6 হাসির গল্প – গল্পের বই

হাসির গল্প – গল্পের বই, অনেক সুন্দর সুন্দর ও মজাদার হাসির গল্প পাবেন আমাদের এই পোস্টে

হাসির গল্প

হাসির গল্প, সোনার কাটি রূপার কাটি

হাসির গল্প, সোনার কাটি রূপার কাটি
এক রাজপুত্র, এক মন্ত্রিপুত্র, এক সওদাগরের পুত্র আর এক কোটালের পুত্র চার জনে খুব ভাব।
কেহই কিছু করেন না, কেবল ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ান।

দেখিয়া শুনিয়া রাজা, মন্ত্রী, সওদাগর, কোটাল, বিরক্ত হইয়া উঠিলেন, বলিয়া দিলেন,“ছেলেরা খাইতে আসিলে ভাতের বদলে ছাই দিও।”

মন্ত্রীর স্ত্রী, সওদাগরের স্ত্রী, কোটালের স্ত্রী কি করেন? চোখের জল চোখে রাখিয়া, ছাই বাড়িয়া দিলেন। ছেলেরা অবাক হইয়া উঠিয়া গেল ।

হাজার হ’ক পেটের ছেলে; তা’র সামনে কেমন করিয়া ছাই দিবেন? রাণী তাহা পারিলেন না। রাণী পরমান্ন সাজাইয়া, থালার এক কোণে একটু ছাইয়ের গুঁড়া রাখিয়া ছেলেকে খাইতে দিলেন।

রাজপুত্র বলিলেন, “মা, থালে ছাইয়ের গুঁড়া কেন?”
রাণী বলিলেন,- “ও কিছু নয় বাবা, অমনি পড়িয়াছে।” রাজপুত্রের মন মানিল না; বলিলেন- “না, মা, না বলিলে আমি খাইব না।” রাণী কি করেন? সকল কথা ছেলেকে খুলিয়া বলিলেন ।

শুনিয়া, রাজপুত্র মায়ের পায়ে প্রণাম করিয়া, উঠিলেন।
চার বন্ধুতে রোজ যেখানে আসিয়া মিলেন, সেইখানে আসিয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কে কেমন খাইয়াছে?”

সকলেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তখন রাজপুত্র বলিলেন,- “ভাই, আর দেশে থাকিব না, চল দেশ ছাড়িয়া যাই ।”
“সেই ভাল!” চারিজনে চারি ঘোড়া ছুটাইয়া দিলেন ।

ঘোড়া ছুটাইতে ছুটাইতে ছুটাইতে, চার বন্ধু এক তেপান্তরের মাঠের সীমায় আসিয়া পৌঁছিলেন ।
মাঠের উপর দিয়া চারদিকে চার পথ।

কে কোন দিকে যাইবেন? ঠিক হইল,– কোটালের দক্ষিণ, সওদাওগরের উত্তর, মন্ত্রীর পশ্চিম আর রাজপুত্রের পুব। তখন সকলে মাথার পাগড়ীর কাপড় ছিঁড়িয়া চার পথের মাঝখানে চার নিশান উড়াইয়া দিলেন,–“যে-ই যখন ফিরুক অন্য বন্ধুদের জন্য এইখানে আসিয়া বসিয়া থাকিবে।”

চার ঘোড়া চার পথে ছুটিল ।
সারা দিনমান চার জনে ঘোড়া ছুটাইলেন, কেহই কোথাও গ্রাম, নগর বন্দর বাড়ি কিছুই দেখিলেন না; সন্ধ্যার পর আবার সকলেই কোন এক এক-ই জায়গায় আসিয়া উপস্থিত!

সে মস্ত এক বন! রাজপুত্র বলিলেন,- “দেখ, আমরা নিশ্চয় রাক্ষসের মায়ায় পড়িয়াছি; সাবধানে রাত জাগিতে হইবে! কিন্তু ক্ষুধায় শরীর অবশ, দেখ কিছু খাবার পাওয়া যায় কি-না।” সকলে ঘোড়া বাঁধিয়া খাবার সন্ধানে গেলেন ।

বনে একটিও ফল দেখা যায় না, কোনও জীবজন্তু দেখা যায় না, কেবল পাথর কাঁকর আর বড় বড় পাকুড় তাল শিমুলের গাছ!
হঠাৎ দেখেন, একটু দূরে এক হরিণের মাথা পড়িয়া রহিয়াছে।

সকলের আনন্দের সীমা রহিল না; কোটালের পুত্র কাঠ কুড়াইতে গেলেন, সওদাগরের পুত্র জল আনিতে গেলেন, মন্ত্রিপুত্র আগুনের চেষ্টায় গেলেন, রাজপুত্র একটি গাছের শিকড়ে মাথা রাখিয়া গা ছড়াইয়া শুইয়া পড়িলেন।

রাজপুত্র ঘুমে। কাঠ নিয়া আসিয়া কোটাল দেখেন, আর বন্ধুরা আসে নাই। কাঠ রাখিয়া কোটাল হরিণের মাথাটি কাটিতে গেলেন ।

তরোয়াল ছোঁয়াইয়াছেন- আর অমনি হরিণের মাথার ভিতর হইতে এক বিকটমূর্তি রাক্ষসী বাহির হইয়া কোটাল আর কোটালের ঘোড়াটিকে খাইয়া, আবার যেমন হরিণের মাথা তেমনি হরিণের মাথা হইয়া পড়িয়া রহিল।

জল আনিয়া সওদাগর দেখেন, কাঠ রাখিয়া কোটাল-বন্ধু কোথায় গিয়াছে। সওদাগর হরিণের মাথা কাটিতে গেলেন। সওদাগর, সওদাগরের ঘোড়া রাক্ষসীর পেটে গেল

মন্ত্রী আসিয়া দেখেন, জল আসিয়াছে, কাঠ আসিয়াছে, বন্ধুরা কোথায়? “আচ্ছা, মাংসটা বানাইয়া রাখি।”
“বাঁচাও বাঁচাও !- বন্ধু, কোথায় তোমরা- —জন্মের মত গেলাম !”

মন্ত্রিপুত্রের চিৎকারে রাজপুত্র ধডুমডু করিয়া উঠিয়া বসিলেন দেখেন,- কি সর্বনাশ, রাক্ষসী !!! রাক্ষসী মন্ত্রিপুত্র আর মন্ত্রিপুত্রের ঘোড়া খাইয়া রাজপুত্রের ঘোড়াকে ধরিল। তরোয়াল খুলিয়া রাজপুত্র দাঁড়াইলেন;

রাজপুত্রের পক্ষিরাজ চেঁচাইয়া বলিল,- “রাজপুত্র, পলাও, পলাও, আর রক্ষা নাই!!” রাজপুত্র বলিলেন, “পালাইব না- বন্ধুদের খাইয়াছে, রাক্ষসী মারিব!” রাজপুত্র তরোয়াল উঠাইলেন,- চোখ আঁধার, হাত অবশ।

রাক্ষসী আসিয়া রাজপুত্রকে ধরে ধরে, বনের গাছ পাথর চারিদিক হইতে বলিয়া উঠিল,- “রাজপুত্র পলাও!” তখন রাজপুত্র, দিশা হারাইয়া, যে দিকে চক্ষু যায়, দৌড়াইতে লাগিলেন ।

রাজপুত্র এক রাজার রাজ্য ছাড়িয়া আর এক রাজার রাজ্যে, – তবু রাক্ষসী পিছন ছাড়ে না। তখন নিরুপায় হইয়া রাজপুত্র সামনে এক আমগাছ দেখিয়া বলিলেন, “হে আমগাছ! যদি তুমি সত্যকালের বৃক্ষ হও, রাক্ষসীর হাত হইতে আমাকে রক্ষা কর।” আমগাছ দু’ফাঁক হইয়া গেল, রাজপুত্র তাহার মধ্যে গিয়া হাঁফ ছাড়িলেন।

রাক্ষসী গাছকে কত অনুনয়-বিনয় করিল, কত ভয় দেখাইল, গাছ কিছুই শুনিল না। তখন রাক্ষসী এক রূপসী মূর্তি ধরিয়া সেই গাছের তলায় বসিয়া কাঁদিতে লাগিল ।

সেই দেশের রাজা, বনে শিকার করিতে আসিয়াছেন। কান্না শুনিয়া রাজা বলিলেন,–“দেখ তো, বনের মধ্যে কে কাঁদে!” লোকজন আসিয়া দেখে, আমগাছের নীচে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে।

মেয়েটিকে রাজা রাজপুরীতে নিয়া গেলেন ।
রাজা সেই বনের মেয়েকে বিবাহ করিলেন। রাণী হইয়া রাক্ষসী ভাবিল, – “সেই রাজপুত্রকে কেমন করিয়া খাই।” ভাবিয়া রাক্ষসী, সাত বাসি পান্তা, চৌদ্দ বাসি তেঁতুলের অম্বল খাইয়া অসুখ বানাইয়া বসিল।

তাহার পর রাক্ষসী বিছানার নিচে শোলাকাটি পাতিল পাতিয়া সেই বিছানায় শুইয়া রঙ্গীমুখ ভঙ্গী করিয়া চোখের তারা কপালে তুলিয়া, একবার ফিরে এ-পাশ, একবার ফিরে ও-পাশ।

রাজা আসিয়া দেখেন, রাণী খান না, দান না, শুক্‌ন ঘরে জল ঢালিয়া চাঁচর চুলে আঁচড় কাটিয়া, রাণী শুইয়া আছেন। দেখিয়া রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন,- “এ কি রাণী! কি হইয়াছে?”

কথা কি ফোটে?’ কোঁকাইয়া কোঁকাইয়া’ কত কষ্টে রাণী বলিল,-“আমার হাড়মুডুমুড়ীর ব্যারাম হইয়াছে।”
রাণী গড়াগড়িতে বিছানার নিচের শোলাকাটিগুলা মুডু মুডু করিয়া ভাঙ্গিতেছিল কি-না?

রাজা ভাবিলেন,– “তাই তো? রাণীর গায়ের হাড়গুলো মুডুমুডু করিতেছে!- হায় কি হইবে!”
কত ওষুধ, কত চিকিৎসা; রাণীর কি যে-সে অসুখ? অসুখ সারিল না !

শেষে রাণী বলিল,- “ওষুধে তো কিছু হইবে না, বনের সেই আমগাছ কাটিয়া তাহার তক্তার ধোঁয়া ঘরে দিলে তবে আমার ব্যারাম সারিবে।”

রাজাজ্ঞা, অমনি হাজার হাজার ছুতোর গিয়া আমগাছে কুড়ুল মারিল ! —গাছের ভিতরে রাজপুত্র বলিলেন, “হে বৃক্ষ, যদি সত্যকালের বৃক্ষ হও, তো আমাকে একটি আমের মধ্যে করিয়া ঐ পুকুরের জলে ফেলিয়া দাও।”

অমনি গাছ হইতে একটি আম টুব্ করিয়া পুকুরের জলে পড়িল; তখনি এক রাঘব-বোয়াল সেটিকে খাবার মনে করিয়া এক হাঁয়ে গিলিয়া ফেলিল ।

ছুতোরেরা আমগাছটি কাটিয়া লইয়া গিয়া তাহার তক্তা করিয়া রাণীর ঘরের চারিদিকে খুব করিয়া ধোঁয়া দিতেছে! কিন্তু রাণী সব জানিতে পারিল; বলিল,- “নাঃ এতেও কিছু হইল না। সে পুকুরে যে রাঘব-বোয়াল আছে, তাহার পেটে একটি আম, সেই আমটি খাইলে আমার অসুখ সারিবে।”

সিঙ্গী জাল, ধিঙ্গী জাল, সব জাল নিয়া জেলেরা পুকুরে ফেলিল; রাঘব-বোয়াল ধরা পড়িল। পেটের ভিতর আম, আমের ভিতর রাজপুত্র বলিলেন,— “হে বোয়াল, যদি তুমি সত্যিকারের বোয়াল হও, তো আমাকে একটি শামুক করিয়া ফেলিয়া দাও।”

বোয়াল রাজপুত্রকে শামুক করিয়া ফেলিয়া দিল। জেলেরা বোয়াল আনিয়া পেট চিরিয়া কিছুই পাইল না । রাজা ভাবিলেন,- “আর রাণীর অসুখ সারিল না!”

এক গৃহস্থের বৌ নাইতে গিয়াছে, রাজপুত্র শামুক তাহার পায়ে ঠেকিল। গৃহস্থের বৌ শামুকটি তুলিয়া আছাড় দিয়া ভাঙ্গিতেই ভিতর
হইতে রাজপুত্র বাহির হইল। গৃহস্থের বৌ ভয়ে জড়সড়।

রাজপুত্র বলিলেন,–“বৌ, ভয় করিও না, আমি মানুষ— রাক্ষসের ভয়ে শামুকের মধ্যে রহিয়াছি। তুমি আমার প্রাণ দিয়াছ, আজ হইতে তুমি আমার হাসন সখী।”

রাজপুত্র হাসন সখীর বাড়িতে আছেন ।
রাণী সব জানিল; রাজাকে বলিল,- “আমার অসুখ তো আর কিছুতেই সারিবে না, আমার বাপের দেশে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, চিরণ দাঁতের চিকন পাটি, আর বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি আছে, সেইগুলি আনাইলে আমার অসুখ সারিবে।”

“কে আনিবে, কে আনিবে?”
“অমুক গৃহস্থের বাড়ি এক রাজপুত্র আছে, সে-ই আনিবে।”
অমনি হাজার হাজার পাইক ছুটিল।

চারিদিকে রাজার পাইক; হাসন সখী ভয়ে অস্থির। রাজপুত্র বলিলেন,– “হাসন সখী, আমারি জন্যে তোমাদের বিপদ, আমি দেশ ছাড়িয়া যাই ।”

বাহির হইতেই, পাইকেরা-রাজপুত্রকে ধরিয়া লইয়া গেল। রাজার কাছে যাইতে রাজপুত্র বলিলেন,- “মহারাজ! রাণী আপনার রাক্ষসী;- রাক্ষসীর হাত হইতে আমাকে বাঁচান । ”

শুনিয়া রাজা বলিলেন,- “মিথ্যা কথা।- তাহা হইবে না, রাণীর বাপের দেশে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, চিরণ দাঁতের চিকন পাটি, আর বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি আছে, সেই সব তোমাকে আনিতে হইবে।”

রাজা এক পত্র দিয়া রাজপুত্রকে পাঠাইয়া দিলেন ।
কি করিবেন, রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন। কোথায় সে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, কোথায় বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি— কোথায় সে রাণীর বাপের দেশ?—

রাজপুত্র ভাবিলেন- “হায়! রাক্ষসীর হাত হইতে কিসে এড়াই!” রাজপুত্র যেদিকে চক্ষু যায় চলিতে লাগিলেন।
কত দিন কত রাত চলিতে চলিতে, এক জায়গায় আসিয়া রাজপুত্র দেখে, এক মস্ত পুরী । রাজপুত্র বলিলেন,– “আহা! এতদিনে আশ্রয় পাইলাম।”

পুরীর মধ্যে গিয়া মানুষজন কিছু দেখিতে পান না,— খুঁজিতে খুঁজিতে এক ঘরে দেখেন, সোনার খাটে গা রূপোর খাটে পা এক রাজকন্যা শুইয়া আছেন। রাজপুত্র ডাকাডাকি করিলেন,- রাজকন্যা উঠিলেন না!

তখন রাজপুত্র দেখেন, বিছানার দুইদিকে দুইটি কাটি- শিয়রের কাটিটি রূপার, পায়ের দিকের কাটিটি সোনার। রাজপুত্র শিয়রের কাটি পায়ের দিকে নিলেন, পায়ের দিকের কাটি শিয়রে নিলেন। রাজকন্যা উঠিয়া বসিলেন।- “কে আপনি!

—দেব না দৈত্য, দানব না মানব, এখানে কেমন করিয়া আসিলেন?- পলাইয়া যান,- পলাইয়া যান,- এ রাক্ষসের পুরী।”
রাজপুত্রের প্রাণ শুকাইয়া গেল।— “এক রাক্ষসের হাত হইতে আসিলাম, এখানেও রাক্ষস! রাজকন্যা, আমি কোথায় যাই?”

রাজকন্যা বলিলেন,- “আচ্ছা, আপনি কে আগে বলুন।”
রাজপুত্র সকল কথা বলিলেন, তারপর বলিলেন- “আমি তো সেই রাক্ষসী রাণীর হাত আজও এড়াইতে পারিলাম না, তা এ রাক্ষসের পুরীতে এমন এক রাজকন্যা কেন?”

রাজকন্যা বলিলেন,– “এই পুরী আমার বাপের; রাক্ষসেরা আমার বাপ-মা রাজ-রাজত্ব খাইয়াছে, কেবল আমাকে রাখিয়াছে। যদি আমি পালাইয়া যাই সেই জন্য বাহিরে যাইবার সময় রাক্ষসেরা সোনার কাটি রূপার কাটি দিয়া আমাকে মারিয়া রাখিয়া যায়।”

শুনিয়া রাজপুত্র ভাবিতে লাগিলেন, কি করিয়া দুইজনে রাক্ষসের হাত হইতে এড়াইবেন।
“আঁই লোঁ মাই লো, মানুষের গন্ধ পাঁই লোঁ।
ধরে ধরে খই লোঁ! -”

সেই সময় চারিদিক হইতে রাক্ষসেরা শব্দ করিয়া আসিতে লাগিল । রাজকন্যা বলিলেন,- “রাজপুত্র, রাজপুত্র- শীগ্গীর আমাকে মারিয়া ফেলিয়া ঐ যে শিব-মন্দির আছে, ওরি মাঝে ফুল-বেলপাতার নীচে গিয়া লুকাইয়া থাকুন।”

“আঁই লোঁ মাই লোঁ’ করিয়া রাক্ষসেরা আসিল। বুড়ী রাক্ষসী রাজকন্যাকে’ বাঁচাইয়া, বলিল;-
“নানি লোঁ নানি! মানুষ মানুষ গঁন্ধ কঁয়-

মানুষ আবার কোথায় রয়?”
রাজকন্যা বলিলেন,- “মানুষ আবার থাকিবে কোথায়; আমিই আছি, আমাকে খাইয়া ফেল।”

বুড়ী বলিল, “উঁহু হুঁ নাতনি লোঁ, তাঁ’ কি পাঁরি !- এই নে নাতনি তোঁর জন্যে কঁত খাবার এঁনেচি।’ নাতনিকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া, বুড়ী আর সকল – রাক্ষস নাকে কানে হাঁড়ি হাঁড়ি সরষের তৈল ঢালিয়া নাক ডাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।

রাজকন্যা, আয়ীর মাথার পাকা চুল তোলেন আর ডেলা ডেলা এক এক উকুন দুই পাথরের চাপ দিয়া কাটস্ করিয়া মারেন।
রাজকন্যার রাত এই ভাবেই যায়।

পরদিন আবার রাজকন্যাকে মারিয়া রাখিয়া রাক্ষসেরা চলিয়া গেল । রাজপুত্র বাহির হইয়া আসিয়া রাজকন্যাকে জাগাইলেন, দুইজনে স্নান খাওয়া-দাওয়া করিলেন। রাজপুত্র বলিলেন,- “রাজকন্যা এ ভাবে কত দিন থাকিব?

আজ যখন বুড়ী আসিবে, তখন দুই কথা ছল ভাণ করিয়া ওদের মরণ কিসে আছে তাই জিজ্ঞাসা করিও।”

আবার রাক্ষসেরা আসিলে, রাজপুত্র শিবমন্দিরে গিয়া লুকাইলেন । রাজকন্যাকে খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া বুড়ী খাটের উপর বসিল।- রাজকন্যা বলিলেন,– “আয়ি, লো আয়ি, কত রাজ্য ঘুরিয়া হাঁপাইয়া হুঁপাইয়া আইলি, আয় একটু বাতাস করি, পাকা চুল দু’ গাছ তুলিয়া দি!”

“ওঁ মাঁ লোঁ মা লক্ষ্মি!” বুড়ী হাসিয়া চোখ দুইটা কপালে তুলিয়া বলিল,- “হ্যাঁ লোঁ হ্যাঁ নানি, পাঁ-টা তো কট্ কটই কচ্ছে। একটু টিপিয়া দিবি?’

“তা আর দিব না আয়ীমা?” হাঁড়ি ভরা সরষের তৈল আয়ীর পায়ের ফাটলে দিয়া রাজকন্যা আয়ীর পা টিপিতে বসিলেন।
পা টিপিতে বসিয়া রাজকন্যা চোখে তেল দিয়া কাদেন,- এক ফোটা চোখের জল বুড়ীর পায়ে পড়িল।

চমকিয়া উঠিয়া জলফোঁটা আঙ্গুলের আগায় করিয়া নিয়া জিভে দিয়া লোণা লাগিল, বুড়ী বলিল,- “নানি তুই কাঁদছিস- কেঁন লোঁ, কেঁন লৌ? তোর আবার দুঃখু কিসের?

রাজকন্যা বলিলেন,- “কাঁদি আয়ীমা, কবে বা তুই মরিয়া যাইবি, আর সকল রাক্ষসে আমাকে খাইয়া ফেলিবে।”
কুলার মত কান নাড়িয়া মূলার মত দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া আয়ী বলিল,- “ওঁরে আমার সোনার নাত্নী, মোঁদের কি মরণ আছে যে মরিব?

এ পিথিমির মোঁদের কিচ্ছুতে মরণ নাই। কেবল ঐ পুকুর যে ফটিকস্তম্ভ আছে, তাঁর মধ্যে এঁক সাঁতফণা সাঁপ আছে; এঁক নিঃশ্বাসে উঠিয়া সোনার তালগাছের তাঁলপত্র খাঁড়া পাঁড়িয়া যদি কোন রাজপুত্র ফটিকস্তম্ভ ভাঙ্গিয়া সাঁপ বাহির করিয়া বুকের উপর রাখিয়া কাঁটিতে পারে তবেই মোঁদের মরণ।

-তাঁ ঘাঁটিতে যদি এঁক ফোঁটা রক্ত পড়ে তোঁ এক এক ফোঁটায় সাঁত সাঁত হাঁজার করিয়া রাক্ষস জন্ম নিবে ৷
শুনিয়া রাজকন্যা বলিলেন,- “তবে আর কী আয়ীমা! তা, কেউ পারিবে না, তোরাও মরিবি না;-আমারও আর ভাবনা নাই।

আচ্ছা আয়ীমা! অমুক দেশের রাজার রাণী যে রাক্ষসী তা’র আয়ু কিসে আয়ীমা? আর হাসন চাঁপা নাটন কাটি চিরণ দাঁতের চিকন পার্টি, বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি কোথায় পাওয়া যায় আয়ীমা?’

আয়ী বলিল,- “আছে লো নাতনি আঁছে! যে ঘরে তোর বাঁপ থাকত সেই ঘরে আছে, আর সে ঘরে যে এঁক শুঁক, তারি মধ্যে আমার মেয়ে সেই রাণীর প্রাণ! কাউকে যেমন কঁস্ নে নানি, সব তোঁ আঁমি তোঁকেই দোবো।”

পরদিন বুড়ী সকল রাক্ষস নিয়া বাহির হইল; বলিয়া গেল,— “নানি লোঁ, আজ আমরা এই কাঁছেই থাকিব।” যে দিন, রাক্ষসেরা দূরের কথা বলে, সে দিন কাছে কাছে থাকে, যে দিন কাছের কথা বলে, সে দিন খুব দূরে দূরে যায়।

রাক্ষসেরা চলিয়া গেলে রাজপুত্র আসিয়া রাজকন্যাকে বাঁচাইয়া সকল কথা শুনিলেন তখনি স্নান-টান করিয়া, কাপড়চোপড় ছাড়িয়া শিবমন্দিরে ফুল-বেলপাতা অঞ্জলি দিয়া, রাজপুত্র নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া তালগাছে উঠিয়া তাল পত্র খাঁড়া পাড়িলেন।

তারপর পুকুরে নামিয়া স্ফটিকস্তম্ভ ভাঙ্গিয়া দেখেন, সাতফণা সাপ। রাজপুত্র সাপ নিয়া উপরে আসিলেন। পৃথিবীর সকল রাক্ষসের মাথা টনটন করিয়া উঠিল;- যে যেখানে ছিল রাক্ষসেরা ছুটিয়া আসিতে লাগিল ।-

আলুথালু চুল, এ-ই লম্বা লম্বা পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে বুড়ী সকলের আগে ছুটিয়া আসে-
“আঁই লো মাই লো, নানি লো নানি লো-
তোর মনে এই ছিল লোঁ !
তোর মুণ্ডুটা চিঁবিয়া খাঁই লোঁ!”

আর মুণ্ডু খাওয়া! রাজকন্যা বলিলেন,-“রাজপুত্র, শীগগীর সাপ কাটিয়া ফেল !
বুকের উপর রাখিয়া তালপত্র খাঁড়া দিয়া রাজপুত্র সাপের গলা কাটিয়া ফেলিলেন । এক ফোঁটা রক্তও পড়িতে দিলেন না ।

সব ফুরাইল, যত রাক্ষস পুকুর পাড়ে আসিতে আসিতেই মুণ্ডু খসিয়া পড়িয়া গেল ।
রাজপুত্র রাজকন্যা হাঁপ ছাড়িয়া ঘরে গেলেন। এক কুঠরীতে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, চিকণ দাঁতের চিকন পাটি, সব রহিয়াছে আর এক শুক পাখি ছট্‌ফট্ করিয়া চেঁচাইতেছে। সব লইয়া রাজপুত্র বলিলেন,- “রাজকন্যা, আমার দেশে চল।”

রাজকন্যাকে একখানে রাখিয়া, রাজপুত্র রাণীর ওষুধ আর শুকটি নিয়া রাজার কাছে গেলেন,- “মহারাজ, আর একবার সভা করিবেন, আমি রাণীর অসুখ সারাইব।”

ভারী খুশী হইয়া রাজা সভা করিয়া বসিলেন। রাজপুত্র কাটি, পাটি, চাঁপা, কাঁকুড় সভায় রাখিলেন। সকলে দেখে কি আশ্চর্য! রাজপুত্র বলিলেন,-“মহারাজ, রাণীকে নিজে আসিয়া এইগুলি নিতে হইবে।”

রাণীর তো ওদিকে হাড় মুডুমুড়ি গিয়া কজে ধড়ফড়ি ব্যারাম হইয়াছে— “ছেলেটা তো তবে সব নাশ করিয়া আসিয়াছে! আজ ওকে খা’ব রাজ্য খাব!!”

রাজ্য খা!— সভার দুয়ারে রাণী পা দিয়াছে, আর রাজপুত্র বলিলেন, – “ও রাক্ষসী, আমাকে খাবি?— এই দ্যাখ্!”- রাজপুত্র খাঁচা হইতে শুকটিকে বাহির করিয়া এক টানে শুকের গলা ছিঁড়েন আর কি !-

রাক্ষসী বলিল— “খাব না, খাব না, রাঁখ রাখ্!! তোঁর পায়ে পঁড়ি!”— রাণীর মূর্তি কোথায়, দাত বিকটী রাক্ষসী!!

রাজা, সভার সকলে থরথর কাপেন ।
রাজপুত্র বলিলেন, ‘দে আমার কোটাল বন্ধু দে, কোটাল বন্ধুর ঘোড়া দে! দে, আমার সওদাগর বন্ধু দে, সওদাগর বন্ধুর ঘোড়া দে! মন্ত্রিবন্ধু, মন্ত্রিবন্ধুর ঘোড়া দে, আমার ঘোড়া দে!”

রাক্ষসী হোয়াক্ হোয়াক করিয়া একে একে সব উরিয়া দিল ! তখন রাজপুত্র বলিলেন,- “মহারাজ, দেখিলেন, রাণী রাক্ষসী কি-না?”

—“এইবার রাক্ষসী-নিপাত যাও!!”
শুকের গলা ছিঁড়িল- রাক্ষসী গ্যা গ্যাঁ করিয়া পড়িয়া মরিয়া গেল । রাক্ষসীর মরণ,- মরিতে মরিতে ও মরণকাড়ি- রাজার সিংহাসন ধরিয়া টান মারে আর কি!-

সার্ সার্ করিয়া রাজা বাঁচিয়া গেলেন ।
ঘাম দিয়া সকলের জ্বর ছাড়িল। রাজা বলিলেন, – “ধন্য তুমি কোথাকার রাজপুত্র! যত ধন চাও, ভাণ্ডার খুলিয়া নিয়া যাও।”

রাজপুত্র বলিলেন,- “আমি কিছুই চাই না, এতদিন রাক্ষসীর হাত হইতে সকলে বাঁচিলাম, এখন আমরা দেশে যাইব।” রাজা শুনিলেন না, ভাঙার খুলিয়া সকল ধন রত্ন বাহির করিয়া দিলেন।

রাজকন্যাকে লইয়া রাজপুত্র, রাজপুত্রের তিন বন্ধু, দেশে গেলেন । পৃথিবীতে যত রাক্ষস জন্মের মত ধ্বংস হইয়া গেল ।
দেশে গিয়া রাজপুত্রেরা, বাপ-মায়ের আদরে, সুখে দিন গণিতে লাগিলেন ।

হাসির গল্প, সুখু আর দুখু

সুখু আর দুখু
এক তাঁতি, তা’র দুই স্ত্রী। দুই তাতীবউর দুই মেয়ে,সুখু আর দুখু । তাঁতি, বড় স্ত্রী আর বড় মেয়ে সুখকে বেশি বেশি আদর করে।

বড় স্ত্রী বড় মেয়ে ঘর-সংসারের কূটাটুকু ছিঁড়িয়া দুইখানা করে না; কেবল বসিয়া খায়। দুখু আর তার মা সূতা কাটে ঘর নিকোয়; দিনান্তে চারটি চারটি ভাত পায়, আর, সকলের গঞ্জনা সয় ।

একদিন তাঁতি মরিয়া গেল। অমনি বড় তাঁতিবউ তাঁতির কড়িপাতি যা’ ছিল সব লুকাইয়া ফেলিল, আপন মেয়ে নিয়া, দুখু আর দুখুর মাকে ভিন্ন করিয়া দিল ।

সুখুর মা আজ হাটের বড়মাছের মুড়াটা আনে, কাল হাটের বড় লাউটা আনে, রাঁধে, বাড়ে সতীন সতীনের মেয়েকে দেখাইয়া খায়।
দুখুর মা আর দুখুর দিনে রাত্রে সূতা কাটিয়া কোনো দিন একখানা গামছা কোনো দিন একখানা ঠেটী, এই হয়।

তাই বেচিয়া একবুড়ি পায়, দেড়বুড়ি পায়, তাই দিয়া মায়ে-ঝিয়ে চারিটি অন্ন পেটে দেয়।

একদিন সূতা নাতা ইঁদুরে কাটে, তুলাটুকু নেতিয়ে যায়,- দুখুর মা, সূতা গোছা এলাইয়া দিয়া তুলা ডালা রোদে দিয়া, ক্ষারকাপড়খানা নিয়া, ঘাটে গিয়াছে। দুখু তুলা আগ্লাইয়া বসিয়া আছে।

এমন সময় এক দমকা বাতাস আসিয়া র তুলাতলা উড়াইয়া নিয়া গেল। একটু তুলাও দু ফিরাইতে পারিল না। শেষে সুধু কাঁদিয়া ফেলিল।

তখন বাতাস বলিল,-” কদিনে আমার সঙ্গে আয়, তোকে তুলা দেব।” সুধু কাঁদিতে কাঁদিতে বাতাসের পিছু পিছু গেল ৷

যাইতে যাইতে পথে এক তাই দুমুকে ডাকে,- “দুখু, কোথা যাচ্ছ- আমার গোয়ালটা কাড়িয়া দিয়া যাবো।” দুখু চোখের জল মুছিয়া, গাইয়ের গোয়াল কাড়িল, খড় জন্ম দিল দিয়া আবার বাতাসের পিছু চলিন।

খানিক দূর যাইতেই এক কলাগাছ বলিল,- “দুখু, কোথা যাচ্ছ- আমায় বড় লতাপাতা ঘিরিয়াছে, এগুলিকে টেনে দিয়ে যাবে?” দুখু একটু থামিয়া কলাগাছের লতাপাতা ছিঁড়িয়া দিল।

আবার খানিক দূর যাইতে, এক সেওড়া গাছ ডাকিল,-“দুখু, কোথা যাচ্ছ আমার শুঁড়িটায় বড় জঞ্জাল ঝাড় দিয়া যাবে?” দুখু সেওড়ার শুঁড়ি ঝাড় দিল, তলার পাতাটা কুড়াইয়া ফেলিল।

সব ফিটফাট্ করিয়া দিয়া, আবার দুখু বাতাসের সঙ্গে চলিল।
একটু দূরেই এক ঘোড়া বলিল,- “দুখু, দুখু কোথা যাচ্ছ,- আমাকে চার গোছা ঘাস দিয়া যাবে?”

দুখু ঘোড়ার ঘাস দিল। তারপর চলিতে চলিতে দুখু বাতাসের সঙ্গে কোথায় দিয়া কোথায় দিয়া এক ধবধবে বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত।

বক্‌বে আয়ীমা, আমার তুলো গুনো নিয়ে দাও।”
চুলগুলো যেন দুধের ফেনা, চাঁদের আলো; সেই চুল সরাইয়া চোখ তুলিয়া চাঁদের মা বুড়ী দেখে ছোট্টখাট্ট মেয়েটি-চিনি হেন মিষ্টি-মধুর বুলি ।

বুড়ী বলিল,-“আহা সোনার চাঁদ বেঁচে থাক। ওঘরে গামছা আছে, ওঘরে কাপড় আছে, ওঘরে তেল আছে, ঐ পুকুরে গিয়া দুটো ডুব দিয়া এসো; এসে ওঘরে আগে চাট্টি খাও, তারপরে তুলো দেবো এখন।”

ঘরে গিয়া দুখু,-কত কত ভাল ভাল গামছা কাপড় দেখে, তা সব ঠেলিয়া, যা’ তা ছেঁড়া নাতা গামছা কাপড় নিয়া যেমন-তেমন একটু তেল মাথায় ছোঁয়াইয়া, এক চিমটি ক্ষার-খৈল নিয়া নাইতে গেল ৷

ক্ষার-খৈল-টুকু মাখিয়া জলে নামিয়া দুখু ডুব দিল। ডুব দিতেই এক ডুবে দুখুর সৌন্দর্য উথলে পড়ে!-সে কি রূপ! অত রূপ দেবকন্যারও নাই!— দুখু তা’ জানিতেও পারিল না। আর এক ডুবে দুখুর গয়না, গায়ে ধরে না, পায়ে ধরে না।

সোনাঢাকা অঙ্গ নিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া আসিয়া দুখু খাবার ঘরে গেল ।
খাবার ঘরে কত জিনিস, দুখু কি জানে? জন্মেও অত সব দেখে নাই ! এক কোণে বসিয়া দুখু চারটি পান্তা খাইয়া আসিল।

চাঁদের মা বুড়ী বলিল,- “আমার সোনার বাছা এসেছিস- ঐ ঘরে যা, পেঁটরায় তুলা আছে, নাও গে!”
দুখু গিয়া দেখিল,—পেঁটরার উপর পেঁটরা— ছোট, বড় ক-ত রকমের দুখু এক পাশের ছোট্ট এতটুকু এক খেলনা পেঁটরা নিয়া বুড়ীর কাছে দিল।

বুড়ী বলিল,- “আমার মানিক ধন। আমার কাছে কেন, এখন মা’র কাছে যাও, এই পেঁটরায় তুলা দিয়াছি ।” বুড়ীর পায়ের ধুলা নিয়া পেঁটরা কাঁখে, রূপে, গয়নায় ঘাট আলো কারিয়া দুখু বাড়ি চলিল পথে ঘোড়া বলিল,- “দুখু দুখু, এস এস আর কি দিব, এই নাও।” ঘোড়া খুব তেজি এক পক্ষীরাজ বাচ্চা দিল।

সেওড়া গাছ বলিল,- “দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” সেওড়া গাছ এক ঘড়া মোহর দিল।

কলাগাছ বলিল,- “দুখু, দুখু, এসএস, আর কি দিব, এই নাও।”
কলাগাছ মস্ত এক ছড়া সোনার কলা দিল।

গাই বলিল,- “দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” গাই এক কপিলা-লক্ষণ বক্‌না দিল। ঘোড়ার বাচ্চার পিঠে ঘড়া, ছড়া তুলিয়া বক্‌না নিয়া দুখু বাড়ি আসিল।

“দুখু, দুখু ও পোড়ারমুখী- তুলা নিয়া কোথায় গেলি।”- ডাকিয়া, ডুকিয়া, আনাচ কানাচ, খানা জঙ্গল খুঁজিয়া, মেয়ে না পাইয়া দুখুর মা অস্থির- দুখুর মা ছুটিয়া আসিল, “ও মা, মা আমার, এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি?”

আসিয়া দেখে— “ও মা! এ কি অন্ধের নড়ি দুঃখিনীর মেয়ে এ সব তুই কোথায় পেলি!” – মা গিয়া দুখুকে বুকে নিল ।

মাকে দুখু সব কথা বলিল, শুনিয়া দুখুর মা মনের আনন্দে দুখকে নিয়া সুখুর মা’র কাছে গেল,– “দিদি, দিদি, –ও সুখু, সুখু আমাদের দুঃখ ঘুচেছে, চাঁদের মা বুড়ী দুখুকে এই সব দিয়াছে। সুখু কতক নাও, দুখুর কতক থাক ।

চোখ টানিয়া মুখ বাঁকাইয়া- তিন ঝাক্‌না ভিরকুট্টি, সুখুর মা বলিল- “বালাই! পরের কড়ির ভাগ-বাঁটারি- তার কপালে খ্যাংরা মারি! তেমন পোদ্দারী সুখুর মা করে না! ছাই নাতা আগর-বাগর তোরাই নিয়া ধুইয়া খা।”

মনে মনে সুখুর মা বিড়বিড় –“শত্তুরের কপালে আগুন- কেন আমার সুখু কি জলে ভাসা মেয়ে? দরদ দেখে মরে যাই! কপালে থাকে তো, সুখু আমার কালই আপনি ইন্দ্রের ঐশ্বর্য লুটে আনবে।” মুখ খাইয়া দুখু দুখুর মা ফিরিয়া আসিল ।

রাত্রে পেঁটরা খুলিতেই দুখুর রাজপুত্র বর বাহির হইল। রাজপুত্র বর ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ায়, কপিলার দুধে আচায়,— দুখু, দুখুর মা’র ঘর-কুঁড়ে আলো হইয়া গেল ।

রা নাই, শব্দ নাই, সুখুর মা সামনের দুয়ারে খিল দিয়াছে। পরদিন সুখুর মা পিছন দুয়ারে তুলা রোদে দিয়া পিপিস্’ ‘ফিফিস্’ সুখুকে বসাইয়া ক্ষার কাপড়ে পুঁটলি বাঁধিয়া ঘাটে গেল ।

কতক্ষণ পর বাতাস আসিয়া সুখুর তুলা উড়াইয়া নেয়,- কুটিকুটি সুখু, বাতাসের পিছু পিছু ছুটিল ।

সেই গাই ডাকিল, – “সুখু, কোথা যাচ্ছ শুনে যাও। সুখ ফিরিয়াও দেখিল না। কলাগাছ, সেওড়া গাছ, ঘোড়া সকলেই ডাকিল, সুখ কাহারও কথা কানে তুলিল না। সুখু আরো রাগিয়া গিয়া গালি পাড়ে— “উঁ! আমি যাবো চাঁদের মা বুড়ীর বাড়ী, তোমাদের কথা শুনতে বসি।

বাতাসের সাথে সাথে সুখু চাঁদের মা বুড়ীর বাড়ি গেল। গিয়াই, “ও বুড়ি, বুড়ি, বসে বসে কি কচ্ছিস? আমায় আগে সব জিনিস দিয়ে নে, তার পর সূতো কাটিস। হুঁ! উনুনমুখী দুখু, তাকেই আবার এত সব দিয়েছেন। বলিয়া, সুখু বুড়ীর চরকা টানিয়া ভাঙ্গে আর কি!

চাঁদের মা বুড়ী অবাক।- “রাখ্ রাখ্”- ওমা! এতটুকু মেয়ে তার কাঠ কাঠ কথা, উড়নচণ্ডে’ কাণ্ড! বুড়ী চুপ করিয়া রহিল; তারপর বলিল,- “আচ্ছা, নেয়ে খেয়ে নে, তারপর সব পারি বলতে সয় না, সুখু, ‘দুড়দাড় করিয়া এ ঘর থেকে’ সবার ভাল গামছাখানা ওঘর থেকে সবার ভাল শাড়ীখানা, সুবাস তেলের হাঁড়ি, চন্দনের বাটি যত কিছু নিয়া ঘাটে গেল ।

সাতবার করিয়া তেল মাখে, সাতবার করিয়া মাথা ঘষে, ফিরিয়া ফিরিয়া চায়, সাতবার করিয়া আরশি ধরিয়া মুখ দেখে, তবু সুখুর মনের মত হয় না। তিন প্রহর ধরিয়া এই রকম করিয়া শেষে সুখু জলে নামিল ।

এক ডুবে সৌন্দর্য! এক ডুবে গহনা!!- আঃ!!!- আর সুখুকে পায় কে? সুখু এদিকে চায়, সুখু ওদিকে চায়, “যত যত ডুব দিব, না জানি আরো কি পাব!”

আঁই-আই-আই!!!”-তিন ডুব দিয়া উঠিয়া সুখু দেখে, গা-ভরা আঁচিল, ঘা পাঁচড়া- এ-ই নখ, শোণের গোছা চুল— কত কদর্য সুখুর কাপালে! “ওঁ মাঁ, মাঁ গোঁ !- কি হল গোঁ-কাঁদিতে কাঁদিতে সুখু বুড়ীর কাছে গেল।

দেখিয়া বুড়ী বলিল,- “আহা আহা ছাইকপালি,-তিন ডুব দিয়াছিলি বুঝি? –যা, কাঁদিসনে যা, বেলা ব’য়ে গেছে, খেয়ে দেয়ে নে!”

বুড়ীকে গালি পাড়িতে পাড়িতে সুখু খাবার ঘরে গিয়া পায়েস পিঠা ভাল ভাল সব খাবার খাবলে খাবলে খাইয়া ছড়াইয়া হাত-মুখ ধুইয়া আসিল- “আচ্ছা বুড়ি, মাঁর কাছে আগে যাঁই। দেঁ তুই পেঁটরা দিবি কি না দে।”

বুড়ী পেঁটরার ঘর দেখাইয়া দিল। য-ত বড় পারিল, এ-ই মস্ত এক পেটরা মাথায় করিয়া সুখু বিডুবিডু করিয়া বুড়ীর চৌদ্দ বুড়ীর মুণ্ডু খাইতে খাইতে রূপে দিক্ চম্‌কাইয়া বাড়ি চলিল !

সুখুর রূপ দেখিয়া শিয়াল পালায়, পথের মানুষ মূর্ছা যায় ।
পথে ঘোড়া এক লাথি মারল; সুখু করে—“আই আই!” সেওড়া গাছের এক ডাল মটাস করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, সুখু করে— “মলাম!

মঁলাম!” কলাগাছের এক কাঁদি কলা ছিঁড়িয়া পিঠে পড়িল; সুখু বলে— “গেঁলাম । গেলাম!” শিং বাঁকা করিয়া, গাই তাড়া করিল, ছুটিতে ছুটিতে হাঁপাইয়া আসিয়া সুখু বাড়িতে উঠিল ।

দুয়ারে আলপনা দিয়া, ঘট পল্লব নিয়া জোড়া পিঁড়ি সাজাইয়া সুখুর মা বসিয়া ছিল। বারে বারে পথ চায়-
সুখকে দেখিয়া, সুখুর মা “ও মা! মা! ও মা গো, কি হবে গো !

কোথায় যাব গো !”
চোখের তারা কপালে, আছাড় খাইয়া পড়িয়া সুখুর মা মূর্ছা গেল । উঠিয়া সুখুর মা বলে, “হক হ’ক অভাগী, পেটরা নিয়ে ঘরে তোল্; দ্যাখ আগে, বর এলে বা সব ভাল হইবে!”

দুইজনে পেঁটরা নিয়া ঘরে তুলিল। রাত্রে পেঁটরা খুলিয়া, সুখুর বর বাহির হইল ! সুখু বলে,–“মা, পা কেন কন্ কন্?”
মা বলিল,-“মল পর।”

সুখ–“মা, গা কেন ছন্ ছন্?’ মা- “মা, গয়না পর।”
তারপর সুখুর হাত কট কট, গলা ঘড় ঘড়, মাথা কচ কচ ক-ত করিল,–সুখু হার পরিল, নথ নোলক, সিথি পরিয়া টরিয়া সুখু চুপ করিল । মনের আনন্দে, সুখুর মা ঘুমাইতে গেল ।

পরদিন সুখু আর দোর খোলে না,-“কেন লো,-কত বেলা, উঠবি না?”
নাঃ, নাওয়ার খাওয়ার বেলা হইল, সুখু উঠে না। সুখুর মা গিয়া কবাট খুলিল।

-“ও মা রে মা!” সুখু নাই, সুখুর চিহ্ন নাই— ঘরের মেজেতে হাড়-গোড়, অজগরের খোলস। -অজগরে সুখকে খাইয়া গিয়াছে!! চেলাকাঠ মাথায় মারিয়া সুখুর মা মরিয়া গেল ।

হাসির গল্প, নীলকমল ও লালকমলের কথা

নীলকমল ও লালকমলের কথা
এক ছিল গরিব ব্রাহ্মণ। ব্রাহ্মণ খুব অলস, সারাদিন শুধু শুয়ে বসে দিন কাটাত, কাজ করতে চাইত না, শহরের এক কোণে ব্রাহ্মণীকে নিয়ে থাকত! কোন ছেলেপুলে ছিল না, ফলে স্বামী-স্ত্রী কারোরই মনে সুখ ছিল না।

একদিন ব্রাহ্মণী জানতে পারল পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজার ছেলের বিয়ে। বিয়ে হবে খুব ধূমধাম করে, সেই উপলক্ষ্যে সকল রাজ্যের ব্রাহ্মণদের আমন্ত্রণ করেছে, বিয়ের দিন সকালে ব্রাহ্মণী স্বামীকে বলল— তুমি যাও না গো সেখানে, অনেক উপহার পাবে, আমাদের এই অভাব দূর হয়ে যাবে।

অলস ব্রাহ্মণ মাটিতে শুয়েছিল, স্ত্রীর কথায় বিরক্ত হয়ে বলল—দূর, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে, ভিক্ষে করে খেয়েপরে আমরা ভালই আছি, কি দরকার এতটা পথ কষ্ট করে যাওয়ার।

ব্রাহ্মণী রেগে গেল, চোখ ছল ছল করে বলল—’তা কেন যাবে? সারাদিন শুধু কুম্ভকর্ণের মত ঘুমোবে? এদিকে চাল, ডাল যে বাড়ন্ত সেদিকে লক্ষ নেই, এই আমার মাথার দিব্যি রইল, তুমি যদি না যাও আমার মরা মুখ দেখবে।’

অগত্যা ব্রাহ্মণ আর কী করে? অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাটতে শুরু করে।
ব্রাহ্মণ সেই রাজ্যের পথ জানত না, পথ চলতে চলতে কারোকে জিজ্ঞাসাও করল না, ফলে ব্রাহ্মণ ভুল পথে চলতে লাগল।

চলছে তো চলছেই, যেতে যেতে একসময় অনেক দূর চলে গেল, চলার পথ শেষ হয়ে গেল, শুরু হল গভীর জঙ্গল, ব্রাহ্মণ আনমনা হয়ে জঙ্গলের পথে চলতে লাগল।

অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর ব্রাহ্মণ দেখল, মস্ত এক কড়ির পাহাড়। রাশি রাশি কড়ি পড়ে আছে, ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল রাজ্যে এমন একটা কড়ির পাহাড় আছে অথচ রাজ্যের কেউ তা জানে না?

ব্রাহ্মণ আবার চলতে লাগল, খানিকটা পথ অতিক্রম করার পর দেখতে পেল পয়সার পাহাড়; অজস্র পয়সা স্তূপাকার হয়ে পড়ে আছে।

আর একটু পথ এগোলে দেখতে পেল সিকির পাহাড় এই ভাবে চলতে চলতে দেখতে পেল আধুলির পাহাড়, টাকার পাহাড়, সব শেষে দেখতে পেল মোহরের পাহাড়।

রাশি রাশি মোহর পড়ে আছে, সূর্যের আলোয় চকচক করছে, ব্রাহ্মণের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। অবাক দৃষ্টিতে মোহর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ভাবল, এত মোহর এখানে পড়ে আছে অথচ আমরা কেউ তা জানি না?

অভিভূত হয়ে ব্রাহ্মণ ধীরপায়ে পাহাড়ের দিকে এগিয়ে চলল। দেখতে পেল মোহরের পাহাড়ের নীচে বিশাল এক অট্টালিকা। অট্টালিকার সামনে রত্নখচিত দরজা, দরজার দিকে তাকাতেই ব্রাহ্মণ দেখতে পেল এক অপরূপ সুন্দরী রাজকন্যা দাঁড়িয়ে আছে।

রাজকন্যা ব্রাহ্মণকে দেখামাত্র খুশিতে উচ্ছসিত হয়ে এগিয়ে এসে বলল—‘এতদিন পরে তবে আমার কথা মনে পড়েছে?’
রূপবতী কন্যার কথায় ব্রাহ্মণ চমকে উঠল, বলল—’কে তুমি? আমি তো তোমায় চিনতে পারছি না?’

রূপবতী কন্যা বলল—‘আমায় চিনতে পারবে কি করে? সে কী আজকের কথা, যখন তুমি আমি ছোট ছিলাম তখন আমাদের বিয়ে হয়েছিল।

এই প্রাসাদ সেদিন আনন্দমুখর হয়ে উঠেছিল, সানাইয়ের মিষ্টি সুরে আকাশ বাতাস উত্তাল হয়ে উঠেছিল। তুমি সব ভুলে গেছ, আমি কিন্তু ভুলিনি, আমার সব মনে আছে। এস হাত মুখ ধুয়ে বিশ্রাম কর।’

রূপবতী কন্যার কথা শুনে ব্রাহ্মণ আকাশ থেকে পড়ল, চিন্তা করতে লাগল। কিন্তু তার তো কিছু মনে পড়ছে না। হতেও পারে, কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তানদের তো একাধিক বিয়ে হয়।

হয়ত খুব ছোটবেলায়, এই কন্যার সাথে বিয়ে হয়েছিল, পিতা মাতা বেঁচে থাকলে হয়তো সবকিছু জানা যেত, ব্রাহ্মণ অসহায় কণ্ঠে বলল—’কন্যে আমার কিন্তু কিছুই মনে পড়ছে না।

রূপবতী কন্যা মধুর হাসি হেসে বলল—‘থাক তোমাকে আর কষ্ট করে মনে করতে হবে না, এতটা পথ অতিক্রম করে এসেছ এবার বিশ্রাম কর।’

এই বলে রূপবতী কন্যা ব্রাহ্মণের হাত ধরে অট্টালিকার অন্দরে নিয়ে গেল। বিরাট বিরাট ঘর, নানারকম মণিমুক্তো আসবাবপত্র দিয়ে সুসজ্জিত।

ব্রাহ্মণ অবাক হয়ে দেখতে লাগল, আর বেশি অবাক হল যখন জানতে পারল, এত বড় অট্টালিকায় রূপবতী কন্যা একা থাকে। এর কারণ জানতে চাইলে রূপবতী কন্যা এক করুণ কাহিনী শোনাল ।

আসলে ঐ রূপবতী কন্যা এক মায়াবী রাক্ষসী, মায়ার অলৌকিক ক্ষমতায় সে সুন্দরী কন্যার রূপ ধারণ করেছে। এইভাবে সে এক এক করে সেই রাজ্যের রাজা ও প্রজাবর্গকে উদরে চালান করে দিয়ে জনমানবশূন্য জঙ্গলে পরিণত করেছে।

এখন সে জঙ্গলের মধ্যে এই অট্টালিকায় বসবাস শুরু করেছে। একদিন মায়াবী রাক্ষসী ব্রাহ্মণকে বলল—‘ওগো তুমি না হয় ভুল করে আর একটা বিয়ে করে ফেলেছ, কিন্তু সে বেচারীর কি দোষ? তুমি বরং তাকে এখানে নিয়ে এস।’

ব্রাহ্মণ ভাবল দুই বউ এক সাথে হওয়া মানেই অশান্তির সৃষ্টি। তাই বলল—‘না থাক, ও শহরে আছে সেখানেই থাক আমি বরং মাঝে মাঝে গিয়ে দেখে আসব।’

ছদ্মবেশী রাক্ষসী অভিমানী গলায় বলল, ‘ও তুমি ভাবছ আমি সতীনের সাথে অশান্তি করব? তুমি যাও, তাকে নিয়ে এস। আর কষ্ট দিও না।

এই কথা বলে ছদ্মবেশি রাক্ষসী ব্রাহ্মণের বউ-এর জন্য দামি দামি শাড়ি, ভাল ভাল খাবার এবং গয়না ব্রাহ্মণের হাতে দিল। ব্রাহ্মণ সেই সব উপহার নিয়ে খুশি হয়ে শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।’

এদিকে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজপুত্রের বিয়ে হয়ে গেছে। এক এক করে সব ব্রাহ্মণেরা পর্যাপ্ত উপহার নিয়ে খুশি মনে শহরে ফিরতে লাগল।

ব্রাহ্মণী স্বামীর আগমনের অপেক্ষায় বসে থাকে, সব সময় তার মনে হয় এই এল বলে, কিন্তু স্বামী আর আসে না, তখন বাধ্য হয়ে ব্রাহ্মণী প্রতিবেশি ব্রাহ্মণদের কাছে তার স্বামীর খোঁজ নেয়।

তারা সবাই অবাক হয়ে বলে না তো আমাদের সাথে তো যায়নি, তাছাড়া রাজবাড়িতেও দেখতে পাইনি, নিশ্চয় পথ ভুল করে অন্য কোথাও চলে গেছে ।

ঐ সব অলুক্ষণে কথা শুনে ব্রাহ্মণী বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগল আর নিজেকে দোষ দিতে লাগল, সে না জোর করে পাঠালে আজ এমন ঘটনা ঘটত না।

ব্রাহ্মণী খাওয়া দাওয়া ত্যাগ করে সারাদিন শুধু স্বামীর কথা ভেবে চোখের জল ফেলতে লাগল একদিন সকালে একদল লোক ব্রাহ্মণীর বাড়ি এসে বলল-—’দামি পোশাকে সজ্জিত হয়ে ব্রাহ্মণ আসছে, হাতে নানারকম উপহার, একথা শুনে ব্রাহ্মণীর আনন্দ আর ধরে না।’

ব্রাহ্মণী পরম যত্নে স্বামীকে বাড়ি নিয়ে এল, জল দিয়ে পা ধুইয়ে দিল, আঁচল দিয়ে সেই পা মুছিয়ে দিল। সেদিন রাতের আহার শেষ করে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে সেই অট্টালিকার কথা বলল।

আরও বলল, আগামীকাল ভোরে এই শহর ছেড়ে চলে যাবে। একথা শুনে ব্রাহ্মণী আতঙ্কিত হয়ে বলল——তুমি জান না, তুমি মায়াবী রাক্ষসীর হাত থেকে বেঁচে এসেছ, আবার ঐ রাক্ষসীর কাছে যাবে, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?’

ব্রাহ্মণীর কথায় ব্রাহ্মণ বিরক্ত হয়ে বলল—’গিন্নী তুমি একবার দেখলে একথা বলতে না, কি আশ্চর্য রূপ তার, তেমনি ব্যবহার, আমাকে কত যত্ন করেছে, যদি রাক্ষসী হত তবে কী আমাকে ফিরতে দিত।’

ব্রাহ্মণের কথাটা ব্রাহ্মণীর মনে ধরল, ভাবল, সত্যিইতো যদি রাক্ষসীই হবে তবে কি আর তার স্বামী ঐ রাক্ষসীর হাত থেকে নিস্তার পেতো?

ব্রাহ্মণ স্ত্রীকে চুপ করে ভাবতে দেখে বলল—’গিন্নী চিন্তা করার কিছু নেই, এতদিন পর ঈশ্বর আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে, চল কালই আমরা এসব ছেড়ে চলে যাই।’

পরদিন ভোরবেলা ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণী বেরিয়ে পড়ল, এক এক করে তারা সিকির পাহাড়, আধুলির পাহাড় এবং টাকার পাহাড় অতিক্রম করে সর্বশেষে উপস্থিত হল মোহরের পাহাড়ের নীচের অট্টালিকায়।

ছদ্মবেশী রাক্ষসী অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণীকে আসতে দেখে তাদের সমাদর করে অট্টালিকার ভিতরে নিয়ে গেল । ব্রাহ্মণীর গলা জড়িয়ে ধরে বিগলিত কণ্ঠে বলল—‘এতদিনে আমার আশা মিটল, বোন আর তোমাকে ছাড়ছি না, এবার থেকে তুমি আমার কাছে কাছে থাকবে।’

ব্রাহ্মণীর মনের ভয় দূর হয়ে গেল, বিশাল অট্টালিকায় তিনজন সুখেই দিন কাটাতে লাগল। দেখতে দেখতে দশ বছর কেটে গেল, রাক্ষসী তার আসল স্বভাব ভুলে গিয়ে মানুষের মত কালযাপন করতে লাগল ।

এক সময় ছদ্মবেশি রাক্ষসীর ঘরে একটা পুত্র সন্তান জন্ম নিল । ব্রাহ্মণ খুশি হয়ে তার নাম রাখল নীলকমল। দেবতার মত রূপ তার, কাঁচা সোনার মত গায়ের রং। তার ঠিক দেড় বছর বাদে ব্রাহ্মণীর ঘরে একটা পুত্র সন্তান হল, ব্রাহ্মণ তার নাম রাখল লালকমল।

লালকমল আর নীলকমল ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগল, তাদের আন্তরিকতা দেখে কে বলবে তারা বৈমাত্রেয় ভাই। শুভ দিন দেখে ব্রাহ্মণ অট্টালিকা থেকে এক ক্রোশ দূরে একটি পাঠশালায় তাদের ভর্তি করে দিল।

প্রতিদিন দুই ভাই দুটো পদ্মখীরাজ ঘোড়ায় চড়ে পাঠশালায় হাজির হয়। ব্রাহ্মণ রাতদিন বাড়িতে শুয়ে বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, মনে মনে ভাবল এই ভাবে রাতদিন বসে থাকলে একদিন হয়তো অসুস্থই হয়ে পড়ব তার চাইতে জঙ্গলে ঘুরে শিকার করলে শরীর মন দুই-ই ভাল থাকবে।

পরদিন থেকেই ব্রাহ্মণ শিকারে বেরিয়ে পড়ল। সারাদিন বনে জঙ্গলে কাটিয়ে বেলা শেষে শিকার নিয়ে ঘরে ফিরত। কোন কোন দিন রাজহাঁস আবার হরিণও মিলে যেত। যেদিন হরিণ শিকার করে নিয়ে আসতো ব্রাহ্মণী এবার ভীষণ রেগে বলল—’খাও মানে!

আমি স্বচক্ষে দেখেছি, শুধু আজ নয় প্রায়দিনই তুমি কাঁচা মাংস খাও।’
ছদ্মবেশি রাক্ষসী এবার ভয়ঙ্কর গর্জন করে বলল—তবে রে জেনেই যখন গেছিস তখন ভাল করেই জেনে নে, কাল তোকে আমি খাব।

এই কথা বলে ছদ্মবেশি রাক্ষসী দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ।’
ব্রাহ্মণী মনে মনে ভাবছে এতটা বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি। জানতে যখন পেরেছিল, এ আসলে মানবী নয় মায়াবী তখন আস্তে আস্তে কেটে পড়াই উচিত ছিল । এখন কী হবে?

ব্রাহ্মণী আপন মনে ভেবে চলেছে কীভাবে কী করা যায়, এই ভাবে প্রায় এক প্রহর কেটে গেল।

ভেবেছিল সব কথা খুলে বলবে ব্রাহ্মণকে, কিন্তু সেদিন আর ব্রাহ্মণ এমুখো হয়নি, তার মানে ছদ্মবেশি রাক্ষসী ছলনায় ব্রাহ্মণকে আটকে রেখেছে, এই ভাবে ভোর হয়ে এল, ব্রাহ্মণী আর সময় নষ্ট করল না, একমাত্র সন্তান লালকমলকে ঘুম থেকে তুলে বিস্তারিত ঘটনা বলল।

আরো বলল, আগামীকাল হয়ত ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণীর শেষ দিন। ছদ্মবেশি মায়াবী তাদের মেরে ফেলবে, তাই লালকমল যেন স্কুল থেকে আর এই অট্টালিকায় না ফেরে।

আর একটা কৌটো লালকমলের হাতে দিয়ে বলল, এই কৌটোতে আমার স্তনের দুধ আছে, তুমি এই কৌটো নজরে রাখবে। যখন দেখবে কৌটোর দুধ রক্তিম আকার নিয়েছে ভাববে তোমার বাবার বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে চলে যেও, ভুলেও এই অট্টালিকার পথে পা দিও না ।

পরদিন সকালে নীলকমল আর লালকমল পাখীরাজ ঘোড়ায় করে পাঠশালায় চলে গেল। বিদ্যালয়ে যেতে যেতে লালকমল কৌটোটা খুলে দেখছিল। নীলকমল ঐ কৌটোর মধ্যে কী আছে জানতে চাইলে লালকমল এড়িয়ে গেল ।

এদিকে ভোরবেলা ছদ্মবেশি রাক্ষসী ব্রাহ্মণকে বলল—‘চল আজ আমি আর তুমি পুকুরে একসাথে স্নান করব।’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্রাহ্মণ রাজি হল । রাক্ষসী নিজরূপ ধারণ করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল ।

লালকমল পক্সখীরাজ ঘোড়ায় বসে কৌটো খুলতেই দেখতে পেল মায়ের দেওয়া দুধ ঈষৎ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে, বুঝতে পারল রাক্ষসী তার বাবাকে হত্যা করেছে। লালকমলের দু’চোখ দিয়ে অশ্রুর ধারা নেমে এল।

চিৎকার করে কেঁদে উঠল, পক্মখীরাজ ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিল, পিছনে নীলকমল আসছিল, ভাইকে চিৎকার করে কাঁদতে দেখে তার ঘোড়ার গতি বাড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে লালকমলকে ডাকতে লাগল ।

এদিকে ব্রাহ্মণের গোটা শরীরটা রাক্ষসী পেটে চালান করে দিয়ে ব্রাহ্মণীকে খেতে লাগল ।
লালকমল ঘোড়ায় করে ছুটতে ছুটতে দেখতে পেল কৌটোর দুধ একেবারে রক্তিমবর্ণ ধারণ করেছে।

বুঝতে পারল রাক্ষসী এবার তার মাকে শেষ করেছে। লালকমল আর পদ্মখীরাজ ঘোড়া চালাতে পারল না, চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ভাইকে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেখে নীলকমল তার ঘোড়া থামিয়ে ব্যস্ত হয়ে ভাইয়ের মাথার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। লালকমলের মাথা নিজের কোলে নিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করতে লাগল—‘ভাই তোমার কী হয়েছে?

লালকমল কাঁদতে কাঁদতে নীলকমলের কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। বলল—‘দাদা তোমার রাক্ষসী মা আমার মাকে এবং বাবাকে শেষ করেছে। এবার আমাকে শেষ করবে বলে আসছে।’

লালকমলের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা জঙ্গলে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। জঙ্গলের গাছে গাছে ধাক্কা খেতে লাগল, ভয়ঙ্কর অট্টহাসি। লালকমল দাদাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকাল। নীলকমল ছোট ভাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল—ভয় নেই ভাই, যতক্ষণ আমি তোমার পাশে আছি ততক্ষণ কার সাধ্যি তোমার শরীরে আঁচড় কাটে।’

নীলকমলের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে রাক্ষসী সেখানে উপস্থিত হল। ছোট ভাইকে আড়াল করে সে কোমর থেকে তরবারী খুলে রুখে দাঁড়াল।

রাক্ষসী ছেলেকে রুখে দাঁড়াতে দেখে বিকৃত স্বরে বলল, নীলকমল আমি তোর মা। আমি তোর কোন ক্ষতি করব না, ওকে আমার হাতে তুলে দে। নীলকমল তখন আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না, ধারালো তরবারী নিয়ে রাক্ষসীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

চিৎকার করে বলল—‘কোন রাক্ষসী আমার মা হতে পারে না। এই বলে নীলকমল এক কোপে রাক্ষসীর গলা থেকে মুণ্ডুটা নামিয়ে দিল। সে কী তীব্র গর্জন, বড় বড় পাহাড় প্রমাণ গাছগুলো নিয়ে রাক্ষসী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে লাগল।

নীলকমল ভাই-এর হাত ধরে উল্টোদিকে ছুটতে লাগল । ছুটতে ছুটতে এক সময় তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। লালকমল ব্যথিত স্বরে বলল–দাদা আর পারছি না।

নীলকমল অসহায় চোখে চারদিকে আশ্রয়ের সন্ধান করতে করতে চোখ মুখ খুশিতে ভরে উঠল। বলল—‘ঐ দেখ ভাই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। চল আমরা ঐ বাড়িতে আশ্রয়ের সন্ধান করি।

বাড়িটার সামনে এসে নীলকমল দেখল বাড়ির সামনে এক বৃদ্ধ গালে হাত দিয়ে বসে আছে।’ নীলকমল তার সামনে গিয়ে বলল— মহাশয় পথশ্রমে আমরা বড় ক্লান্ত।

যদি আপনার গৃহে আজকের দিনটা আশ্রয় মেলে তবে বড়ই উপকার হয় বৃদ্ধ দু’জন কিশোরকে দেখে খুশির কণ্ঠে বলল—‘এস বাড়ির ভেতরে এস।’

এই বলে বৃদ্ধ তাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসতে দিল । অনাহারে পথশ্রমে ওরা খুবই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। বেলা গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে এল, তারপর দু’জনের ঘুম ভাঙ্গল, ঘুম থেকে ওঠে শুনতে পেল পাশের ঘরে কারা যেন আলোচনা করছে।

কৌতুহলী হয়ে নীলকমল পাশের ঘরের জানলায় চোখ রেখে দেখতে পেল, সেই বাড়িরই লোকেরা ঐ ঘরে বসে বিমর্ষ মুখে কী সব আলোচনা করছে। সকলের মুখে চোখে আশঙ্কার ছাপ, একজন বলছে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না, আমি সেখানে যাব।

বৃদ্ধটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল—“না না তা কী করে হয়, আমার তিনকাল চলে গেছে আমারই যাওয়া উচিত। ‘পাশে দণ্ডায়মান বৃদ্ধার স্ত্রী চোখের জল মুছতে মুছতে বলল—না বাপু তোমাদের কারো যেতে হবে না। আমি যাব।’

গোলা এই সব কথাবার্তা শুনে নীলকমল বা লালকমল কারোরই ব্যাপারটা বোধগম্য হল না। নীলকমল ঐ ঘরে প্রবেশ করে বলল—মহাশয় একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

নবাগত অতিথির কণ্ঠস্বর শুনে সবাই চমকে উঠল, বৃদ্ধ বলল—“কী জানতে চাইছ?’
নীলকমল তাদের সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল—কী এমন ঘটনা ঘটেছে যার জন্য আপনারা এত চিন্তিত? বৃদ্ধ বিমর্ষ গলায় বলল – তা জেনে তোমাদের লাভ কী? তোমরা নাবালক ৷’

নীলকমল গম্ভীর কণ্ঠে বলল—‘আমরা হয়তো আপনার কাছে নাবালক ঠিকই, তবে আপনি যদি সম্পূর্ণ ঘটনা বলেন, এবং আমাদের দ্বারা কোন উপকার সম্ভব হয় আমরা তা করতে রাজি আছি।’

বৃদ্ধ অবাক হয়ে বলল—’ঠিক আছে, তুমি যখন শুনতে চাইছ তখন বলছি। আমাদের নগরের শেষ প্রান্তে একটা শিব মন্দির আছে, সেই শিব মন্দিরে একদিন হঠাৎ এক রাক্ষসের আবির্ভাব হয়। রাতের অন্ধকারে নগরের জনবহুল স্থানে প্রবেশ করে মানুষদের মেরে ফেলে।

রাক্ষসের অত্যাচারে সমস্ত নগরবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠল। সন্ধ্যার পর সমস্ত নগরের রাস্তাঘাট নিঝুম হয়ে যেত, আতঙ্কে কোন মানুষ রাস্তায় চলাচল করতো না। কিন্তু তাতে করেও নিস্তার ছিল না। সেই রাক্ষস গভীর রাতে নগরের বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষ ধরে খেত।

শেষ পর্যন্ত সমস্ত নগরবাসী রাজার শরণাপন্ন হল। রাজার কানে এই খবর যেতে মহারাজ রাক্ষসকে হত্যা করার জন্য সেপাই পাঠালেন। তাদের দূর্ভাগ্য তারা কেউ আর বেঁচে ফিরতে পারল না।

মহারাজ বাধ্য হয়ে রাক্ষসের সাথে শর্ত স্থাপন করেন যে, প্রতিদিন মধ্যরাতে শিব মন্দিরের সামনে একটি করে মানুষ রাক্ষসের জন্য মজুত থাকবে। সেই শর্ত অনুযায়ী আজ আমাদের পালা। আমাদের পরিবারের যে কোন একজন আজ রাক্ষসের পেটে যাবে।

এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
বৃদ্ধের কথা শুনে নীলকমল বলল—‘এই ব্যাপার! আপনারা এত ভেঙ্গে পড়ছেন কেন? দায়িত্বটা আমাদের দুই ভাইয়ের ওপর ছেড়ে দিন।’ বৃদ্ধ অবাক হয়ে বলল—“তোমরা আমাদের অতিথি। আমরা কখনও চাই না তোমরা কোন বিপদে পড় । আমাদের কপালে যা আছে তাই হবে।’

নীলকমল প্রতিবাদের কণ্ঠে বলল——এ কথা বলে আপনি আমাদের অবজ্ঞা করছেন। আমরা অতিথি হলেও এখন আপনাদের পরিবারেরই একজন। এখন আপনাদের সাহায্য করা কর্তব্য ।

তাছাড়া মিথ্যাই ভয় পাচ্ছেন, ঐ রাক্ষস আমাদের কিছু করতে পারবে না। আমরা আপনাদের এই রাজ্যের সকলকে চিরদিনের জন্য রাক্ষসের অত্যাচার থেকে বাঁচাতে পারব।’

বৃদ্ধের পরিবারের সকলে নীলকমলের কথায় আপত্তি করতে লাগল, কিন্তু নীলকমল জেদ করে বৃদ্ধকে বলল—’আপনারা অনুগ্রহ করে এবার আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিন, আপনাদের কোন চিন্তা করতে হবে না ।’

নীলকমল ও লালকমল পাখীরাজ ঘোড়া নিয়ে যাত্রা শুরু করল। মন্দিরের ভিতর প্রবেশ করে দুই ভাই মন্দিরের দরজা বন্ধ করে তলোয়ার খুলে রাক্ষসের আসার অপেক্ষায় বসে রইল ।

দেখতে দেখতে রাত্রি প্রায় একপ্রহর হয়ে গেল। ছোট ভাই লালকমল বলল—“দাদা আমার খুব ঘুম পেয়েছে।’
নীলকমল ছোট ভাইকে বলল—’তুই আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়।’

এক প্রহর অতিক্রান্ত হওয়ার পর হঠাৎ মন্দিরের মধ্যে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। উত্তরের বাতাস শোঁ শোঁ করে গর্জন করতে আরম্ভ করল, নীলকমল বুঝতে পারল এবার রাক্ষস আসছে।

একটু পরেই দরজায় জোরে আঘাত করে রাক্ষস ভয়ংকর গলায় জিজ্ঞাসা করল—‘ভেতরে কে আছিস। দরজা খুলে দে আমি তোকে খাব ।’

নীলকমল কিন্তু রাক্ষসের কণ্ঠস্বরে মোটেই ভয় পেল না। জোর গলায় বলল——আমি নীলকমল, এখানে জেগে বসে আছি।’
রাক্ষস গলার শব্দে থমকে গেল, এ তো কোন মানুষের কণ্ঠস্বর নয়! এ যে তার নিজের বংশের কারোর কণ্ঠস্বর। রাক্ষস ভাবল রাজা নিশ্চয়ই এখনও তার জন্য মানুষ পাঠায়নি। সে তখন ফিরে গেল ।

আবার রাত্রি দ্বিতীয় প্রহরে মন্দিরের দরজায় করাঘাত করে রাক্ষস বলল—‘হাঁউ মাঁউ কাঁও মানুষের গন্ধ পাঁউ, ঘরে কে আছিস দরজা খুলে দে।’ নীলকমল জেগেই বসেছিল বলল——আমি নীলকমল, আমার ভাই লালকমল আর দুটো পক্মখীরাজ ঘোড়া এ ঘরে আছে।’

পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে রাক্ষস আবার ফিরে গেল। তৃতীয় প্রহরে নীলকমলের চোখ ভারী হয়ে এল, ছোট ভাই লালকমলকে জাগিয়ে বলল—‘ভাই আমার বড্ড ঘুম পেয়েছে, এবার তুমি পাহারা দাও। আমি একটু ঘুমিয়ে নিই’, দাদার কথায় লালকমল রাজি হয়ে গেল ।

নীলকমল লালকমলের পাশে শুয়ে পড়ল, শুয়ে বলল—ভাই লালকমল তোমাকে একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, রাক্ষস অনেকবার এসেছিল। আমি বিদায় করে দিয়েছি, আর একবার হয়তো আসতে পারে চতুর্থ প্রহরে। যদি আর না আসে তবে অহেতুক রাত্রি জেগে লাভ নেই।

চতুর্থ প্রহরে যদি রাক্ষস আসে তবে শুনতে পাবে দরজায় করাঘাত করে বলছে “হাউ মাউ কাঁও মানুষের গন্ধ পাউ” ঘরে কে আছিস দরজা খুলে দে। খবরদার তুমি দরজা খুলবে না, ভেতর থেকে বলবে নীলকমল ও তার ভাই লালকমল ও দুটো পক্ষীরাজ ঘোড়া আছে।

দেখবে রাক্ষস চলে যাবে। ভুলে আবার নীলকমলের নাম বাদ দিও না, সবার প্রথমে নীলকমলের নাম বলবে।’
নীলকমল ঘুমিয়ে পড়ল, চতুর্থ প্রহরে লালকমল হঠাৎ শুনতে পেল বাতাসের তীব্র গর্জন, মনে হল চারদিক থর থর করে কাঁপতে লাগল, তারপর দরজায় জোরালো করাঘাতের শব্দ।

লালকমল ভয়ে শিউরে ওঠল । হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। রাক্ষসটা দরজার বাইরে থেকে বলল—“হাঁউ মাউ কাউ মানুষের গন্ধ পাউ” ভেতরে কে আছিস দরজা খুলে দে।

লালকমল আমতা আমতা করে বলল—‘আমি লালকমল দাদা নীলকমল আর দুটো পক্মখীরাজ ঘোড়া আছে।’
ব্যাস আর যায় কোথায়। রাক্ষস বুঝতে পারল নীলকমল নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে, এক আঘাতে দরজা ভেঙ্গে ফেলল ।

লালকমল ভয়ে কেঁদে উঠল, দরজা ভাঙ্গার শব্দে নীলকমলের ঘুম ভেঙ্গে গেল, বড় মড় করে উঠে কোমরের খাপ থেকে তলোয়ার বের করে চলে এল দরজার সামনে, রাক্ষসটা যখন দরজার ভেতরে মাথা গলাতে গেল, নীলকমল তলোয়ারের এক কোপে ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা করে দিল।

বিকট চিৎকার করে রাক্ষসের দেহটা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে মন্দিরে ঘুমিয়ে পড়ল। এদিকে শিবমন্দিরের বাইরে রাক্ষসের দেহটা লম্বালম্বি হয়ে পড়ে রইলো।

পরদিন সকালে একদল কাঠুরে কাঠ কাটতে জঙ্গলে প্রবেশ করে দেখতে পেল, জঙ্গলের অনেকটা জায়গা জুড়ে রাক্ষসের দেহটা মরে পড়ে আছে ।

এ হেন দৃশ্য দেখে তারা মনে মনে ভাবল, এখন যদি রাজার কাছে প্রমাণ করতে পারি সেই-ই রাক্ষসের হত্যাকারী তবে নিশ্চয়ই মহারাজ পূর্ব প্রতিশ্রুতিমত পুরস্কার প্রদান করবেন। অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা রাতারাতি ভাগ্য ফিরে যাবে।

এই ভেবে কাঠুরের দল, কাজের বাহানা দেখিয়ে সবাই আলাদা আলাদা হয়ে গেল, কেউ রাক্ষসের একটা হাত কেটে নিয়ে মহারাজের দরবারে উপস্থিত হয়ে বলল, “মহারাজ আমি রাক্ষসকে মেরেছি, এই যে তার হাত।’

আবার অন্য কাঠুরে রাক্ষসের একটা আঙ্গুল কেটে নিয়ে বলল—মহারাজ আমিই রাক্ষসের প্রকৃত হত্যাকারী ও-মিথ্যা কথা বলছে।’
এইভাবে বেশ কিছু কাঠুরে রাক্ষসের অঙ্গ কেটে নিয়ে নিজেকে রাক্ষসের হত্যাকারী দাবী করতে লাগল।

মহারাজ পড়লেন মহা ফাঁপরে। তাদের মধ্যে কে যে প্রকৃত হত্যাকারী? প্রধানমন্ত্রিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন—‘গতকাল কাদের পালা ছিল?’

মহামন্ত্রী ব্রাহ্মণ পরিবারের কথা বললেন। মহারাজ ব্রাহ্মণকে রাজদরবারে ডেকে এনে জিজ্ঞাসা করলেন—‘গতকাল রাক্ষসের কাছে কাকে পাঠিয়েছিলেন।’

ব্রাহ্মণ তখন সব খুলে বললেন। মহারাজ সেপাইদের সাথে হাজির হলেন শিবমন্দিরে, শিবমন্দিরের দরজা তখনও বন্ধ ছিল, ভিতরে নীলকমল আর লালকমল ঘুমোচ্ছিল, সেপাইরা মহারাজার নির্দেশে দরজায় ধাক্কা দিলে নীলকমলের ঘুম ভেঙ্গে যায়।

দরজা খুলে দেয়। মহারাজ ভিতরে প্রবেশ করে দেখতে পায় রাক্ষসের মাথাটা মন্দিরের ঘরে পড়ে আছে। মহারাজ তখন আসল ঘটনা নীলকমলকে জিজ্ঞাসা করল।

নীলকমল সমস্ত ঘটনা বলে বলল- মহারাজ আজ আপনার রাজ্য পাপমুক্ত, রাজ্যের প্রজাদের আর কোন ভয় নেই। এবার আমাদের বিদায় দিন।’

মহারাজ বিদায়ের কথা শুনে চমকে ওঠে বললেন, ‘তুমি এখন আমার পরম আত্মীয় হতে চলেছ, আমার প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে, আমি এক্ষুণি রাজপুরোহিতকে ডেকে আমার একমাত্র কন্যার সাথে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করছি।’

শুভদিন দেখে নীলকমলের সাথে রাজকন্যার বিয়ে হয়ে গেল। মহারাজ অর্ধেক রাজত্ব নীলকমলের হাতে তুলে দিয়ে বললেন— নীলকমল আজ থেকে তুমিই এই অর্ধেক রাজ্যের দেখাশুনা করবে।’

নীলকমল বলল—মহারাজ আপনার আদেশ যথাযথ পালন করার চেষ্টা করব।’
রাজপ্রাসাদের অপেক্ষাকৃত ভাল জায়গার ঘরটি সুসজ্জিত করে রাজকন্যা এবং নীলকমলকে মহারাজ উপহার দিলেন।

তারা সেখানেই বসবাস করতে আরম্ভ করল। আর লালকমলকে ফটকের সামনে একটি সুন্দর প্রাসাদ তৈরি করে দিলেন, মহারাজ লালকমলকে রাজপ্রাসাদেই থাকতে বলেছিলেন। লালকমল আপত্তি করে বলল—‘মহারাজ আমাকে ফটকের সামনে একটা ঘর করে দিন, আমি সেখানেই থাকব।’

রাজপ্রাসাদের দাসীর মধ্যে একজন ছিলো মহারাণীর খুব প্রিয়পাত্র, মহারাণী সর্বক্ষণ তাকে সাথে সাথে রাখতেন। যে কোন কাজ অল্প সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করতে পারত। আসলে সে ছিল ছদ্মবেশি রাক্ষসী, মায়ামন্ত্রে মানবীর রূপ ধারণ করে রাজপ্রাসাদে বসবাস করছে।

সারাদিন তার মহারাণীর সাথে সাথেই কাটে, রাত্রিবেলা নিজের ঘরে চলে যায়। প্রাসাদের সকলে যখন গভীর ঘুমে অচৈতন্য তখন সেই ছদ্মবেশি রাক্ষসী প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে যায় গোশালায়। কোন কোন দিন যায় হাতীশালায়। মনের আনন্দে কাঁচা মাংস খেয়ে আবার রাত থাকতেই ফিরে আসে প্রাসাদে।

লালকমল অনেক রাতে ঘুমোত, দাসীর ব্যাপারটা প্রায়ই তার নজরে পড়ত, ছদ্মবেশি দাসীও বুঝতে পারল। লালকমল তাকে সন্দেহের চোখে দেখছে। তখন ছদ্মবেশি দাসী একটা মতলব এঁটে হাজির হল মহারাণীর কাছে, নাকি কান্না কাঁদতে কাঁদতে বলল—‘রাণীমা আমার আর এই প্রাসাদে থাকা হবে না ।’

বিশ্বস্ত দাসীর মুখে এ হেন কথা শুনে রাণীমা জিজ্ঞাসা করল—‘আবার কী হল?’
–বলছিলাম রাণীমা লালকমলের কথা, সে আমাকে একদম সহ্য করতে পারে না, আজেবাজে কথা বলে মেরে ফেলবার ভয় দেখায়, বলে কে বলেছে তোকে রাণীমার এত সেবা করতে ।

রাণীমা আমার আর থাকার ইচ্ছে নেই, আমি চলে যাব ।
মহারাণী দাসীর কথায় ক্ষেপে বললেন—কী এতবড় কথা বলেছে ঐটুকু ছেলে, ঠিক আছে তোর কোন চিন্তা নেই, তুই যাবি কেন? এখানেই থাকবি, আমি ঐ ছেলেটাকে তাড়াব।’

পরদিন সকালে মহারাণী ডেকে পাঠালেন নীলকমলকে ।
মহারাণী পালঙ্কের উপর শুয়েছিলেন। নীলকমলের গলার শব্দে উঠে বসে বললেন, “তোমাকে বাপু একটা কথা বলব, আগে বল তুমি রাখবে নীলকমল অবাক হয়ে বলল—কী এমন কথা রাণীমা?

আমি কী কখনও আপনাদের আদেশ অমান্য করেছি?’
—তবে শোন, তোমার ছোট ভাই লালকমলকে তাড়িয়ে দাও ।

মহারাণীর কথায় নীলকমল চমকে বলল—‘এ কী বলছেন রাণীমা! ও আমার ছোট ভাই, তাছাড়া কী এমন কাজ করেছে যার জন্য আপনার এত বিরূপ মনোভাব?’

মহারাণী অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন——সেসব কথা তোমাকে বলা যাবে না, যা বলছি তাই কর।’
রাণীমার আদেশে নীলকমল আর কী করে। অনেক চিন্তা ভাবনা করে একজন অনুচরকে দিয়ে লালকমলের কাছে একটা চিরকুট পাঠাল।

তাতে লিখল, “ভাই লালকমল ভগবান আমাদের প্রতি বিরূপ, আমরা সারা জীবন একসাথে থাকতে পারব না, আমায় ক্ষমা করো, তুমি আজ রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে চলে যাও। ইতি—দাদা।”

এ হেন চিঠি পেয়ে লালকমল আকাশ থেকে পড়ল। লালকমল সারাদিন ঘরে বসে চিন্তা করেও কোন উত্তর পেল না, দাদার আদেশ,
লালকমল এক জামা কাপড়ে বেরিয়ে পড়ল, পথে। উদ্দেশ্যহীন পথে হেঁটে চলেছে।

সারারাত হেঁটে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক পরিত্যক্ত অট্টালিকার সামনে উপস্থিত হল। অট্টালিকার ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখতে পেল, জরাজীর্ণ একটি ঘরে এক অপরূপ সুন্দরী কন্যা ঘুমিয়ে আছে।

লালকমল অবাক হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, এই পরিত্যাক্ত অট্টালিকায় এই সুন্দরী কন্যা এলো কী করে? এক এক করে অট্টালিকার সব ঘরগুলো ঘুরে দেখল। কিন্তু দ্বিতীয় কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই, আবার ফিরে এল সেই সুন্দরী কন্যার ঘরে।

মুক্তোর মত কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, লালকমল তাকে জাগাবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার ঘুম ভাঙ্গলো না, গভীর ঘুমে অচৈতন্য হয়ে আছে, লালকমল বিছানার পাশেই দেখতে পেল, একটি সোনার কাঠি ও একটি রূপোর কাঠি পড়ে আছে।

কৌতূহলী হয়ে রূপোর কাঠি তুলে সুন্দরী কন্যার গায়ে ছোঁয়াল, কিন্তু কোন পরিবর্তন দেখা গেল না, এবার সোনার কাঠি দিয়ে স্পর্শ করল, সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী কন্যার ঘুম ভেঙ্গে গেল, খাটের পাশে এক সুদর্শন যুবককে দেখে সে চমকে উঠে বলল—‘কে তুমি এখানে প্রবেশ করলে কী করে?

লালকমল মৃদু হেসে বলল— আগে বল তুমি কে? আর এই নির্জন ভূতুড়ে অট্টালিকায় তুমি একা কেন?”
সুন্দরী কন্যা আতঙ্কিত হয়ে বলল—‘দেখ তুমি আর বৃথা সময় নষ্ট করো না, এক্ষুণি চলে যাও, নয়তো ওরা এসে পড়বে?’

—কারা এসে পড়বে? লালকমলের প্রশ্নে সুন্দরী কন্যা চোখ বড় বড় করে বলল—‘এই অট্টালিকার মালিক এক হাজার রাক্ষস, যারা আমাদের পরিবারের সকলকে মেরে ফেলেছে।

আমার বাবা ছিলেন এই রাজ্যের রাজা, আর এই অট্টালিকা ছিল রাজপ্রাসাদ, তুমি এক্ষুণি পালিয়ে যাও, ওদের আসার সময় হয়ে গেছে।

লালকমল একটুও বিচলিত হল না বরং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল— ভয় নেই রাজকন্যা আমাকে কেউ মারতে পারবে না। এই রাক্ষসপুরীতে তুমি বেঁচে আছ কি করে?

—ওরা আমায় খায়নি। অন্যান্য রাক্ষসরা আমাকে মারতে উদ্যত হলে রাক্ষসমাতা ওদের থামিয়ে দিয়ে বলল—’বাছারা একে আর মারিস না, ভারী সুন্দর দেখতে, একে আমি আমার কাছে রেখে দেব।’ অন্যান্য রাক্ষসরা বৃদ্ধ মাতার কথা শুনে আমায় মারল না।

সেই থেকে আমি ওদের কাছেই থেকে গেলাম। ওরা যখন খাবার সন্ধানে যায় তখন আমাকে রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে ঘুম পাড়িয়ে যায়, আবার দিনের শেষে অট্টালিকায় ফিরে সোনার কাঠি ছুঁইয়ে আমায় জীবন্ত করে তোলে ।

সুন্দরী কন্যার প্রশ্নে লালকমল নিজের জীবন কাহিনী শোনাল, সব শুনে সুন্দরী কন্যা বলল – সত্যি তোমার জীবন ভীষণ দুঃখের। যাই হোক তুমি আর এখানে থেকো না, এক্ষুণি রাক্ষসের দল চলে আসবে।’

লালকমল অসহায় কণ্ঠে বলল——তবে আমি এখন কী করব? কোথায় যাব?’ রাজকন্যা মনে মনে ভাবল, সত্যিইতো এই গভীর জঙ্গলে লালকমল কোথায় যাবে? আর তা ছাড়া রাক্ষসদের যা ঘ্রাণশক্তি তাতে মানুষের অস্তিত্ব টের পেয়ে যাবে।

রাজকন্যা কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে রইল । তারপর বলল—‘এক কাজ কর তুমি আমাকে রূপোর কাঠি দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে অট্টালিকার বাইরে যে বেলগাছ আছে তাতে চড়ে বসো, রাক্ষসরা বেল কাঁটাকে ভীষণ ভয় পায় আজকের রাতটুকু ঐখানেই কাটিয়ে দাও, কাল যখন সব রাক্ষসরা সমুদ্রের তীরে মাছ খেতে চলে যাবে তখন তুমি আবার নেমে আসবে।’

রাজকন্যার পরামর্শ মত লালকমল তাই করল। কিছু পরেই দেখতে পেল রাক্ষসদল উল্লাস করতে করতে অট্টালিকায় ফিরছে।
রাক্ষসদের বৃদ্ধ মাতা অট্টালিকায় ফিরে রাজকন্যাকে জীবন্ত করে তুলল, রাজকন্যা ঘুম থেকে উঠে বৃদ্ধা রাক্ষসীর গা টিপে দিতে লাগল, বৃদ্ধা রাক্ষসী নাক মুখ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল কী রে মেয়ে, মানুষের গন্ধ পাচ্ছি যে?

রাজকন্যা হাসতে হাসতে বলল—তা আমি কি মানুষ না? আমার গন্ধই পাচ্ছ।’
রাক্ষস মাতা আর কিছু বলল না। পরদিন সকালে আবার রাজকন্যাকে ঘুম পাড়িয়ে রাক্ষসদল চলে গেল, লালকমল নজর রাখছিল, রাক্ষসেরা চলে যেতে লালকমল গাছ থেকে নেমে রাজকন্যাকে জাগিয়ে তুলল ।

এইভাবে কেটে গেল বেশ কিছুদিন। একদিন লালকমল রাজকন্যাকে বলল—‘আচ্ছা আমরা কী চিরদিন এইভাবেই কাটাব?’
রাজকন্যা অবাক হয়ে বলল—’কেন?’

লালকমল বলল—‘তবে আমরা কী করব? তুমি রাক্ষসদের নজরবন্দী হয়ে আছ, আমাকে দেখতে পেলে তারা শেষ করে দেবে, চারিদিকে রাক্ষসদের চোখ রয়েছে এমন অবস্থায় আমরা মুক্ত হব কী করে?’

রাজকন্যা বলল— ‘আজ রাতে যখন রাক্ষসমাতা আমাকে জাগত করবে তখন আমি তাকে খুব সেবা করব। আমার সেবায় সে নিশ্চয় খুশী হবে, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করব তাদের প্রাণ কোথায় রাখা আছে।’

সেদিন রাতে রাক্ষস মাতা অট্টালিকায় ফিরে রাজকন্যার গায়ে সোনার কাঠি স্পর্শ করিয়ে জাগ্রত করল, রাজকন্যা রাক্ষসমাতার পা টিপে দিতে লাগল। মাথায় ভাল করে তেল দিয়ে দিল। রাক্ষসমাতা প্রতিদিনের মত আজও বলল—’হ্যাঁ রে কেশবতী মানুষের গন্ধ পাচ্ছি?’

রাজকন্যার একমাথা কালো কোঁকড়ানো চুল ছিল তাই রাক্ষসীমাতা রাজকন্যাকে কেশবতী বলে ডাকত। রাজকন্যা রাক্ষসীমাতার কথায় হেসে বলল—’সেই তোমার এক কথা, আচ্ছা তুমি মানুষ পেলে কী করবে?’

রাক্ষসমাতা বলল—’কত দিন মানুষ খাই না সে আর তুই কী বুঝবি?’ রাজকন্যা বলল— তবে আমাকে খাও না
রাক্ষসমাতা চোখ কপালে তুলে বলল—’ও কথা বলতে নেই, বড় ভাগ্য করে এ জন্মে তোকে পেয়েছি, তোকে কি খেতে পারি?’

রাজকন্যা বিষণ্ণ স্বরে বলল—’তুমি আর কত দিন বাঁচবে? তোমার মৃত্যুর পর আমার কী হবে?’
বৃদ্ধা রাক্ষসী অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল, তারপর বলল—‘দেখ কেশবতী আমরা রাক্ষস, আমাদের মৃত্যু নেই, আমাদের অমরই বলা চলে, তবে ঐ যে সামনের পুকুরটা দেখছিস তার গভীরে জলের নীচে পুকুরের মধ্যিখানে একটা শামুক আছে।

সেই শামুকের পিঠে সব সময় দুটো ভোমরা বসে থাকে, কোন মানুষ যদি এক নিশ্বাসে ডুব দিয়ে নীচে থেকে ভোমরা দুটো উপরে এনে মেরে ফেলতে পারে তবে আমরাও মরে যাব।

ঐ ভোমরার প্রাণের সাথে আমাদের প্রাণ জড়িয়ে আছে, তবে হ্যাঁ যদি ঐ ভোমরা মারার সময় এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ে, তবে আরও এক হাজার নতুন রাক্ষসের সৃষ্টি হবে। কোন মানুষের ক্ষমতা নেই, এক নিঃশ্বাসে পুকুরের নীচ থেকে ভোমরা তুলে আনে। অতএব আমাদের মৃত্যুও কোন দিন হবে না।’

রাজকন্যা কেশবতী মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল——তাই যেন হয়, নয়তো আমি কার সাথে থাকব, সেদিন আর রাক্ষসমাতার সাথে রাজকন্যার কোন কথা হল না। এক সময় তারা গভীর নিদ্রায় অচৈতন্য হয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে যথারীতি রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে কেশবতীকে ঘুম পাড়িয়ে রাক্ষসদল খাবার সন্ধানে বেরিয়ে পড়ল। রাক্ষসরা চলে যেতে লালকমল অট্টালিকায় প্রবেশ করে রাজকন্যাকে জীবন্ত করে তুলল।

রাজকন্যা কেশবতী জাগ্রত হয়ে বলল—’লালকমল গত রাতে আমি রাক্ষদের মারার উপায় জেনে গেছি।’ লালকমল খুশি হয়ে বলল—‘কী ভাবে তাদের শেষ করা যায়।’

তখন রাজকন্যা গতরাতে রাক্ষসমাতার সাথে যে সব কথাবার্তা হয়েছে সব বলল। সব শুনে লালকমল গায়ে ভাল করে তেল মেখে এক ডুবে পুকুরের নীচে শামুকের কাছে চলে এল। সন্তর্পনে তুলে নিল রাক্ষদের প্রাণকেন্দ্র ভোমরা দুটি, ধীরে ধীরে উপরে উঠে এল।

পুকুরের পাড়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে অপেক্ষা করছিল রাজকন্যা। লালকমলকে উঠে আসতে দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। লালকমল ভোমরা নিয়ে পাড়ে উঠে বলল, রাজকন্যা এক কলসি ছাই আর একটা ধারালো ছুরি নিয়ে এস, রাজকন্যা অবাক হয়ে বলল—‘ছাই দিয়ে কী হবে?’

লালকমল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল—মাটিতে আগে ছাই ছড়িয়ে তবে ভোমরা দুটিকে মারব। ফলে মাটিতে আর রক্ত পড়বে না ৷’
রাজকন্যা এক কলসি ছাই নিয়ে পুকুর পাড়ে ছড়িয়ে দিল, তারপর লালকমল ধারালো ছুরি দিয়ে ভোমরা দুটিকে অর্ধেক করে ফেলল।

ভোমরা দুটিকে কেটে ফেলার সাথে সাথে চারিদিক থেকে রাক্ষসদের বিকট চিৎকার ভেসে এল। তাদের মনে হল ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে, এক হাজার রাক্ষসের মৃত্যু যন্ত্রণার দাপাদাপিতে জঙ্গলে সত্যি সত্যি ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল।

আধ ঘণ্টা পর সব চুপচাপ, রাজকন্যা এবং লালকমল বুঝতে পারল রাক্ষসবংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। রাক্ষসদের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে রাজকন্যা কেশবতী লালকমলের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল——তুমি আমার জীবনদাতা। আমাকে গ্রহণ কর।’

লালকমল মন্দিরে গিয়ে গন্ধর্ব মতে মালাবদল করে রাজকন্যা কেশবতীকে পত্নীরূপে গ্রহণ করল। এবং ঐ অট্টালিকায় তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল ।

রাজকন্যা কেশবতী প্রতিদিন সকালবেলা নদীতে স্নান করতে যেত, এমনই একদিন হঠাৎ কেশবতীর এক গুচ্ছ মাথার চুল ছিঁড়ে হাতে চলে এল । কেশবতীর খুব মন খারাপ হয়ে গেল, চুলের গুচ্ছ হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ নদীর ঘাটে গালে হাত দিয়ে বসে রইল।

এক সময় মনে মনে ভাবল, ছিঁড়ে যখন গেছে আর আফসোস করে কী হবে। এই ভেবে রাজকন্যা কেশবতী একটা পদ্মফুলের সাথে চুলগুচ্ছ ভাল করে বেঁধে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল। ভাসতে ভাসতে পদ্মফুল উপস্থিত হল নীলকমলের স্নানঘাটে। নীলকমল তখন স্নান সারছিল।

পদ্মের মধ্যে একগুচ্ছ চুল দেখে তার মনে কৌতূহল জাগে, সঙ্গে সঙ্গে নীলকমল পদ্মফুল থেকে চুলগুচ্ছ হাতে তুলে নেয়, সে কি বিরাট চুল। প্রায় এক মানুষ লম্বা চুল, আর তেমনি কালো । নীলকমল মনে মনে ভাবল—’এই চুল এত সুন্দর, যার চুল সে না
জানি কত সুন্দরী।’

নীলকমল এই সব ভাবতে ভাবতে প্রাসাদে ফিরে এল, কোন কিছুই আর ভাল লাগে না, এমন কি রাজকার্যে যাওয়াও বন্ধ করে দিল।

একদিন রাণীমা নীলকমলকে ডেকে বলল—‘তোমার কী হয়েছে? ঘটেছে?” কিছুদিন ধরেই দেখছি তোমার রাজকার্যে মন নেই। কী এমন ঘটনা নীলকমল প্রথমে বলতে চাইছিল না, রাণীমার পীড়াপিড়িতে বলল—

রাণীমা গত সাতদিন আগে স্নানঘাটে পদ্মের মধ্যে আমি একগুচ্ছ চুল পেয়েছি, এত সুন্দর চুল এর আগে কখনও দেখেছি বলে আমার মনে পড়ছে না, আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, এই চুল যার তাকে না দেখে রাজকার্যে যাব না।’

নীলকমলের কথা শুনে রাণীমা বললেন—‘ও এই ব্যাপার, এর জন্য ভেবো না, আমি তোমার মনোবাসনা পূর্ণ করব।’ এই বলে রাণীমা তার বিশ্বস্ত দাসীকে ডেকে সমস্ত ঘটনা বলল।

সব শুনে দাসী বলল——রাণীমা এ আর এমন কি কাজ, হিজল কাঠের নৌকা আর মন পবনের দাঁড় পেলে আমি আপনার আদেশ পালন করতে পারি।’

দাসীর প্রস্তাব মত রাণীমা একদিন হিজল কাঠের নৌকো আর মন পবনের দাঁড়ের ব্যবস্থা করে দিলেন। দাসী নীলকমল যে ঘাটে স্নান সারে সেই ঘাটে নৌকায় উঠে বসল।

সাথে নিল সাত হাঁড়ি কড়া পাকের নলেন গুড়ের সন্দেশ আর কয়েকটি চীনা মাটির পুতুল। নৌকায় উঠে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে বলল——

“হিজল কাঠের নৌকায় চড়ে,
মন পবনের দাঁড় বেয়ে,
পৌঁছে যাব সেই ঘাটে,
যে ঘাটেতে সেই সুন্দরী স্নান করে।”

নৌকা ছুটে চলল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পৌছে গেল রাজকন্যা কেশবতীর স্নানঘাটে। দাসী নদীর পাড়ে নৌকা বেঁধে মিষ্টি নিয়ে সেই অট্টালিকার সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল—“ওরে মেয়ে তুই কোথায় রে?

কতদিন তোকে দেখি না, কৈ রে একবার বাইরে বেরিয়ে দেখ কে এসেছে?”
রাজকন্যা কেশবতী তখন লালকমলের সাথে গল্পে মশগুল ছিল, বাইরে থেকে চিৎকার ভেসে আসায় তারা দু’জনেই বাইরে বেরিয়ে এল, রাজকন্যা কেশবতীকে দেখা মাত্র দাসী তার সামনে গিয়ে বলল—“ও মা তুই এতবড় হয়ে গেছিস, কতটুকু দেখেছি তোকে?

হাঁ করে দেখছিস কী আমি তোর পিসী’, রাজকন্যা অবাক হয়ে বলল, পিসী!”
হ্যাঁ রে হ্যাঁ তোর আর দোষ কি, সেই এতটুকু থাকতে তোদের বাড়িতে এসেছিলাম আজ আবার আঠার বছর পর আসতে হ’ল, তা কেমন আছিস তোরা, এটা কে রে?

রাজকন্যা কেশবতী লজ্জায় মাথা নীচু করে নিল, দাসী হেসে বলল, ও বুঝেছি বলতে হবে না ।
রাজকন্যা মনে মনে ভাবল হতে পারে তার পিসী। তার কি আর এত সব মনে আছে।

পরদিন দুপুরের আহারের পর লালকমল দিবানিদ্রা যাচ্ছিল। এমন সময় দাসী বলল—‘ও মেয়ে বড্ড গরম লাগে চল নদীতে হাত মুখ ধুয়ে আসি।’ রাজকন্যা শয্যায় শায়িত স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল——উনি ঘুমিয়ে আছে, না জিজ্ঞাসা করে যাওয়া কি ঠিক হবে?’

দাসী ফিক্ ফিক্ করে হেসে বলল তাতে কি হয়েছে রে যাচ্ছিস তোর আপন পিসীর সাথে। এক কাজ কর আমি যে কড়াপাকের সন্দেশ এনেছি তা গোটা কয়েক সন্দেশ আর এক গ্লাস জল বিছানার সামনে রেখে দে, ঘুম ভাঙ্গলে খেয়ে নেবে।’

দাসীর কথামত রাজকন্যা লালকমলের শয্যার পাশে সন্দেশ আর জল রেখে দাসীর সাথে নদীর ঘাটে চলে এল। নদীর জলে গা ধুতে ধুতে রাজকন্যা দেখতে পেল ঘাটের তীরে একটা সুন্দর নৌকা বাঁধা রয়েছে। অবাক হয়ে বলল—‘কী সুন্দর নৌকা পিসী!’

ছদ্মবেশি দাসী বলল—“ওটা তো আমারই নৌকা তুই চড়বি?’
রাজকন্যা মাথা নাড়িয়ে বলল –’না বাবা আমার ভীষণ ভয় করে।’

খিল খিল করে হেসে দাসী বলল—’ভয় কি রে দেখবি আয় নৌকার মধ্যে কত সুন্দর সুন্দর চীনা মাটির পুতুল আছে।’
রাজকন্যার পুতুলের কথা শুনে ভয় দূর হয়ে গেল, দাসীর পিছন পিছন নৌকায় উঠে এল!

সুন্দর সুন্দর পুতুল দেখে রাজকন্যা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল, এই সুযোগে দাসী আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়ে বলল—

“হিজল কাঠের নৌকায় চড়ে
মন পবনের দাঁড় বেয়ে,
পৌঁছে যাব সেই ঘাটে,
যে ঘাটে নীলকমল স্নান করে।”

সঙ্গে সঙ্গে নৌকা তীব্র গতিতে ছুটে চলল। রাজকন্যা বুঝতে পারল সে ঠকেছে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। নদীতে ঝাঁপ দিতে গেলে দাসী তাকে আটকে রাখল। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌছে গেল নীলকমলের স্নানঘাটে।

রাজকন্যার রূপ দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল, মনে মনে ভাবল এ নিশ্চয়ই কোন দেবতার কন্যা, নয়তো এতো রূপ হয় কী করে?
রাজকন্যা কেশবতী চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে বলছে—‘আমাকে স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দাও, কেন আমাকে ধরে নিয়ে এসেছ?’

রাণীমা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল—‘কোন ভয় নেই তোমার, এখন থেকে তুমি আমাদের কাছেই থাকবে।’
অবস্থা বেগতিক দেখে রাজকন্যা কেশবতী কাঁদতে কাঁদতে বলল— কিন্তু রাণীমা আমি যে একটা ব্রত পালন করছি।

আর মাত্র ছয়মাস বাকি—এই ছয়মাসের মধ্যে আমি কোন পুরুষের সাথে কথা বলব না।’
রাণীমা বলল—’ও এই ব্যাপার ঠিক আছে আমি তোমাকে এই ছয় মাসের জন্য আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’

—বিরাট রাজপ্রাসাদের পাশেই রাজকন্যা কেশবতীর জন্য ছোট সুন্দর একটি প্রাসাদ তৈরি করে দিল, রাজকন্যা সেই প্রাসাদে সারাদিন চোখের জলে বুক ভাসায়, আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করে বলে— হে ভগবান, আমাকে এই বিপদ থেকে মুক্ত করে লালকমলের কাছে ফিরিয়ে দাও।’

এদিকে লালকমল ঘুম থেকে উঠে রাজকন্যা কেশবতীকে না দেখতে পেয়ে হন্যে হয়ে চারিদিকে খুঁজে বেড়াতে লাগল। লালকমল এরাজ্য সে রাজ্যে রাজকন্যার খোঁজ করতে থাকে, কিন্তু কোথাও তার সন্ধান মেলে না, এইভাবে প্রায় পাঁচ মাস ছাব্বিশ দিন কেটে গেল, লালকমল হাজির হল সেই রাজ্যে যে রাজ্যের রাজা তার দাদা নীলকমল,

রাজ্যের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা প্রাসাদের সামনে সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, কান্নার শব্দ ভেসে আসছে, সে কী করুণ তার শব্দ, লালকমলের বুক ফেটে যায়। ধীর পায়ে প্রাসাদের জানালার সামনে এগিয়ে গেল। জানালা দিয়ে ভিতরে তাকাতেই চমকে ওঠে একি এ যে কেশবতী! লালকমল ডাকল—‘রাজকন্যা।’

স্বামীর গলার শব্দে চমকে রাজকন্যা কেশবতী দেখতে পেল তার স্বামী দাঁড়িয়ে আছে। আনন্দে সে হাসতে ভুলে গেল, হু হু করে কেঁদে জানালায় আছড়ে পড়ল, লালকমল সান্ত্বনা দিয়ে বলল—‘কেঁদে কী লাভ এ আমাদের পূর্বজন্মের পাপের প্রায়শ্চিত্ত, কেঁদো না।

রাজকন্যা শান্ত হয়ে বলল—‘ওগো আগামীকাল আমার ব্রত সাঙ্গ হওয়ার দিন, তুমি আজই এখান থেকে উদ্ধার কর।’
লালকমল সান্ত্বনা দিয়ে বলল—’আমি যখন এসে গেছি তখন তোমার আর কোন ভয় নেই । তুমি শান্ত হও।’

পরদিন সকালে মহারাজ ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করলেন— আজ রাজকন্যা কেশবতীর ব্রত সাঙ্গ হওয়ার দিন, যে ব্রাহ্মণ রাজকন্যার ব্রতকথা বলতে পারবে তাকে পুরস্কৃত করা হবে।

এ হেন ঘোষণায় রাজ্যের ব্রাহ্মণমহলে সাড়া পড়ে গেল। এই রাজ্যে ব্রাহ্মণের কোন অভাব নেই ঠিকই তবে কোন ব্রাহ্মণই জানে না রাজকন্যা কেশবতীর ব্রতকথা কী? শাস্ত্রেও এমন কোন ব্রতের উল্লেখ নেই।

লালকমলের কাছে এ ঘোষণার খবর পৌছলে লালকমল ব্রাহ্মণের বেশে রাজসভায় হাজির হয়ে বলল—মহারাজ আমি জানি রাজকন্যা কেশবতী কেন এই ব্রত পালন করছে।’

মহারাজ আগত ব্রাহ্মণকে আসন গ্রহণ করতে বলল । তারপর ব্রতকথা শোনার জন্য নির্দিষ্ট স্থান নির্বাচন করে সেখানে মণ্ডপ তৈরি করা হল, মণ্ডপের এক দিকে পর্দার আড়ালে রাজকন্যা কেশবতী আসন গ্রহণ করল ।

অন্যদিকে মহারাজ স্বয়ং পাত্রমিত্র রাজ্যের বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তি ও ব্রাহ্মণ বেশধারী লালকমল আসন গ্রহণ করল। তারপর মহারাজ ব্রাহ্মণ বেশধারী লালকমলকে রাজকন্যা কেশবতীর ব্রতকথা বলার জন্য আদেশ দিলেন লালকমল একেবারে প্রথম থেকে শুরু করল।

তার পিতামাতা ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীর কথা, দুই ভাই নীলকমল ও লালকমলের জন্ম বৃত্তান্ত, রাক্ষসী দাসীর কথা, সব কিছু বলতে বলতে মাঝে মাঝে পর্দার আড়ালে বসে থাকা রাজকন্যা কেশবতীকে জিজ্ঞাসা করছে— কী ঠিক বলছি তো?

সঙ্গে সঙ্গে পর্দার আড়াল থেকে কেশবতী বলছে, ‘হ্যাঁ সব ঠিক, আপনি বলে যান।’
রাজ্যের রাজা নীলকমল নবাগত ব্রাহ্মণের মুখে নিজের জীবন কাহিনী শুনে বুঝতে পারলেন এই ছদ্মবেশি ব্রাহ্মণ তার আদরের ছোট ভাই লালকমল ছাড়া আর কেউ নয়।

ব্রত কথা শেষ হলে, নীলকমল সিংহাসন থেকে নেমে ছদ্মবেশি ব্রাহ্মণের সামনে এসে বলল—ভাই লালকমল তুমি আমায় ক্ষমা কর।
লালকমল বুঝতে পারল দাদা তাকে চিনতে পারছে। সঙ্গে সঙ্গে সে দাদার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। নীলকমল ভাই লালকমলকে বুকে টেনে নিল ।

আর এদিকে সেই রাক্ষসী দাসী বুঝতে পারল, সবাই তার আসল পরিচয় জেনে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে সে নিজ আকৃতি ধারণ করে নীলকমল আর লালকমলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নীলকমল তৈরিই ছিল, তার গায়ে রাক্ষসেরও রক্ত আছে, তার সাথে পারবে কেন?

তরবারীর এক কোপে রাক্ষসী দাসীর মাথা কেটে ফেলল, বিকট চিৎকার করে রাক্ষসী দাসীর দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ।
তারপর থেকে নীলকমল লালকমল ও রাজকন্যা কেশবতী পরম সুখে সেই রাজ্যে দিন কাটাতে লাগল ।

হাসির গল্প, সাত ভাই চম্পা

সাত ভাই চম্পা
এক রাজা, রাজার সাত রাণী। বড় ছয় রাণী যেমন অহঙ্কারী তেমনি হিংসুটে, কিন্তু ছোট রাণী খুব ভাল, হিংসুটেও নয় অহঙ্কারীও নয়। কিন্তু রাজার বা রাণীদের মনে সুখ নেই, একটাও ছেলে কোন রাণীর হল না ।

রাজার আবার তার ওপর ভাবনা, তিনি তো চিরকাল বাঁচবেন না, রাজার মৃত্যুর পর এই রাজ্যের রাজা কে হবে। সেই ভাবনা রাজার শুধু নয়, রাজ্যের সব মানুষের । এইভাবে দিন যায় ।

রাজামশাই সিংহাসনে বসে আছেন, এমন সময় খবর এল ছোট রাণীর ছেলে হবে। খবরটা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে গেল, চারদিকে যেন খুশির বান বয়ে গেল, আর রাজার কথা তো বলাই বাহুল্য।

রাজপ্রাসাদ উৎসবের সাজে সেজে উঠল, কেউ প্রাসাদ থেকে খালি হাতে ফিরল না, মুক্ত হাতে দানের ব্যবস্থা হয়েছে।
এদিকে বড় ছয় রাণীর বুক হিংসায় ফেটেই যাবে বুঝি।

তাঁরা থাকতে কিনা ছোট রাণীর ছেলে হবে, সেই ছেলে রাজা হবে! এ কখনও সহ্য করা যায় না। সবাই মিলে যুক্তি করে মতলব আটল ।

ঠিক হল, দাইয়ের কাজ করবেন বড় ছয় রাণী। এদিকে ছোট রাণীর ছেলে হবে খবর পেয়ে তাঁরাও এমন ভাব দেখাতে লাগলেন যেন কত খুশি হয়েছেন।

যথাসময়ে ছোটরাণীর ছেলে হল—কিন্তু একটা কী দুটো নয়, একেবারে সাত সাতটা—আর একটি মেয়ে। কী রূপ তাদের—অন্ধকার আঁতুরঘর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠলো ।

এদিকে বড় ছয় রাণী চুপচাপ ছিলো না, সাত ছেলে আর এক মেয়েকে হাঁড়িতে ভরে ছাইগাদায় পুঁতে রাখলেন, আর ইঁদুর ও ব্যাঙের সাতটা ছানা এনে রাণীর কোলে শুইয়ে দিলেন জ্ঞান ফিরে পেয়েই ছোট রাণী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দিদি কি হয়েছে গো, ছেলে না মেয়ে?’

ছয় রাণী একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘কোলের কাছেই তো রয়েছে- চোখ মেলে দ্যাখোই না। কত আশা করেছিলুম ছেলে হবে, রাজ্য খুশিতে ভরে উঠবে,—তা নয়, কেবল কয়েকটা ইঁদুর আর ব্যাঙের বাচ্চা প্রসব করেছিস!’

শুনে ছোটরাণী আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন ।
রাজামশাই অনেক আশা করে ছেলের মুখ দেখবেন বলে এলেন, যা দেখলেন তাতে দুঃখে তার বুক ফেটে গেল। তক্ষুনি তাঁর হুকুমে ছোটরাণীকে প্রাসাদ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল ।

রাজার সবচেয়ে আদরের ছোটরাণী। তিনি আর কী করেন, ঘুঁটে দেন, আর সেই ঘুঁটে বিক্রি করে সামান্য যা পান তা বিক্রি করে কোনরকমে কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটান ।

এদিকে ছোটরাণীকে তাড়িয়ে দিয়ে আর ছেলের মুখ দেখার আশায় হতাশ হয়ে রাজামশাই সব সময় মনমরা হয়ে থাকেন, রাজকার্যে মন বসে না ।

অথচ এই ছোটরাণীকেই তিনি ভালবাসতেন সব থেকে বেশি রাজার মালী একদিন ফুল তুলতে গিয়ে দেখে, এক জায়গায় সাতটা চাঁপা গাছ আর একটা পারুল গাছ—প্রত্যেকটা গাছেই একটা করে ফুল ।
মালী পারুল ফুলটা তুলতে যাচ্ছে, এমন সময় পারুল গাছ বলে উঠল :

“সাত ভাই চম্পা, জাগো রে?
উত্তরে সাত ভাই চম্পা বলে উঠল :
কেন বোন পারুল ডাকো রে।
রাজার মালী এসেছে ফুল দিব,
কি না দিব?”
সাত ভাই চম্পা বলে উঠল:
“না দিব না দিব ফুল, উঠিব অনেক দূর,—
আগে আসুক রাজা নিজে তবে দিব ফুল!

সঙ্গে সঙ্গে আটটা ফুল গাছই অনেক উঁচু হয়ে উঠল। সব শুনে আর দেখে মালী তো একেবারে অবাক! দৌড়ে গিয়ে সে রাজামশাইকে খবর দিল। গাছ কথা বলে, এমনটি তো কেউ কখনো শোনে নি।

গেলেন রাজা নিজে ফুল তুলতে। সঙ্গে সঙ্গে পারুল গাছ বলে উঠল :

“সাত ভাই চম্পা, জাগো রে!
কেন বোন পারুল ডাকো রে!
রাজার ছয় রাণী এসেছে, ফুল দিব, কি না দিব?
না দিব না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর,—
আগে আসুক ছোটরাণী, তবে দিব ফুল!”

সেই যে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই থেকে আর ছোটরাণীকে রাজামশাই দেখেন নি। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ছোটরাণী ঘুঁটে দিয়ে সেই ঘুঁটে বিক্রি করে জীবনধারণ করেন।

ছোটরাণী তখন ঘুঁটে কুড়োচ্ছিলেন। পরনে শতছিন্ন কাপড়। অমন সোনার রঙ ঘুচে গেছে। কতকাল মাথায় তেল পড়েনি। রাজা ডাকছেন শুনে, গেলেন তিনি রাজার কাছে।

ছোটরাণী কাছে আসতেই সাতটা চাঁপা আর একটা পারুল ফুল গাছ থেকে নেমে এসেই—মা গো—মা, মা বলে ছোটরাণীর কোলে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু ফুল হয়ে নেমে এলেও ছোটরাণীর ছোঁয়া পেয়ে আর তারা ল নেই—সাতটি রাজপুত্র আর একটি রাজকন্যা হয়ে গেছে।

সঙ্গে সঙ্গে—কোথায় গেল ঘুঁটেকুড়োনি রাণী! তিনি ততক্ষণে সেই আগেকার দিনের ছোটরাণী হয়ে গেছেন—মাথায় মুকুট, পরনে রাণীর বেশ!

আট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কী যে করবেন তিনি ভেবেই পেলেন না । তখন রাজামশাইয়ের বড় ছয় রাণীর শয়তানি বুঝতে অসুবিধে হল না। তাঁর হুকুমে ছয় রাণীকে ছটা গর্তে, তলায় কাঁটা উপরে কাঁটা— এইভাবে পুঁতে রাখা হল ।

আদরের ছোটরাণী আর আট সন্তানকে নিয়ে রাজা মহা আনন্দে প্রাসাদে ফিরলেন ।
তখন চারদিকে যে উৎসব শুরু হল তা লিখে বোঝানো অসম্ভব।

হাসির গল্প, কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা

কাঁকনমালা, কাঞ্চনমালা
এক রাজপুত্র আর এক রাখাল, দুই জনে বন্ধু। রাজপুত্র প্রতিজ্ঞা করিলেন, যখন তিনি রাজা হইবেন, রাখাল বন্ধুকে তাহার মন্ত্রী করিবেন রাখাল বলিল,- “আচ্ছা।”

দুইজনে মনের সুখে থাকেন। রাখাল মাঠে গরু চরাইয়া আসে, দুই বন্ধুতে গলাগলি হইয়া গাছতলে বসেন। রাখাল বাঁশি বাজায়, রাজপুত্র শোনেন। এইরূপে দিন যায় ।

রাজপুত্র রাজা হইলেন। রাজা রাজপুত্রের কাঞ্চনমালা রাণী, ভাণ্ডার ভরা মাণিক, কোথাকার রাখাল, সে আবার বন্ধু! রাজপুত্রের রাখালের কথা মনেই রহিল না।

একদিন রাখাল আসিয়া রাজদুয়ারে ধর্ণা দিল- “বন্ধুর রাণী কেমন, দেখাইল না।” দুয়ারী তাহাকে “দুর, দুর” করিয়া খেদাইয়া দিল। মনের কষ্টে রাখাল কোথায় গেল কেহই জানিল না ।

পরদিন ঘুম হইতে উঠিয়া রাজা চোখ মেলিতে পারেন না। কি হইল, কি হইল? রাণী দেখেন, সকলে দেখে, রাজার মুখ-ময় সূঁচ, গা-ময় সূঁচ, মাথার চুল পর্যন্ত সূঁচ হইয়া গিয়াছে- এ কি হইল! রাজপুরীতে কান্নাকাটি পড়িল ।

রাজা খাইতে পারেন না, শুইতে পারেন না, কথা কহিতে পারেন না। রাজা মনে মনে বুঝিলেন, রাখাল বন্ধুর কাছে প্রতিজ্ঞা করিয়া প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গিয়াছি, সেই পাপে এ দশা হইল। কিন্তু মনের কথা কাহাকেও বলিতে পারেন না।

সূচরাজার রাজসংসার অচল হইল,- সূঁচরাজা মনের দুঃখে মাথা নামাইয়া বসিয়া থাকেন; রাণী কাঞ্চনমালা দুঃখে-কষ্টে কোনো রকমে রাজত্ব চালাইতে লাগিলেন একদিন রাণী নদীর ঘাটে স্নান করিতে গিয়াছেন, কাহার এক পরমাসুন্দরী মেয়ে আসিয়া বলিল,-

“রাণী যদি দাসী কিনেন, তো আমি দাসী হইব।” রাণী বলিলেন- “সূঁচরাজার সূঁচ খুলিয়া দিতে পার তো আমি দাসী কিনি।”
দাসী স্বীকার করিল । তখন রাণী, হাতের কাঁকন দিয়া দাসী কিনিলেন ।

দাসী বলিল,- “রাণী মা, তুমি বড় কাহিল হইয়াছ; কতদিন না-জানি ভাল করিয়া খাও না, নাও না। গায়ের গহনা ঢিলা হইয়াছে, মাথার চুল জটা দিয়াছে। তুমি গহনা খুলিয়া রাখ, বেশ করিয়া ক্ষার-খৈল দিয়া স্নান করাইয়া দেই।”

রাণী বলিলেন, “না মা, কি আর স্নান করিব, থাক।”
দাসী তাহা শুনিল না; রাণীর গায়ের গহনা খুলিয়া ক্ষার-খৈল মাখাইয়া দিল। দিয়া বলিল,-“মা, এখন ডুব দাও ৷’

রাণী গলা-জলে নামিয়া ডুব দিলেন। দাসী চক্ষের পলকে রাণীর কাপড় পরিয়া, রাণীর গহনা গায়ে দিয়া ঘাটের উপর উঠিয়া ডাকিল-

দাসী লো দাসী পান্-কৌ ।
ঘাটের উপর রাঙ্গা বৌ !
রাজার রাণী কাঁকনমালা;
ডুব দিবি আর কত বেলা?”

রাণী ডুব দিয়া উঠিয়া দেখেন, দাসী রাণী হইয়াছে, তিনি বাঁদী হইয়াছেন। রাণী কপালে চড় মারিয়া, ভিজা চুলে কাঁপিতে কাঁপিতে কাঁকনমালার সঙ্গে চলিলেন।

রাজপুরীতে গিয়া, কাঁকনমালা পুরী মাথায় করিল। মন্ত্রীকে বলে,-“আমি নাইয়া আসিতেছি, হাত-ঘোড়া সাজাও নাই কেন? পাত্রকে বলে,– “আমি নাইয়া আসিব, দোল-চৌদোলা পাঠাও নাই কেন?” মন্ত্রীর, পাত্রের, গর্দান গেল ।

সকলে চমকিল, এ আবার কি! ভয়ে কেহ কিছু বলিতে পারিল না। কাঁকনমালা রাণী হইয়া বসিল, কাঞ্চনমালা দাসী হইয়া রহিলেন! রাজা কিছুই জানিতে পারিলেন না ।

কাঞ্চনমালা আঁস্তাকুড়ে বসিয়া মাছ কোটেন আর কাঁদেন, “হাতের কাঁকন দিয়া কিনিলাম দাসী, সেই হইল রাণী, আমি হইলাম বাদী। কি বা পাপে সোনার রাজার রাজ্য গেল ছার কি বা পাপে ভাঙ্গিল কপাল কাঞ্চনমালার?” রাণী কাঁদেন আর চোখের জলে ভাসেন ।

রাজার কষ্টের সীমা নাই। গায়ে মাছি ভিভিন্, সূঁচের জ্বালায় গা-মুখ চিচিন্‌, কে বাতাস করে, কে বা ওষুধ দেয় !
একদিন ক্ষার কাপড় ধুইতে কাঞ্চনমালা নদীর ঘাটে গিয়াছেন । দেখেন, একজন মানুষ একরাশ সূতা লইয়া গাছতলায় বাসিয়া বলিতেছে—

“পাই এক হাজার সূচ
তবে খাই তরমুজ!
সূচ পেতাম পাঁচ হাজার
তবে যেতাম হাট-বাজার!
যদি পাই লাখ-
তবে দেই রাজ্যপাট !!”

রাণী, শুনিয়া আস্তে আস্তে গিয়া বলিলেন, “কে বাছা সূঁচ চাও, আমি দিতে পারি! তা সূঁচ কি তুমি তুলিতে পারিবে?”
শুনিয়া, মানুষটা চুপচাপ সূতার পুঁটুলি তুলিয়া রাণীর সঙ্গে চলিল । পথে যাইতে যাইতে কাঞ্চনমালা, মানুষটির কাছে আপনার দুঃখের কথা সব বলিলেন । শুনিয়া, মানুষ বলিল,- “আচ্ছা!”

রাজপুরীতে গিয়া মানুষ রাণীকে বলিল,- “রাণীমা, রাণীমা, আজ পিট-কুডুলির ব্রত, রাজ্যে পিটা বিলাইতে হয়। আমি লালসূতা নীলসূতা রাঙাইয়া দি, আপনি গে’ আঙ্গিনায় আলপনা দিয়া পিঁড়ি সাজাইয়া দেন; ও দাসী-মানুষ যোগাড়-যাগাড় দিক?”

রাণী আহ্লাদে আটখানা হইয়া বলিলেন,- “তা কেন, হইল-হইল দাসী, দাসীও আজ পিটা করুক।” তখন রাণী আর দাসী দুইজনেই পিটা করিতে গেলেন।

ও মা! রাণী যে, পিটা করিলেন,- আস্কে পিটা, চাস্কে পিটা আর ঘাস্কে পিটা! দাসী, চন্দ্রপুলী, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা এই সব পিটা করিয়াছেন মানুষ বুঝিল যে, কে রাণী আর কে দাসী।

পিটে-সিটে করিয়া, দুইজনে আলপনা দিতে গেলেন। রাণী, একমণ চা’ল বাটিয়া সাত কলস জলে গুলিয়া এ-ই এক গোছা শণের নূড়ি ডুবাইয়া, সারা আঙিনা লেপিতে বসিলেন। এখানে এক খাবল দেন, ওখানে এক খাবল দেন।

দাসী, আঙ্গিনার এক কোণে একটু ঝাড়-ঝুড় দিয়া পরিষ্কার করিয়া একটুকু চালের গুঁড়ায় খানিকাটা জল মিশাইয়া, এতটুকু নেকড়া ভিজাইয়া, আস্তে আম্ভে, পদ্ম-লতা আঁকিলেন, পদ্ম-লতার পাশে সোনার সাত কলস আঁকিলেন; কলসের উপর চূড়া, দুই দিকে ধানের ছড়া আঁকিয়া, ময়ূর, পুতুল, মা লক্ষ্মীর সোনাপায়ের দাগ, এই সব আঁকিয়া দিলেন।

তখন মানুষ কাঁকনমালাকে ডাকিয়া বলিল,- “ও বাঁদী! এই মুখে রাণী হইয়াছিস?”

হাতের কাঁকনের নাগন্ দাসী ! জীব
সেই হইল রাণী, রাণী হইলেন দাসী!
ভাল চাহিস তো, স্বরূপ কথা-ক।”

কাঁকনমালার গায়ে আগুনে হল্কা পড়িল। কাঁকনমালা গর্জিয়া উঠিয়া বলিল,-“কে রে পোড়ারমুখো, দুর হ’বি তো হত ।

জল্লাদকে ডাকিয়া বলিল,- “দাসীর আর ঐ নির্বংশের গর্দান নেও; ওদের রক্ত দিয়া আমি স্নান করিব, তবে আমার নাম কাঁকনমালা ।” জল্লাদ গিয়া দাসী আর মানুষকে ধরিল। তখন মানুষটা পুঁটলী খুলিয়া বলিল,-

“সূতন সূতন নটখটি !
রাজার রাজ্যে ঘটমটি
সূতন সূতন নেবোর পো,
জল্লাদকে বেঁধে থো।”

এক গোছা সূতা গিয়া জল্লাদকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বাঁধিয়া থুইল ।
মানুষটা আবার বলিল, “সূতন তুমি কা’র?”
সূতা বলিল, “পুঁটলী যার তা’র।”
মানুষ বলিল, “যদি সূতন আমার খাও।
কাকনমালার নাকে যাও।”

সূতোর দুই গুটি গিয়া কাঁকনমালার নাকে ঢিবি হইয়া বসিল । কাঁকনমালা ব্যস্তে-মস্তে ঘরে উঠিয়া বলিতে লাগিল,- “দুঁয়ার দাঁও, দুয়ার দাঁও, এঁটা পাঁগন, দাসী পাঁগন নিয়া আসিয়াছে।”

পাগল তখন মন্ত্র পড়িতেছে-
“সূতন সূতন সরুলি, কোন্ দেশে ঘর?
সূচ-রাজার সূঁচে গিয়ে আপনি পর।

দেখিতে-না-দেখিতে হিল হিল করিয়া লাখ সুতা রাজার গায়ের লাখ সূঁচে পড়িয়া গেল ।

তখন সূঁচেরা বলিল,-
“সূতার পরাণ সীলি সীলি, কোন ফুঁড়ন দি।”
মানুষ বলিল, –
“নাগন্ দাসী কাঁকনমালার চোখ-মুখটি।”

রাজার গায়ের লাখ সূঁচ উঠিয়া গেল, লাখ সূঁচে কাঁকনমালার চোখ-মুখ সিলাই করিয়া রহিল । কাঁকনমালার যে ছট্‌ফটি!
রাজা চক্ষু চাহিয়া দেখেন,— রাখাল বন্ধু!

রাজায়-রাখালে কোলাকুলি করিলেন। রাজার চোখের জলে রাখাল ভাসিল, রাখালের চোখের জলে রাজা ভাসিলেন।
রাজা বলিলেন, “বন্ধু, আমার দোষ নিও না, শত জন্ম তপস্যা করিয়াও তোমার মত বন্ধু পাইব না। আজ হইতে তুমি আমার মন্ত্রী।

তোমাকে ছাড়িয়া আমি কত কষ্ট পাইলাম; আর ছাড়িব না। ”
রাখাল বলিল, “আচ্ছা! তা তোমার সেই বাঁশিটি যে হারাইয়া ফেলিয়াছি; একটি বাঁশি দিতে হইবে!”

রাজা রাখাল-বন্ধুকে সোনার বাঁশি তৈয়ারী করাইয়া দিলেন। তাহার পর সূঁচের জ্বালায় দিন-রাত ছট্‌ফট্ করিয়া কাঁকনমালা মরিয়া গেল। কাঞ্চনমালার দুঃখ ঘুচিল ।

তখন, রাখাল, সারাদিন মন্ত্রীর কাজ করেন, রাত্রে চাঁদের আলোতে আকাশ ভরিয়া গেলে, রাজাকে লইয়া গিয়া নদীর ধারে সেই গাছের তলায় বসিয়া সোনার বাঁশি বাজান। রাজা গলাগলি করিয়া মন্ত্রী-বন্ধুর বাঁশি শোনেন।
রাজা, রাখাল, আর কাঞ্চনমালার সুখে দিন যাইতে লাগিল ।

হাসির গল্প, ঘুমন্ত পুরী

ঘুমন্ত পুরী
এক দেশের এক রাজপুত্রের রূপে রাজপুরী আলো। রাজপুত্রের গুণের কথা লোকের মুখে ধরে না।
একদিন রাজপুত্রের মনে হইল, দেশভ্রমণে যাইবেন। রাজ্যের লোকের মুখ ভার হইল, রাণী আহার-নিদ্রা ছাড়িলেন, কেবল রাজা বলিলেন । “আচ্ছা, যাক্।”

তখন দেশের লোক দলে দলে সাজিল,
রাজা চর-অনুচর দিলেন,
রাণী মণি-মাণিক্যের ডালা লইয়া আসিলেন।

রাজপুত্র লোকজন, মণি-মাণিক্য, চর-অনুচর কিছুই সঙ্গে নিলেন না । নূতন পোশাক পরিয়া, নূতন তরোয়াল ঝুলাইয়া রাজপুত্র দেশভ্রমণে বাহির হইলেন।

যাইতে যাইতে যাইতে যাইতে, কত দেশ, কত পর্বত, কত নদী, কত রাজার রাজ্য ছাড়াইয়া, রাজপুত্র এক বনের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইলেন! দেখেন, বনে প’খ্-পাখালির শব্দ নাই, বাঘ-ভালুকের সাড়া নাই!- রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন।

চলিতে চলিতে, অনেক দূর গিয়া রাজপুত্র দেখেন, বনের মধ্যে এক যে রাজপুরী- রাজপুরীর সীমা। অমন রাজপুরী-রাজপুত্র আর কখনও দেখেন নাই! দেখিয়া রাজপুত্র অবাক হইয়া রহিলেন ।

রাজপুরীর ফটকের চূড়া আকাশে ঠেকিয়াছে। ফটকের দুয়ার বন জুড়িয়া আছে। কিন্তু ফটকের চূড়ায় বাদ্য ব্যাজ না, ফটকের দুয়ারে দুয়ারী নাই । রাজপুত্র আস্তে আস্তে রাজপুরীর মধ্যে গেলেন!

রাজপুরীর মধ্যে গিয়া দেখেন, পুরী যে পরিষ্কার, যেন, দুধে ধোয়া, ধব্ ধব্ করিতেছে। কিন্তু এমন পুরীর মধ্যে জন-মানুষ নাই, কোনো কিছুর সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় না, পুরী নিভাঁজ, নিঝুম, পাতাটি পড়ে না, কূটাটুকু নড়ে না ।
রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া গেলেন ।

রাজপুত্র এদিক দেখেন, ওদিক দেখেন, পুরীর চারিদিক দেখিতে লাগিলেন। একখানে গিয়া রাজপুত্র থমকিয়া গেলেন ! দেখেন, মস্ত আঙ্গিনা, আঙ্গিনা জুড়িয়া হাতী, ঘোড়া, সেপাই-লস্কর, দুয়ারী, পাহারা, সৈন্য, সামন্ত সব সারি সারি দাঁড়াইয়া রহিয়াছে!

রাজপুত্র হাঁক দিলেন।
কেহ কথা কহিল না,
কেহ তাঁহার দিকে ফিরিয়া দেখিল না ।

অবাক হইয়া রাজপুত্র কাছে গিয়া দেখেন, কাতারে কাতারে সিপাই, লক্ষর, কাতারে কাতারে হাতি-ঘোড়া সব পাথরের মূর্তি হইয়া রহিয়াছে কাহারও চক্ষে পলক পড়ে না, কাহারও গায়ে চুল নড়ে না। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

তখন রাজপুত্র পুরীর মধ্যে গেলেন।
এক কুঠরীতে গিয়া দেখেন, কুঠরীর মধ্যে কত রকমের ঢাল- তরোয়াল, তীর-ধনুক সব হাজারে হাজারে টানানো রহিয়াছে।

পাহারারা পাথরের মূর্তি, সিপাইরা পাথরের মূর্তি। রাজপুত্র আপনার তরোয়াল খুলিয়া আস্তে আস্তে চলিয়া আসিলেন। আর এক কুঠরীতে গিয়া দেখেন, মস্ত রাজদরবার, রাজদরবারে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি জ্বল্ জ্বল্ করিতেছে, চারিদিকে মণি-মাণিক্য ঝক্‌ঝক্ করিতেছে ।

কিন্তু রাজসিংহাসনে রাজা, পাথরমূর্তি, মন্ত্রীর আসনে মন্ত্রী পাথরমূর্তি, পাত্র- মিত্র, ভাট-বন্দী, সিপাই-লস্কর যে যেখানে, সে সেখানে পাথরমূর্তি।

কাহারও চক্ষে পলক নাই, কাহারও মুখে কথা নাই রাজপুত্র দেখেন, রাজার মাথায় রাজছত্র হেলিয়া আছে, দাসীর হাতে চামর ঢুলিয়া আছে,– সাড়া নাই, শব্দ নাই, সব ঘুমে নিঝুম।

রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চলিয়া আসিলেন। আর এক কুঠরীতে গিয়া দেখেন, যেন কত শত প্রদীপ একসঙ্গে জ্বলিতেছে— কত রকমের ধন রত্ন, কত হীরা, কত মাণিক, কত মোতি,- কুঠরীতে আর ধরে না। রাজপুত্র কিছু ছুঁইলেন না; দেখিয়া, আর এক কুঠরীতে চলিয়া গেলেন ।

সে কুঠরীতে যাইতে-না-যাইতে হাজার হাজার ফুলের গন্ধে রাজপুত্র বিভোর হইয়া উঠিলেন। কোথা হইতে এমন ফুলের গন্ধ আসে? রাজপুত্র কুঠরীর মধ্যে গিয়া দেখেন জল নাই টল নাই, কুঠরীতে মাঝখানে লাখে লাখে পদ্মফুল ফুটিয়া রহিয়াছে।

পদ্মফুলের গন্ধে ঘর ‘ম-ম’ করিতেছে। রাজপুত্র ধীরে ধীরে ফুলবনের কাছে গেলেন ।
ফুলবনের কাছে গিয়া রাজপুত্র দেখেন, ফুলের বনে সোনার খাট, সোনার খাটে হীরার ডাঁট, হীরার ডাঁটে ফুলের মালা দোলান রহিয়াছে; সেই মালার নিচে, হীরার নালে সোনার পদ্মে এক পরমা সুন্দরী রাজকন্যা বিভোরে ঘুমাইতেছেন।

ঘুমন্ত রাজকন্যার হাত দেখা যায় না, পা দেখা যায় না, কেবল চাঁদের কিরণ মুখখানি সোনার পদ্মের সোনার পাপড়ির মধ্যে টুল টুল্ করিতেছে। রাজপুত্র মোতির ঝালর হীরার ডাঁটে ভর দিয়া, অবাক হইয়া দেখিতে লাগিলেন ।

দেখিতে দেখিতে, দেখিতে দেখিতে, কত বছর চলিয়া গেল । রাজকন্যার আর ঘুম ভাঙ্গে না, রাজপুত্রের চক্ষে আর পলক পড়ে না। রাজকন্যা অঘোরে ঘুমাইতেছেন, রাজপুত্র বিভোর হইয়া দেখিতেছেন।

হঠাৎ একদিন রাজপুত্র দেখেন,
রাজকন্যার শিয়রে এক সোনার কাটি! রাজপুত্র আস্তে আস্তে সোনার কাটি তুলিয়া লইলেন । সোনার কাটি তুলিয়া লইতেই । দেখেন, আর এক দিকে এক রূপার কাটি। রাজপুত্র আশ্চর্য হইয়া রূপার কাটিও তুলিয়া লইলেন।

দুই কাটি হাতে লইয়া রাজপুত্র নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিতে লাগিলেন।
দেখিতে দেখিতে, সোনার কাটিটি কখন টুক করিয়া ঘুমন্ত রাজকন্যার মাথায় চুঁইয়া গেল!

অমনি পদ্মের বন ‘শিউরে উঠিল, সোনার খাট নড়িয়া উঠিল, সোনার পাপড়ি ঝরিয়া পড়িল, রাজকন্যার হাত হইল, পা হইল; গায়ের আলস ভাঙ্গিয়া চোখের পাতা কচ্‌লাইয়া ঘুমন্ত রাজকন্যা চমকিয়া উঠিয়া বসিলেন।

আর অমনি রাজপুরীর চারিদিকে পাখি ডাকিয়া উঠিল, দুয়ারে দুয়ারী আসিয়া হাঁক ছাড়িল, উঠানে হাতি-ঘোড়া ডাক ছাড়িল, সিপাই তরোয়াল ঝন্ ঝন্ করিয়া উঠিল;

রাজদরবারে রাজা জাগিলেন, মন্ত্রী জাগিলেন, পাত্র জাগিলেন- হাজার বচ্ছরের ঘুম হইতে, যে যেখানে ছিলেন, জাগিয়া উঠিলেন-লোক-লস্কর, সিপাই পাহারা, সৈন্য সামন্ত তীর-তরোয়াল লইয়া খাড়া হইল ।

—সকলে অবাক হইয়া গেলেন— রাজপুরীতে কে আসিল !
রাজপুত্র অবাক হইয়া গেলেন,
রাজকন্যা অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন,
রাজা, মন্ত্রী, জন-পরিজন সকলে আসিয়া দেখেন- রাজপুত্র রাজকন্যা মাথা নামাইলেন ।

রাজপুরীর চারিদিকে ঢাক-ঢোল শানাই-নাকাড়া বাজিয়া উঠিল! রাজা বলিলেন, “তুমি কোন্ দেশের ভাগ্যবান রাজার রাজপুত্র, আমাদিগে মরণ ঘুমের হাত হইতে রক্ষা করিয়াছ!”

জন-পরিজনেরা বলিল, – “আহা! আপনি কোন্ দেবতা-রাজার দেব- রাজপুত্র -এক দৈত্য রূপার কাটি ছোঁয়াইয়া আমাদের গগমা সোনার রাজ্য ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়াছিল, আপনি আসিয়া আমাদিগে জাগাইয়া রক্ষা করিলেন। রাজপুত্র মাথা নোয়াইয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

রাজা বলিলেন, “আমার কি আছে, কি দিব?-এই রাজকন্যা তোমার হাতে দিলাম, এই রাজত্ব তোমাকে দিলাম।”
চারিদিকে ফুল-বৃষ্টি, চারিদিকে চন্দন-বৃষ্টি; ফুল ফোটে, খৈ ছোটে- রাজপুরীর হাজার ঢোলে ‘ডুম্-ডুম্’ কাটি পড়িল।

তখন, শতে শতে বাঁদী- দাসী বাটনা বাটে, হাজার হাজার ধাই-দাসী কুটনা কোটে;
দুয়ারে দুয়ারে মঙ্গল ঘড়া
পাঁচ পল্লব ফুলের তোড়া;
আল্পনা বিলিপনা, এয়োর ঝাঁক,
পাঠ-পিঁড়ী আসন ঘিরে’, বেজে ওঠে শাঁখ।

সে কি শোভা!- রাজপুরীর চার-চত্বর দলদল্ ঝল্‌মল্। আঙ্গিনায় আঙ্গিনায় হুলুধ্বনি, রাজভাণ্ডারে ছড়াছড়ি ;
জনজনতার হুড়াহুড়ি, – এতদিনের ঘুমন্ত রাজপুরী দাপে কাঁপে, আনন্দে তোল্-পাড়ু ।

তাহার পর, ফুটফুটে চাঁদের আলোয় আগুন-পুরুত সম্মুখে, গুয়াপান, রাজ-রাজত্ব যৌতুক দিয়া রাজা, পঞ্চরত্ন মুকুট পরাইয়া রাজপুত্রের সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ দিলেন ।

চারিদিকে জয়ধ্বনি উঠিল ।
এক বছর, দু’বছর, বছরের পর কত বছর গেল, – দেশভ্রমণে গিয়াছেন, রাজপুত্র আজও ফিরেন না।

কাঁদিয়া কাটিয়া, মাথা খুঁড়িয়া রাণী বিছানা নিয়াছেন। ভাবিয়া ভাবিয়া, চোখের জল ফেলিতে ফেলিতে রাজা অন্ধ হইয়াছেন। রাজ্য অন্ধকার, রাজ্যে হাহাকার।

একদিন ভোর হইতে-না-হইতে রাজদুয়ারে ঢাক-ঢোল বাজিয়া উঠিল, হাতি ঘোড়া সিপাই সান্ত্রীর হাঁকে দুয়ার কাঁপিয়া উঠিল।

রাণী বলিলেন,- “কি, কি?”
রাজা বলিলেন,– “কে, কে?’
রাজ্যের প্রজারা ছুটিয়া আসিল । রাজপুত্র-
রাজকন্যা বিবাহ করিয়া লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন !!

কাঁপিতে কাঁপিতে রাজা আসিয়া রাজপুত্রকে বুকে লইলেন। পড়িতে পড়িতে রাণী আসিয়া রাজকন্যাকে বরণ করিয়া নিলেন ।
প্রজারা আনন্দ ধ্বনি করিয়া উঠিল ।

রাজপুত্র রাজার চোখে সোনার কাটি ছোঁয়াইলেন, রাজার চোখ ভাল হইল । ছেলেকে পাইয়া, ছেলের বউ দেখিয়া রাণীর অসুখ সারিয়া গেল । তখন, রাজপুত্র লইয়া, ঘুমন্ত পুরীর রাজকন্যা লইয়া, রাজা-রাণী সুখে রাজত্ব করিতে লাগিলেন

Read More: গল্পের বই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top