কোথায় খুঁজিব তারে রোমান্টিক গল্পের বই
কোথায় খুঁজিব তারে রোমান্টিক গল্পের বই, অনেক সুন্দর কাহিনী দিয়ে সাজানো গল্পের বই বাংলা এই গল্প বই পড়লে আপনি এত সহজে বলতে পারবেন না তার কারণ এত সুন্দর একটি গল্প এই গল্পের বই বাংলা পোস্টটি সবার সাথে শেয়ার করবেন,
রোমান্টিক গল্পের বই
কোথায় খুঁজিব তারে রোমান্টিক গল্পের বই
এক
রাত নয়টা বাজে। পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদের মেয়েটি এখনো বাসায় ফিরেনি। ডিউটি থেকে বাসায় ফিরে স্ত্রীর জেরার
মুখে পড়াটা বেনজীর সাহেবের প্রায় নিত্যদিনের রুটিন।
কর্মস্থলে পেশাদার ঘাঘু অপরাধীরা যেভাবে জেরার সময়ে চুপ করে বসে থাকে সেভাবে তিনিও স্ত্রীর জেরার সময় চুপ করে বসে থাকেন। তারপর সুযোগ বুঝে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে যান। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে ফিরে আসেন।
ভেবেছিলেন আজকেও সেভাবে চুপ করে পার পেয়ে যাবেন। কিন্তু যখন শুনলেন তার মেয়েটি বাসায় ফিরেনি তখন তিনি আর চুপচাপ থাকতে পারলেন না। পুলিশের পোশাক কোনরকমে খুলে, অস্ত্র রেখে ওয়্যার ড্রোব থেকে একটা শার্ট নিয়ে বাংলার আর দশজন যুবতী মেয়ের বাবার মত সাধারণ বাবা হয়ে গেলেন।
তাকে এভাবে তাড়াহুড়ো করে তৈরি হতে দেখে পথ আটকালেন মিতিল আহমেদ। তিনিই বেনজীর সাহেবের স্ত্রী। এই মুহূর্তে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে আছেন। মেয়েটা তার ফোনও ধরছে না। বেনজীর সাহেবের প্রশ্রয়েই এত বেয়াড়া হয়েছে।
তাদের মেয়েটা অবশ্য প্রায় এমন করে। বাইরে থাকলে সে তার বাবার ফোন ধরে। কিন্তু মায়ের ফোন ধরে না। মিতিল আহমেদের ভাষায়, বাবা ফোন দিলে আদুরে বিড়ালের মত মিয়াউ মিয়াউ করে। আর মা ফোন দিলে বজ্জাত মেয়ের মত ঘেউ ঘেউ করে।
মেয়ে বাইরে থাকলে অবশ্য বেনজীর সাহেব জানেন এক্সাক্টলি তার মেয়েটা কোথায় আছে। আজকেই শুধু ব্যতিক্রম। মেয়েটা তাকেও বলে যায়নি। তবে মিতিল আহমেদের সন্দেহ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে আজও তার স্বামী জানে মেয়েটা কোথায় আছে।
তাকে কিছু বলছে না। এখন তাড়াহুড়ো করে বের হবার ভান করছে। এ জন্যই তিনি তার স্বামীর পথ আটকে দাঁড়িয়ে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বের হবার পথে এরকম একটা বাধা দেখে বেনজীর সাহেব রীতিমত ঘামতে শুরু করলেন।
বাইরে তিনি যতই জাঁদরেল পুলিশ অফিসার হন না কেন বাসায় কিন্তু একেবারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামীর মত থাকেন। মিতিল আহমেদকে খুব ভালোবাসেন। তাই তার শাসনটা উপভোগ করেন।
তাছাড়া যারা পুলিশে চাকরি করেন তাদের পক্ষে নিজের পরিবারকে দেবার মত সময় খুব একটা থাকে না। জনসেবামূলক পেশাগুলো সাধারণত এমনই হয়। বাসার কাছে যেহেতু খেয়াল রাখতে পারেন না তাই তিনি শুধু বাসার মানুষ ছাড়া অন্যকিছুর খোঁজ রাখেন না।
একটা সংসার নিশ্চয় শুধু কিছু মানুষ দিয়েই হয়ে যায় না। সংসারে অনেক কাজ থাকে। অনেক দায়িত্ব থাকে। দেখাশোনার ব্যাপার থাকে।
সব কিছু যখন মিতিল আহমেদ সামলায় তখন তার একটু আধটু শাসন মেনে নিয়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী সেজে থাকতে বেনজীর আহমেদের কোন অসুবিধা নেই।
আজও যখন পথ আটকে দাঁড়ালেন মিতিল তখন তিনি একটা ব্যাংক লুক দিয়ে চোখের ইশারায় বুঝালেন কি হয়েছে? পথ আটকালে কেন?
বেনজীর আহমেদের এমন ব্যাংক লুক দেখে মিতিল আহমেদের রাগ বেড়ে গেল। তিনি অত্যন্ত ঝাঁজালো গলায় বললেন, বুঝতে পারছ না কিছু?
না তো।
কোথায় যাচ্ছ তুমি?
মেয়েকে খুঁজতে। সে কোথায়?
জানি না তো। বাইরে গিয়ে দেখি আগে।
তুমি জানো না বলছ?
সত্যি জানি না। মিথ্যুক একটা।
বিশ্বাস কর আমি জানি না।
না জানলে তুমি আন্দাজে কোথায় যাচ্ছ?
বাইরে গিয়ে ফোন দিব।
কেন আমার সামনে ফোন দিলে আমি জেনে ফেলব তুমি আগে থেকেই জানতে মেয়ে কোথায়?
আরে আমি সত্যি জানি না।
তাহলে এখন ফোন দাও আমার সামনে। তারপর জিজ্ঞেস কর সে কোথায়। আজ আমিও সাথে যাব। দেখব এত রাতে সে কি করে।
আচ্ছা দিচ্ছি। কিন্তু তুমি আমার সাথে যাবে না।
এবং অবশ্যই ওকে কিছু বলবে না।
আগে তো ফোন দাও। তারপর সব ঠিক হবে।
আচ্ছা।
স্ত্রীর সাথে কথায় না পেরে বেনজীর সাহেব ফোন দিলেন তার মেয়েকে। একবার রিং হওয়ার পরেই ফোন ধরল তাদের একমাত্র মেয়ে মৌনতা আহমেদ।
মেয়ে ফোন ধরার পর বেনজীর আহমেদ কিছু বলার আগেই তার হাত থেকে এক প্রকার ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে গেলেন মিতিল আহমেদ। তারপর ঝাঁঝালো গলায় বললেন, এই মেয়ে আমার ফোন ধরিস না কেন?
তুই এখন কই?
কি করিস?
কিরে কথা বলিস না কেন?
মৌনতা তার মায়ের কথা শুনে খুব ঠান্ডা গলায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, তুমি আমাকে বলার সুযোগ কই দিলে?
এই বজ্জাত মেয়ে একদম কথা বাড়াবি না। আগে বল তুই কই?
আমি ফ্রেন্ডদের সাথে।
কোন ফ্রেন্ডদের সাথে?
তুমি চিনবে না।
কেন?
তুমি কি আমার সব ফ্রেন্ড চিন নাকি?
না। কিন্তু রাত কয়টা বাজে?
নয়টা।
এত রাতে তুই বাইরে কেন থাকবি?
আর তোর আশেপাশে এত নয়েজ কিসের?
উফ মা আস্তে। এত জোরে কেউ কথা বলে?
চুপ বেয়াদব মেয়ে। এত নয়েজ কিসের?
করছিস কি তুই?
ড্রিংকস করছি।
কি?
আরে বাবা ড্রিংকস করছি। বুঝতে পারছ না? ড্রিংকস করছি।
মিতিল আহমেদের উত্তেজিত গলার স্বর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ফোন নিয়ে গেলেন তার স্বামী। তারপর তিনি বললেন, মা তুমি কি কর?
মৌনতা আগের মত ঠান্ডা গলায় বলল, বাবা আমি ড্রিংকস করছি। কি বলছ?
হ্যাঁ বাবা। সত্যি বলছি। তিন সত্যি। বিশ্বাস কর।
মা তুমি এখন কোথায় আছ?
কেন?
বাবাকে বল। বাবার চিন্তা হচ্ছে। তোমাকে নিতে আসব। উফ বাবা, তোমাকে নিয়ে আর পারি না। আমি একাই বাসায় ফিরতে পারব।
না মামনী। একা ফিরতে হবে না। তুমি এড্রেসটা বল। আচ্ছা আচ্ছা আমি এসএমএস করে দিচ্ছি।
আচ্ছা।
বেনজীর আহমেদ ফোন ছেড়ে দেখেন তার স্ত্রীর প্রায় ফিট হওয়ার মত অবস্থা। সমানে চিলাচ্ছে, মাথা এপাশ ওপাশ করছে আর বলছে, আল্লাহ গো আমাকে এই দিন দেখতে বাঁচিয়ে রাখলে? আমার মেয়ে ড্রিংকস করছে?
আমি আগেই বলেছিলাম ওকে একা ছাড়া যাবে না। কার না কার পাল্লায় পড়ে আমার অবুঝ মেয়েটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহ আমার মেয়ের সাথে এসব কি হচ্ছে। এই চল আমিও যাব তোমার সাথে।
মিতিল আহমেদের যে লেভেলে রাগ উঠেছে আজকে তাকে নিয়ে বাইরে গেলে বিপদ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। আবার এদিকে তাকে ফেলে যে বাইরে বের হবেন তার উপায়ও নেই। বেনজীর আহমেদ পড়লেন মহাবিপদে।
তিনি মন প্রাণ দিয়ে একটা বুদ্ধি খুঁজতে চাইলেন। শেষে কোন উপায় না পেয়ে পুলিশের ট্রেনিং মনে করার চেষ্টা করলেন। একজন রাগান্বিত মহিলাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? এটা নিয়ে কোন ট্রেনিং দেয়া হয়নি বলে তিনি খুব হতাশ হলেন।
তাই বুদ্ধি খাটিয়ে বললেন, আচ্ছা তুমিও চল। কিন্তু এভাবে যাবে বাইরে? যাও না ভালো একটা শাড়ি পড়ে এস।
মিতিল আহমেদ একটু শান্ত হয়ে বললেন, এখন কি ভালো শাড়ি পড়ার সময়?
না। তবে বাইরে ওর বন্ধুরা আছে হয়তো। তোমার তো ক্যাজুয়ালি সেখানে যাওয়া উচিত না। এই যে তুমি কান্নাকাটি করেছ এগুলো তো ফ্রেশ করতে হবে। যাও তাড়াতাড়ি আমি অপেক্ষা করছি। তৈরি হয়ে এস।
আচ্ছা।
মিতিল আহমেদ তৈরী হতে যাওয়ার পর তিনি পা টিপে টিপে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। এভাবে ধোঁকা দিয়ে বের হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। মেয়েটা কি অবস্থায় আছে তা আগে দেখা প্রয়োজন।
তাই তিনি কোনমতে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে নিজেই ড্রাইভ করে মেয়ের দেয়া ঠিকানায় পৌছে গেলেন।
দূর থেকে মৌনতা দেখল তার বাবা এসেছে। বাবাকে আসতে দেখে সে বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।
বেনজীর আহমেদ মেয়েকে বুকে নিয়ে মেয়ের হাত শুকলেন। তারপর মুখ হা করিয়ে দেখলেন। বাবাকে এমন করতে দেখে মৌনতা খুব অবাক হয়ে বলল, বাবা কি করছ তুমি?
তিনি খুব একটা ভ্রুক্ষেপ না করে বললেন, কিছু না।
মৌনতা তার চেহারায় স্বভাবসুলভ দুষ্টুমি ফুটিয়ে তুলে বলল, এ মিথ্যা কথা বলে। বাবা তুমি চেক করছ আমি কি ড্রিংকস করেছি তাই না? হ্যাঁ করছি।
বাবার কাছ থেকে চেক করার কথা শুনে মৌনতা হাসতে লাগল। বেনজীর আহমেদ মেয়ের এমন কান্ড দেখে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলেন তারপর বললেন, কি খেয়েছ মা তুমি?
মৌনতা এবার তার চেহারায় একটু রহস্য ভাব ফুটিয়ে বলল, বলতেই হবে?
হ্যাঁ। বাবার কাছে সব বলতে হয়।
আচ্ছা বলছি শোন। তোমার ফোন দিয়ে মা যখন ফোন করেছিল তখন আমি কোল্ড ড্রিংকস খাচ্ছিলাম।
বাবার কাছে কোল্ড ড্রিংকস খাওয়ার কথা বলে প্রাণভরে হাসতে থাকে মৌনতা। তার বাবা তখন মানসিক প্রশান্তি নিয়ে বললেন, মামনী তুমি তো আজ ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।
তোমার মায়ের কি অবস্থা হয়েছে জান? চল তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।
কেন বাবা? ভয় পাবে কেন? আমার উপর কোন বিশ্বাস নেই তার?
আছে। কিন্তু তুমি যে বলেছিলে ড্রিংকস করছ তা শুনে ভেবেছিল মদ- টদ খাচ্ছ নাকি। আমি নিজেও কনফিউজড হয়ে গিয়েছিলাম। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই বাবা-মায়ের উচিত যথাসাধ্য খেয়াল রাখা।
মৌনতা নেহায়েত ছেলে মানুষের মত ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বলল, বাবা যাই বল মায়ের কিন্তু এটা বুঝা উচিত ছিল। ড্রিংকস করছি এটা তো আমি ভুল বলিনি।
মেয়ের কট্টর যুক্তির কাছে হার মেনে বেনজীর আহমেদ তখন মাথা দোলালেন। তারপর বললেন, মামনী চল এখন তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে।
বাসায় যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠতে গিয়েও উঠল না মৌনতা। গাড়ির একটা দরজা খুলে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল, বাবা চল না আজকে মাকে অনেক ভয় দেখাই।
বেনজীর আহমেদ ভ্রু কুচকে বললেন, কিভাবে? প্ল্যান কি? মৌনতা কানে কানে তার বাবাকে প্ল্যানটা বলল। তারপর সেই প্ল্যান মোতাবেক প্রস্তুতি নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে গেল তারা।
মিতিল আহমেদ ড্রয়িং রুমে পায়চারি করছেন। সোফায় বসে আছেন তার শাশুড়ি। তার শ্বশুর মারা গিয়েছেন বহু আগে। তিনি তার শাশুড়িকে নিজের মায়ের মত যত্ন করেন। তার শাশুড়িও তাকে মেয়ের মত স্নেহ করেন।
এই পরিবারের যাবতীয় সিদ্ধান্তে তিনি মিতিল আহমেদকে চোখ বন্ধ করে সাপোর্ট করেন। আজকে যে মৌনতা এত রাত করেও বাসায় ফিরেনি এটা তার কাছেও ভালো লাগেনি। তিনি অবশ্য মৌনতা ফোন ধরছে না শুনেই তসবীহ হাতে নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছেন।
ঠিক এমন একটা মুহূর্তে বাসায় ঢুকল মৌনতা ও তার বাবা। তারা দুজনে বাসায় ঢুকল টলতে টলতে। ঠিক যেভাবে মাতালেরা হাঁটে সেভাবে এলোমেলো পা ফেলে। তাদের এভাবে ঢুকতে দেখে মিতিল আহমেদ অত্যন্ত অবাক হলেন।
তারপর এক হাতে টলতে থাকা মৌনতাকে ধরলেন আরেক হাতে তার বাবাকে। মৌনতা ও তার বাবার হাত একসাথে শুকে দেখলেন কেমন যেন ঔষধ ঔষধ গন্ধ। এরপর চিৎকার করে তার শাশুড়িকে ডেকে বললেন, মা দেখেন দুজনে কি খেয়ে আসছে।
দুইটাই মদ খেয়ে আসছে।
তার শাশুড়ি হাতের তসবী রেখে এসে মৌনতার হাত শুকে দেখলেন। তারপর বললেন, আস্তাকফিরুল্লাহ। নাউজুবিল্লাহ মিন জালেক। বউমা ওরে লেবু খেতে দাও। আমার ছেলেরও কি এক অবস্থা?
মিতিল আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, হ্যাঁ মা।
তার শাশুড়ি বলল, বউমা কান্নাকাটি থামাও। লেবু বের কর। আগে লেবুর শরবত খাওয়াও। তারপর ঠিক না হলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
মিতিল আহমেদ তার শাশুড়ির কথা শুনে লেবু আনতে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি সামনে পা ফেলার আগেই তার হাত টেনে ধরল মৌনতা। মাতালের মত করে বলল, মা যেও না তুমি। বাবাকে জোর করে খাইয়ে দিয়েছি। তুমি খাবে? তোমার জন্যও এনেছি।
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে তিনি তার স্বামীর দিকে তাকালেন। তার স্বামী এভাবে তাকাতে দেখে কোন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বললেন, আমার কি দোষ? মৌনতা বলল, বাবা একটু টেস্ট কর। তাই একটু খেয়েছি। তোমার জন্যও নিয়েছি।
মিতিল আহমেদ বললেন, কি? কি বলছ তোমরা?
তার শাশুড়ি বললেন, বউমা ওরা তো এখন মাতাল। কত কথাই বলবে। তুমি কান দিও না। আমার কথা শুন। যা বলছি তা আগে কর।
মৌনতা তার দাদীর কথা শেষ হতে না হতেই বলল, তোমাকে আগে খাওয়াব। তোমার জন্যও এনেছি। মায়ের জন্যও এনেছি।
বেনজীর আহমেদ বললেন, না না। আগে তোমার মাকে খাওয়াব।
মৌনতা হি হি করে হাসতে হাসতে ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করল। ঠিক মুভিতে যেরকম করে দামী মদের বোতল দেখায়। উপরে অনেক রকম ইংরেজি লেখা। ঢাকনাটা একটা গোল্ডেন কালার কাগজে মোড়ানো।
তারপর তার বাবাকে বলল, বাবা এবার মাকে চেপে ধরে মুখ হা করাও।
বেনজীর আহমেদ তার মেয়ের কথা শুনে এক পা দু পা করে আগাতে লাগলেন। তাকে এভাবে আগাতে দেখে মিতিল আহমেদ চিৎকার করে বললেন, খবরদার বলছি এমন করবে না। একদম না। দূরে যাও।
ততক্ষণে বেনজীর আহমেদের হাতে বোতলটা এসে গেছে। ঢাকনাটাও খোলা হয়ে গিয়েছে। তিনি কিছুক্ষণ হালকা করে চেষ্টা করে খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে মৌনতাকে বললেন, মা ছুরি টা আনতো।
মৌনতা আবার বাবার থেকে এক কাঠি বেশি এগিয়ে বলল, বাবা দুবাই থেকে যে সামুরাইটা এনেছিলে ওটা নিয়ে আসি।
বেনজীর আহমেদ ভিলেনের মত হাসতে হাসতে বললেন, যাও নিয়ে এস। বাবার কথা মত মৌনতা গিয়ে সামুরাইটা নিয়ে এল।
তারপর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে খাপটা খুলল। বাবা-মেয়ের এমন ভয়ংকর রূপ মিতিল আহমেদ কখনো দেখেন নি। তিনি শুনেছেন মাতাল অবস্থায় মানুষ যা করে তার কিছুই পরে মনে থাকে না।
এখন যদি তাকে সত্যি সত্যি সামুরাই দিয়ে একটা কিছু করে ফেলে। তার শাশুড়ি অবশ্য সাহস করে মৌনতার কাছে গিয়ে সামুরাইটা নেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বুড়ো মানুষ। মৌনতার সাথে পারবেন কিভাবে।
হঠাৎ করে মিতিল আহমেদ নিজেকে এ দুনিয়ার সবেচেয়ে অসহায় মানুষ মনে করলেন। তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও।
কে শোনে কার কথা। বাবা, মেয়ে জোর করে তাকে বোতলটা খেতে দিল। মুখে দিয়ে অবশ্য তার ডর ভয় সব উবে গেল। এটা তো মিষ্টি মিষ্টি লাগছে। ব্যাপার কি? মদ কি তাহলে মিষ্টি? তিনি তো শুনেছেন মদের স্বাদ ঝাঁঝালো। তবে এটা কি?
নিশ্চয় মদ নয়। ভালো লাগছে দেখে তিনি খাওয়া থামিয়ে বোতলটা হাতে নিয়ে দেখলেন। ভালো করে লেখা পড়ে দেখলেন এটা একটা বিদেশী ফ্রুট জুস। তাকে লেখা পড়তে দেখে মৌনতা আর তার বাবা হাসতে হাসতে হাই ফাইভ দিয়ে বলল, ইয়ে আমরা জিতে গিয়েছি।
ভয় দেখিয়ে দিয়েছি।
মিতিল আহমেদ বললেন, দাড়াও দেখাচ্ছি মজা। আমাকে ভয় দেখানো।
মৌনতা ও তার বাবা হাসতে হাসতে কান ধরে বলল, সরি।
মিতিল আহমেদের শাশুড়ি কিছুই বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, বৌমা কি হল?
মিতিল আহমেদ হাসতে হাসতে বললেন, আর কি হবে মা। ওরা জুস খেয়ে আসছে। আমাদের জন্যও নিয়ে আসছে।
ঐ জুসের ফ্লেভারে ঔষধ ঔষধ গন্ধ।
তার শাশুড়ি তখন মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, পাজিগুলোর কান্ড দেখ। হাসি ঠাট্টার পরিবেশ ফিরে আসার পর পুরো ঘটনা বুঝতে পারলেন মিতিল আহমেদ।
অবশ্য এর আগে মৌনতার বাইরে থাকার কারণ শুনে নিয়েছেন। একটামাত্র মেয়ে তাদের। পুরো নাম মৌনতা আহমেদ ববি। তার নাম মিতিল এর সাথে মিল করে রেখেছেন মৌনতা। ওর বাবার নামের সাথে মিল করে রেখছেন আহমেদ আর ববি।
ভীষণ আল্লাদী আর পাগলী মেয়েটা বাবা মা দুজনেরই জান। এবার সে মাত্র ইউনিভার্সিটিতে উঠল। এ বয়সটাই ছেলে মেয়েদের ভুল করার বয়স। তাই তিনি তার মেয়েকে খুব চোখে চোখে রাখেন।
তাছাড়া মৌনতা যে চঞ্চল তাকে চোখে চোখে না রেখে উপায় নেই। অবশ্য সবকিছুর উপরে আরেকটা কারণ আছে। এ কারণটা মৌনতা ছাড়া সবাই জানে। মানুষের জীবনে কিছু সিক্রেট তো থাকেই যা সেই মানুষটা ছাড়া তার পরিবারের প্রায় সবাই জানে।
মৌনতার জীবনেও এমন একটি সিক্রেট আছে যা সে ছাড়া সবাই জানে।
দুই
ফাহিম ও তার দলবল মন দিয়ে কাজ করছে ভোর থেকে। তাদের কাজ হল বাসার সামনে ছোট্ট খেলার মাঠটা পরিষ্কার করে ক্রিকেট খেলার উপযোগী করা। তারপর ষ্ট্যাম্প বসানো। রঙ করা। পতাকা লাগানো।
কোন কাজে ভুল হলে আজকে তাদের খবর আছে। ফাহিমকে এ দায়িত্ব দিয়েছে মৌনতা। সে অবশ্য ছোটবেলা থেকে তার ক্লাসমেট। প্লাস খুব ভালো বন্ধু। ভালো বন্ধু হয়েও এমন জমের মত ভয় পাওয়ার একটা কাহিনী আছে।
কাহিনীটা হল একবার স্কুলে যাওয়ার সময় সে মৌনতাকে প্রপোজ করেছিল। সিনেমার নায়কের মত এক হাঁটু রাস্তায় গেড়ে আর দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে একটা ফুল দিয়ে ভালোবাসি বলেছিল।
ওর এমন কান্ডে মৌনতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও মুহূর্তেই সামলে নিয়েছিল নিজেকে। তারপর ওকে সেই নায়ক পোজেই বসিয়ে রেখে বলেছিল স্কুল ব্যাগটা ধর। ফাহিম স্কুল ব্যাগ ধরার পরে মৌনতা ওর মাথার চুল ধরে আচ্ছামত চড় মেরেছিল।
মৌনতা অবশ্য চড় মারলেও বিষয়টা ফাহিমের বাসায় জানায় নি। কিন্তু ওর বাসায় জানে। ফাহিমের এমন ছোটখাট অনেক সিক্রেট জানে মৌনতা। তাই সে তাকে বেশি ঘাটায় না। বরং সব কথা মেনে চলে।
আজকে মাঠ পরিষ্কার হয়ে গেলে মৌনতাকে ডাকা হবে। তারপর এলাকার সবাইকে নিয়ে ক্রিকেট খেলা হবে। বিশেষত পিচ্চি বাচ্চা যারা আছে তাদের নিয়ে। বড় প্লেয়ার বলতে মৌনতা, ফাহিম আর দু একজন বন্ধু বান্ধব।
মৌনতা আর বেশি বড় প্লেয়ার নিতে চায় না কারণ তার খেলার নিজস্ব কিছু নিয়ম আছে। সে জীবনেও ফিল্ডিং করবে না। শুধু ব্যাট করবে। তার পরিবর্তে ফিল্ডিং করতে পাঠায় তার পোষা কুকুরছানা মিঃ ববকে। দশ বারো জন প্লেয়ার নিয়ে তাদের খেলা হয়।
কোন দল নেই। মৌনতা বরাবর আগে ব্যাট করে। তারপর বাকিরা কোন সিরিয়ালে ব্যাট করবে তা লটারি করে ঠিক করা হয়। মাঝেমাঝে মৌনতা আউট হয়ে গেলেও ব্যাট ছাড়তে চায় না। আবার রোদ লাগলে বলে আম্মু বকা দিবে আর খেলব না।
ওর এত স্বেচ্ছাচারিতা সহ্য করেও বাচ্চারা ওর কথামত চলে তার কারণ হল তাদের যেকোন খেলাধূলার যাবতীয় স্পন্সর সে। তারপর খাওয়া দাওয়া এটা সেটা তো আছেই। মাঝেমাঝে মৌনতার মা নিজেও এসে সবাইকে এটা সেটা খাইয়ে যায়।
মাঠ খেলার উপযোগী হয়েছে শুনে মৌনতা প্রায় বিশ্বের সেরা দলের অধিনায়কের মত মাঠে এল। গায়ে চকচকে রঙিন জার্সি। পিছনে নাম লিখা। তার ক্রিকেট সেটটা দুজনে মিলে টানতে টানতে আনল। খুব ভারী সেট।
ব্যাট, প্যাড, হেলমেটসহ যাবতীয় সরঞ্জাম আছে সেখানে। সে বলতে গেলে খালি হাতেই মাঠে ঢুকল। একটা চেয়ারে বসে মিঃ ববকে ডাকল। কোথা থেকে যেন মিঃ বব এসে দৌড়ে ওর সামনে দাঁড়াল। লেজ নাড়িয়ে কুই কুই করতে থাকল।
মিঃ বব যখন লেজ নাড়িয়ে কুই কুই করে তখন মৌনতা হাসতে থাকে। এই লেজ নাড়িয়ে কুই কুই করার মানে হল ম্যাডাম আমি তৈরি। মিঃ ববের মাথায় একটা ক্যাপ আছে। সে খেলার সময় মহা আনন্দে এই ক্যাপ পরে।
আগের মতই মৌনতা আগে ব্যাট করবে তা সবাই জানে। তবে এরপর কে ব্যাট করবে তাদের লটারি করে সে ব্যাটিং এ গেল। মুহূর্তেই ছোট ছোট বাচ্চাদের বল পিটিয়ে তুলোধুনো করে ফেলল। মোটামুটি তিন চারটা ছক্কা মেরে রান নিয়ে গেল ত্রিশের ঘরে।
এরপর দুইটা বল মিস করল। বল মিস করলে তার রাগ উঠে যায়। পরের বলটা আসতেই রেগে মেগে ব্যাট চালাল সে। বলটা উড়তে উড়তে গিয়ে একটা বিল্ডিংয়ের জানালা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। সবাই দাঁত কামড় দিয়ে মাথায় হাত দিল।
তবুও একটা স্বস্তি আছে যে কারো কাচ ভাঙ্গেনি। কেউ কেউ ঐ বাসার আশেপাশে উঁকিঝুকি দিয়ে বল আনার চেষ্টা করল। বাসা থেকে কেউ সাড়া দিল না। এই বাসায় নতুন ফ্যামিলি এসেছে অল্প কিছুদিন হয়।
তাই কারো সাথে তেমন পরিচয় নেই। হুট করে বল আনতে যাওয়াটা ঠিক হবে না ভেবে সবাই অন্য বুদ্ধি খুঁজতে লাগল। হঠাৎ করে ফাহিমের মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি এল। সে বলল, এই মিঃ ববকে কাজে লাগানোর এটাই উপায়!
সদ্য সামনে দুইটা দাঁত পড়েছে এমন একটা বাচ্চা ছেলে বলল, কিভাবে ভাইয়া?
ফাহিম ওর মাথায় দুইটা চাটি মেরে বলল, তুই চুপ থাক ফোকলা দাঁত।
ছেলেটাকে ফোকলা দাঁত বলায় সে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় মৌনতাকে বলল, আপুনি দেখ আমাকে বকা দেয়।
মৌনতা সবাইকে থামিয়ে দেয়ার ভান করে বলল, উফফ। তোমাদের নিয়ে পারি না। আগে বল আনবা নাকি ঝগড়া করবা?
কি সুন্দর ফ্লোতে ব্যাট করছিলাম। মৌনতার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ফাহিম বলল, আরে তোর ব্যাটিংয়ের সুবিধার জন্যই তো বুদ্ধিটা করেছিলাম। কিন্তু মাঝখানে প্যাঁচ লাগালো ফোকলা দাঁত।
মৌনতা তাকে একটা ধমক দিয়ে বলল, এই চুপ। তুই বল কিভাবে মিঃ ববকে কাজে লাগাবি?
মৌনতার সামনে কিছু বলার সুযোগ পেলে ফাহিম নিজেকে সব সময় বিজ্ঞ সাজানোর চেষ্টা করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না।
মিঃ ববকে কাজে লাগানোর কথাটা অনেক নাটকীয় ভাবে উপস্থাপন করল সে। মূল বক্তব্য হল তারা যেহেতু দেখেছে কোন রুমে বলটা পড়েছে মিঃ ববকেও তা কোলে করে দেখানো হবে। তারপর কলিং বেল দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে।
কেউ দরজা খুললে তার সাথে কিছুক্ষণ আবোল তাবোল কথা বলবে ফাহিম। এই ফাঁকে ভিতরে ঢুকে যাবে মিঃ বব।
ফাহিমের প্ল্যান মোতাবেক মিঃ বব ভিতরে গেল। দশ মিনিট যায়। পনেরো মিনিট যায়। মিঃ বব তো আর ফিরে আসেনা।
যতই সময় যাচ্ছে ততই মৌনতার রাগ বাড়ছে। আর ফাহিম ঘামছে। আরো পাঁচ মিনিট শেষ হবার পর মৌনতা বলল, কিরে ফাহিম?
ফাহিম মিনমিনে গলায় বলল, বল শুনছি।
মিঃ বব এখনো আসে না কেন?
আমি কি করে বলব? তুইও এখানে আমিও এখানে। তাহলে আমি কি করে বলব?
ফাহিমের বাচ্চা আমার রাগ তুলিস না। মিঃ ববকে তুই তো পাঠিয়েছিলি। তাহলে আসে না কেন এখনো?
আমি ফাহিমের বাচ্চা নই। আমি নিজেই ফাহিম। বিয়ে করিনি। বাচ্চা হবে কোথা থেকে।
ঐ তুই নিজের কথা রাখ। মিঃ ববের কিছু হলে আমি তোকে ছাড়ব না।
মৌনতা এত চেঁচামেচি শুরু করল যে ফাহিম আর কিছু বলার সাহস পেল না। শেষমেশ ঠিক হল ফাহিম নিজেই মিঃ ববকে আনতে সে বাসায় যাবে।
মিঃ ববকে আনতে সে বাসায় গিয়ে ফাহিম দেখল পুরো তুলকালাম অবস্থা। একটা লম্বা চওড়া যুবক ছেলে সারা বাসা দৌড়াচ্ছে। আর তার পেছন পেছন মিঃ বব দৌড়াচ্ছে। কাজের মহিলা কোনমতে দরজা খুলে দেয়ার পরেই সে এই দৃশ্য দেখতে পেয়ে পুরো নির্বাক হয়ে রইল।
মিঃ ববের গায়ের সমস্ত লোমগুলো দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে সে খুব রাগান্বিত। এত কিছুর মাঝেও ফাহিম একবার মিনমিন করে ডাকল মিঃ ববকে। ফাহিমের ডাক শুনে মিঃ বব তার দিকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তেড়ে এসে একটা কামড় বসিয়ে দিল তার পায়ে।
তারপর আরেক কামড় দিবে এমন ভান করে তেড়ে আসতেই সে ভো দৌড় দিয়ে বাইরে এসে পা ধরে বসে হাঁপাতে লাগল। তাকে এভাবে আসতে দেখে মৌনতা জানতে চাইল কি হয়েছে। সে কিছু বলতে পারল না। শুধু আংগুলের ইশারা দিয়ে বাসাটার ভিতরে দেখিয়ে দিল। ফাহিমের কি হয়েছে তার কিছুই বুঝতে
পারল না মৌনতা। তবে অনুমান করল একটা কিছু ইমারজেন্সি হয়েছে। তার এখন নিজের যাওয়া উচিত।
তাই সে আর বেশি দেরি না করে বাসাটার ভিতরে ঢুকল। বাসার ভিতরে ঢুকে দেখল একটা তরতাজা যুবক ছেলে ওয়্যার ড্রবের উপর বসে আছে কম্বল গায়ে দিয়ে।
ছেলেটা ভয়ে কাঁপছে। তার হাতে বলটা ধরা। আর ফ্লোরে ঘররররর শব্দ করে রাগ প্রকাশ করছে মিঃ বব। ছেলেটা কিছুক্ষণ পরপর বলছে, যা দূরে যা। হিস হিস হিস।
মৌনতাকে দেখে মিঃ ববের সাহস আরো বেড়ে গিয়েছে। সে দ্বিগুন উৎসাহে ঘররররর শব্দ করে ছেলেটার দিকে বারবার তাকিয়ে লাফঝাঁপ দিচ্ছে। এমন একটা দৃশ্য দেখে মৌনতার কেন জানি ভয়ংকর রাগ করার পরিবর্তে ভয়ংকর হাসি পেয়ে গেল।
তবুও সে মুখে কঠিন ভাব ধরে রেখে বলল, হচ্ছেটা কি?
ছেলেটা একবার মৌনতার দিকে তাকিয়ে আবার সাথে সাথেই ববের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল, কি হচ্ছে দেখতে পাচ্ছেন না?
এলাকায় আসার সাথে সাথে কেউ একজন আমাকে খুন করার জন্য ট্রেইনড কুত্তা
পাঠিয়েছে।
কি বলছেন এসব?
ঠিক ই বলছি।
আপনাকে কেন কেউ খুন করতে চাইবে?
সেটা তো খুনিই ভালো জানে। দেখেন না কি একটা কুত্তা লেলিয়ে দিয়েছে। যেন আমি খুন হয়ে গেলেও কোন প্রমাণ না থাকে।
এই বার বার কুত্তা কুত্তা করবেন না তো। ওর নাম মিঃ বব।
কি? আপনি ওরে চিনেন? এই হারামি কুত্তা কি বিশাল মাপের ট্রেনিং নিয়া আসছে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। দুই বার জানালা দিয়ে ফেলে দেয়ার পরেও ও কিভাবে যেন চলে আসছে বাসায়। আবার দেখেন অন্য কাউকে কিছু করছে না।
শুধু আমাকেই এটাক করে।
মিঃ ববকে দুইবার জানালা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছে শুনে মৌনতার মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সে সাথে সাথে নিচু হয়ে বসে মিঃ ববকে কোলে তুলে নিয়ে ওর গায়ের ধুলোবালি পরিষ্কার করে দিল।
তারপর বলল, আপনি কি আসলে বলুন তো? মিঃ ববকে দুই বার জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন মানে? কিভাবে পারলেন আপনি?
মৌনতার ছোঁয়া পেয়ে মিঃ বব একদম শান্ত হয়ে গিয়েছে দেখে ছেলেটা একটু অবাক হল। তার অবাক চোখ দুটো এখন মৌনতার উপর স্থির। তবে তার ভয় কাটেনি। সে তার ভয়টুকু গলা থেকে যথাসম্ভব ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে বলল, আপনি একটা কিলার কুত্তাকে সামলে ফেললেন?
এবার মৌনতা ভয়ানক রেগে গেল। সে তার রাগটুকু লুকানোর কোন রকম চেষ্টা না করেই বলল, হোয়াট দ্য হেল আর ইউ টকিং? জাস্ট শাট আপ। ওকে? মিঃ বব কোন কিলার নয়। সে একটা বল নিতে এসেছে। আপনার হাতের বলটা।
ছেলেটা এবার ভীষণ অবাক হয়ে তার হাতের দিকে তাকালো। আসলেই তো তার হাতে যে একটা বল ধরা এতক্ষণ সে এটা বলতে গেলে লক্ষ্য করেনি। মৌনতা বলের কথা বলার পর সে বুঝতে পেরেছে।
তারপর সাথে সাথে বলটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে লাফ দিয়ে ওয়্যারড্রবের উপর থেকে নিচে নেমে দাঁড়িয়ে গা হাত পা ঝাড়া দিল। তারপর বীর পুরুষের মত ভান করে বলল, সামান্য এই বলটার জন্য এমন করল?
এই বলটা সামান্য নয়। আমাদের খেলা চলছিল। আমি ব্যাট করছিলাম। একটা ছক্কা মারার সময় বলটা আপনাদের বাসায় এসে পড়েছিল। ধ্যাত কি সুন্দর খেলা চলছিল। আপনার জন্য সব পন্ড।
ওহ তাই বলেন। কিন্তু আপনাদের এই খেলার জন্য বব নামের কুত্তাটা তো আমাকে খুন করতে বসেছিল।
আবার আপনি ওকে কুত্তা বলছেন?
সরি সরি। আর বলব না। আচ্ছা শুনুন আমি তারিফ। এই এলাকায় নতুন এসেছি।
নতুন এসেছেন তা তো বুঝাই যাচ্ছে। নইলে তো আমাকে চিনতেন। এনিওয়ে আমি মৌনতা।
নাইস নেইম।
থ্যাংকস।
এভাবেই পরিচয় হয় মৌনতা ও তারিফের। পরিচয়ের পর মৌনতা আর তেমন দাঁড়ায় না। সে মিঃ ববকে কোলে করে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। মিঃ বব অবশ্য বেরিয়ে আসার আগে তারিফের দিকে তাকিয়ে একটু রাগী লুক দিয়ে শাসিয়ে দিয়েছে।
সেসব তারিফ খেয়াল করলেও মৌনতা খেয়াল করেনি।
তারিফের বাসা থেকে বের হয়ে মৌনতা আর খেলার মাঠে গেল না। বরং আর খেলবে না বলে বাসায় চলে গেল।
মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসতে দেখে মিতিল আহমেদ অবাক হয়ে গেলেন। তার উপর মিঃ ববের গায়ে ধুলোবালি মাখা দেখে আরো বেশি চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি তাই হাতের কাজ ফেলে রেখে মৌনতার কাছে গেলেন।
একটা তোয়ালে দিয়ে হালকা করে ওর মুখ মুছে দিয়ে বললেন, কি রে আজ এত তাড়াতাড়ি খেলা শেষ?
মৌনতা গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলল, আর বলো না মা। কেন কি হয়েছে? শূন্য রানে আউট হয়ে মেজাজ খারাপ নাকি?
ধূর মা। তা নয়।
তাহলে কি? মিঃ ববের এই অবস্থা কেন?
ওকে নিয়েই তো আজ যত কাহিনী।
কি হয়েছে? খুলে বল তো।
এলাকায় একটা পাজি ছেলে এসেছে। ওর বাসায় আমাদের বলটা চলে গিয়েছিল। পরে ববকে আনতে পাঠিয়েছিলাম। সেই ছেলেটা ববকে এত ভয় পেয়েছে যে কি বলব। সেই ববকে ভয় পেয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। তাই তো ববের গায়ে ধূলো লেগেছে।
আর কিছু করেনি তো?
আরে না আর কি করবে? আমি তো পরে গিয়ে ববকে নিয়ে এসেছি। ফ্লো নষ্ট হওয়াতে আর খেলতে ইচ্ছে করল না। তাই চলে এলাম। ভালো করেছিস মা। এখন ফ্রেশ হয়ে নে।
আচ্ছা মা।
মায়ের কথা শুনে মৌনতা ফ্রেশ হতে গেল।
মৌনতা ফ্রেশ হতে যাওয়ার পর মিতিল আহমেদ তার শাশুড়ির দিকে কিছুটা নজর দিলেন। এই বেচারি মৌনতার ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকেন। বিছানায় বসলে চাদর কুচকে যায় তাই মৌনতা তাকে মেকি ধমক দেয়। আবার তাকে যখন তখন ধরে মেকাপ লাগিয়ে দিতে চায়।
ষ্টাইল করে চুল কেটে দিতে চায়। মিতিল আহমেদ দেখলে যথাসাধ্য তার শাশুড়িকে সেইভ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু না দেখলে তো ঘটনা ঘটে যায়। অবশ্য মৌনতার দাদী এগুলো মিষ্টি মধুর যন্ত্রণা ভেবে উড়িয়ে দেন।
তার বুড়ো বয়সে অন্তত সময় কাটানোর মত একটা কিছু তো আছে। বাংলার বহু বুড়ো মানুষ আছে যাদের শেষ জীবনটা অভিশাপ হয়ে আসে শুধুমাত্র একটু সময় কাটানোর অভাবে। সেসব কিছু চিন্তা করলে তিনি বোনাস জীবন পেয়েছেন।
তার জীবনে সময় তো কাটেই বরং আনন্দের সাথে কাটে।
মিতিল আহমেদ তার শাশুড়ির খোঁজ খবর নিয়ে তার সাথেই বসে রইল কিছুক্ষণ। এর মধ্যে বাথরুম থেকে বের হলো মৌনতা।
সে গিয়ে সোজা ড্রয়িং রুমে বসে টিভি অন করল। কয়েকটা চ্যানেল চেঞ্জ করেই হঠাৎ করে চিৎকার করে উঠল। ওর মাকে আর দাদীকে প্রাণপণে ডাকতে লাগল। মিতিল আহমেদ তার শাশুড়িকে নিয়ে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি এসে জিজ্ঞেস করল, কি করে কি হয়েছে?
মৌনতা টিভি মনিটর থেকে চোখ না সরিয়ে হাত ইশারা করে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ বাবাকে দেখায়।
মিতিল আহমেদ বিরক্ত হয়ে বলল, তোর বাবাকে দেখালে কি হয়েছে?
মায়ের কাছ থেকে এমন নিষ্ঠুর উত্তর পেয়ে মৌনতা আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বসে বসে বাবার সাক্ষাৎকার দেখতে লাগল। আজকাল বড়সড় অপারেশনের পর বাংলাদেশ পুলিশ প্রেস ব্রিফিং করে।
একজন পুলিশ কমিশনার হিসেবে বেনজীর আহমেদ প্রায়ই সেসব ব্রিফিং এর মধ্যমণি থেকে সাংবাদিকদের উত্তর দেন। মৌনতা প্রায় সব সময় এসব ব্রিফিং দেখে মন দিয়ে। ছোটবেলা থেকে তার অভ্যাস বেনজীর সাহেবকে টিভিতে দেখলে চিৎকার চেচামেচি করে পুরো বাসা মাথায় নেয়া।
এতে বরাবর বিরক্ত হন মিতিল আহমেদ। তবে মৌনতার দাদী নিজের ছেলেকে দেখার জন্য মৌনতার পাশে বসে যান। দেখা শেষ হলে খুব গর্ব নিয়ে মৌনতাকে বলেন, আমার ছেলেকে টিভিতে দেখতে খুব ভালো লাগে।
মৌনতা তখন রাগ করার ভান করে বলে, এটা কিন্তু আমারও ছেলে। তার দাদী তখন মুখ টিপে টিপে হেসে বলেন আচ্ছা ঠিক আছে। তোরও ছেলে। তারপর দাদী নাতনী গলাগলি করে বসে থাকে। মাঝেমাঝে বেনজীর আহমেদকে ফোন করে।
আগে মৌনতা কথা বলে। পরে ওর দাদী কথা বলে। আজও নিয়মের কোন ব্যতিক্রম ঘটল না। ওদের ফোনে কথা বলা শেষ হলে ডাইনিং টেবিলে খেতে ডাকল মিতিল আহমেদ। মৌনতা সোফায় বসে বসে বলল, মা এখানে নিয়ে এস।
টিভি দেখব আর খাব।
মিতিল আহমেদ জানেন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। মৌনতার খাবার ওখানেই নিয়ে যেতে হবে। তাকেই এক ঘন্টা ধরে বসে বসে খাওয়াতে হবে। এই মেয়ে জীবনেও নিজের হাতে খাবে না। বাইরে ঠিকই নিজের হাতে খায়।
কিন্তু বাসায় সে বাবা মায়ের হাতেই খাবে। মিতিল আহমেদ যদিও ব্যাপারটা উপভোগ করেন তবুও মাঝেমাঝে কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, এত বড় মেয়ে হয়েও আমাকে জ্বালাতে ভালো লাগে?
মৌনতা তখন ভীষণ আদুরে গলায় বলে, মা আমি না তোমার একমাত্র বাচ্চা? আমি না জ্বালালে কে জ্বালাবে?
প্রায় প্রতিক্ষেত্রে এমন ব্ল্যাকমেইল করে কথা বলে মৌনতা। তার এমন কোণঠাসা উত্তরে মিতিল আহমেদ আর কিছু বলতে পারে না।
সেই সুযোগে সে ভীষণ স্বেচ্ছাচারী হয়ে ইচ্ছামত কাজকর্ম করে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর নিয়মমত মৌনতা ঘুমাতে গেল। যাওয়ার সময় জোর করে দাদীকে সাথে নিয়ে গেল।
তারপর শক্ত করে চেপে ধরে শুয়ে রইল। তার দাদী কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে বলার চেষ্টা করল যে তার অস্বস্তি লাগছে। কিন্তু মৌনতার ভয়ে তার গলা দিয়ে কোন শব্দ বের হলো না। তবে বারবার নড়াচড়া করার কারণে মৌনতা বলল, কি হল দিদুন?
কি হবে?
তুমি এত নড়াচড়া কর কেন?
গরম লাগে তাই।
আহা কি ঢং। চুপ করে শুয়ে থাক।
আচ্ছা।
ও দিদুন…
কি?
একটা গল্প বলো না?
কোনটা বলব?
যেটা ইচ্ছা।
আমি কোনটা বলব? শুরু করলেই তো তুই বলবি এটা তো শুনেছি। ছোটবেলা থেকে গল্প শুনতে শুনতে তো সব শেষ।
দাদীর মুখ থেকে এমন কথা শুনে মৌনতা হাসতে হাসতে বলল, তুমি আর কোন গল্প জানো না কেন?
আমি ফুরিয়ে গেছি রে বোন। তাই আর কিছু নতুন জানি না।
কেমন করে ফুরিয়ে গেলে?
যেমন করে আর দশজন নারী ফুরিয়ে যায় তেমন করে ফুরিয়ে গেছি। একদিন তুইও ফুরিয়ে যাবি।
ইস না। আমি জীবনেও ফুরাবো না।
যৌবন কালে তোর মত আমিও ভাবতাম। তোর মত মোলায়েম টান টান ত্বক আমারও ছিল। আর এখন দেখ কি রকম ঝুলে গেছে।
আমি অনেক যত্ন নিব। তোমার মত এত বুড়ো হবো না।
যত যত্নই নাও গো বুবু লাভ হবে না। বিয়ে হলেই অর্ধেক জীবন শেষ।
ইস। আমি জীবনেও বিয়ে করব না। আর বাবা বলেছে আমাকে বিয়ে দিবে না। আর দিলেও ঘরজামাই রাখবে।
বললেই হল বিয়ে দিবে না?
হ্যাঁ বললেই হলো।
না হলো না।
কেন হলো না?
পুরুষ স্পর্শ ছাড়া নারী জীবন অপূর্ণ তাই।
ইস শুধু পচা কথা বলে।
এগুলো পচা কথা না। তোর বয়সে আমারও এগুলো অস্বাভাবিক লাগত। তবে আমি চাই তুই ধীরে ধীরে এগুলো শিখ। এতে করে তুই ভুল পথে যাবি না।
তাই?
হ্যাঁ।
আচ্ছা তুমি সব শিখিয়ে দিও।
আচ্ছা।
এভাবে দাদী নাতনী গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গেল তা টেরই পেল না। তাদের ঘুমটা ভাঙল সন্ধ্যার একটু আগে। তাও আবার গীটারের শব্দে। ঘুম অবশ্য ঠিক সময়ে ভেঙেছে। তবে মৌনতার একটু বিরক্ত লাগল গীটারের শব্দে।
সে চেয়েছিল আরেকটু মজা করে ঘুমাবে। তবুও বিছানায় উঠে বসে গীটারের শব্দটা কোথা থেকে আসে তা বুঝার চেষ্টা করল। এর আগে তো এই এলাকায় কোন প্রোগ্রাম ছাড়া এমন অসময়ে গীটার বাজেনি। তবে কি তারিফ বাজাচ্ছে?
তারিফের কথা মনে হতেই মৌনতার সকালের ঘটনার কথা মনে পড়ে ভীষণ হাসি পেল। সে নিশ্চিত হওয়ার জন্য গীটারের শব্দটা ফলো করে গিয়ে দেখল আসলেই তারিফের বাসা থেকেই আওয়াজ আসছে। তার মানে এই ব্যাটা গীটার বাজাতে পারে।
নিজের গীটার আছে। গান গাইতে পারে। হঠাৎ করে মৌনতার বুকটা হিংসায় জ্বলে যেতে লাগল। ইউনিভার্সিটিতে পড়লেও তার ভিতর থেকে ছেলেমানুষি একদম যায়নি। তাদের বাসার আশেপাশে একজনের একটা কিছু আছে আর সে জিনিসটা তার থাকবে না এটা হতে পারে না।
ছোট বেলা থেকেই এটা করে আসছে সে। আজ এটার ব্যতিক্রম হতে পারে না। আজ সন্ধ্যায়ই তার গীটার কিনতে হবে। যে করেই হোক এটা বাজানো শিখতে হবে।
গীটার কিনবে ঠিক করার পর মৌনতা বুঝতে পারল এখন বাসায় গেলে তার মা আর তাকে বের হতে দিবে না। তাই বাইরে থেকেই সে ফোন দিল তার বাবাকে। বেনজীর আহমেদ প্রচুর ব্যস্ততার মাঝেও মেয়ের ফোন দেখে হাসতে হাসতে ফোন হাতে নিয়ে বললেন, হ্যালো মামনী।
হ্যালো বাবা।
বল মামনী।
বাবা তুমি কখন আসবে?
কেন মা?
একটা কিছু কিনতে হবে।
মাকে নিয়ে কিনে ফেল।
উফ বাবা তুমি জানো না মা কত হাজার প্রশ্ন করবে। শেষমেশ কিনে দিবে না। তাছাড়া তাকে দিয়ে এটা কেনা যাবে না।
কি কিনতে চাও বল বাবা আসার পথে নিয়ে আসব।
না বাবা আমারও সাথে যেতে হবে।
জিনিসটা কি?
তুমি এলে বলব।
না এখনই বল।
জিনিসটা কি জানার আগে বল আমাকে এক্ষুণি কিনে দিবে? প্লিজ বাবা। প্লিজ।
তোমার কিছু আমি না করেছি? অবশ্যই কিনে দিব। এখন বল কি কিনতে চাও?
আগে বল প্রমিজ আজকেই কিনে দিবা?
আচ্ছা মা প্রমিজ।
বাবা, আমি একটা গীটার কিনতে চাই। দিবা না কিনে? হ্যাঁ দিব মা। কিন্তু…
কিন্তু কি?
হঠাৎ করে তুমি গীটার কিনতে চাইছ কেন?
বাবা আমাদের এলাকায় একটা ছেলে এসেছে নতুন। ওর নাম তারিফ। ওর গীটার আছে। আর আমার নেই। তুমিই বল ব্যাপারটা কত লজ্জার না?
আমর অবশ্যই লজ্জার। এলাকার কারো কিছু থাকবে আর তা আমার মেয়ের থাকবে না তা কি করে হয়?
ঠিক বাবা। এবার বুঝ আমার কেমন লাগছে।
বুঝলাম। এবার বল, তোমার মাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে?
জানি না। তুমি ম্যানেজ করবে।
আমি?
হ্যাঁ তুমি।
আচ্ছা করে নিব।
তাহলে আস বাবা এখনি।
হাতের কাজটা একটু শেষ করে আসি মা?
না। আমি জানি না। তুমি তাড়াতাড়ি আস বাবা। নইলে কিন্তু অনেক রাগ করব।
আচ্ছা মা তোমার রাগ করতে হবে না। বাবা আসছি।
থ্যাংকস বাবা। লাভ ইউ।
লাভ ইউ টু মামনী। সি ইয়ো সুন। বাই।
বাই।
বাবার সাথে কথা বলে মৌনতা আনন্দে লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে। তারপর বারকয়েক এদিক ওদিক হাত পা ছুড়ে ইয়েস ইয়েস বলে নাচতে থাকে। পুরো ব্যাপারটা দূর থেকে মন দিয়ে দেখে তারিফ ও তার মা।
পাগলী মেয়েটার এমন পাগলামি দেখে মা ছেলে দুজনের মুখেই হাসি ফুটে উঠে। তারিফ খুব আনন্দ গলায় ঢেলে তার মাকে বলল, মা দেখলে মেয়েটা কেমন পাগল? তোমাকে যখন সকালের কথাটা বলেছিলাম তখন তো বিশ্বাস করলে না।
তার মা বলল, এই মেয়েটাই বাসায় এসেছিল? হ্যাঁ মা। ওর কুত্তাটাই তো আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। ঐ যে মিঃ বব নাম।
কি যা তা বলছিস। ওর কুকুরছানা তোকে কেন মারতে চাইবে? না দেখলে তুমি বিশ্বাস করো না আমি জানি।
বলেছিলাম না মেয়েটা পাগলি। আস্ত পাগলি। তখন তো বিশ্বাস করোনি। এখন তো দেখে বিশ্বাস করবে নাকি?
না এখনো করব না।
কেন?
তুই বল কেন করব?
তুমি শুনলে না ও ওর বাবার কাছে বলছে আমার গীটার আছে এ জন্য তারও একটা গীটার কিনতে হবে এটা কোন কথা?
ধুর বোকা। তাতে কি হয়েছে। মেয়েটা একটু আহ্লাদী। তবে পাগলি নয়। ভীষণ সুইট।
সুইট না ছাই। আস্ত পাগলি।
আচ্ছা যা খুশি তা। এই ওর নাম কি যেন বলেছিলি?
মৌনতা না যেন কি বলেছিল। ঠিক মনে নাই।
ওয়াও। কি সুন্দর নাম।
মা…
কি?
আমার কিন্তু হিংসে হচ্ছে। তুমি একদম ওর প্রশংসা করবে না। তুমি আমার মা। আমার পক্ষে থাকবে।
তারিফের মা ওর মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, আচ্ছা বাবা তোর পক্ষেই থাকব। তোর বাবা বাসায় আসুক।
আজকে মৌনতার গল্প তাকেও শোনাতে হবে। মেয়েটা কত মায়াবী দেখ। দেখলেই আদর আদর লাগে। এমন একটা মেয়েকে যদি তোর বউ বানাতে পারতাম!
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে তারিফ হঠাৎ করে খুব লজ্জা পেয়ে যায়। তবুও সে যথাসাধ্য লজ্জাটা প্রকাশ না করে বলল, এমন পাগলি আমি জীবনেও বিয়ে করব না।
সে দেখা যাবে। এখন নিজের কাজে যা।
যাচ্ছি মা।
মায়ের সাথে কথা বলে তারিফ নিজের রুমে এসে ভাবতে লাগল মৌনতার কথা। সত্যি সত্যি তো এত পাগলি একটা বউ তার হলে কেমন হবে? সে কি অ্যাডজাস্ট করতে পারবে? নাকি সারাক্ষণ শুধু ঝগড়া হবে?
সবই তো ঠিক আছে। সমস্যা হল মিঃ বব। তাকে বিয়ে করলে তো ববও তার সাথে আসবে। তখন যদি মিঃ বব তাকে কামড়ে দেয়? মৌনতার কথা ভাবতে গিয়ে মিঃ বব চলে এল তারিফের ভাবনায়। ভয়ে আবার তার গা শিউরে উঠল।
যে করেই হোক মিঃ ববের একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। ফাহিমের পা ব্যথা কিছুটা কমেছে। মিঃ ববের কামড় খেয়ে সে যতটা না ব্যথা পেয়েছে তার চাইতে বেশি ভয় পেয়েছে। ডাক্তার বলেছে ভয় নেই। কামড় দিলেও দাঁত বসেনি।
শুধু একটু ছিলে গিয়েছে। তবুও কুকুরের লালায় জীবাণু থাকতে পারে তাই এন্টি পয়জন ইনজেকশনের কোর্স দিয়েছে। মিতিল আহমেদ ফাহিমের কামড় খাওয়ার ব্যাপারটা জানতেন না। ওদের সাথে সকালে ক্রিকেট খেলেছে এমন একটা পিচ্চির কাছে খবর পেয়ে সাথে সাথে তিনি ফাহিমকে দেখতে গেলেন।
গিয়েই এসব তথ্য জানতে পারলেন। তাকে দেখে যে ফাহিমের মা খুব একটা খুশি হয়েছেন তা নয়। তবুও ভদ্রমহিলা মুখ গোমরা করে তাকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন করার চেষ্টা করছেন। মিতিল আহমেদ বারবার খুব আফসোস করে সরি বলছেন।
আর মহিলাও জবাবে ইটস ওকে বলছেন। এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে মানুষ হয়তো মাঝেমধ্যে পড়ে। তবে মৌনতা খুব চঞ্চল হলেও মিতিল আহমেদকে এ ধরনের পরিস্থিতিতে খুব একটা পড়তে হয়নি। তাই তিনি আজ খুব বেকায়দায় পড়ে গেলেন।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে ফাহিমের মা বলল, ভাবী- আমার ছেলেটা আসলে খুব ভীতু। ছেলে মানুষ এত ভীতু হলে চলে না।
মিতিল আহমেদ খুব একটা কথা খুঁজে না পেলেও তাকে সমর্থন দিয়ে বলল, তা ঠিক।
ফাহিমের মা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবার বলল, ভাবী আমারও সাহস খুব কম। ছেলেটা আমার মত হয়েছে। আমারও কিন্তু খুব ভয় লাগছে।
ফাহিমের মা আসলে কি বলতে চাইছেন তা মিতিল আহমেদ প্রথমে বুঝতে পারেন নি। কিন্তু তিনি যে ইনিয়ে বিনিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছেন তা অনুমান করতে পারছেন। তবুও তার অনুমানটুকু গোপন রেখে বললেন, কিসের ভয় ভাবী?
মিতিল আহমেদের কথা শেষ হওয়ার অনেক্ষণ পর ফাহিমের মা বলল, না মানে আজকাল শুনেছি পশুদের দ্বারা নানান ভাইরাস ছড়ায়। আপনাদের বব তো ফাহিম কে কামড়েছে। যদি এখন ফাহিমের কোন সংক্রামক রোগ হয়?
মিতিল আহমেদ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভাবী- এক্সিডেন্ট যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে। আমি লজ্জিত এর জন্য। তবে আপনি ভয় পাবেন না। মিঃ ববের জন্য আলাদা ডক্টর আছে। সেই ডক্টর তাকে সব ধরনের টীকা দিয়ে রাখে।
সপ্তাহ সপ্তাহ ওকে চেক করে। আপনি যদি এরপরেও ভয় পান তবে আমি নাহয় ফাহিমকে ভালো একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
তাদের দুজনের আলোচনার মাঝে হঠাৎ করে ফাহিমের বাবা আসল। তিনি অমায়িক ভদ্রলোক। এসেই হাসি দিয়ে সালাম বিনিময় করলেন মিতিল আহমেদ এর সাথে। তারপর হাসতে হাসতে বললেন, এত ভয় নিয়ে কি দুনিয়া চলে?
আজকে যা হয়েছে তাতে মৌনতার কোন দোষ নেই। একসাথে প্লে গ্রাউন্ডে গেলে কত কিছুই হতে পারে। তাছাড়া ফাহিমকে যখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছি তখন তো তিনি সব চেকাপ করেছেন। দাঁত বসেনি। শুধু প্যান্টের উপর দিয়ে আঁচড় লেগেছে।
ফাহিমের বাবার কথা শুনে মিতিল আহমেদ কিছুটা নির্ভয় বোধ করলেন। এতক্ষণ তার নিজের কাছে নিজেকে খুব অপরাধী লাগছিল। ফাহিমের মাও তার স্বামীর কথা শুনে ভরসা পেলেন। এরপর স্বাভাবিক গল্পগুজব চলতে চলতে এক পর্যায়ে গুমোট পরিবেশ হালকা হয়ে এল।
শেষে মিতিল আহমেদ বিদায় নিলেন।
গীটার কিনতে এসে বেনজীর আহমেদ পড়লেন মহাবিপদে। সারাজীবন তিনি ক্রিমিনাল কেইস নিয়ে পড়ে ছিলেন। তার পক্ষে গীটারের দোকান থেকে গীটার কেনা সত্যিই খুব ভয়াবহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল।
এদিকে মৌনতার ধারণা তার বাবা দুনিয়ার সব জান্তা। যেহেতু সব জান্তা সেহেতু তিনি গীটার সম্পর্কেও জানবেন! বেনজীর আহমেদ অবশ্য তেমন রিস্ক নিলেন না। তিনি গিয়ে সেলসম্যানকে বললেন দোকানের সবচেয়ে দামী আর সুন্দর গীটারটা দেয়ার জন্য।
দোকানী তার কথামত গীটার দিয়ে দিল। লাল রঙের সে গীটারটা হাতে পেয়ে মৌনতার খুশি যেন আর ধরে না। বাসায় ফিরতে ফিরতে গাড়িতে বসে সে তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ও বাবা লাভ ইউ।
বেনজীর আহমেদ তাকে বুকে জড়িয়ে বললেন, লাভ ইউ টু মা। পছন্দ হয়েছে না?
অনেক পছন্দ হয়েছে।
এবার কি তাহলে আমার মা শিল্পী হবে।
জানি না বাবা। আগে তো শিখতে হবে।
আচ্ছা শিখে নিও। তোমাকে না হয় একটা মিউজিক স্কুলে ভর্তি করে দিব।
আরে না বাবা। আমি নিজেই শিখতে পারব।
নিজে কিভাবে শিখবে?
যাদু দিয়ে।
কি যাদু?
বলব না।
বাবাকে বলবে না?
বলব তো। কিন্তু তুমি যদি মামনীকে বলে দাও?
এখনো কি কোন সিক্রেট বলেছি?
না।
তাহলে আমাকে সন্দেহ করলে কেন?
ও বাবা তুমিও না কি। তোমাকে সন্দেহ করছি না।
তবে বল কিভাবে শিখবে।
ইন্টারনেট থেকে।
ভিডিও টিউটরিয়াল দেখে?
হ্যাঁ।
গুড। আমার মা সবচেয়ে বুদ্ধিমতী।
দেখতে হবে না কার মা আমি?
হ্যাঁ ঠিক। তুমি আমার মা। তাই সবচেয়ে বুদ্ধিমতী।
ঠিক। বাবা আইসক্রিম খাব। ঠিক আছে। কিন্তু… কি?
তোমার ঠান্ডা লেগে গেলে তো তোমার মা আমাকে খুব বকা দিবে। মাকে ভয় পাও?
হ্যাঁ পাই।
আমিও পাই।
এখন কি হবে?
ভুজংভাজুং দিয়ে ম্যানেজ করতে হবে।
আচ্ছা।
বাবা, চল মায়ের সবচেয়ে পছন্দ ফুচকা নিয়ে যাই। আজকে তো না জানিয়ে গীটার কিনেছি। মাকে তো খুশি করতে হবে। আর দিদুনের জন্যও কিছু একটা নিতে হবে।
আচ্ছা চল। আমরা আইসক্রিম খেয়ে নেই। তোমার মায়ের জন্য ফুচকা নিয়ে নেই। আর আমার মায়ের জন্য কি নিব?
দিদুন তো ফুচকা খেতে পারে না। দাঁতে টক লাগে। বাবা ফুচকা কিন্তু বেশি করে নিবে। বাসায় গিয়ে আমিও খাব।
সেটা আমি জানি। আগে বল আমার মায়ের জন্য কি নেয়া যায়। ইম… দিদুনের জন্য কাবাব নিয়ে যাই চল।
ওকে।
গীটার কিনে বাসায় ফেরার পথে রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে আরো কিছু কেনাকাটা করলেন বেনজীর আহমেদ। সবই মৌনতার পছন্দমত। সাথে খাওয়া দাওয়া তো আছেই। ছোটবেলা থেকেই মৌনতার এই অভ্যাস।
বাবার সাথে কখনো কিছু কিনতে বের হলেই প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে যা চোখে লাগবে তা কিনে নিয়ে আসবে। শেষমেশ এমন অবস্থা হয় যে দুই হাত ভর্তি ব্যাগের কারণে বাবা মেয়েকে আর দেখা যায় না। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।
ফাহিমদের বাসা থেকে ফিরে মিতিল আহমেদের মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। মানুষ যে কত সুযোগ সন্ধানী তা মৌনতাকে কে বুঝাবে? তাছাড়া তার মেয়েটাও তো ভীষণ পাগলী। পাগলী হোক আর যাই হোক তার এই মেয়েকে ছাড়া তিনি বা তার স্বামী কেউই বাঁচবেন না।
এর একটা কারণ নিশ্চয় আছে। সে কারণ তো আর সবাইকে বলে বেড়ানো যাবে না। আজ যখন বাসায় ফিরে দেখলেন মৌনতা বাসায় নেই তখন তিনি হন্তদন্ত হয়ে ঠিকই ফোন করে খোঁজ নিয়েছেন সে কোথায় আছে।
তবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন মৌনতা বাসায় ফিরলে আজ তাকে বা তার বাবাকে একদম বকাঝকা করবেন না।
বাইরে থেকে ফিরে মিতিল আহমেদের আবেগ প্রবণ আচরণ দেখে মৌনতা ও তার বাবা ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
তবে বকা না খাওয়ার আনন্দে দুজনেই লুকিয়ে কয়েকবার হাই ফাইভও দিয়ে নিল। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর মৌনতা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মামনী তোমার কি হয়েছে?
কি হবে?
কিছু না হলে আজ যে বকা দিলে না?
আমি কি শুধু বকাই দেই? আদর করি না?
হ্যাঁ কর তো।
তাহলে?
কিন্তু তোমার বকাও ভালোবাসি। মধুর লাগে।
তাই?
হ্যাঁ।
আর কি মধুর লাগে?
সব। তোমার হাসি। তোমার কথা। তোমার শাসন। সব।
তাহলে যে এত দুষ্টুমি করিস?
ইচ্ছে করে করি নাকি?
আচ্ছা মা বল না তোমার কি হয়েছে?
কিছু নারে পাগলী।
কিছু না হলে এত মনমরা লাগছে কেন?
এমনি। শোন ফাহিমদের বাসায় গিয়েছিলাম।
কেন?
ওকে দেখতে।
ও হ্যাঁ ভুলেই গিয়েছিলাম। ওকে তো মিঃ বব বাইটস দিয়েছে।
হ্যাঁ। তুই এটা আমাকে আগে বলিস নি কেন?
সরি মা। ভুলে গিয়েছিলাম। এখন ও কেমন আছে?
আউট অব ডেঞ্জার।
যাক বাবা বাঁচা গেল।
না বাঁচা যায়নি।
কেন?
তুই আর মিঃ ববকে নিয়ে খেলতে যাবি না। মানুষ অযথা তোকে হিংসা করে।
করলে করুক।
আমি চাই না কেউ তোকে হিংসা করুক। কারো কুদৃষ্টি তোর উপর পড়ুক।
আচ্ছা যাব না আর। ফাহিমের মা কি তোমাকে কিছু বলেছে?
বললে তুই কি করবি?
আমি শোধ নিব।
কিছু বলেনি। আর বড়দের নিয়ে এমন চিন্তা করতে হয় না। আমি শুধু তোকে সাবধান করে দিলাম।
আচ্ছা আচ্ছা। কান ঝালাপালা হয়ে গেল রে বাবা। উফ।
দেব একটা ধরে।
মিতিল আহমেদ শাসনের ভান করতেই মৌনতা হেসে বলল, এইতো আমার মামনীর মত লাগছে।
মৌনতার এমন নির্মল হাসি আনন্দ দেখে মিতিল আহমেদের বুকটা ভরে গেল। তিনি কিছুক্ষণ ওর হাসি দেখলেন। তারপর কপালে চুমু খেয়ে বললেন, আমার পাগলী মেয়েটা। আজকের গীটারটা কিন্তু খুব সুন্দর হয়েছে।
মায়ের মুখে গীটারের পক্ষে কথা শুনে সে দ্বিগুণ খুশি হয়ে বলল, সত্যি মা?
হ্যাঁ সত্যি।
ও মা। থ্যাংকস। বলতো এটা কার পছন্দ?
জানি না। তুমি বল।
এটা বাবার পছন্দ।
তোর বাবার পছন্দ এত সুন্দর হতে পারে? বিশ্বাস হচ্ছে না।
না মা বিশ্বাস কর। এটা বাবা পছন্দ করেছে। আমার জন্য।
আচ্ছা করলাম।
মামনী একটা কথা বলি।
বল।
তুই তো এখন ইউনিভার্সিটিতে পড়িস। আগে তোর বয়সী মেয়েদের দিব্যি বিয়েশাদী হয়ে যেত। এখনো যে হচ্ছে না তা না। তবে শতকরা হার কম।
তো কি হল?
আগে আমাকে বলতে দে। শেষ করতে দে কথাটা।
আচ্ছা শেষ কর।
এখন তোর আউটডোর গেইমস খেলে সময় নষ্ট করা উচিত না। তোর পড়াশোনায় মনযোগী হওয়া উচিত। দিন দিন দেখবি পড়ার চাপ বাড়বে। ভালো রেজাল্ট না হলে আমরা কষ্ট পাব। তুই চাস আমরা কষ্ট পাই?
কখনোই না। আমি তো পড়ায় ফাঁকি দেই না। আমি জানি তুই ফাঁকি দিস না। তবুও বললাম। মা তুমি চিন্তা করো না। আমি সব ঠিক রেখে চলব। এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। একটা গল্প বল। শুনতে শুনতে ঘুমাই।
মিতিল আহমেদ গল্প বলতে শুরু করলেন। মৌনতা ওর মায়ের বুকে মাথা রেখে গল্প শুনতে লাগল। গল্প শুনতে শুনতে কখন ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল তা সে নিজেও টের পেল না।
তিন
যুক্তরাজ্য ইংল্যান্ড ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ। এ শহরটা প্রায় ছবির মত সুন্দর। এখানে সচরাচর বাঙালী বসবাস করতে পারে না। লিভিং এক্সপেন্স তুলনামূলক বেশি। তাই কার্ডিফে বসবাসকারী ভিনদেশী পরিবারগুলোকে বেশ সৌখিন পরিবার বলা যায়।
আর সেখানে যদি বাঙালী পরিবার বসবাস করে তাহলে তাদের সৌখিন বলার আগে সাহসী সৌখিন বলা ভালো। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ জানে বাঙালী পরিবারগুলো অল্প কিছু টাকা বাঁচানোর জন্য কি পরিমাণ অমানবিক কাজ করে।
প্রিয়জনের কদর তাদের কাছে সব সময় আলাদা। প্রিয়জনের মুখে একটু হাসি ফুটানোর জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে তারা রাজি। মিসেস রেহনুমা কামালও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি কার্ডিফ আছেন দেড় যুগ ধরে।
তবে এই দেড় যুগে শেষ কবে বাংলাদেশ যোগাযোগ করেছেন তা ভুলে গিয়েছেন। এখানে তার পরিবার বলতে গেলে স্বামী আর বারো বছর বয়সী এক ছেলে নিয়ে গঠিত। তবুও মাঝে মাঝে তার দেশের কথা মনে পড়ে। বুকটা চিনচিন করে।
তখন তার স্বামী ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। আজও যখন তার দেশের কথা মনে পড়ল তখন কার্ডিফে গভীর রাত। পেশাদার কাজকর্ম শেষ করে সবাই ঘুমের জন্য তৈরি। ঘুমাতে পারছেন না শুধু মিসেস রেহনুমা কামাল।
তার স্বামী ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বিছানায় গিয়ে আলতো করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মন খারাপ?
রেহনুমা কামাল কোন শব্দ না করে চুপচাপ শুয়ে রইলেন। তার স্বামী তাকে আরেকটু কাছে টেনে ঘাড়ে মুখ ঠেকিয়ে বলল, কি হয়েছে?
কিছু না। তাহলে চুপ কেন? কথা বলছি তো। এই চুপের কথা বলছি না। কোন চুপের কথা বলছ? চুমু দিলাম তবুও রেসপন্স পাচ্ছি না কেন। মন খারাপ? আমার সময় লাগে তুমি জান। সেটা জানি। তবে সত্যটা হল তোমার দেশের কথা মনে পড়েছে।
জানলে আবার জানতে চাও কেন? আমিওতো বুঝতে পারি না বারবার কেন দেশের কথা মনে কর তুমি?
অত না বুঝে নিজের কাজে মন দাও।
খালি মাঠে গোল দিতে মজা লাগে না।
এবার রেহনুমা কামাল তার স্বামীর দিকে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথার চুলগুলো দুই হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে লম্বা লিপ কিস করে বলল, এবার প্রতিপক্ষ পেয়েছ মাঠে? খুশিতো?
তার স্বামী মুচকি হেসে বলল, দারুণ খুশি। তবে আমি আশা করব তুমি মনমরা হয়ে থাকবে না।
আমার অংশে আমি ঠিক থাকলেই হয়। ঠিকমত পাসিং, রিসিভিং, ড্রিবলিং, কাউন্টার এটাক করলেই হল। এর চাইতে বেশি আর কি চাই তোমার?
যৌবন কাল থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত প্রায় একই পরীক্ষা নিয়ে আসছ। তুমি। কেন বলত? তুমি জানো না তোমার শরীর অপেক্ষা মনের প্রাধান্য আমি সব সময় দিয়ে এসেছি।
জানি।
তবুও কেন এমন কর?
মাঝেমাঝে যে খুব মনে পড়ে।
কেন? এতকাল পরেও কেন মনে পড়বে?
জানি না।
আমি কি কিছুর অভাবে রেখেছি তোমাকে?
না।
তবে?
আমি জানি না।
রেহনুমা…
বল।
ছাড় আমাকে। ভালো লাগছে না।
রানিং রাউন্ড শেষ করবে না?
না। কখনোই না।
স্বামীর মুখে না বোধক শব্দ শুনে রেহনুমা কামাল তাকে ছেড়ে দিলেন। দুটি মানবদেহ বিছানায় দু প্রান্তে চলে গেল মুহূর্তে। মনে হল যেন পৃথিবীর দু-প্রান্তে দুজনে আছেন। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ থাকার পর রেহনুমা কামালই প্রথমে বললেন, কেন এমন কর তুমি?
তার স্বামী কিছুটা রেগে গিয়ে বলল, কি করি আমি? সব দোষ আমার? তোমাকে সুখী দেখতে চাই এটা আমার অপরাধ?
না।
তবে?
শুধু তুমি কেন?
ভালোবাসি বলে।
আর কেউ বাসেনা কেন? সেটা তাদের ব্যাপার।
জানো আমি খুব ক্লান্ত অনুভব করি।
কেন?
বুঝতে পারছি না।
কেমন লাগে তোমার?
সব কিছু শূন্য শূন্য লাগে।
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না।
আমিও জানি। কিন্তু কেন যে এমন হচ্ছে। কত ভালো আছি আমরা।
আমারও তো এক কথা। আমরা এখানে যথেষ্ট সুখী আছি। তবুও কেন তুমি কষ্ট পাবে?
কিছু কষ্ট তো থাকেই মানুষের। পিছু ছাড়তে চায় না।
পিছু ছাড়তে চায় না, নাকি মানুষই ইচ্ছে করে ছাড়াতে চায় না?
মানে?
মানে আবার কি?
বুঝিয়ে বল।
বুঝিয়ে বলার কি আছে। নিজেকে দিয়ে দেখ। নিজেই বল ভালো আছ। আবার অযথাই দেশের কথা মনে করছ।
ভুলতে পারি না যে?
দেড় যুগ.. দেড় যুগেও তুমি কেন ভুলতে পারবে না? প্রতিবার কেন তোমার মনে পড়বে? এত কষ্ট পাবে কেন?
আমি তো ইচ্ছে করে এমন করি না।
কিছু একটা কারণ তো আছেই।
হয়তো।
কি সেটা?
জানি না। তুমি জান?
না জানলেও কিছুটা অনুমান করতে পারি।
শুনি তোমার অনুমান।
প্রথম সবকিছু তোমাকে টানে তাই না?
উহু।
তবে?
সেগুলো পিছনে ফেলেই এসেছি। তা তো ভালো করে জান।
প্রথম আবেগ, প্রথম স্পর্শ কত প্রথমের গল্প সব ভুলে গিয়েছ?
হ্যাঁ।
তবে এত কষ্ট কিসের তোমার?
না, আমার কোন কষ্ট নেই। এস আমার কাছে এস।
রেহনুমা কামাল এর কথা শুনে তার স্বামী তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, তুমি নাকি একবার দেশে যাবে?
জানি না।
জান কি তুমি?
তোমাকে জানি। অনেক ভালোবাস এটা জানি। এখন আমার কাছে আসবে এটা জানি। আর একটাও কথা হবে না এটা জানি। অতঃপর আরেকটা সুন্দর সকালে আমাদের ঘুম ভাঙবে এটা জানি।
ছুটির দিনে মৌনতা প্রায় সময় বেলা করে ঘুম থেকে উঠে। আজ তার ব্যতিক্রম। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গীটার নিয়ে প্রাকটিস করতে বসেছে। তার নবীন হাতে গীটার তেমন ছন্দে না বাজলেও বেসুরো নয়েজ হচ্ছে খুব।
তবুও মিতিল আহমেদ বা শাশুড়ি ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। মাঝে মাঝে এটা সেটা লাগলে মৌনতা চেচিয়ে বলে দিয়ে যেতে। তখন মিতিল আহমেদ বা তার শাশুড়ি দিয়ে যান। এই মুহূর্তে মৌনতার আর কিছু প্রয়োজন নাই। প্রাকটিস প্রায় শেষের পথে।
তবুও দাদীকে তার কাছে আসতে দেখে সে ভ্রু কুচকে তাকালো। দাদী তার চোখের ভাষা বুঝতে পেরে বলল, তোর ফোন বাজছে।
কে করেছে?
জানি না তো।
আচ্ছা দাও দেখছি।
দাদীর হাত থেকে ফোন নিয়ে মৌনতা দেখল তার ফোনে একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন এসেছে। তার ফোন নম্বর অবশ্য খুব একটা কেউ জানে না। তাই সে ভেবে পেল না কে ফোন করল। মনে অনেক প্রশ্ন নিয়ে সে ফোন রিসিভ করে বলল, হ্যালো।
ওপর প্রান্ত থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠ ভেসে আসল। সে কণ্ঠটা বলল, হ্যালো মৌনতা।
জ্বি বলছি। কে বলছেন প্লিজ?
বলতো আমি কে?
বুঝতে পারছি না তো।
আহা, একটু চেষ্টা করো না।
পারছি না। আপনি বলে দেন কে।
আরে তুই আমাকে আপনি আপনি করছিস কেন? আচ্ছা যা তোকে একটা ক্লু দেই। আমি তোর এক দোস্ত।
দোস্ত?
হ্যাঁ রে। এত তাড়াতাড়ি আমাকে ভুলে গেলি? অবিশ্বাস্য।
সরি….
এখনো চিনতে পারছিস না। আজব। আরে আমি ইরা। ইরা। তুই কোথা থেকে। এতদিন পর। এটা কার নম্বর?
আগের ফোনটা হারিয়ে গেছেরে। এটা নতুন নিয়েছি। ভাবলাম তোকে একটা ফোন দেই। তোর ঘুমটা ভাঙাই।
খুব ভালো করেছিস দোস্ত। কিন্তু এখন তো আর আমি সকালে ঘুমাই না।
কেন?
ফিংগারিং করতে হয় যে।
মানে?
হ্যাঁরে।
প্রতিদিন করিস নাকি?
হ্যাঁ। প্রতিদিন সকালে।
কি বলিস? প্রতিদিন সকালে?
হ্যাঁ।
আর ইউ ক্রেইজি?
নো বেইবি। ক্রেইজি হব কেন?
ক্রেইজি না হলে কি? হাত ব্যথা করে না।
করেই তো। নতুন নতুন হলে হাত ব্যথা সবারই করে।
তাই বলে তুই প্রতিদিন করবি?
হ্যাঁ। প্রতিদিন প্রাকটিস না করলে শিখব কিভাবে?
এটা আবার প্রাকটিস করে শিখা লাগে? এটা কিভাবে করতে হয় তা সবাই জানে।
সবাই জানলে প্রাকটিস স্কুল খুলত নাকি? তিনমাসে ফিংগারিং ক্লিয়ার হলে সং কভার করতে পারব।
কিসের সং? আজকাল বুঝি ব্লু দেখে খুব হর্নি হয়ে থাকিস?
এই ইরা। তুই এগুলো কি বলছিস? তুই কি ভেবেছিলি? ছিঃ। আমি তো গীটারের কথা বলছি।
মানে?
মানে আবার কি? আমি কি তোর মত খাচ্চোর নাকি। ছিঃ।
মৌনতার কথা শুনে ইরা হাসতে হাসতে বলল, এই বয়সে সবাই কমবেশি খাচ্চোর থাকে।
ইরার কথার প্রতিবাদ করে মৌনতা সাথে সাথেই বলল, সবাই না। কেউ কেউ। বাদ দে। তোর কথা বল।
আমার আর কি কথা।
কেমন আছিস? আমাদের কথা মনে পড়ে না?
পড়ে না আবার। তোদের খুব মিস করি দোস্ত। বাইরের লাইফ খুব কষ্টের।
এখন বুঝ মজা। আগে তোকে নিষেধ করেছিলাম না?
হ্যাঁ করেছিলি। তবুও ভাবলাম অনেকে তো যায়। ক্যারিয়ার গড়ে। তা ঠিক। আচ্ছা তোর পড়ার কি খবর?
আর বলিস না। এই সেমিস্টারে এক্সট্রা খরচ যোগাতে জব নিতে হয়েছিল। তার ইমপ্যাক্ট তো রেজাল্ট এ পড়েছে। আমি খুব খারাপ রেজাল্ট করেছি।
থাক মন খারাপ করিস না। রিটেক দিবি।
নারে। আমেরিকার সিস্টেম আমাদের দেশের মত নয়। এখানে রিটেক দিতে পারব না। রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণে ওরা আমার স্টুডেন্ট এইড বাদ করে দিতে পারে।
বলিস কি?
হ্যাঁ দোস্ত। খুব চাপে আছি রে।
তবে ব্যাক কর দেশে। এত কষ্ট করে থাকার দরকার কি। আছে রে। মজা আছে। তুই বুঝবি না। বুঝলে তো তুইও এখানে চলে আসতি।
কি মজা বল?
প্রথম কথা হল এখানে সবকিছু কত সিকিউর। আমি আমার ইচ্ছেমত চলতে পারি। কেউ কিছু বলার নেই। স্বাধীন। মুক্ত আমি।
ও। শুধু এ কারণে তুই আমেরিকা বেছে নিলি যে কেউ তোকে কিছু বলতে পারবে না?
যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাকে খুশি তাকে চুমু খেতে পারবি। ইচ্ছে হলে আরোঁ বেশি কিছু করতে পারবি।
কথাটা ভুল বলিস নি। উন্নত দেশে সেক্স তো উপভোগের বিষয়। আমাদের দেশের মত কোন লজ্জার বিষয় নয়।
এখানে সবাই ক্যাজুয়াল সেক্সে অভ্যস্ত। পার্ক, রাস্তা, বাসে, ট্রেনে মানুষজন একে অন্যকে চুমু খেতে পারে। তবে জোর করে নয়। সঙ্গী রাজি থাকতে হবে। সঙ্গী রাজি থাকলে যেকোন কিছু করা যায়।
উন্নত দেশের কালচার সম্পর্কে লম্বা লেকচার শুনে মৌনতা বলল, বুঝলাম দোস্ত। তোর কাছে ফ্রিডমই সব। এই ফ্রিডম এর জন্য তুই যেকোন কিছু করতে রাজি আছিস।
হ্যাঁ একদম ঠিক। তবে এখানে পরে থাকার আরো কিছু কারণ আছে। জীবন উপভোগের পাশাপাশি নিজের ক্যারিয়ারও তো গড়তে
হবে।
ঠিক। আচ্ছা দোস্ত তোর এবং তোর ক্যারিয়ারের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইল।
থ্যাংকস। এবার তোর কথা বল কিছু শুনি।
দোস্ত আরেকদিন বলব। এখন যে একটু কাজ আছে।
আচ্ছা তবে বাই। টেইক কেয়ার।
ইউ টু।
কথা শেষ হওয়ার পর মৌনতা বিরক্ত হয়ে ফোনটা ছুড়ে মারল। এমনিতেই সে প্রবাসীদের দেখতে পারে না। তার উপর এমন কাছের একটা বান্ধবী প্রবাসে গিয়ে কেমন হয়ে গেছে। সে ইচ্ছে করে তাকে এড়িয়ে গিয়ে ফোন রেখে দিয়েছে।
ইরার সাথে কথা বলার সময় তার দাদী সামনে ছিল না। কথা শেষ হওয়ার পর তিনি হুট করে দেখলেন মৌনতা মন খারাপ করে বসে আছে। তাই তিনি কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, ও ম্যাডাম। কি হয়েছে আপনার? মন খারাপ নাকি।
দাদীর দুষ্টুমি মাখা কথা শুনেও মৌনতা চুপ করে বসে থাকল। তার দাদী আবারও বলল, বল না কি হয়েছে। আমাকে বল। নাকি মাকে ডাকব?
মাকে ডাকার কথা শুনে মৌনতা জোর গলায় বলে উঠল, মাকে ডাকতে হবে না। একশটা প্রশ্ন করবে এসে।
তাহলে আমাকে বল। মন খারাপ কেন?
মন খারাপ না দিদুন। বিরক্ত আমি।
কেন?
ইরা ফোন করেছিল।
আমেরিকা থেকে? কেমন আছে ও?
ভালো।
ইরা ফোন করায় তুই বিরক্ত হবি কেন?
জানি না।
বোকাটা। দিদুনের কাছে আয়। মৌনতা দাদীর ডাক শুনেও তার জায়গা থেকে নড়ে না। শেষে দাদীই একটু এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বোকাটা। মানুষ যা খুশি করবে তাতে তোর কি? আমি জানি তুই প্রবাসীদের সহ্য করতে পারিস না।
তবুও বল তোর মত কয়জন ভাবে? এই দেশ, মাটি, আলো বাতাস খেয়ে বড় হওয়া মানুষেরা প্রবাসে কখনো স্বেচ্ছায় যায় না। গেলেও তাদের সংখ্যা কম। বেশিরভাগ কোন না কোন কারণে যায়। এখন আর মন খারাপ করে থাকবি না। বাবা মা শুনলে কিন্তু কষ্ট পাবে।
অন্য কারো ভাবনা নিয়ে নিজে বিরক্ত হয়ে থাকার কোন যুক্তি নেই। আয় নাশতা খাব। মা আজ আলু পরোটা বানিয়েছে।
আলু পরোটার কথা শুনে মৌনতার মনটা মুহূর্তে ভালো হয়ে গেল। সে সাথে সাথে উঠে গিয়ে দাদীকে টানতে টানতে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গেল।
সেখানে আগে থেকে মিতিল আহমেদ নাশতা সাজিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। মৌনতা ও তার দাদী যাওয়ার পর তারা সবাই খাওয়া শুরু করল।
বড় রাস্তার মোরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তারিফের পা ব্যথা হয়ে গেল। সে দাঁড়িয়ে আছে মৌনতার জন্য। মৌনতা এই আসি। আসছি। আর পাঁচ মিনিট বলে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেল। তারিফের সাথে মৌনতার সখ্যতা হয়েছে গীটার নিয়ে।
কোনদিনও এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। তবুও কেমন করে যেন তাদের মাঝে গীটার নিয়ে একটা অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছে। যদিও ভয়াবহ ঝগড়া হয়। তবুও বেশ উপভোগ্য। তারিফ এখন মৌনতাকে তুমি করে বলে।
মৌনতা অবশ্য আপনি করেই বলে এখনও। ব্যাপারটা খুলে বলা দরকার। তারিফ গীটার খুব ভালোবাসে। মৌনতাও তাই। আর কিছু মিল থাক বা না থাক দুজনের একটা শখের জায়গা অন্তত এক হয়েছে।
তারিফ অবশ্য কিশোর বয়স থেকে ব্যান্ড দল করে এসেছে। এখন সে একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে ভালো স্যালারির জব করে। পাশাপাশি এলাকায় যারা গীটার শিখতে চায় তাদের টিউশন করায়।
মৌনতা গীটার কিনার পর থেকে বলতে গেলে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। টিউটোরিয়াল দেখে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করেছে ঠিক ই। কিন্তু ব্যবহারিক একদমই পারছিল না। শেষে বাধ্য হয়ে তারিফের শরণাপন্ন হয়েছিল।
তবে শর্ত দিয়েছিল অন্য স্টুডেন্টদের মত ব্যাচে শিখতে পারবে না। তাকে আলাদা শিখাতে হবে। তারিফ আর না করেনি। সে মৌনতার জন্য সব স্টুডেন্ট ছেড়ে দিতে রাজি। যদিও ব্যাপারটা মৌনতা এখনও আঁচ করতে পারেনি।
আঁচ করলে কি ঘটনা ঘটায় তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এই যেমন এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছে তার আসার কোন নাম নেই। আজ মৌনতা সং কভার করা শিখেছে। এ জন্য তারিফ চকোলেট খাওয়াবে বলেছে।
বড় রাস্তার মোরে দুজনে দেখা করার কথা অনেক আগে থেকেই ঠিক করা। এ জন্যই তারিফ অপেক্ষা করছে।
পাক্কা দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পর মৌনতা এল। তারিফ ভেবে পেল না মেজাজ ঠান্ডা করে কি করে কথা বলবে।
তবুও সে যথাসাধ্য নিচু গলায় বলার চেষ্টা করল, এত দেরি করলে যে?
মৌনতা প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আর বলবেন না। আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
কি ভুলে গিয়েছিলে?
এখানে আসার কথা।
মানে কি?
বললামই তো।
একটা মানুষ এতটা কেয়ারলেস হতে পারে?
আরে কি আশ্চর্য আপনি রাগ দেখাচ্ছেন কেন?
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর রাগ করাটা স্বাভাবিক না?
না।
কোন যুক্তিতে?
ছেলেদের কাজই হল আগে থেকে অপেক্ষা করা। নাকে দড়ি নিয়ে ঘুরা।
আমি কি সেই ধরনের ছেলে?
না হলে কি ধোঁয়া তুলসী পাতা?
এই কি বলতে চাও তুমি? আমরা তো প্রেম করছি না। তুমি আমাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরানোর কথা বলছ কেন?
ছেলেরা প্রেম করুক আর না করুক ওদের কাজই হল নিয়মিত
ফোন দেয়া, অপেক্ষা করা, অল্পতে ইমোশনাল হওয়া।
বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু।
আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাই।
ও তার মানে তুমি চলে যাওয়ার জন্য এমন ঝগড়া শুরু করেছ?
চুপ থাকুন প্লিজ। আপনি বলুন যে আজ খাওয়াতে চান না তাই এমন নাটক শুরু করেছেন।
আমি খাওয়াতে চাই না! আমি নাটক করছি?
তা নয়তো কি?
দুই ঘন্টা অপেক্ষা করার পরেও এমন অপবাদ দিলে?
আরে বারবার শুধু বলে দুই ঘন্টা। মনে হয় যেন রাজ্য জয় করে ফেলেছে। একটু আধটু অপেক্ষা করলে এমন কি হয়?
তোমার এত দেরি হল কেন?
বললাম তো ভুলে গিয়েছিলাম। তারপর যখন মনে পড়ল তখন আম্মুকে বলে বেরুনোর সময় দেখি মিঃ বব অসুস্থ। পরে ওর ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে আলাপ করে তারপর এসেছি।
হারামি কুত্তাটা দেখি আমার লাইফ হেল করে দিবে।
এই মিঃ ববকে নিয়ে বাজে কথা বললে কিন্তু আমি সত্যি সত্যি চলে যাব।
আচ্ছা যাও বলব না। তাহলে থাকবে তো?
হ্যাঁ।
থ্যাংকস। চল কোথাও বসি।
না আমরা হাঁটব।
আচ্ছা তোমার যা ইচ্ছা।
আপনি চকোলেট নিয়ে আসুন।
আচ্ছা।
মৌনতার কথামত তারিফ চকোলেট নিয়ে ফিরে এসে দেখল সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কি যেন দেখছে। তারিফ মৌনতার দৃষ্টি অনুসরন করে দেখতে পেল একটা মহিলা তার ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বাচ্চাটার পুরো শরীর তোয়ালে দিয়ে মোড়ানো। তোয়ালের ফাঁক দিয়ে ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত পা দেখা যাচ্ছে। কি অসাধারণ একটা দৃশ্য। মায়ের কোলে ছোট বাচ্চা। তারিফ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টের পেতেই মৌনতা বলল, দেখেছেন কি সুন্দর বাবু?
তারিফ বলল, দেখেছি তো। বাবুর মাও সুন্দর। কি সুন্দর করে শাড়ি পরেছে।
বাবুর মাকে দেখতে বলিনি। বাবুকে দেখতে বলেছি।
হ্যাঁ আমি দেখছি তো। তবে শাড়ি পরলে কিন্তু সব মেয়েদের সুন্দর লাগে না। এই মহিলাকে লাগছে।
হয়তো।
আবার সবাই শাড়ি পরতেও জানে না। ঠিক। আপনি কিভাবে জানলেন?
দেখলেই বুঝা যায়। আচ্ছা তুমি শাড়ি পরতে জান?
না।
শিখবে না?
কখনো না। খুব ভেজাল লাগে। বিয়ের পর পরবে কি তাহলে?
এখন যা পরি তা। কেন বিয়ের পর কি শাড়ি পরা বাধ্যতামূলক? না মানে তা নয়। কিন্তু…
কোন কিন্তু নেই। আমি যাকে বিয়ে করব সে আমার লাইফ স্টাইল জেনেই করবে। আর যদি আমার চলাফেরায় কোন আপত্তি থাকে তবে আমি বিয়েই করব না।
আচ্ছা বাবা। সময়ই কথা বলবে।
ঠিক। এই দেখেন না বাবুর মায়ের দিকে কে যেন এগিয়ে আসছে।
চল এগিয়ে গিয়ে দেখি কি হয়।
চলেন।
দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটার দিকে তারিফ ও মৌনতা নেহায়েৎ কৌতূহল বশে এগিয়ে গেল। গিয়ে তারা দেখতে পেল একটা পুরুষ লোক হাতে কয়েকটা চকোলেট নিয়ে মহিলাটার হাতে দিল। মহিলাটা চকোলেট গুনে গুনে মিলিয়ে দেখার পর লোকটা বলল, এবার তো আমার বাচ্চাটা দাও।
উফ কি ভয়ংকর তুমি। সামান্য চকোলেট খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলে না। আমার ছোট্ট বাচ্চাটা নিয়ে এই ধুলোবালির রাস্তায় এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে! দাও তাড়াতাড়ি।
লোকটার এত তাড়াহুড়ো শুনেও মহিলাটার তেমন কোন ভাবান্তর হলো না। সে খুব রিলাক্সে তোয়ালে মোড়ানো বাচ্চাটাকে তার স্বামীর কোলে দিল। বাচ্চার বাবা বাচ্চাকে কোলে নেয়ার সময় একটু কেঁদে উঠল। তখন মুখ দিয়ে বিভিন্ন অদ্ভুত শব্দ বের করতে করতে বাচ্চার বাবা বলল, ও ও বাবা কাঁদে কেন?
মামনী পচা তাই না বাবা? কষ্ট দিয়েছে তোমাকে? এইতো বাবা এসে গেছি। আর কোন ভয় নেই।
এখন আমরা বাসায় যাব। চল চল চল। হুররে। স্মাইল। স্মাইল। এইতো আমার লক্ষ্মী বাচ্চা।
তারিফ ও মৌনতা দেখতে পেল বাচ্চাটা সত্যি সত্যি হাসছে। আর বাচ্চার মা তখন তার স্বামীর বাম হাতের কনুই পেচিয়ে ধরে বুকের একপাশে মাথা এলিয়ে দিয়ে হাঁটছে। লোকটা কয়েকবার তাকে জোর করে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল।
কিন্তু মহিলাটা কোন তোয়াক্কা না করেই আরো শক্ত করে পেচিয়ে ধরে হাঁটতে লাগল। এভাবে হাঁটতে
হাঁটতে তারা তারিফ ও মৌনতার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল।
লোকটা এবং তার স্ত্রী দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাবার পর তারিফ আবিষ্কার করল মৌনতা তারিফের বাম কনুই ধরে রেখেছে শক্ত করে। বিষয়টা দেখার পর তার গা হাত পা একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল। প্রথম অনুভূতিগুলো হয়তো এমনই হয়।
মৌনতার ঘোর এখনো কাটেনি। সে টের পেল আরও কিছুক্ষণ পর। তার চোখে মুখে অন্যরকম মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তারিফের কনুই ধরে রেখেছে এটা টের পেতেই সাথে সাথে ছেড়ে দিয়ে বলল, সরি। কখন যে আপনার হাত ধরে ফেলেছি বুঝতে পারিনি।
ইটস ওকে। হাত ধরাতে কি হল?
না মানে… ইয়ে।
মৌনতা লজ্জা পেয়ে আমতা আমতা করতে লাগল। তারিফ বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ ঘুরাতে বলল, ইস জীবন কি সুন্দর তাই না?
হ্যাঁ।
একটা ছোট্ট সংসার আর এত সুখ?
কেমন করে সম্ভব বলতে পার? জানি না।
বেবিটা কি সুইট দেখেছ?
আমিই তো আগে দেখেছি।
ওহ হ্যাঁ। ঠিক তো।
আচ্ছা বেবিটা কি মেয়ে বেবি ছিল নাকি ছেলে বেবি?
মেয়ে হয়তো।
কিভাবে বুঝলে?
অনুমান করলাম।
ইস জানো মৌনতা…
কি? বলেন।
এই বেবিটা যদি আমার হত!
কি করতেন?
সারাক্ষণ আদর করতাম বাসায়। জীবনেও এত ছোট বাচ্চা নিয়ে রাস্তায় বেরুতাম না।
কেন?
ধুলোবালিতে অনেক জীবাণু থাকে তো।
তাই বলে প্রয়োজনে বের হতেন না?
কি প্রয়োজন?
কত প্রয়োজন থাকে।
যেমন দুই একটা বল।
ধরুন বেবির জন্য শপিং করা। তারপর ডাক্তার দেখানো। টিকা দেয়া।
বেবির শপিং আমার আম্মু করে দিত। আর ডাক্তার বাসায় নিয়ে
আসতাম। টিকাও।
ইস বললেই হল।
হ্যাঁ হল।
পাগল একটা। এভাবে হয় না। বেবি নিয়ে বের হতেই হত।
হলে হতাম। কিন্তু বেবির আম্মুকে জীবনেও এভাবে একা দাড় করিয়ে চকোলেট কিনতে যেতাম না।
বেবির আম্মু খেতে চাইলে?
জীবনেও দিতাম না।
আমি হলে ঘাড় ধরে কিনাতাম।
কার?
আপনার।
অসম্ভব ব্যাপার।
একশ বার সম্ভব। প্রতিদিন বের হতাম। বেবিকে নিয়ে ঘুরতে।
কেনাকাটা করতে।
না। না। জীবনেও না।
হ্যাঁ। হ্যাঁ।
আমি মানিনা।
মানতে হবে।
পারব না। তবে তুমি আমার বউ হলে মন্দ হতো না।
যাহ অসভ্য।
কেন?
জানি না। যাহ।
মৌনতার এমন ধরাশায়ী অবস্থা দেখে তারিফ হাসতে লাগল। তারিফ হাসতে শুরু করার সাথে সাথে সে তারিফের উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইল। চোখের সামনে মহিলা, তার স্বামী আর বাচ্চার কাহিনী দেখতে দেখতে মৌনতা ঘোরের জগতে চলে গিয়েছিল।
সেখান থেকে ফিরে এসে দেখতে পেল ভালোবাসার মিষ্টি আবেশ তাকে ঘিরে ধরেছে। চাইলেও সে আর আবেশ থেকে ছুটতে পারছে না। এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। এখান থেকে যাওয়া দরকার। কিন্তু সত্যি বলতে তার যেতেও ইচ্ছে করছে না।
সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পরায় আর কোন কথা না বলে চুপ করে রইল। নীরবতা ভাঙল তারিফ। সে বলল, এই শোন পাত্র হিসেবে কিন্তু আমি একেবারে খারাপ হব না।
একদম চুপ।
আরে এত লজ্জা পাচ্ছ কেন?
আমি লজ্জা পাচ্ছিনা।
তাহলে?
চুপ করেন আপনি।
বাসায় নিয়ে যাবে?
চকোলেট খাচ্ছ না যে? খাব না। না ড্রেনে ফেলে দিব। কেন? আমার ইচ্ছা। সব কিছু কি তোমার ইচ্ছায় হবে? হ্যাঁ। আমার পৃথিবী। আমার স্বাধীনতা। ঠিক আছে তাই হোক।
আপনি কি সিগারেট খান? নাতো। মিথ্যে বললে কিন্তু ঠোঁট কেটে দিব। সত্যি খাই না। কোনদিন খাননি? আর এখন? একদমই না। সত্যি তো? হ্যাঁ। হুট করে সিগারেটের কথা কেন? সব কথা কি আপনার জানতে হবে?
কলেজ লাইফে এক দুদিন।
হ্যাঁ হবে।
না হবে না। আমি যা বলি তাই হবে সব সময়। বুঝতে পারলেন? পারলাম। কিন্তু আমাকে এখনো আপনি করে বলছ কেন? যাহ অসভ্য। শুধু পচা কথা বলে। কই পচা কথা বললাম? আমি আপনাকে তুমি করে বলব কেন? আপনি আমার বড় না?
ওরে আল্লাহ। আমি কই যাব এই মেয়েকে নিয়ে? কোথাও যেতে হবে না। এখন আমি বাসায় যাব। আরেকটু থাকো না। না। না বলেছি তো। থাকলে কি হয়? আম্মু বকা দিবে। ধ্যাত। আমি যাচ্ছি। বাই। যাও। বাই বলবেন না? না। তুমি যাও।
প্লিজ।
আচ্ছা।
তারিফ বাই না বললেও মৌনতা চলে গেল। তার মনটা কেমন করছে। ছেলেগুলো প্রায় বুদ্ধ হয়। মেয়েদের মত অনেক না বলা কথা তারা ইশারায় বুঝে নিতে পারে না। বুঝতে পারলে আজ হয়তো তারিফ মন খারাপ না করে আনন্দে নাচতে নাচতে বাসায় যেত।
চার
তারিফের সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে মৌনতার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। ব্যপারটা একটু একটু করে টের পেতে শুরু করেছেন মিতিল আহমেদ। হাজার হোক এ বয়সটা তো তিনি নিজেও পার করে এসেছেন। শুধু নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলতে চাচ্ছেন না মৌনতাকে।
এতে করে হিতে বিপরীত হতে পারে। উঠতি বয়সে সন্তানদের কোন ভুল চলাফেরা চোখে পড়লে বাবা মায়ের একটু সহনশীল আচরণ করা উচিত। এ জন্যই মিতিল আহমেদ এখনো চুপ করে আছেন।
তবে তিনি চুপ করে থাকলেও বিষয়টা সারাক্ষণ তার মনের ভিতর ঘুরপাক খায়। মাঝে মাঝে মৌনতাকে নিয়ে তিনি নিজেই চিন্তায় ঢুবে যান। বেনজীর আহমেদও একরাতে বিষয়টা লক্ষ্য করলেন। লক্ষ্য করার সাথে সাথেই তিনি পাশে শুয়ে থাকা মিতিল আহমেদকে বললেন, এই যে ম্যাডাম এত কি চিন্তা করেন?
মিতিল আহমেদ তার দিকে না ফিরেই উত্তর দিলেন, না। কিছু না। আরে আমার কাছে লুকাচ্ছ কেন?
লুকাচ্ছি না।
তাহলে বল কি চিন্তা করছ।
আমাদের কথা চিন্তা করছি।
আমাদের কি কথা? আমরা তো বেশ আছি।
তবুও ভয় লাগে যে।
ধুর। কিসের ভয়।
জানি না।
তুমি এসব আজগুবি চিন্তা বাদ দাও তো।
আচ্ছা। তবে একটা কথা..
কি কথা?
আমাদের মৌনতা আজকাল কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।
কেমন হচ্ছে?
আরে ইয়াং এইজে যে টাইপ হয়। ও তো এমনিতেই চঞ্চল।
চঞ্চল তো সমস্যা না। একটু লক্ষ্য করে দেখ কিছুদিন হয় আমাদের মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছে।
বুঝিনি। কেমন শান্ত?
তুমি দেখ গীটার কিনে দেয়ার পর থেকে ও আর নতুন কি কি কেনাকাটা করেছে? অথচ ছোট বেলা থেকে ওর অভ্যাস প্রতি সপ্তাহে কিছু না কিছু কেনাকাটা করা।
তা অবশ্য ঠিক বলেছ। কিন্তু এখন তো আমাদের মেয়েটা বড় হচ্ছে। হয়তো বুঝ জ্ঞান আসছে ওর মধ্যে। তাছাড়া গীটার বাজিয়ে গান শিখতেও তো প্রচুর ধৈর্য আর অধ্যবসায়ের দরকার।
তুমি আসলে কচুর পুলিশ হয়েছ। কিছুই বুঝতে পার না। আন্দাজে। ধ্যাত। বিরক্তিকর।
আরে বাবা খুলে বল। সারাদিনই তো আমার সাথে রাগারাগি কর। এখন বিছানায় এসেও রাগ করবে?
করবই তো। মেয়েটার বেসিক সমস্যাটা বুঝতে পারছ না কেন?
আমি তো তোমার মত করে ওকে নিয়ে ভাবার সময় পাই না।
স্যারেন্ডার করছ?
জ্বি ম্যাম। এবার খুলে বলেন আমাকে।
আমার মনে হয় আমাদের মেয়ে কারো প্রেমে পড়েছে।
মিতিল আহমেদের কথা শেষ হতে না হতেই বেনজীর আহমেদ বিছানায় প্রায় লাফ দিয়ে উঠে বসলেন। তারপর এক নাগাড়ে বলতে থাকলেন, কি বলছ এসব? ছেলেটা কে? কি করে? কোথায় থাকে? ওর বাবা কি করে?
এত হাইপার হচ্ছ কেন? এসব কিছুই জানি না। তুমি শান্ত হয়ে বস। আমি জানলে তো সব বলব। কিভাবে শান্ত হব? আমাদের মেয়েটা কোন ভুল করছে না তো?
সেটা আমি দেখব। এই কেইস আমার হাতে।
বাহ এই না হলে পুলিশের বউ।
কেন?
এই যে কেমন করে তদন্তে নেমে গেলে। শুধু নামিই নি। অগ্রগতিও আছে। সময়মত প্রতিবেদন দিব। এখনি বল না।
না।
কেন?
আমাদের মেয়ে এখন পর্যন্ত কোন রিলেশনে জড়ায় নি। জড়ালে আমি জানতাম। ও হয়তো ভাবছে। স্রেফ এইটুকুই। তবুও আমি চোখে চোখে রাখব।
ঠিক আছে। তুমি থাকতে আমার কোন চিন্তা নেই। থাক থাক হয়েছে। আর ফুলাতে হবে না। ফুলাচ্ছি না। একটা জিনিস ভাব। দেখতে দেখতে আমাদের পুচকি টা বড় হয়ে গেল, তাই না?
হ্যাঁ।
ওকে কত কষ্ট করে বড় করেছ তুমি। এ ঋণ কি কোনদিন শোধ করার যোগ্য?
ধ্যাত। এসব কি বল? মায়ের কাছে সন্তানের কিসের ঋণ?
ওর না থাকলেও আমার কিন্তু অনেক ঋণ তোমার কাছে।
চুপ থাক। কি বলতে এসে কি বলা শুরু করলে?
আচ্ছা চুপ করলাম। এখন একটু আদর কর।
লজ্জা নেই তোমার?
বউয়ের কাছে কিসের লজ্জা?
জানি না।
আমাকে এত ভালোবাস কেন?
আবার সেই এক কথা! ঘুম নাই তোমার? না নাই।
বললেই হল? চোখ বন্ধ কর।
বউয়ের কথা মত চোখ বন্ধ করে বেনজীর আহমেদ চুপচাপ পড়ে রইলেন। মিতিল তার কাছে এসে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, তুমি ঘুমাও।
কোন চিন্তা করবে না। আমি সব সামলে নিব। তোমার মিতিল বেঁচে থাকতে তোমার সংসার নিয়ে একদম চিন্তা করতে হবে না।
বেনজীর আহমেদ চোখ বন্ধ রেখেই বললেন, মিতিল তুমি যখন এভাবে বল তখন আমার নিজের কাছে নিজেকে খুব অপরাধী লাগে।
কেন?
মনে হয় আমি তোমাকে ঠকাচ্ছি। ধ্যাত। বাজে কথা।
সত্যি মিতিল আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না। মৌনতাকে দিয়েছ। নিজেকে দিয়েছ। একটা সংসার দিয়েছ। আর কি দিতে চাও তুমি? আমি কি কিছু চেয়েছি?
তবুও…
তবুও আর কি? আমার নিজেরই তো আর কিছু চাই না। আমি আমার সংসার নিয়ে খুব হ্যাপি আছি।
সেই প্রথম থেকে তোমার এক কথা তাই না? হ্যাঁ এক কথা। এতে সমস্যা কি? জানি না। আমি শুধু তোমার হাসিমুখ দেখতে চাই। আর কিছু চাই না।
তবুও মিতিল.. তবুও আর কোন কথা নেই। এখন ঘুমাবে। একদম নড়াচড়া না করে ঘুমাও।
মিতিল আহমেদের এমন কড়া আদেশের পর তার স্বামী আর না ঘুমিয়ে থাকতে পারল না। বেচারা সারাদিন কত প্রেশারের কাজে
থাকে।
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়ার সুযোগই তো হয় না। স্বামী ঘুমানোর পর মিতিল আহমেদ নিজেও ঘুমিয়ে গেলেন।
মৌনতার যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রায় মধ্যরাত। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে ফোন হাতে নিয়ে সে দেখল রাত আড়াইটা বাজে।
এতরাতে কাউকে মনে পড়ার অর্থ কি তা সে জানে না। সে শুধু জানে এই মুহূর্তে তারিফকে খুব মিস করছে। কাউকে মিস করলে এত যন্ত্রণা হয় তা সে আগে বুঝেনি। এটা কেমন কথা। এই ছেলেটা যে কেন তার জীবনে এল।
এত বছরের সংযম, সাধনা সব তছনছ করে দিল। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করে মৌনতার খুব রাগ চেপে গেল। প্রচন্ড রাগ নিয়ে সে সাথে সাথে তারিফকে ফোন দিল।
এত রাতে মৌনতার ফোন পেয়ে তারিফ প্রায় চমকে উঠল। রাতে শোয়ার আগেও তো কথা হল। তাহলে এখন আবার কেন ফোন করল? কোন বিপদ হল নাকি? এসব নানান কথা ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করে তারিফ বলল, হ্যালো।
তারিফ ফোন রিসিভ করার সাথে মৌনতা রাগে ফেটে পড়ে বলল, কি হ্যালো? কি করেন আপনি?
তারিফ খুব শান্ত, স্বাভাবিক গলায় জবাব দিয়ে বলল, ঘুমাই।
কেন ঘুমান?
আরে বাবা মানুষ রাতে কেন ঘুমায়?
আমি কি জানি?
না। আমি ঘুমাই না। কি হয়েছে পাগলীটা?
তুমিও তো ঘুমাও। ঘুমাও না? জানি না। কোন প্রবলেম?
না।
আব্বু, আম্মু বকা দিয়েছে?
না।
তাহলে কি হয়েছে?
আমার ঘুম আসছে না।
কেন? একটা শয়তানের কথা মনে পড়ছে। কে সে? আপনাকে কেন বলব? এমনি বলবা। শুনব তাই। শুনতে চাইলেই কি সব বলা যায়? তা অবশ্য যায় না। তাহলে শুনতে চান কেন? থাক আর চাইব না। সরি।
ইহ.. আবার সরি বলা হচ্ছে! হুহ। আরে বাবা আমি কোনদিকে যাব? সরি বললেও দোষ। জানতে চাইলেও দোষ। দুনিয়ার সব দোষ কি এখন আমার? হ্যাঁ। আপনার সব দোষ।
পাগলীটা এমন করছ কেন?
কেমন করছি?
এই যে কেমন উথাল পাথাল। আচ্ছা, তোমার কি খারাপ লাগছে? না।
তবে কেমন লাগছে আমাকে বল? বল না। আমি ঠিক আছি।
না, তুমি ঠিক নেই। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি তোমার কিছু হয়েছে। রাতে যখন লাস্ট কথা বললাম তখনও তো ঠিক ছিলে। এখন এমন করছ কেন?
আমি কেমন করছি আন্দাজে? আমি শুধু বলেছি আমার ঘুম আসছে না। আমি কি আদর করে দিব? কি?
কিছু না।
না, আপনি বলেন কি বলেছিলেন?
আদর করে দেয়ার কথা বলেছিলাম।
পচা কথা বলতে নিষেধ করেছিলাম না?
হ্যাঁ। কিন্তু আদর কি পচা কথা?
হ্যাঁ।
আমি তো আজ চুমু দেয়ার কথা বলিনি।
চুপ। একদম চুপ। সাহস কত্ত!
আচ্ছা যাও চুপ করলাম। কিন্তু তুমি চাইলে আমি আমার আম্মুকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাতে পারি। পাঠাবো?
না।
কেন?
আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না তাই।
কেন?
আমার ইচ্ছে। আমি যে চাই। একবার ট্রাই তো করে দেখি অন্তত। না। কোন ট্রাই করতে হবে না।
কেন?
আমি আব্বু, আম্মুকে ছাড়া থাকতে পারব না। আব্বু, আম্মুকে না হয় আমাদের সাথে রাখব।
সম্ভব না।
তাহলে কি তুমি চাও আমি ঘরজামাই হই?
না। সেটাও সম্ভব না।
তাহলে?
আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করবেন। সিম্পল। না। মানি না। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। তারপর আমাদের বেবি হবে। বেবিকে তোমার আব্বু, আম্মু, আমার আব্বু, আম্মু খুব আদর করবে।
আর?
তুমি যা চাও তাই দিব।
ইস। কি মিথ্যা বলে।
সত্যি। একবার বিশ্বাস কর পাগলীটা।
না। পারব না।
উফফ..
কি?
তোমাকে নিয়ে আর পারি না।
এখনই বিরক্ত হয়ে যান। আবার বিয়ে করতে চান?
কিসের সাথে কি মিলাও তুমি? তোমার প্রতি বিরক্ত না তো আমি।
তবে উফফ বললেন যে?
আমারও খুব কষ্ট হয়। তাই উফফ বললাম। আহারে।
আহারে বলো না। সিরিয়াসলি কষ্ট হয়।
বুঝলাম।
থ্যাংকস বুঝার জন্য।
ওয়েলকাম।
এই এতক্ষণ যে কথা বলছ কেউ টের পাচ্ছে না?
সবাই ঘুমে। আমি মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে কথা বলছি।
আমার সাথে কথা বলার জন্য এত কষ্ট করছ তাই না? নাহ। ইবলিশ শয়তানের সাথে কথা বলার জন্য এত কষ্ট করছি।
তুমি যে কি মজার কথা বল না। একটা হিসাব করে দেখেছ আমাদের মাঝে এখন রেগুলা। প্রায় কত ঘন্টা যোগাযোগ হয়? না, আমি এসব হিসাব করিনি। আপনি করেছেন?
হ্যাঁ।
দেখি বলেন, কি হিসাব করলেন?
প্রথম প্রথম তো তুমি আমার সাথে কথা বলতে খুব কম। প্রয়োজন
অনুসারে। এরপর আস্তে আস্তে পরিচয়ের মাত্রা বাড়তে থাকল। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ল কথা বলা।
এখন তো প্রায় দশ ঘন্টা আমাদের যোগাযোগ হয়।
তো?
তো কি?
তো হচ্ছে গিয়ে আপনি এসব পরিসংখ্যান দিয়ে কি বুঝাতে চান? আমরা রিলেশনের চাইতেও বেশি কাছে। আবার পচা কথা? এসব ছাড়া কোন কথা নেই? আমি এখন ফোন রাখব। এবার কোন মাফ নেই।
না। প্লিজ। আর কোন প্লিজ শুনব না। আর এসব বলব না। রেখো না ফোনটা প্লিজ। আর একটু কথা বলি। আর একটুও না।
পাগলীটা.. এই.. হ্যালো..
তারিফ হ্যালো হ্যালো করতে থাকল। এদিকে মৌনতা ফোন কেটে সরাসরি অফ করে শুয়ে রইল। এখন বাকি রাতটা তারিফ ছটফট করুক। সে একটু বুঝুক কারো জন্য ছটফট করলে কেমন লাগে! তাদের সম্পর্ক টা এই রকম অদ্ভুত ছন্দে সেই প্রথম থেকে আগাচ্ছে।
কখনো ভীষণ ঝগড়া। কখনো খুব মিল। ঘুরাঘুরি। গান। আড্ডা। খাওয়া দাওয়া। সব মিলিয়ে দারুণ বটে। তবে অফিসিয়ালি রিলেশনশিপ মানে না মৌনতা। সে মুখ ফুটে মনের কথা বলতে পারছে না এটা অবশ্য তারিফ খুব ভালোভাবেই বুঝে গিয়েছে।
সকালবেলা ঘুম থেকে ফ্রেশ হওয়ার পর মৌনতাকে ডাকল তার মা। মায়ের ডাক শুনে সে স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে গেল। তারপর স্বভাবমত মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, বল মা। কি হয়েছে? মিতিল আহমেদ খুব কৌতূহলী চোখে মৌনতার দিকে তাকালেন।
ওর চেহারায় হাত বুলিয়ে দেখলেন। কিন্তু কোন কথা বললেন না। মৌনতা এতে অধৈর্য হয়ে বলল, মা কি দেখ তুমি?
তোকে দেখি।
আমাকে আবার দেখার কি হল? ছোটবেলা থেকেই তো দেখছ।
ছোটবেলা আর বড়বেলার মধ্যে অনেক ফারাক। মেয়ে মানুষের জীবন বৈচিত্রে ভরপুর।
কি রকম?
শৈশবে একরকম। কৈশোরে একরকম। তারপর বিয়ে হলে, বেবি হলে আরেকরকম।
তা তো সবার বেলায় ই। কিন্তু আমাকে এগুলো বলছ কেন হুট করে?
এমনি।
এমনি এমনি তো কোন কথা বল না। কেন বলেছ মা বল।
তোর চোখের নিচে কালি পড়েছে কেন?
জানি না মা।
কপালে মশা কামড়েছে মনে হয়।
মশা কামড়ালে আমার কি দোষ?
না।
চোখের নিচে কালি পড়ল কেন?
জানি না মা।
আজকাল কি তুই কিছু ভাবিস? কোন টেনশন করিস?
না তো!
তবে কি হল তোর?
আমি কি করে বলব? তুমি অযথাই টেনশন করছ। আমার কিছু হয়নি মা।
কিছু না হলেই ভালো। তোর কিছু হলে আমরা বাঁচব না। জানি মা।
এই কথাটা সব সময় মাথায় রেখে চলিস মা।
আচ্ছা রাখব। মা, ক্ষুধা পেয়েছে তো। আবার পড়তেও বসতে হবে। তুমি খাইয়ে দাও। খেতে খেতে পড়ব।
আচ্ছা যা তুই আমি খাবার নিয়ে আসছি।
মৌনতা রুমে এসে দেখতে পেল দাদী তার বিছানায় শুয়ে আছে। দাদী তাকে ঢুকতে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে।
এভাবে দাদীকে হাসতে দেখে সে লজ্জা পেয়ে গেল। তবুও চোখে মুখে কঠিন ভাব ধরে বলল, দিদুন কি হল তোমার। হাসছ কেন?
এমনি।
তুমি কি ভালোয় ভালোয় বলবে? নাকি জোর করে চেপে ধরে শুনব?
আমাকে চেপে ধরলে লাভ কি? যাকে চেপে ধরতে মন চায় তাকে ধর গিয়ে।
কি বলছ এসব?
বুঝতে পারছ না, না?
নাতো।
রাতে কার সাথে কথা বল?
কার সাথে বলি? কখন?
রাতের বেলা। সবাই ঘুমিয়ে গেলে।
ধ্যাত। আমি তো কারো সাথেই কথা বলি না।
মিথ্যা বলা ভালো না।
জানি।
তাহলে বল কেন?
আমি বলি না দিদুন।
তাহলে আমাকে বল, রাতে কার সাথে কথা বল?
আমার বান্ধবী ফোন করেছিল। পড়ার কথা বলতে।
রোজ রাতে কি পড়ার কথা থাকে?
দিদুন। তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না কেন?
করেছি তো। আমাকে বলতে পার সব। কি করে ওনি? দেখতে
কেমন?
জানি না।
আমাকে না বললে কিন্তু মাকে বলে দিব
তুমি যা ভাবছ তা নয় দিদুন।
হলে বলতে পার। বিয়ের কথা বড় হলে ভাবতে হয়। আমি বলব বাবা মায়ের কাছে।
আমি বিয়ে করব তোমাকে কে বলল?
শুধু ফোনে কথা বললে হবে? বিয়েও তো করতে হবে নাকি। যাও দিদুন।
দাদীর মিষ্টি মধুর খুনসুটিতে মৌনতা যখন লজ্জায় লাল হয়ে গেল তখন রুমে ঢুকল মিতিল আহমেদ। তার হাতে একটা ট্রেতে সকালের নাশতা সাজানো। তিনি ঢুকতে ঢুকতে যতটুকু শুনেছেন তার উপর ভিত্তি করে বললেন, কার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে?
মৌনতা ভীষণ লজ্জা পেয়ে ইতস্তত করে বলল, আরে মা দিদুন দুষ্টুমি করতেছে আমার সাথে।
মৌনতার দাদী আগের মত শুয়ে থেকে মুখে মুচকি হাসি নিয়ে বলল, কারো বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে না।
মিতিল আহমেদ চেহারায় কৃত্রিম রাগ ফুটিয়ে বললেন, আমাকে বলা যাবে না।
মৌনতার দাদী বলল, না।
কেন?
আমাদের সব প্রাইভেট আলাপ কি তোমার শুনতে হবে?
হবে না?
না।
কষ্ট পেলাম মা।
পেলে পাও। আমরা দাদী নাতনি কতকিছু আলাপ করব। সব তো তোমাকে বলা যাবে না।
আচ্ছা বলবেন না। এখন নাশতা খান।
প্রথমে মৌনতার দাদীকে নাশতার প্লেট সামনে দিলেন মিতিল আহমেদ। এরপর নিজ হাতে মৌনতাকে খাওয়াতে লাগলেন। খাওয়াতে খাওয়াতে বললেন, পৃথিবীর নিয়মে একদিন নিশ্চয় মৌনতার বিয়ে হবে।
তবে তাদের যেহেতু আর কোন সন্তান নেই সেহেতু ছেলেটাকে অবশ্যই মৌনতার যোগ্য হতে হবে। একচুলও ছাড় দিতে পারবেন না ছেলের যোগ্যতার ব্যাপারে, বংশের ব্যাপারে, শিক্ষার ব্যাপারে, চেহারার ব্যাপারে। মিতিল আহমেদ আকার ইংগিতে মোটামুটি সব কিছু বুঝিয়ে দিলেন মৌনতাকে।
মৌনতাও প্রায় সব বুঝে গেল। সাথে এটাও বুঝে গেল রাতে কথা বলা যাবে না। মারাত্মক একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। সে ঠিক করল তারিফের সাথে যা যোগাযোগ হবে তা দিনেই। আর কথা বলার পরিমাণও কমিয়ে দিতে হবে।
কিছুদিন পরের কথা। মৌনতা তার মায়ের কাছ থেকে আকারে ইংগিতে ওয়ার্নিং পেয়ে তারিফের সাথে খুব সাবধানে যোগাযোগ করত। তারিফ সেই অল্প সময় যোগাযোগ করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত।
এভাবে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর মৌনতা হুট করে লক্ষ্য করল তারিফ কেমন আনমনা। যোগাযোগের সুযোগ পেয়েও আর করতে চায় না। আবার করলেও কথা বলতে চায় না খুব একটা। কেমন যেন উদাসীন উদাসীন একটা ভাব।
ব্যাপারটার একটা সমাধান হওয়া দরকার। সব ছেলেরাই কি এমন হয়? রিলেশন করতে চেয়ে সরাসরি যা চায় তা না পেলেই অন্য রাস্তা ধরে? ইগনোর করে? নাকি শুধু তারিফই এমন? বা ওর কোন ব্যক্তিগত সমস্যা হল কিনা।
এমন বদলে যাওয়ার কারণটা যে করেই হোক জানতেই হবে। তাই সে একটা বুদ্ধি করে তারিফের সাথে দেখা করার প্ল্যান করল। এই প্ল্যানটা সাকসেকফুল হলে তারিফের সাথে নিশ্চয় দেখা হবে। আর দেখা হলেই জানা যাবে তারিফের এমন বদলে যাওয়ার কারণ।
পাঁচ
বেনজীর আহমেদ সকালে নিজ অফিসে পা রাখার পর জানতে পারলেন একজন বৃটিশ নাগরিক তার সাথে দেখা করতে চায়। জরুরী। এমনিতে তার কাজের কোন অভাব নেই। তার উপর বিদেশী নাগরিক দেখা করতে আসলে কেমন অস্বস্তি লাগে।
তারা যা চায় তা দিতে না পারলে নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। হাজার হোক তারা আমাদের অতিথি। তাছাড়া কূটনীতিক সম্পর্কের একটা ব্যাপার তো আছেই।
সবদিক বিবেচনা করে তিনি যে অফিসারের কাছ থেকে খবরটা পেয়েছিলেন সে অফিসারকে বলে দিলেন সেই বিদেশী নাগরিককে কমিশনার অফিসের গেস্ট রুমে বসিয়ে আপ্যায়ন করার জন্য।
তিনি রুটিন কাজগুলো চেক করে একটু ফ্রি হলেই তাকে ডাকবেন। কমিশনার অফিসের গেস্ট রুমটা সুন্দর করে সাজানো গোছানো। মনে হয় প্রায়ই বড় ধরনের অতিথি আপ্যায়ন হয়। সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা আছে।
দেয়ালে আবার কয়েকটা পেইন্টিংও ঝুলানো আছে। হয়তো দেশ বিদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা আসে যায়। তবে রেহনুমা কামালের এখানে বসে থাকতে খুব একটা ভালো লাগছে না। তিনি দেড় যুগ পরে দেশে এসে সবকিছুতে কেমন যেন বেমানান বোধ করছেন।
তাই গেস্ট রুমে বসানোর দশ মিনিটের মাথায় আপ্যায়নকারী অফিসারকে বললেন, আমি আর এখানে বসে থাকত পারছি না। আপনি আমাকে একটু ওনার রুমটা দেখিয়ে দিন।
অফিসার তার সাথে কিছুক্ষণ যুক্তিতর্ক করার চেষ্টা করল। শেষে না পেরে সে রুম দেখিয়ে দিল। রেহনুমা কামাল অতি দ্রুত সে রুমে ঢুকে পড়ল। ঢুকেই একটা চেয়ারে বসে বলল- সরি, আমি কোন নিয়ম মেনে ঢুকতে পারলাম না।
কিঞ্চিত জোর করেই ঢুকতে হল তোমার রুমে। আশাকরি সামান্য ব্যাপারটুকু তুমি সামলে নিবে।
বেনজীর আহমেদ তার দিকে তাকিয়ে কোন কথা বললেন না। তিনি মনে হয় যেন কোথায় হারিয়ে গেলেন।
রেহনুমা কামাল অবশ্য তার এসব হারিয়ে যাওয়ার পাত্তা না দিয়ে খুব অস্থির হয়ে বললেন, কি হল কথা বলছ না যে? চুপ করে আছ কেন? কিছু তো বল। আরে আজব!
বেনজীর আহমেদ খুব ধীর গলায় বললেন, তুমি.. হ্যাঁ আমি। কেন চিনতে পারছ না?
পারছি।
তবে এমন করে তাকিয়ে আছ কেন?
কেন তাকিয়ে আছি বুঝতে পারছ না?
না।
না পারলে নেই। আশা করব অপমান করে বের দেয়ার আগেই বিদায় নিবে।
কি বলছ এসব?
দেখ, আমি যা বলেছি তা খুব স্পষ্ট ভাবেই বলেছি। দেড় যুগ পর দেখা.. কোথায় আপ্যায়ন করবে। খোঁজ খবর নিবে।
তা নয় তুমি খারাপ আচরণ করছ!
তোমার সাথে বাজে কথা বলে সময় নষ্ট করার মত ফ্রি আমি নই। একজন বৃটিশ নাগরিক বসে আছে আমার সাথে দেখা করার জন্য।
আমি একটু পর তাকে আমার রুমে ডাকব। আশা করব তার আগেই তুমি বিদেয় হবে।
তাহলে আমার সাথে কথা বলবে না তুমি? আমার হাতে সময় নেই।
আচ্ছা তবে যাই।
আচ্ছা।
রেহনুমা কামাল রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই বেনজীর আহমেদ সকালের সেই অফিসারটিকে ডেকে বললেন বৃটিশ নাগরিককে তার রুমে পাঠিয়ে দিতে।
কিছুক্ষণ পর সেই অফিসারটি রেহনুমা কামালকে সাথে নিয়ে ঢুকল রুমে। বেনজীর আহমেদ আবারও রেহনুমা কামালকে দেখে অফিসারটিকে ধমক দিয়ে বললেন, কি সব রাবিশ আমার রুমে নিয়ে আস? তোমাদের প্রবলেম কি? বৃটিশ নাগরিক কই?
অফিসারটি মাথা নিচু করে বলল, ইনিই তিনি। আচ্ছা তুমি যাও।
অফিসারটি বেরিয়ে যেতেই বেনজীর আহমেদ বললেন, মিথ্যে
বলার অভ্যাস এখনও যায়নি তোমার?
রেহনুমা কামাল খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, কি মিথ্যে বলেছি?
এই যে বলেছ বৃটিশ নাগরিক।
এটা মিথ্যা তুমি নিশ্চিত?
তুমি না মালয়েশিয়া স্যাটেল করবে বলেছিলে..
এই যে দেখ পাসপোর্ট। বৃটিশ পাসপোর্ট।
রাখ এসব। তোমারগুলো দেখে আমি কি করব?
তুমি বিশ্বাস করছ না তাই দেখালাম।
নাটক রাখ। আমার সময় নষ্ট করবে না। অনেক কাজ আমার।
বেনজীর… প্রথমে বের করে দিয়েছ কিছু বলিনি। এখন কিন্তু আমাকে বের করে দিতে পারো না। আমি তো এখন লিগালি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।
তারপরেও আমি তোমাকে সময় না দিলে তুমি আমার কিছু করতে পারবে না।
জানি সেটা।
জানলে এখন চলে যাও।
কেন এমন করছ?
এত বছর পর কেন এসেছ আমার কাছে? কোন দরকার আছে? আছে। বাসার ঠিকানা দাও। একটু বাসায় যাব। খবরদার। দ্বিতীয় বার এ কথাটা উচ্চারণ করবে না। কেন? একবার তোমার বাসায় যেতে পারি না?
না।
প্লিজ, একবার ঠিকানাটা দাও। চাইতাম না তোমার কাছে। আগের ঠিকানায় গিয়েছিলাম। দেখলাম তোমাকে কেউ চিনে না ওখানে আর। পরে বুঝতে পারলাম বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছ অনেক আগে। এখন নতুন ঠিকানাটা দাও না প্লিজ।
তুমি আর কখনো আমার সামনে আসবে না বলেছিলে। আমাকে মনে রাখবে না বলেছিলে। তবে কেন আসলে আবার? আমার ঠিকানা পেলে কি করে।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করে ঠিকানা পেয়েছি। একবার তোমার বাসায় যাব বলে এসেছি।
আমার বাসায় তোমার কোন কাজ নেই।
আছে একটা কাজ আছে।
কি কাজ?
আমি কিছু একটা ফেলে গিয়েছি। সেটা নিতে এসেছি।
রেহনুমা কামালের মুখে কিছু একটা ফেলে যাওয়ার কথা শুনে বেনজীর আহমেদ উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। তাকে এভাবে হাসতে দেখে রেহনুমা কামাল ভ্রু কুচকে বললেন, পাগল হয়ে গেলে নাকি? এভাবে হাসছ কেন?
পুরাতন সব কিছু ঐ বাড়িটার সাথে বিক্রি করে দিয়েছি আঠারো বছর আগে। তুমি কিছু ফেলে গেলেও আর ফিরে পাওয়ার উপায় নেই। আমার জিনিসটা বিক্রি করনি নিশ্চিত। হয়তো কাউকে দিয়ে দিয়েছ।
ও।
এই জানো আমি না আবার বিয়ে করেছি। আমার একটা ছেলে আছে বারো বছর বয়স। ওর বাবা খুব ভালো। আমাকে খুব ভালোবাসে। আমরা ভালো আছি।
ও।
কি ও ও করছ? তুমি কেমন আছ বল?
উত্তর দেয়ার আগ্রহবোধ করছি না।
আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা কর।
জানলে আবার দেখা করতে এসেছ কেন?
মনটা কেমন করে বুঝলে। আঠারো বছরেও ভুলতে পারিনি যে।
কি ভুলতে পারনি?
বাদ দাও না। তুমি কি আবার বিয়ে করেছ? বাচ্চা কয়টা তোমার? প্লিজ উত্তর দাও।
করেছি বিয়ে।
কাকে? আমি কি চিনি?
চিন। আমি মিতিলকে বিয়ে করেছি।
ও.. তোমার সেই পাগলী ক্লাসমেট? যে তোমাকে পাগলের মত ভালোবাসতো?
ভালোবাসত নয়। এখনো বাসে।
তিনি না তোমার মত বিসিএস ক্যাডার ছিলেন? এখন কোথায়
আছেন? ও আমার মত ক্যাডার ছিল না। আমি পুলিশ ক্যাডার। আর ও প্রশাসন ক্যাডার ছিল। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
বুঝলাম। আচ্ছা, তোমাদের কয়টা বাচ্চা।
একটা।
একটা কেন?
এটা কেমন কথা? একটা নিয়েছি তাই একটা। তাছাড়া মিতিল চায় একটা বাচ্চাকেই প্রপার মানুষ করতে। টেইক কেয়ার করতে। তবে কি…
কি তবে?
সেই ইম্যাচিউর বেবিটা যাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছিল তার কি হল?
তার যা হওয়ার হয়েছে। সে খবর নেয়ার কোন অধিকার তোমার নেই। আর আমি এসব পুরাতন কথা মনে করতে চাই না।
সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি।
কি বুঝতে পারনি?
বেবিটার সারভাইভাল চান্স কম। ডাক্তার বলেছিল। আমার মনে আছে। সরি সেসব কথা মনে করিয়ে দিয়ে তোমার মন খারাপ করে দিতে চাইনি আমি।
কথাটা বলেই হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন রেহনুমা কামাল। বেনজীর আহমেদ কিছুটা ইতস্তত করে বললেন, কাঁদছ কেন তুমি? আবার নাটক শুরু করবে ঠিক করে এসেছ?
না।
তাহলে কান্না থামাও।
জানো, আমি এখনো ওর নড়াচড়া, আমার পেটে বেড়ে উঠা ফিল করতে পারি। আঠারো বছর ধরে আমাকে এই যন্ত্রণা কুরে কুরে খাচ্ছে। আর আজ শুনলাম..
যা শুনেছ শুনেছ। এবার বিদেয় হও।
একবার তোমার বাসায় যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল এটার জন্যই।
আর কোন কথা বলতে ইচ্ছুক নই। তুমি আসতে পার।
এখন তো আর নেই। এবার তাহলে নিজের কাজে যাও। এমন দূর দূর করে তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন?
কি?
একটা চুমু খাবে?
ঠিক আছে চলে যাচ্ছি। লাস্ট একটা কথা রাখবে?
না।
শেষবার? একটা চুমু। প্লিজ।
দুঃখিত। আমি পরনারী, রক্ষিতা, বা বেশ্যায় আসক্ত নই।
বেনজীর সাহেবের রুম থেকে রেহনুমা কামাল বের হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তিনি বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাসায় ফোন করলেন।
অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে আবার নিজের কাজে মন দিলেন।
প্ল্যান অনুযায়ী মৌনতা তারিফকে একটা এসএমএস করে জানাল মিঃ বব ইজ মিসিং। তারিফ অবশ্য আগে থেকেই মিঃ ববকে দেখতে পারত না।
তাই মৌনতার কাছ থেকে এমন একটা এসএমএস পেয়েও খুব একটা বিচলিত হলো না। তবে যখন দেখল মিঃ ববকে ফাহিম গলায় একটা নতুন বেল্ট লাগিয়ে তার সামনে দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তখন সে আর সহ্য করতে পারল না।
হাজার হোক মৌনতাকে সে ভালোবেসে ফেলেছে। ভালোবাসার মানুষের শখের জিনিস হারিয়ে গেছে আর সেটা তার সামনে দিয়ে অন্য কেউ নিয়ে যাবে তা কখনোই হতে পারে না।
শুধুমাত্র মৌনতার জন্য তারিফ গিয়ে ফাহিমের কাছ থেকে মিঃ ববকে উদ্ধার করল। তারপর এটা পৌঁছে দিতে মৌনতাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সে ঘুণাক্ষরেও মৌনতার প্ল্যানের কথা টের পেল না।
মিঃ ববকে পৌঁছে দিতে এসে তারিফের সাথে মৌনতার গার্ডেনে দেখা হয়ে গেল। কুকুরছানাটা ফিরে পেয়ে মৌনতা কিছুক্ষণ হারানো কিছু খুঁজে পাওয়ার পর কেমন লাগতে পারে তার অভিনয় করার চেষ্টা করল।
তারপর কালক্ষেপণ না করে তারিফের দিকে মনযোগী হয়ে বলল, আপনি ওকে কোথায় পেলেন?
তোমার বন্ধু ফাহিমের হাতে।
কি? ঐ শয়তানটা চুরি করেছিল?
সেটা তো বলতে পারছি না।
যাই হোক আপনি মিঃ ববকে ফিরিয়ে দিয়েছেন সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।
তুমি বলবে। পাগলীটা আর এমন হবে না। সরি। এখন থেকে আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখব।
কতদিনের জন্য?
সারাজীবনের জন্য।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আর রাগ করে থাকবে না। বল কেমন আছ?
এতদিন ভালো ছিলাম না। এখন ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
আমিও ভালো।
মিথ্যে কথা সবাই বলতে পারে না। এটা জানেন?
হ্যাঁ জানি।
জেনেও আপনি সুযোগ পেলেই আমার সাথে মিথ্যে বলেন। কারণ কি সত্যি বলবেন?
আমি আবার কই মিথ্যে বললাম?
এই বললেন আপনি ভালো আছেন।
হ্যাঁ তো এটাতে মিথ্যার কি আছে? আমি তো ভালোই আছি।
আপনি ভালো নেই। এবার বলুন কি হয়েছে আপনার?
কি হবে আমার?
এত আনমনা কেন?
কই? আমি তো ঠিক আছি।
আপনি ঠিক নেই। আমাকে বলুন কি হয়েছে। না বললে কিন্তু খবর আছে।
আমি তো নিজেই জানি না আমার কি হয়েছে।
আপনি আমাকে এড়িয়ে চলতে পারলেন?
আর হবে না তো বলেছি। ওটা তো বাদ দিয়েছিলে। এখন আবার তুলেছ কেন?
আচ্ছা আর তুলব না। আপনি শুধু বলেন, আমাকে মিস করেন নি একটুও?
অনেক মিস করেছি।
এতদিন বলেন নি কেন?
এমনি। আচ্ছা তুমি আমাকে মিস করেছ?
না।
সত্যি?
হ্যাঁ।
একটুও না?
না।
ওহ।
ওহ আবার কি? আপনার কি হয়েছে তা বলুন।
এই প্রশ্নের উত্তর তারিফ সাথে সাথেই দিল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খুব ধীরে বলল, শোন মাঝেমাঝে তো আমাদের বাবা মায়ের কথাও ভাবা উচিত, তাই না?
হ্যাঁ। বাবা মায়ের কি হয়েছে?
আমি তো বলিনি কিছু হয়েছে। তুমি শুধু একটা কথা ভাব।
কি কথা?
ধর আমরা বিয়ে করেছি। আমাদের বেবি হয়েছে। আমাদের বেবিটাও একদিন বড় হবে। সবকিছু জগতের নিয়ম তাই না?
হ্যাঁ। তো সমস্যা কি?
সমস্যা কিছু নেই। কিন্তু বেবি বড় হলে তুমি কি বেবির রিলেশন একসেপ্ট করবে?
মানে কি?
মানে বেবি যদি আমাদের মত বয়সী হয়ে কোন রিলেশন করে বা কারো সাথে মেলামেশা করে তাহলে কি তুমি ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিবে?
না।
রিলেশন একসেপ্ট করবে?
কখনো না।
অনেক মিস করেছি।
এতদিন বলেন নি কেন?
এমনি। আচ্ছা তুমি আমাকে মিস করেছ?
না।
সত্যি?
হ্যাঁ।
একটুও না?
না।
ওহ।
ওহ আবার কি? আপনার কি হয়েছে তা বলুন।
এই প্রশ্নের উত্তর তারিফ সাথে সাথেই দিল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে খুব ধীরে বলল, শোন মাঝেমাঝে তো আমাদের বাবা মায়ের কথাও ভাবা উচিত, তাই না?
হ্যাঁ। বাবা মায়ের কি হয়েছে?
আমি তো বলিনি কিছু হয়েছে। তুমি শুধু একটা কথা ভাব।
কি কথা?
ধর আমরা বিয়ে করেছি। আমাদের বেবি হয়েছে। আমাদের বেবিটাও একদিন বড় হবে। সবকিছু জগতের নিয়ম তাই না?
হ্যাঁ। তো সমস্যা কি?
সমস্যা কিছু নেই। কিন্তু বেবি বড় হলে তুমি কি বেবির রিলেশন একসেপ্ট করবে?
মানে কি?
মানে বেবি যদি আমাদের মত বয়সী হয়ে কোন রিলেশন করে বা কারো সাথে মেলামেশা করে তাহলে কি তুমি ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবে নিবে?
না।
রিলেশন একসেপ্ট করবে?
কখনো না।
তোমার কেমন লাগবে?
খুব খারাপ লাগবে।
এবার বুঝ অবস্থা।
আমি বুঝব কি? বেবিকে আমি এমনভাবে ছেড়ে দিব নাকি? ওকে চোখে চোখে রাখব না? তাছাড়া এমনটা চোখে পড়লে মাইর দিয়ে ভূত বানিয়ে ফেলব না?
ঠিক তাই। অথচ ভাব আমাদের বাবা মাও কিন্তু আমাদের চোখে চোখে রাখেন। তারপরেও আমাদের মাইর দিয়ে ভূত বানান নি।
কি বলতে চান আপনি?
বলতে চাই তুমি আমি কেউই মা কিংবা বাবা হইনি তবুও বেবির জন্য এমন লাগে। আর যারা সত্যি সত্যি বেবির বাবা মা তাদের কেমন লাগে? আমরাও তো একদিন বেবি ছিলাম। এখন বড় হয়েছি।
আমাদের নিয়েও নিশ্চয় বাবা মায়ের স্বপ্ন আছে।
ইউ মিন আমাদের বাবা মায়ের কেমন লাগে?
হ্যাঁ।
খারাপ লাগার কথা। কিন্তু আমরা তো খারাপ কিছু করছি না। বাবা মায়ের অমতে কিছু করবও না।
পাগলীটা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর তুমি বাবা মায়ের অমতে কিছু করবে না। মানে কি? বাবা মা যদি অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয় তবে কি হবে?
যা হওয়ার হবে। আপনি আগে বলুন তো এসব জ্ঞানী কথা আপনার মত বুদ্ধর মাথায় কবে এল?
জানি না।
এজন্যই আপনি আমার সাথে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছিলেন? হ্যাঁ।
এতটুকুই যখন বলেছেন তখন পুরো সত্যটা বলুন তো। আপনার মাথায় এসব কি করে এল? তোমার মা বলেছে।
কি?
হ্যাঁ। সত্যি।
কবে?
এইতো কিছুদিন আগে।
মা, আপনাকে এগুলো বলল কোথায়? আমি যে জানলাম না?
আরে আন্টি তো খারাপ কিছু বলেনি। শুধু আমাকে ইংগিতে বুঝিয়ে দিয়েছে।
আর সেজন্য আপনি আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন?
বন্ধ করিনি। কমিয়ে দিয়েছিলাম। উচিত ছিল না কমানো? আমার জায়গায় তুমি হলে কি করতে?
হয়তো একই কাজ করতাম।
যাক। বাঁচালে। এই এখন বল বাবা মাকে কিভাবে ম্যানেজ করবে?
আপনি করবেন আমি কিছু জানি না।
আমি যদি করি তাহলে আমাকে আপনি আপনি করছ কেন?
যদি বিয়ে করতে পারেন তবে তুমি বলব।
এর আগে বললে কি হয়?
বললাম তো পারব না।
তুমি এত আধুনিক মেয়ে হয়ে মাঝেমাঝে এমন আচরণ কর যে আমি অবাক না হয়ে পারি না।
আমি এমনই। বুঝে শুনে পা বাড়ান।
বুঝে শুনেই বাড়িয়েছি। রাজকন্যাকে জয় করেই থামব।
তাহলে বাসর রাতেই তুমি বলব।
এই না প্লিজ। আগে থেকেই।
না। এই শুনুন এখন আমি বাসায় যাব।
আরেকটু থাকো না।
মা কি বলেছে মনে নেই?
আছে আছে।
তাহলে?
এখন বাই। আমি যাই।
বাই।
তারিফের সাথে কথা বলে মৌনতা কপট রাগ নিয়ে বাসায় ঢুকে মিতিল আহমেদকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলল, মা মা মা। আমার অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। কিন্তু আমি খাব না। তুমি কান্না করলেও খাব না।
মিতিল আহমেদ তার মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, আস্তে আস্তে মা। বাসায় গেস্ট এসেছে।
মৌনতা গলার স্বর সাথে সাথেই নামিয়ে বলল, কে এসেছে।
তোমাকে পরে বলছি। যাও ফ্রেশ হয়ে এস।
আচ্ছা। কিন্তু মা আমি আজ খাব না।
কেন?
রাগ করেছি।
আমার মেয়ে আমার সাথে রাগ করতে পারলে?
হ্যাঁ পারলাম।
তুমি রাগ করলে আমি মরে যাব। তখন আর আমাকে খুঁজে পাবে না।
মা এসব কথা বলবে না। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
লাভ ইউ মা।
লাভ ইউ টু। এবার ফ্রেশ হতে যাও। আচ্ছা।
মৌনতা ফ্রেশ হতে চলে যাওয়ার পর মিতিল আহমেদ ড্রয়িং রুমে গেলেন। তাদের বাসায় গেস্ট বলতে রেহনুমা কামাল এসেছে। কি সূত্রে এসেছে তা শুধু মৌনতা ছাড়া সবাই জানে। বেনজীর আহমেদ অবশ্য কখনোই চাননি রেহনুমা কামাল তাদের বাসায় আসুক।
তবুও কেমন করে যেন বাসার ঠিকানা বের করে রেহনুমা ঠিক ঠিক চলে এল বাসায়। মিতিল বা মৌনতার দাদী কেউই কিন্তু তার সাথে খারাপ আচরণ করছেন না। খুব স্বাভাবিক পরিচিত মানুষের মত আচরণ করছেন।
তাদের কাছ থেকে এত আন্তরিক আপ্যায়ন পেয়ে রেহনুমা কামাল নিজেও অবাক। অবশ্য তিনি যে জন্য এ বাসায় এসেছেন সেটা এখনো উদ্ধার হয়নি। শুধু মৌনতার গলা শুনে তার বুকটা কেমন করে উঠেছে। এখনো তিনি তার চেহারা দেখেন নি।
ড্রয়িং রুম থেকে হুট করে ভিতরের রুমে চলে যাওয়া অভদ্রতা। নইলে তিনি তখনই গিয়ে কে কথা বলছিল তা দেখে নিতেন।
মিতিল আহমেদ ড্রয়িং রুমে ঢুকার সাথে সাথে রেহনুমা কামাল বলল, আপা কার গলা শুনলাম?
রেহনুমা কামালের প্রশ্নের উত্তরে মৌনতার মা কিছু বলার আগেই মৌনতার দাদী বলল, মৌনতার।
মৌনতার দাদীর উত্তরে কিছু বুঝতে না পেরে রেহনুমা কামাল হতাশ হয়ে বসে রইলেন। তখন মিতিল আহমেদ বলল, আমাদের মেয়ে মৌনতার গলা শুনেছেন।
আপনি আবার আমাকে আপনি করে বলছেন? আমি আপনার ছোট আপা। আপনি ভুলে যান বারবার।
সরি। আর ভুলব না।
আপনাদের কি একটাই মেয়ে?
হ্যাঁ।
আর কোন বেবি নেই?
না।
ও।
রেহনুমা ও মিতিল আহমেদের কথার মাঝখানে মৌনতার দাদী রেহনুমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমার সব প্রশ্ন কি বেবি ঘিরে?
না তা হবে কেন?
তাহলে ঘুরে ফিরে শুধু বেবিতে আসছ কেন? শালাপী মিতিল আহমেদ বুঝতে পারলেন পরিস্থিতি অন্যদিকে যাচ্ছে। তাই তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রন নেয়ার চেষ্টা করে বললেন, মা ও অনেক বছর পর এসেছে। একটু জানতে চাইতেই পারে।
তাদের আর কোন কথা বাড়ার আগেই মৌনতা এসে ড্রয়িং রুমে হাজির হল। তাকে দেখে সবাই কেমন চুপ করে গেল। মৌনতা এসেই মিতিল আহমেদের পাশে বসে বলল, মা আমার রাগ শেষ। ক্ষুধা পেয়েছে। খাইয়ে দাও।
মৌনতার দাদী কিছু একটা বলতে চাইছিলেন। তার আগেই মিতিল আহমেদ বলল, এক্ষুণি খাইয়ে দিব। তার আগে পরিচিত হও। এটা তোমার একটা আন্টি।
মৌনতা তখন রেহনুমা কামালের দিকে তাকিয়ে হাই হ্যালো করল। তারপর সে বলল, কিছু মনে করবেন না আন্টি আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। আপনি দিদুনের সাথে কথা বলুন। আমি আর মা খেয়ে এসে কথা বলব।
রেহনুমা কামল ইটস ওকে বলার আগেই মৌনতা ওর মাকে টানতে টানতে ভিতরে নিয়ে গেল। তিনি যেন কিছুক্ষণের জন্য নিজেরই প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। বাংলাদেশে পা দেয়ার পর থেকে তার ভিতর একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করছিল। এখন কেমন যেন সেটা বেড়ে গিয়েছে।
রেহনুমা কামাল কুল কুল করে ঘামছেন। মৌনতার দাদী তার এ অবস্থা দেখে বললেন, কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?
জানি না কি হয়েছে।
খুব খারাপ লাগলে না হয় ডাক্তার ডাকি?
না। মা…
আমাকে মা ডাকার কোন অধিকার তোমার আর নেই। বারবার ভুলে যাও কেন?
সরি।
ঠিক আছে। এবার বল কি বলতে চেয়েছিলে?
সেই ইনকিউবেটর বেবিটার কি হল?
কোনটা? যাকে তুমি দুনিয়ার আলোই দেখাতে চাওনি? অন্তত ইনকিউবেটরে রাখা যায় এমন স্টেজ পর্যন্ত নিয়ে আসার জন্য তোমার পা ধরতে হয়েছিল আমাকে! তার কথা?
রেহনুমা কামাল আর কোন কথা বললেন না। তিনি চুপচাপ মাথা নিচু করে রইলেন। মৌনতার দাদী নিজ থেকেই বলতে লাগলেন, শোন আমার সাজানো সংসারে তুমি একবার ঝড় তুলে সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছিলে। সেই ঝড় সামাল দিতে আমার অনেক বছর লেগেছে।
এখন একটু ভালো থাকতে চাই। তোমার কাছে অনুরোধ- আমার সুখের ঠিকানায় আর ঝড় তুলবে না।
রেহনুমা কামল খুব ধরে আসা গলায় বলল, আমি শুধু সেই বেবিটার কথা জানতে চাই।
মৌনতার দাদী বলল, একটু আগে যাকে দেখে তোমার হাত পা জমে গেল.. এটাই সেই ইনকিউবেটর বেবি।
কি…?
হ্যাঁ।
মিতিল আপা আর বেবি নেন নি?
নাহ
কেন?
সে আমার ছেলেকে খুব ভালোবাসে। তাই তার জন্য জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছে। সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। আগের বাড়িটা বিক্রি করে নতুন এ বাড়িটা প্ল্যান করে কিনেছে। সব গুছিয়েছে। একটা ইম্যাচিউর বেবিকে খুব রিস্ক নিয়ে বাঁচিয়ে তুলেছে।
তাই বলে নিজে বেবি নিল না কেন?
যেন কেউ বলতে না পারে সৎ মা কম আদর করেছে। তাছাড়া তার যুক্তিতে মা তো হয়েছেই। এটাকে ঠিকমত মানুষ করতে পারলেই হয়। আমিতো এসব কিছুই জানতাম না। আমার শুধু মনে হত আমার বেবিটা মরে যায়নি। ও বেঁচে আছে।
খবরদার রেহনুমা। শেষবার সাবধান করে দিচ্ছি। আর আমার মেয়ে, আমার মেয়ে করবে না। মৌনতা কখনোই তোমার মেয়ে নয়।
আমি বুঝতে পারি সব। ঠিক আছে করব না।
আমি মৌনতাকে গল্পের উছিলায় তোমার গল্পটা করেছি বহুবার। এ জন্য সে প্রবাসীদের দুচোখে দেখতে পারে না।
কোন গল্পটা?
ঐ যে একটা কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করে। বিয়ের অল্প কিছুদিনের মাথায় কনসিভ করার পর বলে ভুলে হয়েছে এটা। এখন বেবি নেয়ার সময় নেই। সামান্য একটা এশিয়ান স্কলারশিপের জন্য তার ক্যারিয়ারের দোহাই দিয়ে সে ঐ বেবিটা নষ্ট করতে চায়।
এরপর দূরত্বটা ক্রমেই বাড়তে থাকে। নিজের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সে বেবিটার বাবার সাথে ছাড়াছাড়ি করে। বেবিটার দাদী বেবিটাকে নষ্ট না করে ইনকিউবেটরে রাখা যায় এমন স্টেজ পর্যন্ত নিয়ে আসতে মেয়েটার পায়ে ধরে। মেয়েটা কথা শুনে।
সে বেবিকে ইনকিউবেটরে রাখা যাবে এমন স্টেজ পর্যন্ত এসে জোর করে ডেলিভারি করে। তারপর প্রবাসী হয়। আর বেবিটার কোন খোঁজ রাখে না।
রেহনুমা কামাল মৌনতার দাদীর কাছ থেকে গল্প শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, এই গল্পটা তো আমি জানি। পরে কি হল তা তো জানি না।
মৌনতার দাদী আবার বলতে শুরু করল, তোমার গল্প তুমি জানবে না তা কি করে হয়? আমি শুধু একটু মনে করিয়ে দিলাম। পরে কি হল তা শোন।
বলুন।
বেনজীর খুব ভেংগে পড়ল। আমি ঠিক করলাম কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলব। তখনই মাথায় এল মিতিলের কথা। ও তো বেনজীরকে ভালোবাসত ছাত্রজীবন থেকে। মেয়ে হিসেবেও খারাপ না। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডও ঠিক ছিল।
শুধু সমবয়সী বলে ওদের বিয়ে দেইনি।
তারপর?
আমরা যখন কিছুটা স্বার্থপরের মত বিয়ের প্রস্তাব দিলাম তখন মিতিলের বাবা মা কিছুতেই মানল না। কিন্তু মিতিল সবাইকে উপেক্ষা করে আমাদের প্রস্তাব মানল। বিয়ে করল। ভেংগে পড়া বেনজীরকে, তার পরিবারকে আবার গড়ে তুলল। নিজ হাতে।
তিলে তিলে। খুব যত্ন করে। জানো আমি কেন তোমাকে সব বললাম?
না। কেন বললেন সব?
কারণ একবার তুমি আমার কথা রেখেছিলে। তাই আমি এবার তোমার কথা রেখে ঋণ শোধ করলাম। বয়স হয়েছে। কখন মরে যাই তার কি কোন ঠিক আছে?
এসব কি বলছেন?
রেহনুমা… আমি যা বলার বলেছি। সব কিছু শুনেছ। এবার আশা করি তুমি আর বেশি সময় নিবে না।
না আর নিব না। আমার ফ্লাইট তো আজকেই। সন্ধ্যায়।
বেশ। তাহলে ভালো থেক।
আমি কি একবার মৌনতাকে বুকে নিতে পারব?
কি দরকার তোমার নষ্ট বুকে ওকে জড়ানোর?
কি বলছেন এসব?
আমার চুল তো বাতাসে পাকেনি। কি বললাম বুঝতে না পারলে বসে বসে ভাব। আর চোখের পানি মুছ। এখনি হয়তো ওরা আসবে।
রেহনুমা কামাল চোখ মুছে চুপচাপ বসে রইলেন। মৌনতার দাদীও আর কোন কথা বলল না। বেশ কিছুক্ষণ পর রুমে ঢুকল মিতিল আহমেদ ও মৌনতা। ঢুকেই জানতে পারল রেহনুমা কামাল আজই চলে যাবে।
তখন মিতিল আহমেদ ঠিক করলেন মৌনতাকে সাথে নিয়ে এয়ারপোর্ট গিয়ে রেহনুমা কামালকে সি অফ করবেন। যদিও এই সিদ্ধান্তটা মৌনতার দাদী পছন্দ করা দূরে থাক কিছুতেই মেনে নিতে পারল না। তবে মুখে তেমন কিছু বললও না।
কিছুক্ষণ পর এই কথাটা বেনজীর আহমেদও জেনে গেলেন। তিনি শুনে তো রেগেমেগে আগুন। কিছুতেই চান না এয়ারপোর্টে মিতিল আহমেদ বা মৌনতা যাক। তবুও শেষমেশ মিতিল আহমেদের কথায় তিনিও শান্ত হলেন।
সবকিছু গোছগাছ করে মিতিল আহমেদ মৌনতাকে নিয়ে বের হতে চাইলেন। রেহনুমা কামাল আগেই বিদায় নিয়ে নিল। মৌনতার দাদী মুখ ভার করে একদিকে বসে রইল। মিতিল আহমেদ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় চেয়ারে সামান্য একটা ধাক্কা খেলেন।
মৌনতার দাদী তাকে সাথে সাথে ধরে বললেন, বউমা তুমি যেও না। দেখ না প্রথমেই একটা বাধা পেলে।
মিতিল আহমেদ মৌনতার দাদীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ও মা এসব কিছু না। পুরাতন দিন কি এখন আছে?
তবুও একটু বসে যাও।
না মা। ড্রাইভার গাড়ি বের করে ফেলেছে। এখুনি যেতে হবে। নইলে লেইট হয়ে যাবে।
আরে কিছু হবে না।
না মা লেইট হবে। রাস্তাঘাটের ব্যাপার। যানজট হতে পারে। আপনি ঠিকমত খেয়ে নিয়েন। দুপুরে কোন ঔষধ নেই। আমি গেলাম মা।
মিতিল আহমেদ মৌনতার দাদীর কাছ থেকে কোন উত্তরের অপেক্ষা না করে বের হয়ে গেলেন। তারপর রেহনুমা ও মৌনতাকে গাড়িতে বসিয়ে রেখে বললেন, এক মিনিট। আমি একটা ফোন করে আসছি।
গাড়িতে উঠার আগে মৌনতার বাবাকে ফোন করলেন তিনি। তার ধারণা গাড়িতে উঠে ফোন করলে মৌনতার বাবা যদি রাগ করে তাহলে রেহনুমা কামাল মনে মনে কষ্ট পাবে।
দু বার রিং হওয়ার পর ফোন ধরলেন বেনজীর আহমেদ। ফোন ধরেই বললেন, হ্যালো মিতিল তোমার না গেলে হয় না?
কেন?
অনেক তো আপ্যায়ন করেছ। এখন কি এয়ারপোর্ট যাওয়াও জরুরী?
হ্যাঁ। জরুরী।
কেন জরুরী তা একটু বুঝাবে?
না। আমার হাতে এখন সময় নেই।
যাচ্ছি কেমন?
আচ্ছা।
বেনজীর আহমেদের সাথে খুব তাড়াতাড়ি কথা শেষ করে গাড়িতে উঠলেন মিতিল আহমেদ। উঠে দেখলেন মৌনতা ও রেহনুমা অল্পস্বল্প কথা বলছে। তিনি কথা শোনার আগ্রহ নিয়ে বললেন, কি কথা হচ্ছে দুজনে?
রেহনুমা কামাল বলল, আপনাকে নিয়ে।
মিতিল আহমেদ খুব অবাক হয়ে বলল, আমাকে নিয়ে আবার কি কথা হচ্ছে?
মৌনতা বলল, আন্টি বলবেন না কিন্তু। বললে আড়ি দিব।
রেহনুমা কামাল বলল, আমি তো উভয় সংকটে পড়লাম।
মিতিল আহমেদ বলল, থাক বলতে হবে না।
মৌনতা তখন লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বলল, মা বলতে হবে। আমি তারিফের কথা বলছিলাম। তুমি যে ওকে কি কি বুঝিয়েছ তা নিয়ে বলছিলাম।
রেহনুমা কামাল বলল, আমিই জানতে চেয়েছিলাম ওর কোন পছন্দ আছে কিনা।
মিতিল আহমেদ চোখ বড় বড় করে বলল, তারপর ও কি বলল? ও বলল, ওর কোন পছন্দ নেই। তবে একটা ছেলে ওকে খুব পছন্দ করে।
ছেলেটার নাম তারিফ। আর ও করে না?
না।
তাই নাকি?
মিতিল আহমেদ তাই নাকি বলার পর মৌনতা খুব লজ্জা পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকালো। তারপর বলল, মা আমি কাউকে পছন্দ করি না।
মিতিল আহমেদ বলল, আচ্ছা যাও করো না। ঐ পাজি ছেলেটাই তোমার পিছু নিয়েছে। কিন্তু তুমি কি জানো ঐ পাজি ছেলের সাথেই মনে হয় তোমার বিয়ে দিব।
যাও মা। কি বল এসব?
ওরে আমার বাচ্চাটা এত লজ্জা পায়?
মৌনতা কিছু বলল না। সে আগের মত মুখ লুকিয়ে রইল। মিতিল আহমেদ আবার বলল, আমি না পাজি ছেলের মায়ের সাথে কথা বলেছি।
এবার মৌনতা মুখ তুলে ভীষণ অবাক হয়ে বলল, কবে?
এইতো কিছুদিন আগে।
আমাকে তো কিছু জানাও নি।
তুমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে ঐ ছেলেটাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলে তা কি আমাকে জানিয়েছিলে?
মা… তুমি কি? সব জান?
কেমন করে?
মা হলে সব জানতে হয়। তুইও জানবি।
না আমি এসব জানব না।
আচ্ছা জানিস না।
মা মেয়ের কথার মধ্যে রেহনুমা কামাল কেমন উদাস হয়ে গেল। সেটা দেখতে পেয়ে মিতিল আহমেদ বলল, এই রেহনুমা তুমি যে কিছুই বলছ না? আমরাই শুধু কথা বলে যাচ্ছি। এত চুপ কেন?
মৌনতা বলল, আন্টি আপনার কি হয়েছে?
কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছি মা?
কি হারিয়েছেন?
মূল্যবান কিছু একটা।
তাহলে খুঁজেন।
কোথায় খুঁজব?
যেখানে হারিয়েছিলেন।
কিছু জিনিস আছে তা হারালে কোথায় খুঁজবে তার ঠিকানাও থাকে না। আমিও এমন কিছু হারিয়েছি। কোথায় খুঁজব সেটাই জানি না।
উফফ.. এত ভারী ভারী কথা আমি বুঝি না। মা, আমার মনে হয় আন্টি বাংলাদেশ থেকে চলে যাচ্ছে তো তাই মন খারাপ।
মিতিল আহমেদ বলল, ঠিক।
মৌনতা আর রেহনুমা কামালকে নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখালো না। সে বরং তারিফকে নিয়ে ভাবতে লাগল। ওদিকে রেহনুমা কামাল ও মিতিল আহমেদ কথা বলতে লাগল। তাদের এসব কথার ফাঁকে কখন যে এয়ারপোর্ট চলে এল তা কেউ টেরও পেল না।
এয়ারপোর্টে নেমে চেক ইন করার আগে রেহনুমা কামালকে জড়িয়ে ধরার জন্য মৌনতাকে ঠেলে দিল মিতিল আহমেদ। কিন্তু রেহনুমা কামাল তাকে জড়িয়ে না ধরে মিতিল আহমেদকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনার কাছে আমার অনেক ঋণ।
আমি কখনো এ ঋণ শোধ করতে পারব না। আমাকে মাফ করে দিয়েন। আর যদি কখনো দেখা না হয় তবে আমার উপর কোন দাবি রাখবেন না।
মিতিল আহমেদ কিছু বলার আগেই রেহনুমা কামাল এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একপ্রকার দৌড়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে চলে গেল। একবারও পিছন ফিরে মৌনতার দিকে তাকাল না।
রেহনুমা কামাল চলে যাবার পর মৌনতা ও তার মা গাড়িতে এসে বসল।
ড্রাইভার গাড়ি চালাতে শুরু করার পর মৌনতা বলল, মা এই আন্টিটার মাথায় প্রবলেম আছে নাকি?
মিতিল আহমেদ মৌনতার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ছিঃ মা। এভাবে বলতে হয় না। চাচাত থাক তোমার কিভাবে বলব তুমি বল? সে এমন করল কেন? আমাকে জড়িয়ে ধরল না কেন? একবার আমাকে জড়িয়ে ধরলে কি হত?
থাক বাদ দাও না তার কথা।
আচ্ছা বাদ।
চল আজকে একটা কাজ করি।
কি কাজ?
প্রথমে ফুচকা খাই। তারপর আমার একটা কাজ আছে ব্যক্তিগত।
ব্যক্তিগত কি কাজ?
তারিফদের বাসায় যেতে হবে।
কেন?
ওর মা আমাকে যেতে বলেছে। আজ আমার দাওয়াত।
ও তুমি এজন্য এত সাজুগুজু করেছ?
হ্যাঁ।
বাবা যদি রাগ করে?
করবে না।
কেন?
আরে তোর বাবাকে আমি সব বলেছি তো।
সত্যি মা?
হ্যাঁ।
তুমি বাবাকে জানিয়ে দিয়েছ? বাবা তো আমাকে কিছু বলল না?
কিছু সারপ্রাইজ তো বাবা মায়ের কাছে রাখতেই হয়। সব কি বলে
দিলে হয়?
জানি না।
এখন চল ফুচকা খেয়ে নেই। তাড়াতাড়ি। হাতে সময় কম। আচ্ছা।
মিতিল আহমেদ ড্রাইভারকে একটা ফুচকার দোকানে গাড়ি থামাতে বললেন। তারপর দু প্লেট ফুচকার অর্ডার দিয়ে তাড়াতাড়ি দিতে বললেন।
মৌনতার খুশি যেন আর ধরে না। ফুচকা আসার পর সে খুব খুশিমনে মায়ের সাথে ফুচকা খেতে লাগল। ফুচকা খেতে খেতে সে বলল, মা এ ফুচকাগুলো কি মজা দেখেছ?
হ্যাঁ।
এগুলো এত মজা কেন?
কারণ এগুলোতে বাইরের ধুলোবালি লেগে আছে তাই। আরো একটা কারণ অবশ্য আছে।
মৌনতা হাসতে হাসতে বলল, মা তুমি যে কি বল না। আরো কারণ কি?
সেটা তো বলা যাবে না।
বল না প্লিজ।
উহু। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর। আমার দেরি হচ্ছে।
উফ মা কখন থেকে দেরি হচ্ছে দেরি হচ্ছে করছ। এত তাড়াহুড়ো করছ কেন?
আচ্ছা আর করব না। তোকে একটা প্রশ্ন করি?
কর। এটা আবার জিজ্ঞাসা করতে হয়?
তুই আমাকে ছাড়া থাকবি কি করে? পারবি থাকতে?
না। তোমাকে ছাড়া কেন থাকব? তোমাকে, বাবাকে সারাজীবন আমার কাছে রাখব। তোমরা আমার বাচ্চা না?
হ্যাঁ বাচ্চা। কিন্তু তোর বাবার সাথে আমি থাকব না। শুধু জ্বালাতন করে। বুড়ো হলে আরও বাড়বে।
মা তুমি শুধু চোখ গরম করে একবার তাকাবে দেখবে সব ঠান্ডা। বাবা আর নড়াচড়া করবে না। আচ্ছা মা এবার তোমাকেও আমি একটা প্রশ্ন করি।
মৌনতার প্রশ্ন করার আগে প্রস্তুতি দেখে মিতিল আহমেদ হাসতে হাসতে বললেন, কর।
তুমি কি পারবে?
আমিতো তোমাকে ছাড়া থাকতে পারব না। বাবাও পারবে না।
মিতিল আহমেদ বললেন, কঠিন প্রশ্ন। আমি উত্তর দিব না।ক
মা দাও না প্লিজ।
না দিব না। তুই আমাকে জোর করিস না।
করব।
না করবি না। এই শোন আমি আজ তারিফদের বাসায় গিয়ে ওদের দাওয়াত দিব।
কেন?
আরে একটু রিলেশন বিল্ড আপ আর কি। এরপর আরো কত কাজ বাকি!
কি? কি?
গহনা বানানো। শপিং করা। বাসা নতুন করে পেইন্ট করা। মা, আমার কিন্তু খুব লজ্জা লাগছে।
ওরে আমার লজ্জাবতী বাচ্চাটা। তোর কাছে কিন্তু একটা রিকোয়েস্ট আছে।
কি?
পড়ালেখা কিন্তু অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে।
আচ্ছা মা।
আমি কিন্তু হানিমুনে বিদেশে পাঠাবো। যতই বিদেশ ঘৃণা করিস না কেন হানিমুনে কিন্তু যেতে হবে।
ভিসা টিকিট সব আমি করে দিব। এই টাকাগুলো তোর জন্মের আগে যখন চাকরি করতাম তখন থেকে জমানো। তোর বাবাকেও
মা, আমার লজ্জা লাগছে। তুমি থাম।
না থামব না। আমি আমার সব স্বপ্ন বলব।
উফফ… মা চল উঠি। তোমার না দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর খাব না। চল উঠি।
মিতিল আহমেদ উঠতে না চাইলেও মৌনতা প্রায় জোর করে টানতে টানতে গাড়িতে তুলে ড্রাইভারকে বলল সোজা বাসায় যেতে।
ড্রাইভার আবার গাড়ি চালাতে শুরু করার পর মিতিল আহমেদ বলল, তারিফ ছেলেটার ফ্যামিলি কিন্তু ভালোই।
মৌনতা কিছু বলল না।
মিতিল আহমেদ আবার বলতে লাগলেন, তারিফ ছেলেটাও ভালো।
মৌনতা তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিলে বলল, উফ মা তারিফ ছাড়া কি আর কোন কথা নেই তোমার?
না নেই।
আমি কিন্তু আড়ি নিব।
আড়ি নিস না। এই শোন তুই কিন্তু ওকে একদম বিরক্ত করবি না। ছেলেটা অনেক সহজ সরল।
সহজ সরল না ছাই। আস্ত একটা ঝগড়াটে।
মৌনতা ও তার মা যখন কথা বলছিল তখন গাড়িটা একটা রেলক্রসিং পার হচ্ছিল। লাইন ম্যানের ভুলের কারণে রাস্তায় কোন ব্যারিকেড ছিল না। তাদের গাড়িটা যখন ঠিক রেললাইনের মাঝখানে তখনই ট্রেনটা গাড়িটাকে ধাক্কা মারল।
মৌনতার সাথে আর মিতিল আহমেদের কথা বলা হল না। মাইক্রো সেকেন্ডের ব্যবধানে তিনি কোনমতে গাড়ির দরজা খুলে মৌনতাকে গায়ের জোরে ধাক্কা মেরে মেইন রাস্তায় ফেলে দিলেন। নিজে আর বের হওয়ার সময় পেলেন না।
মৌনতার চোখের সামনে দিয়ে গাড়িটা মুহূর্তে দুমড়ে মুচড়ে গেল। ড্রাইভার ও মিতিল আহমেদ, স্পট ডেড। এতবড় একটা এক্সিডেন্ট দেখে মৌনতা শুধু ছোট করে বলল, মা। তারপর আর ওর কিছু মনে নেই।
ছয়
মৌনতার জ্ঞান ফিরে আসতেই সে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করল। তার সারা শরীর ব্যথা হয়ে আছে। একদম নড়তে পারছে না। সে এখানে কেন তাও মনে করতে পারছে না। তার শরীরের কয়েক জায়গায় ব্যান্ডেজ করা।
তাকে ঘিরে ধরে সবাই বসে আছে। বাবা, দাদী, তারিফ, ফাহিম, ওদের বাবা মা। তারিফকে তার বাবার সামনে উপস্থিত হতে দেখে সে মনে মনে তার সাহসের প্রশংসা না করে পারল না। সুযোগ পেলেই তাকে একটা ধমক দিতে হবে।
চোখ খোলার পর মৌনতা শুধু একজনকে খুঁজছে। ডাক্তার শুধু বলছে আস্তে আস্তে কথা বলতে। অনেকেই কাঁদছে। ব্যাপারটা কি? এত মানুষ আছে অথচ মা নেই কেন? মায়ের কথা মনে হতেই সে তার বাবাকে হাত ইশারায় ডাকল। তারপর বলল, মা আসেনি? মা কোথায়?
বেনজীর আহমেদ কোন উত্তর দিতে পারলেন না। তার দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগল। মৌনতা ওর বাবাকে কাঁদতে দেখে অধৈর্য হয়ে বলল, বাবা তুমি কি মায়ের ভয়ে কাঁদছ? মা কিছু বলবে না। আমি ঠিক আছি তো দেখ।
মৌনতার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মত কেউ নেই। সবাই কেমন করে আছে। সে তখন তার দিদুনকে ডেকে বলল, আমাদের সাথে কি হয়েছিল তা কি মা তোমাকে বলেছে।
না।
আরে এয়ারপোর্ট থেকে ফিরার পথে রেলক্রসিং এ একটা ট্রেন এসে পড়েছিল। তারপর মা আমাকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে তিনিও নিশ্চয় বের হয়েছিলেন। আর গাড়িটা তো সিনেমার মত করে ভেংগে গেছে। আমিও ব্যথা পেয়েছি। মা কই দিদুন? মাকে ডাক।
এত জোরে কেউ ধাক্কা দেয়?
মৌনতার দাদী কোন কথা বলতে পারলেন না। তিনিও কাঁদতে লাগলেন।
তাদের দেখাদেখি হঠাৎ করে হাসপাতালে কান্নার রোল পড়ে গেল। মৌনতা তখন তারিফকে জিজ্ঞেস করল, এই আপনি বলেন তো কি হয়েছে? শেষবার আপনাকে নিয়েই কথা বলছিলাম আমরা।
তারিফ মাথা নিচু করে রইল।
মৌনতা আবার বলল, কি হল কিছু বলছেন না যে? না বললে কিন্তু খবর আছে।
তারিফকে অনেক জোরাজোরির পর তারিফ আস্তে করে বলল, তুমি
শান্ত হও। আন্টি ইজ নো মোর।
এই নো মোর মানে কি? আমার মা কই? তোমরা কেউ কথা বলছ না কেন? আমার মাকে কোথায় রেখে এসেছ?
বেনজীর আহমেদ এসে মৌনতাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, মা তুমি শান্ত হও। বাবা আমি কিভাবে শান্ত হব?
যে মানুষটা সারাজীবন শুধু ত্যাগই করে গেল সে নেই আর আমি শান্ত থাকব?
বেনজীর আহমেদ আর মৌনতা দুজনেই গলাগলি করে কাঁদতে লাগল। মৌনতা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, বাবা আমার তো জন্মই হতো না।
নিজের মা-ই চায়নি আমাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে। আর তিনি আমাকে লালন পালন করলেন। বড় করলেন। এরপর মৃত্যু মুখে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের বিনিময়ে আমাকে বাঁচিয়ে গেলেন। পেটে না ধরেও আমার জন্য এতটা কেন করলেন বাবা?
তুমি এসব জানতে মা?
হ্যাঁ। দিদুনের কাছে একটা গল্প শুনেছি। রেহনুমা কামালের। তারপর আজ ওনাকে সি অফ করতে গিয়ে পুরোটা নিশ্চিত হয়েছি।
ওনি আমাকে জড়িয়েও ধরার সাহস পাননি। আমার মা পুরো জীবন আমাদের জন্য দিয়ে দিল। আর আমরা তার জন্য কিছুই করতে পারব না কেন? বাবা, চল মাকে খুঁজে আনি।
বেনজীর আহমেদ আর কিছু বললেন না। তিনি মৌনতার গলা ছেড়ে দিয়ে ধীর পায়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে গেলেন। পিছনে আসতে আসতে শুনতে পেলেন, বাবা তুমি কি মাকে খুঁজতে যাচ্ছ? আমার মা কই বলে মৌনতা আহাজারি করেই চলেছে।
আস্তে আস্তে মৌনতার রুমের ভিড়টা কমল। কারোরই আর মৌনতাকে ফেইস করার সাহস নেই। শেষমেশ শুধু বসে রইল দিদুন ও তারিফ। সে তখন দিদুনকে ডেকে বলল, ও দিদুন। মা যখন খুব তাড়াহুড়ো করল তখন তুমি বুঝলে না কেন?
আমাকে কিছু বলে দিতে পারলে না। তুমি বলে দিলে কি আমরা বের হতাম?
দিদুন চুপ করে বসে কান্না করতে লাগলেন। তারিফ মৌনতার মাথার পাশে বসে ওর একটা হাত ধরে বলল, তুমি শান্ত হও প্লিজ।
কেমন করে শান্ত হব? আপনি জানেন মা আমাদের দুজনকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখেছেন। আমাকে বলতে চেয়েছিল সব। আমিই ইচ্ছে করে শুনিনি তখন। আমার মা বুঝি চলে যাবে বলেই সবকিছু বলে যাচ্ছিল।
মা.. মা.. তুমি কই? মা আমার কাছে ফিরে আস। আপনি আমার মাকে খুঁজে এনে দেন না প্লিজ…
মৌনতার অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছিল। এতবড় মানসিক শক কেউ নিতে পারে না। ডাক্তার এসে তাড়াতাড়ি ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল। ও ঘুম থেকে উঠে ওর মাকে খুঁজবে নিশ্চিত।
খুঁজতেই থাকবে। হয়তো এভাবেই সারাজীবন খুঁজবে। কখনো আকাশের তারাদের মাঝে। কখনো বাগানের ফুলের মাঝে। কখনো বা নিজের অতীতের মাঝে।
Read More: গল্পের বই