে নিয়ে করব? তারপর নাহিদাকে বলল, আমার জিগরী দোস্ত, মহি। এর কথাই তোমাকে একদিন বলেছিলাম।

নাহিদা হাত তুলে সালাম দিয়ে বলল, একদিন আমাদের বাসায় আসুন না।
মহি তাকে একবার দেখেছে। এখন আর তার দিকে তাকাতে ইচ্ছে করল না। কারণ মেয়েটা যেভাবে কাপড় পরেছে, তাতে করে তার দেহের যৌবন বাহার ফুটন্ত ফুলের মতো প্রস্ফুটিত। নোমানের দিকে তাকিয়ে বলল, যাব।

নোমান বলল, দোস্ত, তুই ইংলিসে অনার্স পেয়েও ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করছিস?
এতদিনেও কোথাও কিছু একটা জোটাতে পারলি না?

এমন সময় মিমি ও সুমন সেখানে ফিরে এসেছে। নোমানের কথা শুনে ভাই-বোনে চমকে উঠে দুজন দুজনের দিকে তাকাল। বলে কি লোকটা? দোকানদার ছেলেটা ইংলিসে অনার্স? মিমি সুমনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, দাঁড়া আরো কি কথা হয় শুনি।

ওরা একপাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগল। মহি বলল, কি করব দোস্ত। এম.এ-টা করার ইচ্ছে ছিল, তাও হল না। এ্যাডমিশান নিয়ে বাসায় ফিরে শুনি আব্বা অফিস থেকে ফেরার সময় লরী চাপা পড়ে মারা গেছেন। তুই তো জানিস, আব্বাই ছিলেন আমাদের সংসারের একমাত্র হাল।

তারপর আমাকেই সেই হাল ধরতে হল। চাকরি যে পাই নি তা নয়, কিন্তু আজকাল চাকরির পয়সায় সংসার চালান যায় না। তা ছাড়া তেমন ভালো চাকরিও পেলাম না। ব্যবসা করার টাকাও নেই। জায়গা কিনে বাড়ি করতে গিয়ে আব্বা অফিস থেকে প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা উঠিয়ে নিয়েছিলেন।

বাড়িটার দোতলার কাজ শুরু করার আগে তিনি মারা গেলেন। মা তার গয়নাগুলো আমার হাতে দিয়ে বললেন, এগুলো বিক্রি করে কিছু একটা ব্যবসা কর। প্রথমে আমি রাজি হই নি। পরে মায়ের বার বার তাগিদে এই ব্যবসায় নেমেছি।

এসব জিনিস আমি বাসাতে কারিগর রেখে তৈরী করে বিভিন্ন দোকানে সাপ্লাই দিই। আর অবসর সময়ে এখানে বেচাকেনা করি। আমার কথা বাদ দে, এবার তোর কথা বল। তুই বিয়ে করলি অথচ আমরা কেউ জানলাম না।

নোমান বলল, এ্যাকসিডেন্টের মতো হঠাৎ হয়ে গেছে। আর বিয়ের তিন দিন পর আমার ফ্লাইট ছিল। তাই কাউকে জানাতে পারি নি। দু’বছর পর ফিরলাম। এবার সবাইকে দাওয়াত দিয়ে একটা ফ্যাংসান করব ভাবছি। মহি বলল, ঠিক আছে, এখন কোথায় যাচ্ছিস যা।

কালকে ভাবিকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসিস। হ্যাঁরে, তোর গাড়ি কোথায়? গাড়ি ছাড়া ভাবিকে নিয়ে বেরিয়েছিস না কি?
নোমান বলল, আর বলিস কেন? শালা গাড়িটা আজ হঠাৎ বিগড়ে গেল, ওয়ার্কসপে দিয়ে এলাম। ভাবছি, এটা বিক্রি করে আর একটা কিনব।

স্কুটারে বায়তুল মোকাররমে যাচ্ছিলাম। তোকে দেখতে পেয়ে নামলাম। এখন চলি, কালকে তোদের বাসায় আসব বলে নোমান স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, এস। ওরা চলে যাওয়ার পর সুমন ও মিমি এগিয়ে এল। সুমন বলল, ঐ সার্টটা দিন।

মহি এক নজর তাদের দিকে তাকিয়ে সার্টটা সুমনের হাতে দিল। সুমন মিমিকে বলল, এই আপা, টাকাটা দিয়ে দে। দু’বছরের ছোট হলেও সে বড়বোনের সঙ্গে তুই তোকারি করে কথা বলে। মিমি এতক্ষণ মহির আপাদমস্তক লক্ষ্য করছিল।

ছেলেটা অর্ডিনারী পোশাকে থাকলেও চেহারার মধ্যে একটা আভিজাত্যভাব দেখতে পেল। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি ও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবীতে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। ভাবল, ছেলেটা ইংলিসে অনার্স পেয়েও ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করছে।

সঙ্গে সঙ্গে কারণটা মনে পড়ল। যা তার বন্ধুকে সে একটু আগে বলেছে। মিমি সুমনের কথা শুনতে পেল না। সুমন আপাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, কি হল রে-টাকাটা দিয়ে দে না।

এবার মিমি সম্বিত ফিরে পেয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে মহির দিকে বাড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আশা করছিল, টাকা নেওয়ার সময় অন্তত ছেলেটা তার দিকে চাইবে। কেন না মহি একবারও মিমির দিকে তাকায় নি।

মহি কিন্তু তার স্বভাব অনুযায়ী মিমির দিকে তাকাল না। টাকাটা নিয়ে বুক পকেট থেকে পার্স বের করে তাতে রেখে একটা দশ টাকার নোট দিয়ে মিমির নিকে বাড়িয়ে ধরল। তখনও সে মিমির মুখের দিকে তাকাল না। আর মিমি মহির মুখের দিকে তাকিয়েছিল।

সেই অবস্থাতেই টাকাটা নিতে গিয়ে মহির হাত ধরে ফেলল। মহি তাড়াতাড়ি হাত টেনে নিতে গেলে টাকাটা মিমির পায়ের উপর পড়ে গেল। এবার মহি মিমির দিকে তাকাতে চার চোখের মিলন হল।

মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। তারপর দুজন একসঙ্গে তাড়াতাড়ি করে টাকাটা তুলতে গেলে মাথা ঠুকাঠুকি হয়ে গেল। টাকা মিমিই তুলল, আর তার বোধ হয় একটু বেশি লেগেছে। তাই সে উহ্ করে উঠে আঘাত পাওয়া জায়গাতে হাত বুলাতে লাগল।

মহি প্রথমে বেশ ভেবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণে সামলে নিয়ে বলল, এক্সট্রিমলি সরি, নট উইলিংলি। প্লীজ, এক্সকিউজ মী।
মিমি কটমট করে কয়েক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর সুমনকে বলল, চল। মহি দেখল, রাস্তা পার হয়ে তারা একটা মার্সিডিজ গাড়ির দিকে যাচ্ছে।

তাদেরকে পেছন থেকে দেখে মহির হাসি পেল। দুজনেরই একই ড্রেস। জিনসের প্যান্ট ও সাদার উপর ডোরাকাটা হাওয়াই সার্ট এবং পায়ে জাগুয়ার কেটস। উভয়ের সার্ট ইন করে পরা। মহির মনে হল ঠিক যেন যমজ ভাই। কাস্টোমারের ডাকে সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বেচাকেনায় মন দিল।

মহির পুরো নাম মহিউদ্দিন। তার বাবা কাসেম সাহেব পশ্চিম বাংলার মেদেনীপুর জেলার লোক। পাকিস্তান আমল থেকে ঢাকায় ডাক বিভাগের ইন্সপেক্টর ছিলেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে বাসাবোয় জায়গা কিনে বাড়ির কাজে হাত দেন।

কিন্তু কমপ্লিট করার আগে আল্লাহপাক তাকে দুনিয়া থেকে তুলে নেন। তিনি খুব ধার্মিক লোক ছিলেন। জীবনে কোনো দিন ঘুষ খান নি এবং অন্য কোনো অসৎ উপায়ে টাকা-পয়সা রোজগারও করেন নি। নিজে যেমন ধর্মের আইন মেনে চলতেন, তেমনি পরিবারের সবাইকেও সেইভাবে পরিচালিত করতেন।

ওঁর তিন ছেলে দু মেয়ে। সকলের বড় ফাতেমা। এস.এস.সি. পাস করার পর তার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপর মহি। মহির ছোট আসিফ। ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসায় আলেম ক্লাসে পড়ে। তার ছোট মোজাম্মেল। লালবাগের হাফেজজী হুজুরের মাদ্রাসা থেকে হাফেজ হয়ে চট্টগ্রাম হাটহাজারি মাদ্রাসার দাখেলের ছাত্র।

সবাইয়ের ছোট আসিয়া। সে ক্লাস এইটে পড়ে। কাসেম সাহেব মারা যাওয়ার পর মহির উপর যখন সংসারের ভার পড়ল তখন সে দুচোখে অন্ধকার দেখল। আব্বা কি করে এতসব খরচ চালাতেন, ভেবে কিছু ঠিক করতে পারল না।

ব্যবসা আরম্ভ করার আগে সে কয়েকটা টিউসনী করত আর চাকরির জন্যে হন্যি হয়ে অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়াত। শেষে সুবিধে মতো জোগাড়া করতে না পেরে মায়ের কথা মতো তার গহনা বিক্রি করে রেডিমেড সার্ট-প্যান্টের ব্যবসায় নেমেছে।

প্রথম কয়েক মাস খুব কষ্টে সংসার চলেছে। এখনও অবস্থা তেমন ফেরে নি। তবে আগের মতো অতটা অভাব নেই। সেদিন বাসায় ফিরে রাতে ভাত খাওয়ার সময় মহি মাকে বন্ধু নোমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা জানাল। আরো জানাল, সে হয়তো বৌ নিয়ে কাল সকালে আসতে পারে।

শুনে তার মা মালেকা বানু বললেন, নোমান বিয়ে করল অথচ আমরা জানতে পারলাম না। তোকে বলেছিল না কি?
না বলে নি। আমিও তাকে সে কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, বিয়েটা হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে হয়েছে। তাই কাউকে জানাবার সময় পাই নি।

যতই তাড়াহুড়ো করে হোক, আমাদেরকে একটা টেলিফোন করেও জানাতে পারত? তা পারত। কেন জানাল না কাল এলে তাকে তুমি জিজ্ঞেস করো। মালেকা বানুর এরূপ বলার কারণ ছিল। নোমান প্রায় প্রতিদিন গাড়িতে করে মহির সঙ্গে আসত।

সে ওদের বাড়ির ছেলের মতো হয়ে গিয়েছিল। মহির ভাই-বোনদের সঙ্গে আপন ভাই-বোনের মতো ব্যবহার করত। মাঝে মাঝে ছুটির দিন সকালের দিকে এসে মহির মাকে বলত, খালাআম্মা, আজ ইন্ডিয়ান খানা পাকান।

তার ইণ্ডিয়ান খানা হল, চালের আটার খুব পাতলা আঁশের মতো বেলন রুটি আর ডিমওয়ালা মুরগির ঝোল। সেদিন সেও মহির সঙ্গে বাজারে গিয়ে এক হালি মুরগি কিনে আনত। কারুর নিষেধ শুনত না। নোমান মালেকা বানুর পেটের ছেলের মতো হয়ে গিয়েছিল।

সেই নোমানের বিয়ের কথা শুনে মনে একটু দুঃখ পেলেন। মহি যখন নটরডেম কলেজে পড়ে তখন নোমানের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়। নোমানের বাবার পুরান ঢাকায় কয়েকটা বাড়ি। উর্দুরোডের একটা চারতলা বাড়িতে থাকে। ওরা এক ভাই এক বোন।

বোনটা বড়। ওর বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে শরীয়তের আইন মোতাবেক তার প্রাপ্য সম্পত্তি বাবদ দুটো বাড়ি মেয়েকে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছেন ভবিষ্যতে একমাত্র ছেলের সঙ্গে যাতে জামাই সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল না করে। মেয়ের বিয়ে দেওয়ার পাঁচ বছর পর তিনি মারা যান।

নোমান তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় পাড়ার খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে ভি.সি.আর. দেখতে শুরু করে। আর সেই সঙ্গে চরিত্রের অবনতি ঘটতে থাকে। কলেজে পড়ার সময় খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশে গোল্লায় যেতে বসেছিল।

মহির আদর্শ চরিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে শুধরে গেছে। বায়তুল মোকাররম থেকে বাসায় ফিরে নোমান স্ত্রীকে বলল, মহি, মানে আমার বন্ধু, যার সঙ্গে ফুটপাতে কথা বলেছিলাম, সে না খুব জিনিয়াস ছেলে। কলেজে ভার্সিটিতে পড়াশুনায়
যেমন নাম ডাক ছিল তেমনি মারামারিতেও।

নাহিদা জিজ্ঞেস করল তোমার বন্ধু বুঝি মারপিট করতে খুব ভালবাসে? কিন্তু দেখে তো সে রকম মনে হল না। মনে হল ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। নোমান বলল, প্রথমে আমরা সবাই তাই মনে করতাম। কিন্তু একদিনের ঘটনায় সকলে ওর আসল পরিচয় পেয়ে যাই।

সেদিনকার সেই ঘটনার পর থেকে আমি ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করি। ঘটনাটা বলছি শোন-
তখন আমার ইন্টারমিডিয়েটের সেকেন্ড ইয়ার। ক্লাসে মজনু নামে একটা বাজে ছেলে ছিল। তার আসল নাম মিলন।

সে মেয়েদের দেখলে তাদের পিছু নিত। ক্লাসের মেয়েদের তো কথাই নেই। কলেজের প্রায় সব মেয়েদের সাথে সে দাপটের সাথে আলাপ করত। ডানপিটে ছেলে বলে কেউ তাকে ঘাটাত না। তাদের মধ্যে সায়রা নামে একটা মেয়ের সঙ্গে তার খুব ভাব ছিল।

আমরা তার সম্বন্ধে কিছু বললে বলত, দেখ, আমার সায়রাকে নিয়ে তোরা কেউ কিছু বলবি না। সায়রা আমার একার। ওকে না পেলে পাগল হয়ে যাব। সেই থেকে ওকে আমরা মজনু বলে ডাকতাম। হঠাৎ একদিন মজনু আমার কাছে পাঁচশো টাকা ধার চায়।

জিজ্ঞেস করলাম, এত টাকা কি দরকার? বলল, দে না বে, কৈফিয়ৎ চাইছিস কেন? আমি কি তোর টাকা মেরে দেব মনে করেছিস? ওর সঙ্গে আমারও কিছুটা বন্ধুত্ব ছিল। মাঝে মাঝে একসঙ্গে স্টেডিয়ামে বল খেলা দেখতাম। বললাম, ঠিক আছে, কাল দেব।

আজ অত টাকা সঙ্গে নেই। বলল, কাল মনে করে আনিস। সামনের মাসের পাঁচ তারিখে দিয়ে দেব। পরের দিন ওকে টাকাটা দিলাম। তারপর চার-পাঁচ মাস হয়ে যেতেও মজনু টাকা ফেরৎ দিল না। চাইবার ইচ্ছে থাকলেও আমি চাই নি।

কিসের জন্যে যেন আমার বেশ কিছু টাকার দরকার হয়। সে সময় মা বাড়িতে ছিল না। বড় মামা এসে তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে নিয়ে গেছে। বাড়ি ভাড়া আমরা অনেক পাই। সব টাকা ব্যাংকে মায়ের একাউন্টে জমা থাকে। দরকার মতো মা তোলে।

আমার তখন কোনো একাউন্ট ছিল না। মা আমাকে যা দিয়ে গিয়েছিল তাতে হবে না। হঠাৎ মজনুকে যে টাকা দিয়েছিলাম, সে কথা মনে পড়ল। পরের দিন কলেজে মজনুর কাছে টাকাটা ফেরৎ চাইলাম। সে তখন রেগে-মেগে বলল, কিসের টাকা?

আমি তোর কাছ থেকে কোনো টাকা নিই নি। শুনে আমি তো অবাক। বললাম, সে কিরে? সামনের মাসের পাঁচ তারিখে ফেরৎ দিবি বলে চার-পাঁচ মাস আগে আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা ধার নিলি। আর এখন বলছিস টাকা নিস নি?

মজনু আরো উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে বলল, গুল মারার আর জায়গা পাস নি। বক্সিং মেরে তোর নাক-মুখের নকশা পাল্টে দেব। শালা চালাকি পেয়েছিস। মজনুর চিৎকার শুনে ওর কয়েকজন গুণ্ডা ধরনের বন্ধু এবং কলেজের অনেক ছেলে এসে সেখানে দাঁড়াল।

তাদের মধ্যে সামাদ মজনুর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সব সময় দু’জনে মানিক জোড়ের মতো থাকে। সে এগিয়ে এসে আমাকে বলল, এই যে চাঁদ, ভালই ভালই কেটে পড়। নচেৎ মজনু যা বলল তাই হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে, আমি প্রিন্সিপ্যালের কাছে বিচার দেব।

যেই না বলেছি, অমনি মজনু ও সামাদ আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বেদম মারতে লাগল। অন্যান্য ছেলেরা হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল। কেউ তাদেরকে বাধা দিতে এগোবার সাহস করল না।

আমি যখন মার খেতে খেতে মাটিতে পড়ে গেছি, ঠিক সেই সময় ঐ মহি এসে দু’জনকে ধরে আচ্ছা করে ধোলাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে প্রিন্সিপ্যালের রুমে নিয়ে গিয়ে বলল, স্যার, এরা নোমানকে মেরে প্রায় অজ্ঞান করে ফেলেছে।

আমি তাকে নিয়ে আসছি। তারপর আমাকে পাঁজাকোলা করে প্রিন্সিপালের কাছে নিয়ে গেল। আমার তখন নাক মুখ দিয়ে রক্ত পড়ছে। আমার রক্ত মহির জামা-কাপড়ে লেগে গেল। ততক্ষণে অন্যান্য অধ্যাপকরা সেখানে এসেছেন।

আমার মুখে সবকিছু শুনে প্রিন্সিপাল তাদেরকে কলেজ থেকে নাম কেটে বের করে দিলেন। সেদিন মহি আমাকে মেডিকেলে নিয়ে ফার্স্ট-এড করিয়ে বাসায় পৌছে দেয়। আমি পনের দিন কলেজে যেতে পারি নি।

তারপর যেদিন কলেজে গেলাম সেদিন মহিকে বললাম, তুমি যদি ঐদিন ঠিক সময় মতো না আসতে, তা হলে ওরা আমাকে মেরে ফেলতো। তোমার ঋণ আমি কোনো দিন শোধ করতে পারব না। একটা অনুরোধ করব রাখবে?

মহি কিছু বলার আগে আবার বললাম, মা তোমাকে আজ আমার সঙ্গে যেতে বলেছে? আর আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাই। মহি বলল, তোমার মা যখন ডেকেছেন তখন যাব। কিন্তু আমার সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব করা কি ঠিক হবে?

তুমি হলে বড়লোকের ছেলে। তা ছাড়া ইসলামের দৃষ্টিতে বন্ধুত্ব তার সঙ্গে করা উচিত যে ধার্মিক। আমি বললাম, তা হলে তো আমার প্রস্তাব ঠিক। মহি বলল, একজন চাইলে তো হবে না, দু’জনকে চাইতে হবে। বললাম, তুমি চাইছ না কেন?

মহি বলল, তোমাকে তা হলে আমার মতো ধর্মের আইন-কানুন মেনে চলতে হবে। বললাম, ঠিক আছে তাই হবে।
তারপর থেকে আমরা ক্রমশ গভীর বন্ধুত্বে আবদ্ধ হয়ে পড়ি। শেষে আমাদের সম্পর্ক এমন হয়ে গেল, একদিন আমি ওদের বাসায় থাকতাম আর একদিন ও আমাদের বাসায় থাকত।

ওর সঙ্গে মিশে আমিও তখন ঠিকমতো নামায রোযা করতাম। ও আমাকে কুরআন শরীফ পড়া শেখাল। আমি ওর মাকে খালাআম্মা বলতাম। কিন্তু উনি কোনো দিন আমার সামনে আসেন নি। রুমের বাইরে দরজার পাশ থেকে আমার সঙ্গে কথা বলতেন।

খালাআম্মার মুখ আমি কোনো দিন দেখি নি। মাঝে মাঝে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছি, দারুণ ফর্সা। ওরা খুব গোঁড়া। মহির বড় বোন ফাতেমা বোরখা পরে স্কুলে যেত। আজ তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে মহি নিশ্চয় আমার উপর খুব রাগ করেছে এবং দুঃখ ও পেয়েছে।

আপটুডেট মেয়েদের মহি একদম দেখতে পারে না। বলতো, ওদের দেখাদেখি অন্যান্য মেয়েরা ঐদিকে ঝুঁকে পড়ছে। কালকে ওদের বাসায় যাওয়ার সময় তুমি কিন্তু বোরখা পরে যাবে।

নাহিদা বলল, গতকাল যখন ওর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তখন তুমি যদি একটু ইশারা করে দিতে, তা হলে স্কুটার থেকে নেমে কাপড়টা ঠিক করে গায়ে মাথায় দিতাম। নোমান বলল, তাই করা উচিত ছিল।

বাসায় ফিরে মিমির আজ কিছু ভালো লাগল না। কেবলই ফুটপাতের সেই ছেলেটার কথা মনে পড়ছে। ইংলিসে অনার্স হয়েও ছেলেটা ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করছে, এটা মিমি ঠিক মেনে নিতে পারছে না। কি সুন্দর ছেলে।

টকটকে ফর্সা মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে তাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। মাঝারি গড়নের একহারা পেটাই শরীর। হয়তো ব্যায়াম-ট্যায়াম করে। ভাবল, ড্যাডীকে বলে তার অফিসে একটা কাজ জুটিয়ে দিলে কেমন হয়?

যেই ভাবা সেই কাজ। সে ড্যাডীর কাছে গিয়ে তার গলা জড়িয়ে বলল, তোমার অফিসে একটা চাকরি দিতে হবে। হানিফ সাহেব মেয়ের কথা শুনে হেসে উঠে বললেন, কাকে চাকরি দেব?
আগে তুমি বল, দেবে?

আদুরে ও জেদী মেয়েকে পাশে বসিয়ে বললেন, যাকে চাকরি দেব, সে উপযুক্ত কিনা তা না জেনে কি করে তোকে কথা দিই? একটু বুঝতে চেষ্টা কর। আমি বুঝি, সে কথা না জেনে তোমাকে বললাম।

হানিফ সাহেব একটা ভিজিটিং কার্ড মেয়ের হাতে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে, এই কার্ডটা তাকে দিয়ে অফিসে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলিস। থ্যাংক ইউ ড্যাডী বলে মিমি কার্ডটা নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

হানিফ সাহেব একজন বিজনেস ম্যাগনেট। ধানমণ্ডিতে ছতলা বাড়ি। মতিঝিলের হানিফ ম্যানসন নিজের বিল্ডিং এর সাত তলায় বিরাট অফিস। তাঁর দু’ মেয়ে এক ছেলে। বড় মেয়ে জুলি এম.এ. পড়ার সময় শাহিন নামে একটা ছেলেকে ভালবেসেছিল। ছেলেটা খুব ধার্মিক।

ইসলামি স্টাডিতে অনার্স করছে। দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি পড়াশোনায়ও স্কলার। ভার্সিটির সামনের মাঠে একদিন শাহিন অনেক ছেলে-মেয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কুরআন-হাদিস ও হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর জীবন চরিত থেকে কিছু কথা বলছিল।

সেখান দিয়ে জুলি যাওয়ার সময় শাহিনের মিষ্টি গলার স্বর শুনে কি বলছে জানার জন্য দাঁড়ায়। শাহিনের সুন্দর স্বাস্থ্য ও লাবণ্যময় মুখের দিকে তাকিয়ে এবং কথা শুনে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। আল্লাহপাক কখন কোন অসিলায় কাকে হেদায়েত করেন তা কেউ জানে না।

জুলিরও তাই হল। ঐদিনের পর থেকে সে শাহিনের কাছে মাঝে মাঝে গিয়ে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা ও রাসূল (দঃ)-এর আদর্শ চরিত্রের কথা শুনত। কখনো কখনো ছুটির পর ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিশদ আলোচনা ঘন্টার পর ঘণ্টা করত।

ফলে সে ইসলামকে জানতে পেরে সেই ভাবধারায় চলার প্রেরণা পেল এবং ক্রমশ তারা নিজেদের মনের অজান্তে দু’জন দুজনকে ভালবেসে ফেলল। শাহিন কিন্তু নিজেকে খুব সংযত রাখল। তার মনের খবর জুলিকে একদম জানতে দিল না।

পরীক্ষার পর একদিন শাহিন যখন জুলিকে বলল, রেজাল্ট বেরোবার পর আমি উচ্চ শিক্ষা নিতে মিসর যাব। তখন জুলি কথাটা শুনে নিজেকে সামলাতে পারল না। ছলছল নয়নে বলল, ইনশাল্লাহ নিশ্চয় যাবে। কিন্তু আমার কোনো ব্যবস্থা না করে গেলে আল্লাহপাকের কাছে তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে।

জুলির কথা শুনে শাহিন মোটেই আশ্চর্য হল না। কেন না, অনেকদিন থেকে জুলির কথাবার্তা, চাল-চলন ও তার চোখের দৃষ্টি তাকে সবকিছু জানিয়ে দিয়েছিল। তবু বলল, আরো কিছু দিন চিন্তা করে দেখা উচিত। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি কি আমার সম্পূর্ণ পরিচয় জান?

পরিচয় বলতে তুমি যা বোঝাতে চাচ্ছ তা জানি না। তবে যেটুকু জেনেছি তার বেশি কিছু আমার জানার দরকার নেই। আর চিন্তা করার কথা যে বলছ তাও আমি করেছি। এখন আর আমার কোনো কিছু জানার বা চিন্তা করার নেই।

তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দেবে না? পরে একদিন দেব। আজ আমাদের বাসায় চল আব্বা-আম্মার সঙ্গে পরিচয় করে আসবে। জুলি কোনো কথা না বলে সেদিন শাহিনের সঙ্গে তাদের বাসায় গেল। বাসা দেখে জুলি খুব অবাক হল। বিশাল বাড়ি।

কত লোকজন। দোতলায় উঠে দু-তিনটে রুম পার হয়ে একটা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শাহিন আম্মা বলে ডাকল। একটু পরে একটা সুমিষ্ট মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে এল, কে শাহিন? ভিতরে আয়।

শাহিন জুলিকে নিয়ে ঘরে ঢুকে সালাম দিয়ে মায়ের সামনে গিয়ে বলল, দেখতো আম্মা, মেয়েটাকে তোমার পছন্দ হয় কিনা?
রাবেয়া খাতুন সালামের জওয়াব দিয়ে জুলির দিকে কয়েক সেকেও চোখ বুলিয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন, একে পেলি কোথায়?

এযে আমার সাক্ষাৎ মা। তারপর জুলিকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?
জুলেখা, ডাক নাম জুলি।
কি আশ্চর্য! হ্যারে শাহিন, তোর নানীর নামও যে জুলেখা।

জুলি রাবেয়া খাতুনের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল।
রাবেয়া খাতুন জুলিকে জড়িয়ে ধরে মাথায় ও কপালে চুমো খেয়ে দো’য়া করলেন, ‘আল্লাহপাক তোমাকে সুখী করুন। তোমার হায়াৎ দারাজ করুন।’ তারপর শাহিনকে বললেন, কুলসুমকে ডেকে দিয়ে তোর আব্বাকে এখানে আসতে বল।

শাহিন বেরিয়ে যেতে জুলিকে পাশে বসিয়ে তার পরিচয় জানতে লাগলেন। একটু পরে শাহিনের আব্বা আকবর সাহেব স্ত্রীর রুমে ঢুকে জুলিকে দেখে দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।

রাবেয়া খাতুন মৃদু হেসে বললেন, দাঁড়ালে কেন, দেখ না, শাহিন কাকে নিয়ে এসেছে? ভালো করে দেখতো, আম্মাকে চিনতে পার কি না?

আকবর সাহেব এগিয়ে এসে একটা সোফায় বসে বললেন, ঠিকই বলেছ, শাহিনের নানীর মতো দেখতে। তারপর জুলির পরিচয় জেনে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন। জুলি তার সামনে এসে কদমবুসি করল।

আকবর সাহেব দো’য়া করে বললেন, যখন মা হয়ে এসেছ তখন ছেলে-মেয়েকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেও না। তারপর স্ত্রীকে বললেন, আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে। তুমি আম্মাকে কিছু মিষ্টি মুখ করাও।

তিনি চলে যাওয়ার পর কাজের মেয়ে কুলসুম এলে তাকে রাবেয়া খাতুন বললেন, শিগগীর কিছু মিষ্টি নিয়ে এস।
নাস্তার সময় রাবেয়া খাতুন জোর করে কয়েকটা রাজভোগ খাওয়ালেন। জুলি আপত্তি করতে বললেন, মেয়ের অত্যাচার মাকে সহ্য করতে হয়।

জুলি খুব আশ্চর্যবোধ করতে লাগল। ভাবল, আমি কি সত্যিই শাহিনের নানীর মতো দেখতে। একসময় শাহিন এসে মাকে বলল, এবার ওকে দিয়ে আসি। রাবেয়া খাতুন বললেন, আজ প্রথম এসেছে বলে যেতে দিচ্ছি। পরের বার এলে যেতে দেব না।

তারপর জুলিকে বললেন, মেয়ের কথা মনে করে আবার এস। জী, আসব বলে জুলি বিদায় নিয়ে ফেরার পথে শাহিনকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি তোমার নানির মতো দেখতে? শাহিন বলল, আম্মাতো তাই বলল। আমি যখন খুব ছোট্ট তখন নানী জান্নাতবাসী হন।

আচ্ছা, তোমাদের বাড়িতে অতসব লোকজন, ওরা কারা? ওরা সব আমাদের আত্মীয়। কত আসছে কত যাচ্ছে তার হিসেব আমি রাখি না। সেদিন শাহিন জুলিদের বাসায় গেল।
জুলি বাবা-মার সঙ্গে বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিল।

হানিফ সাহেব কিছু বললেন না।
শাহিন চলে যাওয়ার পর মাহিলা খাতুন মেয়েকে অনেক প্রশ্ন করলেন। শেষে বললেন, তোর রুচিতে বাধল না, একটা মোল্লা ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করলি? সেদিন তিনি বেশি কিছু আর বললেন না।

কিন্তু পরে যখন শাহিন আরো কয়েকবার এল এবং মেয়েকে ক্রমশ ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখলেন তখন অনেক রাগারাগি করলেন। বললেন, আমি ঐ ধরনের ছেলেদের মোটেই পছন্দ করি না। ওরা ধর্মের ব্যাপারে খুব গোঁড়া।

আর একটা কথা জেনে রাখ, দাড়িওয়ালাদের বুদ্ধি-সুদ্ধি কম। জুলিও মায়ের সঙ্গে এই নিয়ে মাঝে মাঝে তর্কাতর্কি করেছে।
হানিফ সাহেব মধ্যস্থতা করতে চেয়েছেন। কিন্তু মা-মেয়ে কেউ তার কথায় কর্ণপাত করে নি। এভাবেই চলছিল।

কয়েক মাস পরে রেজাল্ট বেরোবার পর শাহিন মিসর যাওয়ার কথা জুলিকে জানিয়ে বলল, আমি যাওয়ার আগে তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি কিছু বলবে?

জুলি বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? বারে তোমার মা-বাবাকে বলতে হবে না?
না।
মানে?

মানে আবার কি? তাদেরকে বলার দরকার নেই।
কারণটা জানতে পারি?
তারা তোমাকে পছন্দ করে না?
তবুও জানান দরকার।

শাহিন তুমি আমার মাকে চেন না। জানালে গোলমাল করে বসবে। তার চেয়ে এক কাজ করি এস। আমরা গোপনে কাজি অফিসে কাজটা সেরে ফেলি।

কথাটা অবশ্য মন্দ বল নি। ঠিক আছে তাই হবে। তবু আমি তাদেরকে জানাবার অনুরোধ করছি। ভেবে দেখো। তারপর আবার বলল, আমি সময় মতো তোমাকে জানাব। মিসর যাওয়ার ব্যাপারে কিছুদিন শাহিন খুব ব্যস্ত ছিল।

পাকা ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পর শাহিন একদিন ভার্সিটিতে জুলির সঙ্গে দেখা করে বলল, আগামীকাল তুমি নয়াপল্টন কাজি
অফিসে বেলা এগারটার সময় আসবে। আমি থাকব।
জুলি বলল, আসব।

সেদিন রাতে জুলি শাহিনের কথা রাখার জন্যে মা-বাবাকে বিয়ের কথাটা জানাল। হানিফ সাহেব কিছু বলার আগে মাহিলা খাতুন চিৎকার করে উঠলেন, আমি কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেব না। ছিঃ ছিঃ শেষকালে তুই একটা দাড়িওয়ালা মোল্লা ছেলেকে ……. ভাবতেও পারছি না।কি করতে এম.এ. পড়ছিস? সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছিস? তুই যে কালচার ও সোসাইটিতে মানুষ, তার সঙ্গে

ওদের কোনো মিল নেই। ওরা এসবের ঘোর বিরোধী। চিরদিন তোকে পস্তাতে হবে। অনুশোচনায় সারাজীবন পুড়বি। ওরা পরের দয়ায় বেঁচে থাকে। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, যাদের কাছে সুখ শুধু স্বপ্ন, তাদের ঘরে গিয়ে অভাব-অনটন, দুঃখ-কষ্ট ছাড়া আর কি পাবি?

তোর গর্ভধারিণী মা হয়ে বলছি, ওসব খেয়াল ছাড়। বাবা-মা কোনো দিন সন্তানের অমঙ্গল কামনা করে না। তুই তাকে ভালবাসিস বলে তার দোষগুলো এখন চোখে ধরা পড়ছে না। বিয়ের পর যখন বাস্তব জীবনে ঢুকবি তখন সেগুলো দেখতে পাবি।

আর বুঝবি থিওরিটিক্যাল ও প্রাকটিক্যালের মধ্যে কত তফাৎ। বলাবাহুল্য, জুলি শাহিনদের বাসায় গিয়ে তাদের অবস্থা বুঝতে পারলেও তার মা-বাবা জানত না শাহিনরা কত বড় ধনী। কেন না শাহিন খুব সাধারণ জীবন যাপন করত।

তার মধ্যে বড়লোকের ছেলের কোনো কিছু দেখা যেত না। তাই অনেকেই তাকে গরিব ঘরের ছেলে মনে করত।
জুলি মাকে বাধা দিয়ে বলল, তুমি থামোতো মা। শাহিন ধনী না গরীবের ছেলে তা জেনেও বলব না।

তোমাদের এই বড়লোকি আভিজাত্য আর আধুনিকতা আমার ভালো লাগে না। আর তোমাদের এই কালচার ও সোসাইটিকে আমি ঘৃণা করি। আমি লেখাপড়া করছি। কচি খুকিও নই, আর অবোধ বালিকাও নই। ধন-দৌলত ও আভিজাত্যের অহংকারে তোমরা
অন্ধ হয়ে গেছ।

গরিবদেরকে মানুষ বলে গন্য কর না। ধন ও আভিজাত্যের অহংকারে নিজেদের পরিচয়কেও ভুলে গেছ। সেই সঙ্গে সৃষ্টিকর্তাকেও ভুলে গেছ। আমাকে তোমরা জ্ঞান অর্জনের জন্যে স্কুল-কলেজে পড়িয়েছ এবং আরও উচ্চশিক্ষা লাভ করার জন্যে ভার্সিটিতে
পড়াচ্ছ।

এখন যদি আমি সেই জ্ঞান অর্জন করে সৃষ্টিকর্তার পরিচয় পেয়ে ধনী-গরীবের ভেদাভেদ না করে জ্ঞানকে বাস্তবায়ন করতে চাই, তা হলে তোমরা তাতে বাধা সৃষ্টি করছ কেন?

মাহিলা খাতুন বিদ্রূপ কণ্ঠে বললেন, একটা মোল্লাকে বিয়ে করে বুঝি জ্ঞানের বাস্তবায়ন করতে চাস? জুলি বলল, তুমি ঠিক বলেছ মা, মোল্লাকে বিয়ে করেই আমি সেই জ্ঞানের বাস্তবতা প্রথম দেখাতে চাই। সেই জ্ঞানের দ্বারা আমি জেনেছি, সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক বলিয়াছেন, ‘টাকা-

পয়সা বা উচ্চ বংশের অধিকারী হলে সে উচ্চ নয়? যদি সে ধর্মীয় গুণে গুণান্বিত না হয়।’ তিনি আরো বলিয়াছেন,-‘সেই ব্যক্তি ইহজগতে ও পরজগতে উচ্চ সম্মানের অধিকারী, যে ব্যক্তি আল্লাহকে অধিক ভয় করে তাঁর ও তাঁর হাবিবের (সঃ) প্রদর্শিত পথে চলে।’

আর বার বার তুমি মোল্লা মোল্লা করছ কেন? মোল্লারা যদি এতই খারাপ, তবে বিয়ে পড়ান, লাশের দাফন-
কাফন ও মুরুব্বীদের নামে কুরআন খানির সময় তাদেরকে ডাকা হয় কেন? সেই সময় তাদেরকে এত সম্মান দেখাও কেন?

তারপর জুলি আবার বলল, তোমরাতো এসব বুঝবে না। আর বুঝলেও স্বীকার করবে না। তোমরা যা খুশী কর আর ভাব, আমাদের বিয়ে কালকে কাজি অফিসে হবেই ইনশাল্লাহ। কথা শেষ করে সে নিজের রুমে চলে গেল।

জুলি চলে যাওয়ার পর মাহিলা খাতুন স্বামীকে বললেন, শুনলে তোমার গুণধর মেয়ের কথা? হানিফ সাহেব বললেন, তুমি অত উত্তেজিত হচ্ছ কেন?

আমি উত্তেজিত হচ্ছি কেন? এদিকে যে মেয়ে কালকে বিয়ে করতে যাচ্ছে, সে কথা ভেবে দেখেছ? তোমার দ্বারা কিচ্ছু হবে না। তুমি শুধু তোমার বিজনেস নিয়ে থাক। তারপর তিনি রাগে ফুলতে ফুলতে সেখান থেকে চলে গেলেন।

পরের দিন বেলা দশটার সময় জুলি যখন কাপড়-চোপড় পরছিল তখন মাহিলা খাতুন তার ঘরের দরজা আটকে দিয়ে বললেন, আমিও দেখব, কেমন করে ঘরের বাইরে যাস। মা যে এ রকম করবে, জুলি তা স্বপ্নেও ভাবে নি। কয়েকবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে মাকে দরজা খুলে দিতে বলল।

মাহিলা খাতুন বললেন, যতদিন না তুই মত পাল্টাবি, ততদিন তোকে এই রুমের মধ্যে থাকতে হবে। জুলি মহা ফাঁপরে পড়ে গেল। এদিকে শাহিন কাজি অফিসে এসে অপেক্ষা করবে। দরজা খুলে দেওয়ার জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করল।

কোনো কাজ হল না। শেষে কি করবে না করবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। মাহিলা খাতুন এক মন্ত্রীর ভাইজী। তার আগে একবার সাবের নামে একজন বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। তিনি ছিলেন ধার্মিক লোক।

মাহিলা খাতুন ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে। স্বামীর অমতে বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে ইচ্ছামতো মেলামেশা করতেন। ক্লাবে যেতেন। সাবের সাহেব জানতে পেরে প্রথমে এ রকম করতে বুঝিয়ে নিষেধ করেন। এর সুফল- কুফলের কথা বলে সংযত জীবন যাপন করতে বলেন।

কিন্তু তিনি স্বামীর কথা মেনে নিতে পারেন নি। শেষে সাবের সাহেব তার স্বাধীনতার উপর কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করেন। ফলে তাদের দাম্পত্য জীবনে ফাটল শুরু হয়। শেষমেস ডিভোর্সের মধ্যে দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। ততদিনে জুলি জন্মেছে।

কোর্টে রায় হয়-জুলি এখন দুগ্ধপোষ্য, তাই সে তার মায়ের কাছে থাকবে। যতদিন সে থাকবে ততদিন সাবের সাহেব তার খোরপোষ দেবেন। তারপর জুলি আড়াই বছরের হলে সাবের সাহেব মেয়েকে নিয়ে আসবেন। এই ঘটনার দু’বছর পর সাবের সাহেব মারা যান।

যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি প্রতিমাসে দু’হাজার টাকার চেক মাহিলা খাতুনের ঠিকানায় পাঠিয়েছেন। কিন্তু মাহিলা খাতুন সে টাকা কোনো দিন নেন নি। সাবের সাহেব মারা যাওয়ার পর তার আত্মীয়েরা কেউ আর জুলির খোঁজ-খবর নেয় নি।

আরো বছর খানেক পর এক পার্টিতে মাহিলা খাতুনের সঙ্গে হানিফ সাহেবের পরিচয় হয়। মাহিলা খাতুনের রূপে তিনি মুগ্ধ হন। কিছুদিন পর হানিফ সাহেব তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মাহিলা খাতুনও হানিফ সাহেবকে পছন্দ করে ফেলেছেন।

বিয়ের কথা শুনে পূর্বের সব ঘটনা বললেন এবং প্রাক্তন স্বামীর একটা মেয়ে আছে তাও জানালেন। হানিফ সাহেব বললেন, আমি অবশ্য আগে কিছু কিছু শুনেছি। জেনে-শুনেই প্রস্তাব দিয়েছি। জুলির কথা চিন্তা করেছেন?

করেছি। জুলিও তোমার সঙ্গে আমার বাড়িতে আসবে। আমি তাকে মেয়ের মতো মানুষ করব।
তারপর দু’মাসের মধ্যে হানিফ সাহেবের স্ত্রী হয়ে জুলিকে নিয়ে মাহিলা খাতুন বাসায় আসেন এই পূর্ব স্বামীর অভিজ্ঞতায় মাহিলা খাতুন জুলির বিয়ে মৌলভী টাইপের ছেলের সঙ্গে দিতে একদম নারাজ।

ঐদিন শাহিন বেলা তিনটে পর্যন্ত কাজি অফিসে অপেক্ষা করে সাড়ে তিনটের সময় জুলিদের বাসায় এল। এর মধ্যে কাজি অফিস থেকে জুলিদের বাসায় কয়েকবার ফোন করেছে। ফোনে জুলির কথা জিজ্ঞেস করলেই যে ফোন ধরে সে কোনো কথা না বলে ছেড়ে দেয়।

শেষে বেশ কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে রিং করল। ওদিকে রিসিভার তোলার সঙ্গে শাহিন বলল, আমি বেগম হানিফের সঙ্গে কথা বলতে চাই।
মাহিলা খাতুন বললেন, আপনি কে বলছেন?

শাহিন।
স্টুপিড।
শাহিন কিছু বলার আগেই রিসিভার রাখার শব্দ পেল। শেষকালে কোনো উপায় না পেয়ে ওদের বাসায় রওয়ানা দিল। তার দৃঢ় ধারণা হল, নিশ্চয় জুলির কোনো বিপদ হয়েছে।

এদিকে এক সপ্তাহ পর তার ফ্লাইট। কাজি অফিসে বিয়ে করে জুলিকে তাদের বাড়িতে এই ক’দিন রাখবে বলে তাকে বলেছিল। তারপর মিসর যাওয়ার পর সে তার সুবিধে মতো যেখানে ইচ্ছা থাকবে।

শাহিন যখন জুলিদের বাসায় পৌঁছাল তখনও তার বাবা অফিস থেকে ফেরেন নি। মাহিলা খাতুন শাহিনকে দেখে রাগে ফেটে পড়লেন। বললেন, এখানে কেন এসেছ? বেরিয়ে যাও। এতবড় সাহস তোমার? জান, তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে জেলে পাঠাতে পারি?

জুলিকে সহজ সরল দেখে ভুলিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলেছ। মৌলভীরাও যে প্রেম করে জানতাম না। তারা তো এগুলোকে হারাম বলে ওয়াজ-নসীহত করে। সাধারণ মানুষ ঠিকই বলে, তারা লোকদের যা করতে নিষেধ করে, নিজেরা তা করে।

শাহিন একটু রেগে গেলেও নিজেকে সংযত রেখে বলল, আপনি অত চেঁচামেচী করছেন কেন? যা বলছেন তা ভালবাবে বলুন। তবে সুবিধে হবে বলে মনে হয় না। আপনার মেয়ে সাবালিকা এবং উচ্চ শিক্ষিতা। তাকে কেমন করে আমি ভুলাতে পারি?

জুলির সঙ্গে দেখা করা আমার অত্যন্ত জরুরী? দয়া করে তাকে একটু ডেকে দিন।
মাহিলা খাতুন অগ্নিদৃষ্টি হেনে বললেন, তোমার সাহস তো কম না? তুমি জান, আমি তোমাকে একদম পছন্দ করি না, তোমার সঙ্গে জুলির সম্পর্ক থাকুক তাও চাই না।

তা সত্ত্বেও তুমি মনে করেছ, তোমার সঙ্গে আমি তাকে দেখা করতে দেব? শাহিন বলল, দেখুন, আপনি না চাইলেও জুলি চায়। সে যখন চায় তখন আপনি বাধা দিয়ে কি তাকে আটকাতে পারবেন? শুনে রাখুন, মৌলভীদেরকেও আল্লাহপাক রক্ত-মাংস দিয়ে তৈরি করেছেন।

তাদের দিলেও প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ-মমতা, ভক্তি-শ্রদ্ধা সব কিছু তিনিই দিয়েছেন। তবে সেগুলোকে তারা পথভ্রষ্টদেরমতো ব্যবহার করে না। তারা আল্লাহ ও রাসূলের (সঃ) আইন মোতাবেক সবকিছু করে থাকে। যে প্রেমে পাপ আছে, পঙ্কিলতা আছে, ঠকবাজি আছে তেমন প্রেম মৌলভীরা করে না।

যদি কেউ শয়তানের প্ররোচনায় করেও থাকে, তা হলে সে মৌলভী নামের অযোগ্য এবং সেজন্যে তাকে সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শাস্তি আল্লাহপাক দেবেন। প্রেম হল আল্লাহপাকের বহুৎ বড় নেয়ামত। সেখানে উঁচু-নিচু, ধনী- দরিদ্র, ছোট-বড়, সুন্দর-অসুন্দরের কোনো ভেদাভেদ নেই।

আপনি এখন রেগে আছেন। এসব কথা ভালো লাগবে না। অনুগ্রহ করে জুলিকে ডেকে দিলে বাধিত হব। ননসেন্স, বেরিয়ে যাও। নচেৎ পুলিশে ফোন করতে বাধ্য হব। কাজি অফিসে আজ কেন গেল না বুঝতে পারছ না? তার ভুল ভেঙ্গেছে? সে তোমাকে ঘৃণা করে।

ভদ্রভাবে কথা বলুন? দিন না পুলিশকে খবর, কে আপনাকে আটকে রেখেছে? যাই করুন তার আগে আমি জুলির সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমাকে সে যে ঘৃণা করে, তা তার মুখে শুনব।

বেগম সাহেবের চেঁচামেচি শুনে ঘরের চাকর-চাকরাণী ও দারোয়ান দরজার বাইরে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাহিলা খাতুন তা বুঝতে পেরে বলে উঠলেন, এই তোরা কে কোথায় আছিস, এই বাঁদরটাকে ঘাড় ধরে গেটের বাইরে বের করে দে।

গৃহ কর্ত্রীর কথা শুনে দারোয়ান ও চাকর দু’জনকে রুমে ঢুকতে দেখে শাহিন বলল, যদি ভালো চান, তা হলে আপনারা এক পা এগোবেন না। তারপর মাহিলা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি চলে যাচ্ছি, তবে একটা কথা মনে রাখবেন, নিজের মেয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা বলা উচিত হয় নি।

আর একজন শিক্ষিতা মায়ের কাছ থেকে এ রকম ব্যবহারও আশা করি নি। আমাদের প্রেম যদি নিষ্পাপ ও খাঁটি হয়, তা হলে ইনশাল্লাহ, আমি জুলিকে বিয়ে করবই। দুনিয়ার কোনো শক্তি আমাদেরকে আটকাতে পারবে না। চলি, আল্লাহ হাফেজ বলে সে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেল।

জুলি দোতলার রুমের জানালা থেকে শাহিনকে আসতে ও ফিরে যেতে দেখল। শুধু চোখের পানিতে বুক ভাসানো ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। মনে মনে আল্লাহকে জানাল, ‘আল্লাহপাক, তোমার কাছে শুধু আমার এটুকু মিনতি, শাহিন যেন আমাকে ভুল না বুঝে।

আর তাকে ছাড়া আমাকে অন্য কারুর অঙ্কশায়িনী করো না।
শাহিন জুলিদের বাসা থেকে বেরিয়ে তার বাবার অফিসে গিয়ে তাকে ঘটনাটা বলে বলল, আপনি এর একটা কিছু ব্যবস্থা করুন।
হানিফ সাহেব শাহিনের কথা শুনে বেশ আশ্চর্য হলেন।

আবার একটু রেগেও গেলেন। বললেন, মেয়ের মায়ের কাছ থেকে অপমান হয়ে তার বাবার কাছে এসেছ কোন সাহসে?
আমিও যদি অপমান করে তাড়িয়ে দিই?
তা দিতে পারেন। তবে আমি মনে করি, সেটা আপনি করবেন না।

কি করে বুঝলে?
জ্ঞানের অনুভূতিতে।
তা হলে প্রথমে আমার কাছে এলে না কেন? ভেবেছিলাম, আপনিও বাসায় আছেন।

তুমি আমার মেয়েকে ভালবাসতে পারলে, নিজে কিছু করতে পারলে না?
কথাগুলো শুনে শাহিন লজ্জা পেয়ে কয়েক সেকেণ্ড মাথা নিচু করে রইল। তারপর বলল, আমি তো করতেই চেয়েছিলাম। কিন্তু আম্মা যে বাধা হয়ে-

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে হানিফ সাহেব বললেন, প্রেম ভালবাসাতে তো বাধা আসবেই। তাতে যারা জয়ী হতে পারে, তারাই আসল প্রেমিক। তা আমাকে এখন কি করতে হবে? শাহিনকে মাথা নিচু করে ভাবতে দেখে আবার বললেন, তুমি এত তাড়াহুড়ো করছ
কেন?

আমি মিসরে উচ্চ শিক্ষা নিতে চলে যাব। এক সপ্তাহ পরে আমার ফ্লাইট। সেই জন্যে যাওয়ার আগে আমি বিয়েটা করে যেতে চাই।
তোমার বাবা-মা এসব ব্যাপার জানেন?
জি।

বিয়ে করে আমার মেয়েকে তোমাদের বাড়িতে রেখে যেতে পারবে? জি, পারব।
ঠিক আছে, তুমি বাসায় গিয়ে তোমার মা-বাবাকে জানাও। আমি কাল দশটার দিকে জুলিকে নিয়ে তোমাদের বাসায় আসব।

কাজি সাহেবকে বেলা দশটার দিকে আসতে বলো। একটা কথা, বিয়ের ব্যাপারটা তোমার মা-বাবাকে গোপন রাখতে বলবে। অবশ্য কালকে আমি তাদেরকে বিস্তারিত সব বলব? ও. কে?
জি, শুকরিয়া।

তারপর হানিফ সাহেব কলিং বেল বাজিয়ে পিয়নকে দিয়ে নাস্তা আনিয়ে খাইয়ে বিদায় দেওয়ার সময় বললেন, বাই দা বাই, তোমাদের বাসার ঠিকানাটা দাও।
শাহিন ঠিকানা লিখে দিল।

ঠিকানা পড়ে হানিফ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তুমি আকবর ভাইয়ের ছেলে? কি আশ্চর্য? আগে বলবে তো? শাহিনকে অবাক হয়ে তার দিকে চাইতে দেখে আবার বললেন, আমি ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না, তোমার বাবা যে আমার কত বড় উপকার করেছিলেন।

বিপদের সময় তিনি যদি আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে না আসতেন, তা হলে হানিফ ম্যানসন আজ এতবড় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত না। তুমি আকবর ভাইয়ের ছেলে, ভাবতেই পারছি না? তুমি ঠিক তোমার বাবার মতো সাহসী হয়েছ।

তোমাকে দেখেই আমার মনের মধ্যে কেমন যেন একটা টান অনুভব করছিলাম। আচ্ছা, তুমি তো বললে, বিয়ের ব্যাপারটা তোমার মা-বাবা জানেন। কিন্তু কোথায়, কার মেয়েকে বিয়ে করছ, তা কি জানেন? জি না।

ওঁরা জানেন, আমি কোনো দিন এমন কোনো কাজ করব না, যাতে করে ওঁরা কষ্ট পাবেন, অথবা বেইজ্জতি হবেন।
আর একটা কথা, তুমি তোমার মা-বাবাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠালে না কেন? তা হলে তো এ রকম গোলমাল হতো না।

আমি আব্বাকে বলেছিলাম। উনি বললেন, তুমি নিজে যখন জীবন সঙ্গিনী পছন্দ করেছ, তখন তাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা নিজেই কর।
জুলি কি তোমাদের বাড়িতে কখনও গেছে?

জি, মাত্র একবার আমি নিয়ে গেছি। আব্বা-আম্মার সঙ্গে কথাও বলেছে।
হানিফ সাহেব একটু চিন্তা করে কিছু যেন বুঝতে পারলেন। বললেন, তুমি যাও। তোমার বাবা-মাকে আর কিছু বলা লাগবে না, যা বলার আমি বলব।

শাহিন সালাম জানিয়ে চলে যাওয়ার পর হানিফ সাহেব শাহিনদের বাসায় ফোন করে আকবর সাহেবকে চাইলেন। আকবর সাহেব রিসিভার ধরে সালাম দিয়ে বললেন, আকবর বলছি?

হানিফ সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, আকবর ভাই, আমি হানিফ বলছি। কেমন আছেন? ভাবি সাহেবা কেমন আছেন?
আল্লাহপাকের রহমতে আমরা ভালই আছি। আপনারা কেমন আছেন?

আমরাও আল্লাহপাকের রহমতে ও আপনাদের দো’য়ায় ভালোই আছি?
কি ব্যাপার? অনেকদিন পর মনে পড়ল বুঝি?

আমাকে আর লজ্জা দেবেন না ভাই? ব্যবসা নিয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার খাপ। যাই হোক, শুনলাম ছেলের বিয়ে দিচ্ছেন?
আমি আর দিচ্ছি কই, ছেলে নিজেই করছে।

আপনাদের একমাত্র সন্তান বলে কথা। সেই ছেলে নিজের ইচ্ছামতো বিয়ে করতে যাচ্ছে; আপনি বাবা হয়ে সেই মেয়ের খোঁজ-খবর নেবেন না?
আপনার কি মনে হয়?

মনে তো যা হওয়ার হয়েছে? তবু একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম। আমি তো এইমাত্র জানলাম। তাও জানতেই পারতাম না, যদি না আমার গিন্নী শাহিনকে অপমান করে তাড়িয়ে দিত। আবার শাহিন অপমানিত হয়ে যদি না আমার কাছে আসত।

সত্যি ভাই, শাহিন যে আপনার ছেলে, তা ঘৃণাক্ষরে কিছুক্ষণ আগেও জানতাম না। শাহিন উচ্চশিক্ষা নিতে মিসর যাবে, এক সপ্তাহ পর তার ফ্লাইট। তাই সে যাওয়ার আগে আমার মেয়ে জুলিকে আজ- কালের মধ্যে বিয়ে করতে চায়। আপনি বোধ হয় সব কিছু জানেন?
হ্যাঁ, জানি।

জুলির মাকে একটু শিক্ষা দেব। তাই বলছিলাম, আমি কাল জুলিকে নিয়ে আপনার বাসায় আসছি। আপনি কাজি সাহেবকে বেলা দশটা-এগারটার দিকে আসতে বলবেন। বেশি আয়োজন করবেন না। আর কোনো আত্মীয়-স্বজনকেও বলবেন না।

আমি গোপনে কাজটা করতে চাই। জুলির মা জানবে, জুলি মনের দুঃখে কোথায় চলে গেছে। আমি অবশ্য থানাতে জানাব এবং কাগজেও এ ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি দেব। আপনাদের বাসায় যদি কেউ জুলির খোঁজ করে, তবে আপনারা কোনো কিছু জানেন না বলে দেবেন।

শাহিন ফিরে এলে আমি মেয়ে জামাইকে নিয়ে আসব।
আকবর সাহেব হেসে উঠে বললেন, এটা যে নভেল-নাটকেরমতো হয়ে যাবে। যা খুশী হোক। তবু জুলির মাকে একটু শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। বেশ আপনি যা বললেন, তাই হবে?

আকবর ভাই, একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে, আপনি জানেন জুলি আমার মেয়ে, তবু কেন ওদের বিয়ের ব্যাপারটা আমাকে জানালেন না?

ভুলে যাচ্ছেন কেন আমি ছেলের বাবা? দেখলাম, মেয়ের বাবা-মা মেয়ের জন্য কি করেন? কি দেখলেন?
কি আর দেখব? আল্লাহপাকের যা মর্জি তাই দেখলাম।

আপনার সঙ্গে যুক্তিতে কি আর পারব ভাই? আচ্ছা আপনি কি জানেন, জুলি ওর মায়ের আগের স্বামীর সন্তান?
জানি, সব জানি। আপনারা ছেলে-মেয়ের খবর না রাখলেও আমি সব খবর রাখি। কারণ প্রত্যেক বাবা-মার উচিত ছেলে-মেয়ের সবকিছুর প্রতি লক্ষ্য রাখা।

আপনি ঠিক বলেছেন, ভাই। এখন তা হলে রাখি?
রাখুন বলে, সালাম বিনিময় করে আকবর সাহেব ফোন ছেড়ে দিলেন?

হানিফ সাহেব ক্র্যাডেলে রিসিভার রেখে ভাবতে লাগলেন, আকবর সাহেবের মতো মানুষ আজ-কালের জামানায় অতি বিরল।

যখন ব্যবসায় লস খেয়ে দেউলিয়া হয়ে পাগলেরমতো বড় বড় বন্ধুদের কাছে সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন একদিন এক বন্ধুর বাড়ি থেকে বিফল মনোরথে ফেরার সময় গেটে একটা টুপি পরা দাড়িওয়ালা লোক এগিয়ে এসে বললেন, আপনাকে মহসিন সাহেবের সাথে কথা বলতে দেখলাম না?

হানিফ সাহেব বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
লোকটা বললেন, আপনি মহসীন সাহেবের সঙ্গে যে সমস্ত কথা-বার্তা বলেছেন, আমি তার কিছু কিছু শুনেছি। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে আসুন না একটা হোটেলে বসে একটু চা খাই। আর কিছু কথা-বার্তা বলি।

আপনাকে তো চিনি না।
তাতে কি হয়েছে? আমিও আল্লাহপাকের করুণায় কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য করি। তা ছাড়া আমাদের সব থেকে বড় পরিচয় আমরা মুসলমান।

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, ‘এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই। তা হলে এক ভাই বিপদে পড়লে অন্য ভাই তা জানতে পারলে সাধ্যমতো তাকে সাহায্য করাইতো উচিত। যারা তা করে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) তাদেরকে খুব ভালবাসেন। মুসলমান ভাই হিসেবে বলছি, আপনার বিপদের কথা খুলে বলুন।

ইনশাআল্লাহ আমার সাধ্যমতো আপনাকে সাহায্য করব।
হানিফ সাহেব লোকটার কথা শুনে খুব আশ্চর্য হলেন। চোখে পানি এসে গেল। তা বুঝতে পেরে লোকটা একটা হোটেলে নিয়ে গিয়ে প্রথমে নাস্তা খাওয়ালেন।

তারপর বিপদের কথা বলতে বললেন। হানিফ সাহেব বললেন, বিদেশ থেকে যে জাহাজে আমার মাল আসছিল, সেটা ডুবে
গেছে, ফলে আমার বহু টাকা লস হয়েছে। বাজারেও প্রায় দুলক্ষ টাকা ঋণ আছে। লোকটা একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, আগামীকাল বেলা বারটায় দেখা করবেন।

এখন আমাকে কয়েক জায়গায় যেতে হবে। তারপর হোটেলের বিল মিটিয়ে সালাম বিনিময় করে ত্রস্তপদে বেরিয়ে গেলেন।
হানিফ সাহেবও তার পেছন পেছন এসে দেখলেন তিনি একটা মিটসুবিসি মাইক্রোবাসে উঠতে ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিল।

হানিফ সাহেব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর কার্ডটার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ও শ্রেষ্ঠ ধনীদের অন্যতম আকবর হোসেনের কার্ড। দানশীলতার জন্য যাঁর নাম বিখ্যাত।

তাঁর মহৎ হৃদয়ের কথা একদিন এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলেন। উনি টিকাটুলিতে একটা চারতলা মার্কেট করে যখন সালামি বা এ্যাডভান্স ছাড়াই দোকান বিলি করেন তখন জনৈক বন্ধু তাঁকে বলেন, এ আপনি কি করছেন? মার্কেটটা তৈরি করতে কত লক্ষ্য টাকা আপনার খরচ হয়েছে।

সালামি বা এ্যাডভান্স নিয়ে সেই টাকা তুলে নিন। মৃদ হেসে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহপাক আমাকে প্রচুর দিয়েছেন। তা থেকে জনসাধারণের কিছু উপকার করা উচিত। আমার তো টাকার কোনো অভাব আল্লাহপাক রাখেন নি। কেন আমি ঐসব নিয়ে দোকান মালিকদের কষ্ট দেব?

তারা যদি সালামি দিয়ে দোকান নিতে গিয়ে ঋণ করে, তা হলে তাদের ঋণের জন্য আমি আল্লাহপাকের কাছে পরোক্ষভাবে দায়ি হয়ে যাব। আর তারা যদি সালামি দেওয়ার পর নিঃস্ব হয়ে ব্যাংক থেকে সুদের উপর লোন করে, তা হলে আমি তাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে সুদের টাকা নেওয়াছি।

আল্লাহপাক সুদ দেওয়া ও নেওয়া হারাম করেছেন। আর আমি যদি তাদেরকে সুদের উপর টাকা নিতে পরোক্ষভাবে বাধ্য করি, তবে আমিও পরোক্ষভাবে ঐ দোষে দোষি হয়ে যাব।

কাল কেয়ামতের ময়দানে আল্লাহপাক আমাকে যখন বলবেন, আমি তো তোমার কোনো অভাব রাখি নি, তবু কেন মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাদেরকে হারাম কাজ করতে বাধ্য করেছ?

তখন আমি কি জবাব দেব? এখন হানিফ সাহেব সেই লোককে প্রত্যক্ষ করলেন। সেখান থেকে ফিরে আসার সময় ভাবতে লাগলেন, উনি কি শুধু দু’লাখ দেবেন, না আরো বেশি দেবেন? দু’লাখ দিলে তো ঋণ পরিশোধ করতে শেষ হয়ে যাবে।

আবার ভাবলেন, ঋণ পরিশোধ হয়ে গেলে ব্যাংক থেকে লোন পাওয়া যাবে। সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতে সেদিন বাসায় ফিরলেন। পরেরদিন হানিফ সাহেব সময়মতো অফিসে গিয়ে ওঁর কাছে হাজির হলেন।

হানিফ সাহেবকে দেখে আকবর সাহেব দাঁড়িয়ে সালাম বিনিময়ের পর হাত মোসাফাহা করে বসতে বললেন। তারপর বেয়ারাকে ডেকে নাস্তার অর্ডার দিলেন। হানিফ সাহেব বললেন, ওসবের কি দরকার আছে?

আলবাৎ আছে। মেহমান এলে তাকে সাধ্যমত আদর-আপ্যায়ণ করা সুন্নত। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ঋণ শোধ করতে এবং ব্যবসা চালাতে আপনার মোট কত টাকার প্রয়োজন হতে পারে? হানিফ সাহেবতো শুনে অবাক। লোকটা বলে কি?

তাকে ভাবতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করলেন, আমার কথা শুনে খুব অবাক হচ্ছেন না? এতে অবাক হওয়ার কি আছে? উপকার যখন করার ক্ষমতা আল্লাহপাক আমাকে দিয়েছেন তখন প্রয়োজনমতো তো করতে হবে। কত টাকা দরকার বলুন।

হানিফ সাহেব বললেন, লাখ পাঁচেক হলে চলবে। উঁহু! হল না, বলুন ইনশাআল্লাহ লাখ পাঁচেক হলে চলবে। মনে রাখবেন, সব সময় সব কথায় ও কাজে আমাদেরকে আল্লাহপাকের স্মরণ রাখা উচিত। এটাই প্রকৃত মুসলমানের কর্তব্য।

যাক, আপনার ব্যাংকের নাম ও একাউন্ট নাম্বারটা দিন। পাঁচলাখ কেন, যত টাকা দরকার আগামী কাল থেকে তুলতে পারবেন, আমি ব্ল‍্যাংক চেকে সই করে দিচ্ছি। তাঁর কথা শুনে, নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না হানিফ সাহেব।

হানিফ সাহেব বিস্ময় ভাবটা কোনো রকমে কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, টাকাটা কতদিনে এবং কিভাবে আমি পরিশোধ করব, সে সম্বন্ধে কিছু বলবেন না? আকবর সাহেব বললেন, না বলব না। টাকা আমি আপনাকে “কর্জে হাসানা” স্বরূপ দিলাম।

আপনার যখন সুবিধে হবে দেবেন, নচেৎ দেবেন না। ঐ টাকার উপর আমার কোনো দাবি নেই। আপনি না দিতে পারলেও আল্লাহ আমাকে ওর থেকে অনেক বেশি দেবেন। তা ছাড়া আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) কর্জে হাসানা দানকারীকে খুব ভালবাসেন।

আমি টাকার চেয়ে তাঁদের ভালবাসার বেশি প্রত্যাশী। প্রত্যেক মুসলমানের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকা উচিত, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ)-কে খুশী করা। যাই হোক, আপনাকে ঐ টাকা শোধ করার চিন্তা করতে হবে না। যা কিছু করার মালিক যিনি, তিনি করবেন।

ছেলেবেলার একটা কথা মনে পড়ল, কিছু মনে না করলে শোনাতে পারি। বলুন। আমি তখন গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফাইভে পড়ি। একদিন আমার ক্লাসফ্রেণ্ড কাজল ছুটির পর তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। তার মা দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতো।

কাজল বন্ধু বলে পরিচয় দিল। মেয়েটা আমাকে বেশ আদর করল। তারপর মেঝেয় আসন পেতে দু’জনকে মুড়ি ও নারকেলের নাড়ু খেতে দিল। ওরা হিন্দু ব্রাহ্মণ। হঠাৎ ওর মা আমার নাম জিজ্ঞেস করল। আমি নাম বলতে সে চমকে উঠে বলল, তুমি মুসলমান?

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম। তখন মেয়েটা বলল, দেখ কি সর্বনাশ? তুমি বাইরে গিয়ে খাও। কথাটা শুনে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। খাব না বলে চলে এলাম।

আসার সময় শুনতে পেলাম কাজলের মা কাজলকে খুব বকছে। তাদের বৈঠকখানায় দেওয়ালে টাঙ্গান ফ্রেমে বাঁধান কিছু লেখা ছিল। একবার পড়ে সেটা আমার মুখস্থ হয়ে যায়। আজও মনে আছে। বলছি শুনুন,

“চলবে কিসে ভাবছ মিছে
ভাববার তুমি কে?
যাঁর ভাবনা ভাবছেন তিনি
ভাব তুমি তাঁকে।”

তাই বলছিলাম, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংসার-পত্র কিভাবে চলবে, সে সব না ভেবে আল্লাহপাককে স্মরণ রেখে যে যার কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে যান, তারপর যাঁর ভাবনা তিনি তো আগের থেকে সবকিছু ঠিক করেই রেখেছেন। যাক, দু’জনের অনেক সময় নষ্ট হল।

আর দু- একটা কথা বলে ইতি টানব। ছেলেবেলায় আম্মা আমাকে প্রায় একটা কথা বলতেন, মনে রেখ, “আপ ভালাতো জগৎ ভালা”। আব্বা দুটো কথা বলতেন। (১) “অনেস্টী ইজ দ্যা বেস্ট পলিসি” (২) “হ ইয়ার দেয়ার ইজ এ উইল, দেয়ার ইজ এ ওয়ে”।

আর দাদাজী বলতেন, ভাই জীবনে যা কিছু কর না কেন, কখনো ফরয নামায ও ফরয রোযা ত্যাগ করো না। আর সব কথায় ও কাজের প্রথমে আল্লাহকে স্মরণ করবে।” আমি তাঁদের এই অমিয়বাণী পাথেয় করেছি বলে আল্লাহপাকের দো’য়ায় এই অবস্থায় পৌঁছেছি।

সেই আকবর সাহেবের সাহায্যে আজ হানিফ সাহেব এত বড় বিজনেস ম্যাগনেট। অবশ্য দু-তিন বছরের মধ্যে তিনি আকবর সাহেবের সব টাকা পরিশোধ করে দিয়েছেন।

ফোন ছেড়ে দিয়ে অফিসে বসে বসে এই সবকথা চিন্তা করছিলেন। সন্ধ্যের পর হানিফ সাহেব বাসায় ফিরে স্ত্রীর মুখে সব ঘটনা শুনে গুম হয়ে বসে রইলেন।

মাহিলা খাতুন বললেন, কি হল কিছু বলছ না কেন?
কি বলব বল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার মেয়ে তুমি যা খুশী কর। আমি বললে তো তুমি শুনবে না।
মাহিলা খাতুন খোঁচাটা খেয়ে আরো রেগে গেলেন।

বললেন, জুলি না হয় আমার মেয়ে, কিন্তু ওর জায়গায় যদি মিমি হত, তা হলে কি করতে?
মিমি যদি হত, তা হলে তখন তা ভেবে দেখতাম। স্ত্রীর রাগ প্রশমিত করার জন্যে আবার বললেন, বাদ দাও ওসব কথা। যা করার তা তো তুমি করেছ।

শাহিন যদি কিছু জোর করতে চায়, তা হলে আইনের প্যাঁচে ফেলে বাছাধনকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব। ঐ সব নিয়ে এখন আর মন খারাপ করার দরকার নেই। জুলি কোথায়? তাকে কি তুমি এখনো তার রুমে আটকে রেখেছ?

হ্যাঁ রেখেছি। যতদিন না ঐ মোল্লা ছেলেটাকে ভুলবে, ততদিন ছাড়ছি না। তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? একটা শিক্ষিত মেয়েকে এভাবে রাখা তোমার উচিত হয় নি। যদি কিছু একটা করে বসে? কথা শেষ করে তিনি জুলির ঘরের দিকে গেলেন।

জুলি যে কিছু করে ফেলতে পারে সেকথা মাহিলা খাতুন এতক্ষণ ভাবেন নি। স্বামীর কথা শুনে তাকে বাধা দিলেন না।
হানিফ সাহেব দরজা খুলে ঘরে ঢুকতেই জুলি বাবা বলে তাকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে হানিফ সাহেব বললেন, তুই একটা আস্ত বোকা।

যা মনে আছে তা প্রকাশ করলি কেন? তোর মায়ের গোঁ তো তুই জানিস। তারপর মেয়েকে ফিস ফিস করে কিছু বললেন?
জুলি বাবাকে ছেড়ে দিয়ে কান্নামুখে হাসি দিয়ে বলল, সত্যি বলছ বাবা?

হ্যাঁরে সত্যি বলছি। নে এবার চল দেখি; হাত-মুখ ধুয়ে আমার সঙ্গে খাবি। সারাদিন তো কিছু খাস নি। পরের দিন হানিফ সাহেব মেয়েকে নিয়ে ঠিক সময়মতো আকবর সাহেবের বাসায় উপস্থিত হলেন। তারপর বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে মেয়ে-জামাই, বেয়াই ও বেয়ানকে সব বুঝিয়ে বিকেলে অফিসে গেলেন।

সেদিন তিনি ইচ্ছে করে দেরিতে বাসায় ফিরলেন। এদিকে সন্ধ্যে হয়ে গেল অথচ জুলি ভার্সিটি থেকে ফিরছে না দেখে মাহিলা খাতুন চিন্তিত হলেন। স্বামীকে ফোন করে জানিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বললেন। জুলির অনেক বন্ধু- বান্ধবীদের বাসায়ও ফোন করলেন, তারা সবাই বলল, জুলি তাদের বাসায় আসে নি।

শেষে মমতার কথা মনে পড়তে তার কাছে ফোন করল। মাহিলা খাতুন জানেন, মমতা জুলির খুব অন্তরঙ্গ। মমতা বলল, জুলি মাত্র একটা ক্লাস করেছে। তারপর শরীর খারাপ লাগছে বলে চলে গেছে। শুনে মাহিলা খাতুন ভাবলেন, তা হলে কি জুলি শাহিনকে বিয়ে করে তাদের বাসায় চলে গেছে?

এমন সময় স্বামীকে ফিরতে দেখে রাগের সঙ্গে বললেন, হল তো? মেয়েকে আদর করে ছেড়ে দিলে, আবার ভার্সিটিও যেতে দিলে। এখন তাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চয় শাহিন নিয়ে ভেগেছে। তুমি থানায় জি.ডি. করে তাদের বাসায় খোঁজ নাও।

থানা থেকে একদল পুলিশ নিয়ে যাবে। বাছাধনকে জেলের ভাত খাইয়ে তবে নিস্তার। হানিফ সাহেব চিন্তার ভান করে বললেন, ও যে এ রকম করবে ভাবতেও পারি নি। তুমি শাহিনদের বাসার ঠিকানা বা টেলিফোন নাম্বার জান?

না, আমি জানি না। তুমি পুরুষ, যেমন করে হোক ওদের ঠিকানা বের কর। ঠিক আছে আমি দেখছি। কিন্তু ওরা যদি বিয়ে করে ফেলে, তা হলে তো কিছু করা যাবে না। সাবালক ও শিক্ষিত ছেলেমেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে জানলে থানা-পুলিশ করলেও তারা কিছু করতে পারবে না।

আগে খোঁজ নিয়ে দেখ, তারপর যদি সে রকম কিছু হয়ে যায়, তবে চাচাকে দিয়ে এর বিহিত আমি করবই। আমি দেখছি বলে হানিফ সাহেব বাসা থেকে বেরিয়ে প্রথমে থানায় গেলেন। ও.সি-কে সব ঘটনা বলে একটা ফলস জি.ডি. করালেন।

আর বললেন, কেউ ফোন করলে বলবেন, আপনারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন। আগামীকাল দু-তিনটে দৈনিক পেপারেও আমি নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দেব। পড়ে কিছু মনে করবেন না।

ও.সি. সাহেব শুনে হেসে খুন। বললেন, আপনি তো খুব রসিক মানুষ সাহেব? হানিফ সাহেব বললেন, ছেলের ফ্যামিলির পরিচয় পেলে মেয়ের মা অবশ্য-অমত করত না। বরং হাতে আকাশের চাঁদ পেত।

ও.সি. সাহেব বললেন, আপনি তাকে জানান নি কেন? জানালে তো আর এত হৈ চৈ উনি করতেন না।
হানিফ সাহেব বললেন, আমরা কেউ তার পরিচয় জানতাম না। গতকাল শুধু আমি জানতে পেরে নিজেই বিয়ে দিয়ে মেয়েকে জামাই বাড়িতে রেখে এসেছি।

মেয়ের মাকে কিছু জ্ঞান দিতে চাই। আমি মেয়েকে একটা ফোন করতে পারি?
কোথায়?
টিকাটুলি আকবর সাহেবের বাসায়।

বলেন কী? দানবীর আকবর হোসেন সাহেবই আপনার বেয়াই নাকি?
জি, তবে আর বললাম কি?

করুণ, করুণ, আপনার মেয়ে খুব ভাগ্যবতী। যেমন শ্বশুর-শাশুড়ী, তেমনি স্বামী। বাবা- মার উপযুক্ত ছেলে। আকবর সাহেবের স্ত্রীও খুব দানশীলা মহিলা। ওঁর বাবার বাড়ির কাছে আমার শ্বশুরবাড়ি। গ্রামের এমন কেউ নেই যাকে উনি নানাভাবে সাহায্য করেন নি।

আপনার জামাই এখনো ছাত্র। তবু দেশ ও দশের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত বাজি রেখে কাজ করেন।
হানিফ মেয়েকে ফোনে তার মায়ের অবস্থা বলে তাকে মন খারাপ করতে নিষেধ করলেন। তারপর জামাইকে দিতে বললেন।

শাহিন ফোন ধরতে বললেন, তুমি কাল সকালের দিকে জুলির খোঁজে আমাদের বাসায় একবার আসবে। চিন্তা করো না, আমি থাকব। আর শোন, গাড়ি নিয়ে আসবে, কেমন?
শাহিন বলল, জি আসব।

হানিফ সাহেব তারপর ফোন রেখে থানা থেকে বিদায় নিয়ে রাত দশটার দিকে বাসায়
ফিরে এলেন।
মাহিলা খাতুন স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল? কিছু খোঁজ খবর পেলে?

না, কোনো কিছু পেলাম না।
শাহিনদের বাসায় পুলিশ নিয়ে গিয়েছিলে?

তা আবার যাই নি। শাহিন বাসায় ছিল না। তার বাবা অনেক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন। ফেরার সময় অবশ্য শাহিনের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। জুলিকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে তার মন খুব খারাপ হয়ে যেতে দেখলাম। সেও জুলিকে খুঁজবে বলে বলল।

শাহিনের বাবা কিন্তু বিরাট ধনী, বহু ধরণের লোকজন তার বাসায় যাওয়া আসা করতে দেখলাম, বাড়িটাও বিরাট। গ্যারেজে দু’টো প্রাইভেট কার ও একটা মাইক্রোবাস দেখলাম।

শাহিনের বাবার কথা শুনে মাহিলা খাতুন বললেন, জুলিতো সে রকম কিছু বলে নি। মনে মনে ভাবলেন, তা হলে আমি কি ভুল করলাম? মুখে বললেন, এখন তা হলে কি করা যায়?

হানিফ সাহেব বললেন, এখন আর চিন্তা করে কি হবে? কুষ্টিয়ায় ওর খালার বাড়িতে গেল কিনা খোঁজ নিতে হবে, আর যেখানে যেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা সেখানেও খোঁজ নিতে হবে। আমি ইনকিলাব ও ইত্তেফাক অফিস হয়ে আসছি।

কালকে কাগজে বিজ্ঞপ্তি বেরোবে-“মা জুলি অতি শিঘ্র বাড়ি ফিরে এস। তুমি যা বলবে তাই হবে। আমরা তোমার জন্য ভীষণ দুঃশ্চিন্তায় আছি। তোমার বাবা-মা।” তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক হয়েছে না?

মাহিলা খাতুন বললেন, হয়েছে।
পরেরদিন সকালে শাহিন গাড়ি নিয়ে জুলিদের বাসায় এসে জুলিকে পাওয়া গেছে কি-না
জিজ্ঞেস করল।
হানিফ সাহেব বললেন, না পাওয়া যায় নি। তবে আমরা নানান জায়গায় খোঁজ করার ব্যবস্থা করেছি।

মাহিলা খাতুন আজ প্রথম শাহিনকে ভালভাবে লক্ষ্য করলেন, পাজামা, লম্বা পিরান ও মাথায় টুপি এবং দাড়িওয়ালা ছেলেটার সৌম্য সুন্দর চেহারার মধ্যে উজ্জ্বল লাবণ্য ফুটে রয়েছে। কথা-বার্তার মধ্যে কোনো ঔদ্ধত্য নেই। কত নম্র, কত ধীর।

তবু মেয়েকে না পাওয়ার কারণে উষ্মার সঙ্গে বলে উঠলেন, তোমার জন্য, হ্যাঁ, তোমার জন্য আমরা আমাদের মেয়েকে হারাতে বসেছি। শাহিন বলল, আমাকে দোষ দিচ্ছেন কেন? আপনারা বাধার সৃষ্টি না করলে এ রকম পরিণতি হত না।

আমাকে যখন আপনারা দোষী করছেন তখন আমিই তাকে খুঁজে বের করব ইনশাল্লাহ। আপনারা দো’য়া করুণ, আমি যেন কামিয়াব হতে পারি। তারপর সে তাদেরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে চলে এল।

জুলিকে খুঁজে বের করার জন্য সবকিছু করা হল, কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। দেখতে দেখতে আজ চার বছর পার হয়ে গেছে। এক বছর পর শাহিন এসে জুলিকে নিয়ে মিসর চলে গেছে। হানিফ সাহেব বেয়াই সাহেবের সাথে এয়ারপোর্টে গিয়ে বিদায় দিয়ে এসেছেন।

মাহিলা খাতুন মেয়ের জন্য বেশ কিছু দিন কান্নাকাটি করেছেন। এখন আর অতটা করেন
না। মেয়ের ব্যাপারে স্বামীর উদাসীনতা দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। মাঝে মাঝে বলতেও ছাড়েন না, নিজের মেয়ে হলে এ রকম চুপ করে থাকতে পারতে?

হানিফ সাহেব কি আর বলবেন, মনে মনে হাসেন। কিন্তু তা বহিঃপ্রকাশ না করে সেখান থেকে সরে যান।
মাহিলা খাতুন মিমিকে নিয়ে এখন শংকিত। বড় বোনের ব্যাপারটা সে জানে। সে তখন তরুণী হলেও অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে।

মিমি এ বছর ইংলিশে অনার্স নিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে, আর সুমন ঢাকা কলেজে ইন্টার সাইন্সে। কিছুদিন থেকে মিমির যেন কোনো কিছু ভালো লাগছে না। জীবনটা বড় এক ঘেয়েমি মনে হচ্ছে। কোনো কিছুতে শান্তি পাচ্ছে না। ক্লাসের পড়া ভালো না লাগলে কখনো গল্পের বই পড়ে।

কখনো গান শোনে। আবার কখনো বন্ধু- বান্ধবীদের বাসায় বেড়াতে যায়। কোনো কোনো দিন তাদেরকে বাসায় নিয়ে এসে হৈ হুল্লোড় করে। তবু যেন মনের মধ্যে কোথায় একটা কিছুর অভাব বোধ করে। আসলে ছেলে-মেয়েদের এই সময়টা মন খুব অস্থির থাকে।

নিজেকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। আর ধরাকে সরা মনে করে। বেশ বেপরোয়া ভাব তাদের মধ্যে দেখা যায়। ঠিক এই সময় সুমনের জামা কিনতে গিয়ে মহির পরিচয় পেয়ে তার মন লাগামহীনের মতো ছুটে চলেছে।

মাহিলা খাতুন কিছুদিন থেকে মিমির এই বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করে একদিন স্বামীকে বললেন, মিমির জন্য ছেলে দেখ।
হানিফ সাহেব অবাক হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ও একদম ছেলে মানুষ।

এখন ওর বিয়ের কথা চিন্তা করছ কেন? আমার যে কেবল মনে হচ্ছে, জুলির মতো যদি মিমিও কিছু করে বসে, তা হলে আমি বাঁচব না। কিন্তু ওর কতই বা বয়স হয়েছে? তা ছাড়া অনার্স নিয়ে পড়ছে। এসব কথা শুনলে হুলস্থুল কাণ্ড করে বসবে।

বয়সের কথা বাদ দাও। ওর চেয়ে কম বয়সী কত মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। আর বিয়ের পরও পড়াশুনা করতে পারবে। তোমার বন্ধুর একটা ছেলে আছে না? সে তো বাবার বিজনেস দেখাশোনা করে। ছেলেটার নাম যেন কি?

সাদেক।
হ্যাঁ, সাদেক। সেতো দু’একবার আমাদের বাসায় এসেছে। দেখতে-শুনতে বেশ হ্যান্ডসাম। মিমির সঙ্গে মানাবে ভালো।
কিন্তু মিমিরওতো মতামত আছে? সে যদি এখন বিয়ে করতে রাজি না হয়? অবশ্য সাদেক ছেলে হিসেবে ভালো।

ওর মতামতের জন্যে তোমাকে ভাবতে হবে না। সে আমি ম্যানেজ করব। ম্যানেজ করব বললে তো হবে না। মেয়ে বড় হয়েছে। লেখাপড়া করছে। তার মতামতের একটা দাম আছে। তা ছাড়া সে যদি তার কোনো বন্ধুকে পছন্দ করে থাকে।

বললাম তো, আমি সে সব বুঝব। তুমি শুধু তোমার বন্ধুর মতামত নিয়ে সাদেককে আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে আসতে বলবে। তারপর যা করার আমি করব। হানিফ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমার কথা ভেবে দেখব।

মিমি আজও ভার্সিটির ছুটির পর স্কুটারে গুলিস্তান যেতে যেতে চিন্তা করল, আজকে যদি মহিকে না পায়, তা হলে আর কোনো দিন যাবে না। সে চাকরি দেবে বলে গত চারদিন গিয়ে তাকে পায় নি।

প্রথমদিন গিয়ে সেখানে অন্য একটা ছেলেকে বেচা-কেনা করতে দেখে জিজ্ঞেস করল, যে ছেলেটা এখানে গতকাল প্যান্ট-সার্ট বিক্রি করছিল, সে আজ আসে নি? ছেলেটা বলল, কার কথা বলছেন, মহি ভাইয়ের? মিমি কিছু বলার আগে ছেলেটা আবার বলল, উনি তো প্রতিদিন এখানে বসেন না।

মাঝে মধ্যে এক আধ দিন বসেন। আমরা উনার কাছ থেকে কাপড় এনে বিক্রি করি। সেদিন মিমি মন খারাপ করে ফিরে আসে।
আজ স্কুটার থেকে নেমে মহিকে একটা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলতে দেখতে পেল। স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে ধীরে ধীরে রাস্তা পার হয়ে এল।

মহি তখন কথা শেষ করে গুলিস্তানের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে। একটু পরে পেছনে থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠ শুনতে পেল, মহি সাহেব, একটু দাঁড়ান। মহি পেছনে ফিরে চেনা-জানা কোনো মেয়েকে দেখতে না পেয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল।

মিমি একটু দ্রুত হেটে আসতে আসতে বলল, এই যে মহি সাহেব, শুনছেন? একটু দাঁড়ান না। এবার মহি না দাঁড়িয়ে পারল না। ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখল, একটা সুন্দরী যুবতী তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে একপাশে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করল, মেয়েটা সাদা সালওয়ার ও হাল্কা ঘিয়ে কালারের কামিজ পরেছে।

বুকের উপর উড়না নেই। কানে দুটো সরু রিং। দু’হাতে একগাছি করে সোনার চুড়ি। পায়ে বাটার স্যান্ডেল। চুল বেণী করে বাঁধা। এখন বেণীটা বুকের দুই উঁচু মাংসপিণ্ডের মাঝ দিয়ে ঝুলে আছে। মেয়েটা কাছাকাছি আসতে সে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিল।

মিমি সামনে এসে বলল, আপনি আচ্ছা মানুষ তো? আপনাকে ডাকছি অথচ আপনি শুনতে পেয়েও চলে যাচ্ছেন? মহি বলল, আমি তো আপনাকে চিনি না। মহি নাম আরো কারুর থাকতে পারে?

আপনি চেনেন না তো কি হয়েছে? আমি আপনাকে চিনি।
তা কি করে সম্ভব?
জগতে অসম্ভব অনেক কিছু সম্ভব হয়। যাক, আপনার কি একটু সময় হবে?

কেন?
আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই।
এই তো আলাপ হচ্ছে, আবার কি আলাপ করতে চান?
আবদারের সুরে মিমি বলল, প্লীজ! চলুন না কোনো রেস্তোরায় বসি।

মহির মনে হল, মেয়েটার মাথায় ছিট আছে। কেটে পড়ার জন্যে বলল, দেখুন, আমাকে কয়েক জায়গায় যেতে হবে, খুব দরকারি কাজ আছে। অন্য একদিন জমিয়ে আলাপ করা যাবে। অন্য একদিন আপনাকে পাব কোথায়?

অভিমান ভরা কণ্ঠে আবার বলল, জানেন, আজ নিয়ে পাঁচদিন আপনার খোঁজে আসছি। মহি বেশ অবাক হয়ে বলল, কেন? কেন আবার, আলাপ করার জন্যে। আমি এই ক’দিন সেই ভার্সিটি থেকে আপনার সঙ্গে আলাপ করব বলে আসছি, আর আপনি একটু সময় দিতে পারছেন না?

মিমির কথা শুনে মহি আরো অবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগল, মেয়েটা কে? দেখে মনে হচ্ছে খুব বড়লোকের। কিন্তু আমাকে চিনল কি করে? হঠাৎ মনে পড়ল, সেদিন এই মেয়েটাই বোধ হয় একটা ছেলের সঙ্গে সার্ট কিনতে এসেছিল?

টাকা কুড়োতে গিয়ে যার সঙ্গে মাথা ঠোকাঠুকি হয়েছিল। সেদিন মেয়েটা সার্ট-প্যান্ট পরেছিল। আজ সালওয়ার কামিজ পরায় চিনতে পারে নি। এখন মহির মনে দৃঢ় ধারণা হল, এই সেই মেয়ে।

তাকে এতক্ষণ ভাবতে দেখে মিমি বলল, কি ভাবছেন? মহি সম্বিত ফিরে পেয়ে তার চোখের দিকে চাইতে সেদিনের মত আজও চার চোখের মিলন হল।

সেই অবস্থাতেই মিমি কাঁপা গলায় বলল, কিছু বলছেন না কেন? মহি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, চলুন, সামনে একটা রেস্তোরাঁ আছে। ওরা হামদর্দের সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। অল্প কিছু দক্ষিণে এগিয়ে এসে ‘খাওয়া-দাওয়া’য় ঢুকে এক কোণের টেবিলে মুখোমুখি বসল।

বেয়ারা তাদের কাছে এলে মহি বলল, কি খাবেন? তরল না শক্ত? মিমি ফিক করে হেসে বলল, আগে শক্ত পরে তরল।
মহি বেয়ারাকে পরোটা শিক কাবাব ও তার সঙ্গে দু’টো ফান্টার অর্ডার দিল।

বেয়ারা চলে যেতে মিমি জিজ্ঞেস করল, আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে। আপনি বুঝতে পারলেন কি করে?
আমারও ক্ষিদে পেয়েছে বলে। এখন বলুন, কি আলাপ করতে চান।

মিমি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার নাম মিমি। ভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স নিয়ে এ বছর ভর্তি হয়েছি। আমার একটা ভাই আছে। তার নাম সুমন। সে ঢাকা কলেজে ইন্টারে সাইন্স নিয়ে পড়ছে। বাসা ধানমণ্ডি। বাবা একজন বিজনেস ম্যান।

ও হ্যাঁ, আমার বড় একজন আপা ছিল। নাম জুলি। এখন নেই। এবার আপনারটা বলুন। যদিও আমি কিছু কিছু জানি।
মিমির কথা শুনে মহির ধারণা দৃঢ় হল, মেয়েটার মাথায় গোলমাল আছে। বলল, আমারটা যখন কিছু কিছু জানেন তখন আর কি বলব?

আমার পুরো পরিচয় বললাম। আপনারটা তো পুরোটা জানি না। পুরোটা যে জানতে আমার খুব ইচ্ছে করছে।
কেন, ইচ্ছে করছে কেন?

সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, বলা যাবে না।
আমিও যদি বলি আমার পূর্ণ পরিচয় বলা যাবে না, সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার? মিমি খুব মিনতির সুরে বলল, প্লিজ মহি সাহেব, বলুন না। নচেৎ আমি খুব মাইন্ড করব।

এমন সময় বেয়ারা অর্ডার সাপ্লাই করে চলে গেল।
মহি বলল, নিন, আগে খেয়ে নিন তারপর শুনবেন।
খেতে খেতেই বলুন না।

বলব। তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো, আমার পরিচয় জেনে আপনার কি লাভ?
আমার লাভের কথা এখন বলব না, সময় হলে বলব। তবে আপনার লাভ আছে।

মহি মনে মনে ভাবতে লাগল, আচ্ছা পাগলীর পাল্লায় পড়েছি রে বাবা? এমনি কত দেরি
হয়ে গেল। আরো কত হবে কে জানে? তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবার জন্যে বলল, আমার কি রকম লাভ জানতে পারলে পুরো পরিচয় বলতে পারি।

আপনি ইংলিশে অনার্স এবং সেদিন আপনার বন্ধুর সঙ্গে যে সমস্ত কথাবার্তা হয়েছে তার অনেকটা আমি শুনেছি। আপনাকে আমি ভালো একটা জব দিতে পারি। মহি খাওয়া বন্ধ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?

এই নিন বলে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে তার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, এখানে গেলে মনের মতো চাকরি পাবেন। মহি কার্ডটার দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, কার্ডের মালিক কি হয় আপনার?

ড্যাডী।
মহি আরো একটু গম্ভীরস্বরে বলল, যদি কার্ডটা না নিই?
মহির গম্ভীর স্বর শুনে মিমি চুপসে গেল। ম্লান মুখে বলল, নেবেন না কেন?

না নিলে আমার মনে খুব কষ্ট হবে। আপনি হয়তো ভাবছেন, আমার মাথায় গোলমাল আছে। চেনা নেই, জানা নেই, একটা ভিজিটিং কার্ড নিয়ে গেলেই বুঝি চাকরি হয়ে যাবে? মনে রাখবেন, আমার বয়স কুড়ি? আমি ভার্সিটিতে ইংলিশে অনার্স করছি।

অতএব আমি আপনার সঙ্গে নিশ্চয় ফাজলামি করছি না। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, আপনি যদি কার্ডটা না নিয়ে ড্যাডীর সঙ্গে দেখা না করেন, তা হলে আমি সুইসাইড করব।

মিমির কথা শুনে মহি চমকে উঠল। ভাবল, মেয়েটার মাথায় কি সত্যিই গোলমাল আছে?
আবার ভাবল, যদি তা না হয়, তবে মেয়েটা অনার্স পড়লে কি হবে এখনো তেমন জ্ঞান হয় নি।

বড় লোকের খুব সরল সাদাসিদে আদরের মেয়ে। কার্ডটা হাত থেকে নিয়ে পড়ার সময় দেখল, নিচে ছোট করে কালি দিয়ে লেখা- ‘ড্যাডী, দ্য ইয়ং ইজ মাই সিলেকটেড।’

তারপর মিমির দিকে তাকিয়ে বলল, বাট হোয়াই?
বিকজ আই লাভ ইউ ডিপলী।
হোয়াট?
ইয়েস, আই লাভ ইউ ডিপলী।

কি বলছেন, আপনি?
যা সত্যি তাই বলছি।
আমি যদি এখন আপনার গালে খুব জোরে একটা চড় মারি?

মিমি ছলছল নয়নে বলল, মেরেই দেখুন, তারপরও ঐ কথা বলব।
মিমির কথা শুনে মহি রোমাঞ্চিত হল। কি রকম একটা আনন্দের স্রোত তার সমস্ত শিরা-

উপশিরায় প্রবাহিত হতে লাগল। সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, লাভ কাকে বলে জানেন? অফকোর্স। লাভের অর্থ হল প্রেম। তোমার সঙ্গে আমার প্রেম হয়েছে। ঐ যে ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইট।’

ঐ দিন ফুটপাতে প্রথম দর্শন ভালবেসে ফেলেছি। আমি তোমাকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালবাসি।
প্রেম ভালবাসার অর্থ বোঝ?

কেন বুঝব না? প্রেম হল অন্তরের ব্যাপার। প্রেম ছাড়া মানব জীবন বৃথা। প্রেম আছে বলে মানুষ বেঁচে আছে।
এ রকম প্রেম ক’জনের সঙ্গে করেছ?

প্লীজ মহি, ডোন্ট টক লাইক এ ফুল। তারপর আহত স্বরে বলল, প্রেম কি জিনিস তোমাকে দেখার আগে পর্যন্ত জানতাম না। ক্লাসের অনেক মেয়ে প্রেম করে শুনেছি। ঐদিন টাকা কুড়োবার আগে এবং পরে তুমি আমার দিকে যে দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, সে দৃষ্টি আমার অন্তরে প্রেমের বীজ বুনে দিয়েছে।

সেই থেকে আমাকে পাগল করে রেখেছে। তারপর থেকে আমার যে কি হল, জানি না। সব সময় শুধু তোমার কথা মনে পড়ে। তোমার চেহারা মনের পাতায় ভেসে উঠে। পড়াশুনায় মন বসে না। কোনো কিছু ভালো লাগে না। শুধু তোমার কথা ভাবতে ভালো লাগে।

তোমাকে দেখতে মন চায়।
মনের অজান্তে কখন যে দু’জনে আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে তা কেউ টের পেল না।
মহি বলল, আমারও তো প্রেমিকা থাকতে পারে?

তা পারে। তবে আমি জানি নেই।
কি করে জানলে?
সেদিনের দৃষ্টি আমাকে জানিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু একজনের মনে প্রেম জন্মালে তো আসল প্রেম হয় না। দু’জনের হতে হবে।
তা আমিও জানি। আর এটাও জানি তুমিও আমার প্রেমে পড়েছ এবং আমাকে গভীরভাবে ভালবাস। অবসর সময়ে আমার কথা ভাব।

মহি অবাক হলেও হেসে ফেলে বলল, আমার ব্যাপারটা তুমি জানলে কি করে? আমার মন বলেছে। সত্যি করে বল, আমি যা বললাম, তা ঠিক কিনা?

এমনিতে মহি মিমির কথাবার্তায় আশ্চর্য বোধ করছিল। তার উপর এই কথা শুনে সে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। কারণ ঐ ঘটনার পর মিমির কথা প্রায় তার মনে পড়ে।

প্রতি রাতে ঘুমোবার সময় হঠাৎ কোথা থেকে মিমির সঙ্গে চোখাচোখির ঘটনা তার মনের পাতায় ভেসে উঠে। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মিমি বলল, আমার কথার উত্তর দেবে না?

পরে দেব। আজ আর সময় নেই। চল, ওঠা যাক।
কিন্তু তুমি ড্যাডীর অফিসে যাবে কিনা বললে না যে?
ভেবে-চিন্তে বলব। কোনো কথা বা কাজ বলা বা করার আগে চিন্তা করে দেখা উচিত।

হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিতে নেই। এগুলো হাদিসের কথা।
হাদিস কি?
হাদিস হল আমাদের পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর বাণী।

হাদিসে আর কি আছে?
অনেক কিছু আছে? তোমাকে আমি একটা কিনে দেব, পড়ো।
কবে দেবে?

মহি যত কথা শেষ করতে চায়। মিমি তত বাড়ায়। একটু রাগের সঙ্গে বলল, এক্ষুনি বললাম না, তাড়াহুড়ো করে কোনো কিছু করতে নেই?

মিমি আহত স্বরে বলল, তুমি রেগে গিয়ে আমাকে বকছ কেন? আমার মনে কষ্ট দিয়ে বুঝি আনন্দ পাও?
মহি মহা ফাঁপড়ে পড়ল। এ রকম মেয়ে জীবনে দেখে নি। বলল, ঠিক আছে, আমার অন্যায় হয়ে গেছে।

আর কখনো রাগব না, বকব না, এবারেরমতো মাফ করে দাও।
মিমি হাসি মুখে বলল, প্রথমবারের জন্যে মাফ করে দিলাম। কিন্তু পরে যেন আবার এ রকম ভুল না হয়। তারপর আবার বলল, এবার চল।

তোমার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম।
মহি বেয়ারাকে ডেকে পার্স বের করে বিল দিতে গেলে মিমি তার হাত ধরে বলল, প্লীজ, আমি দেব।
মহি একটু রাগের সঙ্গে বলল, হাত ছাড়।

মিমি হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, আবার রেগে কথা বলছ?
মহি হেসে ফেলে বলল, ভুল হয়ে গেছে।

আবার যদি ভুল হয়?
হবে না।
মনে থাকবে?
থাকবে।

ওখান থেকে বেরিয়ে মহি তাকে একটা স্কুটারে তুলে দিল।
স্কুটারে বসে মিমি জিজ্ঞেস করল, কালকে কোথায় এবং কখন তোমার সঙ্গে দেখা হবে?

আমার সঙ্গে দেখা করে আর কি হবে? আলাপ করতে চেয়েছিলে, আলাপ তো হল।
চাকরি দিতে চেয়েছিলে, তার ব্যবস্থাও করলে। আবার দেখা করার দরকার আছে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না।

তোমার হচ্ছে না, কিন্তু আমার হচ্ছে। আমার মতো তোমারও মাথায় ছিট আছে দেখছি।
তা না হলে এত কিছুর পর এই কথা বলতে না।

তা হলে তুমি নিজেই স্বীকার করছ, তোমার মাথায় ছিট আছে?
আগে ছিল না। তোমার সঙ্গে দেখা ও আলাপ করার পর মনে হচ্ছে দু’জনেরই মাথায় ছিট আছে। ওসব কথা বাদ দিয়ে আমার কথার উত্তর দাও।

আমি কখন কোথায় থাকি, তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। কি করে বলব? তোমাকে বলতেই হবে। নচেৎ তোমাদের বাসায় এসে পড়ব।
বলে কি মেয়েটা? জিজ্ঞেস করল, বাসার ঠিকানা জান?

তাই তো? বল না ঠিকানাটা?
মেয়েটার মাথায় সত্যি ছিট আছে কিনা জানার জন্যে বলল, ঠিকানা লাগবে না, আগামীকাল রাত বারোটায় রমনা পার্কের এক নাম্বার গেটে?

মিমি উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল, ঠিক আছে। পরক্ষণে সময়টার কথা খেয়াল হতে জিজ্ঞেস করল, কি বললে রাত বারোটায়? তাড়াতাড়ি করে স্কুটার থেকে নেমে ড্রাইভারকে দশ টাকা দিয়ে বলল, আমি যাব না।

মহি বলল, আরে কর কি? ওঠ, ওঠ, তোমার সঙ্গে একটু রসিকতা করলাম। না, আমি উঠব না। আগে সময়টা চেঞ্জ কর।
ড্রাইভারকে তাদের রকম-সকমে হাসতে দেখে মহি ভাবল, আচ্ছা মেয়ের পাল্লায় পড়া গেল। আরো যদি কিছু বলে বসে, ভেবে বলল, ঠিক আছে, দুপুর বারোটায়?

কিন্তু তা হলে তো আবার তোমার ক্লাস কামাই হবে। একটু চিন্তা করে বলল, কাল আমার আবার ঐ সময় ছাড়া সময় হবে না। এক কাজ কর, পরশু দিন শুক্রবার। ভার্সিটি বন্ধ। ঐদিন বেলা দু’টোর সময় বায়তুল মোকাররমের উত্তর দিকের গেটে এস।

আসব বলে মিমি স্কুটারে উঠে বসল। তোমাকে এটা কথা জানান হয় নি। কি কথা জানাও। আমার সঙ্গে প্রেম করতে হলে আমি যা বলব তা শুনতে হবে। মিমি কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, খুব কঠিন কিছু বলবে নাকি?

সাধ্যের মধ্যে হলে কোনো কথা নেই। বাইরে হলে কী আর করব, জানটাই দিয়ে দেব। মিমির কথা শুনে মহির সঙ্গে ড্রাইভারও হেসে উঠল। মহি বলল, তুমি নরম মেয়ে, শক্ত কিছু বলব না। আর সেগুলো আমার কথাও না। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাকের ও তাঁর রাসূলের (দঃ)।

তুমি যে বললে, তোমার কথা শুনতে হবে। আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। সেজন্যে না হয় তোমার কথা শুনব। তাই বলে সৃষ্টিকর্তা বা তাঁর রাসুলের (দঃ) কথা শুনব কেন?

স্কুটারের ড্রাইভার ও মহি আবার হেসে উঠল। এমন সময় আসরের আযান শুনতে পেয়ে মহি বলল, আমি এখন বায়তুল মোকাররমে নামায পড়তে যাব। সময় নেই। তা ছাড়া স্কুটারের ড্রাইভার কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? ঐ দিন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব।

এখন বলছি, বাসায় গিয়ে আজ থেকে একটা বড় রুমাল দিয়ে চুলসহ পুরো মাথা সব সময় বেঁধে রাখবে।
আর একটা মোটা কাপড়ের ওড়না দিয়ে বুক পিঠ ঢেকে রাখবে বুঝেছ? তা না হলে তোমার মতো আমারও মনে কষ্ট হবে।

মিমি একটু চিন্তা করে বলল, এগুলো করতে হবে কেন?
আবার প্রশ্ন করছ? বললাম তো ঐ দিন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেব। তারপর ড্রাইভারকে বলল, তাড়াতাড়ি স্টার্ট দেন তো ভাই, আমি নামায পড়তে যাব।

ড্রাইভার বুঝতে পেরে গাড়ি ছেড়ে দিল। মহি সেদিকে তাকিয়ে দেখল, মিমি স্কুটারের পেছনের ফাঁক দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে
আছে। স্কুটার অদৃশ্য হয়ে যেতে নামায পড়তে যেতে যেতে চিন্তা করল, আচ্ছা মেয়ের পাল্লায় পড়েছিলাম বাবা?

আজকাল বড়লোকের সব মেয়েরাই কি এরকম? আবার ভাবল, মেয়েটা কি সত্যিই তাকে ভালবাসে? না বড়লোকের খেয়ালী মেয়ে বলে আমাকে খেলার সামগ্রী মনে করে খেলাচ্ছে? তার মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল “মহি সাবধান, ঐ পথে পা বাড়িও না।

এ পথ দুর্গম। জান না, বড় লোকের ছেলে-মেয়েরা বড় জেদী আর খামখেয়ালী। যা মনে আসে তাই করে বেড়ায়।” মেয়েটার কথা মন থেকে তাড়াতে গিয়ে হঠাৎ তার তিনটে কথা মনে পড়ল, ‘বাবার সঙ্গে দেখা না করলে সুইসাইড করব।’

‘আই লাভ ইউ ডিপলী।’ ‘আর তুমিও তো আমাকে গভীরভাবে ভালবাস।” মহি চিন্তা করল, আমি কি সত্যি মেয়েটাকে ভালবাসি? আর সে জন্যেই কি মিমির কথা বার বার মনে পড়ছে?

ততক্ষণে সে বায়তুল মোকাররমের অযুখানায় পৌছে গেল। চিন্তা দূর করে অযু করায়
মন দিল।

নোমান বৌ নিয়ে পরের দিন মহিদের বাসায় আসে নি। এল ঐ শুক্রবার সকালে, যেদিন মহি মিমিকে কথা দিয়েছিল বায়তুল মোকাররমে দেখা করবে বলে। প্রথমে আলাপ ও পরে আপ্যায়নের পর মহি বন্ধু পত্নীকে মায়ের কাছে গল্প করতে বলে নোমানকে নিয়ে নিজের রুমে এল।

কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর মহি বলল, তুই সেদিন বৌকে ঐ পোশাকে বাইরে নিয়ে বেরোলি কি করে? বিদেশে গিয়ে ঐ সব শিখে এসেছিস বুঝি? আচ্ছা, তুই কি চাস, তোর সুন্দরী বৌয়ের দিকে চেয়ে রাস্তার লোক তার রূপ যৌবনের সৌন্দর্য সুধা পান করুক?

তুই তো ওরকম ছিলি না। মনে হচ্ছে সে দেশের সমাজের আবহাওয়া রপ্ত করে এসেছিস? এই জন্যে আলেমরা বলে থাকেন, ‘যে যার সঙ্গে মিশবে সে সেরকম হয়ে যাবে।’ বন্ধুত্ব করার সময় কি প্রতিজ্ঞা করেছিলি মনে নেই?

নোমান জানত, মহির কাছে এরকম তিরস্কার খেতে হবে? তাই লজ্জামিশ্রিত স্বরে বলল, মনে থাকবে না কেন? তবে তোর কথাই ঠিক, মানুষ যে সমাজে থাকে, সেরকমে অভস্থ হয়ে যায়। ওয়াদা করছি বিদেশে যা কিছু করেছি, এখানে আর করব না।

ওয়াদা করলে হবে না, সেই সাথে তওবা করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
এমন সময় নোমানের স্ত্রী নাহিদা সেখানে এল।
তাকে দেখে মহি বলল, আসুন ভাবি, বসুন।

নাহিদা বসে বলল, আমি এসে আপনাদের আলাপে ডিস্টার্ব করলাম না তো?
না-না, ডিস্টার্ব হবে কেন? বরং কথাগুলো আপনারও শোনা দরকার। নোমান বিদেশে গিয়ে অনেক পাল্টে গেছে।

তাই বলছিলাম, আল্লাহর কাছে তওবা করে ক্ষমা চাইতে। আপনাদের দুজনকেই ধর্মীয় বই পুস্তক পড়ার অনুরোধ করছি। কারণ ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে শয়তান আপনাদেরকে পথভ্রষ্ট করে দেবে।

তারপর নাস্তা খেয়ে গল্প করতে করতে জুম্মার নামাযের সময় হয়ে গেল। মসজিদে যাওয়ার সময় নোমানকে প্যান্টের মোহরীর ঝুল ফোলডিং করতে দেখে বলল, কিরে প্যান্টের ঝুল গুটিয়ে খাটো করছিস কেন?

নোমান বলল, খাটো করতে হবে না আবার? খাডু গাঁটের নিচে কাপড় থাকলে তো নামায হবে না। আশ্চর্য! তুই এত জানিস আর এটা জানিস না?

মহি বলল, আমি যা জানি পরে বলছি। তুই কার কাছ থেকে এটা জেনেছিস বল।
নোমান বলল, এটা কারো কাছ থেকে জানতে হয় না, সবাই জানে। মহি বলল, না সবাই জানে না।

আসলে অনেক সময় অন্যকে কিছু করতে দেখে আমরাও তাকে অনুসরণ করি। ফলে আসল ঘটনা বা ঘটনার কারণ সম্বন্ধে আমরা অনভিজ্ঞ থেকে যাই। আর অন্যকে তাই করতে দেখে এটাই নিয়ম ভেবে করে থাকি।

তোকে আগেও বলেছি এবং এখনো বলছি, ধর্মীয় অনেক বই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। সবকিছুর সাথে ঐগুলো নিজেও পড় আর ভাবিকেও পড়তে বল। তা হলে সবকিছু বুঝতে পেরে সেই মতো চলার প্রেরণাও পাবি।

আল্লাহপাক আমাদের জন্যে যতটা শরীর ঢেকে রাখা ফরয করেছেন তা হল পুরুষের জন্য নাভীর উপর থেকে হাঁটুর নিচে পর্যন্ত। হাদিসে আছে, রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, ‘পুরুষেরা উপরের দিকে নাভী ঢেকে রাখবে আর নিচের দিকে খাড়ু গাঁটের উপর পর্যন্ত।

অপর দিকে মেয়েদের মুখ মণ্ডল, হাতের কব্জির বাইরের অংশ ছাড়া সর্বশরীর ঢেকে রাখবে এবং নিচে কাপড়ের বুল মাটিতে ঠেকে যাবে। তবে পুরুষদের জন্যে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ফরয, পায়ের গোচ পর্যন্ত সুন্নত ও খাড়ু গাঁটের উপর পর্যন্ত জায়েজ।’

খাড়ু গাঁটের নিচে কাঁপড় পরা পুরুষদের জন্য হারাম। তাই শুধু নামাযের সময় খাড় গাঁটর উপরে পরবে আর অন্য সময় খাড়ু গাঁটের নিচে পরবে। এটা মোটেই ঠিক নয়। নচেৎ আল্লাহ ও রাসূলের আইনের বরখেলাপ কাজ হয়ে যাবে এবং শক্ত গোনাহ হবে।

এখন বুঝে দেখ, সবাইয়ের জানার মধ্যে কত ভুল ধারণা রয়েছে। আর সেইজন্যে বহু পাজামা ও প্যান্টধারী নামাযীকে দেখেছি নামাযের আগে পাজামা ও প্যান্টের ঝুল গুটিয়ে নামায পড়ে। নামাযের পর আবার খুলে দেয়।

অথচ ইসলামে এ রকম ফোল্ডিং সিস্টেম জায়েজ নেই। আর তুই যে এই ড্রাগনের ছবি ছাপা সার্ট গায়ে দিয়েছিস, এটাও ইসলামের দৃষ্টিতে না জায়েজ। এই জামা গায়ে দিয়ে নামায তো হবেই না, উপরন্তু যারা তোর সঙ্গে নামায পড়বে তাঁদের দৃষ্টি যদি তোর জামার দিকে যায়, তা হলে তাদেরও নামায হবে না।

এমন কি যাদি কেউ নামাযের মধ্যে না দেখে সালাম ফিরাবার পর কারুর নজর কোনো প্রাণীর ছবির উপর পড়ে, তবে তার নামায ও অযু দুটোই নষ্ট হবে। তাকে আবার অযু করে সেই নামায পুনরায় পড়তে হবে।

তারপর নিজের একটা জামা নোমানের হাতে দিয়ে মহি বলল, তোরটা খুলে এটা পরে মসজিদে চল।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দু’বন্ধুতে নানারকম গল্প করার পর বিকেলে আসরের নামায পড়ে তাদেরকে বিদায় দিল।

তারপর মহি নিজের কাজে বের হল। রাস্তার মোড়ে টেম্পুতে উঠতে হঠাৎ মনে পড়ল, আজ মিমির সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। সকালে অবশ্য ভেবে রেখেছিল, বায়তুল মোকাররমে জুম্মার নামায পড়ে মিমির সঙ্গে দেখা করবে।

কিন্তু দোস্ত নোমান তার বৌকে নিয়ে আসাতে সে কথা একদম ভুলে গেছে। এখন মনে পড়তে ভাবল, ওয়াদা খেলাপ করে গোনাহ করে ফেললাম। আবার ভাবল, এটাই হয়তো আল্লাহপাকের ইচ্ছা। তিনি ভুলিয়ে দিয়ে তার চেয়ে বেশি গোনাহর হাত থেকে রক্ষা করলেন।

কেন না
বেগানা যুবক-যুবতীদের একসঙ্গে মেলামেশা হারাম।
মিমি আজ নিজে গাড়ি ড্রাইভ করে এসে বায়তুল মোকাররমের উত্তর দিকের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে পৌনে দু’টো থেকে গেটের কাছে অপেক্ষা করছে।

সে গতকাল নিউমার্কেট থেকে একটা জর্জেটের কাল রুমাল ও হাল্কা ঘিয়ে রংয়ের বড় ওড়না কিনেছে। মহি তাকে এগুলো সব সময় পরতে বললেও সে বাসায় পরে না। কারণ সে জানে তার বড় আপা জুলিকে তার লাভার শাহিন ঐসব পরতে বলায় সে বাসাতেও পরত বলে মাম্মী তাকে অনেক বকাবকি করত।

তাই মিমি গতকাল কিনলেও মাম্মীর ভয়ে বাসায় পরে নি। কিন্তু আজ বেরোবার সময় এগুলো গোপনে সঙ্গে নিয়ে এসে গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় পরেছে। সে যখন এসে দাঁড়াল তার আগে থেকে লোকেরা নামায পড়ে বেরোচ্ছে। মিমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে লক্ষ্য রাখল।

এক সময় সব লোক বেরিয়ে এল; কিন্তু মহিকে দেখতে পেল না। ভাবল, সময় মতো আসতে পারে নি বলে নিজেদের এলাকার মসজিদে নামায পড়ে আসবে? দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার পা ব্যথা হয়ে গেল। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে গাড়িতে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

শেষে যখন সে অধৈর্য হয়ে পড়ল তখন পাঁচটা বাজে। চিন্তা করল, মহি এল না কেন? ইচ্ছা করে, না ভুলে গেছে? আবার চিন্তা করল, তার কি কোনো অসুখ করল। সেদিন বাসার ঠিকানা নেওয়া উচিত ছিল। শেষে ফিরে যাওয়ার মনস্থ করে গাড়ি ছেড়ে দিল।

হঠাৎ মনে জাগল, গুলিস্তানে একটু খোঁজ নিলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। গুলিস্তান এসে গুলিস্তান বিল্ডিংয়ের পূর্ব দিকের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে রাস্তা পার হয়ে এসে পশ্চিম দিকের ফুটপাতে খোঁজ করল। পেল না। তখন তার ধারণা দৃঢ় হল, নিশ্চয় মহির অসুখ করেছে।

অথবা অন্য কোন কারণ ঘটেছে। ফিরে এসে গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় মহিকে ফুটপাত দিয়ে চলে যেতে দেখল।
মহি গুলিস্তানের মোড়ে টেম্পু থেকে নেমে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে নবাবপুর রোডের আসছিল। ওখান থেকে রিক্সায় সদরঘাট যাবে।

মিমি তাকে দেখতে পাওয়ার আগে সে কিছুটা এগিয়ে গেছে।
মিমি তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা ঠেলে বন্ধ করে একটু জোরে হাঁটতে হাঁটতে ডাকল, মহি দাঁড়াও।

মহি মিমির গলা শুনতে পেয়ে চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, মিমি তার কথামতো মাথায় রুমাল বেঁধেছে এবং গায়ে ওড়নাও দিয়েছে। তার মনে তখন একটা শান্তির শিহরণ খেলে গেল। মুখের দিকে চাইতে মনে হল মিমিকে বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

ভাবল, তা হলে কি সে সেই দুটো থেকে অপেক্ষা করে না পেয়ে এখানে খোঁজ করতে এসেছে? মিমি কাছে এসে অভিমান ভরা কণ্ঠে বলল, কোনো কথা এখন বলবে না, লক্ষ্মী ছেলের মতো আমার সঙ্গে এস।

মহি মিমিকে দেখে মনে করেছিল, যা মেজাজি মেয়ে, কত কড়া কথা না শোনাবে। ফুটপাতেই না কোনো সীন ক্রিয়েট করে বসে। তেমন কিছু করল না দেখে মহি চুপচাপ তার সাথে এসে গাড়িতে উঠল।

মিমি গাড়ি চালিয়ে সোজা রমনা পার্কের রেস্টুরেন্টে এসে গাড়ি পার্ক করল। তারপর মহিকে নিয়ে একটা কেবিনে বসে জিজ্ঞেস করল, কি খাবে, ভারী না হাল্কা?

রাস্তায় মহি কিছু বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মিমি কিছু বলছে না দেখে সেও কিছু বলে নি। সারা রাস্তায় তার মনে হয়েছে মিমির প্রতি খুব অবিচার হয়েছে। এখন তার কথা শুনে বলল, আমি শুধু একটা ফান্টা খাব। তুমি যা খুশী খেতে পার।

মিমি ভার ভার গলায় বলল, আমি কিন্তু এখনো লাঞ্চ করি নি। ড্যাডী বাসায় খেয়ে বেরোতে বলেছিল। আমি বলেছি এক বন্ধুর সঙ্গে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, তার সঙ্গে হোটেলে খাব।

ড্যাডী আর কিছু বলে নি। মাম্মী অবশ্য ছেলে বন্ধু না মেয়ে বন্ধু জিজ্ঞেস করছিল। আমি কিছু না বলে চলে এসেছি।
কথাগুলো শুনে মহির যেমন লজ্জা পেল তেমনি অনুশোচনাও হল। বলল, সত্যি মিমি, আমি খুব দুঃখিত।

সকালে ভেবে রেখেছিলাম, বায়তুল মোকাররমে নামায পড়ে দু’জনে হোটেলে খাব। কিন্তু সেই বন্ধু নোমান, তার বৌকে নিয়ে এসে পড়ায় সে কথা একদম ভুলে গেছি। বল, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ?

ভুল হলে ক্ষমা তুমি পাবে। কিন্তু বার বার যদি কর, তা হলে আমার যে খুব কষ্ট হবে। আমি তো মনে করছিলাম, কোনো বিপদ, মানে অসুখ-বিসুখ হল কিনা। দেরি দেখে তাই ভেবে তোমাদের বাসায় যেতে চেয়েছিলাম।

সেদিন ঠিকানা চাইলাম দিলে না। ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে বলল, আগে ঠিকানা লিখে দাও। তারপর অন্য কথা।

মহি ঠিকানা লিখে দিয়ে বলল, দুপুরে কিছু খাও নি। এখন কিছু খেলে হত না? সে বেয়ারাকে ডেকে মিমিকে বলল, কি খাবে অর্ডার দাও।

মিমি বলল, এখন আর ভাত খাব না। মোগলাই পরোটা আর দুটো ফান্টা বেয়ারাকে আনতে বলল। বেয়ারা তাই দিয়ে যাওয়ার পর খেতে খেতে মিমি জিজ্ঞেস করল, ড্যাডীর অফিসে গিয়েছিলে?

গেলে তুমি নিশ্চয় জানতে পারতে।
যাও নি কেন? না, যাবে না বলে ঠিক করেছ?
না তা নয়, সে কথা এখনো ভাববার সময় পাই নি।
কবে সময় হবে?

মহি উত্তর না দিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
কিছু না বলে অমন করে কি দেখছ?
তোমাকে।
কেমন দেখলে?

বলব না।
কেন?
সেটা আমার ইচ্ছা।
আমার কি জানার অধিকার নেই?
আছে। তবে বলছ না কেন?

কি দেখলাম আমি নিজেই ঠিক বুঝতে পারছি না।
তোমাকে কি বলব?
না বোঝার কি আছে?
আমি দেখতে খারাপ না ভালো তাও তো বলতে পার?

পারি, কিন্তু আমি তা দেখছি না।
এক্ষুনি তো বললে আমাকে দেখছ?
তা বলেছি।

আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার অন্তরটা দেখছিলাম।
সেখানে কি দেখলে?
বললাম তো ঠিক বুঝতে পারছি না।

আমি কিন্তু তোমার অন্তর, বাহির সব বুঝে নিয়েছি।
ভালো।
কি ভাল?
যা বুঝেছ।

কি বুঝলাম, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে না?
হলে কি আর তুমি বলবে?
জিজ্ঞেস করে দেখ না।
বল।

তুমি একটা গবেট ও ভীতু।
মহি মৃদু হেসে বলল, তা হবে।
না, তা হওয়া চলবে না।
কেন? তুমি তো নিজেই বললে।

এবার মিমিও মৃদু হেসে বলল, সত্যি তুমি গবেট ও ভীতু। তা না হলে তোমার জন্য যে সারাদিন না খেয়ে কত কষ্ট উপেক্ষা করে অপেক্ষা করল, যে তোমার জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারে, তাকে তুমি মনের কথা বলতে পারছ না।

ভাবছি, কি করে ইংলিশে অনার্স পেলে? আবার ব্যবসাও করছ। আচ্ছা, ঐ সাবজেক্টের মেয়েরা অন্যদের থেকে বেশি ফ্রি, তাদের কারো সাথে তোমার কিছু হয় নি?

মহি কথা না বলে একটু কঠিন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
মিমি আব্দারের সুরে বলল, তুমি ঐভাবে তাকিয়ে রয়েছ কেন? আমার যে ভয় করছে।

মহি সামলে নিয়ে নরম সুরে বলল, আমাকে গবেট ও ভীতু বললে, কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ঐ সব গুণে তুমিও গুণান্বিতা।
তুমি যখন বলছ, তা হলে তাই।
না, তা হওয়া চলবে না।

কেন, তুমি তো নিজেই বললে।
মহি হেসে উঠে বলল, হলে দুজনেই, নচেৎ কেউ না। তারপর বলল, চল বাইরে পার্কে গিয়ে বসি।

ওখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা নির্জন জায়গা খুঁজতে লাগল। সকালে, দুপুরে কি বিকেলে, পার্কে নির্জন জায়গা পাওয়া খুব মুশকিল। সব জায়গা সব সময় প্রেমিক- প্রেমিকাদের দখলে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর লেকের ধারে আধা পছন্দ একটা জায়গা পেয়ে সেখানে মুখোমুখি বসে কিছুক্ষণ দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।

এক সময় মহি দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।
বল কি বলবে।

যা কিছু বলব শোনার পর ভেবে-চিন্তে উত্তর দিও। এখনই যে দিতে হবে তা নয়, ভেবে-
চিন্তে পরে দিলেও চলবে।
সেটা আমার ব্যাপার। কি জানতে চাও বল।

তুমি প্রথম আলাপের দিন বলেছিলে আমাকে তুমি গভীরভাবে ভালবাস, আর আজ বললে আমার জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পার। কিন্তু একবারও ভেবে দেখেছ, আমি কি ধরনের ছেলে? আমার চরিত্র কেমন?

তুমি একটু আগে যে কথা জিজ্ঞেস করলে, তার উত্তরে আমি যদি বলি ভার্সিটিতে পড়ার সময় অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছি। তা জেনেও কি তুমি আমার সঙ্গে প্রেম করবে? তা ছাড়া আমার আর্থিক অবস্থা কেমন তা তুমি কিছুটা জান।

তোমার বাবা- মা জানার পর আমাকে পছন্দ করবেন না। সব শেষে আমার বাড়ির পরিবেশ ও আমার মেজাজ ও স্বভাব-চরিত্র তোমার জানা উচিত। আলাপি বা বন্ধু এক জিনিস, আর প্রেম- ভালবাসা আর এক জিনিস এবং বিয়ে হল সব থেকে কঠিন ব্যাপার।

আমাকে দেখে এবং আমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে হয়তো আমার কিছু জিনিস তোমার পছন্দ হয়েছে। তাই আমাকে যেমন ভালবেসে ফেলেছ, যখন আমার খারাপ জিনিসগুলো তোমার চোখে ধরা পড়বে তখন ঠিক তেমনি সেই ভালবাসার বদলে ঘৃণাও অবহেলা করতে শুরু করবে।

তবে ভালবাসা আর প্রেম সম্পূর্ণ দুটো আলাদা জিনিস। যদিও দুটোর শাব্দিক অর্থ প্রায় এক। ভাললাগা থেকে ভালবাসার জন্ম হয়। যদিও আমরা প্রেম শব্দকে ভালবাসার মতো ব্যবহার করি। আর এখানেই আমরা মারাত্মক ভুল করি এবং আমরা প্রেম শব্দটাকে মিস ইউজও করি।

সেইজন্য আমরা সচরাচর বলে থাকি, অমুক ছেলে-মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে। অমুক ছেলে বা মেয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করেছে। আমি বলব ঐ সব ভুল কথা। প্রেমের বদলে ভালবাসা শব্দটা ব্যবহার করা ন্যায় সঙ্গত হত।
মিমি জিজ্ঞেস করল, তা হলে প্রেম কি?

প্রেমের আভিধানিক অর্থ হল-ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা ও পরিণয় ইত্যাদি। এগুলোকে মানুষ কলুষিত করতে পারে। কিন্তু আসল প্রেমকে কেউ কোনো দিন কলুষিত করতে পারে না। কারণ প্রেম হল আল্লাহ পাকের বহুত বড় নেয়ামত।

একমাত্র তিনিই যাকে ইচ্ছা করেন তাকে দিতে পারেন। প্রেম হল বেহেস্তের ফল। যাদের মধ্যে প্রেমের বীজ অংকুরিত হয়, তাদের মধ্যে কোনরকম হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, মোহ-মাৎশ্চার্য থাকতে পারে না। চাই সে প্রেম আধ্যাত্মিক হোক বা জাগতিক হোক অথবা কোন মানব-

মানবীর হোক। আসল প্রেমের উৎস হল স্বয়ং সৃস্টিকর্তা মহান প্রভু আল্লাহপাকের কাছ থেকে। প্রেম হল মহাসমুদ্র। সমুদ্রের যেমন কোনো কুল কিনারা নেই, তেমনি প্রেমের সাগরের ও কোনো সীমা পরিসীমা নেই। সেই সাগর পাড়ি দিতে প্রচুর বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

দক্ষ নাবিক যেমন প্রবল ঝড়-তুফানের বাধা ঠেলে জাহাজ নিয়ে সমুদ্র অতিক্রম করে, তেমনি আসল প্রেমিক-প্রেমিকাদেরকেও হাজার রকমের বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করতে হয়। অনেক সময় যেমন দক্ষ নাবিকেরা শত চেষ্টা করে ও গন্তব্য স্থানে পৌছাতে পারে না, তারাই শুধু পারে যাদের আল্লাহপাক সাহায্য করেন।

তেমনি প্রেমিকদের বেলায়ও ঠিক ঐ একই রকম। আজ কালের প্রেম কাহিনী দেখে-শুনে আমার যেমন হাসি পায়, তেমনি দুঃখও লাগে। অনেকে প্রেম করে বিয়ে করে বেশি দিন ঘর-সংসার করতে পারে না। আবার অনেক ছেলে প্রেম করে ব্যর্থ হয়ে মেয়ের মুখে এ্যাসিড মারে অথবা আত্মহত্যা করে।

এমনও হামেশা দেখতে পাওয়া যায়, প্রেমের পিরিয়ডে তাদের যৌন মিলনও হচ্ছে এবং অনেক মেয়ে প্রেগনেন্ট হয়ে জারজ সন্তান জন্ম দিচ্ছে। আবার কেউ অ্যাবরসন করাচ্ছে। বর্তমানে সমাজে প্রেমের নামে পঞ্চতত্বের খেলা চলছে। তুমি লাইলী-মজনুর প্রেমের কথা শুনেছ কিনা জানি না।

মিমিকে মাথা নাড়তে দেখে মহি বলল, লাইলী ছিল এক ধনী সওদাগরের মেয়ে। আর মজনু ছিল এক বাদশাহর ছেলে। মজনুর আসল নাম কায়েস। যখন সে লাইলীর প্রেমে পাগল হয়ে গেল তখন তার নাম হল মজনু। মজনু শব্দের অর্থ হল পাগল।

একদিন মজনু বন্ধুদের সঙ্গে বসে গল্প করছিল, এমন সময় লাইলীদের একটা কুকুরকে তাদের পাশ দিয়ে যেতে দেখে মজনু তাকে জড়িয়ে ধরে তার পায়ের থাবায় চুমো খেতে লাগল। তাই দেখে বন্ধুরা হো হো করে হেসে উঠল।

তাদের মধ্যে একজন বলল, কায়েস সত্যিই তুই মজনু হয়ে গেছিস। তা না হলে কুকুরের পায়ের থাবায় কেউ চুমো খায়?
মজনু মৃদু হাসি দিয়ে বলল, তোরা যা বললি, তা তোমাদের কাছে ঠিক; কিন্তু আমার কাছে নয়। আমি কুকুরের পায়ের থাবায় চুমো খাচ্ছি কেন জানিস?

এই কুকুর লাইলীদের, লাইলী তাদের বাড়িতে যেসব জায়গায় চলাফেরা করে। এই কুকুরও সেসব জায়গায় চলাফেরা করে। লাইলীর পায়ের ধুলো এই কুকুরের পায়ের থাবায় লেগে আছে। কুকুরের পায়ের থাবায় নয়, বরং লাইলীর পায়ের ধুলোতে আমি চুমো খাচ্ছি।

“সুবহান আল্লাহ”, প্রেম কাকে বলে বুঝতে পারলে?
মিমি জিজ্ঞেস করল, “সুবহান আল্লাহ” বললে কেন? এ কথার মানে কি?

“সুবহান আল্লাহ” শব্দের মানে হল আল্লাহপাক পবিত্রময়। কোনো আশ্চর্যজনক কথা শুনলে আল্লাহ পাকের পবিত্রতার বর্ণনা করতে হয়। তারপর বলল, আজকাল ছেলে-মেয়েরা প্রেম করার পরেও তাদের প্রেমিক বা প্রেমিকা অপেক্ষা সৌন্দর্যশীল ও ধনী ছেলে বা মেয়ে পেলে প্রাক্তনদের পরিত্যাগ করে নতুনের দিকে ধাবিত হয়।

প্রেমিক-প্রেমিকার কারো একজনের অসুখ-বিসুখ বা এ্যাকসিডেন্ট হয়ে অঙ্গহানি হলে তখন প্রেম কপূরের মতো উড়ে যায়। আসল কথা কি জান, প্রেম মানে আগুন। আগুন যেমন সবকিছু পুড়িয়ে ভস্মিভূত করে, তেমনি প্রেমও মানব-মানবীকে পুড়িয়ে তারপর তাদের প্রেমাষ্পদের সঙ্গে মিলনের রাস্তা করে দেয়।

চাই সে প্রেম আধ্যাত্মিক হোক আর জাগতিক হোক। প্রেমের পথ বড় বন্ধুর ও অসংখ্য বিপদ শংকূলে। অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা এই পথে পা বাড়াতে গিয়ে পথের বিভীষিকা দেখেশুনে ফিরে এসেছে।

আবার কেউ কেউ বীরত্ব দেখিয়ে কিছুটা অগ্রসর হলেও ধৈর্য ধরতে না পেরে বিফল মনোরথে ফিরে এসেছে। শুধু তারাই সেই বিভীষিকাময় ও বিপদ শংকুল পথ অতিক্রম করতে পারে, যাদের প্রেম খাটি এবং যাদের উপর আল্লাহপাক রাজি থাকেন।

প্রেমের ব্যাখ্যা তো শুনলে, কি মনে হচ্ছে-প্রেম করবে, না বন্ধুত্ব বা ভালবাসা পাতাবে?
অবশ্য ভেবে-চিন্তে পরে উত্তর দিতে পার। সেকথা তো আগেই বলেছি।

মিমি এতক্ষণ পুত্তলিকাবৎ বসে একাগ্রচিত্তে মহির কথা শুনছিল। তার প্রশ্ন শুনে আরো কিছুক্ষণ ঐভাবে থেকে কিছু যেন ভাবল। তারপর বলল, আমি প্রেম করব কি? অলরেডী তো করেই ফেলেছি। এখন আর ভাবনা-চিন্তার কিছু নেই।

মহি বলল, কঠিনটাতে পা বাড়ালে কেন? ওটাতে হাজারো বিপদ। বরং ভালবাসার পথে পা বাড়াও। যখন ইচ্ছা তা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। একজনের সঙ্গে অসুবিধে দেখা দিলো অন্যের সঙ্গে সহজেই ঐ পথে পা বাড়ান যায়।

মিমি বলল, তুমি ভীষণ চালাক। আমি তোমাকে গবেট বলে মস্ত বড় ভুল করেছি।
আসলে আমিই গবেট।
মহি হেসে উঠে বলল, আমরা কেউ চালাকও নই আর গবেটও নই। আসলে আমরা কোনটাই নই।

মিমিও হেসে উঠে বলল, তা হলে আমরা কি?
আমরা এমনই অন্যান্য সাধারণ ছেলের মত।
এটা কি সঠিক উত্তর হল?
কেন হল না?

তুমি নিজেই চিন্তা করে দেখ। আমার মনে হচ্ছে তুমি উত্তরটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছ।
তোমার অনুমান ঠিক। আমরা হলাম বলে মহি মিমির চোখের দিকে চুপ করে তাকিয়ে রইল।
কি হল চুপ করে গেলে কেন?

চোখ সরিয়ে নিয়ে মহি বলল, জানি না।
জান, অথচ বলতে চাচ্ছ না, আমি তা হলে বলি?

বল।
আমরা হলাম বলে সেও কয়েক সেকেন্ড মহির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, একদম ছেলে
মানুষ।
এই কথায় দুজনেই হেসে উঠল।

মহি বলল, খুব সত্যি কথা বলেছ। প্রেমের আসল ব্যাখ্যা না জেনে আমরা প্রেম করতে গিয়ে ছেলেমানুষি করতে যাচ্ছিলাম।
মিমি বলল, আমার কথা সত্য হল কি করে? আমি না জানলেও তুমি তো জানতে। এখন তোমার কথাতেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তুমি জেনে-শুনে আমার সঙ্গে প্রেমের পথে পা বাড়িয়েছ।

আমি না হয় ভুল করে জেনেশুনে ঐ পথে পা বাড়িয়েছি। তুমি নিশ্চয় এখন জেনেশুনে আর এ পথে এগোবে না?
মিমি অশ্রুভরা নয়নে বলল, আমি এগোব না সে কথা কখন বললাম? তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।

মহি বলল, কাঁদছ কেন? বল নি তা স্বীকার করছি। আমার বলার উদ্দেশ্য হল, না জেনে কেউ দুর্গম পথে পাড়ি দেওয়ার পর যখন পথের বিপদের কথা জানতে পারে তখন বুদ্ধিমানেরা আর অগ্রসর না হয়ে ফিরে আসে। সেই রকম অনুমান করে বলেছি।

তোমাকে কাঁদাবার জন্য বা দুঃখ দেওয়ার জন্য বলি নি।
মিমি চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি আর ফিরব না। মৃত্যুদূতও যদি এসে আমার পথ রোধ করে দাঁড়ায়, তবু না। কথা শেষ করে সে ফুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢাকল।

মহি শুধু মিমির রূপে নয়, তার সরলতায় ও তার গভীর প্রেমের উক্তি শুনে নিজেকে হারিয়ে ফেলল। চিন্তা করল, মিমিকে সে আর ফেরাতে পারবে না এবং সেও মিমিকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে খুব মিষ্টি সুরে মিমি বলে ডাকল।

মিমি তখনও ফুলে ফুলে কাঁদছিল। মহির মিমি ডাকের মধ্যে যে এত মধু, তা সে আর কোনো দিন অনুভব করে নি। সাড়া না দিয়ে আর একবার ঐ মধুমিশ্রত ডাক শোনার জন্য অপেক্ষা করল।

মহি কয়েক সেকেন্ড পর আবার ডাকল, মিমি আমার দিকে তাকাও। এবার মিমি ধীরে ধীরে হাত দুটো নামিয়ে অশ্রুভেজা নয়নে তার দিকে তাকাল। দেখল, মহির চোখও অশ্রুপূর্ণ। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। মহি বলে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেল।

মহি তা বুঝতে পেরে খপ করে তার হাত দুটো ধরে বলল, এ তুমি কি করছ মিমি? চারদিক লোকজন রয়েছে না? তা ছাড়া বিয়ের আগে আমরা আলিঙ্গনাবদ্ধ হতে পারি না। এটা আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) কুরআন-হাদিসে বর্ণনা করছেন।

মিমি লজ্জা পেয়ে জড়সড় হয়ে বলল, না জেনে আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল করে ফেলেছি। আজ কিন্তু একটা হাদিস কিনে দিতে হবে। আর সেই সঙ্গে একটা ব্যাখ্যাসহ কুরআনও। সেগুলোতে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (দঃ) কি বলেছেন আমার জানতে বড় ইচ্ছে করে।

মহি বলল, এটা তো খুব ভালো কথা। প্রত্যেক মুসলমান নর নারীর এগুলো পড়া উচিত। যদি পড়ত, তা হলে বিপথগামী না হয়ে আল্লাহ ও রাসুলের (দঃ) প্রদর্শিত পথে চলার প্রেরণা পেয়ে সেই পথে চলার চেষ্টা করত। আজ ফেরার পথে কিনে দেব।

আর শোন, তুমি ভার্সিটিতে পড়লে কি হবে, তোমার পার্থিব জ্ঞান এখনো হয় নি। তাই কয়েকটা কথা বলছি, আমার মন বলছে তোমার সাথে সম্পর্কের কথা যখন তোমার বাবা-মা জানতে পারবেন তখন থেকে একটা ঝড় তোমার উপর বইতে শুরু করবে।

সেই ঝড়ের তাণ্ডব সহ্য করতে না পেরে ঝট করে নিজে কোনো ডিসিশান নেবে না। প্রতিদিন আমার সঙ্গে দেখা হওয়া সম্ভব নয়। কেন না, আমাকে নানান কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মন দিয়ে পড়াশোনা কর।

অবসর সময়ে কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা এবং মুসলিম বিশ্বের যে সমস্ত নারী-পুরুষ ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের জীবনীও পড়। যখন মন খারাপ লাগবে তখন আমাকে ফোন করবে। ঠিকানায় ফোন নাম্বার দিয়ে দিয়েছি।

তোমাদের ফোন আছে এতদিন জানাও নি কেন?
এতদিন কোথায় হল? মাত্র তো দু’দিন আলাপ হল। আমাকে রাত বারটার পরে ফোন করবে। অবশ্য সকাল দশরটার মধ্যেও করতে পার।

তবে তখন আমি কাজে ব্যস্ত থাকব। অত রাত্রে ফোন করলে যদি অন্য কেউ ধরে তা হলে কি হবে?
কিছুই হবে না। ফোনটা আমার ঘরেই আছে। অত রাতের কথা বলছ? কাজ সেরে বাসায় ফিরতেই সাড়ে এগারটা বেজে যায়।

তারপর খাওয়া-দাওয়া করে হিসাবপত্র শেষ করে ঘুমোতে দেড়টা দুটো বেজে যায়।
কি এমন কাজ কর? প্রতিদিন এত রাত হয়ে যায়? তার চেয়ে তুমি ড্যাডীর সঙ্গে দেখা কর। সে তোমাকে তার অফিসে একটা ভালো কাজ দিয়ে দেবে।

দেখ মিমি, আমি কি করব না করব সেটা আমাকে ভাবতে দাও। নিজের চেষ্টায় কিছু করে বড় হওয়া কি ভালো নয়? স্বীকার করছি তোমার ড্যাডীর কাছে গেলে তিনি আমাকে অনেক বেতনের একটা চাকরি দেবেন। কিন্তু সারা জীবন আমার মনে একটা অশান্তির কাঁটা থেকে যাবে।

আমি চিরকাল বিবেকের কাছে এবং তোমার কাছে ছোট হয়ে থাকব। তুমি কি তা চাও? তুমি কি চাও না, তোমার প্রিয়তম নিজের চেষ্টায় বড় হোক? চাকরির চেয়ে ব্যবসাতে আল্লাহপাক বেশি বরকত দান করেন।

অবশ্য আমি আমার প্রিয়তমাকে খুশী করার জন্য চাকরি করি আর নাই করি, অফিসে তার ড্যাডীর সঙ্গে দেখা করব।
মিমি কয়েক সেকেণ্ড মহির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমার নির্বুদ্ধিতার জন্য ড্যাডীর কাছে চাকরির জন্য যেতে বলে তোমাকে অপমান করেছি।

আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আর কখনো বলব না।
মহি হাসি মুখে বলল, তোমার কোনো অন্যায় হয় নি। তোমার সরলতার কারণে বলেছ। জেনে রেখ, আসল প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যের দোষ-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখে।

যাই হোক, আজ যেভাবে কাপড় পড়ে এসেছ, বাসার বাইরে বেরোবার সময় সব সময় এইভাবেই বেরোবে। এর ফলে হয়তো তোমাকে তোমার ড্যাডী ও মাম্মীর অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।

মিমি বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তারা যে আমাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করবে, তা তুমি
অনুমান করলে কি করে?

জ্ঞানের অনুভূতিতে মানুষ ভবিষ্যতের অনেক কিছু অনুমান করতে পারে এবং তার বেশির
-ভাগ সত্য হয়।
তোমার অনুমান ঠিক, জুলি আপাকেও মাম্মী এই ব্যাপারে অনেক বকাবকি করত।
জুলি কে?

বললাম তো আপা। সে আমার থেকে পাঁচ বছরের বড়। বছর তিনেক হল হারিয়ে গেছে। জুলি আপা তখন এম.এ পড়তো। একদিন ভার্সিটি থেকে আর ফিরে আসে নি। মহি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা, মানে তোমার ড্যাডী-মাম্মী তাঁর খোঁজ করেন নি?

খোঁজ আবার করে নি। থানা পুলিশে জানান হল। খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হল।
কত জায়গায় খোঁজা হল। কোনো কিছুতেই পাওয়া গেল না।
কিন্তু তোমার জুলি আপা হারিয়ে গেল কি করে?

তিনি কি ছোট মেয়ে যে, হারিয়ে গেলো আর তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না?
তা জানি না। জুলি আপা হারিয়ে গেছে শুনে আমি কয়েকদিন কেঁদেছিলাম। আমাকে খুব ভালবাসত। মাম্মীও খুব কেঁদেছিল। এখনও মাঝে মাঝে কাঁদে।

আমার মনে হয়, তোমার জুলি আপা হারিয়ে যায় নি। নিশ্চয় কোথাও না কোথাও আছে। আসলে ইচ্ছে করে তোমাদের কাছ থেকে দূরে চলে গেছেন, তার চলে যাওয়ার পিছনে নিশ্চয় কোেনা কারণও আছে।

আমি শুনে খুব আশ্চর্য হচ্ছি, তুমি এত কিছু অনুমান করে বলতে পারছ কি করে?
মিমির প্রশ্ন শুনে মহি মৃদু হেসে বলল, একটু আগে বললাম না, জ্ঞানের অনুভূতিতে ভূত- ভবিষ্যতের অনেক কিছু অনুমান করে বলা যায়?

তুমি একটু আগে বললে, তোমার মাম্মী জুলি আপাকে মাঝে মাঝে বকাবকি করতেন? কিন্তু কেন বলতে পার?
জুলি আপা যে ছেলের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করতে চেয়েছিল। মাম্মী তাকে একদম পছন্দ করত না।

কারণ?
কারণ ছেলেটা তবলীগ জামাত করত। লম্বা জামা ও মাথায় সব সময় টুপি দিয়ে থাকত। মাম্মী মৌলভী ধরণের ছেলেদের একদম দেখতে পারে না।

মহির মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, তোমার জুলি আপা তবলীগ জামাতের একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করে তাকে বিয়ে করতে না পেরে হারিয়ে গেছেন। এখন তুমিও আবার দাঁড়িওয়ালা একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম করছ। তোমার সাহস তো কম না?

তোমার ড্যাডী-মাগী জুলি আপাকে বাধা দিয়ে তাকে হারালেন। তোমার বেলায় কি হবে খুব চিন্তার কথা। তুমি কি এ ব্যাপারে কিছু ভেবে দেখছ?
না ভাবিনি।
কেন?

ভেবে কি করব? যা ভাগ্যে আছে তা হবেই। ভাগ্যকে নিয়ে ভেবে কেউ কোনো দিন কিছু করতে পেরেছে? না ভাগ্যকে কেউ বদলাতে পেরেছে?

তা অবশ্য পারে নি। তবে অবাক হচ্ছি, সবকিছু জেনে তুমিও আবার এ পথে পা বাড়ালে কেন? আমিও তো তোমার জুলি আপার লাভারের মত ধর্মের আইন যথাসাধ্য মেনে চলার চেষ্টা করি।

ধর্মের আইন যারা মেনে চলে তারা ধার্মিক। আর ধার্মিক লোকেরা সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বড়। বড়র সঙ্গে কে নো প্রেম করতে চায়?
কিন্তু তোমার মা-বাবা তো তাদের পছন্দ করেন না?

তারা নাই করুক। তারা তো তোমার সঙ্গে প্রেম করছে না। করছি আমি। আমি ধার্মিক লোকদের খুব পছন্দ করি।
মহি হেসে উঠে বলল, কারণটা জানতে পারি?

অফকোর্স। কারণ ধার্মিক লোকেরা খুব চরিত্রবান হন। তাঁরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে অন্যায়কারীদের ধর্মের পথে আহবান করেন। তারা নিজেদের সুখ-শান্তির দিকে না তাকিয়ে দেশ ও দশের তথা সারা বিশ্বের সুখ শান্তি কামনা করেন এবং সেজন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পিছ পা হন না।

মারহাবা, মারহাবা, কি দারুণ কথা বললে। আচ্ছা, এসব কথা তুমি জানলে কেমন করে? জুলি আপা হারিয়ে যাওয়ার পর তার সব বই গুছিয়ে রাখতে গিয়ে “ফাজায়েলে আমল,” “হেকায়েতে সাহাবা” ও অনেক ধর্মীয় বই পাই। সেগুলোর মধ্যে ঐ বই দুটো আমি পড়েছি।

তুমি মারহাবা বললে কেন? ওটার অর্থ কি?
তোমার কথা শুনে আমি খুব আশ্চর্য যেমন হয়েছি তেমনি আনন্দিতও হয়েছি। তাই বললাম। শব্দটার শাব্দিক অর্থ ঠিক আমি বলতে পারব না, তবে ইসলামিক দৃষ্টি-ভঙ্গিতে তোমার প্রশংসা করলাম।

আমরা যেমন বাংলাতে বলি সাবাস, ধন্যবাদ, আবার ইংরেজিতে বলি থ্যাংক ইউ, ব্রাভো ইত্যাদি। আবার হাততালি দিয়েও আমরা ঐ সব কথা প্রকাশ করি। ইসলামে হাততালি দেওয়া নিষেধ। তার বদলে মারহাবা মারহাবা বলতে হয়।

তুমি না নিজেকে তখন গবেট বললে? তা ঠিক নয়। তুমি বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী। যাই হোক, সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আমাকে নামায পড়তে হবে। তুমি কি নামায পড়তে জান? তাকে মাথা নেড়ে অস্বীকার করতে দেখে বলল, হাদিস-কুরআন কিনে দেওয়ার সময় একসেট “বেহেস্তি জেওরও কিনে দেব।

তাতে নারী-পুরুষের ধর্মের প্রয়োজনীয় অনেক কিছু আছে। যা জানা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য। মাগরিবের আযান শুনতে পেয়ে বলল, তুমি এখানে একটু বস, আমি নামাযটা পড়ে আসি।

তারা লেকের ধারে বসেছিল। অপর পাড়ে তিন চারজন কেয়ার টেকার নামায পড়ার জন্য ঘাসের উপর পাটি বিছাচ্ছিল। মহি লেকের পানিতে অযু করে তাদের সঙ্গে নামায পড়ে ফিরে এসে বলল, এবার ফেরা যাক। বাসায় তোমার ড্যাডী-মাম্মী নিশ্চয় চিন্তা করছেন?

মিমি বলল, হ্যাঁ চল।
গাড়ির কাছে এসে মহি বলল, তোমাকে পৌছে দিই?
মিমি উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, তুমি আমাদের বাসায় যাবে?

মহি ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে বলল, বাসার গেট থেকে একটু দূরে পর্যন্ত যাব, বাসার ভিতরে নয়।
কেন?
এই দুষ্টু মেয়ে, এত প্রশ্ন তোমার মাথায় আসে কোথা থেকে?

যেখানে থেকেই আসুক, ভিতরে যাবে না কেন বল।
গেলে আজ থেকেই তা হলে তোমার উপর ঝড় বইতে শুরু করবে।
করুক গে।

না।
কি না?
ভিতরে যাওয়া চলবে না।
কেন?

এখন থেকে তোমার উপর ঝড় বইলে তোমার যেমন পড়াশুনার ক্ষতি হবে, তেমনি আমার উন্নতির রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে; বুঝেছ গবেট মেয়ে?

তখন বললে আমি খুব বুদ্ধিমতী, আর এখন গবেট হয়ে গেলাম?
যখন বুদ্ধিমানের মতো কথা বল তখন বুদ্ধিমতী, আর যখন গবেটের মতো কথা বলবে তখন গবেট।

একটু আগে আমাকে তো বললে কোথা থেকে এত আমার প্রশ্ন আসে। এখন আমি যদি বলি তোমার এত বুদ্ধি আসে কোথা থেকে?

ব্রেন থেকে। আমি ব্রেন খাটাই। তাই বুদ্ধি বের হয়। তুমিও খাটাও, দেখবে হড়হড় করে বুদ্ধি বেরোচ্ছে।
মিমি হেসে উঠে বলল, হড়হড় কি?

তা জানি না, শব্দটা ব্রেন থেকে বেরিয়ে এল অমনি আমিও বলে ফেললাম। এই কথায় দুজনেই হেসে উঠল।
মিমি বলল যাহ, ভুলে গেলে? কুরআন-হাদিস আর কি কি বই কিনে দেবে বললে?

ভুলি নি। নিউ মার্কেটে থেকে কিনে দেব।
নিউ মার্কেট থেকে সেগুলো কিনে মিমিকে তাদের বাসার কাছে পৌছে দিয়ে মহি গুলিস্তান ও সদরঘাটের দোকান থেকে টাকা আদায় করল।

তারপর নতুন মালের অর্ডার নিয়ে রাত সাড়ে বারটায় বাসার ফিরল।
ছেলেকে খেতে দিয়ে মালেকা বানু বললেন, আজ এত রাত হল কেন? এদিকে আবার তো ফজরের নামায পড়ে কাজ করতে আরম্ভ করবি।

মার্কেট থেকে একটু সকাল সকাল ফিরতে পারিস না? এত খাটা-খাটনি করলে শরীর টিকবে?
মহি বলল, আজ একজনের সঙ্গে এক জায়গায় গিয়েছিলাম। তাই মার্কেটের কাজ সারতে দেরি হয়ে গেল।

মালেকা বানু বললেন, আমি ভুলেই গেছি, বারটার দিকে একটা মেয়ে ফোন করে তোকে চাইল। এখনো ফিরিসনি শুনে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করল। পরিচয় দিতে বলল, আপনার ছেলে এতরাত পর্যন্ত বাইরে থাকে। আপনি তাকে নিষেধ করেন নি কেন?

আমি তার পরিচয় জানতে চাইতে বলল, আপনি চিনবেন না। আপনার ছেলেকে বলবেন, মিমি ফোন করেছিল,
আবার করবে”। মালেকা বানু জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটা কে রে? মেয়েটার কথা বলার টোন একদম ছেলেমানুষের মতো।

মহির মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। বলল, একদিন ফুটপাতে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে তার সার্ট কিনতে এসে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। বড় লোকের আদুরে মেয়ে। ভার্সিটিতে পড়ে। বাদ দাও তার কথা, তুমি বসে আছ কেন খেয়ে নাও না।

মালেকা বানু বললেন, তোর খাওয়া হয়ে গেলে খাব। চিটাগাং থেকে মোজাম্মেলের চিঠি এসেছে। এ মাসের টাকা এখনো সে পায় নি। তুই কি টাকা পাঠাস নি?

না পাঠান হয় নি। ভাবছি, কাল পাঠিয়ে দেব। খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে এসে হিসাব করতে বসল। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। মহি রিসিভার তুলে বলল, ইয়েস, মহি স্পিকিং, হু আর ইউ?
মিমি।

মিমি কি? আমার ছোট বোন আসিয়া তো রোজ এক প্যাকেট করে চুষে চুষে খায়।
তোমার খেতে ইচ্ছে করে না?
করে। তবে প্যাকেটের মিমি নয়, রক্ত-মাংসের মিমিকে।

কথাটা শুনে মিমি খুব লজ্জা পেয়ে চুপ করে রইল। কোনো কথা বলতে পারল না।
কি হল? কথা বলছ না কেন?
তা হলে খাচ্ছ না কেন?

এখনো সময় হয়নি বলে।
কখন হবে?
আল্লাহপাক জানেন, তিনি যখন খাওয়াবেন তখন।
এসব কথায় আমার লজ্জা করে না বুঝি?

করাই তো উচিত।
তবু বলছ কেন?
বলে দেখলাম, তোমার লজ্জা আছে কি না?
কি দেখলে?

আছে।
এখন এসব কথা বাদ দিয়ে বল, তুমি প্রতিদিন এত রাত করে বাসায় ফের কেন?
প্রতিদিন রাত হয়। কিন্তু আজকের মত এত রাত হয় না।
আজ হল কেন?

আজ রাস্তায় একটা যুবতী পাগলীর পাল্লায় পড়ে রাত হয়ে গেল। পাগলিটা এমনভাবে জড়িয়ে ধরেছিল, কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছিলাম না। শেষে ঘণ্টা তিনেক ধস্তাধস্তি করে তবে মুক্তি পাই।

আতঙ্কিত স্বরে মিমি বলল, সে কি? তা হলে তো খুব বিপদে পড়েছিলে? রাস্তায় লোকজন ছিল না? তারা কেউ তোমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে নি?

আমরাতো রাস্তায় ছিলাম না। পাগলিটা গুলিস্তান থেকে পিকআপ করে একেবারে রমনা পার্কে নিয়ে গিয়েছিল। তার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে মার্কেটের কাজ সারতে সারতে দেরি হয়ে গেল।

এতক্ষণে মিমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, তুমি না, তুমি না, বলে চুপ করে গেল। কি হল? তুমি না, তুমি না বলতে বলতে থেমে গেলে কেন? তুমি একটা আস্ত ত্যাঁদোড়।

কি বললে আমি ত্যাঁদোড়?
হ্যাঁ, ত্যাঁদোড় না তো কী?

ত্যাদোড় হলে পার্কে আজ তোমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়তাম। বটে? হ্যাঁ তাই। আচ্ছা দেখা যাবে। এই, তুমি আমাকে পাগলি বললে কেন? যে কারণে তুমি আমাকে ত্যাঁদোড় বললে। আমি তো আগে বলি নি। তুমি পাগলি বলার পর বলেছি।

তুমি তো আসলে পাগলি। অস্বীকার করতে পার, তুমি আমার প্রেমে পড়ে পাগল হও নি? তা করব কেন? তা হলে তুমিও তো ঐ দোষে দুষী? লোকেরা ঠিক কথাই বলে, নিজের দোষ কেউ দেখতে পায় না, শুধু অপরের দোষ দেখতে পায়।

আর তোমার দোষ ধরব না। ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দাও। ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও বলে মিমি ভেংচি কেটে বলল, এত ঘন ঘন ভুল করলে মাফ করতে পারব না বলে দিচ্ছি। এরই মধ্যে কতবার ভুল করেছ মনে আছে? আছে।

তা হলে আবার ভুল করলে কেন? ভুল করার সময় মনে থাকে না বলে। কেন মনে থাকে না কেন? মন কোথায় যায় শুনি? মিমির কাছে। এবার মিমি লজ্জিত সুরে বলল সত্যি? তিন সত্যি। তাই যদি হয়, তবে যতবার ভুল করবে ততবার মাফ করে দেব।

ভাবছি, মনটাকে তার কাছে থেকে ফিরিয়ে নেব।
কেন?

সব সময় ভুল হচ্ছে বলে। হোক ভুল। আমিও সব সময় মাফ করে দেব। কিন্তু ব্যবসার কাজেও যে ভুল হচ্ছে? এবার মিমি অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তো হলে তা চিন্তার কথা। আমিও তাই চিন্তা করছি। কি করা যায় বল তো? তুমি বল।

না তুমি। না, না তুমি। আচ্ছা, আমি বলছি, ব্যবসার কাজের সময় তোমার কথা মন থেকে দূরে রাখব। তা হলে আর ভুল হবে না।
কথাটা মন্দ বল নি। তবে অন্য সময় মনে রাখবে তো?

রাখব।
এখন কি করছ?
খেয়ে উঠে হিসাবে বসেছি আর তখনই মিমির ফোন পেলাম। এখন তার সঙ্গে খেজুরে
আলাপ করছি।

খেজুরে আলাপ আবার কি?
এই তোমাতে-আমাতে যা করছি।

জান, আজ খাবার টেবিলে ড্যাডী বলল, তুই কাকে চাকরি দেওয়ার জন্য কার্ড নিলি, সে তো কই আমার সঙ্গে দেখা করল না। অফিসে একজন এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার দরকার। ভাবছি, কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিলে নানান ঝামেলা হবে।

একটা পোষ্টের জন্য কয়েকশো এ্যাপ্লিকেশন পড়বে। তারপর তাদের ইন্টারভিউ-এর ব্যাপার। শুধু কি তাই, প্রতিদিন কয়েকশ টেলিফোন আসবে, যাতে তার লোক চাকরিটা পায়। আমি বললাম, তাকে কার্ড দিয়ে তোমার কাছে যেতে বলেছিলাম।

ছেলেটা বলল, আমি একটা কাজে ব্যস্ত আছি। সময় করে দেখা করব। ড্যাডী বলল, দু একদিনের মধ্যে না এলে ঝামেলা হলেও কাগজে বিজ্ঞপ্তি দেব। তুমি কি আগামী কাল ড্যাডীর সঙ্গে দেখা করবে?

করব।
মিমি উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, সত্যি বলছ?
আমি কোনো দিন মিথ্যা বলি না। কেন না মিথ্যা বলা হারাম। মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) পছন্দ করেন না। আর সমাজের কাছেও সে ঘৃণ্য। আমি কি সকালে ড্যাডীকে বলব, তুমি আজ তার সঙ্গে দেখা করবে?

না।
ঠিক আছে। একটা কথা বলব রাখবে?
রাখব, তবে রাখার মতো হলে।
তুমি এখন আর হিসাব করতে বস না, সকালে করো।

কেন? সারারাত বুঝি টেলিফোনে কথা বলবে?
মন তো তাই চাচ্ছে। তোমার চাচ্ছে না?

চাচ্ছে। কিন্তু এটা কি আমাদের উচিত হবে? এমনিতেই এতরাতে যা করছি তা কেউ কোনো দিন করেছে কিনা জানি না।
কারুর জানার দরকার নেই।
কিন্তু ঘুমের তো দরকার আছে।

এক রাত না হয় নাই ঘুমোলাম।
পরের রাত গুলোতেও এরকম করার জন্য মন চাইবে।
তা অবশ্য চাইবে।

তা হলে ভেবে দেখ, মন যা চায় তা সব সময় করা যায় না এবং তা করা উচিতও নয়। আমার আম্মা বা ছোট ভাই-বোনেরা বাথরুমে যাওয়ার যদি সময় আমাকে ফোনে এইসব কথা বলতে শোনে, তা হলে তারা কি ভাববে?

আর তোমার ভ্যাডী-মাম্মীও যদি তোমার কথা শোনেন, তা হলে ব্যাপারটা কি হবে চিন্তা করেছ? প্লিজ মিমি, এবার ফোন রেখে ঘুমিয়ে পড়। তা ছাড়া আমাকে এখন তাহাজ্জুদের নামায পড়তে হবে। আবার ভোরে উঠে ফজরের নামায পড়ব।

তাহাজ্জুদের নামায কি?
রাত সাড়ে বারটার পর থেকে ভোরে ফজরের নামাযের সময়ের আগে পর্যন্ত যে নামায পড়া হয় তাকে তাহাজ্জুদের নামায বলে। এই নামায যারা পড়ে তাদেরকে আল্লাহপাক খুব ভালবাসেন।

তোমাকে আজ বেহেস্তী জেওর নামে তিন খণ্ডে যে বই কিনে দিলাম, সেগুলো পড়লে সবকিছু জানতে পারবে। আজ এ পর্যন্ত থাক। রিসিভার রেখে ঘুমিয়ে পড় কেমন? রাখতে যে মন চাইছে না।

তবু রাখতে হবে।
না রাখব না।
আচ্ছা মিমি, তুমি কি নিজের মতো আমাকেও পাগল করে ছাড়বে?
আবার কিন্তু পাগল বলছ?

পাগল না তো কি? সারা রাত ফোনে প্রেমালাপ কথা লোকে তা জানতে পারলে পাগল ছাড়া আর কি বলবে?
লোকে যা কিছু বলুক, তাতে আমাদের কিকি যায় আসে?
আসে।

কি আসে?
সমাজের কথা আসে।
মানে?

মানে সমাজে বাস করতে হলে সমাজের সবকিছু মেনে চলতে হয়।
আমরা কি সমাজের বরখেলাপ কিছু করছি?
যা করছি, সমাজ তা জানতে পারলে নিন্দে রটাবে।

রটাক।
না রটাবে না।
তা হলে তো সব চুকে গেল। তবে তুমি আবার সমাজের কথা বলছ কেন? মিমির সরলতায় মাহি হেসে উঠল।
হাসলে কেন?

তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি একদম নেই।
নাই থাক।
থাকতে হবে।
কারণ?

বুদ্ধিশুদ্ধি না থাকলে প্রেম করবে কী করে? বিয়ের পর স্বামীর ঘর করবে কী করে? ছেলে- পুলে মানুষ করবে কী করে?
ওরে বাবা, তা হলে তো অনেক বুদ্ধি দরকার?

তাতো দরকার।
কিন্তু আমার তো অত বুদ্ধি নেই।
আমি দেব।
তুমি দিলে সবকিছু ম্যানেজ করতে পারব।

তা হলে এখন কিছু দিই।
দাও।
নেবে তো?
নিশ্চয়।

এখন আমি যা বলব তা বুদ্ধি দিচ্ছি মনে করবে?
করব।
বলি?
বল।

এখন রিসিভার রেখে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (দঃ) কথা স্বরণ করে ঘুমিয়ে পড়। পরে
যখন দরকার মনে করব তখন আরো বুদ্ধি দেব। এবার রাখছি।

এই শোন আর এক মিনিট, না-না, দু’ মিনিট। আমি ঘড়ির দিকে চেয়ে রয়েছি, দু’মিনিট হয়ে গেলে রিসিভার রেখে দেব। কালকে তোমার সঙ্গে কখন ও কোথায় দেখা হবে? হবে না। কেন হবে না? মিমির গলার স্বর খুব করুণ শোনাল।

কালকে আমি খুব ব্যস্ত থাকব। তা হলে পরশু? তাও ঠিক বলতে পারছি না। তার মানে তুমি আমাকে এড়িয়ে থাকতে চাইছ? তা যদি মনে কর, তা হলে আমার কিছু বলার নেই। রাগ করলে?

অল্প একটু। দু’মিনিট হয়ে গেছে। কাল কিন্তু রাতে ফোন করবে বলার সঙ্গে মিমি ওপাশে রিসিভার রাখার শব্দ পেল। সে রিসিভারটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তাতে একটা চুমো খেয়ে ক্রাডেলে রেখে দিল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত আড়াইটা।

মনে মনে খুব লজ্জা ও দুঃখ পেল। ভাবল, বেচারা সারাদিন খাটাখাটনি করে কোথায় ঘুমোবে, তা থেকে বঞ্চিত করে ভীষণ অন্যায় করলাম। তারপর মিমি ঘুমিয়ে পড়ল।

মহি বাসায় চার-পাঁচ জন দর্জী কর্মচারী রেখে কাপড় সেলাই করায়। সে ফজরের নামাযের পর থেকে সারাদিন কাপড় কেটে দেয়। আসরের নামাযের পর অর্ডার মোতাবেক দোকানে দোকানে সাপ্লাই দেয়। এই ব্যবসা শুরু করার আগে সে কাটারিং কলেজে ভর্তি হয়ে ছমাসের কোর্স শেষ করে।

তারপর একজন কার্টার মাস্টারের কাছে বেশ কিছুদিন কাজ করে হাত পাকা করেছে। সে রাতে মহি আর ঘুমাল না। তাহাজ্জুদের নামায পড়ে হিসাব করতে বসল। তারপর ফজরের নামায পড়ে কাপড় কাটতে লাগল।

বেলা এগারটার সময় জি.পি.ও. তে গিয়ে চিটাগাংয়ে ছোট ভাই মোজাম্মেলের কাছে এই মাসের খরচের টাকা মানি অর্ডার করল। তারপর মতিঝিলে হানিফ ম্যানসনে মিমির ড্যাডীর সঙ্গে দেখা করতে গেল।

রুমের দরজার বাইরে টুলে একজনকে বসে থাকতে দেখে তার কাছে গিয়ে বলল, আমি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। লোকটা বলল, ভিতরে যান, পি.এ. সাহেব আছেন, তাকে বলুন। মহি ভিতরে ঢুকে দেখতে পেল একজন মধ্যবয়সি লোক একমনে কিছু লিখছেন।

সে সালাম জানাল। লোকটা মুখে কিছু না বলে শুধু একটা মাথা নিচু করে হাতের ইশারায় বসতে বললেন। মহি তার টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। রুমটা এয়ার কণ্ডিশনার। মেঝেয় দামী কার্পেট। পাশাপাশি আরো কয়েকটা চেয়ার রয়েছে।

একপাশে একটা আলমারীতে নানারকম বই। রুমটা ডিস্টাম্বার করা। বাইরের কোলাহল ও গরম আবহাওয়া কোনোটাই এখানে প্রবেশ করতে পারে নি। দেওয়ালে কয়েকজন মৃত রাজনৈতিক নেতাদের ফটো টাঙ্গান।

হাতের কাজ সেরে ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, কি দরকার বলুন।
আমি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

একটা ছাপান স্লীপ প্যাড তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা পূরণ করুন।
মহি স্লীপটা পড়ে বলল, এটাতে উনি আমাকে চিনবেন না। তারপর কার্ডটা বের করে টেবিলের উপর রেখে বলল, এটা ওঁকে দেন, তা হলে হবে।

ভদ্রলোক কার্ডটা দেখেই ফেরৎ দিয়ে দরজা দেখিয়ে বললেন, ঐ রুমে যান।
মহি দরজা পুশ করে ভিতরে গিয়ে সালাম দিল।

উইদাউট ইনফরমেশানে কাউকে ঢুকতে দেখে হানিফ সাহেব ভ্রূকুটিপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন। মহির স্যান্ডসাম চেহারা ও তার গলার মিষ্টি স্বর শুনে পরক্ষণে তাঁর দৃষ্টির পরিবর্তন হল। কি সুন্দর ছেলে? যেমন লাবণ্যময় চেহারা, তেমনি শরীরের গড়ন।

চওড়া কপালের নিচে মিশমিশে কালো ভ্রুযুগল একসঙ্গে মিশে রয়েছে। ফর্সা চেহারায় ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ঠোঁটে সব সময় হাসির রেখা। ঠিক যেন মহাপুরুষের মতো। এ রকম ছেলে খুব কম দেখা যায়।

তাঁকে ঐ ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে মহি টেবিলের কাছে এগিয়ে আসার সময় আবার
সালাম দিল।

হানিফ সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন। কিছুটা অনুমান করতে পারলেন, তবু বললেন, আমি আপনাকে চিনতে পারছি না।

মহি কার্ডটা বাড়িয়ে ধরল।
হানিফ সাহেব কার্ডটার উপর একবার চোখ বুলিয়ে মৃদু হেসে বললেন, বসুন। সেদিন তা হলে মিমি তোমার জন্য, সরি, আপনার চাকরির ব্যাপারে বলেছিল?

মহি বলল, আমাকে তুমি করে বললে বাধিত হব।
হানিফ সাহেব, উঠে বললেন, দ্যাটস রাইট। তারপর কলিং বেল বাজাবার সময় বললেন, কি খাবে বল।
জি না, ওসব কিছু লাগবে না।

লাগবে না মানে? কিছু অন্তত পান কর। চা, কফি, কোকো? মহি কিছু বলল না দেখে আবার বললেন, তোমরা এখন ইয়ংম্যান। যা খুশী তাই খাবে। পিয়ন এলে তাকে হাল্কা নাস্তার সঙ্গে দুটো কোকো আনতে বললেন।

পিয়ন চলে যাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ইজ ইউর কোয়ালিফিকেশন?
অনার্স ইন ইংলিশ।
কবে পাস করেছ?

দু’বছর হয়ে গেছে।
এতদিন বেকার রয়েছ?
জি না, বাসায় সার্ট-প্যান্ট তৈরি করে মার্কেটে সাপ্লাই দিই।

মিমির সঙ্গে পরিচয় হল কি করে?
কয়েকদিন আগে মিমি ও সুমন গুলিস্তানের ফুটপাতে আমার কাছে থেকে একটা সার্ট কিনে। সেই সময় পরিচয় হয়।

হানিফ সাহেব অবাককণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ফুটপাতে কাপড় বিক্রি কর?
জি করি। আগে রেগুলার করতাম। এখন মাঝে মাঝে সময় পেলে এক-আধদিন করি।

ছেলেটা অকপটে সব কিছু বলছে দেখে হানিফ সাহেব আরো অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা কি করেন? বাবা ডাক বিভাগে চাকরি করতেন। বছর দুই হল এ্যাকসিডেন্ট করে মারা গেছেন।

তুমি বললে সার্ট কিনতে গিয়ে তোমার সঙ্গে মিমির পরিচয় হয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। শুধু পরিচয় থাকলেতো সে তোমার চাকরির জন্য আমাকে বলত না। নিশ্চয় আরো ব্যাপার আছে। যা তুমি গোপন করছ অথবা বলতে পারছ না।

আপনার দ্বিতীয় অনুমানটা ঠিক। কথাটা ঘোরাবার জন্য বলল, আমি কিন্তু চাকরির জন্য আসি নি। হানিফ সাহেব আবার অবাক হলেন। কয়েক সেকেণ্ড তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে কেন এসেছ?

মিমি কার্ড দিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল। তাই এসেছি।
আমার অফিসে এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারের পোস্ট খালি আছে। সেই পদে যদি তোমাকে
নিয়োগ করি, তা হলেও কি করবে না?

আমি চাকরির চেয়ে ব্যবসা অধিক পছন্দ করি এবং উত্তম ভাবী।
তুমি যে ব্যবসা করছ, তাতে ভবিষ্যতে বড় হতে পারবে বলে মনে কর?

বড় হতে পারব কিনা আল্লাহপাক জানেন। পরের গোলামীর চেয়ে নিজে স্বাধীনভাবে কিছু করা কি ভালো নয়, আপনিই বলুন? এখন আমার ব্যবসা হয়তো ছোট। কিন্তু আল্লাহপাক যদি রাজি থাকেন এবং সাহায্য করেন, তা হলে বড় হতে ক’দিন।

সব কিছু তো ছোট থেকে শুরু হয়। তারপর না বড়। আমার ভাগ্যে বড় হওয়া থাকলে হব। না থাকলে হব না। আল্লাহপাকের হাতে যখন সব কিছু তখন তিনি যখন যেভাবে রাখেন তাতেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। সৎভাবে পরিশ্রম করে যাব, তারপর যা করার আল্লাহপাক করবেন।

খুব দামি কথা বলেছ। তোমার কথা আমার খুব ভালো লাগল। পিয়ন অর্ডার মতো সব কিছু নিয়ে এলে মহিকে খেতে বলে নিজে একটা কোকোর বোতল নিলেন। পাইপে মাঝে মাঝে টান দিতে দিতে মহির আপাদমস্তক লক্ষ্য করার সময় চিন্তা করলেন, মিমির কথাই ঠিক, উপযুক্ত ছেলেই সে পাঠিয়েছে।

এক সময় জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই কি সংসারের একমাত্র উপার্জনকারী?
জি।
আর কে কে আছে?

আম্মা আছেন। আমরা তিন ভাই দু বোন। আব্বা বড় বোনের বিয়ে দিয়ে মারা গেছেন।
বাকি সবাই পড়াশুনা করছে।
যে বাড়িতে থাক, সেটা কি ভাড়া বাড়ি?

জি না। আব্বা প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা এ্যাডভান্স নিয়ে জায়গা কিনে বাড়ি করেছিলেন। দোতলার কাজ শুরু করার সময় তিনি মারা যান। ঐ অবস্থায় এখনও আছে। ততক্ষণে মহির খাওয়া শেষ হয়েছে।

হানিফ সাহেব বললেন, তোমার সঙ্গে কথা বলে খুশী হলাম। বাই দা বাই, মিমির সঙ্গে কি তোমার প্রায় দেখা হয়?
আলাপ হয়েছে মাত্র কয়েকদিন আগে। এর মধ্যে দু’বার দেখা হয়েছে। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, প্রথম আলাপের পর সে তোমাকে তোমার চাকরির কথা বলে।

তুমি কি তাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেছিলে?
জি না। ঐদিন ওরা যখন সার্ট কিনছিল তখন এক বন্ধুর সাথে কিছু আলাপ করছিলাম, সে সময় হয়তো মিমি আমার এডুকেশনের কথা জানতে পারে। তার চার-পাঁচ দিন পর হঠাৎ জি.পি.ও.-র কাছে দেখা।

সেদিনই প্রথম আমরা একটা হোটেলে বসে কিছুক্ষণ আলাপ করি। আলাপের শেষ পর্যায়ে এই কার্ড দিয়ে বলেছিল, আপনার কাছে আসলে একটা ভালো চাকরি পেতে পারি।

তুমি চাকরি করবে না সে কথা তাকে বল নি?
জি বলেছি। তবু সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে বলে।

হুঁ বলে হানিফ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, তোমার মতো একটা ছেলে আমার অফিসে দরকার ছিল। আরো ভেবে দেখার জন্য কি সময় নেবে?

আপনি দো’য়া করুন, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আমি নিজে কিছু করে যেন বড় হতে পারি। ভেরী গুড। নিশ্চয় দো’য়া করব। নিজে নিজে কিছু করে বড় হওয়া যে কত আনন্দ, কত শান্তি, কত ইজ্জৎ তা তুমি সেই দিন বুঝতে পারবে, যেদিন তুমি সফলতা অর্জন করবে।

এখন আমাকে যাবার অনুমতি দিন।
দেব, আর একটু বস। একটা কথা বলছি মনে কিছু নিও না। তোমার ব্যবসার উন্নতির জন্য যদি কোনো কিছুর প্রয়োজন হয়, আই মিন আর্থিক বা অন্য কিছু, তা হলে কোনো দ্বিধা সংকোচ না করে সোজা আমার কাছে চলে আসবে।

আর একটা কথা, তোমার চাকরির জন্য আমার অফিসে সব সময় ভ্যাকেন্সি থাকবে।
মহি কথাগুলো শুনে ভাবল, এই জামানায় তা হলে এখনো ভালো লোক আছে? তার মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, থাকবে না কেন?

ভালো মন্দ নিয়েই তো দুনিয়া। আরো ভাবল, ইনি খুব সাদা দীলের নিরঅহংকার মানুষ। তাই মেয়ে মিমিও ঐ রকম। দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আল্লাহর সাহায্যই আমার কাম্য। অন্য কারো কাছ থেকে সাহায্য নেওয়া পছন্দ করি না।

কেন না আল্লাহ কুরআনপাকে বলিয়াছেন, “আপনি যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করেন১।” তা ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য প্রার্থীহওয়া প্রকৃত ঈমানদারের লক্ষণ নয়। আপনি যদি আমাকে কিছু দিতে চান, তা হলে শুধু এই দো’য়া করবেন, আল্লাহ যেন সব সময় আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেন এবং সর্ব বিষয়ে সাহায্য করেন।

এক্সেলেন্ট! তুমি জীবনে উন্নতি করবেই। আমি তোমার জন্য দো’য়া করব। কয়েক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে হানিফ সাহেব আবার বললেন, তোমার কথা ঠিক। তিনি যাকে ইচ্ছা করেন তাকে সাহায্য করেন। কিন্তু তিনি স্বহস্তে কাউকে কিছু দেন না, কারুর মারফত দেন।

তোমার মতো ছেলে আমার অফিসে খুব প্রয়োজন থাকলেও আমি আর তোমাকে এখানে চাকরি জন্য বলব না। তবে তোমার ব্যবসার উন্নতির জন্য ফাইন্যান্স দিয়ে সাহায্য করতে চাই। যদি তুমি এটাকে করুণা বা অন্য কিছু ভাব, তা হলে ভুল করবে।

কেন না, তুমিও জান, এক মুসলমান আর এক মুসলমানের কি সম্পর্ক। “এক মুসলমান আর এক মুসলমানকে সাহায্য করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) খুশী হন।”

হানিফ সাহেবের কথা শুনে মহি দাঁড়ান অবস্থায় অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। তাই দেখে হানিফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি বেঠিক কিছু বলে ফেললাম? না আপনি হাদিসের কথা বলেছেন।

আপনার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শুনব আশা করি নি। আপনার মতো মানুষ যদি সমাজে আরো থাকত, তা হলে সমাজের তথা দেশের গতিধারা
১ সূরা-আল ইমরান, পারা-৩, ২৭ লা আয়াতের শেষ অংশ।

অন্যমুখে প্রবাহিত হত। আল্লাহ হেদায়েত দেওয়ার মালিক। তিনি সবাইকে হেদায়েৎ দান করুন। আপনার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। এবার এজাজত দিন।
আচ্ছা এস। মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করো।

জি করব, বলে সালাম বিনিময় করে মহি বেরিয়ে এল।
মহি বেরিয়ে যাওয়ার পর হানিফ সাহেব চিন্তা করতে লাগলেন, মিমি কি ছেলেটাকে ভালবাসে? আবার ভাবলেন দু-একবার আলাপে তা কি করে সম্ভব? তা হলে কি আগের থেকে ওদের জানাশোনা ছিল? কিন্তু তাও তো নয়।

ছেলেটা তো মিথ্যা বলবে না। তাকে খুব ধার্মিক মনে হল। যে ছেলে এত বড় সুযোগ হেলায় ত্যাগ করতে পারে, তাকে তো সাধারণ ছেলে ভাবা ঠিক হবে না। ছেলেটার আরো খবর নিতে হবে। মিমি হয়তো জানে। চিন্তাটা দূর করে দিয়ে একটা ফাইল খুলে দেখতে লাগলেন।

কিন্তু ছেলেটার আকর্ষণীয় চেহারা ও তার কথা- বার্তা বার বার তাঁর মনে পড়তে লাগল।
বিকেলে বাসায় ফিরে হানিফ সাহেব লনে বসে চা খাচ্ছেন। মাহিলা খাতুন পাশে বসে ছিলেন। বললেন, তুমি সেদিন মিমিকে বলছিলে, তোমার অফিসে একজন লোক দরকার।

হানিফ সাহেব বললেন, হ্যাঁ, একজন এ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার দরকার।
আমার ভাইপো বাসার এম.এ. পাস করে বেকার রয়েছে। বড় ভাই কিছুদিন আগে এসে তোমাকেও তো তার জন্য একটা চাকরির জন্য বলে গেল। সেকথা ভুলে গেছ বুঝি?

বাশারকে নিলে হয় না?
ভুলি নি। কিন্তু বাশারকে তো আমি চিনি। তাকে ঐ পদে নেওয়া ঠিক হবে না। অন্য কোনো পদ খালি হলে তখন দেখা যাবে।
বাশারকে নেয়া যাবে না কেন?

পদটা খুব দায়িত্বপূর্ণ। সে তার উপযুক্ত নয়। তুমি এক কাজ কর। ব্যবসা করার জন্য তাকে কিছু টাকা দাও। সেটা বরং এর থেকে ভালো হবে। প্রয়োজনে আমি তাকে ব্যবসার ব্যাপারে সাহায্য করব।

মাহিলা খাতুন স্বামীর দীল দরিয়ার কথা জানেন। চেনা অচেনা অনেক আত্মীয় অনাত্মীয় সাহায্য প্রার্থী হয়ে এলে যতটা পারেন তাদের সাহায্য করেন। তবু বললেন, আজকাল ব্যবসা করতে হলে তো অনেক টাকার দরকার।

প্রথমে কত হলে চলবে তাকে জিজ্ঞেস কর। পরে আরো লাগলে তখন দেখা যাবে। তারপর বললেন, আজ অফিসে এমন একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটেছে, যা দেখে-শুনে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা হল।
বল না শুনি।

অফিসে একটা ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ছেলেটা ঐ পদের জন্য ফিটেস্ট। আমার তাকে খুব পছন্দ হল। অফার দিলাম। কিন্তু ছেলেটা রাজি হল না।
কেন রাজি হল না কেন?

সে নিজের চেষ্টায় ছোট-খাট কি যেন একটা ব্যবসা করে।
এত বড় অফার পেয়েও করল না?
না, সে চাকরি করবে না।

তা হলে সে তোমার কাছে এসেছিল কেন?
আমিও সেকথা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, তাকে যে আমার কাছে পাঠিয়েছে,
তার সম্মান রক্ষার্থে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।

যাকগে, আমি যে তোমার বন্ধুর ছেলের কথা বলেছিলাম, তার কি হল?
ফোনে একদিন আলাপ করেছিলাম। শুনে বলল, “এটা আমার সৌভাগ্য; কিন্তু ভাগ্যে নেই। আমার শালীর মেয়ের সঙ্গে কয়েকদিন আগে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে।

ওরা আবার আগের থেকে, মানে বুঝতেই তো পারছেন। আজকালের ছেলে-মেয়েরা নিজেরা নিজেদের জীবনসাথী পছন্দ করছে।”
মাহিলা খাতুন কিছু না বলে চলে গেলেন।

হানিফ সাহেব বসে বসে সকালের পেপারটার উপর চোখ বোলাতে লাগলেন। মিমি এসে বলল, ড্যাডী, তুমি কি কোথাও যাবে? আমি একটু গাড়িটা নেব। হানিফ সাহেব বললেন, নিতে পার। খুব তাড়া না থাকলে একটু বস, দু-একটা কথা বলব।

মিমি একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল না, তাড়া নেই। নিউ মার্কেটে একটা বই কিনতে যাব।
আজ সেই ছেলেটা এসেছিল।
মিমি হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, তাই না কি? তোমার পছন্দ হয়েছে?

তা অবশ্য হয়েছে। কিন্তু চাকরি দেওয়া গেল না।
কেন?
যে চাকরির করবে না, তাকে দেব কী করে?
পদটার কথা বলেছিলে?

বলেছি। তবু রাজি হল না।
অবশ্য আমাকেও সে ঐ কথা বলেছিল। তখন মনে করেছিলাম, পদটার কথা জেনে হয়তো করবে।
তোর সঙ্গে তার কি আর দেখা হবে?

হলে কি কিছু বলতে হবে?
না, এমনি জিজ্ঞেস করছি।
সে তো দেখা করে না। আমিই ফেঁচে তার সঙ্গে দু’বার দেখা করেছি।

কেন জানতে পারি? কথাটা হানিফ সাহেব বেশ ভারী গলায় বললেন।
মিমি সেটা পাত্তা না দিয়ে বলল, ছেলেটা খুব ভালো। ভালর সঙ্গে কার না দেখা করতে
ইচ্ছে করে? কে না মিশতে চায়?

যতই ভালো হোক, ছেলেটা তো ফুটপাতের। তার সঙ্গে মেলামেশা করতে তোর রুচিতে বাধল না? আর এটা করাও কী উচিত হয়েছে?

মহিকে ফুটপাতের বলাতে মিমি একটু রেগে গেল। বলল, দেখ ড্যাডী, উচিত অনুচিত আমি বুঝি না। মানুষ যদি প্রকৃত মানুষের মতো হয়, তা হলে তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা কি অন্যায়? তা সে যেখানকার মানুষ হোক না কেন?

বড় বড় মনীষীদের লাইফ হিস্ট্রি পড়লে জানা যায়, তাঁদের অনেকে খুব গরীব ঘরের ছেলে ছিল। কে কখন কি হবে, তা কি আমরা জানি? তা ছাড়া সে যে ফুটপাতের নয়, তার সঙ্গে আলাপ করে তুমিও নিশ্চয় তা বুঝেছ?

কিন্তু প্রত্যেক সন্তানের পিতা-মাতার সম্মানের দিকে লক্ষ্য রাখা কর্তব্য।
নিশ্চয় তা কর্তব্য। কিন্তু আমি তো এমন কোনো কাজ করি নি, যা তোমাদের অসম্মানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে তোমরা যদি ধনদৌলত ও আভিজাত্যের অহংকারে অন্ধ হয়ে গরিবদের ঘৃণা কর, তা হলে অন্য কথা।

কিন্তু আমাদের একটা সমাজ আছে। সেই সমাজের কেউ তোকে ফুটপাতের একটা ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করতে দেখলে তারা কি মনে করবে? আমাদের সম্মানের হানি হবে না? সে ফুটপাতের ছেলে না হলেও ফুটপাতে ব্যবসা করে।

তোমাদের সমাজকে আমি পরোয়া করি না। যে সমাজ মানুষকে মানুষ বলে গ্রহণ করে না, যে সমাজ শুধু টাকা, গাড়ি-বাড়ি বুঝে, সে সমাজকে আমি মানি না। তোমাদের সেই সমাজের জানা উচিত গরিব হলেই যে তারা ছোটলোক, অভদ্র, ইতর হবে, তা ঠিক নয়।

হানিফ সাহেব যা জানার জেনে গেলেন। বললেন, কোথায় যাবি বলছিলি এবার যেতে পারিস।
থ্যাংক ইউ ড্যাডী বলে মিমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ঐদিন রাত বারটায় মিমি মহিকে ফোন করল।

মহি সবে মাত্র খেয়ে উঠে হাত মুখ ধুচ্ছে। ফোনের রিং বাজার শব্দ শুনে তার মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল। রিং বেজেই চলেছে। মহি ইচ্ছে করে ধীরে সুস্থে এসে রিসিভার তুলে বলল, কি খবর বল।

মিমি বলল ফোন যে আমি করেছি, তা বুঝলে কি করে? মিমি ছাড়া এত রাতে ফোন করার আর কেউ নেই বলে।
ফোন ধরতে দেরি করলে কেন?
দেখলাম, তোমার রাগ আছে কিনা।

কি দেখলে?
আছে, তবে অল্প। যেটা আমি ফোন ধরার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে গেছে।
তাই।
হ্যাঁ তাই।

কেমন আছ?
ভালো। তুমি?
ভালো না।
কি হয়েছে?

রোগ ধরেছে।
ডাক্তার দেখাও।
ঐ রোগের ওষুধ নেই।

সব রোগেরই ওষুধ আছে।
আছে, তবে ডাক্তারের কাছে নেই।
যার কাছে আছে তার কাছে যাও।

সে যে পাত্তা দিচ্ছে না।
তারও ব্যবস্থা আছে।
কি ব্যবস্থা?

সে যখন পাত্তা দিচ্ছে না, তখন তাকে বাদ দিয়ে যে পাত্তা দেবে তার কাছে যাও।
মিমি আহতস্বরে বলল, তুমি একথা বলতে পারলে?

পারব না কেন? তোমার রোগ তো সারান দরকার?
আমি যে তার কাছে ছাড়া মরে গেলেও অন্যের কাছে যেতে পারব না?
তা হলে অন্য একটা ব্যবস্থা করতে পার।

বল?
তোমার যে রোগ হয়েছে, সে কথা তুমি একদম মন থেকে মুছে ফেল। প্রথম দিকে একটু অসুবিধে হলেও দু-চারদিন পর ঠিক হয়ে যাবে।

আমার জন্য তোমার কি একটু দয়া হয় না?
নিশ্চয় হয়।
তা হলে ঐরকম বলছ কেন?

তোমার রোগের ট্রিটমেন্টের জন্য।
তোমার ট্রিটমেন্ট রং।
তা হলে তো সেই একই কথা বলতে হয়, অন্য কাউকে দিয়ে রাইট করে নাও।

এবার মিমি করুণ সুরে বলল, প্লিজ মহি, আমার অবস্থাটা একটু বোঝার চেষ্টা কর।
করলাম।
তা হলে বল কখন তোমাকে পাব?

যখন ইচ্ছা করবে তখনই পাবে। এখন যদি ইচ্ছে করে, তা হলে দেরি না করে এক্ষুনি চলে এস।
তুমি পাষাণ, তোমার হৃদয়ে প্রেম-ভালবাসা, দয়া-মায়া কিছু নেই। যা আছে তা শুধু আমাকে কাঁদাবার জন্য।

এবার আমি যদি বলি তোমারও ঐসব গুণগুলো আছে?
প্রমাণ করতে পারবে?

তুমি যখন প্রমাণ না দেখিয়ে ঐসব বলতে পারলে, তখন আমাকে প্রমাণ দেখাতে বলছ কেন? আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আর বলব না। অন্যায় হয়েছে, হল তো? এবারের মতো আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ করে দাও।
দিলাম।

এই, আজ তুমি ড্যাডীর সঙ্গে দেখা করেছ, সে কথা ড্যাডী বলছেন।
তোমার ড্যাডী কিন্তু খুব ভালো মানুষ। আমাকে নাস্তা খাইয়ে কত উপদেশ দিলেন।

মাঝে মাঝে দেখা করতেও বলছেন।
চাকরির ব্যাপারে তুমি কি বললে?

কি আর বলব, তোমাকে যা বলেছি ওঁকেও তাই বললাম।
শুনে ড্যাডী কিছু বলেন নি?

খারাপ কিছু বলেন নি। চাকরি না করে ব্যবসা করার কথা শুনে আমার ব্যবসার ও বাড়ির সব খোঁজ-খবর জানতে চাইলেন।
তুমি সব বললে?

বলব না কেন?
আমাকে তো কিছু বল নি?
তুমি জানতে চাইলে বলতাম।

জানতে চেয়েছিলাম। তুমি অন্য কথার প্রসঙ্গ টেনে এড়িয়ে গেছ? মনে নেই বুঝি?
তা হবে হয়তো।
এখন বল।
না।

না কেন?
আমার ইচ্ছে।
তা হলে বলবে না?
তোমার ড্যাডীর কাছ থেকে জেনে নিও।

ঠিক আছে, আমিও আর কোনো দিন জিজ্ঞেস করব না।
ভালই হল। প্রেমিকার কাছে আর নিজের সংসারের দুঃখের কথা বলে ছোট হতে হল না।
আচ্ছা তুমি কি?

একটা মানুষ।
অমানুষের মতো কথা বলছ কেন?

না হয় অমানুষও হলাম।
উহ্, কি লোকরে বাবা? কোনো কথাতেই পারা যাচ্ছে না। আচ্ছা, তুমি আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছ কেন?
আর দেব না।
ঠিক?

ঠিক।
মনে থাকবে?
থাকবে।
এ রকম তো আগেও বলেছ। কই, ঠিক থাকতে তো দেখলাম না?

এবার দেখবে।
তা হলে বল কখন এবং কোথায় কাল তোমার সঙ্গে দেখা করব।
গতরাতে বললাম না, দুদিন খুব ব্যস্ত থাকব। আর তুমি যদি প্রতিরাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমাকে ফোনে এঙ্গেজ রাখ, তা হলে হয়তো কোনো দিনই আর সময় পাব না।

কারণ রাতেও আমাকে অনেক কাজ করতে হয়। সেগুলো রাতে করতে না পেরে দিনে করতে হচ্ছে।
তার মানে তুমি আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে চাও। ঠিক আছে, এই ফোন রাখলাম। আর কোনো দিন ফোনও করব না, আর তোমার সঙ্গে দেখাও করব না।

তারপর মহি কিছু বলার আগে ফোন ছেড়ে দিল।
মহি মৃদু হেসে পাগলি বলে রিসিভার ক্রাডেলে রাখল।
আজ এক মাস হতে চলল কেউ কারুর খোঁজ-খবর নেয় নি। মহি প্রতি রাতে হিসাব করতে করতে মাঝে মাঝে ফোনের দিকে তাকায়।

মনে করে এক্ষুনি বুঝি ফোনটা বেজে উঠবে। মিমির কথা ভেবে একটু আনমনে হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফিরে পেয়ে আবার হিসাবে মন দেয়। দিনে আগের থেকে অনেক বেশি ব্যস্ত থাকে। অর্ডার অনুযায়ী মাল সাপ্লাই দিতে পারছে না বলে কারখানাটা বাড়িয়ে আরো তিনটে মেশিন কিস্তিতে কিনেছে।

নতুন কর্মচারীও লাগিয়েছে। একা কেটে সামলাতে পারছে না বলে একজন কার্টারের ব্যবস্থাও • করেছে। এই সমস্ত করতে গিয়ে তার হাতে যত টাকা ছিল সব খরচ হয়ে গেছে। এর মধ্যে হঠাৎ জানতে পারল, চিটাগাংয়ে বিদেশী থান কাপড়ের গাঁট নিলাম হবে।

নিলামে কিনতে পারলে তিন-চারগুণ লাভ। সদরঘাটের একটা বড় দোকানের মালিকের ছোট ভাই তাকে খবরটা দেয়। ঐ দোকানে মহি সার্ট-প্যান্ট সাপ্লাই দেয়।

একদিন মালেকা বানু ছেলের মন খারাপ দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোর কি হয়েছে? কোনো অসুখ-বিসুখ করে নি তো?
মহি হেসে বলল, তোমার দো’য়া ও আল্লাহপাকের রহমতে আমার ওসব কিছু হয় নি।

তবে ক’দিন থেকে তোর মনটা ভারভার দেখছি কেন?
মহি বলল, জান আম্মা, চিটাগাংয়ে বিদেশী কাপড় নিলাম হবে। ধরতে পারলে প্রচুর লাভ হত। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই।
কেন?

অনেক টাকা লাগবে বুঝি?
হ্যাঁ আম্মা, অনেক টাকা লাগবে।
তবু কত টাকা লাগবে?

কেন, তুমি দেবে নাকি? যদি বলি দেব? তা হলেও হবে না। তুমি যা দেবে তাতে কুলোবে না। বল না কত হলে হবে? পঞ্চাশ হাজার। পঞ্চাশ হাজার? অত টাকা কোথায় পাব বাবা?

তুই প্রতিদিন সংসার খরচের জন্যে যা দিস, তা থেকে কিছু করে আমি জমিয়েছি। দেড় বছরে মনে হয় পাঁচ-ছ হাজার হবে। তোকে ব্যবসা করার জন্য সোনার যে গয়নাগুলো দিয়েছিলাম, সেগুলো আমার। তোর আব্বা ফাতেমা ও আসিয়ার জন্য দু’সেট বানিয়েছিল।

ফাতেমার বিয়ের সময় তারগুলো তাকে দিয়ে দিয়েছি। আসিয়ারগুলো আছে। সেগুলো বেঁচে কতটা হয় দেখ। তারপরও যদি কম পড়ে আল্লাহ যেখানে থেকে হোক ব্যবস্থা করে দেবেন।

মহি বলল, তোমার জমানো টাকা নিতে পারি, কিন্তু আব্বা আসিয়ার জন্য যা করে গেছেন তা বিক্রি করতে পারব না। কেন পারবি না? মাল তুলে বিক্রি করে আবার গড়িয়ে দিবি। যদি একান্ত বিক্রি করতে না চাস, তবে কারুর কাছে ওগুলো রেখে সুদের উপর টাকা নিয়ে আয়।

মাল তুলে বেঁচে ছাড়িয়ে নিবি।
মহি বলল, আম্মা তুমি জান না, সুদের টাকা হারাম?
আমরা তো সুদ খাচ্ছি না।

সুদ খাওয়া আর দেওয়া দুটোই হারাম। আল্লাহপাক কুরানের মধ্যে সুদকে হারাম করেছেন। কুরআনে আছে, “মানুষের ধনে বৃদ্ধি পাবে বলে তোমরা সুদে যা দিয়ে থাক আল্লাহর দৃষ্টিতে তা ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে না, কিন্তু তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য যাকাত দিয়ে থাকে, তাহাদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়, তারাই সমৃদ্ধিশীল’।

আর রাসূল করিম (দঃ) সুদ প্রদানকারী, ইহার লেখক এবং ইহার সাক্ষীকে অভিশাপ দিয়েছেন। তিনি বলিয়াছেন, তাহারা সকলেই সমান২।”

মালেকা বানু বললেন, আমি এসব জানতাম না। আল্লাহ যেন আর কখনো বলব না। তা হলে জিনিসগুলো বেঁচেই দে। আমাকে মাফ করে দেন। মহি বলল, আমি চিন্তা করে দেখি। সেই দিন রাতে মহি অনেক চিন্তা করে শেষে ঠিক করল, জিনিসগুলো নোমানের মায়ের কাছে রেখে টাকা নেবে।

তা হলে সুদ দিতে হবে না।
১ সূরা-রূম, ২১-পারা, আয়াত-৩৯
২ বর্ণনায়: হযরত জাবের (রাঃ) মুসলিম

পরের দিন সকালে নাস্তা খেয়ে মাকে জিনিসগুলো দিতে বলল।
মালেকা বানু জিনিসগুলো একটা রুমালে পুঁটলি বেঁধে ছেলের হাতে দেওয়ার সময় বললেন, তোর আব্বা বলেছিলেন, দু’মেয়ের পাঁচভরী করে দশ ভরী।

এখনতো সোনার দাম অনেক বেশি। এগুলো বেঁচলে হবে না?
মহি মায়ের হাত থেকে পুঁটলিটা নিয়ে বলল, ইনশাআল্লাহ হয়ে যেতে পারে। তারপর সে উর্দুরোডে নোমানদের বাসায় গেল।

নোমান বাসায় নেই। বৌ নিয়ে শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে গেছে। তার মা সুফিয়া খাতুন মহিকে আদর-আপ্যায়ন করে বাসার সকলের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করলেন।

কলেজে নোমানের জান বাঁচিয়েছিল এবং তাকে কুসংসর্গ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল বলে সুফিয়া খাতুন মহিকে নিজের পেটের ছেলের মতো মনে করেন। নাস্তা খাওয়ার পর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি কোনো দরকারে নোমানের কাছে এসেছ?

মহি বলল, দরকারে এসেছি, তবে নোমানের কাছে নয়, আপনার কাছে।
সুফিয়া খাতুন বললেন, বল বাবা কি দরকারে এসেছ।

মহি গয়নার পুঁটলিটা তাঁর হাতে দিয়ে বলল, এতে কিছু সোনার জিনিস আছে। এগুলো রেখে হাজার পঞ্চাশেক টাকা দিতে হবে। ব্যবসার ব্যাপারে আজ কালের মধ্যে দরকার। ইনশাআল্লাহ মাস খানেকের মধ্যে ফেরত দিয়ে এগুলো নিয়ে যাব।

সুফিয়া খাতুন বললেন, পাগল ছেলের কাণ্ড দেখ। তুমি তা হলে আমাকে পর ভাব? তা না হলে ছেলে কোনো দিন মায়ের কাছে সোনার গয়না রেখে টাকা চায়? তোমার টাকা দরকার, সে কথা এমনি এসে চাইতে পারতে।

এগুলো আনা তোমার ঠিক হয় নি। আমার কাছে চাইতে লজ্জা লাগলে নোমানকে বলতে পারতে। যাকগে, এগুলো দিয়ে বুঝি আম্মা পাঠিয়েছে?

মহি বলল, আম্মা বিক্রি করতে দিয়েছেন। এগুলো আব্বা আসিয়ার বিয়ের জন্য অনেক আগে তৈরি করে রেখেছিলেন। আম্মারগুলো আগে বিক্রি করে ব্যবসায় নেমেছি।

সুফিয়া খাতুন গয়নার পুঁটলিটা টেবিলের উপর রেখে বললেন, এটা তোমার মাকে দিয়ে বলো, আমি বিক্রি করতে দিই নি। নোমান কিসের যেন ব্যবসা করবে বলে আমার কাছে দুলক্ষ টাকা কয়েকদিন আগে চায়।

আমি বললাম এবার তুই সবকিছু বুঝে নে। কতদিন আর আমি এসব সামলাব। ওর ব্যাংক একাউন্ট ছিল না। ঐদিন একাউন্ট খুলে সব টাকা ওর একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিয়ে আমারটা ক্লোজ করে দিয়েছি। তবে আমার কাছে বেশ কিছু টাকা আছে।

নোমান তা জানে না। তুমি বস, দেখি কত আছে বলে উঠে ভিতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে একশ টাকার চারটে বাণ্ডিল টেবিলের উপর রেখে বললেন গুণে নাও। দশ হাজার করে এক এক বাণ্ডিলে আছে। পঞ্চাশ হাজার হল না।

এতে না হলে নোমান ফিরলে তার কাছ থেকে বাকি দশ হাজার আমি চেয়ে দেব।
মহি টাকাগুলো গুণে নিয়ে বলল, টাকার ব্যাপারটা নোমানকে জানাবেন না। বাকি টাকাটা ইনশাআল্লাহ ম্যানেজ হয়ে যাবে।

তারপর কদবুসি করে বিদায় নিয়ে চলে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
সুফিয়া খাতুন বললেন, গয়নার পুঁটলিটা রয়ে গেল যে, নিয়ে যাও।

মহি টেবিল থেকে পুঁটলিটা নিয়ে সুফিয়া খাতুনের হাতে দিয়ে বলল, খালাম্মা, বেয়াদবি মাফ করবেন। এটা আপনাকে রাখতেই হবে। আর আম্মাকে আপনার কথা বলতে পারব না।

উনি যদি এই ব্যাপারে শোনেন, তা হলে আমার ওপর যেমন রাগ করবেন তেমনি মনেও কষ্ট পাবেন। আপনি আমার আম্মার চেয়ে কম নন। আপনাকে অপমান করার জন্য বলছি না, আমি এগুলো সময় মতো নিয়ে যাব। এখন আপনার কাছে গচ্ছিত রাখলাম।

তারপর সে সুফিয়া খাতুনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।
মহি ওখান থেকে বাসায় ফেরার পথে আম্মা জিজ্ঞেস করলে কিভাবে ম্যানেজ করবে ভেবে রাখল।

ছেলেকে ফিরতে দেখে মালেকা বানু কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, বেঁচে কত পেলি?
মহি বলল, যা পেয়েছি তার পরেও দশ হাজারের মতো লাগবে। মায়ের কাছে সত্য কথা খুলে বলতে পারছে না বলে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে আছে।

মালেকা বানু আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন, তুই মন খারাপ করে রয়েছিস কেন? আল্লাহ ইচ্ছে করলে তোকে আরো বেশি জিনিস গড়াবার তওফিক দেবেন। যা কাজে মন দে। এ ব্যাপারে আর চিন্তা করিস না। আমি দো’য়া করছি, তিনি তোকে কামিয়াব করাবেন।

এক মাসের বেশি হয়ে গেছে মহি মিমির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে নি। অবশ্য যে রাতে মিমি রাগ করে ফোন ছেড়ে দেয়, তার পরের দিনে সে তাদের বাসায় দশটার সময় ফোন করেছিল। সুমন ফোন ধরে বলেছিল, আপা ভার্সিটিতে চলে গেছে।

সুমন কিছু জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সে কিছু না বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছে। প্রথম দিকে কারখানা বাড়ান, মেসিন কিনা ও নতুন কারিগরের ব্যাপারে ব্যস্ত ছিল। তারপর টাকার চিন্তায় মশগুল। আজ কিছুটা স্বস্তি পেয়ে দুপুরে খাওয়ার পর মিমির কথা ভাবতে লাগল।

প্রতিদিন রাতে ঘুমোবার আগে তার কথা ভেবেছে। এমন কি দু রাতে দুবার ফোনও করেছে, কিন্তু কেউ ধরে নি। অনেকক্ষণ রিং বাজতে শুনে মনে হয়েছে ফোনের কাছে কেউ থাকে না। কিন্তু মিমি কি করে এতদিন ধৈর্য ধরে আছে?

তার কি কোনো অসুখ-বিসুখ হয়েছে? তা হলে ফোন করবে না কেন? আবার ভাবল, ধনীর দুলালীদের মতো কি খামখেয়ালী ও আবেগের বশবর্তী হয়ে কয়েকদিন আমার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলল? তাও বা হয় কি করে? মিমি তো সে ধরনের মেয়ে নয়।

একবার ফোন করলে কেমন হয়? এখন কি ওকে পাওয়া যাবে? যদি অন্য কেউ ধরে? সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মহি ডায়েল করল। ওপাশে একটা ছেলের গলা শুনতে পেল, আমি সুমন বলছি।

আপনি কে বলছেন?
আমাকে কি আপনি চিনবেন? আমি মহি বলছি। আপনার আপাকে একটু দিন তো। সুমন বলল, আপনাকে আমি চিনি। আমাকে আপনি করে বলছেন কেন? ধরুন, আপাকে ডেকে দিচ্ছি।

মিমি কিছুক্ষণ আগে ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। সুমন তার কাছে গিয়ে বলল, এই আপা ফুটপাতের সেই শার্ট বিক্রেতা ছেলেটা তোকে ফোনে চাইছে।

শুনে মিমি প্রথমে চমকে উঠল। তারপর সামলে নিয়ে বলল সুমন, তুই জানিস ছেলেটা শিক্ষিত। তুইও লেখাপড়া করছিস। একজন শিক্ষিত ছেলের সম্বন্ধে ওরকম কথা তোর বলা উচিত হয় নি।

সুমন হাসি চেপে রেখে বলল, সরি আপা, ভুল হয়ে গেছে। মিমি বলল, আর যেন না হয়। তুই যা আমি আসছি।
সুমন চলে যেতে মিমি ড্রইংরুমে এসে রিসিভার তুলে বলল, একজন বীজনেস ম্যাগনেট হয়ে নিশ্চয় মিমির খোঁজ করছ?

মহি মিমির কথা শুনে চিন্তা করল, এটা তার অভিমান না বিদ্রূপ? কিছু না বলে চুপ করে রইল।
কি হল, কথা বলবে না তো ফোন করলে কেন? আজ পাঁচটার দিকে পার্কে আসতে পারবে?

ভীতুর জাহাজ বলে মিমি রিসিভার রেখে দিয়ে নিজের রুমে ফিরে এল। মহি ফোন ছেড়ে দিয়ে ভাবল, মিমির প্রতি খুব অবিচার করে ফেলেছে। আজ আবাহনী ও মোহামেডানের ফাইনাল লীগ খেলা। দু ভাই-বোনের দেখতে যাওয়ার কথা।

সুমন তৈরি হয়ে আপার রুমে এসে তাকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে বলল, কিরে যাবি না?
মিমি বলল, তুই যা, আমি যাব না। শরীরটা খারাপ লাগছে।

সুমন দুষ্টু হেসে বলল, একটু আগে যাবি বললি। এক্ষুনি শরীর খারাপ হয়ে গেল? মহি ভাইয়ের ফোনে বুঝি শরীর খারাপের জীবাণু ছিল?

হানিফ সাহেব যেদিন লনে বসে মিমির সঙ্গে মহির ব্যাপারে কথা বলছিলেন তখন সুমন অল্প দূরে একটা গাছের তলায় বসে গল্পের বই পড়ছিল। সে পড়া বন্ধ করে তাদের সব কথা শুনে বুঝতে পারে মিমি মহিকে ভালবাসে।

তাই আজ যখন মহির ফোন আসে তখন জিনিসটা যাচাই করার জন্য ঐ রকম বলে। তারপর মিমির কথা শুনে সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যায়। সেইজন্য এখন আবার ঐ কথা বলে দুষ্টুমি করল।

সুমনের কথা শুনে মিমি চোখ বড় বড় করে বলল, খুব ফাজিল হয়ে গেছিস না? দেব এক চড় বলে হাত তুলে এগিয়ে এল।
সুমন একটু পিছিয়ে এসে বলল, সত্য সব সময় অপ্রিয় হয়। তাইতো রেগে গেছিস।

ঠিক আছে, শরীর খারাপ যখন বলছিস তখন লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাক, আমি খেলা দেখতে চল্লাম বলে সে ছুটে বেরিয়ে গেল।
মিমি ভাবল, তাদের সম্পর্কের কথা সুমন জানল কি করে? জানুক গে। মাকে যেন না বলে সেকথা ওকে বলে দিতে হবে। তারপর ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, সাড়ে তিনটে। এখনও দেড় ঘন্টা বাকি।

মিমি দশ মিনিট আগে পার্কে পৌছে লেকের ধারে নির্দিষ্ট জায়গায় বসে বসে ভাবতে লাগল, মহি এলে তাকে কি বলবে? আর সেও বা কি বলবে?

মহি ঠিক পাঁচটায় এসে দেখল, মিমি বসে আছে। সে নিঃশব্দে চুপি চুপি তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর কয়েক সেকেণ্ড পর ডাকল, মিমি, মাই সুইট হার্ট। মিমি চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। তারপর ছল ছল নয়নে একদৃষ্টে
শুধু তাকিয়ে রইল।

কোনো কথা বলতে পারল না।
হার্ট। মহিও একই ভাবে মিমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার ডাকল, মিমি, মাই সুইট
এবার মিমি সামলাতে পারল না। মহির মুখের মিমি ডাক তাকে পাগল করে দেয়।

অভিমানভরা কণ্ঠে বলল, নো, নো ভগ, হু ইজ সী? তারপর আর কিছু বলতে পারল না, দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল।
মিমি, আমার অন্যায় হয়েছে। আর কখনো এরকম হবে না। মিমি সামলাতে পারছে না বলে কিছু বলতে পারল না।

মিমি কিছু বলছে না দেখে মহি আবার বলল, প্লীজ মিমি, আমাকে ফিরিয়ে দিও না। তুমি যদি আমার পরিস্থিতির কথা জানতে, তা হলে রাগ বা অভিমান করতে পারতে না। প্রতিদিন রাত বারটার পর তোমার ফোনের আশায় প্রহর শুনেছি।

থাকতে না পেরে দু’দিন ফোনও করেছি। প্রত্যুত্তরে শুধু রিংয়ের আওয়াজ শুনেছি। সেই রাতের পরের দিন সকালেও ফোন করেছি। সুমন ধরে বলেছে তুমি ভার্সিটি চলে গেছ। তুমি আমার সব কিছু জেনেও রাগ, অভিমান করতে পারলে?

আমি তোমার উপযুক্ত হওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছি। আর আজ আমাকে ফোনে প্রথম যা বলেছ তা শুনে মনে হয়েছে, একথা মিমির কাছ থেকে শোনার আগে আমার মৃত্যু হল না কেন? সমস্ত দুনিয়ার মানুষ আমাকে মন্দ বলুক বা ক্রীটিসাইজ করুক, তাতে কিছু যায় আসে না, কিন্তু আমার মিমির কাছে থেকে শুনব, তা স্বপ্নেও ভাবি নি।

যদি মিমির কাছে আমি সেই রকম হয়ে যেয়ে থাকি, তবে চললাম। জীবনে আর কোনো দিন তোমার সামনে আসব না। জানব, আমি যে মিমিকে ভালবেসে ছিলাম, সে মিমি হারিয়ে গেছে। কথা শেষ করে ধীর পদক্ষেপে ফিরে চলল।

এই একটা মাস যে মিমির কি করে কেটেছে তা সে বলতে পারল না। সারা দিনরাত সে মহির চিন্তা করেছে। রাত্রে বারবার তার ফোন করার ইচ্ছে হলেও অভিমান তাকে তা করতে দেয় নি। ভেবেছে, দেখবে মহি তার খোঁজ না নিয়ে কতদিন থাকতে পারে?

এর মধ্যে সে কয়েকদিন গুলিস্তান ও বায়তুল মোকাররমের রাস্তায় ঘুরেছে তাকে এক নজর দেখার জন্য।
কিন্তু দেখা পায় নি।

এতক্ষণ মিমি মহির কথা শুনতে শুনতে বিবেকের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছিল, তার দীলটা ব্যথায় দুমড় মুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। সে যে মহিকে থামাবে তাও পারছিল না। তাকে চলে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে দাড়াল।

তারপর কোনো রকমে বলল, প্লীজ মহি যেও না। গেলে, পরে আমার মরা মুখ দেখবে।
মহি মাত্র কয়েক পা এগিয়েছিল। মিমির কথা শুনে ফিরে এসে মিমির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ছিঃ মিমি, ওরকম কথা বলতে নেই, গোনাহ হবে।

তুমি তোমার মিমির এতদিন খোঁজ নাও নি, তাকে এতদিন পরে পেয়েও ডেকে এনে
ফেলে রেখে চলে যাচ্ছ, তোমার গোনাহ হবে না? না শুধু মেয়েদের গোনাহ হয়, ছেলেদের হয় না?

গোনাহের কাজ করলে সকলেরই গোনাহ হয়। আমি যা করেছি, তা বিপর্যায়ে পড়ে করেছি। কিন্তু তুমি তোমার মহিকে এত কষ্ট দিলে কেন? আমি তো তোমার কাছে পাষাণ, হৃদয়হীন, অমানুষ।

সেইজন্য আমি না হয় ঐ সবের মতো কাজ করেছি; কিন্তু তোমার মধ্যে তো ঐ গুণগুলো নেই, তবু কেন ঐসবের মতো কাজ করলে?

ওড়নায় চোখ-মুখ মুছে মিমি বলল, অন্যায় হয়ে গেছে, আর করব না। মাফ করে দাও।
করব না।
কেন?

মাফ করলে আবার অন্যায় করবে।
বললাম তো আর করব না।
ঠিক?

ঠিক।
তা হলে মাফ করে দিলাম।
বসবে না?
বসলাম বলে মহি বসে পড়ল।

মিমিও তার কাছে বসে পড়ল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোমার পরিস্থিতির কথা কি যেন
বলছিলে?

আমাদের মালের চাহিদা বাজারে বেশি হওয়ায় কারখানা বড় করতে হয়েছে এবং কয়েকটা মেশিন কিনতে হয়েছে। কারিগরও বাড়াতে হয়েছে। ঐসবের পর একটা সুযোগ পেলাম। সুযোগটা কাজে লাগাতে পারলে প্রচুর প্রফিট হবে।

কিন্তু অত কিছু করার পর হাত একদম খালি। সুযোগটা ইউটিলাইজ করতে হাজার পঞ্চাশ টাকার দরকার। টাকা নেই, তবু
সুযোগ হাত ছাড়া করা উচিত হবে না ভেবে টাকার জন্য খুব চিন্তায় ছিলাম। তার ওপর মিমি নামে মেয়েটার চিন্তা।

কিভাবে যে দিনগুলো কেটেছে আল্লাহপাক জানেন।
মিমি বলল, টাকা জোগাড় হয়েছে?

টাকার কথা বাদ দাও। কেমন আছ বল।
তুমি যেমন রেখেছ।
এখনো নরমাল হতে পারছ না?

কি করে হব? তারপর তোমার জান এত শক্ত কেন দেখি বলে মিমি মহির জামার বুকের বোতাম খুলতে লাগল।
আরে বোতাম খুলে কি দেখবে? ভিতরে গেঞ্জি ঘামে ভিজে গেছে। দুর্গন্ধ বেরোবে তো।

বেরোক তবু দেখব তোমার বুকে চুল আছে কিনা। শুনেছি, যার বুকে চুল নেই, সে নির্দয় হয়। বোতাম খুলে তার বুকে চুল ভর্তি দেখে অবাক হয়ে বলল, এত চুল রয়েছে, তবু তুমি এত পাষাণ? তোমার দীল তো মায়া-মমতায় ভরে থাকা উচিত?

একদম নেই বুঝি?
আছে। তবে যতটা থাকা উচিত ততটা নেই। যদি বলি তার চেয়ে বেশি আছে?
থাকলে প্রমাণ পেতাম।

ইনশাআল্লাহ সময় হলে প্রমাণ পাবে। আর তোমার শোনা কথামতো আমিও যদি তোমার জামার বোতাম খুলে চুল আছে কিনা দেখতে চাই?

অসভ্য হলে পারমিশান চাইতাম না। তোমার মতো খুলেই দেখতাম।
মিমি লজ্জা পেয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বলল, তুমি ভীষণ অসভ্য। যাও আর অসভ্যতা করবে না। মেয়েদের বুকে চুল হয় না জান না বুঝি? জানি। তবু দেখতে চাইলে কেন? চুল ছাড়া আর কি আছে দেখব বলে।

যার কারণে তারাও মাঝে মাঝে পাষাণ হয়। তুমি একটা যাচ্ছে তাই। জন্য মহি হাত বাড়াতে উদ্যত হল। পারবে বলে সে মহির মুখের দিকে তাকাল। মহি তার চিবুক ধরে বলল, না। তা হলে অভিনয় করলে কেন?

তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য। দুষ্টু। ওসব কথা বাদ দাও। একটা কথা বলব রাগ করবে না তো? ওটা তো আমার চেয়ে তুমি বেশি কর। আর করব না। মনে থাকবে?

যাচ্ছে তাই যখন বললে তখন যাচ্ছেতাই করেই ছাড়ব বলে তার জামার বোতাম খোলার
থাকবে বলে মিমি হেসে উঠে বলল, এবার বলি?

বল।
তোমার বিজনেসে আমাকে পার্টনার নেবে? আজকাল পার্টনারশীপ বীজনেস করা উচিত নয়।
কারণ?

কারণ অনেক। তার মধ্যে দুটো প্রধান, (এক) বীজনেসে একটু উন্নতি হলে একজন অন্য জনকে ভাগাবার চেষ্টা করে। (দুই) একে অপরকে ফাঁকি দিয়ে নিজের আখের গোছায়।

এরকম আকসার হচ্ছে।
বীজনেস করবে তুমি, আমি শুধু ফাইন্যান্সে পার্টনার থাকব। আমি কি করে ঐ সব করব। তুমি না করলে আমি করতে পারি?
না তুমি পার না।

করতেও তো পারি?
বললাম না, করতে পার না, পার না, পার না।
কি রকম?
কেন?

তবু বাধা আছে। লোকে বলবে প্রেমিকাকে ফাইনান্সে পার্টনার নিয়ে বড় হয়েছে। বলুকগে। লোকের কথায় কি যায় আসে। আমরা দুজনে ঠিক থাকলেই হল। তোমার ড্যাডী-মাম্মী রাজি হবেন না। সে সব আমার ব্যাপার, তোমাকে ভাবতে হবে না।

হবে। তুমি যে আমার প্রিয়তমা। তাকে কেউ কিছু বলুক, তা আমি চাই না। মিমি মহির দুটো হাত নিজের হাতে ধরে রেখে বলল যদি তাই হয়, তা হলে বল আমাদের মধ্যে কি সত্যিকার প্রেম হয় নি? সেটা তোমার মনকে জিজ্ঞেস করে দেখ। হচ্ছে।

দেখছি। তোমার মুখে শুনতে চাই।
খাঁটি প্রেম অন্তরের ব্যাপার। মুখে বললে প্রেমকে অপমান করা হয়। প্রেমিক-প্রেমিকা দৈহিক আলাদা হলেও অন্তরে এক কিনা?
অফকোর্স।

একজনের অন্তর কোনো কারণে বিচলিত হলে অন্য জনেরও হবে কি না?
হবে।
তা হলে তোমার অন্তরের বিচলিত অবস্থাটা আমার অন্তরে হচ্ছে কি না?

দু’জন দু’জনের সেই বিচলিত সমস্যাটা দূর করার চেষ্টা করা উচিত কি না?
উচিত।
তাতে কারুর কোনো আপত্তি থাকাও নিশ্চয় উচিত নয়?

না, উচিত নয়।
বেশ, তা হলে এস আমার সঙ্গে। তারপর গেটের বাইরে এসে একটা স্কুটারে উঠে মিমি ড্রাইভারকে বলল, ধানমণ্ডি চল।
মহি বলল, তার আগে আমাকে একটু বাসায় যেতে হবে।

মিমি মহির আপাদমস্তক একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ড্রাইভারকে বলল, আগে বাসাবো চল।
বাসাবো রেল লাইন ক্রস করে ড্রাইভার ঠিকানা জানতে চাইলে মহি ঠিকানা বলল। এক সময় স্কুটার মহিদের বাসার গেটে এসে থামল। মহি ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে মিমিকে বলল, এস।

রাস্তার ধারে বাড়ি। তাই মহির বাবা কাসেম সাহেব বাড়ি তৈরির কাজে হাত দেওয়ার আগে চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে বড় লোহার গেট করে নিয়েছিলেন। গেট থেকে আসল বাড়িটা একটু দূরে। ভিটেটা দেড় বিঘার মত। বাড়িটা দক্ষিণ দিক ঘেঁষে।

মাঝ বরাবর উত্তর দিকে রাস্তার সঙ্গে গেট। তিন দিকে বেশ অনেকখানি ফাঁকা জায়গা। পশ্চিম সাইডে মহি একটা সেমি পাকা লম্বা হল রুম করেছে। সেটাই জামা-কাপড় তৈরির কারখানা। অন্য দুপাশে সারি সারি কয়েকটা নারকেল গাছ।

তার ফাঁকে ফাঁকে কতকগুলো পেয়ারা ও কাগজী লেবুর গাছ। গেটের পাশে একটা বড় সাজনা ডাটার গাছও রয়েছে। এগুলো সব কাসেম সাহেব জায়গা কেনার পরপর লাগিয়েছেন। বাড়ির দোতলার ছাদে পিলারের রডগুলো লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মেঘলা জ্যোস্না রাতে হঠাৎ সেগুলোর উপর কারুর নজর পড়লে ভূত মনে করে ভয় পাবে। গেটের থামে শ্বেত পাথরে নেমপ্লেট রয়েছে। গেটটা বেশ বড়। ট্রাকও ঢুকতে পারবে। একদিকে কাটা পাল্লা সিস্টেম। সেটা দিয়ে লোকজন যাতায়াত করে।

মহি গেটের কড়া নাড়া দিতে ছোট বোন আসিয়া গেট খুলে দিল। মহি তাকে সালাম দিয়ে বলল, আম্মাকে গিয়ে বল, একজন মেহমান এসেছে।

আসিয়া সালামের প্রতি উত্তর দিয়ে একবার মিমিকে দেখে গেট লাগিয়ে আম্মাকে খরবটা দিতে চলে গেল।

মিমি গেটের ভিতরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে পরিবেশ দেখছিল। তার গাছপালাগুলো খুব ভালো লাগল।
মহি তাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের রুমে এল।

মিমি বলল, ছোটরা তো বড়দের সালাম দেয়। তুমি দিলে কেন?
ছোটদের অবশ্য কর্তব্য বড়দের আগে সালাম দেওয়া। আসিয়াও দেয়, আজ তোমাকে দেখে হয়তো একটু দেরি করে ফেলেছে।

তবে কে আগে দেবে সেটার কোনো আইন নেই। যে কেউ আগে দিতে পারে এবং যে আগে দেবে সে উত্তর দাতার চেয়ে নব্বইগুণ সওয়াব বেশি পাবে। এটা হাদিসে আছে। তা ছাড়া ছোটরা বড়দের থেকে শিখবে।

কই, তুমি তো আমাকে একদিনও দাও নি?
তার কারণ আছে।
কি কারণ?

আমি সালাম দেওয়ার পর তুমি যদি উত্তর না দিতে পার, তা হলে তোমার গুনাহ হবে। “সালাম দেওয়া সুন্নত আর উত্তর দেওয়া ওয়াজিব।” এটাও হাদিসের কথা।

সুন্নত-ওয়াজিব কি?
সুন্নত হল, আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (মঃ) নিজে বাস্তব জীবনে যা করেছেন। আর ওয়াজেব হল, আল্লাহ ইনডাইরেক্ট তার বান্দাকে যা করতে বলেছেন।

তা হলে তো আল্লাহ ডাইরেক্টও কিছু করতে বলেছেন? সেগুলোকে কি উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দাও।
তোমাকে যে “বেহেস্তী জেওর” বই কিনে দিলাম, সেগুলো পড় নি তা হলে, পড়লে সবকিছু জানতে পারতে।

না, এখন কুরআনের ব্যাখ্যা পড়ছি, পরে পড়ব। তুমি বল না।
আল্লাহপাক বান্দাদেরকে যা কিছু করতে বলেছেন সেগুলোকে ফরয বলে। যেমন-কলেমা, নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত।

আরো অনেক বিধি-নিষেধ আছে। কুরআনের মধ্যে পাবে। তারপর বলল, তুমি দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? বস। আমি আসছি।
মিমি বলল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না।

ঠিক আছে আসছি বলে মহি মায়ের কাছে গিয়ে বলল, সেদিন রাতে যে মেয়েটা ফোন করেছিল, সে এসেছে। তুমি ওর সঙ্গে দেখা করে নাস্তার ব্যবস্থা কর। তারপর আসিয়াকে বলল, আমার ঘর থেকে আকাশি রঙের প্যান্ট ও পাঞ্জাবীটা নিয়ে আয় তো।

আর একটা লুঙ্গীও আনিস।
মহি বেরিয়ে যেতে মিমি রুমটার চারদিকে লক্ষ্য করল, সবকিছু গোছান ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বেশ ছিমছাম। খাটের বিছানা পত্র বেশ পরিপাটি। বেড কভার টান টান। কোথাও একটু কুঁচকে নেই। এক পাশে খাট। মাথার দিকে একটা ছোট গোলাকার টেবিল।

তার উপর একটা সুন্দর টেবিল ল্যাম্প আর টেলিফোন সেট রয়েছে। দরজার পাশে একটা মাঝারি সাইজের সেক্রেটারিয়েট টেবিল। তার তিন দিকে তিনটে চেয়ার।

মিমি একটা চেয়ার টেনে এনে বসে বাসায় রিং করল। ড্যাডীকে পেয়ে বলল, আমার ফিরতে একটু দেরি হবে। তুমি কোথাও যেও না, দরকার আছে।

হানিফ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুই কোথা থেকে ফোন করেছিস? মিমি বলল, এক বন্ধুর বাসা থেকে। তারপর সে ফোন ছেড়ে দিল।

মালেকা বানু আসিয়াকে কাজের মেয়েকে নিয়ে নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলে মহির রুমে গেলেন। দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন, মেয়েটা দরজার পাশের টেবিলের কাছে একটা চেয়ারে বসে হিসাবের খাতা দেখছে। তিনি মিমির আপদমস্তক লক্ষ্য করলেন, কি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে।

আকাশি কালারের সাটিং কাপড়ের শালাওয়ার-কামিজে তাকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। চুলসহ মাথাটা কাল জর্জেটের রুমালে বাঁধা। চেয়ারের র‍্যাকে ঐ কালারের ওড়নাটা রয়েছে। তিনি সাড়া দিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।

মিমি প্রথমে ওঁকে দেখতে পায় নি। সাড়া পেয়ে সেদিকে তাকিয়ে মালেকা বানুকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে রইল।
মালেকা বানু বললেন, বস মা বস, আমি মহির আম্মা।

মিমি এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেলে তিনি তাকে ধরে বললেন, থাক মা থাক। আল্লাহ তোমাকে সুখী করুন। মিমিকে তাঁর খুব ভালো মেয়ে বলে মনে হল। জিজ্ঞেস করলেন, তুমিই সেদিন রাতে ফোন করেছিলে?

মিমি লজ্জা পেয়ে জি বলে মাথা নিচু করে নিল।
তোমারই নাম তা হলে মিমি?

মিমি কিছু বলতে পারল না। শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
মালেকা বানু বললেন, তুমি বস, আমি মহিকে ডেকে দিচ্ছি। কথা শেষ করে বেরিয়ে গেলেন।

চা-নাস্তা খেয়ে মহিকে সঙ্গে করে মিমি যখন তাদের বাসায় ফিরল তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা।
মাহিলা খাতুন বিকেলে মহিলা সমিতিতে গেছেন। সেখানে আজ একটা নাটকের ফাইন্যাল রিহারসাল হবে। তিনি ভার্সিটিতে পড়ার সময় থেকে এর সঙ্গে জড়িত।

নাটক পরিচালনা করার দায়িত্ব তাঁর উপর। তিনি এখনো ফেরেন নি।
মিমি রুমে ঢুকে ড্যাডি বলে ডাকল।

হানিফ সাহেব মেয়ের অপেক্ষায় ড্রইংরুমে বসে একটা পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছিলেন।
ইয়েস বলে হানিফ সাহেব পত্রিকাটা রেখে মুখ তুলে তাকাতে মহি সালাম দিল।

সালামের উত্তর দিয়ে হানিফ সাহেব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলেন, আরে তুমি? কেমন আছ?
এসো, বস বস।

মহি বলল, আল্লাহর রহমতে এবং আপনার দো’য়ায় ভালো আসি। আপনি কেমন আছেন?
ভালো আছি। তোমরা দাঁড়িয়ে কেন, বসবে তো। ওরা বসার পর জিজ্ঞেস করলেন, তোমার ব্যবসার কিছু প্রগ্রেস হচ্ছে?

জি হচ্ছে।
মিমি বলল, ড্যাডী, তুমি একটু ভিতরে চল, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরী কথা আছে। তারপর মহির দিকে তাকিয়ে বলল, একটু বস, আমরা এক্ষুনি আসছি।

ড্যাডীকে পাশের রুমে নিয়ে এসে মিমি বলল, একটা কথা বলব রাগ করবে না তো?
কথাটা না শুনে আগে থেকে কি করে বলব?
আঃ ড্যাডী, তুমি উত্তরটা ঘোরাচ্ছ। বল না, রাগ করবে কি না?

আচ্ছা বল, রাগ করব না।
আমি না মহিকে.
কি হল থেমে গেলি কেন?

যাও বলতে পারব না। বোকা ছেলের মতো বুঝতে পারছে না? হানিফ সাহেব হেসে উঠে বললেন, মহিকে তুই ভালবাসিস, এই কথাটা বলতে পারছিস না? ভীতু মেয়ে কোথাকার। কিন্তু মা, ভালবাসা এক জিনিস, আর বাস্তব জীবন অন্য এক জিনিস।

তুই কি ভালো করে চিন্তা করে দেখেছিস? ওর সঙ্গে তোর বেশি দিন পরিচয়ও হয় নি। আরো কিছুদিন চিন্তা করে দেখ, আর সেই সঙ্গে মহিকেও ভালো করে জেনে নে। তবে খুব সাবধানে চলাফেরা করবি। তোর মাম্মী যেন টের না পায়।

মিমি বলল, তুমি যা বললে তাই করব। একটা কথা জিজ্ঞেস করব সঠিক উত্তর দিতে
হবে কিন্তু।
উত্তর জানা থাকলে সঠিকই দেব।

মহিকে তোমার কেমন মনে হয়?
হানিফ সাহেব বললেন, আমি তো বোকা ছেলে। আমার ভালো-মন্দের কি দাম?
আবার কথা ঘোরাচ্ছ। সাফ সাফ উত্তর দাও।

ভালোকে তো আর খারাপ বলতে পারি না। তবে আরো কিছুদিন দেখলে কতটা ভালো
বলতে পারতাম।
তুমি একটা ব্ল‍্যাংক চেক সই করে আমাকে দেবে?

হানিফ সাহেব মৃদু হেসে বললেন, কি করবি?
দরকার আছে, দেবে কিনা বল না?
না বললে দেব না।

আঃ ড্যাডী, দেরি হয়ে যাচ্ছে। মহি না আবার চলে যায়?
না, সে যাবে না। তুই আগে বল।
ড্যাডী এবার কিন্তু আমি রেগে যাব?

হানিফ সাহেব মেয়ের রাগের কথা জানেন। যা বলবে তা যদি না হয়, তা হলে বলবে এক শিশি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়ব। ছোট বেলায় কান্না-কাটি করে না খেয়ে জীদ পূরণ করত।

বড় হয়ে একবার যা কাণ্ড ঘটিয়েছিল, সে কথা মনে পড়লে হানিফ সাহেবের বুক শুকিয়ে যায়। তখন মিমি ক্লাস টেনে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে এসে বলল, আমার ক্লাসফ্রেন্ড রুমকি তার বাবা-মার সঙ্গে কলকাতা বোম্বাই, দিল্লী, আগ্রা বেড়াতে গিয়ে কত ঐতিহাসিক নিদর্শন দেখে এসেছে। আমারও খুব ইচ্ছা করছে ঐ সব জায়গা ঘুরে দেখার।

চল না ড্যাডী, মাম্মী, আমি, তুমি, জুলি আপা, সুমন সবাই মিলে বেড়িয়ে আসি।
হানিফ সাহেব সেই সময়ে সবেমাত্র ব্যবসার মন্দাভাব কাটিয়ে উঠেছেন। দম ফেলার ফুসরৎ নেই।

মেয়েকে অনেক করে বুঝিয়ে বললেন, এখন তো মা সময় হবে না। তুমি এস.এস.সি পরীক্ষাটা দিয়ে নাও। তারপর নিয়ে যাব। পরীক্ষার পর তুমি দু-তিন মাস ছুটি পাবে। আর আমিও ততদিনে সময় করে নিতে পারব। মিমি কিন্তু শুনল না। ছেলেমানুষের মতো জীদ করতে লাগল।

মাহিলা খাতুন মেয়েকে খুব রাগারাগি করলেন। হানিফ সাহেব শুধু বুঝিয়েছেন, রাগারাগি করেন নি।
পরের দিন স্কুল থেকে ফেরার সময় মিমি জানাশোনা ফার্মেসী থেকে এক শিশি ঘুমের ওষুধ কিনে আনে। দোকানদার কোনো কথা জিজ্ঞেস করে নি।

মনে করেছে ওর মা হয়তো কিনতে পাঠিয়েছেন। কারণ প্রায়ই তার কাছ থেকে ঘুমের ওষুধ কিনে নিয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যার পর মাহিলা খাতুন যখন ঐ ওষুধ কিনতে আসলেন তখন দোকানদার বলল, আপনার মেয়ে তো এক শিশি কিনে নিয়ে গেছে। মাহিলা খাতুনের বুকটা ধড়াস করে উঠল।

তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে স্বামীকে সে কথা বললেন। তখন রাত আটটা। মিমি ভেবে রেখেছে, খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই যখন ঘুমিয়ে যাবে তখন সে সব ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুমিয়ে গেলে নাকি মৃত্যু যন্ত্রণা বুঝতে পারা যায় না।

এ কথা সে তার ক্লাসমেট রীনার কাছে শুনেছে। রীনার বড় বোন তাদের ড্রাইভারের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল। তার বাবা পুলিশ কেস করে তাদেরকে ধরে এনে মেয়েকে খুব শাসন করে। আর ড্রাইভারকে ভয় দেখিয়ে জোর করে ডিফোর্স করিয়ে নিয়ে অপমান করে তাড়িয়ে দেয়।

সেই রাতে রীনার বড় বোন একশিশি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ে। হানিফ সাহেব শুনে তাড়াতাড়ি স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মিমির রুমে ঢুকে তাকে শুয়ে থাকতে দেখে খুব ভয় পেয়ে গেলেন। কাছে গিয়ে মেয়ের পাশে বসে বললেন, তোর কি হয়েছে, রাগ করেছিস?

ঠিক আছে, কালকেই পাসপোর্টের ব্যবস্থা করছি। হয়ে গেলেই আমরা সবাই মিলে ইন্ডিয়ায় গিয়ে সমস্ত বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখে আসব।

মিমি ধড়মড় করে উঠে ড্যাডীকে জড়িয়ে ধরে বল সত্যি বলছ?
হ্যাঁ মা সত্যি বলছি। চল খাবি চল।

মাহিলা খাতুন স্বামীকে বললেন, তুমি যাও, আমি ওকে নিয়ে আসছি। হানিফ সাহেব বেরিয়ে গেলে মাহিলা খাতুন মেয়েকে আদর করতে করতে বললেন, তুই নাকি আমার জন্য ফার্মেসী থেকে ঘুমের ওষুধ নিয়ে এসেছিস?

ফার্মেসীতে কিনতে যেতে তারা বলল। আমার ওষুধ যে ফুরিরে গেছে তুই জানলি কি করে? যাক, এনে ভালই করেছিস। কোথায় রেখেছিস? আমার রুমে তো পেলাম না।

মিমি মাম্মীর চালাকি ধরতে পারল না। ভয়ে ভয়ে গদীর নিচে থেকে শিশিটা বের করে তার হাতে দিল।
মাহিলা খাতুন মেয়েকে সঙ্গে করে খাবার রুমে এলেন। মাস খানেক পর হানিফ সাহেব সবাইকে নিয়ে পনের দিন ইন্ডিয়া ঘুরে এসেছিলেন।

তারপর থেকে তাকে বকাবকি করলেই বলে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ফেলব।
এখন আবার মেয়ে রেগে যাওয়ার কথা শুনে ভয় পেলেন। গম্ভীর মুখে বললেন, দেব।

মিমি ড্যাডীরে গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি রাগ করলে?
হানিফ সাহেব সামলে নিয়ে মৃদু হেসে বললেন না করি নি। এবার চল মহি চলে যাবে না? তারা যখন ড্রইংরুমে ফিরে এল তখন কাজের মেয়ে তিন কাপ কফি দিয়ে গেল।

মিমি ড্যাডীকে ও মহিকে দু কাপ দিয়ে নিজেও একটা নিল। তারপর কফি খেতে খেতে বলল, ড্যাডী আমি মহির সঙ্গে পার্টনারে বীজনেস করতে চাই, তুমি কি কিছু বলবে?

হানিফ সাহেব বললেন তুই যা ভালো বুঝবি করবি, তাতে আমি কি বলব?
কিন্তু মহি তো রাজি হচ্ছে না।
কেন?

আমাকে তো কত রকমের কথা বলল। কোথায় বাধা তুমি ওর সঙ্গে আলাপ কর, আমি একটু আসছি বলে মিমি ভিতরে চলে গেল।

হানিফ সাহেব মহিকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, তোমাকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে? মিমিই বা কেন তোমার বীজনেস পার্টনার হতে চাচ্ছে? আর তুমিই বা তাকে নিতে চাচ্ছ না কেন?

মহি বলল, বীজনেসের ব্যাপারে আমি একটা বেটার চান্স পেয়েছি। বেশ কিছু টাকা ইমিডিয়েট দরকার। তা না হলে চান্সটা মিস হয়ে যাবে। এখনো সম্পূর্ণ টাকাটা ম্যানেজ হয় নি। মিমি সে কথা জানতে পেরে ডাইরেক্ট টাকাটা দেওয়ার কথা বলতে না পেরে পার্টনার হওয়ার প্রস্তাব দেয়।

তাতে আমি রাজি না হওয়াতে আপনার কাছে নিয়ে এসেছে। আমি অবশ্য জানতে পারি নি, সে এখানে নিয়ে আসবে।
হানিফ সাহেব প্রথম জীবনে ধর্মের কোনো কিছু তেমন জানতেন না। আর ধর্মের ধারও ধারতেন না।

ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের সময় আকবর সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ইসলামের আদর্শের কথা জানতে পারেন। তারপর থেকে তিনি ধর্মের সবকিছু জানার জন্য প্রেরণা অনুভব করতেন। কিন্তু কর্মব্যস্ততায় তা সম্ভব হয় নি।’

পরে যখন জুলি একজন ধার্মিক ছেলেকে বিয়ে করতে চাইল তখন থেকে পরিবর্তন আসল। স্ত্রী মাহিলা খাতুনকে তিনি অত্যন্ত ভালবাসেন। তাই তিনি তার অনেক অন্যায় সহ্য করেন। এমন কি তিনি তাঁর যথেচ্ছাচারের উপরও কোনো দিন হস্তক্ষেপ করেন না।

তিনি খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। ভিতরে ভিতরে স্ত্রীর অনেক কার্যকলাপে অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কিন্তু কোনো দিন তাকে বুঝতে দেন নি। জুলির বিয়ের পর থেকে তিনি পুরোপুরি ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং ঠিকমতো নামায-রোযা করেন। স্ত্রীর সঙ্গে মনোমালিন্যের ভয়ে বাসায় কোনো দিন নামায পড়েন নি।

তবে রোযার ব্যাপারটা নিয়ে কোন গোলমাল হয় নি। কারণ মাহিলা খাতুন ধর্মের কিছু না করলেও রোযা রাখেন। বড় মেয়ে জুলির মতো মিমিকেও ধার্মিক ছেলের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখে তিনি মনে মনে খুশী।

কারণ আজকাল ছেলে-মেয়েরা যে ধর্ম বিমুখ হয়ে চরিত্রের অবক্ষয়ের দিকে ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে, তা তিনি অহরহ দেখতে পাচ্ছেন। সেইজন্য তিনি মিমিকে বাধা দেন নি। আর ছেলে সুমনের দিকে প্রখর দৃষ্টি রেখেছেন।

আজে-বাজে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে নিষেধ করেন, তবু সুমন মায়ের আঙ্কারায় একটু বেলাইনে চলেছে বলে তাঁর মনে হয়। মাঝে মাঝে তাকে এমন ছেলেদের সঙ্গে মিশতে দেখেছেন, যাদেরকে তিনি অপছন্দ করেন।

বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়ে কোনো কোনো দিন রাত করে বাসায় ফিরে। এ নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে অল্প অল্প কথা কাটাকাটিও করেন। মাহিলা খাতুন বলেন, উঠতি বয়সের ছেলেরা একটু আধটু এমন হবেই। তা নিয়ে তুমি এত হৈ চৈ করছ কেন?

এই বয়সে নিজে কি করেছিলে ভুলে গেছ বুঝি?
হানিফ সাহেব তখন রেগে গেলেও সংযত থেকে বলেছেন, সে যুগের সঙ্গে আজকের যুগের তুলনা কর কেন? মাহিলা খাতুন বলেছেন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাই তো উচিত।

সেদিন থেকে তিনি আর স্ত্রীর সঙ্গে ছেলের ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামান না? যতটা পারেন ছেলেকে মাঝে মাঝে সৎ উপদেশ দেন। এখন মহির কথা শুনে হানিফ সাহেব বললেন, শোন মহি, তোমাকে আমি ব্যবসা-সংক্রান্ত কিছু কথা বলব, কিছু মনে করো না।

ব্যবসাতে সুযোগ-সুবিধা সব সময় আসে না। যে বুদ্ধিমান হয়, ধার কর্জ করে হলেও সে সুযোগটা নেবেই। মিমি তোমাকে আমার কাছে এনে খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। প্রয়োজনের সাথে সাথে আমার কাছে তোমার নিজের আসা উচিত ছিল।

তা হলে মিমির কাছে তোমাকে ছোট হতে হত না। আমিতো সেদিন তোমাকে অফিসে বলেছিলাম, আল্লাহ নিজের হাতে কাউকে কিছু দেন না। কারুর মারফত দেন। বুঝতে পারছি তিনি তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন।

আর সেই জন্য তুমি না এলেও তিনি মিমিকে দিয়ে আনিয়েছেন। তুমি যদি মিমির কাছ থেকে কোনো রকমের সাহায্য নিতে অপমানিত বোধ কর, তা হলে আল্লাহ ও তার রাসুলকে (দঃ) খুশী করার জন্য আমি তোমাকে তোমার প্রয়োজনমত “কর্জে হাসানা” দেব। “কর্জে হাসানা” অর্থ নিশ্চয় জান?

মহি বলল, জি জানি। তারপর সে হানিফ সাহেবের উন্নত চরিত্রের কথা চিন্তা করে কি বলবে না বলবে ভেবে ঠিক করতে পারছিল না। তাই চুপ করে রইল।

হানিফ সাহেব তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বললেন, এতে ভাববার কি আছে? পৃথিবীতে যত বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন, তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া ব্যবসায়ী মাত্রেই সবাই ব্যাংকের সাহায্য নিচ্ছে। তুমি তো দান গ্রহণ করছ না।

তোমার টাকার প্রয়োজন অথচ তোমার নেই। আমার অনেক আছে, আমি তোমাকে সাহায্য করব। এতে তো কোনো রকম বাধা থাকতে পারে না। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত প্রয়োজনে অন্য মুসলমানকে সাহায্য করা।

মুসলমান হয়ে যদি আমি তোমাকে সাহায্য না করি, তা হলে আল্লাহপাকের কাছে হাশরের ময়দানে মুখ দেখাব কি করে? আমার কথা শুনে তুমি খুব আশ্চর্য হচ্ছ বুঝতে পারছি। কারণ অনেকের ধারণা গরিবদের রক্ত চুষে খেয়ে খেয়ে ধনীদের দীল পাষাণ হয়ে গেছে।

তারা শুধু টাকা, আয়েশ, আরাম ও বিলাসিতা বুঝে। তারা গরিবদের ঘৃণা করে। তাদেরকে মানুষ বলেও গণ্য করে না। তাদের জানাটা ঠিক, তবে পুরোটা নয়। সমাজে এখনো অনেক ধনকুবের আছেন, যাঁরা তাঁদের সেই অথৈ ধনরাশি দেশ ও দশের জন্য ব্যয় করে থাকেন।

তবে তাদের সংখ্যা বর্তমানে এত কম যে, সাধারণ মানুষের জানার বাইরে। তুমি শুনে আরো আশ্চর্য হবে, আমিও একবার তোমার থেকে অনেক বড় বিপদে পড়েছিলাম। সেই সময় আল্লাহ তাঁর এক নেক বান্দাকে দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছিলেন।

তা না হলে কোথায় থাকতাম জানি না। তারপর তিনি চুপ করে গেলেন। হানিফ সাহেবের কথা শুনতে শুনতে মহি অধিক থেকে অধিকতর আশ্চর্য বোধ করছিল।

কিন্তু অযাচিত সাহায্য নিতে তার খুব বিবেকে বাধল। কেবলই তার মনে হতে লাগল, মিমি আমাকে ভালবাসে বলে হয়তো তার উপযুক্ত করার জন্য সাহায্য করতে চাইছেন। সে বেশ অপমান বোধ করল।

এমন সময় মাহিলা খাতুন বাসায় ফিরলেন। একটা দাড়িওয়ালা ছেলেকে বসে থাকতে দেখে স্বামীর দিকে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে তাকালেন।

হানিফ সাহেব বললেন, মিমির বন্ধু। তারপর মহির দিকে তাকিয়ে বললেন, মিমির মাম্মী।
মহি সালাম জানাল।

মাহিলা খাতুন শুধু হাত তুলে প্রত্যুত্তর দিলেন, মুখে কিছু বললেন না।
মহি হানিফ সাহেবকে বলল, আমাকে এবার যাওয়ার অনুমতি দিন।

হানিফ সাহেব বললেন, বস বস, যাবে তো নিশ্চয়। আমাদের আলোচনাতো এখনো শেষ
হল না? তা ছাড়া মিমির সঙ্গে দেখা করে যাবে না?

ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলে নেব। আমাকে কয়েক জায়গায় যেতে হবে।
কিন্তু টাকার ব্যাপারে তো কিছু বললে না?

মহি মিমির মাম্মীর দিকে এক পলক তাকিয়ে বুঝতে পারল, তিনি খুব বিরক্তিপূর্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হানিফ সাহেবের কথার উত্তরে বলল, আপনি কি মিমির সঙ্গে আমার সম্পর্কটা জানেন?

জানি।
সম্পর্কটা না জানলে অথবা না থাকলেও কি এই সব কথা বলতেন?
বলতাম হে ছোকরা বলতাম। তুমি কিন্তু একটু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ।

ছেলে মনে করে মাফ করে দেবেন। আরো একটু বেয়াদবি করব, মিমির সঙ্গে যদি কোনো রকম সম্পর্ক না থাকত, তা হলে আপনার কথা আমি মাথা পেতে নিতাম, ঔদ্ধত্য ও বেয়াদবির জন্য আবার ক্ষমা চাইছি। এবার অনুমতি দিন বলে সে দাঁড়িয়ে সালাম বিনিময় করে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।

এদিকে মিমি ড্যাডীকে বোঝাতে বলে বাথরুমে গিয়েছিল। ফিরে এসে দরজার আড়াল থেকে এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। মহিকে চলে যেতে দেখে দ্রুত ঘরে ঢুকে তার পথ রোধ করে বলল, একটু কিছু মুখে দিয়ে যাও।

আজ থাক, দেরি হয়ে গেছে। অন্য দিন বলে সে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল। মিমিও তার সঙ্গে আসতে আসতে বলল, একটা অনুমতি চাইব?

চাও।
আজ রাতে ফোন করব।
তখন ওরা বারান্দায়। মহি থমকে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকাল। দেখল, চোখ ভরা মিনতি।

বলল, নিষেধ করেছি নাকি?
আর একটা?
বল।

তুমি যদি আজ মার্কেটে না যাও, তা হলে ড্রাইভার তোমাকে গাড়ি করে বাসায় পৌছে দিক?
মহি ডান হাত দিয়ে তার নরম তুলতুলে মাংসল গালটা আস্তে করে টিপে ধরে নাড়া দিতে দিতে বলল, সবটাতে বাড়াবাড়ি।

হাদিসে আছে, “কোন জিনিসের বাড়াবাড়ি ভালো নয়, সব জিনিসের মধ্যম ভাল”। তারপর হাতটা সরিয়ে নিয়ে চলতে শুরু করল। গেটের বাইরে এসে স্কুটার না পেয়ে একটা খালি রিক্সা দেখতে পেয়ে তাতে উঠে বসল।

মহি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মাহিলা খাতুন স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটার সঙ্গে টাকার কথা নিয়ে কি যেন আলোচনা হচ্ছিল? আর মিমির সঙ্গে কিসের সম্পর্কের কথাও জিজ্ঞেস করছিল? ব্যাপারটা খুলে বলতো?

ছেলেটা মিমির বন্ধু আগেই বলেছি। ও ইংলিশে অনার্স। ছোটখাট কিসের যেন ব্যবসা করে। ব্যবসায়িক কারণে তার বেশ কিছু টাকা দরকার। মিমি তা জানতে পেরে আমার কাছে নিয়ে এসেছিল। আমি তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, দেখলে তো, মিমির বন্ধু বলে তার বাবার কাছ থেকে সাহায্য নিতে অস্বীকার করে চলে গেল।

কিন্তু মিমি তার সব খবর রাখবে কেন?
বারে বন্ধু বন্ধুর খবর রাখবে না?

মাহিলা খাতুন একটু রাগের সঙ্গে বললেন, না, রাখবে না। কোথাকার কে ছেলে? বন্ধুত্ব থাকলে বুঝি তার সব খবর রাখতে হবে? তারপর মিমির রুমের দিকে গেলেন।

মাহিলা খাতুন যখন মেয়ের রুমে ঢুকলেন তখন মিমি ড্রেস চেঞ্জ করে বই নিয়ে বসেছে। জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটার সঙ্গে তোর কত দিনের বন্ধুত্ব?

দেড় দু’মাস হবে।
কি করে হল?

কি করে আবার? একদিন হঠাৎ করে আলাপ হল। ছেলেটা না মা ইংলিশে অনার্স,, খুব ভালো ছেলে। তাই বন্ধুত্ব করে ফেললাম। এই কদিনের বন্ধুত্বে তার সঙ্গে এত কি সম্পর্ক হল যে, তাকে সাহায্য করার জন্য বাসায় নিয়ে এসেছিস?

তাতে কি হয়েছে? দেখলে তো, ছেলেটা কত ভালো? ড্যাডী স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে চাইলেও না নিয়ে চলে গেল।
যতই ভালো হোক, তার সঙ্গে তুই আর মিশবি না।
কেন?

কেন আবার, ও রকম ছেলে আমার পছন্দ নয়।
তুমিতো তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছ না?

মিমি মুখ সামলে কথা বল। ওকে আর কোনো দিন যেন আমি না দেখি।
তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? ছেলেটার দোষ কোথায় বলবে তো?

গরিব ও দাড়িওয়ালা ছেলেদের আমি মোটেই দেখতে পারি না।
মাম্মী, মহি বড় লোক না হতে পারে, কিন্তু গরিব নয়। আর দাড়ি নিয়ে কথা বলছ কেন?

দাড়ি তো বড় বড় মনীষীরাও রেখেছেন। সেটা আমিও জানি। তাঁদের দাড়ি রাখার সঙ্গে এদের অনেক তফাৎ। যাই হোক, ছেলেটা যেন আর বাসায় না আসে। আর তুইও তাকে আনবি না।

কিন্তু বন্ধু-বন্ধুর বাসায় আসবে না?
বললাম তো আসবে না।

সে যখন আমার বন্ধু তখন নিশ্চয় আসবে, তাতে তোমার কি? তোমার বন্ধুরা কত আসে, কই আমি তো কোনো দিন কিচ্ছু বলি নি?

বড়দের সঙ্গে কি রকম ভাবে কথা বলতে হয় শিখিস নি?
তুমি কি শিখিয়েছ?

মিমি, তুই সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছিস। বুঝে-সুজে কথা বল নইলে……
নইলে কি করবে শুনি?

হানিফ সাহেব স্ত্রীকে মেয়ের ঘরের দিকে যেতে দেখে যা অনুমান করেছিলেন তাই। তাদের গলার উচ্চস্বর শুনে তিনি সেখানে এসে বললেন, এসব কি হচ্ছে তোমাদের? তারপর মেয়েকে বললেন ছি-মা, মাম্মীর সঙ্গে রাগারাগি করতে নেই।

তারপর স্ত্রীকে বললেন, ও ছেলেমানুষ, যা বলার বুঝিয়ে বললে তো পারতে। ওর কত বন্ধুতো প্রায় আসে। চল এখান থেকে। মাহিলা খাতুন মেয়েকে রেগে যেতে দেখে স্বামী আসবার আগেই সামলে গেছেন। কোনো কথা না বলে স্বামীর সঙ্গে ফিরে এলেন।

সেরাতে মিমি রাগ করে ভাত খেতে চাইল না। মাহিলা খাতুন দু’বার এসে নরম সুরে খোশামোদ করে গেছেন। মিমি ক্ষিদে নেই বলে এড়িয়ে গেছে। শেষে হানিফ সাহেব স্ত্রীকে সঙ্গে করে এসে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে খাওয়ালেন।

খেয়ে এসে মিমির আজ আর পড়তে ভালো লাগল না। ভাবল, মহিকে একবার রিং করে দেখবে নাকি? আবার ভাবল, এত তাড়াতাড়ি কি ফিরেছে? তার চেয়ে এখন একটু ঘুমিয়ে নিই, বারটা-একটার দিকে ঘুম ভাঙলে রিং করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। মহির কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

ওদের দু’টো টেলিফোন একটা ড্রইংরুমে অন্যটা হানিফ সাহেবের বেডরুমে। বাড়িটা দোতলা গোলাকার, ফ্লাট সিস্টেম, দু’টো সিঁড়ি। মিমি ড্রইংরুমে থেকে মহিকে ফোন করে। ওরা সবাই দোতলাতেই থাকে, নিচের বড় হলরুমটা ড্রইংরুম।

মিমির কিন্তু ঘুম ভাঙল না, একঘুমে ভোর। তাড়াতাড়ি করে লাইট জ্বেলে ঘড়ি দেখল, পাঁচটা। ড্রইংরুমে এসে ফোন করল। একটানা রিং বেজে চলেছে। ভাবল, মহির ঘুম হয়তো এখনো ভাঙে নি। রিসিভার রাখতে যাবে এমন সময় একটা মেয়ে ফোন ধরে বলল, হ্যাল্লো, কাকে চান?

মহি কোথায়?
আপনি কে বলছেন?
মিমি।

আসিয়া ফজরের নামায পড়বে বলে কলতলায় অযু করতে যাওয়ার সময় একটানা ফোন বাজতে শুনে ফোন ধরেছে। বলল, বড় ভাইয়া মসজিদে নামায পড়তে গেছে।

মিমি বলল, তোমার ভাইয়াকে বলো আমি ফোন করেছি, আবার করব।
আসিয়া বলল, আচ্ছা বলব।

মিমি ফোন ছেড়ে দিয়ে রুমে ফিরে এসে বাথরুমে ঢুকল অযু করার জন্য। সে আজ দু’দিন হল নামায পড়ছে। মাম্মী যাতে না জানতে পারে সে জন্য নামায পড়ার সময় দরজা বন্ধ করে দেয়। জুলি আপা বাসায় নামায পড়ত বলে মাম্মী তাকে বকাবকি করত।

তাই এই ব্যবস্থা। আর ঐ একই কারণে সে বাসায় রুমাল ও ওড়না ব্যবহার করে না। বাসায় ঢোকার আগে এগুলো সে দারোয়ানের কাছে রেখে আসে। আবার বাইরে যাওয়ার সময় তার কাছে থেকে নিয়ে রাস্তায় পরে।

মিমিদের বাসা থেকে ফেরার পথে মহি রিক্সায় চিন্তা করল, ওদের সাহায্যকে ডিনাই করে কি ভুল করলাম? হানিফ সাহেবের কথা মনে পড়ল, “আল্লাহ কাউকে সাহায্য করতে চাইলে অন্য একজনকে দিয়ে করিয়ে থাকেন।”

মনে মনে ফরিয়াদ করল, “হে আল্লাহ, তুমি আলেমূল গায়েব, তুমি মানুষের অন্তরের খবর জান। আমি যে কেন তাদের সাহায্য নিতে পারছি না, তা তুমি জান। তুমি আমাকে কারো কাছে অপমানিত কর না।

আমি হালাল উপায়ে উপার্জন করার জন্য তোমার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছি। তুমি উত্তম, রেযেকদাতা ও উত্তম সাহায্যকারী, তুমি আমাকে রেজেক দান কর এবং সাহায্য কর”। ঐদিন সে মার্কেট থেকে সকাল সকাল বাসায় ফিরে এল।

মালেকা বানু ছেলেকে দেখে বললেন, কিরে, আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলি যে? মহি বলল, তুমি একটু আমার ঘরে এস, বলছি।

মালেকা বানু ছেলের ঘরে এসে একটা চেয়ারে বসে অন্য একটা চেয়ার টেনে সামনে এনে বললেন, আমার কাছে বস। মহি বসার পর তার গায়ে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কাজ করে করে তোর কি চেহারা হয়েছে?

এভাবে দিন রাত কাজ করলে অসুখে পড়ে যাবি তো। তারপর ছেলের চিন্তাক্লীষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে, ব্রাকি টাকাটার কিছু ব্যবস্থা হল?

মহি বলল, না হয় নি। তারপর অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, জান আম্মা, একজন আমার টাকার দরকার জানতে পেরে সরাসরি দেওয়ার কথা না বলে পার্টনার হয়ে দিতে চেয়েছিল। আমি রাজি হলাম না।

তখন সে আমাকে তার আব্বার কাছে নিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা জানাল। তার আব্বা একজন খুব বড় ব্যবসায়ি। শুনে তিনি বললেন, যদি পার্টনার না নিতে চাও, তবে তোমার ব্যবসার উন্নতির জন্য যতটাকা প্রয়োজন আমি তোমাকে “কর্জে হাসনা’ দেব।

আমি তো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভাবলাম, আজকালের যুগে আল্লাহর এ রকম বান্দাও তা হলে আছেন। আমি কিন্তু অস্বীকার করে চলে এসেছি।

মালেকা বানু বললেন, যতদিন দুনিয়া থাকবে ততদিন আল্লাহর নেকবান্দা কেউ না কেউ থাকবেই। “কর্জে হাসনা” যখন দিতে চাইলেন তখন তুই নিতে পারতিস। সুবিধে মতো শোধ করে দিতিস।

তোর আব্বার মুখে শুনেছি, আল্লাহ যাকে সাহায্য করতে ইরাদা করেন, তাকে অন্যের অসিলায় করেন। তিনি নিজে কাইকে কিছু দেন না। তিনি যা ইচ্ছা করতে পারেন, এটা তার কুদরতী শক্তি। অনেক সময় তিনি দুষমণকে দিয়েও সাহায্য করিয়ে থাকেন।

মহি বলল, আমিও সেই কথা ভেবে নিতাম, যদি না তার মেয়ের সঙ্গে আমার…… বলে থেমে গেল। বেখেয়ালে বলে ফেলে ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল।

মালেকা বানু বললেন, কিরে চুপ করে গেলি কেন? তার মেয়ের সঙ্গে কি হয়েছে? মেয়েটা বুঝি টাকা দিতে নারাজ?
মহি বলল, না তা নয়, বরং মেয়েটাই টাকা দিয়ে পার্টনার হতে চেয়েছিল।

এতক্ষণে মালেকা বানু ছেলের টাকা না নেয়ার কারণটা বুঝতে পারলেন। বললেন, ভালই করেছিস, মেয়েকে পার্টনার না নিয়ে তার আব্বার কাছে থেকে টাকা নিলে ব্যাপারটা খুব খারাপ দেখাত।

তুই চিন্তা করিস না, যা যোগাড় হয়েছে আর আমার কাছে যা আছে, তাই নিয়ে তুই কাল চিটাগাং চলে যা, আল্লাহ রাজি থাকলে ওর মধ্যেই তোর কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে। এখন আমি যাই, ওদেরকে খেতে দিই, তুইও হাত-মুখ ধুয়ে আয় খেয়ে নিবি।

তারপর যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বিকেলে ঐ মেয়েটা এসেছিল কেন? মহি কখনো মিথ্যা বলে নি। সত্য কথা বলতে তার খুব লজ্জা করছে। কি বলবে মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল।

ছেলের অবস্থা বুঝতে পেরে মালেকা বানু বললেন, অত লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আমি না তোর মা। ঐ মেয়েটাই তো মাঝে মাঝে ফোন করে?

মহি শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
মালেকা বানু ভাবলেন, তা হলে কি ঐ মেয়েটাই পার্টনার হতে চেয়েছিল? জিজ্ঞেস করে দেখব নাকি? আবার ভাবলেন, এমনিতেই যা লজ্জা পেয়েছে, একথা জিজ্ঞেস করলে আরো পাবে।

বললেন, ওদের বাসার ঠিকানাটা দিস, একদিন গিয়ে ওর আব্বা-আম্মার সঙ্গে আলাপ করে আসব।
মহি কোন রকমে বলল, সে দেখা যাবে। এখন যাও ভাত বের কর, ক্ষিদে পেয়েছে। হ্যাঁ আয় বলে মালেকা বানু রুমে থেকে বেরিয়ে গেলেন।

মহি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল, এ সময় যদি মিমি ফোন করত, তা হলে লজ্জা রাখার আর জায়গা থাকত না। সে রাতে মহি তাহজুদের নামায পড়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে দোষ ত্রুটী মাফ চেয়ে সাহায্য প্রার্থনা করল।

ঘুমাবার সময় চিন্তা করল, মিমি ফোন করার অনুমতি চেয়েও করল না কেন? তা হলে ওর মাম্মী জানতে পেরে কি ওকে রাগারাগি করেছেন?

ফজরের নামায পড়ে মিমি বিছানার উপরে পড়তে বসল। ভেবে রেখেছে, ড্যাডী অফিসে চলে যাওয়ার পর ফোন করবে। পড়ছিল আর মাঝে মাঝে টেবিল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।

এমন সময় ড্যাডীর গলা শুনতে পেল, মিমি তুই কি পড়ছিস?
ইয়েস ড্যাডী, কাম ইন।

হানিফ সাহেব ভিতরে এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন, মহির টাকার ব্যপারে কি কিছু
ভেবেছিস?

কি ভাববো? কিছু বললে তো শুনবে না, সব সময় নিজের গঁয়ে চলে। আমাদের সাহায্য নিলে একটু তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে পারত। অবশ্য আমার বিশ্বাসও একদিন না একদিন বড় হবেই ইনশাআল্লাহ। কিছু দিন সময় লাগবে আর কি।

মেয়ের কথা শুনে হানিফ সাহেব মনে মনে খুশী হলেন। তারপর সইকরা ব্ল‍্যাংক চেকটা বের করে মেয়েকে দিতে গেলেন।
মিমি বলল, ওটা আর লাগবে না, গতকাল যাওয়ার সময় কি বলে গেল মনে নেই বুঝি?

তুই যদি কোন বুদ্ধি টুদ্ধি করে চেষ্টা করতিস?
ওর গঁয়ের কাছে কোনো বুদ্ধিই খাটবে না। যে বুদ্ধি করেই দিতে যাই না কেন, কোনো কাজ তো হবেই না, বরং উল্টে মনে ব্যথা পাবে।

উল্টে রাগ না করে ব্যথা পাবে কেন?
ও আমার উপর রাগ করতে পারে না বলে।

তুই বললি ওর খুব গ। ওর গঁটা তোর কাছে কেমন লাগে? মনে ব্যথা লাগে না?
ও ন্যায়ের পথে থেকে নিজের গঁয়ে চলে, তাতে আমার মনে ব্যথা লাগবে কেন।

তুই ঠিক বলেছিস, যাদের মধ্যে এ ধরনের গঁ থাকে, তারা জীবনে উন্নতি করে। গঁ মানে কি জিনিস? প্রিনসিপাল অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব। নিজস্ব প্রিনসসিপাল না থাকলে বড় হওয়া যায় না। আজকালের ছেলেরা ঘন্টায় ঘন্টায় নিজের ব্যক্তিত্বকে সার্থের খাতিরে বদলে ফেলে।

আর শোন, মহিকে একটু বুঝিয়ে বলবি, সে যেন মতিঝিলের আশে-পাশে একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী করার চেষ্টা করে। আজকাল বিদেশে বাংলাদেশের জামা-কাপড়ের খুব চাহিদা। উঁচু লেবেলের অনেকের সঙ্গে আমার খাতির আছে, আমি তাদেরকে দিয়ে সুযোগ-সুবিধা করে দেব।

তুই শুধু এ ব্যাপারে একটু হিন্টস দিয়ে ওর এ্যানার্জী আনাবি। খুব সাবধানে এগোবি, যদি জানতে পারে এ সবের পিছনে আমি আছি, তা হলে কোনো সুযোগই নেবে না, যা সেন্টিমেন্টাল ছেলে? হ্যাঁরে, যা বললাম পারবি না?

তুমি দো’য়া কর ড্যাডী, আমি যেন কৃতকার্য হতে পারি।
পারবি রে পাগলি পারবি। আমি দো’য়া করছি পারবি। আর একটা কথা, মহির ব্যাপারে তোর মাম্মী যদি তোকে রাগারাগি করে, তবে তুই মাতবি না। তাকে একটু ম্যানেজ করে চলবি।

তাই হবে ড্যাডী। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ঠিক উত্তর দেবে তো?
বলেই দেখ না?

আমার দৃঢ় ধারণা, জুলি আপা হারিয়ে যায় নি। তার খবর মাম্মী না জানলেও তুমি জান। জুলি কোথায় আছে বলে তোর ধারণা?
শাহিনকে বিয়ে করে তাদের বাড়িতে আছে।

হানিফ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত রেখে নাড়া দিয়ে বললেন, মাই ডিয়ার চাইল্ড, ইউ আর ভেরী ইন্টেলিজেন্ট। তারপর গলার স্বর খাটো করে বললেন, তোর ধারণা ঠিক। তবে এখন এসব কথা কারো কাছে বলবি না। তোর মাম্মীকে একটু শিক্ষা দিতে চাই।

জানিস, তোর তালই সাহেব এত বড়লোক, তিনি আমার মতো দু-দশ জন বীজনেস ম্যাগনেটকে কিনে নিতে পারেন।
মিমি চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি বলছ ড্যাডী?

হ্যাঁরে পাগলি হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
তারপর তিনি জুলির বিয়ের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলো বললেন, জুলি আজ দুবছর মিসরে শাহিনের কাছে চলে গেছে।

এদিকে মাম্মী যে কত কাঁদে, তোমার মায়া হয় না?
হয়, আরো কিছুদিন শিক্ষা পাক। তারপর তোর আর মহির বিয়ের সময় ওদেরকে আসতে বলব।

তুমি আমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছ বলে মিমি হানিফ সাহেবের বুকে মাথা রাখল।
হানিফ সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। অনার্সটা ভালোভাবে নে? আর ততদিন মহিও গুছিয়ে উঠুক, কেমন?

ও ড্যাডী, তুমি দুষ্টু ছেলের মতো কথা বলছ।
নে এবার পড়। তোর মা আবার আমার খোঁজে এখানে না এসে পড়ে। কথা শেষ করে তিনি বেরিয়ে গেলেন।

ড্যাডি অফিসে চলে যাওয়ার পর মিমি ড্রইং রুমে এসে মহিকে ফোন করল, ড্যাডীর মুখে মহির সঙ্গে বিয়ের কথা শুনে তার সমস্ত দেহে ও মনে আনন্দের স্রোত বইছে।

মহি তখন কারিগরদের কাপড় বুঝিয়ে দিচ্ছিল। আসিয়া এসে বলল, বড় ভাইয়া তোমার ফোন।
মহি রুমে এসে রিসিভার তুলে সালাম দিয়ে বলল, মহি বলছি।

মিমি সালামের প্রতি উত্তর দিয়ে বলল, আমি মিমি।
মিমিকে সালামের উত্তর দিতে শুনে মহি বলল, আলহামদুলিল্লাহ।

এই আলহামদুল্লিাহ বললে কেন? ওটার অর্থ কি?
মহি বলল, কোন সুসংবাদ শুনলে আলহামদুলিল্লাহ বলতে হয়। ওটার অর্থ হল সমস্ত প্রশংসা আল্লাহপাকের।

সুসংবাদগুলোতো এখনো বলি নি। তুমি জানলে কি করে?
তুমি কি, সংবাদের কথা বলছ জানি না, সালামের উত্তরটাই আমার কাছে সুসংবাদ। এইটাই আশা করেছিলাম। আল্লাহ আমার সেই আশা পূরণ করেছেন।

তাই তাঁর প্রশংসাগীত গাইলাম। এবার বল, গতরাতে ফোন করলে না কেন? আমার বুঝি দুশ্চিন্তা হয় না?
সে জন্য ক্ষমা চাইছি। তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। পড়তে ভালো লাগছিল না। তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ি।

তার আগে ভেবেছিলাম, তোমাকে যখন বারটার আগে পাওয়া যাবে না তখন একটু ঘুমিয়ে নেই। সময় মতো ফোন করব। কিন্তু একঘুমে সকাল। তখনই অবশ্য ফোন করেছিলাম। তোমার বোন ধরে বলল, তুমি মসজিদে নামায পড়তে গেছ।

ঠিক আছে, তুমি যখন অনেকবার আমাকে ক্ষমা করেছ তখন আমিও ক্ষমা করে দিলাম। এখন কি খবর বল?
তোমার সঙ্গে কথা আছে।

কথা তো অলরেডী বলছ। আরো থাকলে বল। এমন কিছু কথা থাকে, ফোনে বলা যায় না। সে সব তো বিয়ের পর নতুন স্বামী-স্ত্রীর কথা। এই ফাজিল কি হচ্ছে?

আমি ফাজিল?
তুমি অসভ্য ও।
আচ্ছা তাই আমি ফাজিল, অসভ্য। না আরো কিছু বলবে?

না। তোমার ওসব কিছু হওয়া চলবে না। কি হতে হবে তা হলে? সেই কথাটাই তো তোমার সাক্ষাতে বলতে চাই। ফোনেই বল না। বললাম না, বলা যাবে না। তা হলে সাক্ষাতেই বলো। হ্যাঁ তাই। সেইজন্য বলছি তুমি বিকেলে পার্কে আসবে।

না, এখন তোমাদের বাসায় যাই। না-না, বাসায় এস না। মাম্মী কাল তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। তুমি কে, কেন এসেছ?
তুমি কি বললে?
শুনতে খুব ইচ্ছে করছে না?

করছেই তো।
বলব না।
ঠিক আছে, আমি তাহলে বাসায় এসে পড়ছি। বলছি-বলছি। বললাম, ছেলেটা ফুটপাতের দোকানদার।

একদিন সুমনের জামা কিনতে গিয়ে এমনি একটু আলাপ হয়েছিল। আজ বায়তুল মোকাররমে দেখা হতে আমার কাছে কিছু টাকা ব্যবসা করার জন্য সাহায্য চাইল। তাই ড্যাডীর কাছে এনেছিলাম। ড্যাডী কি উল্টোপাল্টা বলতে টাকা না নিয়ে চলে যায়।

তুমি আমাকে কি মনে কর?
তোমার মনকে জিজ্ঞেস করে দেখ। করলাম, কিন্তু কোনো রিপ্লাই নেই।

মিথ্যে কথা বলছ কেন?
তুমি আগে বললে বলে?
আর বলব না।

তা হলে আমিও আর বলব না। আমার আম্মাও কিন্তু গতরাতে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল, বিকেলে ঐ মেয়েটা কেন এসেছিল রে, মেয়েটা কে? ঐ মেয়েটাই কি তোকে মাঝে মাঝে ফোন করে?

তুমি কি বললে? আমার মতো মিথ্যে বলবে না কিন্তু। অবশ্য একটু আগে আর বলবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছ।
তা হলে যা বলব বিশ্বাস করবে?
করব।

বলব না।
মিমি হেসে উঠে বলল, প্লীজ বল না।
আমি লজ্জায় কিছু বলতে পারি নি। তবে আম্মা কিন্তু সব বুঝে নিয়েছে। কি করে বুঝলেন?

আম্মু কি করে বুঝলেন তা জানি না। আমি কিছু বলছি না দেখে আম্মা বললেন, মেয়েটা তা হলে আমিও বলছি আল্লাহ হাফেজ। মহি ফোন ছেড়ে দিতে একটু পরে অপর প্রান্তে মিমিও ছেড়ে দিল।

সেইদিন বিকেলে মহি বিকেলের ফ্লাইটে চিটাগাং গেল। যাওয়ার সময় তার আম্মার জমান পাঁচ হাজার টাকাসহ মোট পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছে। আল্লাহ পাকের করুণায় ঐ টাকাতেই তার কাজ মিটে গেল।

মালগুলো ট্রান্সপোর্টে বুক করে মহি দু’দিন পর সকালের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরল। বেলা পাঁচটার দিকে মহি প্রথমে অফিসে হানিফ সাহেবকে ফোন করে না পেয়ে বাসায় করল।
মাহিলা খাতুন ফোন ধরে বললেন, কাকে চান?

একটু হানিফ সাহেবকে দেন?
আপনি কে বলছেন?
আমাকে চিনবেন না।
নাম বলুন।
মহিউদ্দিন।

পরিচয়টা জানতে পারি?
মহি ভাবল, আচ্ছা মেয়েরে বাবা, পরিচয় দেওয়া ঠিক হবে কি-না চিন্তা করতে লাগল।
কি হল চুপ করে আছেন কেন?

আচ্ছা বলুনতো, ফোন আসলেই কি আপনি সব সময় আগে তার পরিচয় নেন?
মাহিলা খাতুন রেগে গিয়ে বললেন, সে কৈফিয়ৎ কি আপনাকে দিতে হবে?

আমি তো কৈফিয়ৎ চাইছি না, এমনি জানার ইচ্ছা হল….
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মাহিলা খাতুন বললেন, পরিচয় দিতে এত ভণিতা
করছেন কেন?

পরিচয় দিলে কি চিনবেন?
সেটা আমার ব্যাপার।
মিমির বন্ধু। আপনি কে বলছেন।
সেটা জানা তোমার দরকার নেই। উনি এখনো বাসায় ফেরেন নি।

তা হলে মিমিকে দিন।
না, তাকে দেয়া যাবে না।
মহি বুঝতে পারল, মিমির মাম্মী ফোন ধরেছে। বলল, দয়া করে মিমিকে একটু দিন না।

মাহিলা খাতুন ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন। বললেন, বললাম না, দেওয়া যাবে না।
এমন সময় হানিফ সাহেব বাসায় ফিরে স্ত্রীকে ফোনে রাগের সঙ্গে কথা বলতে দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন।

কাছে এসে বললেন, কী ব্যাপার? কে ফোন করেছে?
মাহিলা খাতুন রিসিভারটা স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন, যতসব ছোটলোক। প্রথমে তোমাকে চাইল। তুমি নেই বলতে মিমিকে দিতে বলল।

আমি রাজি না হতে মিমির বন্ধু বলে পরিচয় দিল। ছেলেটা বড় বেয়াদব, আচ্ছা করে গ্রেটিং দিয়ে দাও। কথা শেষ করে তিনি
সেখান থেকে চলে গেলেন। হানিফ সাহেব স্ত্রীর চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর বললেন, তুমি মহি বলছ?

মহি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল, বাব্বা, মেয়ে নয় যেন আগুনের গোলা। সালাম দিয়ে বলল, জি, আমি মহি বলছি। কেমন আছেন?

হানিফ সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভালো। কি খবর বল।
তা হলে আমিও বলছি আল্লাহ হাফেজ।
মহি ফোন ছেড়ে দিতে একটু পরে অপর প্রান্তে মিমিও ছেড়ে দিল।

সেইদিন বিকেলে মহি বিকেলের ফ্লাইটে চিটাগাং গেল। যাওয়ার সময় তার আম্মার জমান পাঁচ হাজার টাকাসহ মোট পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছে। আল্লাহ পাকের করুণায় ঐ টাকাতেই তার কাজ মিটে গেল।

মালগুলো ট্রান্সপোর্টে বুক করে মহি দু’দিন পর সকালের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরল। বেলা পাঁচটার দিকে মহি প্রথমে অফিসে হানিফ সাহেবকে ফোন করে না পেয়ে বাসায় করল।
মাহিলা খাতুন ফোন ধরে বললেন, কাকে চান?

একটু হানিফ সাহেবকে দেন?
আপনি কে বলছেন?
আমাকে চিনবেন না।

নাম বলুন।
মহিউদ্দিন।
পরিচয়টা জানতে পারি?

মহি ভাবল, আচ্ছা মেয়েরে বাবা, পরিচয় দেওয়া ঠিক হবে কি-না চিন্তা করতে লাগল।
কি হল চুপ করে আছেন কেন?

আচ্ছা বলুনতো, ফোন আসলেই কি আপনি সব সময় আগে তার পরিচয় নেন?
মাহিলা খাতুন রেগে গিয়ে বললেন, সে কৈফিয়ৎ কি আপনাকে দিতে হবে?

আমি তো কৈফিয়ৎ চাইছি না, এমনি জানার ইচ্ছা হল….
তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মাহিলা খাতুন বললেন, পরিচয় দিতে এত ভণিতা
করছেন কেন?

পরিচয় দিলে কি চিনবেন?
সেটা আমার ব্যাপার।
মিমির বন্ধু। আপনি কে বলছেন।

সেটা জানা তোমার দরকার নেই। উনি এখনো বাসায় ফেরেন নি।
তা হলে মিমিকে দিন।
না, তাকে দেয়া যাবে না।

মহি বুঝতে পারল, মিমির মাম্মী ফোন ধরেছে। বলল, দয়া করে মিমিকে একটু দিন না।
মাহিলা খাতুন ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন। বললেন, বললাম না, দেওয়া যাবে না।

এমন সময় হানিফ সাহেব বাসায় ফিরে স্ত্রীকে ফোনে রাগের সঙ্গে কথা বলতে দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেন। কাছে এসে বললেন, কী ব্যাপার? কে ফোন করেছে?

মাহিলা খাতুন রিসিভারটা স্বামীর হাতে দিয়ে বললেন, যতসব ছোটলোক। প্রথমে তোমাকে চাইল। তুমি নেই বলতে মিমিকে দিতে বলল। আমি রাজি না হতে মিমির বন্ধু বলে পরিচয় দিল। ছেলেটা বড় বেয়াদব, আচ্ছা করে গ্রেটিং দিয়ে দাও।

কথা শেষ করে তিনি সেখান থেকে চলে গেলেন। হানিফ সাহেব স্ত্রীর চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। তারপর বললেন, তুমি মহি বলছ?

মহি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল, বাব্বা, মেয়ে নয় যেন আগুনের গোলা। সালাম দিয়ে বলল, জি, আমি মহি বলছি। কেমন আছেন?

হানিফ সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, ভালো। কি খবর বল।
মিমির সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
ধর, দিচ্ছি।

একটু পরে মিমি ফোন ধরে প্রথমে সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, কখন ফিরলে?
এগারটার দিকে।
কোনো অসুবিধে হয় নি তো?

আল্লাহপাকের রহমতে শারীরিক ও ব্যবসায়িক কোনো কিছু অসুবিধে হয় নি। তবে মানসিক হয়েছে।
মিমি বুঝতে পারল, মহি দুষ্টুমী করছে তাই বলল, মানসিক ডাক্তারকে দেখালে না কেন?

চিটাগাং-এ সে ডাক্তার নেই।
কোথায় আছে?
ঢাকায়।
এবার তার কাছে যাও।

সেই জন্যে তো ঢাকায় ফিরেই তাকে ফোনে বুক করতে চাইছি। ডাক্তার সাহেব, আজ বিকেল পাঁচটায় গুলিস্তানে “খাওয়া-দাওয়ায়” আমি থাকব, আপনি যদি দয়া করে একটু আসতেন, তা হলে বাধিত হতাম।

মিমি হেসে ফেলে বলল, না।
কারণটা জানতে পারি স্যার।

এই এখন দুষ্টুমী কর না, মাম্মী এসে পড়তে পারে। এতক্ষণ কথা বলছি জানতে পারলে অসুবিধে আছে। যা বলছি শোন, আগামী কাল সকালের দিকে আমার মাত্র তিনটে ক্লাস আছে। তুমি ঠিক বারটার সময় আর্টস বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ দিকের গেটের পাশে ফুটপাতে যে আমগাছটা রয়েছে, তার ছায়ায় অপেক্ষা করবে।

মহি একটু ভেবে বলল, ঠিক আছে স্যার, আজ যখন আপনি আসতে পারছেন না, তখন আর কি করব। কালকে আপনার কথামতো আমিই না হয় আসব।
মিমি হাসতে হাসতে বলল, তোমার আজ কি হয়েছে বল তো?

তখন বললাম না, মানসিক রোগ?
আবার দুষ্টুমী করছ?
ডাক্তারের সাক্ষাৎ না পেলে দুষ্টুমী সারবে না।

আমি রিসিভার রেখে দিচ্ছি কিন্তু। বলার সঙ্গে সঙ্গে মিমি মহির রাখার শব্দ পেল। সেও রিসিভার রেখে ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বলল, দিন দিন তোমার দুষ্টুমী বেড়ে যাচ্ছে। পরের দিন মহি রিক্সায় করে আসার সময় ট্রাফিক জ্যামে পড়ল।

যখন সে নির্দিষ্ট স্থানে এসে পৌছল তখন বারোটা পঁচিশ। সেখানে মিমিকে না পেয়ে ভাবল, আমার দেরি দেখে সে কি চলে গেছে? তাতো হতে পারে না। যে মিমি দুটো থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারে, সে পঁচিশ মিনিট দেরি দেখে চলে যাবে, এটা ভাবা ঠিক হচ্ছে না।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দেখা যাক। মহি আমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপারের ফুটপাতের বাক্সবাদাম গাছতলায় একজোড়া কপোত-কপোতিকে গল্প করতে দেখল। তখন তার চার বছর আগের একদিনের ঘটনা মনে পড়ল।

ঐ গাছতলায় দাঁড়িয়ে আফসানার সঙ্গে তার দাড়ি রাখা নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিল। মহির দাড়ি নিয়ে ক্লাসে মেয়েরা হাসাহাসি করত। কেউ সাহস করে ডাইরেক্ট কিছু বলতে পারত না।

কারণ মহি পড়াশোনায় যেমন ভালো, তেমনি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। দোহারা পেটাই শরীর, পাঁচফুট দশইঞ্চি হাই। ছত্রিশ ইঞ্চি ছাতি। স্পোর্টসে সব সময় ফার্স্ট হয়। আফসানা নামে তাদের ক্লাসের একটা বড়লোকের সুন্দরী মেয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে বেড ধরে মহির দাড়ি ফেলাবার জন্য উঠে পড়ে লাগল।

সে প্রথমে নোট নেওয়ার অজুহাতে মহির সঙ্গে আলাপ করে। পরে আকার ইঙ্গিতে প্রেমের অভিনয় করতে লাগল। মহি প্রথম দিকে তেমন খেয়াল করে নি। পরে যখন টের পেল, আফসানা নোট নিতে এলে তার চোখেও কথাবার্তায় যেন অন্য রকমের ইঙ্গিত রয়েছে তখন থেকে সে সাবধান হয়ে গেল।

মহির হাবভাব বুঝতে পেরে আফসানা চিন্তা করল, সে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, তা হওয়ার নয়। তাই শেষ চেষ্টা করে দেখার জন্য একদিন মহিকে ডেকে নিয়ে ঐ গাছতলায় এসে বলল, মহি, আমি তোমাকে ভালবাসি।

মহি আগেই বুঝতে পেরেছিল, আফসানা একদিন না একদিন এই কথা বলবে। তাই এখন তার মুখের দিক কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে বলল, কি রকম ভালবাসো?

আফসানা ভেবেছিল ভালবাসার কথা বললে মহি গলে পড়বে। কেন না ভার্সিটির অনেক ছেলে তার সঙ্গে একটু আলাপ করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করত। এদিক দিয়ে তার বেশ অহংকার ছিল। মহির প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে বলল, ভালবাসার আবার রকম আছে নাকি?

মহি বলল, নিশ্চয় আছে। যেমন, মা ছেলেকে ভালবাসে, ভাই বোনকে ভালবাসে,
আফসানা একটু রাগের সঙ্গে বলল, আর একটা মেয়ে একটা ছেলেকে ভালবাসে না?

তাও নিশ্চয় বাসে। সে জন্যে তো জিজ্ঞেস করলাম।
যদি বলি শেষেরটা।

ক্লাসে যখন দাড়ি নিয়ে মেয়েরা হাসাহাসি করত তখন মহি তাদের মধ্যে আফসানাকেও দেখেছে। বরং সেই একটু বেশি করত। এখন তার কথা শুনে বলল, বিশ্বাস হচ্ছে না।
কেন?

যে মেয়ে আমার দাড়ি রাখা নিয়ে ক্রীটিসাইজ করে, তার কথা বিশ্বাস কবর কি করে?
তুমি ঠিকই বলেছ, কিন্তু কেন করেছি জান? তোমাকে ভালবাসি বলে এবং যাতে তুমি দাড়িটা কামিয়ে ফেল। তোমার ফিগার ও চেহারা কত সুন্দর।

দাড়িটা কামিয়ে ফেললে আরো সুন্দর দেখাবে। দাড়ির জন্য তোমাকে বুড়ো বুড়ো মনে হয়।
মহি বলল, ক্রীটিসাইজ করে ব্যর্থ হয়ে শেষে ভালবাসার কথা বলে দাড়ি ফেলাতে এসেছ? তুমি আমাকে খুব বোকা মনে কর তাই না?

মহির কথা শুনে আফসানা হঠাৎ চাবুক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। তবু শেষ চেষ্টা করতে ছাড়ল না। বলল, তুমি আমাকে যা কিছু ভাব না কেন, আমি তোমাকে সত্যিকার ভালবাসি। তুমি দাড়ি কামিয়ে আমাকে পরীক্ষা করে দেখ।

আমি দাড়িকে ঘৃণা করি। দাড়ি না কামিয়ে পরীক্ষা করতে এস না। যত দিন না তুমি দাড়ি কামাবে, ততদিন আমি আর তোমার সঙ্গে কথাও বলব না আর কাছেও আসব না।

মহি বলল, তোমার মনের কথা খুলে বলে খুব ভালো করেছ। এবার আমার কথা শোন। আমরা ভার্সিটিতে উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছি, ভালবাসাবাসি করতে আসি নি। কিন্তু দৈবাৎ যদি এ রকম কিছু হয়েই যায়, তা হলে খুব বুঝে-সুঝে ধীরে গতিতে সেদিকে অগ্রসর হতে হয়।

আর ভালবাসা হল অন্তরের ব্যাপার। মুখে মুখে ব্যবহার করলে তাকে অপমান করা হয়। মানুষের মুখটা হল মনের আয়না। মানুষের মনে কি আছে তার মুখের দিকে একটু জ্ঞানের দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বোঝা যায়।

এখন বুঝতে পারছ, তোমার মেকী ভালবাসার অভিনয় তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমি বুঝতে পেরেছি। দাড়ি কামিয়ে ফেলার কথা শুনে খুব দুঃখ পেলাম। জেনে রেখ কোনো মুসলমান নর-নারী যদি নবীর (দঃ) সুন্নতকে অপছন্দ করে অথবা ঘৃণা করে, তা হলে সে আর মুসলমান থাকবে কিনা সন্দেহ।

শুধু তুমি কেন, তোমার মতো হাজারটা মেয়ের বদলেও আমি দাড়ি কামাব না। যারা নবীর (দঃ) সুন্নতকে ঘৃণা করে তাদের সঙ্গে আমিও কোনো সম্পর্ক রাখতে ঘৃণা করি। একটা অনুরোধ করব, মুসলমান ঘরের মেয়ে হয়ে ইসলামের কোনো জিনিসকে নিয়ে বিদ্রূপ করো না।

বরং ইসলামকে জানার চেষ্টা করো। আমরা মুসলমান ঘরের ছেলে-মেয়ে হয়ে প্রকৃত ইসলামকে না জেনে, ক্ষয়প্রাপ্ত ইসলামি সমাজকে দেখে দূরে সরে যাচ্ছি। এটা কি আমাদের উচিত হচ্ছে। তারপর রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল, চল ক্লাসের সময় হয়ে এল।

সেদিন থেকে আফসানা আর কোনো দিন মহির কাছে আসে নি।
মহি এই সমস্ত কথা রাস্তার ওপারের ঐ গাছতলার দিকে তাকিয়ে চিন্তা করছিল। এদিকে মিমি যে তার সামনে গাড়ি থামিয়ে ডাকছে তা খেয়াল হয় নি।

মহিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এবং তার ডাকে সাড়া না দিতে মিমি গাড়ির হর্ণ বাজাল।
মহি সম্বিত ফিরে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, দেরি হল কেন?

মিমি পাশের দরজা খুলে দিয়ে বলল, আগে উঠে এস। মহি ওঠার পর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে বলল, ক্লাস শেষ হওয়ার পর স্যার নোট দিচ্ছিলেন। তুমি রাস্তার ওপারের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে কি এমন চিন্তা করছিলে?

দেরি হলেও পাঁচ মিনিট ধরে তোমাকে লক্ষ্য করেছি। গাড়ি থামার শব্দেও যখন তোমার খেয়াল হল না তখন নাম ধরে ডাকলাম। তাতেও কাজ হল না দেখে শেষে হর্ণ বাজালাম।

মহি মৃদু হেসে বলল, ভার্সিটিতে পড়ার সময়কার একটা ঘটনা ওপারের ফুটপাতের গাছতলায় ঘটেছিল। ঐদিকে তাকাতে সেই কথা মনে পড়ল।
আমি শুনতে পারি?

পার, তবে না শোনাই ভালো।
কেন?
না শোনাই ভালো যখন বললাম তখন তো বুঝতেই পারছ।
তবু শুনব।

মহি ঘটনাটা বলে জিজ্ঞেস করল, আমার দাড়ি রাখা নিয়ে তোমার মনে কোনো কিছু হয় নি?
তোমাকে দেখার আগে পর্যন্ত ঐ ব্যাপারে কোনোদিন ভাবি নি। তারপর তোমাকে দেখার পরও খারাপ কিছু মনে হয় নি। তবে মাম্মী দাড়িওয়ালাকে একদম পছন্দ করেন না।

ছিঃ মিমি, মুরুব্বীদের দোষ কখনো ধরতে নেই। বিশেষ করে পিতা-মাতার। কেন না আল্লাহ সন্তানদেরকে পিতা-মাতার ব্যাপারে বলিয়াছেন-“তোমরা এমন কোন কথা বলবে না বা এমন কোন কাজও করবে না যা তাদের মনকষ্টের কারণ হয়।”

আল্লাহ কুরআন মজিদে বলিয়াছেন, “এবার আমি মানুষকে তাহার পিতা-মাতার সহিত সদ্ব্যবহার করিতে নির্দেশ দিয়াছি। আর যদি তাহারা উভয় এই বিষয়ে তোমার উপর চাপ দেয় যে, তুমি এমন কোনো বস্তুকে আমার শরীক সাব্যস্ত কর, যাহার (উপাস্য হওয়া)

সম্বন্ধে তোমার নিকট কোনো প্রমাণ নেই, তবে তুমি তাহাদের কথা মানিও না; তোমাদের সকলকেই আমার নিকট ফিরিয়া আসিতে হইবে, তখন আমি তোমাদিগকে তোমাদের কৃতকর্মগুলি জানাইয়া দেব।”১

গাড়ি ধানমণ্ডি ছাড়িয়ে কলাবাগানের উপর দিয়ে যেতে দেখে মহি জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাবে? লাঞ্চটা সেরে নিলে হত না?
দেখছ না ড্রাইভ করছি। তুমি তো সেদিন বললে একসঙ্গে দুটো কাজ হয় না।
১ সুরা-আলকাবুত, আয়াত-৮, পারা ২৯
প্রেম বেহেশতের-৬

মহি মৃদু হেসে বলল, সব জিনিসের ব্যতিক্রম আছে। একটু সরে বস, দেখি করা যায় কিনা, পেটে ক্ষিদে নিয়ে দুষ্টুমী। মিমি সরে বসলে মহি তার দিকে একটু সরে এসে স্টীয়ারিং হুইল ধরে বলল, ব্রেক ও এক্সিলেটর থেকে পা সরাও।

মিমি পা সরিয়ে দরজার দিকে আরো চেপে বসে বলল, দুষ্টুর সঙ্গে দুষ্টুমী করতে হয়।
সময় হলে দেখব দুষ্টুর সঙ্গে কত দুষ্টুমী করতে পার।
কথাটা ঠিক বুঝলাম না।

বোঝনি যখন তখন আর বোঝার দরকার নেই। সময় হলেই বুঝতে পারবে।
না, এখন বুঝতে চাই।

মহি ভাবল, মিমির এখনো হয়তো সেক্স সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান হয় নি। বলল, সব জিনিস সব সময় বোঝা ভালো নয়।
ভালো নাই হোক, তবু বুঝতে চাই।

সামনে একটা চাইনিজ হোটেল দেখতে পেয়ে মহি গাড়ি পার্ক করে বলল, বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে, আগে ডান হাতের কাজটা সেরে নিই চল।

হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে মহি জিজ্ঞেস করল, এদিকে কোথায় যাচ্ছিলে? চিড়িয়াখানায়।
দেখবে, না অন্য কোনো কাজ আছে।

কিছুটা দেখব, বাকিটা তোমার সঙ্গে কিছু আলাপ করব। আর দুটো সুসংবাদ শোনাব। ওখানে বেশ নিরিবিলি জায়গা পাওয়া যায়।
আলাপ কি হচ্ছে না?

হচ্ছে।
তা হলে নিরিবিলি জায়গায়র কথা বলছ কেন? সেখানে তো তারা যায়, যারা প্রেমকে টোপ হিসেবে ফেলে ইয়ে-টিয়ে করে।
মিমি হেসে উঠে বলল, ইয়ে-টিয়ে আবার কি? এ রকম কথা তো কখনো শুনি নি।

শোন নি যখন তখন না শোনাই ভালো।
নাই ভালো হোক, তবু শুনব।
বললেই তো আমাকে দুষ্টু, ফাজিল বলবে।

না, কিছু বলব না।
বলি তা হলে?
হ্যাঁ বল।
ফষ্টি নষ্টি।

মিমি বড় বড় চোখ বের করে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
বারে এখানে সাহসের কি দেখলে? কথাটা খারাপ বলে প্রথমে আমি তো বলতে চাই নি। তুমি না জোর করে বলালে।

তুমি ক্রমশ অসভ্যও হয়ে যাচ্ছ।
অসভ্য যখন হয়েই গেছি তখন নিরিবিলিতে নিয়ে গেলে ঠিক তাই করে ফেলব। মিমি তার পিঠে কয়েকটা আস্তে করে কিল দিয়ে বলল, ড্যাডীকে বলে দেব।

ড্যাডীকে যতবার ইচ্ছা বলো; কিন্তু মাম্মীকে নয়। কেন, মাম্মীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে না কি?
গতকাল অফিসে ফোন করে না তোমার ড্যাডিকে পেয়ে তোমাদের বাসায় করে প্রথমে তাঁকে চাইলাম।

তোমার মাম্মী ধরে একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলেন, আমি কে? কাকে চাই? কেন করেছি? শেষে পরিচয় জানার জন্য খুব চাপ সৃষ্টি করলেন। যখন বললাম মিমির বন্ধু, তখন বললেন, উনি বাসায় নেই।

আমি বললাম, তা হলে মিমিকে দিন। রেগে গিয়ে বললেন, দেওয়া যাবে না। বললাম দিলে কি হয়? আরো রেগে গিয়ে বকা দিলেন। এমন সময় তোমার ড্যাডী এসে ফোন ধরলেন এবং তোমাকে ডেকে দিলেন।

তুমি তা হলে মাম্মীর সঙ্গেও দুষ্টুমি করেছ?
তুমি আমাকে দুষ্টু বলে বলে দুষ্টু করে দিয়েছ। আগে কিন্তু আমি খুব ভালো ছিলাম। ততক্ষণে ওরা চিড়িয়াখানার গেটে এসে পৌঁছে গেল।

টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকে কিছুক্ষণ পশু পাখি দেখল। তারপর বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢুকে একটা ঝোপের আড়ালে বসল।
মহি বলল, কি সব শোনাবে বলে এখানে নিয়ে এলে বলে ফেল।

মিমি বলল, সুসংবাদ দুটো আগে শোনাই, প্রথমটা হল, জুলি আপা তার স্বামীর সঙ্গে মিসরে আছে। মাম্মীর অমত ছিল বলে ড্যাডী নিজে গোপনে তার লাভারের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। আর দ্বিতীয়টা হল বলে থেমে গিয়ে মহির চোখের দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে রইল।

মহি অবাক হয়ে বলল, চুপ করে গেলে কেন? দ্বিতীয়টা কি বল? তবু যখন মিমি ঐ অবস্থায় রইল তখন তার চিবুক ধরে তুলে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। দেখল, তার ফরসা টকটকে মুখটা লজ্জায় আবিরের মতো লাল হয়ে গেছে। চিবুকটা একটু নাড়া দিয়ে ডাকল, মিমি।

মহি চিবুক ধরে তোলার সময় সে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। মহির ডাকে তার চোখের
পাপড়িগুলো শুধু একটু কেঁপে উঠল। মহি আবার ডেকে বলল, মিমি চোখ খোল। নচেৎ সত্যি সত্যি অসভ্যতা করে ফেলব।

মিমি আরো লজ্জা পেয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বলল, তুমি তা করতে পার না।
কি করে জানলে?
আমার প্রেম জানিয়েছে।

স্বীকার করলাম। এবার যা বলতে বলতে থেমে গেলে, শেষ করবে না?
ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে।

লজ্জা আছে বলে পাচ্ছে। তাই বলে কথাটা বলবে না? তুমি মুখ থেকে হাত সরাও তো, না হলে লজ্জা কাটবে না বলে মহি তার হাত দুটো ধরে নামিয়ে দিল।

মিমি ধীরে ধীরে চোখ খুলে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ড্যাডী যখন জুলি আপার কথা বললেন, তখন বললাম, তার জন্যে মাম্মী কত কাঁদে, তুমি তাকে জানাও নি কেন? ড্যাডী বললেন, তোর মাকে কিছু শিক্ষা দিতে চাই।

মহির সঙ্গে তোর যখন বিয়ে দেব তখন জুলিকে ও জামাইকে নিয়ে আসব। আরো বললেন, তুই এখন মন দিয়ে পড়াশোনা করে অনার্সটা নে। আর মহিও এদিকে স্ট্যাবলিস্ট হোক।

মহি এরকম কিছু আন্দাজ করেছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বাবা হয়ে মেয়েকে নিজে বলবেন কথাটা ভেবে মহি বেশ আশ্চার্য হল। চিন্তা করল, সেইজন্যে কি হানিফ সাহেব আমাকে টাকা দিয়ে কিনে নিতে চেয়েছিলেন?

কথাটা ভেবে তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।
মিমি মহির পরিবর্তন লক্ষ্য করে বলল, মনে হচ্ছে, বিয়ের কথা শুনে তোমার মন খারাপ
হয়ে গেল।

প্রেমিকা-প্রেমিকারা তাদের বিয়ের কথা শুনে কখনো মন খারাপ করে না। আমার মন খারাপের অন্য কারণ আছে।
কারণটা কি বল।
পরে বলব। এখন চল ওঠা যাক, ভালো লাগছে না।

মিমি অবাক হয়ে আহত স্বরে বলল, তোমার কি এমন হল? মনে হচ্ছে, তুমি আর তুমিতে নেই।
প্লিজ মিমি, আমি এখন তোমাকে কোনো কথা বলতে পারছি না। আমাকে ক্ষমা কর।

মহির কথাগুলো মিমির কানে কান্নার মত শোনাল। কিছু বুঝতে না পেরে বলল, আমার কথা শুনে তুমি কি মনে ব্যথা পেলে?
না।
তা হলে?

মনে হচ্ছে, কোথাও যেন আমি একটা ভুল করে ফেলেছি অথবা করতে যাচ্ছি। মিমি মহির দুটো হাত নিজের গালে চেপে ধরে ভিজে গলায় বলল, মহি, তুমিই বলেছ, প্রকৃত প্রেমিক-প্রেমিকাদের কোনো একজনের কিছু হলে অন্যজনেরও তা হয় এবং তারা তাদের মনের কথা বুঝতে পারে।

আমি তো তোমার মনের ব্যথাটা বুঝতে পারছি; কিন্তু কারণটা স্বল্প বুদ্ধির কারণে বুঝতে পারছি না। প্লীজ মহি, কারণটা বল। নচেৎ এখানে মাথা ঠুকে মরব। কথা শেষ করে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

মহি এতক্ষণ হানিফ সাহেবের সঙ্গে প্রথম দিনের আলাপের থেকে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং এখন মিমির কাছে যা শুনল সেই সব চিন্তা করছিল। বার বার তার মনে হচ্ছে, হানিফ সাহেব তাকে যেন টাকার জোরে কিনে নিতে চাচ্ছেন।

মিমির কান্না দেখে ও তার কথা শুনে মনের ভেতর থেকে কে যে বলে উঠল, মহি তুমি হানিফ সাহেবকে ভুল বুঝতেছ। যে লোক “কর্জে হাসনা” দেওয়ার কথা বলতে পারে, সে তোমাকে কিনতে চাইবে কোন দুঃখে? আর সে যদিও কিনতে চায়, তুমি তো তার টাকা নাও নি।

আমার কথা বিশ্বাস না হয় নাই করলে, কিন্তু মিমির দিকে চেয়ে দেখ, সেও কি তোমাকে টাকা দিয়ে কিনতে চায়? তুমি জান, তোমার কাছ থেকে আঘাত পেলে মিমি সুইসাইড করবে। জেনে-শুনে ভুল করলে সারা জীবনের জন্য তুমি পঙ্গু হয়ে যাবে।

বেঁচে থাকাও তোমার অসম্ভব হয়ে পড়বে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে মহির চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে উঠল। সে সজ্ঞানে ফিরে এল। তার উদ্ভ্রান্ত ভাবটা নরম্যাল হয়ে এল! মিমির গাল থেকে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে তার দুটো হাত নিজের দগালে চেপে রেখে ভিজে গলায় বলল, মিমি তুমি আমাকে ক্ষমা কর।

আমি তোমাকে ও তোমার ড্যাডীকে ভুল বুঝে ভীষণ অন্যায় করেছি। বল, মিমি বল, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ।
মিমির চোখ থেকে তখনও পানি পড়ছিল। মহির চোখে পানি দেখে আরো বেশি ভেঙ্গে পড়ল। কোনো কথা বলতে পারলো না।

মহি তাকে সামলাবার জন্য কিছুক্ষণ সময় দিল। তারপর তার হাত ছেড়ে দিয়ে রুমালে চোখ-মুখ মোছার সময় বলল, মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আমিও মানুষ। আমারও ভুল হবে। তোমারও হবে।

আমরা যদি উভয় উভয়েই ক্ষমা না করি, তা হলে আমাদের প্রেম অলক্ষ্যে উপহাসের হাসি হাসবে।
মহির কথায় মিমিও সামলে নিয়ে ওড়নায় চোখ-মুখ মুছে বলল, জানি না তুমি কি ভুল করেছ।

তবু যখন ক্ষমা চাইছ তখন তো করতেই হবে। আর এ রকম ভুল বার বার করতে থাকলে আমিও বার বার কাঁদব কিন্তু। আর কাঁদাব না।

এর আগে কতবার বলেছ ভুল করব না, তবু কর। এবার বলছ কাঁদাব না, তবু কাঁদাবে তাই না? বলে মিমি ফিক করে হেসে ফেলল।

মহিও হেসে ফেলে বলল, তুমি ভুল করার সুযোগ দাও কেন? তুমি ভুল করবে আর দায়ী করবে আমাকে; বেশ ছেলে তো তুমি? করেছি তো কি হয়েছে? তুমি কি পচে গেলে? বেশ মেয়ে তো তুমি? মিমি হেসে উঠে বলল; তুমি যে কি?

আমি তোমার প্রেমিক। এখন আর কি বলবে বলছিলে বল। সে সব কথা শুনে যদি তুমি আবার ঐ রকম কর। আমার তো বেশ ভয় করছে। মহি হাসিমুখে বলল, না আর করব না। তোমার প্রেম আমাকে আগের থেকে জ্ঞানী করে দিয়েছে।

মিমি বিজনেসের ব্যাপারে ড্যাডী যা বলতে বলছিল, তা বুঝিয়ে বলল।
শুনে মহি বলল, আমি তাই চিন্তা করেছি। তোমার ড্যাডীকে বলো, তিনি যেন আমাকে ঐ ব্যাপারে ফোনে আলাপ করেন।

মিমি হাসিমুখে বলল, ড্যাডীকে কিছু বলা লাগবে না। যা করার সে নিজের থেকে করবে।
তুমি কিছু মাইও করতে পার ভেবে আমাকে একটু হিন্টস দিয়ে রাখতে বলেছে।

মহি বলল, তোমার কথা কি শেষ হয়েছে?
কেন?
এবার আমি কিছু বলব। বলি?
বল।

কয়েকদিন ধরে একটা কথা তোমাকে বলব বলে ভেবেছি? কিন্তু বলাটা ঠিক হবে কিনা ভেবে বলি নি।
কি এমন কথা তুমি আমাকে বলতে পারছ না?
কথাটা এ সময় বলা কি ঠিক হবে?

হবে।
তুমি যদি কিছু মাইও কর?
করব না।
ঠিক?
ঠিক।

ইসলামের দৃস্টিতে যুবক-যুবতীদের ফ্রিভাবে মেলামেশা করা এবং নিরিবিলিতে দেখা সাক্ষাৎ ও গল্প করা সরাসরি হারাম অর্থাৎ নিষিদ্ধ। এটা আল্লাহর হুকুম। আমরা যা করছি তা আল্লাহর হুকুমের পরিপন্থি।

কথাগুলো শুনে মিমির মন খারাপ হয়ে গেল? ম্লান মুখে বলল, আমরা তো বিয়ে করব, তবু হারাম হবে?
হ্যাঁ হবে।

কিন্তু বিয়ে সেই কবে হবে, ততদিন তোমার সঙ্গে মেলামেশা না করে আমি থাকব কি করে? আর তুমিও কি পারবে?
মহি বলল, আমরা মেলামেশা করলে যাতে করে আল্লাহর হুকুমের পরিপন্থি না হয়, তার একটা প্লান ভেবে ঠিক করেছি।
সেইটাই তোমাকে বলতে চাই।
মিমি আনন্দে টগবগিয়ে উঠে বলল, তা হলে বলতে এত দেরি করছ কেন? ভাবলাম তুমি যদি আমাকে অন্য কিছু মনে কর?

বললাম না, কিছু করব না?
তা হলে শোন, কাউকে কিছু না জানিয়ে আমরা কাজি অফিসে কাবিন করে ফেলি চল। তারপর আল্লাহর যখন মর্জি হবে তখন গার্জেনরা আমাদের সব কিছু করবেন। কাবিন হয়ে গেলে তোমার-আমার ফ্রি মেলামেশার আর কোনো বাধা থাকবে না।

মহির কথা শুনে মিমির শরীরের সমস্ত শিরা-উপশিরায় আনন্দের স্রোত বিদ্যুতের মতো প্রবাহিত হতে লাগল। আনন্দের আতিশয্যে তার বাকশক্তি রহিত হয়ে গেল। শুধু পলকহীনভাবে মহির মুখের দিকে চেয়ে রইল।

মহিও তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল কি বলে শোনার জন্যে। মিমি কিছু বলছে না, তবু সেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারল না। শুধু দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে রইল। একসময় দুজনের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।

কতক্ষণ কেটে গেছে কেউ জানতে পারল না। চিড়িয়াখানার মসজিদে আসরের আযান পড়তে মহির সম্বিত ফিরে পেয়ে মিমির একটা হাত ধরে নাড়া দিয়ে বলল, এই দুষ্টু মেয়ে, নিজেও কাঁদবে আর আমাকেও কাঁদাবে।

মিমি সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, আমি দুষ্টু মেয়ে, না তুমি দুষ্টু ছেলে? তুমি তো আগে আমাকে কাঁদালে? তারপর না হয় আমি কাঁদিয়েছি। তা হলে আগে দুষ্টুমী করল কে?

দু’জনেই।
মিমি হেসে উঠে বলল, কেউ কোনো দিন নিজের দোষ দেখতে পায় না।
আমি পাই।
ঘোড়ার ডিম পাও।

ভালোই হল। ঘোড়ার ডিম খেতে খেতে দু’জনে ফিরে যাই চল।
মিমি আবার হেসে উঠে বলল, ঘোড়ার ডিম বলে সত্যি কিছু আছে নাকি? ঘোড়ার তো
বাচ্চা হয়?

সেটা সবাই জানে।
তবু খাবে বলছ কেন?
সবাই বলে তাই।
সবাই জেনেও বলে কেন?

সবাইয়ের কথা বাদ দাও। তুমি এখন বললে কেন?
সবাই বলে বলে আমিও বললাম।
তা হলে স্বীকার করছ সবাইয়ের মতো তুমিও ভুল করছ?

তুমিও তো বললে, তা হলে তুমিও ঐ দোষে দোষী?
দোষ যখন দু’জনেই করেছি তখন দোষীও দু’জনেই। তা হলে ওরকম বাজে জিনিস নিয়ে কথা বাড়ালে কেন?

জিনিসটা বাজে হল কি? একটু আগে দু’জন দোষ করে দু’জনকে কাঁদালাম। ঘোড়ার ডিম বলে যেমন কিছু নেই, তেমনি আমরাও ঘোড়ার ডিমের মতো ভুল করে, ভুল বুঝে দু’জনে কাঁদলাম।

থাক ওসব কথা। আমি যে গোপনে কাজী অফিসে কাবিন করার কথা বললাম, তার কি হল? কিছু তো বললে না?
আমি আবার কি বলব। তোমার মতামতই তো আমার মত?

ঠিক কথা বলেছ। কিন্তু অনেকের বেলায় দেখা যায় স্বামীর মতে স্ত্রীর মত বিয়ের পর
বেশিদিন থাকে না?

কি করে জানলে? তুমি বুঝি আগে আরো অনেকবার বিয়ে করেছ?
মহি হেসে ফেলে বলল, তোমার মাথায় কি ঘিলু নেই? সামান্য কথা বুঝতে পারছ না? একথা জানতে বিয়ে করা লাগে না।

সমাজের দিকে লক্ষ্য করলে হাজার হাজার দেখা যায়।
আমি তোমার মতো সমাজকে দেখি নি, কি করে বুঝব?

থাক, তোমাকে আর বুঝতে হবে না। যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দাও।
কি জিজ্ঞেস করলে?
ঐ যে আমার মতের সঙ্গে তোমার মত কতদিন টিকবে?

দেখ মহি, তুমি মাঝে মাঝে খুব কঠিন প্রশ্ন কর। সেগুলো আমি বুঝতে না পেরে কষ্ট পাই। আমি তোমার সঙ্গে প্রেম করেছি। প্রেম চায় শান্তি। তুমি যখন-তখন উল্টো-পাল্টা প্রশ্ন করে সেই শান্তির মাঝে অশান্তি এনে দাও।

আমার প্রেম শুধু বোঝে কি করে আমি তোমাকে সব সময় শান্তি দেব। আর এটাও জানি তোমাকে আমি যদি শান্তি দিই, তা হলে তুমিও আমাকে শান্তি দেবে।

মহি তার কথা শুনে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে বলল, ‘আল্লাহ গো তুমি আমাদের মনের খবর জান। তুমি আমাদেরকে তোমার ও তোমার হাবিবের পাকের (দঃ) ‘প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করে ইহকালে ও পরকালে শান্তি দান করো। আমাদের প্রেমকে নিষ্কলঙ্ক রেখে অক্ষয় করে দিও।’

মিমি বলল, আমিন।
মহি বলল, মারহাবা। মারহাবা। সত্যি মিমি, তুমি খাঁটি প্রেমিক। তুমি অনন্যা। আল্লাহ তোমার উপর রহমত বর্ষর্ণ করুক।
মিমি বলল, হল না।
কি হল না?

আল্লাহ আমাদের দু’জনের উপর এবং কুল মোখলেকাতের উপর রহমত বর্ষণ করুক। সুবহান আল্লাহ বলে মহি আবার দো’য়া করল, ‘ইয়া আল্লাহ, তুমি তোমার এই নেক বান্দিকে আমার স্ত্রীরূপে দান করে কৃতার্থ কর। তাকে যেন আমি সুখ-শান্তি দিতে পারি, সেই তওফিক আমাকে দিও। তুমি সর্বশক্তিমান।

তুমি আমাদের মনের নেক মকসুদ পূরণ করে
আমাদেরকে ধন্য করো।’
মিমি আবার আমিন বলে বলল, এই আযান হয়ে গেল, নামায পড়বে না?

অফকোর্স, বাসায় গিয়ে পড়বে, না এখানে পড়বে?
বাসায় গিয়ে পড়ব। ড্যাডী কোথায় যেন যাবে। আমি গাড়ি চাইতে বলেছিল পাঁচটার আগে ফিরিস।

সে কথা এতক্ষণ বল নি কেন? সাড়ে চারটে বেজে গেছে তাড়াতাড়ি চল।
ওরা যখন মিমিদের বাসার কাছাকাছি পৌঁছাল তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। মিমিদের বাসার গেট থেকে খানিকটা দূরে গাড়ি থামিয়ে মহি নেমে বলল, আসি আল্লাহ হাফেজ।

মিমি ড্রাইভিং সিটে বসে আল্লাহ হাফেজ বলে বলল, সী এগেন। মহি বড় রাস্তায় এসে একটা স্কুটারে উঠে বায়তুল মোকাররম যেতে বলল।

মিমি বাসায় ঢুকে ড্রইংরুমে ড্যাডীকে বাইরে যাওয়ার পোশাকে একজন অপরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে দেখল। সালাম দিয়ে বলল, সরি ড্যাডী, আমি বোধ হয় একটু লেট করে ফেলেছি?

হানিফ সাহেব সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তাতে কোনো অসুবিধে হয় নি। তুমি ভেতরে যাও।
দোতলায় সিঁড়ির ডান দিকের রুমটা সুমনের। বাম দিকেরটা মিমির। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সুমনের ঘরে কড়া মিউজিকের শব্দ মিমি শুনতে পেল। এর আগে আর কোনো দিন শোনে নি।

সুমন ছোটবেলা থেকে নাচ গান পছন্দ করে না। মাঝে মাঝে ক্যাসেটে রবীন্দ্র সঙ্গীত বা নজরুল গীতি শুনে। আজ তার ব্যতিক্রম দেখে মিমি উপরে উঠে সমুনের রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

দেখল, চেঞ্জারে রেকর্ড চাপিয়ে সুমন ও চার-পাঁচটা ছেলে-মেয়ে হাত ধরাধরি করে মিউজিকের তালে তালে নাচছে। তাদের মধ্যে একটা মেয়ে দেখতে পেয়ে থেমে গেল।

সুমন বলল, কি হল তুমি থেমে গেলে কেন? তাকে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও তাকাল। মিমিকে দেখে বলল, এই আপা, তুইও আয় না, আমাদের সঙ্গে একটু নাচবি।

বাইরের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এসে নাচতে দেখে মিমি সুমনের উপর বেশ অসন্তুষ্ট হল। বলল, আমি এখন বাইরে থেকে এলাম। টায়ার্ড ফিল করছি। কথা শেষ করে নিজের রুমে চলে গেল। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল।

ভাবল, সুমন যদি ধর্মীয় শিক্ষা পেত, তা হলে এ রকম করত না। শুধু সুমন কেন, আজকাল বড় লোকের ক’টা ছেলে-মেয়েই বা ধর্মীয় শিক্ষা পাচ্ছে?

প্রত্যেক পিতা-মাতা যদি নিজেরা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সেইমতো মেনে চলত এবং তাদের ছেলে-মেয়েদেরকেও সেইমতো শিক্ষা দিয়ে পরিচালিত করত, তা হলে তারা আজ এ রকম হত না। তারা বড় হয়ে হতাশায় ভুগে বিপথগামীও হত না।

গার্জেনদের গাফিলতির ফলে আজ সমাজের এত অবক্ষয়।
মহি কয়েকদিন ব্যবসায়িক কাজে খুব ব্যস্ত। ক’দিন ধরে ফোনটা ডেড হয়ে আছে। বার বার কমপ্লেন করেও কাজ হচ্ছে না।

কাজের চাপে এবং অনেকটা ইচ্ছে করে অন্য কোথাও থেকে মিমিকে ফোন করে নি। রাতে ঘুমোবার সময় ভাবে, মিমি নিশ্চয় বার বার ফোন করে খুব রেগে যাচ্ছে। সে তো জানে না, আমাদের ফোন ডেড।

আমিও যে কিছু করছি না, তাতে নিশ্চয় সে আরো অভিমান করছে বা রেগে যাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হল, মিমি যদি এসে পড়ে? তা হলে তো ভালই হয়। কিন্তু আসবে কি? আসবে না মনে হচ্ছে। কেন না এমনি সে যা লাজুক, তার ওপর কাবিনের কথা বলেছি।

ভেবে রাখল, যেমন করে হোক দু-একদিনের মধ্যে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতেই হবে।
এদিকে মিমি প্রতিরাতে ও দিনে ফোন করছে, রিং হচ্ছে না। ভাবল, নিশ্চয় ওদের ফোন খারাপ। কিন্তু মহি কেন কোনো ব্যবস্থা করছে না?

একদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় ভাবল, ওদের বাসায় গেলে কেমন হয়? ভাবল বটে; কিন্তু লজ্জা তাকে যেতে দিল না।
সেদিন ভেবে রাখল, আজও যদি মহি না খোঁজ নেয়, তা হলে তার বারটা বাজিয়ে ছাড়বে। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে এসে রিক্সার জন্যে অপেক্ষা করছিল।

এমন সময় মহিকে অল্প দূরে রিক্সা থেকে নামতে দেখে তার সব রাগ, অভিমান কপূরের মত উবে গেল। এগিয়ে এসে মহিকে রিকসা ভাড়া দিতে দেখে সালাম দিয়ে বলল, ভাড়া দিও না।

মহি সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেন?
এই রিক্সাতেই যাব বলে?
মহি রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বলল, তা হতে পারে না।
কি হতে পারে না?

এখনো পাশাপাশি ঘেঁসাঘেঁসি করে বসার অধিকার হয় নি বলে।
মানে?
মানে হল, বিয়ের আগে ঘেঁসা ঘেসি করে বসা ধর্মীয় আইনে নিষেধ।
তা হলে কিসে যাবে?

হেঁটে।
তাই চল। কিন্তু কোথায় যাবে?
যেদিক দু’চোখ যায়।
মিমি হেসে ফেলে বলল, নিউমার্কেটে যাই চল।

মহি কিছু না বলে হাঁটতে আরম্ভ করল। এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে মহি বলল, নভেলে
গিয়ে ঠাণ্ডা কিছু খাই চল। বড্ড পিয়াস লেগেছে।
ওরা নভেলের দোতলায় একটা কেবিনে বসল।

মিমি বলল, তুমি তো আমাকে রোজ খাওয়াও, আজ আমি খাওয়াব। কি খাবে বল।
এখন তো কিছু খেতে পারব না। কফি টফি হলেই চলবে।
মিমি হেসে উঠে বলল, টফি আবার কি?

টফি তো চকোলেটের মতো। বাচ্চা ছেলে-
মেয়েরা চুষে চুষে খায়।
তোমার খেতে ইচ্ছে করে না?

ছেলেবেলায় করত। এখন আর করে না।
এখন কি খেতে ইচ্ছে করছে?

চুমো। কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। বলে ফেলে মিমি ভীষণ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিল।
মহি তার দিকে কয়েক সেকেণ্ড তাকিয়ে থেকে থেকে বলল, কাকে?

মিমি মাথা নিচু করেই বলল, যাও বলতে পারব না।
বলতেই হবে।
তোমাকে।
খাচ্ছ না কেন?

গোনাহ হবে বলে।
গোনাহ যাতে না হয়, সেই কাজ করছ না কেন?
সেই কাজ তো তুমি করবে।
আমাকে করতে বলছ না কেন?

তোমাকে পাচ্ছিলাম না বলে।
এখন তো পেয়েছ, বল।
বুদ্ধ।
মহি হেসে ফেলে বলল, কে?

তুমি।
বুদ্ধর সঙ্গে প্রেম করেছ কেন?
ভুল করেছি।
এবার তা হলে কি করবে?

বিয়ে করব।
কাকে?
বুদ্ধকে?
জেনে-শুনে কেউ এমন কাজ করে?

করে। তাকে মানুষ করার জন্য এটা করা দরকার।
বুদ্ধরা বিয়ের পর বৌকে রাতভর কষ্ট দেয়। জ্বালা-যন্ত্রণা দেয়। সময় সময় কামড়ও দেয়।

বিয়ের পর সব পুরুষরাই বুদ্ধর মত কাজ করে।
তুমি বুঝি সব পুরুষদেরকে বিয়ে করে জেনেছ?

মিমি খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, সত্যি তুমি বুদ্ধ।
অতো জোরে হেসো না মিমি? নারী পুরুষ সবাইকে আল্লাহর রাসুল (দঃ) উচ্চস্বরে হাসতে নিষেধ করেছেন। তিনি আরো বলিয়াছেন, উচ্চ স্বরে হাসলে দীলের ঈমানের আলো কমে যায়। অর্থাৎ আল্লাহ ভীতি কমে যায়।

মিমি সামলে নিয়ে বলল, আর কখনো জোরে হাসব না। এবার বল, কি খাবে অর্ডার দিই।
মহি বেয়ারাকে ডাকল।
বেয়ারা এলে মিমি তাকে ফ্রুট কেক ও দুটো কো-কো দিতে বলল।

আমি তো কফি খাব বললাম।
ফ্রুট কেটের সঙ্গে কোকো ভালো লাগবে। পিয়াস লেগেছে বললে না?

খেতে খেতে মিমি বলল, ভার্সিটিতে বেরোবার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আজ যদি তুমি আমার খোঁজ না নাও, তবে তোমার বারোটা বাজিয়ে ছাড়ব।
এসে তা হলে ভুল করলাম।
বারোটা বাজলে খুব ভালো হতো বুঝি?

তা জানি না। তবে আমিও তা হলে তোমার তেরটা বাজিয়ে ছাড়তাম।
তেরটা আবার বাজে বুঝি?

বাজে। রেলওয়ে টাইমে-টেবিলে বাজে। শুধু তেরটা কেন, তেরটা থেকে তেইশটা পর্যন্ত বাজে।
বাজুক গে, তুমি এসে গেছ আর বাজাব না। তারপর আবার বলল, তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ে খুব আনন্দ পাও তাই না? কি করে বুঝলে?

তা না হলে এত দিন খোঁজ-খবর নাও নি কেন?
খোঁজ না নিয়ে আমিও এই ক’দিন খুব কষ্ট পেয়েছি। শেষে সহ্য করতে না পেরে আজ তোমার কাছে এসেছি।
কাল থেকে আবার তো কষ্ট দেবে?

না দেব না। সেই জন্যে একটা কথা বলতে এলাম। আগামীকাল তুমি ভার্সিটির গেটে ঐ আম গাছতলায় ঠিক দশটার সময় থাকবে। আমি এসে তোমাকে সঙ্গে করে কাজি অফিসে যাব।

মিমি কিছু না বলে খাওয়া বন্ধ করে মহির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মহিও তার দিকে তাকিয়েছিল। চোখে চোখ পড়তে বলল, কিছু বলছ না কেন?
কি বলব?
আসবে কিনা?

তোমার কি ধারণা?
আসবে।
তবে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?

তোমার মুখে শুনব বলে। যদি বলি আসব না। না এসে পারবে না। আছে। যদি বলি নেই?
না ও তো আসতে পারি?

বললাম তো, না এসে পারবে না।
তবে আর জিজ্ঞেস করার কি দরকার?
তবু বলতে হবে।
কেন?

কেন না বিয়ের সময় আগে মেয়ের মতামত নিতে হয়, বুঝেছ বুদ্ধর প্রেমিকা?
বুঝলাম। ততক্ষণ ওদের খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। বেয়ারা বিল নিয়ে এলে মিমি তাকে ত্রিশ টাকা দিয়ে বলল, ফেরৎ লাগবে না।

তারপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে মার্কেটের গেটে এল। একটা স্কুটার নিয়ে মহি মিমিকে তাদের গেটের অনতিদূরে নামিয়ে দিয়ে ফিরে এল।

পরের দিন ওরা কাজি অফিসে গিয়ে কাবিন করল। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠল। মহি প্রথমে রিক্সায় উঠতে চায় নি। বলল, স্কুটারে যাব। শেষে মিমি যখন বলল, রিক্সায় চড়তে আজ আমার মন চাইছে, এখন তো আর ধর্মের বাঁধা নেই তখন রিকশায় উঠল।

রিক্সায় যেতে যেতে মহি বলল, আজকের এই শুভদিনে তোমাকে কিছু দিতে মন চাইছে। বল কি দিলে তুমি খুশী হবে।
চাইছে না।

মিমি বলল, তুমি যা দেবে তাতেই আমি খুশী হব। তবে আমার মন পার্থিব কোনো কিছু তা হলে অপার্থিব কিছু চাও। সেটা কি জিনিস আমি জানি না। আমার মন আগেও যা চাইত, এখনও তাই চাচ্ছে। কি চাচ্ছে বল।

প্রেম।
থ্যাংক ইউ। আমারই বোঝা উচিত ছিল। তোমাকে একান্ত করে পেয়ে আমার বুদ্ধি লোপ পেতে বসেছে। ঠিক আছে তাই দেব।
না, বুদ্ধি লোপ পায় নি?

কি করে বুঝলে?
লোপ পেলে রিক্সাতেই আমাকে কিস দিতে।

ডবল থ্যাংক ইউ। তুমি কালকে বললে না, মাঝে মাঝে আমি এমন কথা বলি যা তুমি বুঝতে পার না। আজ আমি বলছি, ঠিক সময় মতো কি করে এমন বুদ্ধিমানের মতো কথা বল, তা আমিও বুঝতে পারি না।

মিমি বলল, ছেলেরা সাধারণত সব কিছু তড়িঘড়ি করে, তাই তাদের উপস্থিত বুদ্ধি মাথায় আসে না। আমি তোমাকে তাদের থেকে ব্যতিক্রম দেখেছি। ফুটপাতে প্রথম দিন তাই দেখে তোমাকে মনের কুঠরীতে বসিয়েছি। তারপর বলল, আমরা কোথায় যাব রিক্সাওয়ালাকে না বলেই তো উঠলে, কোথায় যাচ্ছি বলে দাও।

মহি বলল, না বললেও রিক্সাওয়ালা জানে। দেখ না কোথায় নিয়ে যায়।
মিমি আজ সাদা পবলিনের সালওয়ার কামিজ পরেছে। মাথায় সাদা রুমাল, গায়ে সাদা ওড়না। মহি বার বার তার দিকে তাকিয়ে দেখছে।

তার মনে হচ্ছে আজকের মিমি যেন অন্য কেউ। কোনো দলছাড়া পরীকন্যা হঠাৎ তার পাশে রিকশায় এসে বসেছে।
তার দিকে মহিকে বার বার চাইতে দেখে মিমি জিজ্ঞেস করল, আজ এত ঘন ঘন আমার দিকে চেয়ে কি দেখছ? মনে হচ্ছে কোনো দিন যেন আমাকে দেখ নি।

মহি বলল, ঠিক কথা বলেছ। আজকের মিমিকে এর আগে কোনো দিন দেখি নি।
আজ কেমন দেখলে?
এখন বলব না, বাসায় গিয়ে বলব।

এক সময় রিকশা মহিদের বাসার গেটে এসে থামল।
মিমি বলল, এই, আমার যে ভীষণ লজ্জা করছে। আজ আম্মা যদি আমার সামনেই তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন, তা হলে কি বলবে?

ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। এমন কথা বলব, যা তোমাকে লজ্জা থেকে বাঁচাবে।
রিকশা থেকে নেমে মিমি বলল, বল না কি কথা বলবে?

চল না যখন বলব তখন শুনবে।
সব সময় দুষ্টুমি।

গেটে আওয়াজ দিয়ে মহি বলল, দেখ, সব সময় দুষ্টু বলবে না। যখন সত্যি সত্যি দুষ্টুমি করে ফেলব তখন বুঝবে।
বাসার কাজের মেয়ে গেট খুলে দিয়ে সালাম জানিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। মহি সালামের উত্তর দিয়ে মিমিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলে সে আবার গেট লাগিয়ে দিল।

মহি মিমিকে সঙ্গে করে নিজের রুমে ঢুকে দরজার পর্দা ফেলে টেনে দিল। তারপর মিমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে দু’হাতে পাঁজাকোলা করে তুলে তার সারা মুখ চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, হে মোর প্রিয়তমা, জীবনযাত্রার প্রথম এই শুভলগ্নে দিলাম তোমার আমার সারা জনমের চির অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেমের স্বাদ।

এছাড়া তোমাকে দেওয়ার মতো আমার যে আর কিছুই নেই। এই অধমের সামান্য প্রেমের অর্ঘ্য নিয়ে কর মোরে ধন্য।” তারপর সে তাকে বুকে চেপে ধরল।

মহি যে এরকম করবে মিমি ভাবতেই পারে নি। যখন সে তাকে দু’হাতে তুলে তার সারামুখে চুমো খাচ্ছিল তখন মিমি প্রথম হতবাক হযে যায়। আর লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে। তারপর তার প্রেমের আশীষ বাণী শুনে সমস্ত তনু মন দিয়ে প্রিয়তমার দান গ্রহণ করল।

তারপর সেও মহির মাথাটা দু’হাত দিয়ে ধরে তার সারামুখে চুমোর প্রতিদান দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ভীত কপোতীর ন্যায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘ওগো মোর সুন্দর প্রিয়তম, তোমার প্রেমের অর্ঘ্য পেয়ে আজ আমিও হলাম ধন্য।

তার প্রতিদান দেওয়ার মতো আমারও কিছু নেই। শুধু সারা জীবন যেন তোমাকে প্রেম দিয়ে সুখ-শান্তি দিতে পারি সেই দো’য়া করো। আমি যা প্রত্যাশা করেছিলাম, আল্লাহ তার থেকে কোটি কোটি গুণ বেশি দিলেন।

কিছুক্ষণ আলিঙ্গন অবস্থায় থাকার পর মহি যখন বুঝতে পারল, মিমির কাঁপুনি থেমে গেছে, তখন মৃদু স্বরে ডাকল, মিমি।
মিমি তখন মহির কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে প্রিয়তমার স্পর্শে অনন্ত সুখ শান্তির সাগরে ভেসে যাচ্ছিল। তার দু’চোখ দিয়ে তখন আনন্দাশ্রু গড়াচ্ছিল।

মহির ডাক শুনে বলল, বল।
এবার ছাড়। আমরা এসেছি কাজের মেয়েটা আম্মাকে নিশ্চয় বলেছে। আম্মা খবর নেওয়ার জন্যে কাউকে পাঠাতে পারে।

মিমি তাকে ছেড়ে দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে লাগল।
মহি বলল, তুমি একটু বস, আমি আম্মাকে ডেকে নিয়ে আসি।

আম্মাকে আবার এখানে ডেকে আনবে কেন? বারে, আম্মার দো’য়া নিতে হবে না। না করবে না? আমি আম্মাকে সেই রকম বলব। মিমির মিনতি ভরা দৃষ্টি দেখে তার চিবুক ধরে বলল, কিছুদিন পরে তো এখানে থাকতে হবে। অত লজ্জা, ভয় করছ কেন?

ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েদের আজকাল ওসব নেই।
তুমি আম্মাকে ব্যাপারটা জানাবে না কি?

জানাতে হবে না? না জানালে তোমাকে বার বার আসতে দেখলে কি ভাববে?
কিন্তু আমার যে ভীষণ লজ্জা ও ভয় পাচ্ছে? উনি যদি কিছু জিজ্ঞেস করেন?

আমার আছে।
থাকা ভালো। আছে যখন, তখন সেগুলোকে জয় করতে হবে। বুঝেছ ভীতুর ডিম? এই, ভীতুর ডিম আবার কি?

ঘোড়ার ডিমের মতো।
এই কথায় দু’জইে হেসে উঠল।
তারপর মহি রুম থেকে বেরিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে আম্মা বলে তার পাশে দাঁড়াল।

মালেকা বানু রান্না ঘরের দাওয়ায় বসে তরকারি কূটছিলেন। কাজের মেয়ের মুখে শুনেছেন, মিমি এসেছে। ভাবছিলেন, দুপুরে মেয়েটাকে নিয়ে এল। কি দিয়ে পাতে ভাত দেবেন। বড় লোকের মেয়ে, এসব কি পাতে দেওয়া যাবে?

আজ মহি বাজারের টাকা দিয়ে যায় নি। নিজের কাছে যা ছিল তাই দিয়ে বাজার করিয়েছেন। এমন সময় ছেলের ডাক শুনে তার দিকে তাকালেন। দেখলেন, মহির ফর্সা মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। ছেলেকে এর আগে এত লজ্জা পেতে তিনি কোনো দিন দেখেন নি। জিজ্ঞেস করলেন, কিছু বলবি?

মহি কি করে কথাটা বলবে ভেবে ঠিক করতে না পেরে মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা হেঁট করে রইল। মালেকা বানু কিছু একটা যেন আন্দাজ করে আবার জিজ্ঞেস করলেন, কিরে, চুপ করে আছিস কেন? কি বলবি বল না?

মহি কোনোরকমে তুমি ঘরে এস বলে মায়ের রুমে গেল।
মালেকা বানু কাজের মেয়েকে ডেকে বললেন, আনাজগুলো নিয়ে যাও। মুরগিতে নষ্ট করে ফেলবে। তারপর ঘরে মহির কাছে গিয়ে বললেন, কি হয়েছে? তোকে যেন কেমন দেখাচ্ছে?

মহির যেমন লজ্জা করছে তেমনি ভয় ভয়ও করছে। সে বসে পড়ে মায়ের দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোমাকে না জানিয়ে আজ কাজি অফিসে মিমির সঙ্গে কাবিন করেছি। তুমি আমাকে মাফ করে দিয়ে আমাদেরকে দো’য়া কর। মহির চোখ দিয়ে তখন পানি পড়ছিল।

মালেকা বানু ছেলেকে দু’হাত দিয়ে তুলে মাথায় ও কপালে চুমো খেয়ে বললেন, মায়েরা সন্তানদের শত শত দোষ ক্ষমার চোখে দেখে। তুই তো অন্যায় কিছু করিস নি। তোর কাছে তো আমি সেদিন ওদের বাসার ঠিকানা চেয়েছিলাম, ওর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করব বলে।

নিজের আঁচলে ছেলের চোখ মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, হ্যাঁরে, ওর মা-বাবা জানেন?
মহি বলল, না। তুমিও যেন আমাদের কাউকে বলো না। মিমি এখন তার বাবার বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে। আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আমি একটু সামলে উঠলে তখন সবকিছু করে ওকে নিয়ে আসব।

মালেকা বানু আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন, ওর মা-বাবা যদি এ বিয়ে মেনে না নেন, তা হলে কি হবে?
সে সব ভেবে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি জানি ওর বাবার মত আছে। ওর মা হয়তো একটু অমত করতে পারেন।

কাবিন হয়ে গেছে জেনে গেলে তেমন কিছু করতে পারবেন না। মিমিকে কি তুই এক্ষুনি নিয়ে চলে যাবি?
বিকেলে ওদের বাসায় দিয়ে আসব।

এ বাড়ির বৌ হয়ে প্রথম এল। কেউ জানবে না, কোনো কিছু হবে না? এ কেমন কথা তুই বলছিস। কিছু না হোক, ভালো খাওয়ার ব্যবস্থাটা অন্তত করতে হবে না? তুই কিছু টাকা দে। সকালে না দিয়ে চলে গেলি। টাকার জন্যে ভালো বাজার হয় নি।

মিষ্টি আনারও টাকা দিস।
মহি মায়ের হাতে হাজার খানেক টাকা দিয়ে বলল, বেশি কিছু করতে যেও না। জর্দা, পোলাও, মুরগির রোস্ট আর খাসীর রেজালা করো। তারপর আবার বলল, তুমি আমাদের দো’য়া করবে না?

নিশ্চয় করব। তোর সঙ্গে কথা বলছি তাই। তুই ঘরে যা, আমি আসছি। মহি বেরিয়ে যাওয়ার পর মিমি সেই থেকে খাটে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগল। মহি তার মাকে জানাতে গেল। জেনে গিয়ে যদি মহিকে রাগারাগি করেন?

এসে যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন? কি উত্তর দেবে? হঠাৎ মহির আলিঙ্গন, চুম্বন ও প্রেমের আশীষ বাণীর কথা মনে পড়তে রোমাঞ্চ অনুভব করল। তার সারা শরীরে ও মনে ক্ষণে ক্ষণে শিহরণ খেলে যাচ্ছে।

তার উনিশ-বিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম পুরুষের আলিঙ্গন ও আদর তার দেহে ও মনে নতুন এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করল। শুধু মহিকে কাছে পেতে তার ইচ্ছে করছে। দুষ্টুটা আমাকে এতক্ষণ একা রেখে মায়ের কাছে কি করছে?

আসুক না একবার মজা দেখাব। নিজের মনে নিজে হেসে উঠে ভাবল, সে আর তাকে কি মজা দেখাবে? যা দেখাবার মহিই তো দেখাচ্ছে।

এমন সময় মহি মিমির কাছে এসে বলল, আমি আম্মাকে কাবিনের কথা বলেছি। মিমিকে ভয় পেতে দেখে তার গালটা আস্তে টিপে ধরে বলল, ভয়ের কোনো কারণ নেই। আম্মা তোমাকে প্রথম দিন দেখে পছন্দ করেছে। এক্ষুনি দো’য়া করতে আসছে।

আম্মা এলে আমি যখন সালাম করব তখন তুমিও করবে।
মিমি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মহির দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

মহি তখনও গাল ধরে রয়েছে। তার ভয় কাটাবার জন্যে গাল থেকে হাত সরিয়ে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলল, বললাম না, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে বিয়ে করেছি শুনে আম্মা খুশী হয়েছে। তারপর ছেড়ে দিয়ে চিবুক ধরে বলল, একটু হাসিও উপহার দেবে না?

মিমি ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে দুষ্টু, ত্যাঁদোড়, অসভ্য বলে দু’হাতে মুখ ঢাকল।
মহি বলল, যা কিছু বলে আমার দুর্ণাম করলে, সময় সুযোগ পেলে তার প্রত্যেকটার প্রমাণ দেখিয়ে ছাড়ব।
তা হলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে।

আগে তো যা করার করবই, তারপর না শাস্তি।
মালেকা বানু অযু করে এসে দরজার বাইরে থেকে মহি বলে ডাকলেন।

মহি দরজার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে বলল, এস আম্মা। মালেকা বানু ঘরে ঢুকে মিমির দিকে এগিয়ে এলেন।
মহি মিমিকে ইশারা করে মায়ের কাছে এসে কদমবুসি করল। মিমিও একই সঙ্গে করল।

মালেকা বানু দু’জনকে দু’হাত দিয়ে ধরে তুলে জড়িয়ে ধরে প্রথম তাদের মাথায় চুমো খেলেন। তারপর দু’হাত তুলে দো’য়া করলেন। “হে আল্লাহ, তুমি কুল মোখলুকাতের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তোমার সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে মানুষ জাতি শ্রেষ্ঠ।

আবার সেই মানুষ জাতির মধ্যে যাকে সর্বশ্রেষ্ঠ করে ধরাধামে পাঠিয়েছিলেন তিনি তোমার পেয়ারা হাবিব (সঃ)। তাঁর মোবারক কদমে সর্বপ্রথমে জানাই শত কোটি দরুদ ও সালাম। তাঁর প্রতি তুমি রহমতের ধারা অনন্তকাল বর্ষণ কর।

তারপর তোমার সমস্ত সৃষ্টির উপর বর্ষণ কর। তুমি সর্বশক্তিমান। তোমার সমকক্ষ কেউ নেই। তুমি সর্বত্র বিরাজমান। তোমার হুকুম ছাড়া দুলুক ভূলোকে কোনো কিছু করার কারুর ক্ষমতা নেই। তুমি প্রতিটি প্রাণীকে জোড়ায় জোড়ায় পয়দা করেছ।

তোমার ইচ্ছায় আমার কলিজার টুকরোসম এরা পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। তুমি এদের বন্ধনকে কবুল করে নাও। এদের সাংসারিক ও দাম্পত্য জীবন সুখময় ও শান্তিময় করে দাও।

ইহকাল ও পরকালের শান্তিময় ও সুখময় জীবনের জন্যে এদের প্রতি রহমত বর্ষণ কর। তোমার ও তোমার রাসূল (সঃ)-এর প্রদর্শিত পথে থেকে জীবন অতিবাহিত করার তওফিক এদেরকে এবং আমাদের সবাইকে দান কর। এদের সবাইকে তথা জগতের সকল বিশ্বাসী-নর-

নারীকে অসৎ পথ থেকে বিরত রেখে সৎপথে পরিচালিত কর। তুমি আমাদেরকে এবং জগতের সমস্ত মুসলমান জিন্দা, মুর্দা নর-নারীকে তোমার ক্ষমার গুণাবলিতে ক্ষমা করে দাও।

তোমার হাবিবে পাকের পবিত্র রুহ মোবারকের উপর আবার কোটি কোটি দরুদ ও সালাম জানিয়ে আরজী পেশ করছি, সেই হাবিবে পাক (সঃ)-এর অসিলায় আমাদের দো’য়া কবুল কর। আমিন সুম্মা আমিন।

মহি ও মিমি আম্মার সঙ্গে হাত উঠিয়ে দো’য়াতে সামিল হয়েছিল। তারাও আমিন সুম্মা আমিন বলে মুখে হাত বুলিয়ে মোনাজাত শেষ করল।

Read More: প্রেম কাহিনী

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top