অসম প্রেম কি – অসম প্রেম কাহিনী 1

অসম প্রেম কি অসম প্রেম কাহিনী

অসম প্রেম কি

তিস্তা নদীর পাড়ে বসে সাইফুল পানির দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে সে ঝর্ণাকে একটা চিঠি দিয়েছে। চিঠি নিয়ে ঝর্ণা যে রকম রাগের সঙ্গে তাকিয়েছিল, তাতে করে বেপরোয়া স্বভাবের সাইফুল প্রথমে একটু ভয় পেলেও পরক্ষণে বলেছিল, রাগ করো আর যাই করো, চিঠিটা পড়ার পর করো। চিঠিটা কি সে না পড়ে ছিঁড়ে ফেলেছে, না-পড়ে ছিঁড়েছে? যদি পড়ে থাকে, তা হলে সে কি করবে, এই কথাই সে ভাবছে। নদীর স্রোতের কুলকুল ধ্বনি তার কানে প্রবেশ করছে না। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।

অসম প্রেম কি অসম প্রেম কাহিনী

রাখাল ছেলেরা নদীর চর থেকে গরু-ছাগল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। নানা রকম পাখি দলবেঁধে কিচির মিচির করতে করতে নিজেদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। সাইফুল প্রতিদিন সন্ধ্যে পর্যন্ত নদীর পাড়ের এই জায়গায় বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আনন্দ উপভোগ করে। আজ কোনো দিকে তার খেয়াল নেই। গ্রামের মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান শুনে ত্রস্তাপদে নামায পড়ার জন্য মসজিদের দিকে যেতে যেতে ভাবল, ঝর্ণাকে চিঠিটা দেয়া বোধ হয় ঠিক হয় নি ।

উত্তর বাংলার কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তা নদীর পূর্ব দিকে অনন্তপুর গ্রাম। রাক্ষসী তিস্তা এই গ্রামের অনেক লোককে পথে বসিয়েছে। তবু যেন তার ক্ষুধা মিটছে না। ঘরবাড়ি গ্রাস করেই চলেছে। গ্রামের মাঝখানে সেমীপাকা হাইস্কুল। তার পাশে সরকারি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল। সাইফুলের পূর্ব পুরুষদের বাড়ি ছিল এই গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে। তিস্তা তখন তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যেত। হঠাৎ একদিন তিস্তা ক্ষেপে গিয়ে ঘরবাড়ি গ্রাস করতে লাগল। তখন সাইফুলের দাদাজীর আমল।

ওর দাদাজীর নাম কলিম উদ্দিন। কলিম উদ্দিনের বাস্তু-ভিটা, জমি-জায়গা, পুকুর-ডোবা ও আগান- বাগান নেহাত কম ছিল না। তিস্তা সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাকে পথের ভিখারি করে দিল। শেষে কলিম উদ্দিন একই গ্রামের শ্বশুরের একটা পড়ো জমিতে দু’খানা বেড়ার ঘর উঠিয়ে বাস করতে লাগলেন। বার মাস যার বাড়িতে কামলারা কাজ করত, সে এখন অন্যের বাড়িতে কামলাগিরী করে সংসার চালায়। তার একমাত্র ছেলে ওসমান।

সেও বাপের সঙ্গে অন্যের ক্ষেত-খামারে কামলাগিরী করছে। যে বছর এক রকম নিঃস্ব হয়ে কলিম উদ্দিন এই গ্রামে চলে আসেন, সে বছর ওসমান এস. এস. সি’তে ভালো রেজাল্ট করেও আর পড়াশোনা করতে পারে নি। কলিম উদ্দিন নিজের ভাগ্যের দুরাবস্থার কথা চিন্তা করে দিনের পর দিন ভেঙ্গে পড়তে লাগলেন। কলিম উদ্দিন ধার্মিক লোক । তিনি ছেলেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছেন।

ওসমানের কলেজে পড়ার খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তার আব্বার শরীরের দিকে তাকিয়ে এবং আর্থিক দুরাবস্থার কারণে সংসারে হাল ধরতে বাধ্য হয়েছে। তার মামাদের অবস্থাও তেমন ভালো নয়। কোনো দিকে আশার আলো দেখতে না পেয়ে ওসমান গ্রামের লোকজনের ক্ষেত-খামারে কাজ করে সংসার চালাতে লাগল। একবার রংপুরে অথবা ঢাকায় এসে চাকরির চেষ্টা করবে বলে তার আম্মাকে বলেছিল । জেবুন্নেসা তখন বলেছিলেন, তুই আমাদের একমাত্র ছেলে। তোর আব্বা আর খাটাখাটনি করতে পারে না।

তুই শহরে গিয়ে চাকরি করে কবে টাকা পাঠাবি তার কোনো ঠিক আছে। ততদিন আমাদের চলবে কি করে? এই কথা শোনার পর সে শহরে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দেশেই কামকাজ করতে লাগল। আর রাতে কয়েকা ছেলেকে প্রাইভেট পড়িয়ে যা আয় করত, তা থেকে কিছু জমা রাখত। এভাবে কয়েক বছর কঠোর পরিশ্রম করে সংসারে কিছুটা স্বচ্ছলতা এনেছিল ।

এক সময় আব্বা-আম্মার জেদাজেদিতে মামাতো বোন মালেকাকে বিয়ে করে। বিয়ের তিন বছর পর মালেকা একটা কন্যা সন্তান প্রসব করে। কলিম উদ্দিন নাতনির নাম রাখলেন মনিরা বেগম। মনিরা জন্মাবার এক বছর পর দেড় মাসের ব্যবধানে কলিম উদ্দিন ও জেবুন্নেসা মারা যান। ওনাদের মৃত্যুর পাঁচ বছর পর সাইফুলের জন্ম হয়। ওসমান সাইফুলকে প্রথমে ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় আরবি পড়তে দেয়। আরো একটু বড় হতে স্কুলে ভর্তি করে।

সাইফুল ছোট বেলা থেকে খুব মেধাবী পড়াশোনায়ও খুব মনোযোগী। কিন্তু ভীষণ চঞ্চল ও বেপরোয়া। পাড়ার ছেলেদের সাথে নিজেও যেমন মারামারি, ঝগড়া-ঝাঁটি করে, তেমনি অন্যদের দ্বারা ঐ সব করাতেও ওস্তাদ। সাইফুল যখন কিশোর বয়সে পড়ল তখন ওসমান ছেলেকে কড়া শাসনে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সেই মতো চালাত। হাই স্কুলে ভর্তি হয়ে তার স্বভাবের সবকিছু পরিবর্তন হল । কিন্তু বেপরোয়া ভাবটা রয়ে গেল।

সমাজের কেউ কিছু অন্যায় করলে, তার বিচার না হওয়া পর্যন্ত তাকে ছেড়ে কথা কয় না। শিশুকাল থেকে সাইফুল একটু রোগা। এখন সে তরুণ। মাঝারি ধরনের লম্বা একহারা শরীর । গায়ের রং ঠিক ফর্সা নয়, ঈষৎ চাপা উন্নত নাক, মুখের দিকে তাকালে বেপরোয়া ভাবটা বেশ বোঝা যায়। নিচের ক্লাস থেকে সে ফার্স্ট হয়ে আসছে। সেই জন্যে তার বেপরোয়া স্বভাব জেনেও স্কুলের ছাত্র- ছাত্রীরা এমন কি শিক্ষকরাও তাকে মনে মনে ভালবাসে।

এই গ্রামে মেয়েদের জন্য কোনো আলাদা স্কুল না থাকায়, ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে ক্লাস করে। প্রত্যেক ক্লাসে ছেলেরা একদিকে বসে, আর মেয়েরা অন্য দিকে। মধ্যখান দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা । সরকারি ফ্রি প্রাইমারী স্কুল থেকে সাইফুল বৃত্তি নিয়ে পাশ করে হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়। প্রথম যেদিন সাইফুল স্কুলে আসে, সেদিন ঝর্ণার দিকে সে বারবার তাকিয়ে দেখেছে। ক্লাসের সব মেয়েদের চেয়ে ঝর্ণাকে বেশি সুন্দরী মনে হয়েছিল।

অসম প্রেম কি অসম প্রেম কাহিনী

ছোটবেলা থেকে সে যেকোনো সুন্দর জিনিসকে ভালবাসে। প্রাকৃতিক দৃশ্য তাকে সব থেকে বেশি আকর্ষণ করে। তাই সে খেলাধূলার চেয়ে নদীর পাড়ে ঘুরে ঘুরে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। ঝর্ণাকে দেখার পর থেকে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য সাইফুলের মন ছটফট করত। কয়েকদিন পর একদিন টিফিনের সময় ঝর্ণার কাছে গিয়ে তার নাম জিজ্ঞেস করেছিল। ঝর্ণা তার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করেছিল তখন তার সাথের মেয়েটা ঝর্ণার নাম বলে। আরো অনেক পরে সাইফুল তার আব্বার নাম জেনেছিল হামিদ চেয়ারম্যান।

ঝর্ণা হাই স্কুলের মর্নিং সিফটে বেতন দিয়ে ক্লাস ওয়ান থেকে পড়ে আসছে। আর সাইফুল গরিবের ছেলে বলে সরকারি ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে পড়েছে। তাই সে ঝর্ণাকে চিনত না। ঝর্ণাও নিচের ক্লাস থেকে ফার্স্ট হয়ে এসেছে। সে বছর সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার সময় সাইফুল ফাস্ট আর ঝর্ণা সেকেণ্ড হয়। রেজাল্টের দিন সেকেণ্ড হয়েছে জেনে ঝর্ণা কেঁদেছিল। সেই সঙ্গে সাইফুলের প্রতি তার খুব রাগ হয়েছিল, আর মনে মনে ভেবেছিল, সামনের বছর সাইফুল কেমন করে ফাস্ট হয় দেখবে। কিন্তু সে বাসনা আজ পর্যন্ত পূরণ হয়নি। ফলে সাইফুলের প্রতি রাগ ও ঘৃণা বছরের পর বছর বাড়তেই থাকে। কোনো কোনো সময় সাইফুল তার সঙ্গে কথা বলতে গেলে, ঝর্ণা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। এখন তারা ক্লাস টেনে পড়ে।

গত সপ্তাহে যেদিন টেস্টের রেজাল্ট বেরোল, সেদিন ঝর্ণা প্রথম সাইফুলের সঙ্গে কথা বলে। ঐ দিন রেজাল্ট জানার জন্য সাইফুল স্কুলে গিয়ে দেখল, ঝর্ণা নোটিশ বোর্ডের কাছে কয়েকজন মেয়ের সাথে কথা বলছে। সাইফুলকে দেখে ঝর্ণা বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, তুমি আবার এসেছ কেন ? ভালো ছাত্রদের রেজাল্ট তো জানাই থাকে ।

ঝর্ণার বিদ্রুপের হাসি সাইফুল বুঝতে পেরেও গায়ে মাখল না। যেচে কথা বলেছে এটাই তার কাছে সৌভাগ্য বলে মনে হল। সেও হাসিমুখে বলল, ভালো ছাত্ররাও অনেক সময় ফেল করে। তা ছাড়া তুমিও তো ঐ দলের ; তবে তুমি কেন এসেছ?

সাইফুলকে হেসে কথা বলতে দেখে ঝর্ণা মুখ ঘুরিয়ে সঙ্গিদের নিয়ে চলে গেল । ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলার পর সাইফুলের বেপরোয়া ভাবটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তাই ভালো-মন্দ না ভেবে সে আজ তাকে চিঠি দেয়। স্কুলের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা উত্তর-দক্ষিণে গেছে। ঝর্ণাদের ঘর উত্তর দিকের গ্রামের রাস্তার শেষ প্রান্তে। আর সাইফুলদের ঘর দক্ষিণ দিকের গ্রামের শেষ প্রান্তে।

স্কুলে আসার আগে সাইফুল চিঠিটা লিখে এনেছিল । ভেবেছিল, কোনো এক ফাঁকে ঝর্ণাকে দেবে। কিন্তু সে সুযোগ পেল না। তাই ছুটির সময় সাইফুল আগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে ঝর্ণাদের বাড়ির রাস্তায় কিছু দূরে এসে একটা বড় আমগাছের আড়ালে দাঁড়াল। সৌভাগ্যক্রমে রাস্তায় তখন কোনো লোকজন ছিল না । একটু পরে ঝর্ণাকে তাদেরই ক্লাসের বেলী নামে একটা মেয়ের সঙ্গে আসতে দেখল। কাছে এলে সাইফুল আমগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চিঠিটা তার হাতে একদম গুঁজে দিল ।

ঝর্ণা ভাবতেই পারেনি, সাইফুল তাকে চিঠি দেবে। প্রথমে ভ্যাবাচ্যাখা খেয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণে যখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, এটাতে কি লিখেছ? তখন সাইফুল ঐ কথা বলে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় ।
মাগরিবের নামায পড়ে ঘরে এসে সাইফুল পড়তে বসে কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারল না। কেবল ঝর্ণার কথা মনে পড়তে লাগল ।

পরের দিন স্কুলে এসে কয়েকবার আড়চোখে ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে তার মনের ভাব কিছু বুঝতে পারল না ।
প্রথম ক্লাস হেডমাস্টার তাহের সাহেবের। তিনি ক্লাস টেনের এই সেকশনে অংক করান। আজ ক্লাসে এসে রোল কল শেষ করে সাইফুলের কাছে অংকের বই চাইলেন । সাইফুল বইটা দেয়ার আগে ঝর্ণা এসে একটা চিঠি স্যারের টেবিলের উপর রেখে আস্তে আস্তে বলল, গতকাল সাইফুল আমাকে দিয়েছে। তারপর ফিরে এসে নিজের সিটে বসে পড়ল ।

সাইফুলের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাহের সাহেব সেটা পড়ে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার অর্ণার দিকে তাকিয়ে
ঝর্ণাকে হেডস্যারের কাছে চিঠিটা দিতে দেখে সাইফুলের সৎকম্পন শুরু হল। তারপর স্যারকে ঐ ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সে অংকের বইটা দেয়ার জন্য বইটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই অবস্থায় সে মাথা নিচু করে রইল।

স্কুলের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা জানে, হেডস্যার তাহের সাহেব যেমন খুব ভালো শিক্ষক তেমনি অত্যন্ত আদর্শবান। কোনো অন্যায়কে তিনি প্রশ্রয় দেন না, তা সে যেই হোক না কেন? ঝর্ণা যখন চিঠিটা স্যারকে দেয় তখন ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সেদিকে চেয়েছিল। সবাই জানে হেডস্যার হঠাৎ রাগেন না। কিন্তু কোনো কারণে রেগে গেলে তখন আর ওনাকে চেনা যায় না। ফর্সা গোলগাল মুখটা রাগে লাল হয়ে যায়। ঝর্ণার চিঠি পড়ে স্যারকে সাইফুলের দিকে ঐভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে গর্জে উঠলেন, চুপ কর। তারা ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়ল।

সবাই ফিস ফিস করে বলাবলি করতে লাগল, আজ সাইফুলের নিস্তার নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের গুঞ্জন শুনে তাহের সাহেব টেবিলে ডাষ্টার ঠুকে স্যারের কথা শুনে ছেলেমেয়েরা সব চুপ হয়ে গেল। তাহের সাহেবের হাতে সব সময় একটা বেতের চাবুক থাকে। স্কুলে যতক্ষণ যেখানেই থাকেন, বেতটা সঙ্গে থাকবেই । অবশ্য কেউ গুরুতর অন্যায় না করলে কাউকে কখনো বেত্রাঘাত করেন না। ছোটখাট অন্যায় কেউ করলে বেত নাচিয়ে ভয় দেখিয়ে বুঝিয়ে তাকে সাবধান করে গম্ভীরস্বরে ডাকলেন, সাইফুল, এদিকে এস । দেন।

তিনি চিন্তা করতেই পারছেন না, সাইফুলের মতো ছেলে এই কাজ করবে।
হেডস্যারের এই স্বর সকলের জানা। তারা ভাবল, আজ সাইফুলের রক্ষা নেই। যারা সাইফুলকে দেখতে পারত না, তারা মনে মনে খুব খুশী হল। আর অন্যরা ভয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগল। সাইফুলও বুঝতে পেরেছে এখন কি ঘটবে। তাই সে স্যারের ডাক শুনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল।

এটা তোমার লেখা ? চিঠিতে সাইফুলের নাম নেই। তাহের সাহেব সাইফুলের হাতের লেখা চেনেন এবং ঝর্ণাও তার নাম বলেছে। তবু সত্য-মিথ্যা যাচাই করার জন্য জিজ্ঞেস করলেন, রইল । সাইফুল ভয়ে ও লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে
সাইফুল ঢোক গিলে কোনো রকমে বলল, জি । তাহের সাহেব একই স্বরে বললেন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

উত্তর দাও ।
তাহের সাহেব দাঁড়িয়ে সারা শরীরে বেতের পর বেত মেরে চললেন।
সাইফুল ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলানর আপ্রাণ চেষ্টা করল। মুখ দিয়ে হল সে বুঝি অজ্ঞান হয়ে যাবে। কোনো শব্দ বের হল না। শুধু চোখ দিয়ে অবিরল পানি পড়ছে। এক সময় তার মনে যাও, বস গিয়ে । আর কখনো এরকম ঘটনা যেন না শুনি । মারতে মারতে তাহের সাহেব ক্লান্ত হয়ে মারা বন্ধ করে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, সাইফুল কোনোরকমে টলতে টলতে নিজের সিটে এসে বসে পড়ল।

তাহের সাহেব ছেলেদের জিজ্ঞেস করে দু’তিনটে হোম টাক্সের কঠিন অংক বোর্ডে করে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর ঘন্টা পড়তে হোমটার দিয়ে তিনি ছাত্র হাজিরা খাতা, ডাষ্টার, চক, বেত ও চিঠিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। হেডস্যার চলে যাওয়ার পর ক্লাসের মধ্যে আবার গুঞ্জন উঠল। ছেলেরা মেয়েদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাতে তাকাতে রাগে ফুলতে লাগল। মেয়েদের মধ্যে যারা চিঠির কথা জেনেছিল, তারা বলল, ঠিক হয়েছে। আর অন্যরা ঝর্ণার কাছে এসে জিে করল, সাইফুল তোকে কি এমন লিখেছিল, যার জন্য হেডস্যারকে দিয়ে মার খাওয়ালী? ঝর্ণা মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, যা লিখেছে তা যদি তোদেরকে লিখতো, তা হলে তোরাও আমার মতো করতিস।

গতকাল ঝর্ণা স্কুল থেকে ঘরে ফেরার সময় যখন তেমাথা রাস্তায় এল তখন সাইফুল এই চিঠিটা তাকে দেয়। ঝর্ণার একবার মনে হয়েছিল, চিঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু সাইফুলের কথা শুনে কি লিখেছে জানার আগ্রহে তা না করে শুধু একবার তার দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে চলে আসে। নিজের রুমে এসে চিঠিটা খুলে দেখতে পেল, পুরো চিঠিটাতে শুধু “ঝর্ণা আই লাভ ইউ” লেখা। পড়ে তার মাথা গরম হয়ে গেল।

চাচাতো বোন বেলী রাস্তায় ঝর্ণাকে বলেছিল, কিরে চিঠিতে সাইফুল কি লিখেছে পড়বি না? ঝর্ণা তখন বলেছে, ঘরে গিয়ে পড়ব। তুইও আমার সঙ্গে চল। এখন তার হাতে চিঠিটা দিয়ে বলল, পড়ে দেখ, ফকিরের ছেলের সাহস কত? যার গায়ে তালি দেয়া ময়লা জামাকাপড় দেখলে বোঝা যায় তার বাপের অবস্থা। সে কি না আমাকে ভালবাসে। তারপর বলল, কি করা যায় বলতো? চিঠিটা আব্বাকে দিয়ে ছেলেটাকে শায়েস্তা করতে বলবো?

বেলী বলল, তার চেয়ে হেডস্যারকে দিলে আরো ভালো হবে। গরিবের ঘোড়া রোগে ধরেছে। তুই হেডস্যারকেই দে। বাছাধনকে একদম প্রেমের ঘোল খাইয়ে ছাড়বেন।

ঝর্ণা স্কুলে আসার পর থেকে চিন্তা করেছে, কখন চিঠিটা স্যারকে দেয়া যায়। রোল কলের পর দেবে ভেবে রেখেছিল। তাই স্যার যখন সাইফুলের কাছে অংকের বই চাইলেন তখন সে তার আগে চিঠিটা দিয়েছে। হেডস্যার যখন সাইফুলকে মারতে ছিলেন তখন ঝর্ণা তার করুন অবস্থা দেখে মনে মনে হেসেছে আর বলেছে, এখন বুঝো বড় লোকের মেয়েকে ভালবাসার ফল ।

ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারল, সাইফুল নিশ্চয় ঝর্ণাকে প্রেম পত্র দিয়েছিল। তবু কয়েকজন ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করল, ঝর্ণাকে চিঠিতে কি লিখেছিলি? সাইফুল তাদের কথায় কান না দিয়ে বই খাতা নিয়ে বাড়ি চলে গেল?
সাইফুলের আব্বা ওসমান ক্ষেতের কাজ সেরে স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে ঘরে ফিরছিল। মোরসেদ তাকে দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বলল, ওসমান চাচা, সাইফুল ঝর্ণাকে চিঠি দিয়েছিল বলে হেডস্যার তাকে ভীষণ মেরেছেন।

ওসমান জিজ্ঞেস করল, সাইফুল কোথায় ?
মোরসেদ বলল, মার খাওয়ার পর সে ঘরে চলে গেছে।
ওসমান তাকে আর কিছু না বলে ঘরের দিকে চলে গেল। মোরসেদ সাইফুলের বন্ধু । একই পাড়ায় ঘর।

মোরসেদ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। সাইফুলকে হেডস্যার যখন মারতেছিলেন তখন তারও খুব কষ্ট হয়েছে। ঝর্ণাকে যে সাইফুল ভালবাসে, তা মোরসেদ জানত । কিন্তু চিঠি দেয়ার কথাটা জানত না। সাইফুল তাকে না জানিয়ে ঝর্ণাকে চিঠি দিয়েছে জেনে তার উপর মোরসেদের একটু মনে কষ্ট হল। বিকেলে তাদের ঘরে গিয়ে জ্বর শুনে তার চিঠির কথা জানাতিস, তা হলে এরকম হত না। কাছে গিয়ে কথাটা না বলে পারল না। তারপর আরো বলল, তুই যদি আগে আমাকে
সাইফুল ম্লান হেসে বলল, তুই মনে কষ্ট নিস না। চিঠি দেয়ার কথা আমার আগে স্কুলেও তোকে জানাবার সুযোগ পাইনি। মনে হয় নি। আজ স্কুল যাওয়ার আগে হঠাৎ খেয়াল টাঘাড়ে চাপে। তাই তখনই লিখি ।

ওসমান মোরসেদের কাছে ছেলের অপকর্মের কথা শুনে খুব রেগে যায়। ঘর এসে ছেলের ওপর ভীষণ রাগারাগি করল। ঐদিন রাত থেকে সাইফুল কয়েকদিন জ্বরে ভুগল।

খবর পেয়ে হেডস্যার তাহের সাহেব সাইফুলকে একদিন এসে দেখে গেছেন। ঐদনি রেগে দিয়ে তিনি সাইফুলকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু পরে সে কথা চিন্তা করে ওঁর চোখ দুটো পানিতে ভরে গেছে। ভাবলেন, তাকে বেশি স্নেহ করি বলে জিজ্ঞেস করেন, সাইফুল স্কুলে আসছে না কেন তুমি জান? কি শাসনটাও বেশি করে ফেললাম? তাকে স্কুলে আসতে না দেখে মোরসেদকে
মোরসেদ বলল, তার জ্বর হয়েছে। সেইদিনই তিনি সাইফুলকে দেখতে যান।

সাইফুলের বড় বোন মনিরা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখন ওসমান ভালো সম্বন্ধ হয়ে বলল, আমি আর ঐ স্কুলে পড়ব না । পেয়ে তার বিয়ে দিয়ে দেন। সাইফুলের ঘটনাটা সে জানতে পারল না। সাইফুল ভালো
করেছেন। তাতে স্কুল কি দোষ করল? শুনে ওসমান রেগে গিয়ে বলল, অন্যায় করেছিলি, সে জন্যে মাস্টার শাসন
সাইফুল বলল, আমি কিছুতেই ঐ স্কুলে আর পড়বো না ।

ওসমান চিন্তা করল, মনিরা পরের ঘরে, সাইফুলকে কড়াকড়ি করলে সে যদি কোথাও চলে যায়? তাই বেশি বকাবকি না করে বুঝিয়ে বলল, কয়েক মাস পরে তোর ফাইন্যাল পরীক্ষা। সে জন্যে স্কুলের বেতন, কোচিং চার্জ ও পরীক্ষার ফি সবকিছু দেয়া হয়ে গেছে । তা ছাড়া এখন তো তুই অন্য স্কুল থেকেও পরীক্ষা দিতে পারবি না। ওসব তুই তো কলেজে পড়বি । পাগলামি ছাড়, এই কটা মাস মন দিয়ে পড়াশোনা করে পরীক্ষাটা দিয়ে দে। তারপর সাইফুল স্পষ্ট জানিয়ে দিল, আমি এবছর পরীক্ষা দেব না, পরের বছর দেব।

কাছে গিয়ে ছেলের মতামতের কথা বলে বোঝাতে বলল । ওসমান ছেলের কথা শুনে খুব রেগে গেলেও কিছু বলল না। চুপি চুপি হেডস্যারের
তাহের সাহেব বললেন, অত ভালো ছেলে শিক্ষকের হাতে মার খেয়ে পরীক্ষা দেবে না, এ কেমন কথা? স্কুলে আসতে যদি তার লজ্জা হয়, তা হলে বাড়িতে পড়ে পরীক্ষা দিক। সাইফুল যে স্কলারসীপ পাবেই সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। স্কলারসীপ চলুন, আমি আপনার সঙ্গে গিয়ে বোঝাব পেলে আমাদের স্কুলের ও গ্রামের কত গৌরব হবে। না-না তা হতে দিতে পারি না ।

সাইফুল দূর থেকে আব্বার সঙ্গে হেডস্যারকে আসতে দেখে ঘরের পিছনের কলাবাগান দিয়ে পালিয়ে গেল। তারপর সে আর ঘরে ফিরল না। সেদিন বিকেলে মধুপুরে বুবুদের বাড়িতে এসে রাত কাটাল। সকালে মনিরার কাছ থেকে কয়েকটা টাকা চেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা দিল।
এদিকে ওসমান হেডস্যারকে বসতে বলে সাইফুলকে দেখতে না পেয়ে স্ত্রীকে তার কথা জিজ্ঞেস করল।
মালেকা বলল, একটু আগেও তো ঘরে ছিল। মনে হয় তোমার সাথে হেডস্যারকে আসতে দেখে বাইরে চলে গেছে।

ওসমান স্ত্রীকে কিছু নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলে স্যারের কাছে এসে বলল, ওর আম্মা বলল, একটু আগে ঘরে ছিল, আমাদের আসতে দেখে পালিয়েছে
হেডস্যার বললেন, এখন তা হলে চলি; আর একদিন আসব।
ওসমান বলল, একটু বসুন। গরিবের বাড়ি এসেছেন, কিছু মুখে না দিয়ে যেতে পারবেন না।
হেডস্যার নাস্তা খাওয়ার পরও সাইফুলের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গেলেন ।

সেদিন রাতেও যখন সাইফুল ফিরে এল না তখন মালেকা স্বামীকে বলল, ও বোধ হয় মনিরাদের বাড়ি গেছে। তুমি কাল সকালে গিয়ে নিয়ে এস ।
দিল । ওসমান তখন স্ত্রীকে কিছু না বললেও সকালে নাস্তা খেয়ে মেয়ের বাড়িতে রওয়ানা মাইল তিনেক দূরে মধুপুর গ্রামে মনিরার বিয়ে হয়েছে। জামাইয়ের নাম কাওসার। সুন্দর স্বাস্থ্যবান ছেলে। মা-বাপ নেই। এক ফুফু তাকে মানুষ করেছে। ফুফু নিঃসন্তান বিধবা। তিন কূলে তারও কেউ নেই। সেই ফুফুর বাস্তু ভিটা, আগান-বাগান ও কিছু ক্ষেতি জমি আছে। কাওসার ফুফুকেই মা বলে জানে। তার জন্মের কয়েকদিন পর তার মা মারা যায়। ফুফু পনের দিনের ভাইপোকে নিয়ে এসে মানুষ করেছে।

নির্ঝঞ্ঝাট সংসার দেখে ওসমান মনিরাকে সেই ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। বিয়ের বছর দুই পরে মনিরার একটা মেয়ে হয়। ওসমান খবর পেয়ে নাতনিকে দেখতে গিয়ে তার নাম রাখে নাজনীন। নাজনীন যখন দু’বছরের তখন মনিরার ফুফুশাশুড়ী মারা যায়। কাওসার খুব কর্মঠ ছেলে। নিজের ও গ্রামের লোকের ক্ষেতে-খামারে কাজ করে বেশ ভালো ভাবেই সংসার চালিয়ে আসছে। ওসমান যখন মেয়ের বাড়ি গিয়ে পৌছাল তখন বেলা দশটা ।

অসম প্রেম কি অসম প্রেম কাহিনী

মনিরা আব্বাকে এক বদনা পানি দিয়ে বলল, অজু করে ঠান্ডা হন। ওসমান ওজু করে বসার পর মনিরা একটা বড় গ্লাসে করে একগ্লাস পানি, এক গ্লাস সরবৎ ও পানের সরঞ্জাম নিয়ে এসে সামনে রেখে হাত পাখা দিয়ে আব্বাকে বাতাস করতে করতে খবরা-খবর জিজ্ঞেস করল।
ওসমান সরবৎ খেয়ে একটা পান সেজে মুখে দিয়ে সাইফুল এখানে এসেছিল কিনা জিজ্ঞেস করল।

মনিরা বলল, সাইফুল কাল বিকেলে এসেছিল। আজ সকালে নাস্তা খেয়ে আমার কাছ থেকে বিশ টাকা চেয়ে নিয়ে গেল। আব্বার কপালে চিন্তার ছাপ দেখতে পেয়ে পড়াশোনা না করে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন? জিজ্ঞেস করল, সাইফুলের কি হয়েছে? তুমি কিছু বলেছ? ওর সামনে পরীক্ষা।
ওসমান একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সব কথা বলল।

জনে মনিরার মন খারাপ হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ও যা ছেলে, একবার যখন বলেছে এ বছর পরীক্ষা দেবে না তখন কি আর দেবে? আমার মনে হয় সে ঘরে না গিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। তুমি ওর জন্য চিন্তা করো না আব্বা। ছোট না, খাট না, অতবড় ছেলে হয়ে যদি নিজের পায়ে নিজে কুড়োল মারে, তাতে তোমার কি করার আছে? এবেলা থেকে খেয়েদেয়ে ওবেলা যাবে।

এমন সময় মনিরার মেয়ে নাজনীন স্কুল থেকে এসে নানাকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বই খাতা রেখে কদমবুসি করে বলল, কেমন আছেন নানা? নানি ভালো আছে? মামা কালকে এসেছিল, আজ সকালে নাস্তা খেয়ে চলে গেল। কত করে বললাম থাকতে, থাকল না। আপনাকে আজ থাকতে হবে কিন্তু ।
ওসমান নাতনীকে দু’হাতে ধরে কোলে বসিয়ে মাথায় চুমো খেয়ে দোয়া করে বললেন, হ্যাঁ ভাই আমরা সবাই ভাল আছি। তুমি এখন কোন ক্লাসে পড়?
নাজনীন বলল, নানা ভাই, আপনি বড্ড ভুলে যান। সেবারে যখন এলেন তখন বলেছিলাম না, থ্রিতে পড়ি?

ওসমান মনিরাকে বলল, তোর মেয়ে একদিন লেখাপড়ায় খুব ভালো হবে দেখিস । তারপর বলল, এবার যাই মা, তোর মা আবার ওদিকে চিন্তা করবে।
মনিরা বলল, চিন্তা করবে কেন? আম্মা তো জানে তুমি এখানে এসেছ।
নাজনীন বলে উঠল, আমি আপনাকে যেতে দিলে তো যাবেন। তারপর সে যাবেন। গেলে রোদে মাথা ফেটে যাবে । ছাতাটা নিয়ে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রেখে এসে বলল, এবার যান তো দেখি কেমন করে ওসমান হেসে উঠে মনিরাকে বলল, তোর মেয়ের বুদ্ধি দেখেছিস? আমাকে যেতে দেবে না বলে আমার ছাতা লুকিয়ে রেখে রোদের ভয় দেখাচ্ছে।

মনিরা হাসিমুখে নাজনীনকে বলল, তুই স্কুলের জামা খুলে এসে নানার সাথে গল্প
কর, আমি রান্নার ব্যবস্থা করি। সেদিন বিকেলে ওসমান ঘরে ফিরে স্ত্রীকে সাইফুলের কথা জানাল? তারপর বেশ কিছুদিন পার হয়ে যেতেও যখন সাইফুল ফিরে এল না তখন তারা আল্লাহর কাছে চেয়ে সবুর করে রইল । ছেলের সহিসালামতের জন্য এবং তাকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কান্নাকাটি করে দো’য়া
মনিরা মাঝে মাঝে এসে আব্বা-আম্মাকে প্রবোধ দিয়ে যায় সাইফুলের ঘটনা গ্রামের লোকজন জেনে অনেক দুঃখ প্রকাশ করল।

কিন্তু ঝর্ণা করতে পেরে খুব খুশী হয়েছে। তাকে মনের মতো শাস্তি দিতে পেরেছে ভেবে ও তার পড়াশোনা বন্ধ করে গ্রাম ছাড়া
সেদিন সাইফুল বুবুর বাড়ি থেকে ঢাকায় চলে আসে। ঢাকায় এসে ছেলে মেয়েদের পড়াবার বদলে থাকা-খাওয়ার লজিং এর অনেক চেষ্টা করল। অচেনা
ছেলেকে দরকার থাকলেও কেউ রাখতে চাইল না। থাকা-খাওয়ার তার খুব কষ্ট হতে লাগল। শেষে কোনো উপায় না দেখে এক রিক্সাওয়ালাকে অনেক অনুনয় বিনয় করে তার কাছে রিক্সা চালান শিখে রিক্সা চালাতে লাগল। আর রিক্সার মালিককে বলে তার গ্যারেজে রাত কাটাত। শহরে এসে এতো কষ্টের মধ্যেও সে কিন্তু নামায ছাড়ে নি। সে ফার্মগেটের গ্যারেজের রিক্সা চালায়।

একদিন ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমার সামনে রাত এগারোটার সময় হুড তুলে বসে আছে। তখন শ্রাবণ মাস। তিন-চার দিন একটানা বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সিনেমার প্যাসেঞ্জারদের জন্য সে অপেক্ষা করছে। এই সময়ে প্যাসেঞ্জারদের কাছ থেকে ভালো ভাড়া পাওয়া যায়। এমন কি নিরাপদে পৌঁছে দিলে দু’পাঁচ টাকা বখশীষও মিলে। সিনেমা সাড়ে এগারোটায় ভাঙ্গল। ভাগ্যক্রমে মীরপুর এক নাম্বারের দু’জন প্যাসেঞ্জার পেল। এতরাতে অতদূরে যাওয়ার ইচ্ছা সাইফুলের না থাকলেও পঁচিশ টাকা ভাড়া দেবে শুনে রাজি হয়ে গেল ।

এক নাম্বার পানির ট্যাংকীর পাশে একটা গলিতে নেমে ভাড়া দেওয়া তো দূরের কথা, তারা দু’জনে দুটো চাকু বের করে ভয় দেখিয়ে সাইফুলের সারাদিনের রোজগার কেড়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে বলল। চালাকি করে লোকজন ডাকার চেষ্টা করলে, জানে শেষ করে দেবার হুমকিও দিল তাদের দু’জনের কাছে দুটো চাকু ছিল বলে সাইফুল কিছু বলল না। মনের কষ্ট মনে চেপে ফিরে আসতে লাগল ।

আজ চার মাস হল সে ঢাকায় এসেছে। রিক্সা চালিয়ে সারাদিনে যা রোজগার করে, তা থেকে নিজের খরচ ও রিক্সার জমা টাকা দিয়ে যা বাঁচে তার সবটাই গ্যারেজের মালিকের কাছে জমা রাখে। তার ইচ্ছা প্রয়োজন মতো টাকা জমা হলে স্কুলে ভর্তি হয়ে এস.এস.সি. পরীক্ষা দিবে। আজ তার বেশ ভালো উপার্জন হয়েছিল। এতগুলো টাকা খোয়া গেল ভেবে তার চোখে পানি এসে গেল। কল্যাণপুর পার হয়ে পোলটার উপর উঠেছে এমন সময় শুধু কোমরে চট জড়ান একজন ফকিরের মতো লোক তার পথ আগলে বলল, এই বেটা, তোর কাছে কি আছে দে । আজ তিন দিন আমার কিছু খাওয়া হয় নি ।

সাইফুল রিক্সা থেকে নেমে বলল, আমর আজকের সব রোজগার একটু আগে দু’জন প্যাসেঞ্জার কেড়ে নিয়েছে। কিছু থাকলে নিশ্চয় দিতাম। আপনি আমার রিক্সায় উঠুন। আমি যেখানে থাকি, সেখানে নিয়ে গিয়ে খাওয়াব।

ফকিরটা হো হো করে হেসে উঠল ।
রাত প্রায় একটার মত । এই গভীর রাতে ফকিরের হাসির শব্দে সাইফুল ভয় পেয়ে গের। সাহস করে বলল, হাসছেন কেন? গেলে চলুন। দেখছেন না, গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে গেছি। আমার ঠান্ডা লাগছে ।

ফকিরটা সাইফুলের কাছে এসে নিজের আঙ্গুল থেকে একটা আংটি খুলে তার ডান হাতের মধ্যমায় পরিয়ে দিয়ে বলল, যা বেটা, তুই কি আমাকে খাওয়াবি। আসমানের দিকে আঙ্গুল তুলে আবার বলল, আল্লাহ সবার রেজেকদাতা। সেই সবাইকে খাওয়ায় । তুই খুব সাবধানে থাকবি। ফরয নামায আর ফরয রোযা জীবনে কখনো ছাড়বি না । যদি ছাড়িস তা হলে এই আংটি তোর কাছে থাকবে না। আর তুই বিপদেও পড়বি। সব সময় আল্লাহকে স্মরণ করবি। তা হলে তোর মনস্কামনা পূরণ হবে ।

ফকিরের কথা শুনে সাইফুল হাঁ করে তার দিকে চেয়ে রইল। চেয়ে থাকতে থাকতে এক সময় তার মনে হল, ফকিরকে আর দেখতে পাচ্ছে না। দু’হাতে চোখ রগড়ে চারপাশে তাকিয়ে খুব অবাক হয়ে গেল। কোথাও ফকিরটা নেই। ভাবল, তা হলে কি সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছিল? আংটির কথা মনে পড়তে হাতটা তুলে দেখল, আংটিটা আঙ্গুলে রয়েছে। আল্লাহর নাম স্মরণ করে রিক্সায় উঠে গ্যারেজে ফিরে এল। সকালে মালিককে গত রাতে শুধু টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনাটা বলল।

মালিক বললেন, ভালো-মন্দ দেখে প্যাসেঞ্জার তুলতে হয়।
সেই ঘটনার দিন পনের পর একদিন একটা প্যাসেঞ্জার নিয়ে মতিঝিল এল। প্যাসেঞ্জার নামিয়ে গ্রীনলেজ ব্যাংকের সামনে দিয়ে আসার সময় একজন ভদ্রলোক রিক্সায় উঠে পুরানা পল্টনে যেতে বললেন। ঠিকানা মতো পৌঁছে দিয়ে বেশ কিছু দূর ফিরে আসার পর রিক্সার পাদানিতে কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে দেখল, একটা মাঝারি সাইজের চামড়ার ব্যাগ রিক্সার পাদানিতে পড়ে রয়েছে। রিক্সা থেকে নেমে সাইফুল ব্যাগটা হাতে নিয়ে বুঝতে পারল, ব্যাগটা বেশ ভারি। চেন টেনে খুলে অবাক হয়ে গেল। ব্যাগটা পাঁচশো টাকার নোটে ভর্তি। তাড়াতাড়ি বন্ধ করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সেটা গদীর নিচে রেখে সেই ভদ্রলোকের বাসায় ফিরে চলল।

এদিকে ভদ্রলোক টাকার ব্যাগের কথা ভুলে গেছেন। অসুস্থ স্ত্রীকে রেখে তিনি অফিসে গিয়েছিলেন। দুপুরে বাসায় খেতে আসার সময় স্টাফদের বেতন দেবেন বলে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রিক্সায় করে এসেছেন। খাওয়া-দাওয়া করে স্ত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে বেরোবার সময় টাকার ব্যাগের কথা মনে পড়ল । টাকার ব্যাগ না পেয়ে হতাশ হয়ে বসে ভাবলেন, নিশ্চয় রিক্সায় রয়ে গেছে। গাড়ি থাকলে এরকম হত না। ভুলে গেলেও ব্যাগটা গাড়িতেই থাকত। এরকম কয়েকবার হয়েছে। গাড়িটা ট্রাবল দিচ্ছিল বলে ওয়ার্কশপে দিয়েছেন।

এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, একটা রিক্সাওয়ালা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছে।
ভদ্রলোক একটা কোম্পানীর মালিক। নাম জালাল সাহেব। দারোয়ানর কথা শুনে জালাল সাহেব চমকে উঠে বললেন, তাকে ভিতরে নিয়ে এস।
সাইফুল ব্যাগটা গামছা দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে ভিতরে এসে ভদ্রলোককে চিনতে পারল। দারোয়ান চলে যাওয়ার পর গামছা খুলে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে বলল, আপনি ব্যাগটা আমার রিক্সায় ফেলে এসেছেন ।
জালাল সাহেব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাগে কি আছে দেখেছ?
সাইফুল বলল, জি, দেখেছি। সব পাঁচশো টাকার নোট ।

এলে কেন? নিয়ে চলে যেতে পারতে? জালাল সাহেব আরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জেনে শুনে এটা ফেরৎ দিতে
সাইফুল জ্বীব কেটে বলল, কি বলছেন সাহেব? আপনার টাকা আমি নেব কেন? সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এখন আমি রিক্সাওয়ালা। তাই বলে বেইমানি করব? তা ছাড়া কোনো মুসলমানের কি তা করা উচিত? কাল হাশরের ময়দানে আল্লাহপাকের কাছে মুখ দেখাব কি করে? আমার আব্বা-আম্মা আমাকে বেইমানি করার শিক্ষা দেয় নি ।

জালাল সাহেব বুঝতে পারলেন, নিশ্চয় ছেলেটা বুনিয়াদি ঘরের। কিছু লেখাপড়াও জানে। তিনি ছেলেটার দিকে ভালো করে লক্ষ্য করতেই নিজের ছেলে আরজুর কথা মনে পড়ল। আরজু তার একমাত্র ছেলে ছিল। কলেজে পড়তে পড়তে কুংফু শিখত। কলেজে ইলেকশনের সময় বিপক্ষ পার্টির ছেলেদের ছুরির আঘাতে মারা যায়। তারপর থেকে ওঁর স্ত্রী তাহেরা বেগম অসুস্থ। সাইফুলের মধ্যে তিনি নিজের ছেলের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন। বললেন, বস, কিছু খেয়ে যাও।

সাইফুল বলল, না সাহেব, আমার দেরি হয়ে যাবে। টাকাগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে নিন । কি আছে দেখার জন্যে আমি একবার মাত্র খুলে টাকা দেখে বন্ধ করে ফেলেছি। জালাল সাহেব বললেন, আমি তা বুঝতে পেরেছি। তারপর তিনি ব্যাগ থেকে দুটো পাঁচশো টাকার নোট বের করে তাকে দিয়ে বললেন, এটা তোমার সততার পুরস্কার । সাইফুল বলল, মাফ করবেন, আমি টাকা নিতে পারব না ।

জালাল সাহেব খুব আশ্চর্য্য হয়ে বললেন, নেবে না কেন? তুমি আমার এত বড় উপকার করলে, আর আমি তার প্রতিদান দেব না?
সাইফুল বলল, আপনি যদি সত্যি আমাকে কিছু দিতে চান, তা হলে একটা চাকরি দিতে পারেন । এবার যাই, বেশি দেরি হলে আমার রিক্সা চুরি হয়ে যাবে ।
জালাল সাহেব একটা ভিজিটিং কার্ড তার হাতে দিয়ে বললেন, তুমি রিক্সাটা জমা দিয়ে এই ঠিকানায় আজই আমার সঙ্গে দেখা কর । দেখি, তোমাকে একটা চাকরি দেয়া যায় কিনা । সাইফুল আনন্দে হাত তুলে সালাম দিয়ে রিক্সা জমা দিতে চলে গেল ।

জালাল সাহেব স্ত্রীর রুমে গিয়ে টাকার ঘটনাটা বলে বললেন, ছেলেটা কুব সৎ ও ধার্মিক। ব্যাগে এত টাকা আছে জেনেও ফেরৎ দিয়ে গেল। তাকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিতে গেলাম, তাও নিল না। ছেলেটাকে দেখে আমাদের আরজুর কথা মনে পড়ল। মনে হল, এতদিন পরে যেন আরজু ফিরে এল। ছেলেটা একটা চাকরি চায় । তাকে অফিসে আসতে বলেছি। এলে আমাদের কাছে রেখে দেব ভাবছি।
তাহেরা বেগম বললেন, ছেরেটাকে দেখতে আমার খুব ইচ্ছা করছে। যদি আসে, তা হলে বাসায় নিয়ে এস।
সাইফল রিক্সা জমা দিয়ে মতিঝিলে জালাল সাহেবের অফিসে এল ।

তখন অফিসের ছুটির সময়। জালাল সাহেব তাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে এলেন। ড্রইং রুমে বসিয়ে স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললেন, ছেলেটা এসেছে, চল দেখবে। ছেলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর উনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। পরে জ্ঞান ফিরলেও এক সাইড প্যারালাইজড হয়ে যায় । হাঁটা চলা করতে পারেন না। হুইল চেয়ার ব্যবহার করেন। জালাল সাহেব নিজেই হুইল চেয়ার ঠেলে স্ত্রীকে ড্রইংরুমে নিয়ে এলেন ।
তাহেরা বেগম সাইফুলকে প্রশ্ন করে তার পরিচয় এবং ঢাকায় এসে রিক্সা চালাবার কারণ জানতে চাইলেন ।
সাইফুল ঝর্ণার ব্যাপার ছাড়া সব কিছু বলল ।

তাহেরা বেগম বেশ কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে স্বামীকে বললেন, ও এখন ছেলে মানুষ, কি চাকরি করবে? তা ছাড়া পড়াশোনা করার জন্য চাকরি করতে চায়। কিন্তু চাকরি করতে করতে পড়াশোনা করতে পারলেও ভালো রেজাল্ট করতে পারবে না। তারচেয়ে এক কাজ কর, ও আমাদের আরজু হয়ে আমাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করুক।

দু’জনেরই চোখে পানি। জিজ্ঞেস করল, আরজু কে? সাইফুল সাহেবের স্ত্রীর কথা শুনে অবাক হয়ে ওনাদের দিকে তাকিয়ে দেখল,
জালাল সাহেব চোখ মুছে বললেন, আরজু আমাদের একমাত্র সন্তান ছিল। তাকে আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন। তারপর স্ত্রীকে দেখিয়ে বললেন, সেই থেকে অসুস্থ হয়ে গেছে।

শুনে সাইফুলের মনে দুঃখ হল। সেই সঙ্গে ফকিরের কথা তার মনে পড়ল। আল্লাহকে স্মরণ করে সে উঠে এসে প্রথমে জালালসাহেবকে এবং পরে তাহেরা বেগমকে কদমবুছি করে বলল আমাকে আপনারা আপনাদের ছেলে মনে করবেন ।
তাহেরা বেগম তার মাথায় চুমো খেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, দিয়েছেন। আমরা তোমাকে আরজু বলে ডাকব । হ্যাঁ, তাই মনে করব বাবা।

সে জন্যে বোধ হয় আল্লাহ তোমাকে আমাদের কাছে এনে সেই থেকে সাইফল আরজু হয়ে তাদের কাছে থেকে লেখাপড়া করতে লাগল । সে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও প্রতিদিন ভোরে কুরআন তেলাওয়াত করে ।
তাই দেখে জালাল সাহেব ও তাহেরা বেগম নামায পড়ছেন এবং কুরআন তেলাওয়াত করেন। ওনারা সাইফুলকে পেয়ে নিজেদের ছেলের কথা ভুলে গেলেন ।

তাকে আরজু নামে ডাকেন।
সাইফুল ও ওনাদের স্নেহ বালবাসায় মুগ্ধ হয়ে ওনাদেরকে আব্বা ও আম্মা বলে ডাকে ।
পরের বছর মনিরার স্বামী সাপের কামড়ে মারা গেল। স্বামী মারা যাওয়ার পর মনিরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। কোনো পুরুষ বলতে ঘরে রইল না। শুধু নাজনীনকে নিয়ে বাস করা মুসকীল হল । মনিরা দেখতে সুন্দরী। এখনো অটুট স্বাস্থ্য। তার ওপর তার স্বামীর জমিজায়গা বেশি না হলেও নেহাৎ কম না। গ্রামের ছেলে-বুড়ো নিকের পয়গাম পাঠাতে লাগল। মনিরা তাদেরকে দৃঢ়ভাবে জানাল, সে নিকে করবে না।

কিন্তু তারা লোভ সামলাতে না পেরে বারে বারে পয়গাম পাঠাতে লাগল। রাজি না হলে এর বিহিত করতে বলল । অনেকে জানের হুমকি পর্যন্ত দিতে লাগল। শেষে মনিরা বাধ্য হয়ে আব্বাকে জানিয়ে ওসমানের আগের মতো গায়ে ক্ষমতা নেই। ছেলে চলে যাবার পর তার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। জামাইয়ের গ্রামের লোকদের সঙ্গে গোলমাল না করে সেখানকার সব সম্পত্তি সস্তায় বিক্রি করে দিয়ে মেয়ে ও নাতনিকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল । নাতনির বিয়ে দিতে চাইল । কিন্তু মনিরা কিছুতেই রাজি হল না । লেখাপড়ার জিদ দেখে তাকে এখানকার স্কুলে ভর্তি করে দিল ।

অসম প্রেম কি অসম প্রেম কাহিনী

ওসমান মেয়ের আবার ঝর্ণা এস. এস. সিতে তিনটে লেটার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে পাস করল। তারপর উলিপুর হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজ থেকে ভালভাবে আই.এ. পাস করে বাংলায় অনার্স নিয়ে ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হল। সে রোকেয়া হলে থাকে।
সাইফুলের একটা বছর নষ্ট হল। সে এস. এস. সি ও এইচ. এস. সি’তে প্রথম স্থান অধিকার করে ইসলামিক হিস্ট্রীতে অনার্স নিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হল ।

জালাল সাহেব ও তাহেরা বেগম কলেজে পড়ার সময় সাইফুলকে বার বার বুঝিয়েছেন, সে যেন কোনো পার্টি না করে। কারণ জিজ্ঞেস করলে ছেলের কথা বলেছেন। আরজু যে ঘরে থাকত সেই ঘরেই সাইফুল থাকে। সেখানে আরজুর কয়েকটা বড় বড় ফটো দেয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে। সেগুলোতে আরজুর কুংফু প্রাকটিস করার ছবি। তাই দেখে সাইফুল একদিন জালাল সাহেবকে ও তাহেরা বেগমকে বলল, আমি কুংফু শিখব ।

জালাল সাহেব বরলেন, আজকাল এসব শিখে রাখা ভালো। দেশের যা অবস্থা, রাস্তাঘাটে যখন তখন খুন, জখম, হাইজ্যাক লেগেই আছে। তবে তুমি যদি প্রতিজ্ঞা কর, ঐসব শিখে সাধারণ মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না, তা হলে আমরা আপত্তি করব না। সাইফুল তৎক্ষণাৎ প্রতিজ্ঞা করল । তারপর কুংফু ক্লাবে ভর্তি হয়ে লেখাপড়ার সাথে সাথে কুংফু প্রাকটিস করতে লাগল। শেষে সে এত পারদর্শিতা লাভ করল যে, দু’বছরের মধ্যে কংফু মাস্টার খেতাব অর্জন করল। এখন সে ঐ ক্লাবে প্রশিক্ষকের কাজও করে।

জালাল সাহেবের কাছে আশ্রয় পাওয়ার দেড় বছর পর সাইফুল একেবারে এস.এস.সির রেজাল্ট নিয়ে নিজেদের গ্রামে যায়। আব্বা, আম্মা ও বুবুকে সালাম করে তাদের দো’য়া নেয় । বোনাইয়ের মৃত্যুর খবর জেনে বুবুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, তোমার কোনো চিন্তা নেই। আল্লাহ আমাকে যত দিন বাঁচিয়ে রাখবেন ততদিন তোমার কোনো কষ্ট হতে দেব না। তারপর থেকে সে প্রথমে নিজের হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে স্টাইফেনের টাকাসহ প্রতি মাসে আব্বাকে কিছু কিছু পাঠিয়েছে।

তারপর কুংফু মাস্টার হওয়ার পর সেখান থেকে যা পায় সেটাও হাত খরচের বাঁচান টাকার সঙ্গে আব্বাকে পাঠায়। মাঝে মাঝে দেশে গিয়ে ঝর্ণার খোঁজ-খবর নেয়। সাইফুল যখন ভার্সিটিতে ভর্তি হল তখন ঝর্ণার অনার্সের সেকেণ্ড ইয়ার চলেছে। সে আগেই ঝর্ণার ভার্সিটিতে পড়ার খবর জেনেছে। এ্যাডমিশন নেয়ার পর দূর থেকে তাকে লক্ষ্য করে। কোনো দিন কাছে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করে নি। একদিন লাইব্রেরীতে একটা বই নিতে গিয়ে লাইব্রেরীর বারান্দায় তার সঙ্গে মুখো-মুখি দেখা। ঝর্ণা তখন একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে লাইব্রেরী থেকে বেরোচ্ছে

আজ এখানে দেখে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। ঝর্ণা সাইফুলের নিরুদ্দেশের পর থেকে তার কোনো খবর জানে না! তাই তাকে
কেমন আছ? সাইফুল বহুদিন তার মানস প্রতিমাকে এত কাছ থেকে দেখে নি। জিজ্ঞেস করল,
ঝর্ণা তখন সাইফুলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, সাইফুল তা হলে ভার্সিটিতে পড়ছে। আগের সেই রোগা পেঁচকা হাড়গীলে সাইফুল এখন বেশ সুঠাম দেহের অধিকারী। গায়েও দামী প্যান্ট শার্ট। তাকে ভালো মন্দ খোঁজ নিতে দেখে তেলে বেগুনের মতো জ্বলে উঠল। কড়া কিছু বলতে গিয়ে সামলে নিল। আমিনের সামনে নেই। তারপর আমিনকে বলল, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। কোনো সিন ক্রিয়েট করতে চাইল না। সংযত হয়ে বলল, সে কথা জেনে তোমার লাভ
আমিন জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা কে?

লেখাপড়া করছে। ঝর্ণা বলল, আমাদের গ্রামের এক ভূমিহীন কৃষকের ছেলে। কারো দয়ায় হয়তো দুলাতে দুলাতে চলে গেল । আমিন সাইফুলকে একা বিদ্রুপের হাসি উপহার দিয়ে ঝর্ণার একটা হাত ধরে যায় না, দূর থেকে দেখে । সাইফুল মৃদু হেসে লাইব্রেরীতে ঢুকল। এরপর থেকে সে আর ঝর্ণার কাছাকাছি
আমিন বড়লোক না হলেও মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে।তার বাবার ছোট খাট ব্যবসা।

বিভিন্ন অফিসে মাল সাপ্লাই দেন। ব্যবসা থেকে যা ইনকাম করেন এবং দোতলা বাড়ির উপরের দু’টো ফ্লাট থেকে যা ভাড়া পান, তাতে সংসারে কোনো অভাব নেই। আমিনের সঙ্গে ঝর্ণার পরিচয় ক্লাসমেট হিসাবে। আমিন সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। নিয়মিত ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করে। দেখতেও সুন্দর। পোষাক পরিচ্ছদ কেতা দুরস্ত। বড় বড় কথা বলে ফাঁট দেখায়। তার সবচেয়ে বড় গুণ সে মেয়েদেরকে কনভিন্স করতে ওস্তাদ। ঝর্ণা সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, পড়াশুনায় ভালো, তার ওপর বড়লোকের মেয়ে। পরিচয়ের পর তাই আমিন তার সঙ্গে প্রেমের খেলা খেলছে।

ঝর্ণার শেষ বর্ষ চলছে। আজ ভার্সিটি বন্ধ । আমিনের কথামত ঝর্ণা বেলা দেড়টার দিকে রোকেয়া হলের গেটের বাইরে এসে আমিনকে দেখতে না পেয়ে অপেক্ষা করতে অল্প দূরে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে সাইফুল বাদাম কিনছে । লাগল । আমিন তাকে আজ চাইনিজ খাওয়াবে। হঠাৎ দেখতে পেল, গেটের পূর্বদিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, নাও, বাদাম খাও।

সাইফুল দু’ঠোঙা বাদাম কিনে ঝর্ণার কাছে এগিয়ে এসে একটা ঠোঙা তার দিকে লাইব্রেরীর বারান্দায় ঘটনার পর থেকে প্রায় দেড় বছর হতে চলল ঝর্ণা সাইফুলকে আর তার কাছে আসতে দেখে নি। মাঝে মাঝে তাকে দূর থেকে লক্ষ্য করতে দেখেছে। তাকে না দেখার ভান করে সরে গেছে। সে সময় ভেবেছে, যার বাপ কামলাগিরী করে খায়, সে কিনা ভাগ্যগুণে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে বলে নিজেকে কি ভাবে কি জানি? যদি কোনোদিন আবার সামনে এসে কথা বলার চেষ্ট৷ করে, তা হলে বাছাধনকে টের পাইয়ে ছাড়ব। সাইফুলকে দেখেলেই ঝর্ণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘৃণায় রি রি করে উঠে।

এখন তাকে বাদাম দিতে দেখে রাগে বারুদের মতো জ্বলে উঠল। বাদামের ঠোঙাটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তোমার মতো নির্লজ্জ বেহায়া ছেলে জীবনে দেখি নি। তোমার কি আত্মসম্মান জ্ঞান বলতে কিছু নেই? তুমি তো জান, আমি তোমাকে ইতর প্রাণীর চেয়ে বেশি ঘৃণা করি। তবু তুমি আমার পিছনে ঘুরো কেন? তুমি কি নিজের পরিচয় জান না? কোন সাহসে তুমি আমার পিছনে লেগেছে? ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছ, কমনসেন্স বলতে তোমর এককণাও নেই। চলে যাও, আর কোনো দিন আমার সামনে আসবে না ।

ঝর্ণা একটা ছেলেকে রাগারাগি করছে দেখে অনেক ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগে আমিন এসে তার কথাগুলো শুনেছে। ঝর্ণা তাকে চলে যেতে বলা সত্ত্বেও ছেলেটাকে দাঁড়িয়ে বাদাম খেতে দেখে আমিন এগিয়ে এসে বলল, কি ব্যাপার? তোমাদের গ্রামের সেই ছেলেটা না? ওকি তোমাকে অপমান করেছে?

ঝর্ণা বলল, হ্যাঁ। আমার রূপে মুগ্ধ হয়ে আমাকে বাদাম খাওয়াতে চাচ্ছে।
আমিন তাই নাকি বলে সাইফুলের সামনে এসে বলল, এই যে ব্রাদার, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বুঝি জ্বিব দিয়ে লালা পড়ে? ভালই ভালই কেটে পড়ুন, নচেৎ কপালে খারাবি আছে। যান চলে যান। আর কোনোদিন কোনো সুন্দরী মেয়ের পিছনে লাগবেন না। ভার্সিটিতে পড়ছেন অথচ ছোটলোকি ব্যবহার ত্যাগ করতে পারলেন না।

সাইফুল তার কথায় কান না দিয়ে নির্দ্বিধায় বাদাম খেতে লাগল ।
তাই দেখে আমিনের গা জ্বলে উঠল। বলল, কি হল, কথা বুঝি কানে যাচ্ছে না? সাইফুল বলল, সৃষ্টিকর্তা দুটো কান যখন শোনার জন্য দিয়েছেন তখন নিশ্চয় সবকিছু গেছে। তবে এখান থেকে চলে যেতে বলার অধিকার শুধু আপনার একার নয়, সবাইয়ের মতো আমারও আছে। এ জায়গাটাতো কারোর নিজস্ব নয়।
আমিন রাগ সহ্য করতে পারল না, তার মুখে একটা ঘুসি মারতে গেল ।

সাইফুলের মুখে ঘুসিটা লাগার আগে সে খপ করে তার হাতটা ধরে পিছন দিকে মুচড়ে ধরে রেখে বলল, ঢিল ছুড়লে পাটকেল খেতে হয়। তারপর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, গায়ে শুধু শক্তি থাকলে হয় না, সেগুলোর প্রয়োগ করার কৌশলও জানতে হয়। এবার আপনি বরং যান ঝর্ণাকে নিয়ে কোথায় যাবেন। বেচারি অনেকক্ষণ ধরে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমিনের গায়ে প্রচুর শক্তি। কেউ সহসা তার সঙ্গে মারামারি করা তো দূরের কথা, কথা কাটাকাটি করতে পর্যন্ত সাহস পায় না। সেই আমিন এতগুলো ছেলেমেয়ে ও ঝর্ণার সামনে একটা একহারা ছেলের কাছে হেরে গিয়ে অপমানে ও রাগে লাল হয়ে গেল । ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, আমিও দেখে নেব।
সাইফুল মৃদু হেসে বলল, নিজে একা দেখে বুঝি সাধ মিটল না? দলবল নিয়ে দেখতে চান? তাতেও সুবিধে করতে পারবেন না। ওরকম বদ খেয়াল ছেড়ে দিন । মনে রাখবেন আমিও ভার্সিটির ছাত্র।

যারা প্রথম থেকে ঘটনাটা দেখেছে, তারা সাইফুলের দোষ মনে করে আমিনের হয়ে কিছু বলবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু তারা সাইফুলের কাণ্ড দেখে ও তার কথা শুনে ভয় পেয়ে চুপ করে রইল ।

আমিন বুঝতে পেরেছে ছেলেটা রোগা হলে কি হবে, গায়ে অসুরের শক্তি। সম্মুখ তারপর ঝর্নাকে বলল, এস অনেক দেরি হয়ে গেল। সমরে তার কিছু করতে পারবে না ভেবে শুধু বলল, আমি এর প্রতিশোধ নেই।

জানতে পারি? তারা একটা রিকশায় উঠে চলে যাওয়ার পর নকীব নামে একটা ছেলে সাইফুলকে বলল, আচ্ছা একহাত দেখালেন ভাই। সত্যিই আপনার জওয়াব নেই। আপনার নামটা সাইফুল বলল, নাম জেনে আর কি হবে? তবু যখন জানতে চাইছেন তখন বলাই উচিত, কি বলেন? তারপর সেও একটা রিকশায় উঠে বলল, আমার নাম সাইফুল।

নকীব নাম শুনে চমকে উঠে হাঁ করে সাইফুলের চলে যাওয়া রিক্সার দিকে চেয়ে রইল । ওর নাম শুনে চমকে উঠে অমন করে চেয়ে রয়েছেন কেন? তার অবস্থা দেখে অন্য একটা ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করল, কি ব্যাপার? আপনি নকীব বলল, কুংফু মাস্টার সাইফুলের নাম আপনি শোনেন নি? যার নাম কুংকু জগতে বিখ্যাত। আমি ওনার নাম অনেক শুনেছি। কিন্তু চোখে কোনো দিন দেখি নি। আজ দেখলাম। সত্যি ওনাকে দেখলে কিন্তু সে রকম বিখ্যাত লোক বলে বিশ্বাস হয় না। তা আপনি বুঝলেন কি করে?

ছেলেটা বলল, আমিও ওনার নাম শুনেছি, কিন্তু দেখি নি। আর উনিই যে তিনি, নকীব বলল, দেখলেন না, প্রতিপক্ষের আক্রমণ কত সহজে ব্যর্থ করে কি ভাবে তাকে কুপোকাত করে ফেললেন। ঐ যে ছেলেটা ঘুসি মারতে গিয়েছিল, তাকেও আমি চিনি। ওনার নাম আমিন। সেরা ব্যায়ামবীর। উনি যেখানে ব্যায়াম করেন, আমিও

সেখানে কিছু দিন হল প্রাকটিস করছি।
ছেলেটা বলল, আপনার কথা হয়তো ঠিক ।
পরের দিন নকীব যখন আমিনকে সাইফুলের কথা বলছিল তখন ঝর্ণা সেখানে সাইফুলের ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামিও না। ছিল। শুনে সে বেশ অবাক না হয়ে পারে নি। পরে আমিনকে এক সময় বলল, তুমি কথাটা শুনে আমিনের মনে অনেক প্রশ্ন এসে ভীড় করল। সেগুলোকে প্রশ্রয় না চেয়েছিল ।

তাতে তুমি অত রেগে গিয়েছিলে কেন? দিয়ে বলল, গ্রামের চেনা জানা ছেলে। তাই হয়তো তোমাকে বাদাম খাওয়াতে ঝর্ণা বলল, তাই বলে আমি তার কাছ থেকে খাব? ও খুব নিচু বংশের ছেলে । ওর বাবা আমাদের ক্ষেতে কামলার কাজ করে। বাদ দাও ওর কথা ।

আমিনের বাবা হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন। বাবার ব্যবসা ও সংসারের হাল আমিনকে ধরতে হল । তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিন বড়। ছোট দু’জনের একজন ইন্টার মিডিয়েট পড়ে। আর অন্যজন ক্লাস সেভেনে। তাই বাধ্য হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে সবকিছু দেখতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ভার্সিটিতে এসে ঝর্ণার সঙ্গে দেখা করে । আমিন বাবার ব্যবসাটা বড় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ব্যবসার প্রগ্রেস করতে হলে প্রচুর টাকার দরকার।

বড় বড় মার্চেন্ট অফিসের টেণ্ডার ধরতে হলে পার্টি দিতে হয়। পাটি দিয়ে কাজ পেতে হলে প্রচুর টাকার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরী ললনা দরকার। আমিন সে সব পাবে কোথায়। কয়েক জায়গায় টেণ্ডার না পেয়ে তার মন খারাপ হয়ে গেল। কি করে এই প্রবলেম সলভ করা যায়, সেই কথা একদিন শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল। হঠাৎ ঝর্ণার কথা মনে পড়তে তার মন বলে উঠল, একে দিয়ে তুমি তোমার প্রবলেম সলভ করতে পারবে এবং একে একে উন্নতির সোপান অতিক্রম করে তোমার মনের বাসনা পূরণ করতে পারবে। কথাটা তার খুব পছন্দ হল। পরের দিন ভার্সিটিতে গিয়ে আমিন ঝর্ণার সঙ্গে দেখা করে বিয়ের প্রস্তাব দিল ।

ঝর্ণা বিয়ের কথা শুনে মনে মনে খুব খুশী হল। কিন্তু রাজি হল না। বলল, এত তাড়াহুড়ো করছ কেন? আগে পরীক্ষা দিয়ে নিই, তারপর দেখা যাবে।
আমিন বলল, বিয়ের পরও তুমি পড়াশোনা করতে পারবে। বাবা হঠাৎ মারা যাওয়ার পর আমাকে তার ব্যবসা চালাতে হচ্ছে। মায়ের শরীর ভেঙ্গে পড়েছে। মা বলছে, এবার একটা বৌ এনে দে। আমি আর তোদের সংসারে ঝামেলা বইতে পারছি না।

তোর বাবা বৌ দেখে যেতে পারল না। আমার শরীরের অবস্থাও তেমন ভালো না । কবে কি হবে জানি না। মরার আগে আমিও কি বৌ দেখে মরব না? মায়ের কথাটা সে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মিথ্যা করে বানিয়ে বলল ।
ঝর্ণা তবু প্রথম দিকে রাজি হল না। বলল, তোমাকে তো আগে বলেছি, আমার বাবা ভীষণ কড়া লোক। সারা রংপুরে তার খুব নাম ডাক। সে কি এখন আমার বিয়ে দিতে রাজি হবে? তা ছাড়া তাকে এ ব্যাপারে কে বলবে?

ঝর্ণার সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর আমিন তাদের বাড়ির সব খবর নিয়ে তার সঙ্গে ভালবাসা করেছে। তার বাবার অবস্থা খুব ভালো । তিন ভাইয়ের-এক বোন । এক ভাই আবার আমেরিকায় থাকে। ঝর্ণাকে বিয়ে করতে পারলে শ্বশুরের কাছ থেকে অনেক টাকা পয়সা পাওয়া যাবে। তখন আর ব্যবসার উন্নতির পথে কোনো বাধা থাকবে না। তাই তাড়াতাড়ি বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে।

ঝর্ণার কথা শুনে বল, তুমি অত কিছু চিন্তা করছ কেন? আমরা কোর্ট ম্যারেজ করার পর তোমার বাবা মাকে জানাব । প্ৰথম প্রথম রাগারাগি করলেও পরে মেনে নেবেন। মায়ের কথা ভেবে তাড়াতাড়ি করছি। নচেৎ তোমার কথামতো তাই করতাম। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, তুমি কি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছ না?

বিয়ের কথা শুনে বাবা কি করবেন, ঝর্ণা এতক্ষণ সেকথা চিন্তা করছিল। আমিনের কথা শুনে বলল, বিশ্বাস করব না কেন? ভাবছি বাবার কথা।
আমিন বলল, ভাবনাটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি যেমন করে হোক ম্যানেজ করব। তোমাকে দু’একদিনের মধ্যে কোর্ট ম্যারেজ করে ঘরে তুলতে চাই। তাতে তুমি রাজি আছ কিনা বল?

ঝর্ণার তখন সাইফুলের কথা মনে পড়ল । আমিন ভার্সিটিতে পড়াশোনা বন্ধ করার পর সাইফুল তার কাছাকাছি ঘোরা-ঘুরি করে। তবে কোনো দিন কথা বলে নি। করে।তবে সাইফুলকে দেখলে ঝর্ণার আগে সব সময় রাগ ও ঘৃণা হত। সেদিনের ঘটনার পর সেই সঙ্গে ভয়ও করে। সাইফুলকে জব্দ করার জন্য বলল, বেশ আমি রাজি। তবে ফাইন্যাল পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত বালাকে জানান চলবে না ।

হলে আগামীকাল আমি বেরা দশটার দিকে আসব। আমিন আনন্দে আটখানা হয়ে বলল, সে ব্যাপারে তুমি যা বলবে তাই হবে। তা
গতকাল সামার ভ্যাকেসানের ছুটি পড়েছে। আগামীকাল ঝর্ণা দেশে যাওয়ার মনস্থ করেছিল। আমিনের কথা শুনে বলল, বেশ তাই এস।
পরের দিন ঝর্ণা সুপারিন্টেন্ডেন্টকে দেশে যাওয়ার কথা বলে হল থেকে বেরিয়ে না গিয়ে কাজী অফিসে গেল । এল। আমিন আগের থেকে গেটের বাইরে অপেক্ষা করছিল। তাকে সঙ্গে করে কোর্টে ঝর্ণা বলল, কোর্টে যাবে না?

আমিন বলল, কোর্টে অনেক ঝামেলা। কোর্ট আর কাজী অফিসের মধ্যে পার্থক্য ঝর্ণাকে নিয়ে বাসায় এল । নেই। সেদিন কাজী অফিস থেকে কাবিন করে একদম বিয়ের কাজ সেরে আমিন ।

আমিন আগেই মাকে বুঝিয়ে বলেছে, ঝর্ণাকে-বিয়ে করলে তার বাবার কাছ থেকে গ্রহণ করে ঘরে তুললেন। ব্যবসার ব্যাপারে অনেক সাহায্য পাওয়া যাবে। তাই শায়লা বেগম পুত্রবধুকে সাদরে আমিনের বাসায় এসে ঝর্ণার মন খারাপ হয়ে গেল । সে ভেবেছিল, আমিনের বাবা যখন ব্যবসায়ী তখন তাদের বাড়ি ও ঘরের আসবাবপত্র নিশ্চয় খুব উন্নত ধরণের হবে । কিন্তু দোতলা চারকামরা করে আটকামরা বাড়ি ও নিম্নমানের আসবাবপত্র দেখে তার হয়েছে মনে করে সব কিছু মেনে নেয়ার চেষ্টা করল ।

মন খুঁৎ খুঁৎ করতে লাগল। কিন্তু বাইরে তা প্রকাশ করল না। ভাগ্যে যা ছিল তাই দিন পনের বেশ আনন্দ ফুর্তিতে কেটে গেল। একদিন আমিন ঝর্ণাকে বলল, যাও । এবারে না গেলে বাড়ির সবাই চিন্তা করবে । তোমার একবার দেশে যাওয়া উচিত। কারণ প্রতি বছর সামার ভ্যাকেসানে তুমি বাড়ি
ঝর্ণা বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ। আমিও তোমাকে কথাটা বলব ভাবছিলাম ।

তা হলে কালকেই তোমার যাওয়ার ব্যবস্তা করে দিচ্ছি। একটা কথা বলি শোন, তুমি গিয়ে মাকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা জানিয়ে বাবাকে ম্যানেজ করতে বলবে। বলেছি ফ্যাইন্যাল পরীক্ষার পর জানাব । ঝর্ণা আতংকিত হয়ে বলল, না না, তা এখন সম্বব নয় । তোমাকে তো আগেই
সে কথা আমার মনে আছে। তবে কি জান, একটা কন্ট্যাক্ট ধরার জন্যে কিছু টাকার দরকার। কন্ট্যাক্ট ফেল করলে যেমন আমার বহু টাকা লস হবে, সাকসেসফুল হলে তেমনি প্রচুর লাভ হবে।

এর পিছনে আমি বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা অলরেডী খরচ করে ফেলেছি। বলছিলাম কি, ওনাদের দো’য়া নেয়ার পর তুমি যদি বাবাকে বলে লাখ খানেক টাকা ম্যানেজ করতে পারতে, তা হলে ব্যবসাতে তাড়াতাড়ি উন্নতি করতে পারতাম। তা ছাড়া এটাতে আমার ফার্মের ইজ্জৎও জড়িত আছে। ঝর্ণা বলল, ছি-ছি, এ কথা বলতে তোমার মুখে আটকাল না? কোন মুখ নিয়ে বাবার কাছে টাকা চাইব? এমনিতেই যা ঘটে গেল, সেটা জেনে কি করবেন তার ঠিক নেই ।

আমিন বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি নিজের সম্মান দেখছ, স্বামীর দিকটা চিন্তা করে দেখবে না? এত লেখাপড়া করলে, বুদ্ধি করে সবদিক ম্যানেজ করার চেষ্টা কর। মেয়েরা স্বামীর জন্য কত অসাধ্য সাধন করে। আর তুমি এই সামান্য কাজটা করতে পারবে না?
ঝর্ণার মনের ভিতর থেকে কে যেন বার বার বলছে, ঝর্ণা তুই খুব ভুল করেছিস। আজকাল মানুষ চেনা খুব কঠিন। এখন আর ভেবে কিছু করতে পারবি না। ভাগ্যকে মেনে নে। চোখে পানি এসে যেতে আঁচলে মুছতে মুছতে বলল, ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব।

ঝর্ণা যখন তাদের দেশের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে। সে বাবা-মাকে কদমবুসি করল।
হামিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুইতো চিঠিতে লিখেছিলি আরো পনের দিন আগে আসবি। দেরি দেখে আমরা দুঃশ্চিন্তা করছিলাম। তোর খোঁজ নেয়ার জন্য আবসারকে দু’একদিনের মধ্যে ঢাকায় পাঠাব ভাবছিলাম ।

ঝর্ণা জানত তাকে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই আগের থেকে উত্তর ভেবে রেখেছে। বলল, পরীক্ষা এগিয়ে আসছে তাই আমরা কয়েকজন বান্ধবী হলে থেকে একজন অধ্যাপকের কাছে টিউটোরিয়াল করছিলাম। পরের দিন রাত্রে খাওয়ার-দাওয়ার পর ঝর্ণা মাকে তার বিয়ের কথা বলে টাকাটার কথাও জানাল ।
মেয়ের কথা শুনে আফসানা বেগম খুব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন । তারপর আতঙ্কিত স্বরে বললেন, এ তুই কি বলছিস, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না?

অসম প্রেম কি অসম প্রেম কাহিনী

ঝর্ণা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, হ্যাঁ মা, এটাই তোমাকে বুঝতে হবে এবং বাবাকেও বোঝাতে হবে ।
আফসানা বেগম মেয়েকে কাঁদতে দেখে বললেন, তুই একবারও তোর বাবার ইজ্জতের দিকে তাকালি না। সে কি এ বিয়ে মেনে নিতে পারবে? রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট তোর বাবার বন্ধু । তার ছেলে বিলেত থেকে লেখাপড়া শেষ করে এ বছর ফেরার কথা । তার সঙ্গে তোর বিয়ের কথাবার্তা একদম ফাইন্যাল হয়ে আছে। সব কিছু জেনে কি করে আমি তাকে তোর কথা জানাব?

ঝর্ণা কাঁদতে কাঁদতে বলল, এখন আর সে কথা বলে লাভ কি? তোমরা আমাকে এতদিন সে কথা জানাও নি কেন? আমার ভাগ্যে যা ছিল হয়েছে। তোমরা আমার ভাগ্যকে কি বদলাতে পারবে?

আফসানা বেগম কি করবেন ভেবে ঠিক করতে পারলেন না ।
ঘুমাবার সময় স্ত্রীর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে হামিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? তোমার কি শরীর খারাপ, না, আমার কিছু হয় নি।
তোমাকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না।
আফসানা বেগম সাহস সঞ্চয় করে বললেন, তোমার মেয়ের খবর শুনলে তোমারও তাই হবে।

হামিদ সাহেব কপাল কুচকে বললেন, তার আবার কি খবর?
তোমার মেয়ে ভালবাসা করে বিয়ে করেছে। ছেলেটার বাপের কি ব্যবসা ছিল। সে মারা যেতে ছেলে সেই ব্যবসা চালাচ্ছে। ব্যবসার জন্যে তার লাখ খানেক টাকা দরকার। সেই জন্যে তোমার মেয়ে এসেছে। সে এসে যে কথা বলেছে তা মিথ্যে হামিদ সাহেব নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। হতবাক হয়ে চিন্তা করতে লাগলেন, আমার মেয়ে হয়ে এরকম কাজ করবে তাও কি সম্ভব?

আবার চিন্তা করলেন, সে যখন নিজের মুখে বলেছে, তখন তো বিশ্বাস করতেই হয়। তারপর খুব রাগের সঙ্গে বললেন, এ বিয়ে আমি কখনো মেনে নিতে পারব না। আমার মান ইজ্জৎ সব যাবে। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আমি কোন মুখে একথা জানাব? ডাক তাকে, তার মুখে আমি শুনতে চাই ।
আফসানা বেগম মেয়েকে ডেকে নিয়ে এলেন।

ঝর্ণা মায়ের সঙ্গে এসে জড়সড় হয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপতে লাগল ।
হামিদ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, তোর মাকে যা বলেছিস তা কি সত্যি? ঝর্ণা ভয়ে কথা বলতে পারল না। মাথা নিচু করে চুপ করে কাঁপতেই লাগল । কি হল কিছু বলছিস না কেন?

ঝর্ণা কোনো রকমে কাঁপা গলায় বলল, জি, সত্যি।
হামিদ সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, স্বীকার করতে তোর লজ্জা করল না। বড় আশা করে উচ্চ শিক্ষা নেয়ার জন্য তোকে ভার্সিটিতে ভর্তি করেছিলাম। আর তুই কিনা এমন জঘন্য কাজ করলি? যার ফলে আমি কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না। কোথাকার কেমন ছেলে, কার ছেলে, তা জানাবার দরকারও মনে করলি না? যে ছেলে বিয়ের পরপর স্ত্রীকে টাকার জন্য তার বাবা-মার কাছে পাঠায়, সে কি ধরণের ছেলে আমার জানা আছে।

তোর যদি বুদ্ধি থাকত, তা হলে বুঝতে পারতিস, আমাদের সব কিছু জেনে তোকে টাকা কামাবার টোপ হিসাবে ব্যবহার করবে বলে বিয়ে করেছে। তুই না বুঝতে পারলেও আমি পেরেছি। তারপর স্বর নামিয়ে বললেন, খুব ভুল করে ফেলেছিস মা। যাক যা হবার হয়েছে; তোর আর ফিরে যাওয়ার দরকার নেই। আমি ডিভোর্সের জন্য উকিলি চিঠি পাঠিয়ে দিচ্ছি। মনে হয় লাখ দু’য়েকের মধ্যে মিটমাট করে ফেলতে পারব।

বাবার স্বর নরম হতে দেখে ঝর্ণা সাহস করে বলল, তা হয় না বাবা। আমি তোমার সঙ্গে একমত নই। সে আর যাই হোক অত ছোট নয় ।
হামিদ সাহেব মেয়ের কথা শুনে আবার রেগে গেলেন। তবু সংযত হয়ে গম্ভীরস্বরে আমি যা বললাম তাই হবে । বললেন, তুই এত লেখাপড়া করলে কি হবে, মানুষ চেনার জ্ঞান তোর এখনও হয়নি।

ঝর্ণা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমি তা মেনে নেব না। যাকে ভালবেসে বিয়ে করেছি, করব, তবু তা পারব না। তাকে বাদ দিয়ে অন্য ছেলেকে আবার বিয়ে করতে পারব না। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা হামিদ সাহেব এতক্ষণ অনেক ধৈর্য্য ধরে ছিলেন, এবার সীমার বাইরে চলে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, তা হলে তুই জাহান্নামে যা, আমি আর তোর মুখ দেখতে চাই না। কাল যেন তোর ঐ মুখ আমি আর না দেখি। দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে। বিষ খেয়ে মর আর সেই ছোটলোকের ঘরে ফিরে যা, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। তোকে আমার মেয়ে ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে। এক্ষুনি বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে। আর কোনোদিন এ মুখো হবি না ।

বাবার কথা শুনে ঝর্ণার মনে প্রচণ্ড আঘাত লাগল । সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, হ্যাঁ, তাই চলে যাব বাবা। আর কোনোদিন তোমাদের কাছে আসব না। কথা শেষ করে সে ছুটে বেরিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা খিল দিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল ।
আফসানা বেগম মেয়েকে বোঝাবার জন্য তার পিছনে যেতে উদ্দত হলে হামিদ সাহেব জোর গলায় বললেন, তুমি ওর কাছে যাবে না। গেলে তোমাকেও চিরকালের জন্য এ ঘর ত্যাগ করতে হবে।

আফসানা বেগম স্বামীর রাগ জানেন, চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বললেন, মেয়েটা যদি কিছু অঘটন ঘটিয়ে ফেলে?
হামিদ সাহেৰ বললেন, অঘটন যা ঘটাবার তা তো ঘটিয়েই ফেলেছে, আবার কি ঘটাবে? আফসানা বেগম আর কিছু না বলে বসে পড়লেন।
হামিদ সাহেব অনেক বছর ধরে ধলিবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।

আর্থিক অবস্থা খুব ভালো। ওনার তিন ছেলে এক মেয়ে। তিন ছেলেই গ্রাজুয়েট। বড় ছেলে আসার চাষবাস দেখাশোনা করে। বিরাট ইরি প্রজেক্ট আছে। মেজ ছেলে মারুফ রংপুর টাউনে একটা পাঁচতলা আবাসিক হোটেল করে সেটা পরিচালনা করে। ছোট ছেলে সবুজ আমেরিকায় উচ্চ শিক্ষা নিতে গিয়েছিল। শিক্ষা শেষে চাকরি করতে করতে একজন আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই থাকে । ঝর্ণা সকলের ছোট।

অসম যেন ঝর্ণা সারা রাত কেঁদে কাটাল। অনেকবার চিন্তা করেছে, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করবে। পরক্ষণে ভেবেছে এখানে আত্মহত্যা করলে বাবাকে আরো অপমানিত হতে হবে। যদি একান্ত করতে হয়, ঢাকাতে গিয়েই করবে। ভোরে কেউ জাগার আগে সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। ঢাকায় আমিনদের বাসায় যখন পৌছাল তখন রাত আটটা। আমিন তখনও বাসায় ফিরে নি।

শায়লা বেগমবৌ-এর চেহারা দেখে যা বোঝার বুঝে গেলেন । আমিন অনেক রাত্রে ফিরে সব কিছু শুনে বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইল। তারপর বলল,তোমার চলে আসা উচিত হয় নি। বাবা-মাকে না জানিয়ে বিয়ে করলে সব বাবা-মাই ঐ রকম বকাবকি করেন। কয়েকদিন থাকা তোমার উচিত ছিল। থাকলে দেখতে, রাগ পড়ে গেলে তারা কিছু একটা ব্যবস্থা করতেন। কিছুদিন যাক, ওনাদের রাগও পড়ুক। তখন নিজেরাই টাকাটা দিয়ে দেবেন। গেলে আর এ রকম করবেন না।

জামাই এর ব্যবসার জন্য টাকার দরকার ভেবে কি করে? ঝর্ণার মন এমনিই খারাপ, তার উপর এরকম কথা শুনে তার মনে খুব কষ্ট হল । বলল, আমি মরে গেলেও সেখানে আর যাব না। এত কিছু হয়েছে জেনেও যেতে বলছ তার কাছে চিঠি দিয়ে টাকাটার ব্যবস্থা করতে বল। আমিন বলল, তা হলে এক কাজ কর, তোমার এক ভাই তো আমেরিকায় থাকেন, ঝর্ণা যেন ক্রমশ আমিনের আসল মতলব বুঝতে পারছে।

তখন তার বাবার কথা মনে পড়ল- ‘ছেলেটা টাকা কামাবার টোপ হিসাবে ব্যবহার করবে বলে তোকে বিয়ে করেছে।’ বেশ রাগের সঙ্গে বলল, তাও আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আচ্ছা, একটা ব্যাপার ভাইদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছ কেন? বুঝতে পারছি না, আমাদের বিয়ের এখনও একমাস হয় নি; এরই মধ্যে আমার বাবা-

আমিনের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। বলল, বুঝবে, আস্তে আস্তে সব বুঝবে। এখন ও কথা বাদ দিয়ে তোমার বাবা বা আমেরিকার ভাইয়ের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি পার টাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এবার চল খেতে দেবে।
ভার্সিটি খোলার পর ঝর্ণা ক্লাস করার কথা আমিনকে বলল ।

আমিন বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, মেয়েদের বেশি লেখাপড়া করে লাভ কি শুনি? যতই উচ্চডিগ্রী নিক না কেন, সংসারের কাজ ও ছেলে-পুলে মানুষ করা তাদেরকে আনার ব্যবস্থা কর। তারপর না হয় দেখা যাবে । করতেই হবে। তবু যদি তোমার সখ হয়, তা হলে বাবা-ভাইদের কাছ থেকে মালপানি
বিয়ের আগে কি বলেছিলে মনে নেই?

মনে থাকবে না কেন? জান না বুঝি, বিয়ের আগের কথা বিয়ের আগে পর্যন্ত ঠিক থাকে। বিয়ের পরে আর সেগুলোর কোনো মূল্য থাকে না, বাসি ফুলের মতো ডাস্টবিনে ফেলে দিতে হয় । ওসব পুরোন প্যাচাল বাদ দিয়ে টাকার ব্যবস্থা কর।

এরপর থেকে ঝর্ণার জীবনে কালো ছায়া নেমে এল। মাস দু’য়েক স্বামী, শাশুড়ী অনেক বুঝিয়ে ও ভয় দেখিয়ে যখন ঝর্ণাকে দিয়ে টাকা আদায় করাতে পারল না তখন তারা তার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করতে লাগল । স্বামী-স্ত্রী একরুমে থাকলেও খাট আলাদা, শুধু রাতে দৈহিক সম্পর্ক ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই। আমিন প্রয়োজন ছাড়া তার সঙ্গে কথা বলে না। প্রয়োজনের কথাগুলোও খুব গরম মেজাজে বলে। শাশুড়ীও তাকে একদম দেখতে পারেন না।

সংসারের সব কাজ তাকে দিয়ে করান । কাজের খুঁৎ ধরে মোটা মোটা কথা শোনান। বাপের বাড়ি থেকে কিছু আনতে পারে নি সব কিছু সহ্য করে যাচ্ছে। বলে যখন তখন খোঁটা দেন। ঝর্ণা ভাগ্যের কথা ভেবে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে একদিন বিকেলে আমিন বাসায় ফিরে হাসি মুখে ঝর্ণাকে বলল, বিয়ের পর থেকে কাজের চাপে তোমাকে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে পারি নি। আজ এক বন্ধু পার্টি দিচ্ছে, সেই পার্টিতে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অনুরোধ করে বলেছে।

সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায় পার্টি শুরু হবে। আমরা সাতটার সময় বেরোব। তারপর ব্রীফকেস খুলে একটা প্যাকেট বের করে তার হাতে দিয়ে বলল, তোমাকে তো আজ পর্যন্ত কোনো ভালো জামা-কাপড় দিই নি। তাই এগুলো কিনে আনলাম। বন্ধুর পার্টিতে তো আর যা-তা পরে যাওয়া যায় না।
অনেক দিন পর স্বামীকে হাসি মুখে কথা বলতে দেখে ও তাকে পার্টিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দামী কাপড় কিনেছে দেখে ঝর্ণা মনে মনে খুশী হলেও বাইরে তা প্রকাশ করল না। শুধু একটু ম্লান হাসি হেসে বলল, আমার সৌভাগ্য।

পার্টি বলতে কি বোঝায় ঝর্ণা আগে তা জানত না। এখানে এসে যেন আজ আর একটা জগৎ দেখল। পার্টিতে তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতী, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া সবাই আছে। আমিন তার বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে একটু পরে আসছি বলে সেই যে গেছে, এক ঘন্টা পার হয়ে গেল, তবু তার পাত্তা নেই। স্বামীর বন্ধুকে ঝর্ণার খুব অভদ্র বলে মনে হল । কথা বলার সময় নানান ছুতোয় গায়ে হাত দিচ্ছে।

একবার তো বলেই ফেলল, আপনার মতো এত সুন্দর ফিগারের মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। আপনার ভাবি ভিতরে আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত আছে এলে পরিচয় করিয়ে দেব। দেখবেন, সেও সুন্দরী। তবে আপনার মতো এত সুন্দর ফিগার তার নয়। এই রকম ফিগার না হলে বিছানায় আনন্দ পাওয়া যায় না। পরিচয়ের সময় তার নাম হুদা বলেছিল। এখন তার নির্লজ্জ ব্যবহার ও কথাবার্তা দেখে শুনে ঝর্ণার মনে হল, লোকটার নাম বেহুদা হলে ঠিক হত ।

পার্টির কাজ শেষ হতে রাত দশটা বেজে গেল। খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে মদ খেতে দেখে ঝর্ণা খুব অবাক হল । এক ফাঁকে হুদ। তার গিন্নীকে নিয়ে এসে ঝর্ণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম মিলি। ঝর্ণার মনে হল, মিলি তার থেকে কম সুন্দরী নয়। ডানা কাটা পরীর মতো। সবাইর সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে। শাড়ি-ব্লাউজ যেভাবে পরেছে, তাতে করে সবাই তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। সেদিকে মিলির কোনো খেয়াল নেই। সবাইকে নিজের উদভ্রান্ত যৌবন দেখিয়ে বেড়ানই যেন তার প্রধান কাজ।

পাতলা ফিনফিনে জর্জেটের শাড়ি পরনে, গায়ে তিন ইঞ্চি বহরের সাণ্ডো ব্লাউজ। ফর্সা ধব ধবে প্রায় গোটা পিঠটা দেখা যাচ্ছে। ব্লাউজের কাপড় এত পাতলা যে, ব্রা দেখা যাচ্ছে। ব্রাটা এমনভাবে পরেছে, যার ফলে তার সুউচ্চ উন্নত বক্ষ দুটো অর্ধেক বেরিয়ে রয়েছে। বুকের ওপরকার শাড়িটা সরে গিয়ে দুই পাহাড়ের গিরীপথ দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে জর্জেটের শাড়িটা বুক থেকে খসে পড়ে যাচ্ছে। সেটাকে বেশি সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে যথাস্থানে রাখছে। ঝর্ণার মনে হল, মিলির যৌবন দেখবার জন্য যেন এই পার্টির আয়োজন।

আর একটা জিনিস সে লক্ষ্য করল, পার্টির প্রধান অতিথিকে নিয়ে যেন মিলি বেশি ব্যস্ত। আর তার স্বামী অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে বেশ হাসাহাসি করছে। রাত যত বাড়তে লাগল, তত যেন পার্টির রং বদলে যেতে লাগল। এক সময় বড় বাতি অফ করে গাড় নীলাভ বাতি জ্বেলে দেয়া হল। ঝর্ণার গা ছম ছম করে উঠল। গোটা রুমটা কুয়াসার মত আচ্ছন্ন হয়ে গেল। কারো মুখ চেনা যাচ্ছে না।

নারী-পুরুষ যেন মিশে এক হয়ে যাচ্ছে। কে কাকে জড়িয়ে ধরছে সেদিকে কেউ লক্ষ্য করছে না, আর বাধাও দিচ্ছে না। ঝর্ণা এইসব দেখে খুব বিব্রত বোধ করছিল। হঠাৎ একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এসে তার হাত ধরে বলল, আপনি একা কেন? আসুন একটু ফুর্তি করি। ঝর্ণার গোটা শরীরটা ঘৃনায় রি রি করে উঠল। ঝটকা মেরে হাতটা ছড়িয়ে নিয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল।

পৌঁঢ় ভদ্রলোক বিড় বিড় করে কিছু বলে টলতে টলতে চলে গেল। এমন সময় আবছা দেখতে পেল, অল্প দূরে একটা মেয়ে আমিনকে জড়িয়ে ধরে চুমো খাচ্ছে আর ফিস ফিস করে কি বলছে। ঝর্ণা এগিয়ে এসে আমিনের হাত ধরে টান দিয়ে মেয়েটার কাছ থেকে যুক্ত করে বলল, ছি ছি আমাকে আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। কোথায় নিয়ে এসেছ? আর তুমি এত নিচে নেমে গেছ?

এক্ষুনি বাসায় ফিরে চল,
আমিন রেগে গেলেও কিছু না বলে তাকে নিয়ে বেরিয়ে এল। ফেরার পথে বলল, মনে হচ্ছে তুমি আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছ। তা প্রথম প্রথম অমন সবারই হয়। কয়েকটা পার্টিতে এটেন করলে তারপর আর খারাপ মনে হবে না।

ঝর্ণা তখন কিছু বলল না। বাসায় এসে বলল, পার্টিতে কি কাজ হল জানি না, আর কখনো যাচ্ছি না। তবে পার্টিতে যে নোংরামী-ইতরামী হয়, তা জানতে পারলাম। এ রকম পার্টিতে আমি ঐগুলোই পার্টির উপকরণ। আর এ উপকরণগুলো না হলে পার্টির আসল উদ্দেশ্য করে পাঁচ লাখ টাকার সাপ্লাই অর্ডারটা সই করিয়ে নিল। সফল হয় না। দেখলে না, বন্ধু তার বৌকে দিয়ে প্রধান অতিথিকে কি রকম তোয়াজ কখন করল? শেষের দিকে তো প্রধান অতিথিকে দেখলাম না ।

সেই সঙ্গে বন্ধু পত্নীকেও কি দেখেছ? দেখ নি । ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না? সবাই যখন আনন্দ করতে ব্যস্ত তখন বন্ধুপত্নী কাজ আদায় করার জন্য তাকে নিয়ে আলাদা করতে হয়েছে। একটা রুমে গিয়ে ফাইলে সই করিয়ে নিয়েছে। অবশ্য সই করাবার আগে তাকে খুশী নিজের বৌ-এর ইজ্জতের চেয়ে ব্যবসাটা বড় হল? ঝর্ণা এতক্ষণে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শিউরে উঠল। বলল, তোমার বন্ধুর কাছে টাকার চেয়ে ইজ্জৎ বড় নাকি?

বরং টাকা না থাকলে কেউ ইজ্জৎ দেয় না । আমার স্বার্থ সিদ্ধি করবে। তোমাকেও বলে রাখছি, আমি যখন পার্টি দেব তখন তুমিও বন্ধুপত্নীর মতো কাজ করে এই জন্যে বুঝি এত ঘটা করে আজ পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিলে?

আমিন হাসি মুখে বলল, এই তো বুদ্ধিমানের মতো সব কিছু বুঝতে শিখেছ।
সেদিনও বুদ্ধিমানের মতো কাজ করো ।
তার চেয়ে আমাকে বিষ এনে দিও।
আমিন রেগে গিয়ে বলল, বাপ-ভাইয়ের কাছ থেকে এক কানাকড়িও আনতে পারলে না, আবার দেমাগ দেখাচ্ছে। আমার কথামতো কাজ না করলে, চাবকে গায়ের চামড়া তুলে নেব। তোমার অনেক অন্যায় এতদিন সহ্য করেছি, আর নয়।

ঝর্ণাও রাগের সাথে বলল, নিজের বিয়ে করা বৌকে অন্যের অঙ্কশায়িনী করে টাকা পারবে না । কামান বুঝি অন্যায় নয়? মেরে মেরে, মেরে ফেললেও আমাকে দিয়ে ঐ কাজ করাতে আমিন রাগ সামলাতে পারল না, ঝর্ণার গালে জোরে একটা চড় মেরে বলল, আলবৎ তোকে ঐ কাজ করতে হবে। তারপর সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।

আমিনের বলিষ্ঠ হাতের চড় পেয়ে স্বর্ণার মাথা পুরে গেল। সালটা ব্যপার টনটন করে উঠল। তার চোখ দুটো দিয়ে পানি পড়তে লাগল। পারলে তা ভাষণ, আমি যে এত নিচ, এক ছোটলোক, তা আগে বোঝা তার বাবার কথা মনে পড়তে লাগল। তখন যদি বাবার কথামতো ফিরে না আসত, তা হলে কত ভালো হত। অনুশোচনায় তার মন খুব ভেঙ্গে পড়ল। ড্রেস চেঞ্চ করার কথা ভুলে গিয়ে বিছানায় শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।

প্রায় দু’বছর হতে চলল, শত লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ও শংকর মাছের চার মার দেে তাকে বিভিন্ন পার্টিতে যেতে হচ্ছে। বর্ণ : না ভেবেছে, আত্মহত্যা করে এই পংকিল জীবনের অবসান ঘটাতে। কিন্তু পারে নি। ভাবে কি করে এই দুর্বিসহ জীবন থেকে পরিত্রাণ পাবে। কোনো উপায় দেে পেয়ে রাতকে রাত কেঁদে কাটাচ্ছে।

এদিকে আমিনের ব্যবসা দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠছে। গাড়ি কিনেছে। পরের পুরোন আসবাবপত্র বিক্রি করে নতুন কিনেছে। আগে পার্টিতে মদ পেত। এখন পুরো মদখোর হয়েছে। প্রতিরাতে মদ খেয়ে বর্ণার উপর অত্যাচার করে। এবার সে একটা খুব বড় কন্ট্যাকের জন্য পার্টি দেবে। সে কথা একদিন বর্ণাকে জানিয়ে বলল, প্রথম যেদিন আমার বন্ধুর পার্টিতে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই পার্টিতে বন্ধুপত্নী যে ডাইরেক্টরের মন যুগিয়ে অর্ডার বাগিয়েছিল, তার সঙ্গে এবারে আমি কন্ট্যাক করেছি। এবারের অর্ডার দশলাখ। এটা যদি তুমি বন্ধুপত্নীর মতো বাগাতে পার, তা হলে তুমি যা চাইবে তাই দেব।

স্বর্ণা শুনে চমকে উঠে ভাবতে পাগল, এতদিন সে নানান ছলচাতুরি করে নিজের ইজ্জৎ বাঁচিয়ে সব কাজ হাসিল করেছে। কিন্তু যে লোককে মিপি দেহ দিয়ে কাজ আদায় করেছে, তাকে দেহ না দিয়ে কি সে সাকসেসফুল হতে পারবে? লোকটাকে সেদিন দেখে মনে হয়েছে, বয়স হলে কি হবে, ভীষণ কামুক। মেয়েদের দিকে কি রকম লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। তার উপর মদখোর।

তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আমিন জিজ্ঞেস করল, কি ভাবছ? কিছু বললে না যে? ঝর্ণা রাগের সঙ্গে প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল। সামাল নিয়ে বলল, কি আর ভাববো, তত্ত্বদিরের কথা ভাবছিলাম।
আমিন বলল, তরুদিরকে মেনে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

আমিন যেদিন অফিসে পার্টি দিবে, সেদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ঝর্ণাকে বলল, সন্ধ্যের আগে রেডী হয়ে থেক, এনে নিয়ে যাব।
আজ আমার শরীর খারাপ, পার্টিতে যেতে পারব না।
আমিন বিরক্ত হয়ে বলল, যাব না বললেই হল, ওসব বাজে অজুহাত বাদ দিয়ে যা বললাম ভাই করো। তারপর সে বেরিয়ে গেল।

ঝর্ণা সারাদিন চিন্তা করল, কি করবে? না গেলে আমিন নিশ্চয় খুব মারধর করবে। আর গেলে কি ইজ্জত বাঁচাতে পারবে? আজকাল শিক্ষিত সমাজে মদ আর মেয়ে মানুষ যেন একটা ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এরা কেমন শিক্ষিত? ব্যবসা করে টাকা কামানর

জন্য নিজের বৌদের ইজ্জৎ বিলিয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করে না। বরং গর্ববোধ করে। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, আজ পার্টিতে যাবে না। তাতে কপালে যা আছে তাই হবে। সন্ধ্যের সময় আমিন বাসায় ফিরে ঝর্ণাকে তৈরি থাকতে না দেখে বলল, কি ব্যাপার, এখনও তুমি তৈরি হও নি?

ঝর্ণা স্বামীর দু’পা জড়িয়ে ধরে বলল, মাফ কর, আজ পার্টিতে যেতে পারব না। আমিন পা দিয়ে তাকে ঠেলে দিয়ে রাগের সঙ্গে বলল, ওসব প্যানপ্যানানি আমি পছন্দ করি না। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। ঝর্ণাকে বসে কাঁদতে দেখে আমিন তার হাত ধরে তুলে বলল, তুমি না গেলে আজ যেমন আমার ইজ্জৎ ধুলোর সঙ্গে মিশে যাবে, তেমনি দশলাখ টাকার অর্ডারটাও হাত ছাড়া হয়ে যাবে। ভালো চাওতো যা বললাম করো, নচেৎ শংকর মাছের চাবুক দিয়ে যা করার করব।

শংকর মাছের চাবুকের কথা শুন ঝর্ণার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। আগে এক পার্টিতে যাওয়ার দিন সত্যি সত্যি ঝর্ণার শরীর খারাপ ছিল। সেই জন্যে পার্টিতে যেতে চাইনি। সেদিন আমিন তাকে সদ্য কিনে আনা শংকর মাছের চাবুক দিয়ে ধোলাই করেছিল । সেই ধোলাই খেয়ে কয়েকদিন ঝর্ণাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। সমস্ত শরীর ফেটে গিয়ে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।

এখনও মারের দাগ আছে। সেই মারের কথা মনে পড়তে শেষমেষ ঝর্ণা পার্টিতে গেল । স্বামীর বন্ধুপত্নী মিলির মতো ব্যবহার সবাইয়ের সঙ্গে করতে পারল না। কিন্তু খুব চালাকির সঙ্গে ডাইরেক্টরকে পটিয়ে কাজ আদায় করেছে। পার্টিতে অনেক ছলাকলা দেখিয়ে ইজ্জৎ রক্ষা করেছে বটে, কিন্তু দু’চারজন আলাপ করতে করতে কাছে টেনে নিয়ে দু’একটা চুমো খেতে ছাড়ে নি। ঝর্ণা ভাবল, আমিনের কথামতো সে যদি মদ খাওয়া অভ্যাস করত, তা হলে সে ইজ্জৎ বাচাতে পারত না ।

বাসায় ফিরে আমিন খুশীতে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কয়েকটা চুমো খেয়ে বলল, তুমি আজ যা করলে, তার জওয়াব নেই। বল কি উপহার চাও? যা চাইবে তাই দেব । আমিন তাকে জড়িয়ে চুমো খেতে ঝর্ণার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঘৃণায় ভরে গেল। ভাবল, পার্টিতে স্ত্রীর এই গালে কত লোক চুমো খেয়েছে জেনেও স্বামীর কোনো অন্যকে কি দেবে? প্রতিক্রিয়া নেই। নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে ম্লান হেসে বলল, যে নিঃস্ব সে আবার আমিন কপাল কুচকে বলল, কথাটা বুঝলাম না?

ঝর্ণা বলল, বোঝার আর দরকার নেই। আমি এখন ঘুমাব । বড় ক্লান্তি লাগছে। আমিন জানে পার্টিতে ঝর্ণার খুব ধকল গেছে। তাই তার কথা শুনে আর কিছু বলল না। ড্রেস চেঞ্জ করার সময় শুধু বলল, যার কাছ থেকে তুমি অর্ডারটা সই করিয়ে যেমন সুন্দরী তেমনি বুদ্ধিমতী । নিলে ওনার নাম আজিজ সাহেব। উনি কি বললেন জান? বললেন, আপনার ওয়াইফ আমিনের কথা শুনে ঝর্ণার পার্টির কথা মনে পড়ল।

সবাইয়ের কাছ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে যখন আজিজ সাহেবের কাছে সই করাবার জন্য ফাইলটা খুলে ধরল তখন তিনি বললেন, ওটা তো হবেই। তবে এখানে নয়, পাশের রুমে চলুন। আগে একটু ফুর্তি করে নিই বলে তার একটা হাত ধরে উঠে দাঁড়ালেন। ঝর্ণা সরে এসে তার গা ঘেঁসে বলল, এত লোকজনের মধ্যে দিয়ে পাশের রুমে গিয়ে জুৎসই ফুর্তি করা যাবে না। কিছু হলেও শান্তি পাওয়া যাবে না।

তার চেয়ে আপনি সময় সুযোগ মতো কোনো হোটেলে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে আমাকে জানাবেন। তখন আর আপত্তি করব না।
আজিজ সাহেব তাকে শুধু একটা চুমো খেয়ে মুচকি হেসে বললেন, আপনি শুধু সুন্দরী নন, বুদ্ধিমতীও। তারপর ফাইলটা নিয়ে অর্ডারে সই করে দেন।
এখন স্বামীর কাছে আজিক সাহেবের সেই কথা শুনে ঝর্ণা মনে মনে ভয় পেলেও ঠোটে হাসি ফুটিয়ে বলল, আজিজ সাহেব যাই বলুন না কেন, তুমি কি মনে কর?

আমিন হেসে উঠে বলল, আমি তোমাকে তাই জেনেই তো ভালবেসে বিয়ে করেছি। আমিনের মুখে ভালবাসার কথা শুনে ঝর্ণার আবার ঘৃনায় মনটা ভরে গেল। বলল, আমার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, ঘুম পাচ্ছে।
বেশ কিছুদিন পর একদিন আমিন অফিস থেকে এসে বলল, আজিজ সাহেব কাল একটা পার্টি দিচ্ছেন। আজ ফোনে সে কথা জানিয়ে আমাদেরকে নিমন্ত্রণ করলেন । কথাটা শুনে ঝর্ণা চমকে উঠে বলল, আমি উনার পার্টিতে যেতে পারব না, তুমি একা যেও।

কেন?
কেন আবার। সেদিন অনেক কষ্টে ওনার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছি। এবারে তিনি ছেড়ে কথা বলবেন না। ঐ সব নোংরামী জান গেলেও আমি করতে পারব না । নোংরামী কাজ না করেও তাকে তুমি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করবে। আমি কি তোমাকে নোংরামী করতে বলেছি?
ডাইরেক্ট না বললেও আমাকে দিয়ে যে কাজ করাচ্ছ, তাতে বোঝা যায়, ইনডাইরেক্ট বলছ।

আমিন রেগে উঠে বলল, আমি তোমার অত কথা শুনতে চাই না। কাল তুমিও আমার সঙ্গে আজিজ সাহেবের পার্টিতে যাবে ।
যদি না যাই?
তার পরিণতি তুমি জান ।
জানলেও যাব না ।
ঠিক আছে, কাল দেখা যাবে ।
পরের দিন আমিন ঝর্ণাকে যাওয়ার জন্য প্রথমে অনেক বোঝাল। তাতে রাজি না হতে রেগে গিয়ে গালাগালি করল। তারপর শংকর মাছের চাবুক দিয়ে আঘাতের পর আঘাত করতে করতে বলল, আজ না গেলে সেই দশলাখ টাকার অর্ডারটা ক্যান্সেল হয়ে যাবে। যদি আমার কথামতো কাজ না করতে পারিস, তা হলে এক্ষুনি বেরিয়ে যা । যে স্ত্রী স্বামীর উন্নতি চায় না, তেমন স্ত্রী থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো ।

ঝর্ণা জানত, পার্টিতে না গেলে আমিন মারধর করবে। কিন্তু এরকমভাবে ছোটলোকের মতো ভাষা ব্যবহার করে গালাগালি করে এতবেশি মারবে তা ভাবতেই পারে নি। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি এ মুখ নিয়ে কোথায় যাব? তার চেয়ে মারছ যখন, তখন একদম শেষ করে দাও। নচেৎ বিষ এনে দাও, খেয়ে নিজেও শান্তি পাব আর তুমিও পাবে। তার আগে শুনে রাখ, তুমি এত নীচ, এত ছোটলোক, এত ইতর, আগে যদি জানতে পারতাম, তা হলে … বলে মারের যন্ত্রণায় কঁকাতে লাগল ।

তার কথা শুনে আমিন আরো উত্তেজিত হয়ে বলল, তা হলে কি করতিস? তা হলে বুঝি তোর গ্রামের সেই সাবেক প্রেমিক সাইফুলকে বিয়ে করতিস?
ঝর্ণা রেগে বলে উঠল, হ্যাঁ তাই করতাম।
তবে রে হারামজাদী বলে আমিন তাকে আবার মারতে লাগল। এক সময় ক্লান্ত হয়ে চাবুকটা যথাস্থানে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলল, ফিরে এসে তোকে যেন আর না দেখি ।

মার খেতে খেতে ঝর্ণার প্রায় মুর্ছা যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমিন বেরিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুক্ষণ ঘরের মেঝেয় পড়ে কাঁদল। তারপর টলতে টলতে বাথরুম থেকে মুখ-হাত ধুয়ে এসে যে জামা কাপড় পরে এ বাড়িতে প্রথম এসেছিল, সেটা পরে নিঃস্ব হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করল। কোথায় যাবে চিন্তা করে ঠিক করতে না পেরে শুধু হেঁটেই চলল।

কতক্ষণ হেঁটেছে তার খেয়াল নেই। সে খুব আনমনা অবস্থায় হাঁটছিল। সামনে থেকে একটা প্রাইভেট কার তাকে চাপা দেয় দেয় অবস্থায় পাশ কাটিয়ে চলে গেল। গাড়ীর হর্ণ ও তীব্র আলোয় ঝর্ণার সম্বিত ফিরে এল । বুঝতে পারল, সে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছে। তাড়াতাড়ি ফুটপাতে উঠে ধীরে ধীরে যেতে যেতে ভাবল, এই রাতের বেলা কোথায় যাওয়া যায়? হঠাৎ করে বান্ধবী শিরীনের কথা মনে পড়ল।

অনার্স পড়তে পড়তে এক ডাক্তারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর একদিন হলে এসে তাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেখানে যাওয়ার মনস্থির করে একটা রিক্সায় উঠে ঠিকানা বলল। আমিনের বাসা বক্সিবাজারে। ঝর্ণা সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে গুলিস্থান চলে এসেছিল। শিরীনরা আজিমপুরে একটা ফ্লাটে থাকে।

কিছুদূর আসার পর মনে পড়ল তার কাছে টাকা নেই, ভাড়া দেবে কি করে? ভাবল, রিক্সাওয়ালাকে সে কথা বলে নেমে যাই। আবার ভাবল, এতদূর কি এই অবস্থায় হেঁটে যেতে পারবে? তা ছাড়া রিক্সাওয়ালাই বা কি মনে করবে? শেষে ভাবল, শিরীনের কাছ থেকে নিয়ে দেবে। বাসায় পৌঁছে ঝর্ণা রিক্সাওয়ালাকে বলল, একটু দাঁড়াও ভাই, ভাড়া পাঠিয়ে দিচ্ছি।

রিক্সাওয়ালা কি আর বলবে, এরকম প্যাসেঞ্জার সে অনেক দেখেছে। বলল, একটু তাড়াতাড়ি পাঠাবেন আপা ।
শিরীন ঝর্ণার বিয়ের ব্যাপারটা জানত না। এতদিন পরে ঝর্ণাকে দেখে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে এসে বলল, কিরে এখন কোথা থেকে এলি? তারপর তার বিধস্ত চেহারার দিকে লক্ষ্য পড়তে আতঙ্কিত স্বরে বলল, কি ব্যাপার, তোর এরকম অবস্থা কেন?

রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে । পূর্ণা বলল, পরে সব বলব আগে দশটা টাকা কাউকে দিয়ে নিচে পাঠিয়ে দে, শিরীন টাকাটা কাজের মেয়ের হাতে পাঠিয়ে দিল। তারপর ঝর্ণার হাত ধরে পাশাপাশি বসে বলল, কি ব্যাপার খুলে বলতো?
আমি কিন্তু তোদের কাছে কয়েকদিন থাকব বলে এসেছি।
যতদিন ইচ্ছা থাকিস। আগে বল তোর এরকম অবস্থা কে করল?

ঝর্ণা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে উঠে শিরীনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল ।
শিরীন ঝর্ণাকে দেখার পর থেকে আতঙ্কিত হয়ে আছে। এখন তাকে কাঁদতে দেখে আরো বেশি আতঙ্কিত হয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে প্রবোধ দিতে গেলে ঝর্ণা উহু লাগছে বলে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, হাত দিবি না। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা ।
শিরীন অবাক হয়ে বলল, ব্যথা! কি হয়েছে বলতো?

ঝর্না সামলে নিয়ে পিঠের ও হাত-পায়ের কাপড় সরিয়ে বলল, আগে এগুলো দেখ, তারপর বলছি।
শিরীন দেখে চমকে উঠল। তার সারা শরীরে মারের আঘাতে জায়গাগুলো ফুলে গেছে। সেগুলো থেকে রক্ত বেরিয়ে শুকিয়ে গেছে। সে বোবা হয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তাকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতে দেখে ঝর্ণা বলল, কিরে, তুই মারের চিহ্ন দেখে ভয় পেয়ে গেলি? এ রকম মার খেলে তা হলে কি করতিস?

শিরীন বলল, কি করতাম জানি না, এখন তুই বল কে তোর সঙ্গে এমন পশুরমতো ব্যবহার করল?
ঝর্ণা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বিয়ে হওয়া থেকে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বলল । তারপর চোখ মুছে বলল, খুব পিয়াস লেগেছে, একগ্লাস ঠান্ডা পানি দেত ।

কাজের মেয়েটা রান্না ঘরে ছিল। শিরীন তাকে ডেকে বলল, এক জন মেহমানের জন্য বেশি করে রান্না করবে। এখন সিভিটা দিয়ে এক গ্লাস সরবত করে নিয়ে এস। কাজের মেয়েটা সরবত দিয়ে চলে যেতে শিরীন বলল, তোর জন্য দুঃখ হচ্ছে। তুই কত বড়লোকের মেয়ে, তোর আজ এই অবস্থা? যা বললি তারপর তো তুই আমিনের কাছে বা বাপের কাছে ফিরে যেতে পারবি না । কি করবি কিছু ভেবেছিস?

ভাববার সময় পেলাম কই। তোর কাছে কয়েকদিন থেকে ভেবেচিন্তে যা হোক কিছু করব।
হ্যাঁ, তাই করিস।
তোর ডাক্তার এখনও ফিরে নি?
সে এত তাড়াতাড়ি ফিরবে? বিকেলে মেডিকেল থেকে ফিরে ধানমণ্ডিতে একটা ক্লিনিকে বসে। ফিরতে রাত দশ-এগারটা বেজে যায়।

শিরীনের স্বামী জায়েদ এগারটায় ফিরে ঝর্ণার সব কথা শুনে দুঃখ প্রকাশ করে বলল, আপনি যদি চান, তা হলে কেস করে পাষণ্ডটাকে জেলে পাঠাতে পারি ।
ঝর্ণা বলল, সে সব পরে চিন্তা করব। আপাততঃ আপনি আমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করুন। তা না হলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর কোনো রাস্তা খোলা নেই ।

জায়েদ বলল, এ রকম ভয়ঙ্কর কথা বলবেন না। আপনি শিরীনের বান্ধবী । আপনাকে আমি আপন বোনের মতো মনে করে বলছি, যতটুকু পারি সাহায্য করব। কোনোদিন আত্মহত্যার কথা ভাববেন না। এই কাজ যারা করে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করেন না ।

শিরীনের আব্বা আহম্মদ উল্লাহ সাহেব ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। একটা ইসলামী সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা। জায়েদ কলেজে পড়ার সময় থেকে ঐ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত আহম্মদ উল্লাহ সাহেব জায়েদের উন্নত চরিত্রে আকৃষ্ট হয়ে একমাত্র মেয়ে শিরীনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দেন। তিনি একদিকে যেমন বিরাট ব্যবসায়ী, অন্যদিকে তেমনি দেশের ও দশের জন্যে নিবেদিত প্রাণ। বর্তমানে উচ্চ শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা যাতে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে সেই মতো চলে, সেই জন্য তিনি এই সংগঠন করেছেন।

নিজের মেয়েকে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেও ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় শিক্ষা দিয়ে সেই মতো মানুষ করেছেন। তাই শিরীন ক্লাস নাইন থেকে ভার্সিটি পর্যন্ত বোরখা পরে ক্লাস করত। ভার্সিটিতে শিরীনের বোরখা পরা নিয়ে অনেক ছেলেমেয়ে হাসাহাসি করত। একদিন কমন রুমে মেয়েরা শিরীনকে নিয়ে মজা করার জন্য তাদের মধ্যে একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই বোরখা পরিস কেন? তোর কি বিয়ে হয়ে গেছে? আমরা তো জানি গোঁড়া মুসলমানের মেয়েরা বিয়ের পর বোরখা পরে ঘরের বাইরে বেরোয়।

শিরীন বলল, তোদের ঐ জানাটা ভুল। তোরা ধর্মীয় বই একদম পড়িস না বলে এই রকম কথা বলছিস। যদি পড়তিস, তা হলে জানতে পারতিস পৃথিবীর সমস্ত সাবালিকা মেয়েদের বোরখা পরে ঘরের বাইরে বেরোন উচিত। যে কোনো জিনিস আলোচনা করতে হলে, তা ভালো-মন্দ জ্ঞান রাখতে হয়। এখন আমি যদি তোদেরকে বলি বোরখা পরার ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ কর, পারবি কি ? পারবি না। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দে, মানুষ জামা-কাপড় কেন পরে?

জন্য জামা-কাপড় পরে । অন্য একটা মেয়ে বলল, এটা আবার একটা প্রশ্ন হল? সবাই জানে, ইজ্জৎ ঢাকার শিরীন বলল, তাই যদি হয়, তা হলে পুরুষরা জামা-কাপড় পরে তাদের শরীরের কোনো অংশ মেয়েদের দেখায় না। আর মেয়েরা কেন তা পরেও পুরুষদেরকে তাদের শরীরের অনেক লোভনীয় অংশ দেখায়? অথচ সবাই জানে পুরুষদের চেয়ে মেয়েদের লজ্জা বেশি। এ কথারও তোরা উত্তর দিতে পারবি না। তোরা আমাকে ভুল বুঝিস না। কথাটা যখন তোরা তুলেছিস তখন দু’একটা কথা না বলে পারছি না। আমরা বিভিন্ন বিদ্যাপীঠে জ্ঞান অর্জন করার জন্য আসি। কিন্তু আমরা কি তা করছি?

করছি না। আমরা শুধু ডিগ্রি নিতে আসি। অনেকে হয়তো বলবি, আমরা ডিগ্রির সঙ্গে জ্ঞানও অর্জন করছি। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, জ্ঞান অর্জন করার পর কি কেউ অজ্ঞানের মতো কাজ করতে পারে? মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ভালোমন্দ বোঝার জন্য। মন্দকে ত্যাগ করে ভালোকে গ্রহণ করার জন্য। আর তখনই জ্ঞান অর্জনের সার্থকতা যখন জ্ঞানের প্রতিফলন নিজের জীবনে প্রতিফলিত করবে।

আসলে আমরা তা না করে শুধু ডিগ্রি নেয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষা নিতে আসি। জ্ঞান অনুযায়ী কেউ অনুশীলন করাকে নির্বুদ্ধিতা মনে করি। তাই আল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা এবং হযরত মোহাম্মদ (দঃ)-কে পৃথিবীর সব যুগের শ্রেষ্ঠ মানব জেনেও তাঁদের আদেশ মেনে চলছি না। আর যারা আদেশ মেনে চলার চেষ্টা করে, তাদেরকে নিয়ে আমরা বিদ্রুপ করি, হাসি মস্করাও করি ।
শিরীনের কথা শুনে কেউ কোনো কথা বলতে পারল না।

ইউনিভার্সিটিতে সেদিন শিরীনের কথা ভালো লাগলেও অন্যদের মত ঝর্ণাও মেনে নিতে পারে নি। কিন্তু শিরীনের মধুর ব্যবহারে আকৃষ্ট হয়ে তর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। সেই শিরীনের বাসায় কয়েকদিন থেকে বুঝতে পারল, এদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কত সুন্দর। সংসারটা যেন শান্তির নীড়। একদিন কথায় কথায় শিরীন বলল, জানিস, শিক্ষিত অশিক্ষিত নারী-পুরুষ ধর্মের জ্ঞান না পেয়ে এবং যারা কিছু কিছু তা পেয়েও সেই মতো অনুশীলন করছে না বলেই সমাজের এত অবক্ষয়।

তোকে অনুরোধ করছি, আমাদের অনেক ধর্মীয় বই রয়েছে, সেগুলো পড়। দেখবি, তুই যেন অন্য জগতে চলে গেছিস। আল্লাহ ও তার রাসূল (দঃ) প্রত্যেক নর-নারীর জ্ঞান অর্জন করাকে অবশ্য কর্তব্য বলেছেন। কিন্তু সেই জ্ঞান কি জ্ঞান, সেটা চিন্তা করা প্রত্যেকের কর্তব্য। জ্ঞান অর্জন বলতে কেউ যদি শুধু স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানকে বোঝে, তবে সে যেমন ভুল করবে, আবার যদি কেউ শুধু ধর্মীয় শিক্ষাকে বোঝে, তা হলে সেও তেমনি ভুল করবে। কারণ জ্ঞানের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।

মানুষ যে কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। তবে সে জ্ঞান যেন মানুষের কল্যাণে আসে। মানুষকে সব সময় মনে রাখতে হবে, যে জ্ঞান আল্লাহ ও রাসূলের (দঃ) আইনের পরিপন্থী তা পরিত্যাগ করতে হবে। আর তা জানার জন্য আল্লাহপাকের কুরআন ও রাসূল (দঃ)-এর হাদিসের ব্যাখ্যা পড়তে হবে। আমরা তা করছি না বলে আজ সারা বিশ্বে মুসলমানরা সব থেকে ঘৃনিত, আর সমাজে এত অশান্তি ।

শিরীনের কথা শুনতে শুনতে ঝর্ণা মনের মধ্যে কি রকম যেন অস্থিরতা অনুভব করল। কুরআন-হাদিসে কি আছে জানার জন্য প্রেরণা পেল। বলল, তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে, আমরা ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন না করে ঐশ্বর্য্যের মধ্যে সুখ-শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছি। যার ফলে এত সুখের নীড় অশান্তিতে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

এরপর থেকে ঝর্ণা তাদের ঘরে যত ধর্মীয় বই ছিল, সেগুলো পড়তে পড়তে তার জ্ঞানের চোখ খুলে গেল । সেগুলো পড়ে এবং বিভিন্ন বিষয়ে শিরীন ও তার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পারল, আসল জ্ঞান কুরআন-হাদিস না পড়লে অর্জন করা যায় না। তারপর সে নামায পড়তে শুরু করল। কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা যত সে পড়তে লাগল, ততই তার মনে যেন এক স্বর্গীয় শান্তি অনুভব হতে লাগল । জীবনে যে এত বড় বিপর্যয় ঘটে গিয়ে তার মন দুঃখের সাগরে ভাসছিল, এখন তার মনে হতে লাগল, সেই সাগেরর তীরের দিকে যেন ক্রমশঃ এগিয়ে যাচ্ছে।

প্রায় প্রতিদিন সে জায়েদকে চাকরির কথা জিজ্ঞেস করে। একদিন রাতে খাওয়া- দাওয়ার পর ঝর্ণা জায়েদকে বলল, আর কত দিন আপনাদের ঘাড়ে বসে খার? আসলে আপনি সিরিয়াসলি চেষ্টা করছেন না। আপনার ধারণা ভুল। চেষ্টার কোনো ত্রুটি করছি না। আমাদের ক্লিনিকে একজন রিসেপসনিস্ট দরকার। দু’জন মেয়ে ঐ পদে ছিল। একজন বেটার চান্স পেয়ে চলে আপনি রাজি থাকলে আমি ব্যবস্থা করে দেব। গেছে। সকাল আটটা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত ডিউটি। বেতন দেড় হাজার টাকা।

ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করল, কি রে করবি না? ঝর্ণা কিছু বলার আগে শিরীন বলল, করবে না কেন? তুমি ব্যবস্থা কর। তারপর তাকিয়ে বলল, আপনি ব্যবস্থা করুন। ঝর্ণা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, করব না মানে? নিশ্চয় করব। তারপর জায়েদের দিকে পেলে ছেড়ে দিবি। শিরীন বলল, বেতনটা একটু কম, তা হোক আপাতত এটা কর । পরে বেটার চান্স জায়েদ বলল, বেতনটা কম বলে আমি কথাটা বলতে চাই নি । উনি আমাকে চেষ্টা করছি না বলে সন্দেহ করায় বললাম । তবে বিকালের দিকে একটা ছাত্রীকে প্রাইভেটও পড়াতে পাবেন । আমার এক বন্ধুর ভাগ্নি ক্লাস টেনে পড়ে। বেতন মোটামুটি ভালই দেবে। তবু কত দেবে বলে মনে হয়?

আগে যে পড়াত, তাকে এক হাজার দিত। সে সপ্তাহে তিন দিন যেত । উনি যদি সবদিন পড়ান, তা হলে আমি বললে দেড় হাজার দিতে পারে ।
ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল, উনি আপনার কি রকম বন্ধু?

জায়েদ বলল, বন্ধু বন্ধুর মতই। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুত্ব হয়। ছেলেটা একটু বেপরোয়া মতো হলে কি হবে খুব সরল আর ধার্মিক। সে সময় আমাদের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল । এখন তার কথা মনে হলে খুব দুঃখ হয় ৷
শিরীন জিজ্ঞেস করল, কেন দুঃখ হয় কেন?

গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। জায়েদ বলল, সে কথা শুনলে তোমরাও দুঃখ পাবে। তাছাড়া সব কথা বলতে ঝর্ণা বলল, হোক ভোর, তবু শুনব । যার ভাগ্নিকে পড়াব তার সব কথা জানা দরকার । জায়েদ চিন্তা করতে লাগল এদের কাছে বন্ধুর সম্বন্ধে কতটা বলা যায় । স্বামীকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শিরীন বলল, চুপ করে আছ কেন? ঝর্ণাতো ঠিক কথা বলেছে।

জায়েদ বলতে আরম্ভ করল, বন্ধুর নাম আরজু। আমি আই. এস. সি পাস করে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পর আরজুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ তেমন হত না। মাঝে মাঝে সংগঠনের মিটিং-এ দেখা হলে আলাপ হত। প্রায় বছর তিনেক হল সংগঠনের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। সেক্রেটারীকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, সে সংগঠন ছেড়ে দিয়েছে।

হঠাৎ দিন পনের আগে আরজু আমাদের ক্লিনিকে পেটের যন্ত্রনার ট্রিটমেন্ট করাতে এলে আমাকে দেখে আনন্দে কোলাকুলি করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করল । তাকে সংগঠন ছেড়ে দেয়ার কথা জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে বিলেতে চলে গিয়েছিলাম। বছর খানেক পরে বাবা-মার মৃত্যুর খবর পেয়ে ফিরে আসি। তারপর আবার চলে যাই । সেখানে পড়াশোনা করতে গিয়ে একটা চাকরি করছি।’

ওর বাবা একজন বড় ব্যবসায়ী জানতাম। জিজ্ঞেস করলাম, পড়াশোনা না করে সেখানে চাকরি করছ কেন? পড়াশোনা ভালো না লাগলে বাবার ব্যবসায় নেমে যাও। আমার কথা শুনে ম্লান হেসে একটা কার্ড দিয়ে বলল, ‘সময় করে দু’একদিনের মধ্যে বাসায় এস, সেদিন তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব।’
ওকে পরীক্ষা করে দেখলাম ওর লিভার পচতে শুরু করেছে। সে জন্য পেটে যন্ত্রনা হচ্ছে।

যারা বেশি মদ খায় তাদের এই রোগ হয়। তাই অবাক হয়ে বললাম, তোমার এই রোগ হল কি করে? আবার ম্লান হেসে বলল, বললাম না, বাসায় এলে সব কথা বলব। আরজু চলে যাওয়ার পর চিন্তা করলাম, অত ধার্মিক ছেলে মদ ধরল কি করে? আগে ওর কত সুন্দর স্বাস্থ্য ছিল, সব সময় মুখে হাসি লেগে থাকত। এখন কত রোগা হয়ে গেছে। মুখে হাসি নেই। সব সময় বিষাদের ছায়া। ভেবে রাখলাম কালকে ছুটি আছে, যাওয়া যাবে। পরের দিন বেলা দশটার দিকে পুরানা পল্টনে ওদের বাসায় গেলাম।

বেশ বড় দোতলা বাড়ি। গেটে দারোয়ান। আমাকে দেখে সালাম দিয়ে পরিচয় জানতে চাইল। আমি পরিচয় দিতে গেট খুলে দিল। আমাকে দেখে আরজুর কি আনন্দ। হাঁক-ডাক করে কাজের মেয়েদের ডেকে নাস্তা পানি করাল। বাড়িতে আর কোনো লোকজন দেখলাম না। নাস্তা খাওয়ার পর আরজু একজন পঁয়ত্রিশ বছরের মহিলা ও পনের-ষোল বছরের একটা মেয়েকে সঙ্গে করে এনে বলল, আমার বড় বোন ও তার মেয়ে ।

তারপর আমাকে দেখিয়ে তাদেরকে বলল, আমার বন্ধু । এ ডাক্তার । এর কাছেই টিটমেন্ট করাচ্ছি। আরজুর বড় বোনকে তেমন প্রফুল্ল দেখলাম না। তবে তার মেয়েটা খুব সুন্দর। হাসি-খুশী ভাব। সালাম বিনিময়ের পর ভদ্রমহিলা দু’একটা কথা জিজ্ঞেস করে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন। দুপুরে না খাইয়ে ছাড়ল না। তার আগে আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে বাসায় ফোন করে সে কথা জানিয়ে দিল ।

খাওয়া- দাওয়ার পর বিশ্রাম নেয়ার সময় আমার মনে অনেক কিছু জানার ইচ্ছা হল । অতবড় বাড়িটাকে মৃত্যুপুরী বলে মনে হল । চিন্তা করলাম, নিজেদের লোক কম, ভাড়া না দিয়ে ফেলে রেখেছে কেন? আরজু বিয়ে করেছে বলেও মনে হল না । ইচ্ছাগুলো চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করতে যা বলল, তা বিশ্বাস করতে আমার অনেক সময় লেগেছিল । শিরীন বলে উঠল, কই, তুমি তো তার কথা কখনো বল নি?

জায়েদ বলল, শুনে তুমি দুঃখ পাবে ভেবে বলি নি। আজ তোমরা একান্ত শুনতে চাচ্ছ বলে বলছি।
ঝর্ণা শিরীনকে বলল, তুই থামতো, মাঝখান থেকে ডিস্টার্ব করিস না। তারপর জায়েদকে বলল, বলুন ।
জায়েদ আবার বলতে আরম্ভ করল, আরজু উত্তর বঙ্গের ছেলে। স্কুলে ক্লাস টেনে পড়তে পড়তে কি একটা গোলমাল করে ঢাকায় পালিয়ে আসে। এসে প্রথমে কোনো কাজ না পেয়ে রিক্সা চালাত। তারপর এক সাহেবের কৃপা দৃষ্টিতে পড়ে। সাহেবের একটা মাত্র ছেলে ছিল। কলেজে পড়ার সময় মারা যায়। ছেলের শোকে সাহেবের স্ত্রী পঙ্গু হয়ে যান।

ওনারা আরজুকে নিজেদের ছেলে করে নেন। আরজুও তাদেরকে মা- বাবা বলে ডাকত। সাহেব তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেন। তারপর ভার্সিটিতে পড়ার সময় একদিন বাসায় কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ বিলেতে চলে যায়। কেন গেল জিজ্ঞেস করতে বলল, সে কথা এখন বলতে পারবে না। বিলেতে কিছু দিন পড়াশোনা করে। তারপর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে চাকরি করতে থাকে। প্রায় বছর খানেক পর সে বাড়িতে চিঠি দেয়। ততদিন আরজুর শোকে সাহেব ও তার স্ত্রী মারা গেছেন। সাহেব মারা যাওয়ার আগে সবকিছু আরজুকে উইল করে দিয়েছিলেন।

যে ব্যারিস্টারকে দিয়ে উইল করিয়েছিলেন, সাহেবের মৃত্যুর পর সেই ব্যারিস্টার আরজুর চিঠি আসার পর সব কিছু জানিয়ে ফিরে আসতে বলেন। আরজু এসে বছর খানেক ঢাকায় থেকে ব্যবসায় মন দিল। খুব বুদ্ধিমান ছেলে। কিছুদিনের মধ্যে ব্যবসা করে প্রচুর টাকা রোজগার করল। এর মধ্যে দেশে গিয়ে মা, বাবা, বিধবা বোন ও তার মেয়েকে নিয়ে আসে। গুলশানে একটা বাড়ি করেছে।

মা-বাবাকে আনার পর সে সেই বাড়িতে থাকে। প্রতিদিন শুধু দুপুরে এ বাড়িতে খেতে আসে। কয়েক মাস পরে তার মা-বাবা দু’মাসের ব্যবধানে মারা যায়। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ম্যানেজারের হাতে ব্যবসার ভার তুলে দিয়ে আবার বিলেতে চলে যায়। ব্যবসায়িক কারণে ম্যানেজারের চিঠি পেয়ে এসেছে। একবার ঐ সাহেব তার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে আরজুর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আরজু তখন ভার্সিটিতে পড়ত।

বিয়ের কথা শুনে তাদেরকে বলে, আমি চিরকুমার থাকব। তাতে যদি আপনারা অসন্তুষ্ট হন, তা হলে বলুন আমি এখান থেকে চলে যাব। ওনারা আরজুর মধ্যে নিজের ছেলেরমতো ডেসপ্যারেট ভাব লক্ষ্য করছেন। সেই ছেলে যা বলত তার একচুল নড় চড় করত না। তাই আরজুর কথা শুনে ঐ ব্যাপারে আর কিছু বলেন নি।

আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার যে অসুখ হয়েছে, তা হেভী মদখোরদের হয়। তা হলে কি তুমি মদ খাও?
কেন?

আরজু একটু গম্ভীর হয়ে বলল, বুঝতেই যখন পেরেছ তখন আবার জিজ্ঞেস করছ পারছি না । খুব অবাক হয়ে বললাম, কিন্তু তোমার মতো ছেলে মদ খাবে এটা বিশ্বাস করতে আরজু করুণ স্বরে বলল, পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস ঘটছে, তা বিশ্বাস করা যায় না।
বললাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করো না। তুমি চিরকুমার থাকতে চাইছ কেন?

আমার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ছলছল নয়নে আমার দিকে চেয়ে বলল, একটা মেয়ের অপেক্ষায় । আরজুর চোখে পানি দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, সেই মেয়ে কি জানে তুমি তার প্রতীক্ষায় আছ?

মুখে কিছু না বলে আরজু শুধু মাথা নাড়াল ।
খুব আশ্চার্য্য হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম, সেই মেয়েকে নিশ্চয় ভালবেসেছিলে? শুধু ভালবেসেছিলাম না, আজও বাসি এবং মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বেসে যাব ।
সেও কি তোমাকে ভালবাসে?
না, সে আমাকে ঘৃণা করে ।

আশ্চর্য! এরকম ঘটনাও ঘটে তা হলে? আচ্ছা, তুমি যে এত ভালবাস সে কি তা জানে?
জানে। আর জানে বলে আমাকে জব্দ করার জন্য অন্য একজনকে ভালবেসে বিয়ে করেছে।
আরজুর কথা শুনতে শুনতে আমার বিস্ময় উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। বললাম, এতকিছুর পরও তুমি তাকে আমৃত্যু ভালবাসবে?

বাসব। কেন জান? সেই মেয়েটাকে ছোটবেলা থেকে শুধু ভালবাসি নি, সে আমার অন্তরে এত গভীরভাবে বাসা বেঁধে আছে, সেখান থেকে সরান কিছুতেই সম্ভব নয়। যে ক’টাদিন বাঁচব তার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকব। তারপর সামলে নিয়ে চোখ মুখ মুছে বলল, আজ পর্যন্ত কাউকে এসব কথা বলি নি। ভেবেছিলাম, কাউকে আমার দুর্ভাগ্যের কথা জানাব না। কিন্তু তোমাকে কেন যেন বলে ফেললাম। একটা অনুরোধ করব রাখবে?
বললাম, রাখব না কেন?

আমার এই ভাগ্নির জন্য একজন মহিলা টিউটর জোগাড় করে দেবে? বুবু আবার কোনো পুরুষ টিউটর রাখতে চায় না।
বললাম, ঠিক আছে চেষ্টা করব। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম চারটে বেজে গেছে । এবার আমি যাই, আমাকে ক্লিনিকে যেত হবে। চা-নাস্তা খেয়ে ফিরে এলাম । এই হল আমার বন্ধুর হিষ্ট্রী। তারপর ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করল, এখন বলুন, আপনি আমার বন্ধুর ভাগ্নিকে পড়াবেন কিনা?

ঝর্ণা এতক্ষণ শুনতে শুনতে চিন্তা করছিল, সাইফুলের সঙ্গে ওনার বন্ধুর হিষ্ট্রীর অনেক মিল রয়েছে। সে নয় তো? আবার চিন্তা করল, তা কি করে হয়? এনার নাম তো আরজু। জায়েদের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, আপনার বন্ধুর হিষ্ট্ৰী বড় রোমাঞ্চকর ও দুঃখ জনক । দেখুন কথা বলে, আমার কোনো আপত্তি নেই।

জায়েদ বলল, সেদিন বলেছিল বেশিদিন সে থাকবে না। দাঁড়ান টেলিফোন করে দেখি আছে কিনা। টেলিফোন ইনডেক্স থেকে নাম্বার নিয়ে ডায়েল করল। রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। ঘড়ির দিকে তাড়িয়ে দেখল, রাত সাড়ে বারটা। হেঁসে উঠে বলল, বন্ধুর ইতিহাস বলতে বলতে টাইমের কথা ভুলে গেছি। সাড়ে বারটার সময় কেউ কাউকে টেলিফোন করে নাকি?

রিসিভার রাখতে যাবে এমন সময় ওপাশের রিসিভার তোলার শব্দ পেল । একটু পরে একটা তরুনীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল-কত নাম্বার চান? আরজুর ভাগ্নি নাজনীন নিজের রুমে পড়ছিল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে দরজা বন্ধ করতে এসে বারান্দায় টেলিফোন বাজতে শুনে ফোন ধরেছে।
জায়েদ নাম্বার বলল ।
নাজনীন বলল, কাকে চান? মামাকে?

হ্যাঁ।
মামা তো এ বাসায় থাকেন না। গুলশানের বাসায় থাকেন। ওখানকার ফোন নাম্বার জানেন?
না, আপনি বলুন ।

নাজনীন নাম্বার বলে বলল, সকাল আটটার মধ্যে করবেন। এখন উনি ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে। পড়েছেন। আরজু এ বাসায় বলে রেখেছে, রাত্রে তাকে কেউ ফোন করলে ঘুমিয়ে তাই করবো বলে জায়েদ রিসিভার ক্রাডেলে রেখে বলল, কাল তার অফিসে একবার ফোন করে যোগাযোগ করব। এখনও তা হলে সে বিলেত চলে যাই নি পরের দিন মেডিকেল থেকে জায়েদ আরজুর অফিসে ফোন করে গেল না।

বিকেলে ক্লিনিকে এসে আবার ফোন করার জন্য ডায়েল করছে এমন সময় তাকে এক্ষুনি ফোন করছিলাম । স্বশরীরে ঢুকতে দেখে রিসিভার রেখে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করে বলল, তোমাকে আরজু হাসি মুখে বলল, আমার সৌভাগ্য। যাক, কি জন্যে ফোন করছিলে বল? জাযেদ পিয়নকে দুটো চায়ের অর্ডার দিল। তারপর বলল, আগে তোমার বিলেত যাওয়ার খবর বল ।

কাল সকালের ফ্লাইটে যাচ্ছি।
কতদিনে ফিরছ?
তা এখন ঠিক বলতে পারছি না ।
কেন?
ভাবছি সহসা ফিরব না ।
তা কি করে হয়? এখানকার ব্যবসা, বাড়িঘর দেখাশুনা করবে কে?

ম্লান হেসে আরজু বলল, ওসবের ওপর আমার তেমন কোনো টান নেই। ম্যানেজারকে বলেছি দেখতে। আর মাঝে মাঝে আমিও আসব। বুবু আর তার মেয়ে না থাকলে হয়তো আর আসতাম না । আমার কথা বাদ দাও, কেন ফোন করতে যাচ্ছিলে বল ।
না, মানে আমার স্ত্রীর এক বান্ধবি ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ে আমাদের কাছে এসে উঠেছে। মেয়েটা শিক্ষিতা। তুমি সেদিন তোমার ভাগ্নিকে পড়াবার জন্যে প্রাইভেট টিউটরের কথা বলেছিলে না, সেই ব্যাপারে আলাপ করতে চেয়েছিলাম।

ভাগ্য বিপর্যয়ের কথা শুনে আরজুর নিজের ভাগ্যের কথা মনে পড়ল । মৃদু হেসে বলল, যাদের ভাগ্যে বিপর্য্যয় আসে, পরে আবার তাদের ভাগ্যে সৌভাগ্যও আসে। ঠিক আছে, উনি কাল থেকে পড়াতে আসুক । আমি বুবুকে সে কথা বলে রাখব। আমার ফ্লাইট খুব ভোরে। তুমি প্রথম দিন বাসা চিনিয়ে দিও। খুব ব্যস্ত আছি, এখন চলি।

যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে একটু দেখা করতে এলাম বলে দাঁড়িয়ে আবার বসে বলল, তোমার ফোনটা একটু এদিকে দাওতো। এক সপ্তাহ আগে ম্যানেজার তার একজন পোস্ট খালি আছে কি না । পি.এ. দরকার জানিয়েছিল। তাকে আমি অর্ডারও দিয়েছিলাম। ফোন করে দেখি সেই
জায়েদ ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার অফিস এখনও খোলা আছে?

ম্যানেজারের বাসায় ফোন করব। তারপর ফোন করে তার সঙ্গে আলাপ করে ফোন ছেড়ে দিয়ে বলল, তোমার স্ত্রীর বান্ধবীর সৌভাগ্যের চাবি এখন থেকেই হাতে আসতে আরম্ভ করল। তারপর একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে তার উল্টো দিকে দু’কলম লিখে সিগনেচার দিয়ে বলল, এটা নিয়ে কালই অফিস আওয়ারে যেতে বলবে। আমি ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি, এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিয়ে দেবেন। আর ওনাকে বায়োডাটা ও ছবিসহ একটা এপ্লিকেশন নিয়ে যেতে বলবে। দেখছে, ভাগ্য কাকে বলে?

একসঙ্গে দুটো চাকরি। প্রাইভেট টিউটর ও ম্যানেজারের পি.এ.। যাক, উঠি তা করে আরজু চলে গেল । হলে, এখনো অনেক কাজ বাকি আছে। তারপর হাত মোসাফাহা ও সালাম বিনিময় জায়েদ রাত্রে বাসায় ফিরে স্ত্রী ও ঝর্ণাকে সব কথা জানাল । শুনে দু’জনে আল্লাহর শোকর আদায় করল।
জায়েদ ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করল, কোনটা করবেন? আমাদের ক্লিনিকের রিসেপসনিস্ট, না অফিসের ম্যানেজারের পি. এ? আমার মনে হয় ক্লিনিকের চেয়ে অফিসের চাকরিটা ভালো।

শিরীন বলল, অফিসের বেতন স্কেল কত এবং প্রাইভেট পড়াবার জন্য কত দেবে জিজ্ঞেস কর নি?
জায়েদ বলল, যে নিজে থেকে সব কিছু ব্যবস্থা করল, তাকে কোন মুখে বেতনের কথা জিজ্ঞেস করব?
ঝর্ণা বলল, ডাক্তার ভাইয়ের কথা ঠিক। উনি যে নিজের থেকে এতকিছু করলেন সেটাই যথেষ্ট ।

এরপর বেতনের কথা তোলা প্রেসটিজের ব্যাপার না?
দিন দুই পরে ঝর্ণা বোরখা পরে সময় মতো অফিসে গিয়ে পিয়নকে জিজ্ঞেস করতে সে ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেল ।
ম্যানেজার খুব সৎলোক। অনেক দিন থেকে এখানে কাজ করছেন। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। সৌম্য শান্ত চেহারা। তিনি একমনে একটা ফাইল দেখছিলেন। ফাইলের কাজ শেষ করে সেটা বন্ধ করার সময় বোরখা পরা একটা অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন, কে আপনি? কেন এসেছেন বলুন?

ঝর্ণা ম্যানেজারের রুমে ঢুকে মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়েছে। ম্যানেজারের কথার উত্তরে সালাম দিয়ে সব কাগজপত্রের সঙ্গে আরজুর দেয়া কার্ডটাও দিল ।
ম্যানেজার সেগুলোর উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তটস্থ হয়ে তাকে বসতে বলে বললেন, কিছু মনে করবেন না। ছোট সাহেব বিলেত যাওয়ার আগের দিন তা হলে আপনার ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলাপ করছিলেন। কিন্তু আপনি যে পর্দানসীন মহিলা সে কথা বলেন নি।

তারপর তার কি কাজ বুঝিয়ে দিয়ে কলিংবেল বাজিয়ে পিয়নকে ডাকলেন। পিয়ন আসার পর ঝর্ণাকে বললেন, আপনি ওর সঙ্গে আপনার রুমে যান। আমি এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়ে দিচ্ছি। ম্যানেজারের পাশের রুমটা পি.এ.র জন্য ঠিক করা হয়েছে। পিয়ন ঝর্ণাকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল ।
ঝর্ণা নিজের সিটে বসে রুমটার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল। ম্যানেজারের রুমটার মতো এ রুমও এয়ারম কন্ডিশান করা। মেঝেয় কার্পেট বিছান।

টেবিলের উপর পুরু কাচ। এক সাইডে একটা স্টীলের নতুন আলমারী। চাবিটা কীহোলে এক পাশে ইনটারকম রয়েছে। লাগান। তার পাশে … স্টীলের সেলফ। থরে থরে ফাইল সাজান রয়েছে। টেবিলের প্লেট চাপা দিয়ে চলে গেল। একটু পর পিয়ন এসে একগ্লাস পানি ছোট টেবিলের এক পাশে রেখে সিরামিকের ঝর্ণার পিয়াস লেগেছিল।

ানিটা খেয়ে গ্লাস রাখছে এমন সময় ইন্টারকমে পিক পিক শব্দ হতে রিসিভার তুলে কানের কাছে ধরতে ম্যানেজারের গলা শুনতে পেল, আট নাম্বার ফাইলটা নিয়ে আসুন। ঝর্ণা সেলফের কাছে গিয়ে ফাইল নিয়ে ম্যানেজারের রুমে এল।

ম্যানেজার তাকে বসতে বলে ফাইলটা খুলে কি করতে হবে বুঝিয়ে বললেন, প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হবে। পরে ঠিক হয়ে যবে। এবার যান, যা বললাম সেভাবে কাজ করুন। কোনো অসুবিধে হলে আমার কাছে আসবেন, বুঝিয়ে দেব।

ঐ দিন ফেরার পথে ঝর্ণা ভাবল, আজ সাহেবের বাসায় গিয়ে ছাত্রীর সঙ্গে আলাপ করে যাই, কাল থেকে পড়ান যাবে। গেটে দারোয়ান বাধা দিলে ঝর্ণা পরিচয় দিতে পেয়ে বলল, আমি সাহেবের ভাগ্নিকে পড়াতে এসেছি। গেট খুলে দিল। ঝর্ণা ভিতরে গিয়ে বারান্দায় উঠে একটা কাজের মেয়েকে দেখতে একটু পরে ফিরে এসে অন্য একটা রুমে নিয়ে গেল। কাজের মেয়েটা তাকে সঙ্গে করে ড্রইংরুমে বসিয়ে ভিতরে খবর দিতে চলে গেল ।

ঝর্ণা রুমে ডুকতেই বুঝতে পারল, এটা ছাত্রীর রুম। একদিকে একটা শোবার উপর ছিব্বা ঢাকা একটা প্লেট। পাশে পানির জগ ও গ্লাস । খাট। অন্য দিকে একটা টেবিল। তারপাশে দেওয়ালের গায়ে বুক সেলফ। টেবিলের কাজের মেয়েটা ঝর্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, আপনি অফিস থেকে তো একটু পরে আসবে। কথা শেষ করে চলে গেল । আসছেন, তাই আপা বললেন, ওনাকে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেয়ে নিতে বল। নাজনীন ঝর্ণা দুপুরে কিছু খায় নি। প্রথম দিন বলে খাবার সঙ্গে আনে নি ।

সে খুব ক্লান্ত ও ক্ষুধা অনুভব করছিল। কাজের মেয়েটা চলে যাওয়ার পর এটাচড বাথরুম থেকে হাত- মুখ ধুয়ে এসে নাস্তা খেয়ে রুমালে হাত-মুখ মুচছে এমন সময় দেখল, স্যালোয়ার- নিয়ে আসছে। বুঝতে পারল, এ মেয়েটাই সাহেবের ভাগ্নি। কামিজ পরা একটা ফুটফুটে সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে সেই কাজের মেয়েটা এক কাপ চা রেখে ফিরে গেল । নাজনীন কাছে এসে সালাম দিল। আর কাজের মেয়েটা চায়ের কাপটা টেবিলে ঝর্ণা সালামের উত্তর দিয়ে তাকে বসতে বলল। নাজনীন বসার পর চা খেয়ে কাপটা টেবিলের একপাশে মেঝেয় রেখে বলল, আজ পড়াতে আসি নি, তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম । কাল থেকে পড়াব। তোমার নাম কি ?

নাজনীন নাম বলল ।
তোমার আম্মাকে ডেকে আন, আলাপ করব।
নাজনীন চলে যাওয়ার পর ঝর্ণা একটু ভয়ে ভয়ে চিন্তা করতে লাগল, যদি আরজু সাইফুল হয়, তা হলে তার বোন আমাকে চিনে ফেলতে পারে। আচ্ছা, আমিও কি তাকে চিন্তেত পারব ? সে তখন সাইফুলের বড় বোনের মুখ মনে করার চেষ্টা করল।

কিন্তু কত বছর আগে কয়েকবার মাত্র তাকে দেখেছে, তাই মনে করতে পারল না। কিছুক্ষণ পরে বাইরে পায়ের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকাল ।
একটু পরে নাজনীনের সঙ্গে মনিরা পর্দা ঠেলে রুমে ঢুকে এগিয়ে এল।
ঝর্ণা দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে চিনবার চেষ্টা করল। কিন্তু মনে করতে পারল না।

মনিরা কাছে এসে সালামের উত্তর দিয়ে বলল, দাঁড়ালেন কেন বসুন। তারপর ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে চেনা চেনা লাগল । কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে মনে করতে পারল না। ভাবল, হয়তো এনার মতো কোনো মেয়েকে কোথাও দেখেছে।
তার মুখের দিকে নাজনীনের আম্মাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঝর্ণা ভয়ে ভয়ে আলাপ করার চেষ্টা করল।
মনিরা বেশিক্ষণ বসল না, দু’চারটে কথা বলে চলে গেল ।
ঝর্ণা নাজনীনকে জিজ্ঞেস করল, তোমার আম্মা কি অসুস্থ?

নাজনীন বলল, না। আমার নানা-নানি মারা যাওয়ার পর থেকে আম্মা সব সময় গম্ভীর হয়ে থাকে । কারো সঙ্গে বড় একটা কথা বলে না ।
ঝর্ণা বলর, ঠিক আছে, আজ তা হলে চলি, কাল এসে পড়াব
শিরীন জানে আজ ঝর্ণা অফিসের পর সাহেবের ভাগ্নিকে পড়াতে যাবে। তাই দেরি করে ফেরার জন্যে কৈফিয়ে‍ না চেয়ে জিজ্ঞেস করল, কিরে, ছাত্রী কেমন? তাদের বাসার লোকজন দেখে কি মনে হল?

ঝর্ণা বলল, ডাক্তার ভাই তো সেদিন তাদের বাসার সব কথা বললেন। ছাত্রী মোটামুটি ভালো হবে বলে মনে হয় ।
পরের দিন থেকে ঝর্ণা প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে নাজনীনকে পড়িয়ে বাসায় আসে। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে ঝর্ণা নিজের দুটো শাড়ি, ব্লাউজ ও সায়া এবং শিরীনের জন্য একটা ভালো শাড়ি ও ডাক্তার ভাইয়ের জন্য একটা পাঞ্জাবী কিনে আনল ৷ ঝর্ণা প্রাইভেট পড়িয়ে ও অফিসের বেতন বাবদ মোট সাড়ে চার হাজার টাকা আজ পেয়েছে । তাদের জন্য কাপড় কিনেছে দেখে শিরীন কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ঋণ পরিশোধ করতে চাচ্ছিস?

ঝর্ণা বলল, তোদের ঋণ কি আমি জীবনভোর শোধ করতে পারব? রাগ করছিস কেন? তোদেরকে খুশী করার জন্য দিচ্ছি না, প্রথম রোজগারের টাকা পেয়ে নিজের খুশীর জন্য দিলাম।
কয়েকদিন পর ঝর্ণা শিরীনের সামনে জায়েদকে বলল, আপনাদের ঘাড়ের ওপর বসে এতদিন খেলাম। এখন তো উপায় করছি। এবার নিজের ভার নিজেকে বহন করার সুযোগ দিন । সেই সঙ্গে আমার ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দিন।

জায়েদ বলল, আরো কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখুন, উনি কি করেন। আর আপনিও ভাবনা চিন্তা করুন । সে কি করবে না করবে তা জানার আমার দরকার নেই। তা ছাড়া তার কোনো আমি আর তার কাছে ফিরে যাব না । মতামত আমি মেনে নেব না। আর আমার ভাবনা চিন্তা করারও কিছু নেই। এ জীবনে
তবু কিন্তু কিছু কথা থেকে যাচ্ছে।

আর মিটমাট হতে পারে না। ঝর্ণা যা বলল, তাই কর। শিরীন বলে উঠল, এর মধ্যে আবার কি কথা থাকতে পারে? ঐ পাষণ্ডের সঙ্গে
জায়েদ বলল, ঠিক আছে, একদিন সময় করে আপনাকে একজন উকিলের কাছে ঘাড়ে বসে খাওয়ার কথা বলছেন? নিয়ে যাব। তারপর ঝর্ণাকে বলল, এখানে আপনার কি এমন অসুবিধে হচ্ছে, যে জন্য অসুবিধে কেন হবে, বরং সুখেই আছি।

শিরীন বলল, তুই এখানেই থাকবি। কোথাও তোর যাওয়া চলবে না। একা মেয়েছেলেকে কেউ সহসা ঘর ভাড়া দেবে না। আর যদিও বা কেউ দেয়, তোর সেখানে একা থাকাও ঠিক হবে না। সেই পাষণ্ডটা তোকে এত সহজে ছেড়ে দেবে বলে চলাফেরা করার সময় খুব সাবধানে থাকবি । মনে করেছিস বুঝি? ঐ রকম ধরণের লোকেরা বড় ডেঞ্জারার্স। রাস্তা-ঘাটে তুই একা রাখলে অন্য কথা । তাই বলে কতদিন তোদের ঘাড়ে বসে খাব? অবশ্য আমাকে পেয়িংগেস্ট হিসাবে শিরীন একটু রাগের সঙ্গে বলল, রোজগার করতে শিখে টাকার গরম দেখাচ্ছিস?

তুই ভুল বুঝচ্ছিস কেন? বিপদের সময় তোদের কাছ থেকে যে উপকার পেয়েছি, দিয়েছেন, এখনো পরগাছার মতো থাকা কি উচিত? চিরকাল সে জন্য কৃতজ্ঞ থাকব। এখন আল্লাহ আমাকে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা কোথাও থাকতে দেব না। শিরীন বলল, ঠিক আছে, তোর যা মনে চায় তাই কর। কিন্তু তোকে একা অন্য এক বছর হতে চলল ঝর্ণা শিরীনদের বাসায় পেয়িংগেস্ট হিসাবে থেকে চাকরি ডিভিশনে এস.এস.সি. পাস করল । করছে এবং নাজনীনকে প্রাইভেট পড়াচ্ছে। নাজনীন ঝর্ণার কাছে প্রাইভেট পড়ে ফার্স্ট পরীক্ষার পর ঝর্ণা প্রতিদিন নাজনীনকে শুধু গ্রামার ও ট্রানশ্লেসান করাতে আসে ।

যে দিন রেজাল্ট বের হল, সেদিনও ঝর্ণা পড়াতে এল। সে অফিসে খবরের কাগজে নাজনীনের রোল নাম্বার দেখে তার রেজাল্ট জেনেছে।
নাজনীন নিজের রুমে আন্টির জন্য অপেক্ষা করছিল। সে ঝর্ণাকে আন্টি বলে ডাকে। ঝর্ণা ঘরে ঢুকতে এগিয়ে এসে প্রথমে সালাম দিয়ে বলল, আন্টি আজ আমাদের রেজাল্ট বেরিয়েছে। আমি ফার্স্ট ডিভিশানে তিনটে লেটার পেয়ে পাশ করেছি। তারপর সে কদমবুসি করল।

ঝর্ণা তার মাথায় হাত ছুঁয়ে চুমো খেয়ে হাসি মুখে বলল, আমি অফিসে পেপার দেখে আগেই জেনেছি।
আন্টি, আজ পড়তে ইচ্ছে করছে না।
বেশ তো, না হয় না পড়লে, তাতে কি? আজ কি আর কেউ পড়াশোনা করতে পারে? আপনি বসুন, আমি আসছি বলে নাজনীন চলে গেল। একটু পরে একটা প্লেটে বেশ কয়েক রকমের মিষ্টি নিয়ে ফিরে এসে টেবিলের উপর রেখে বলল, আম্মা মিষ্টি মুখ করতে বলল।

ঝর্ণা বলল, তা তো করবই । তুমি খাও ৷
একটু আগে আম্মা আমাকে খাইয়েছে।
ঝর্ণা মিষ্টির প্লেটের ঢাকা দেয়া প্লেটে তিন চারটে মিষ্টি তুলে দিয়ে বলল, আম্মা খাইয়েছে এবার আন্টি খাওয়াবে। নাও এগুলো খেয়ে ফেল ।
নাজনীনের খাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও আদব রক্ষার্থে দুটো খেল। তারপর বলল, আজ মামার চিঠি এসেছে। আমার রেজাল্টের খবর জানাতে বলেছেন।

জানেন আন্টি, মামার অসুখ আরো বেড়ে গেছে।
ঝর্ণারও খাওয়া শেষ হয়েছে। এমন সময় মনিরা এসে ঝর্ণাকে সালাম দিল।
সেই প্রথম দিনের পর ছাত্রীর মাকে দীর্ঘ এক বছর পরে তার কাছে আসতে দেখে ঝর্ণা বেশ অবাক হল । সালামের উত্তর দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
মনিরা বলর, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর নাজনীনকে বলল, তুমি প্লেটগুলো নিয়ে যাও। আমি তোমার আন্টির সাথে আলাপ করব ।
নাজনীন চলে যাওয়ার পর ঝর্না বলল, নাজনীন বলছিল, আপনার ভাইয়ের অসুখ আরো বেড়েছে। ওনার কি অসুখ?

লিভার নষ্ট হয়ে গেছে। এখানেই অসুখটা হয়েছিল । তেমন গুরুত্ব দেয় নি । আপনারা সে সময় ট্রিটমেন্ট করাতে বলেন নি?
সাইফুল ছেলেবেলা থেকে বেপরোয়া স্বভাবের। কারো কথা নেয় না। নিজে যা ভাবে তাই করে। আব্বা-আম্মার কথাই নেয় নি, আর আমার কথা শুনবে ।
সাইফুলের নাম শুনে ঝর্ণা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি আরো একটা ভাই আছে?
মনিরা তাকে চমকে উঠতে দেখে বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন বলুন তো? সাইফুলই আমার একমাত্র ভাই ।

ভাইয়ের নাম আরজু বলেছিলেন। যিনি আমাকে নাজনীনকে পড়াবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, তিনি আপনার ও তাই বলুন। আমি মনে করেছিলাম, আপনি সাইফুলকে চেনেন। আরজুর আসল নাম সাইফুল। এই বাড়ি যাদের ওনাদের সাইফুলের মতো একটা ছেলে ছিল। ছেলেটা কলেজে পড়ার সময় মারা যায়। তার নাম ছিল আরজু। সাইফুলকে পেয়ে উনি ও ওনার স্ত্রী ছেলের শোক ভুলে যান এবং সাইফুলকে নিজের ছেলে করে লেখাপড়া করান। ওনারাই সাইফুলের নাম পরিবর্তন করে নিজের ছেলের নামে ডাকতেন।

মনিরার কথা শুনে ঝর্ণার মনে অনুশোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে। অনেক কষ্টে সংবরণ করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব কিছু মনে করবেন না। আপনার ভাই কি না এখনো বিয়ে করেন নি? না। আব্বা-আম্মা কত চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কিছুতেই ও রাজি হয় নি। আপনাদের দেশের বাড়ি কোথায়?

কুড়িগ্রাম জেলার অনন্তপুর গ্রামে ।
শুনে ঝর্ণা আবার চমকে উঠল ।
শিরীনের স্বামীর কাছে তার বন্ধুর হিস্ট্রী শুনে ঝর্ণা যে কথা অনুমান করে সন্দেহের দোলায় দুলছিল, মনিরার কথা শুনে নিশ্চিত হল, আরজুই সাইফুল। একটু আগে সাইফুলের নাম শুনে অনুশোচনার যে ঝড় মনে বইত শুরু করেছিল, তা এখন প্রবল আকার ধারণ করল। চোখে পানি এসে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে চোখ মুছে নিজেকে সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করল । তারপর মাথা তুলে জানা সত্ত্বেও অসুখ কতটা সিরিয়াস তা জানার জন্য জিজ্ঞেস করল, আপনার ভায়ের লিভার নষ্ট হল কি করে?

ঝর্ণার হাবভাব দেখে মনিরার মনে সন্দেহ হল। এখন যেন তাকে হামিদ চেয়ারম্যানের মেয়ে বলে একটু একটু মনে পড়ছে। সন্দেহটা যাঁচাই করার জন্য সাইফুলের সব কথা বলতে আরম্ভ করল। সে কথা আর জিজ্ঞেস করবেন না। সাইফুল পড়তে পড়তে বিলেত চলে যায়। এই বাড়ির মালিক ও ওনার স্ত্রী মারা যাওয়ার খবর পেয়ে ফিরে এসে আমাদের সবাইকে দেশ থেকে নিয়ে আসে। আমাদের আনার পর গুলশানে বাড়ি করে ওখানে একা থাকত।

শুধু অফিস থেকে এখানে খেতে আসত । আব্বা-আম্মা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর একদিন আমাকে বলল, এখানে আমার কিছুতেই মন টিকছে না। আমি আবার বিলেত চলে যাব। ওকে নিষেধ করে কোনো ফল হবে না ভেবে কিছু না বলে চুপ করে রইলাম। তারপর বেশ কয়েকদিন ওর খোঁজ- খবর নেই। অফিসে ফোন করে পাওয়া যায় না। দুপুরে এখানে খেতে আসে, তাও আসে না।

একদিন সন্ধ্যের পর আমি গুলশানের বাড়িতে গেলাম। তখনও সে ফিরে নি। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত দশটার দিকে মাতাল হয়ে টলতে টলতে ফিরল। সাইফুল মদ খাবে, তা আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। প্রচণ্ড বেগে গিয়ে তার গালে একটা কষে চড় মেরে বললাম, তুই ধার্মিক ছেলে হয়ে মদ খাস ? চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে পড়ল । আল্লাহপাক মদকে হারাম করেছেন, তা ভুলে গেছিস?

আমার চড় খেয়ে সাইফুলের দিয়ে পানি বেরিয়ে পড়ল। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে মাথা নিচু করে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বুবু, তুমি আমাকে যত ইচ্ছা মার আর বকাবকি কর, তাতে আমি কিছুমনে করব না। মদ ধরেছি কেন শুনবে? তারপর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, আমি হেরে গেছি বুবু। ঝর্ণা আমার সবকিছু কেড়ে নিয়ে হারিয়ে দিয়েছে। সেই পরাজয়ের গ্ল ভুলে থাকার জন্য প্রথমে দেশ ছাড়লাম, তাতে কাজ না হতে মদ ধরেছি। তবু যে তাকে ভুলতে পারছি না বুবু। আমি ছোটবেলা থেকে যে স্বপ্ন দেখে এসেছি, তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে।

ওর কথা শুনে মনে হল, মদ খেয়ে মাতলামি করছে। তাই আরো রেগে গিয়ে তার দু’গালে বেশ জোরে কয়েকটা চড় মেরে বললাম, মদ খেয়ে ঘরে এসে মাতলামি করা হচ্ছে। সাইফুল মারকে গ্রাহ্য না করে আমার দু’পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বুবু তুমি আমাকে আরো মার। ঝর্ণা যে হঠাৎ বিয়ে করে ফেলবে, তা কল্পনাও করতে পারি নি। ঘুণাক্ষরে যদি বুঝতে পারতাম, তা হলে যেমন করে হোক তার বিয়ে বন্ধ করে দিতাম। সব থেকে বড় কথা কি জান বুবু, যার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছে, সে ছেলেটা ভালো নয় ।

ওর কথা শুনে মনে হল, মদ খেলেও মাতলামি করছে না। বললাম, ঝর্ণা কে?
বলল, তোমার মনে নেই বুবু, আমাদের গ্রামের হামিদ চেয়ারম্যানের মেয়ের কথা? ক্লাস টেনে পড়ার সময় তাকে চিঠি দিয়েছিলাম বলে সেই চিঠি হেডস্যারের কাছে দিয়ে আমাকে মার খাইয়েছিল? সেজন্যে আমি পড়া ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় পালিয়ে আসি। সেই ঝর্ণা ভার্সিটিতে পড়ত। তিন বছরের বেশি হয়ে গেল আমিনের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে। ওকে ভুলে যাওয়ার জন্য মদ খাই। তবু যে ভুলতে পারছি না। কি করলে ওকে ভুলতে পারব, তুমি বলে দাও না বুবু । আমি যে আর পারছি না ।

ওর এই পরিণতির কারণ জানতে পেরে আমারও খুব দুঃখ হল। ভাবলাম, সাইফুল ছোটবেলা থেকে ধর্মের আইন মেনে চলে। একটু বড় হতে গ্রামের কেউ অন্যায় কিছু করে পার পেত না। মাতবররা সাইফুলকে ছাড়া বিচার করত না । গ্রামের ছোট-বড় সবাই সাইফুলকে ভালবাসত। সেই সাইফুল ঝর্ণাকে না পেয়ে মদ খাচ্ছে? বললাম, কাউকে ভালবাসা পাপ নয় । তুই ঝর্ণাকে ভালবাসিস, সেটা ভালো কথা ৷

কিন্তু তাই বলে তাকে না পেয়ে আল্লাহর হুকুমের বরখেলাপ কাজ করছিস কেন? একটা মেয়ের জন্য তোর মতো শিক্ষিত ছেলের এটা করা উচিত হয়েছে? অনেক সময় অনেক জ্ঞানী-গুণীজনও সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে শয়তানের প্ররোচনায় অন্যায় করে ফেলেন। তোরও তাই হয়েছে। তুই আমাকে যে কথা জিজ্ঞেস করলি, তার সমাধান বলছি, তুই একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তা হলে দেখবি, প্রথম দিকে একটু খারাপ লাগলেও ধীরে ধীরে ঝর্ণাকে ভুলতে পারবি।

এই কথা শোনার পর সাইফুল বলল, তাও আমি চিন্তা করে দেখেছি। কিন্তু অন্য কোনো মেয়ের কথা ভাবলে ঝর্ণার স্মৃতি আমাকে আরো অস্থির করে তুলে। তুমি আমাকে বিয়ের কথা বলো না বুবু। তার চেয়ে আমার খাবারের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিও। তারপর সে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল ।
আমি তাকে সেদিন অনেক বুঝিয়ে এই বাসায় ফিরে এলাম। কিন্তু কিছুতেই মদ ছাড়ল না। বরং এরপর থেকে আরো বেশি মদ খেতে লাগল ।

জানেন, সাইফুল ঝর্ণাকে এখনো এত বালবাসে তা আপনাকে বলে বুঝাতে পারব না। গুলশানে যে বাড়িটা করেছে, সেটার নাম দিয়েছে ঝর্ণালজ। আর কত রং বেরং এর স্যালওয়ার, কামিজ, ওড়না, শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ এবং কত রকমের প্রসাধনী কিনে ঘরে সাজিয়ে রেখেছে, তার ইয়ত্তা নেই। দেখলে মনে হবে সে সুখী দাম্পত্য জীবন কাটাচ্ছে। শুধু গুলশানের বাড়িতে এ সব করে নি, এখানে যে রুমে থাকত, সে রুমেও ঐ সব জিনিস আছে। সমস্ত জিনিস কার জন্য কিনে ঘর ভরিয়ে রেখেছিস?

একদিন আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁরে তুই বিয়ে করবি না বলিস, তবে আবার এ
তখন সাইফুল বলল, জান বুবু, ঝর্ণাকে এই সমস্ত জিনিস ব্যবহার করতে দেখেছি। তাই কিনে রেখেছি। তার পছন্দ মতো জিনিস দেখে আমি মনে খুব শান্তি পাই।

আলমারীতে ও ওয়ার্ডড্রবে যে কত জামা-কাপড় কিনে রেখেছে, তা যদি দেখতেন, তা হলে আপনি তাকে পাগল ছাড়া আর কিছু ভাবতেন না ।
ঝর্ণা মনিরার মুখে তার প্রতি সাইফুলের ভালবাসার কথা শুনতে শুনতে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। বারবার তার মনে হতে লাগল, যে সাইফুলকে স্কুল জীবন থেকে সব থেকে বেশি ঘৃণা করে এসেছে, সেই সাইফুল তাকে এত ভালবাসে?

এই দুনিয়ায় কোনো ছেলে কি কোনো মেয়েকে এত বালবাসতে পারে? তার তখন মনে হল, সাইফুলের মনে এত কষ্ট দিয়েছি বলে আল্লাহ আমার অবস্থা এইরকম করলেন । এখন সাইফুল যদি জানতে পারে, আমিনের সঙ্গে আমার ডির্ভোস হয়ে গেছে, আমি তার অফিসে চাকরি করছি এবং তার ভাগ্নিকে পড়াচ্ছি, তা হলে কি করবে? আমাকে সে কি গ্রহণ করবে? আর সে গ্রহণ করতে চাইলে আমি কোন মুখে তা স্বীকার করব? তৎক্ষণাৎ ঝর্ণার বিয়ের পরে সাইফুল যে কথা একদিন বলে এসেছিল, তা মনে পড়ল- ‘তোমার বিয়ে হয়ে গেছে জেনেও আজীবন তোমার অপেক্ষায় থাকব। তোমাকে না পেলেও যতদিন বাঁচব ততদিন তোমার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকব।’

অনুশোচনায় ঝর্ণার অন্তর ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। সে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে থাকতে পারল না। নিচু হয়ে হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে সামলাবার চেষ্টা করল । মনিরা কথা বলতে বলতে ঝর্ণার মুখের অবস্থা মাঝে মাঝে করুণ হতে দেখেছে। এখন তাকে ঐভাবে থাকতে দেখে সন্দেহটা দৃঢ় হল। ভাবল, মেয়েটাকে প্রথম দিন দেখে চেনা চেনা লেগেছিল ।

আজ আবার সাইফুলের কথা শুনে এরকম করছে কেন? তা হলে কি এই ঝর্ণা? নাম জিজ্ঞেস করব না কি? আবার ভাবল, তা কি করে হয়? তার তো বিয়ে হয়ে গেছে। হয়তো ওনার প্রেসার আছে। সাইফুলের কথা শুনে দুঃখ পেয়ে প্রেসারের গোলমাল শুরু হয়েছে। জিজ্ঞেস করল, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন?

ঝর্ণা আরো কিছুক্ষণ ঐভাবে থেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে বসে বলল, হ্যাঁ, মানে হঠাৎ মাথাটা যেন ঘুরে গেল । তারপর দাঁড়িয়ে বলল, আজ আসি আপা । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে যান। মাথা ঘুরছে বললেন না?

এখন একটু সুস্থ বোধ করছি। আসি বলে সালাম বিনিময়ে করে চলে গেল। মনিরার মনে সন্দেহটা থেকেই গেল। ভেবে রাখল, কয়েকদিন যাক, তারপর চালাকি করে ওর পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সব কিছু জানা যাবে ।

বাসায় ফিরে ঝর্ণা সাইফুলকে নিয়ে অনেক চিন্তা করল। তার কথা যত ভাবে তত চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। চিন্তায় চিন্তায় দু’দিন অফিসেও গেল না এবং নাজনীনকে পড়াতেও গেল না ।

প্রথম দিন শিরীন ঝর্ণার শুকনো বেদনাভরা মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে তোর অসুখবিসুখ করেছে নাকি? তোকে ঐরকম দেখাচ্ছে কেন? তার উত্তরে ঝর্ণা বলেছিল, মাথা যেন কেমন করছে। তারপর তাকে দু’দিন ঘরে থাকতে দেখে দুপুরে খাওয়ার পর বলল, তোর কি হয়েছে বলতো? ভালো করে খাচ্ছিস না, অফিস কামাই করছিস, ছাত্রী পড়াতেও যাচ্ছিস না। অসুখবিসুখ হলে কোনো ডাক্তারের কাছে যা। তারপর স্বামীর কথা বলে বলল, তাকেও তো বলতে পারিস?

অসুখবিসুখ কিছু হলে তাই করতাম।
তা হলে কি হয়েছে বলবি তো? তাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, তা যদি না হয়, তবে কি কোনো প্রবলেমে পড়েছিস? এই কথা বলার পরও ঝর্ণার কাছ থেকে উত্তর না পেয়ে গায়ে একটা হাত রেখে বলল, যদি কোনো প্রবলেমে পড়ে থাকিস, তা হলে বল, সেটা সলভ করার চেষ্টা করব।
ঝর্ণা শিরীনের দিকে তাকিয়ে কি ভাবে সাইফুলের কথা বলবে, চিন্তা করতে করতে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল ।

শিরীন তাই দেখে আতঙ্কিত হয়ে বলল, কিরে আমিন তোর খোঁজ পেয়ে শাসিয়েছে না কি? আমিনের সঙ্গে মাস ছয়েক আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে।
ঝর্ণা না বলে বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

শিরীন কিছু বুঝতে না পেরে বেশ অবাক হয়ে বলল, কি হয়েছে বল না? আমাকে বলতে তোর বাধা কোথায়? তুই কি আমাকে বিশ্বাস করিস না?
ঝর্ণা সংযত হয়ে বলল, তুই যা ভাবছিস, সে সব কিছু নয়। ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক । আর সেটার জন্য আমিই দায়ী। আমার ভাগ্যে বুঝি কোনো দিন সুখশান্তি আসবে না। চিরকাল দুঃখের সাগরে ভেসে বেড়াতে হবে ।

শিরীন বলল, সুখ-দুঃখ নিয়েই মানুষের জীবন। আমিনের সঙ্গে দৈব দুর্ঘটনায় যা হয়েছিল, ডিভোর্সের মধ্যে দিয়ে তার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তুই ইচ্ছা করলে তোর বাবা-মার কাছে ফিরে গিয়ে তাদেরকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে পারিস। তারপর ওনারা আবার ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে সুখী করার চেষ্টা করবেন ।
ঝর্ণা মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, মানুষ যা ভাবে তা যদি হত, তা হলে পৃথিবীতে দুঃখ বলে কিছু থাকত না।

বাবা-মার কাছে কিছুতেই আমি ফিরে যেতে পারব না। নিজের কথা চিন্তা করে আমার এই অবস্থা হয় নি। আমার এই অবস্থা কেন, হয়েছে বললে, তুই যেমন অবাক হবি তেমনি দুঃখও পাবি ।
শিরীন বলল, আমার যাই হোক না কেন, তুই বল ।
ঝর্ণা তখন সেই স্কুল জীবন থেকে গত দু’দিন আগে পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে সব খুলে বলল ।

শিরীন শুনে সত্যি সত্যি যেমন অবাক হল তেমনি দুঃখও পেল। বলল, এরকম একতরফা প্রেম কাহিনী কখনো শুনি নি। তুই কি করবি ভেবে কিছু ঠিক করতে পেরেছিস? না, এখনো ভেবে কিছু সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি নি। তুই বল না, আমার কি করা উচিত? চাকরি ছেড়ে দেব?

আমার কথা যদি মেনে নিস, তা হলে বলব, সাইফুলের এই পরিণতির জন্য যখন তুই দায়ী তখন তাকে বাঁচানোর জন্য তোরই এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তোকে সে ফিরিয়ে দেবে না। বিয়ের পর তোকে তো বলেছিল, ‘তোর জন্য সে চিরকাল অপেক্ষা করবে। তোর জন্যে চিরকাল তার মনের দুয়ার খোলা থাকবে।’ আর এখন চাকরি ছাড়িস না। সেটা যখন ইচ্ছা ছাড়তে পারবি। আরো ভাবনাচিন্তা করে দেখ।

আমার মনও তাই বলে। কিন্তু আমি কোন মুখে তার কাছে গিয়ে দাড়াব। কি বলে তোমাকে ভালবাসি? এত নিলর্জ্জ হব কি করে? তার কাছে ক্ষমা চেয়ে বলব, আমার ভুল ভেঙ্গেছে, এখন তোমার মতো আমিও এত চিন্তা করছিস কেন? তুই তো বললি, বিলেতে সে অসুখে ভুগছে। তোর ছাত্রীর কাছ থেকে তার ঠিকানা নিয়ে সাইফুলকে চিঠিতে তোর বর্তমান অবস্থার কথা জানা। উত্তরে কি বলে দেখ।

তারপর যা কিছু করার করবি। সে কঠিন অসুখে ভুগছে। কঠিন অসুখের সময় সব মানুষই অতি প্রিয়জনকে পেলে বাঁচার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠে। আমার মনে হয়, চিঠি পেয়ে সে নিজেই তোর কাছে ছুটে আসবে। এখন আমার কথা শোন, ভেঙ্গে না পড়ে মনকে শক্ত করে আল্লাহর কাছে সাহায্য চা। আর কাজকর্ম কিভাবে তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করবি। ঠিকমত করে যা। সাইফুলকে চিঠি দিয়ে অপেক্ষা কর।

ততদিন তুইও চিন্তা কর করতে পারছি না । তুই অবশ্য ভালো কথাই বলেছিস ; কিন্তু আমি কিভাবে কি করবো চিন্তা করে ঠিক একটা কথা বুঝতে পারছিস না কেন? সাইফুলের সবকিছু জেনে তোর মনে বে অনুশোচনার ঝড় বইছে, তার কারণ তুইও এখন তাকে ভালবেসে ফেলেছিস? আল্লাহ না করুক, সত্যি সত্যি তার যদি কিছু হয়ে যায়, তা হলে তুই নিজেকে কি বলে বোধ দিবি? তখন আর অনুশোচনা করেও কোনো ফল হবে না। এখনও সময় আছে, যা বললাম তাই কর। তারপর তোর ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

একখাটা কথা জেনে রাখ, প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিজেদের মধ্যে ক্ষমা চাওয়া-চাউয়ি করতে দ্বিধা থাকা উচিত না। আর একটা জিনিস তোর বোঝা উচিত, তুই তাকে এখন ভালবাসিস বলে কাঁদছিস, নচেৎ তার এই পরিণতি দেখে তোর তো আনন্দ পাওয়ার কথা ।
ঝর্ণা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, তুই ঠিক বলেছিস। তোর কথামতো আগে · একটা চিঠি দেব; তারপর আমার তকদির আমাকে দিয়ে যা করাবে তাই করব।

পরের দিন ঝর্ণা সিকলীভের দরখাস্ত লিখে নিয়ে অফিসে গেল। ফেরার পথে নাজনীনকে পড়াতে গিয়ে জানল, তার আম্মা মীরপুর মাজারে গেছে ।
জিজ্ঞেস করল, তোমার মামাকে চিঠি দিয়েছ? আজ ঝর্ণার কেবল সাইফুলের কথা মনে পড়তে লাগল । এক সময় নাজনীনকে
হ্যাঁ দিয়েছি। সেই সঙ্গে তাড়াতাড়ি ফিরে আসার জন্য টেলেক্সও করেছি। তোমার মামার ঠিকানাটা একটা কাগজে লিখে দাওতো।

লিখে পাতাটা ছিঁড়ে আন্টির হাতে দিল । নাজনীন টেবিলের ড্রয়ার খুলে মামার চিঠিটা বের করে খাতার পাতায় ঠিকানা
ঝর্ণা ঠিকানাটায় একবার চোখ বুলিয়ে ভাঁজ করে ভ্যানিটি ব্যাগে রেখে বলল, আজ পড়াতে ভালো লাগছে না, তোমাদের বাসাটা একটু ঘুরে দেখি চল ।

নাজনীন আন্টিকে সঙ্গে করে সব ঘর দেখিয়ে দোতালায় মামার রুমে নিয়ে গেল।
দরজা খুলে ঢুকে ঝর্ণা রুমের চারদিকে একবার তাকিয়ে আশ্চার্য হয়ে স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। কি সুন্দর ভাবে সাজান রুমটা । এক সাইডে ডবল বেডের খাট। ঝর্ণার মনে হল সাইফুল ছাড়া আর কেউ এই খাটে ঘুমায় না। সে দীর্ঘ দিন নেই, তবু যেন কেউ প্রতিদিন বিছানাটা ঝেড়ে ঠিকঠাক করে রেখেছে। অন্য তিন সাইডে আলমারী, বুক কেস, ওয়ার্ডড্রব ও ড্রেসিং টেবিল রয়েছে।

সেগুলো যে প্রতিদিন ঝাড়ামুছা করা হয় তা বুঝতে পারল। ড্রেসিং টেবিলের ছোট থাকগুলো টানা গ্লাস সিস্টেম। থাকগুলোতে কত রকমের দেশী- বিদেশী প্রসাধনী। সেগুলোর প্রায় সব ঝর্ণার পছন্দ। টেবিলের উপর সাইফুলের চারটে ফটো পাশাপাশি দাঁড় করান রয়েছে। একটা স্কুলে পড়ার সময়কার, একগাদা বই হাতে করে তোলা। দ্বিতীয়টায় সাইফুল লুংগী ও গেঞ্জী পরে রিক্সা চালাচ্ছে।

তৃতীয়টা ভার্সিটির আর্টস বিল্ডিংয়ের সামনে সে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। চতুর্থটা একজনকে কুংফু শেখাচ্ছে। ফটোতে সাইফুলকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে দেখে ঝর্ণা ভাবল, তাকে দেখলে ঘৃণা হত বলে তার এই সুন্দর চেহারা এতদিন লক্ষ্য করে নি। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে আরো আশ্চর্য হয়ে গেল। চারপাশের দেওয়ালে চারটে বড় অয়েল পেন্টিং রয়েছে। প্রত্যেকটাতে পাহাড়ী ঝর্ণার দৃশ্য। আর প্রত্যেকটার নিচে আলাদা কাগজে কিছু হাতে লিখে গাম দিয়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে। ঝর্ণা এগিয়ে গিয়ে পড়তে লাগল ।

(১) ঝর্ণা, তুমি এই পাহাড়ী ঝর্ণার মত চঞ্চল । তোমার চঞ্চলতা আমাকে বড় মুগ্ধ করে।
(২) ঝর্ণা, তুমি ঝর্ণার মত সর্বদা আমার হৃদয়ে বয়ে চলেছ। যার শব্দ আমি অহরহ শুনে তৃপ্তি পাই ।
(৩) ঝর্ণা, তুমি আমার জীবনের স্বপ্ন। তোমাকে নিয়ে এই রকম ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে বলব, সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টি এই ঝর্ণার চেয়ে শত শত গুণ বেশি সুন্দরী তুমি; তোমাকে আমি আমার সমস্ত সত্ত্বা দিয়ে ভালবাসি।’

(৪) ঝর্ণা, তোমাকে পাব কিনা জানি না, তবে চিরকাল তোমার স্মৃতি এই ঝর্ণার স্রোতের মতো আমার হৃদয়ের শিরা উপশীরায় রক্তের সঙ্গে আমৃত্যু বইতে থাকবে।

লেখাগুলো পড়ে ঝর্ণার মাথা ঘুরতে লাগল। কোনো রকমে টলতে টলতে টেবিলের কাছে এসে সাইফুলের ফটোগুলোতে একবার হাত বুলিয়ে মুর্ছা যেয়ে মেঝেয় পড়ে গেল ।

নাজনীন আন্টিকে আসা অব্দি তার মন খারাপ দেখেছে এবং এই ঘরে ঢোকার পর থেকে তার মুখের চেহারা আরো খারাপ হতে লক্ষ্য করেছে। এখন পড়ে যেতে তাড়াতাড়ি তার কাছে এসে বসে কয়েকবার আন্টি বলে ডাকল । সাড়া না পেয়ে দু’জন কাজের মেয়েকে ডেকে ধরাধরি করে মামার খাটে শুইয়ে দিল। তাদের একজনকে চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিতে বলে সে ফ্যান ছেড়ে দিল।
কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে ঝর্ণার জ্ঞান ফিরল ।

নাজনীন আন্টিকে চোখ খুলতে দেখে ভয়ার্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, এখন কেমন বোধ করছেন?
ঝর্ণা জ্ঞান ফিরে পেয়ে সাইফুলের খাটে নিজেকে শুয়ে থাকতে দেখে হৃদয়ে যেন কি রকম একটা শান্তি অনুভব করল। ভাবল, আল্লাহ কি আমাকে আবার এই বিছানায় শোবার ভাগ্য করবেন? নাজনীনের কথাশুনে উঠে বসে বলল, মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠতে সময় চিন্তা করল, ছি ছি, নাজনীন কি ভাবছে কি জানি । পড়ে গেলাম। এখন ভালো লাগছে। চল, আমরা এ ঘর থেকে যাই।

বেরিয়ে আসার আসছি বলে সে বেরিয়ে গেল নিজের রুমে এসে নাজনীন বলল, আপনি আরো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন। আমি ততক্ষণ মনিরা ফিরেছে। মেয়ের মুখে ঝর্ণার কথা শুনে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, এটা খেয়ে নিন, সুস্থ বোধ করবেন।
মাজারে গিয়েছিলেন?

ঝর্ণা দুধটা খেয়ে প্রসঙ্গ এড়াবার জন্য বলল, নাজনীনের কাছে শুনলাম, আপনি মনিরা বলল, হ্যাঁ। সাইফুল যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে এবং তার সুস্থ্যতার জন্য মীরপুরের ও হাইকোর্টের মাজারে মানত করে এলাম ।

ঝর্ণা বলল, হাদিসে পড়েছি, কোনো অলি আল্লাহর মাজার জিয়ারত করা যায়েজ হলেও সেখানে মানত করা, আগরবাতি এবং টাকা-পয়সা দেয়া নাযায়েজ। হাদিসে আছে, আল্লাহর রাসূল (দঃ) বলিয়াছেন, ‘তোমাদের কারো কিছু চাওয়ার দরকার হলে ব্যতিরেকে কেউ কিছু করতে পারে না।’ সরাসরি আল্লাহপাকের কাছে চাইবে। তিনি সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তাঁর ইচ্ছা কখনো এমন কাজ করব না । মনিরা বলল, আল্লাহ আমাকে মাফ করুন। আমি না জেনে করে ফেলেছি। আর ঝর্ণা তারপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এল ।

ঘরে গেল কি করে? ঝর্ণা চলে যাওয়ার পর মনিরা মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, তোর আন্টি সাইফুলের নাজনীন বলল, আজ আসার পর থেকে আন্টির মনটা খারাপ দেখলাম। পড়াতে ভালো লাগছে না বলে আমাদের বাসাটা ঘুরে দেখতে চাইলেন। সব ঘর দেখার পর মামার ঘরে ঢুকে চারদিকে তাকিয়ে কেমন যেন হয়ে গেলেন। তারপর মামার ফটোতে একবার হাত বুলিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন । আমার কি মনে হয় জান আম্মা, আন্টি বোধ হয় সেই মেয়ে, যাকে মামা ভালবাসে ।

মনিরাও তাই আন্দাজ করেছে। তবু জিজ্ঞেস করল, কি করে বুঝলি?
নাজনীন এখন কলেজে পড়ছে। সব কিছু বুঝবার বয়সও হয়েছে। মায়ের কথা শুনে বলল, আজকের ঘটনা থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। তা ছাড়া মামার কথা আন্টি প্রায় জিজ্ঞেস করে ।

তোর আন্টির নাম জানিস?
ঝর্ণা। তাতেই তো আমার ধারণা দৃঢ় হয়েছে।
মনিরা মেয়ের কথা শুনে চমকে উঠে ভাবল, তা হলে কি স্বামীর সঙ্গে ঝর্ণার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? দু’দিন আগে সাইফুলের কথা শোনার পর ঝর্ণার হাবভাব লক্ষ্য করে যে সন্দেহ হয়েছিল, আজকের ঘটনা শুনে সেই সন্দেহ আরো দৃঢ় হল। ভেবে রাখল, ঝর্ণাকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে না। সাইফুল ফিরে এলে সত্যি-মিথ্যা যাচাই করে যা হয় করা যাবে।

নাজনীনকে বলল, তুই তোর আন্টির সঙ্গে এমন ব্যবহার করবি, যেন তুই তার আসল পরিচয় জানিস না ।
ঐদিন বাসায় ফিরে এলে শিরীন তার মুখের করুণ অবস্থা দেখে জিসে করল, কিরে, তোর কি হয়েছে? তোর মুখ অত শুকনো কেন ?
ঝর্ণা ছলছল চোখে আজকের ঘটনা বলে বলল, জানিস, আমি সাইফুলকে যত জানতে পারছি তত ওকে ভালবেসে ফেলছি। ওর ভালবাসার গভীরত্বের কোনো পাচ্ছি না। সে কথা মনে হলে আমার অন্তরটা যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।

শিরীন বলল, আল্লাহ তোকে সহ্য করার ক্ষমতা দিক। তুই কি সাইফুলকে চিঠি দিয়েছিস?
ঠিকানা জানতাম না। আজ নাজনীনের কাছ থেকে এনেছি।
আজ চিঠিটা রাতে লিখে কাল পোষ্ট করে দিবি।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর ঝর্ণা কাগজ কলম নিয়ে চিঠি লিখতে বসল ।

পত্রের প্রারম্ভে তোমাকে কি বলে সম্বোধন করব, তা ঠিক করতে না পেরে জায়গাটা ফাঁকা রাখলাম। আমি তোমাকে পত্র দেব, এটা যেমন তুমি ভাবতে পারছ না, তেমনি আমিও কোনো দিন ভাবি নি। কিন্তু মানুষ নিয়তির কাছে বন্দি। নিয়তি কখন মানুষকে দিয়ে কি করাবে তা কেউ জানে না। আমিও মানুষ। তাই আমাকে নিয়ে নিয়তি যে খেলা খেলে চলেছে তা সহ্য করতে পারছি না। স্কুল জীবন থেকে তুমি আমাকে যত না ভালবেসেছ, তার চেয়ে অনেক বেশি আমি তোমাকে ঘৃণা করেছি।

তুমি আমাকে চিনলেও আমি চিনি নি। আমিনের কপট ভালবাসায় পড়ে তোমাকে জব্দ করার জন্য তার ফাঁদে পা দিই। বিয়ের মাস খানেক পর তার আসল রূপ দেখে ভয়ে শিউরে উঠি। কিন্তু তখন আমার আর কিছু করার উপায় ছিল না বলে, ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সামাল দেয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ভাগ্য আমার প্রতি বিরূপ। তাই দুটো বছর আমিনের অকথ্য অত্যাচার সহ্য করে যখন সহ্যের বাইরে চলে গেল তখন পালিয়ে এসে এই ঠিকানায় এক বান্ধবীর বাসায় উঠি। বান্ধবীর স্বামী ডিভোর্সের ব্যবস্থা করে দেন।

তারপর ওনারই চেষ্টায় চাকরি করে ওনাদের কাছে আছি। ওনাদের কাছে থাকতে কিতে আল্লাহপাক তাঁর অপার করুনায় আমাকে হেদায়েৎ দান করে একদিকে যেমন ধন্য করেছেন, তেমনি তোমার সবকিছু জানিয়ে আমাকে দুঃখের ও অনুশোচনার সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছেন। তুমি আমার বিয়ের পর আমাকে যে কথা বলেছিলে, সেই কথার উপর ভসা করে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়ে এই চিঠি লিখলাম ।

আমার জন্য তোমার এই পরিণতি হয়েছে জানতে পেরে পুরানা পল্টনের বাড়িতে তোমার রুমে একদিন গিয়ে যা দেখলাম, তাতে করে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে সাহস হচ্ছে না। কারণ যদি তুমি আমাকে ক্ষমা করে কাছে পেতে চাও, তা হলে কোন মুখে, কেমন করে এই অপবিত্র দেহ নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াব? আমার রকারণে তুমি চিরকুমার থাকবে এবং আমার স্মৃতির যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মদ খেয়ে লিভার পচিয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছ জানতে পেরে আমার অন্তর অনুশোচনার আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

জানি না কতদিন এই আগুন সহ্য করতে পারব। বেশি কিছু লিখে তোমার ক্ষত বিক্ষত হৃদয়কে আরো ক্ষত বিক্ষত করতে চাই না। শুধু আর একটা কথা বলে শেষ করছি, ঘৃণা করে জব্দ করতে গিয়ে তোমাকে যতটা শাস্তি দিয়েছি, আল্লাহপাক তার শতশতগুণ বেশি দৈহিক ও মানসিক শাস্তি আমাকে দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। তোমার ভালবাসার কসম দিয়ে বলছি, তুমি আমাকে যা শাস্তি দিয়ে তৃপ্তি পাও তাই দিও, তবু মদ ছেড়ে দাও এবং যত শিঘ্র পার দেশে ফিরে এস। আল্লাহর কাছে তোমার সহিসালামতের এবং তোমাকে হেদায়েৎ করে দেয়ার জন্য দোয়া করে শেষ করছি। আল্লাহ্ হাফেজ।

ইতি
তোমার ভালবাসার পাত্রী
অপবিত্রা : ঝর্ণা ।

পরের দিন অফিসে যাওয়ার পথে চিঠিটা পোষ্ট করল। বিকেলে নাজনীনকে পড়াতেও গেল ।নাজনীনের মায়ের কথামতো এমনভাবে আন্টির সঙ্গে ব্যবহার করল, যেন গতকালের ঘটনা সে জানে না।
নাজনীনের ব্যবহার দেখে ঝর্ণা স্বস্থি পেল। তবু ভাবল, গতকালের ঘটনায় এরা কি তা হলে কিছু বুঝতে পারে নি? চিন্তাটা দূর করে দিয়ে নাজনীনকে ভালভাবে পড়াতে লাগল ।

মাস তিনেক পর একদিন পড়ার সময় নাজনীন ঝর্ণাকে বলল, জানেন আন্টি, আগামীকাল মামা আসছে। কথাটা বলে সে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তার চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় কি না দেখার জন্য ।
কথাটা শুনে ঝর্ণার মুখটা মুহূর্তের জন্য আনন্দোজ্জল হয়ে পরক্ষণে গভীর চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। যে পড়াটা বোঝাচ্ছিল সেটার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল ।

নাজনীন যা বোঝার বুঝে গেল। বলল, আন্টি চুপ করে আছেন কেন? শরীর খারাপ লাগলে আজ পড়া বন্ধ থাক ।
ঝর্ণা নাজনীনের কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে বলল, না, তেমন কিছু হয় নি, তুমি পড়।
পরের দিন ঝর্ণা অফিসে গিয়ে শুনল, আজ এগারটার ফ্লাইটে সাহেব আসছেন। তিনি অসুস্থ। তাই ছুটির পর অফিসের সব স্টাফ সাহেবকে দেখতে বাসায় যাবে।

ঝর্ণা চিন্তা করতে লাগল সেও যাবে কিনা। এক মন বলল, তোর চিঠির উত্তর দেয় নি। তাতেই বুঝতে পারছিস না কেন, সে তোকে গ্রহণ করবে না। তার যা না। আর এক মন বলল, যদি না যাস, তা হলে অফিস স্টাফরা তোকে কি ভাববে, সে সে কথা ভেবে দেখ। তুইতো বোরখা পরে যাবি, তোকে সে চিনতে পারবে না। সবাইয়ের সঙ্গে তোর যাওয়া উচিত। গিয়েই দেখ না কি ঘটে?

মনিরা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি করে এয়ারপোর্টে গেল। সাইফুলকে দেখে তারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। সে খুব রোগা হয়ে গেছে। চোখ-মুখ বসে যাওয়ায় তাকে চেনাই যায় না। সাইফুল তাদেরকে প্রবোধ দিতে দিতে গাড়িতে উঠল। বুবু ও ভাগ্নির শত আকুতি-মিনতি স্বত্ত্বেও সাইফুল পুরানা পল্টনের উঠে গুলশানের বাড়িতে উঠল। সেই বাড়ি দেখাশুনার জন্য দু’জন কাজের লোক ও একজন দারোয়ান সাইফুল রেখে গিয়েছিল।

দারোয়ান সাহেবের গাড়ি দেখে গেট খুলে দিয়ে সালাম দিল। কাজের লোক দুটো বাসার সামনের ফাঁকা জায়গায় কি কাজ করছিল, তারাও এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে গাড়ির পিছন পিছন এল ।
খাওয়া-দাওয়ার পর মনিরা সাইফুলকে তার অসুখের ও চিকিৎসা করার কথা জিজ্ঞেস করল।

সাইফুল বলল, সেখানে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। ডাক্তাররা বলেছে, আগে মদ ছাড়তে হবে তারপর লিভার যতটা নষ্ট হয়েছে, তা কেটে বাদ দিতে হবে। তবে এটা খুব রিস্কি। বাঁচতে পারি নাও পারি । কোনোটাই হয় নি।
মনিরা বলল, আমি এখানকার বড় বড় ডাক্তারদের নিয়ে বোর্ড তৈরি করে তোর চিকিৎসা করাব।

সাইফুল ম্লান হেসে বলল, করার সময় পার হয়ে গেছে। তা ছাড়া সেখানকার ডাক্তাররা যা পারে নি, তখন আর এখানকার ডাক্তাররা কি পারবে? এদের দৌড় কত, তা আমার জানা আছে।
তুই সারা জীবন নিজের গঁয়ে চলেছিস। এখন আর সেই গঁয়ে কি করে চলিস দেখব। আমার মনে যা আছে তা করবই সাইফুল আর কিছু না বলে চুপ করে রইল ।

মনিরা সাইফুলকে বিশ্রাম করতে বলে নাজনীনকে নিয়ে বেরিয়ে গেল ।
সাইফুল শুয়ে শুয়ে চিন্তা করতে লাগল, ঝর্ণা পুরানা পল্টনের বাড়িতে গিয়েছিল চিঠিতে লিখেছে। সে আমার ঐ বাড়ির খোঁজ পেল কি করে? চিঠিতে যে ঠিকানা দিয়েছিল, সেটা তো বন্ধু জায়েদের। জায়েদকে একবার ফোন করতে হবে। সেখানে এখনো আছে কিনা? যদি না থাকে, তা হলে তার খোঁজ পাব কি করে? ঐ বাড়িতে এসেছিল যখন, তখন নিশ্চয় তাকে বুবু ও নাজনীন চেনে।

বুবুকে তো তার কথা জিজ্ঞেস করতে পারব না, নাজনীনকে জিজ্ঞেস করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে মদ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বুবুর চিঠি ও টেলেক্স পেয়ে সাইফুল ফিরে আসে নি। ঝর্ণার চিঠি পেয়ে এসেছে। সেই সময় বেশি অসুস্থ থাকায় আসতে দেরি হয়েছে। বিকেল চারটের সময় নাজনীনের ডাকে সাইফুলের ঘুম ভেঙ্গে গেল। নাজনীন বলল, অফিসের সব লোকজন তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ওনারা ড্রইংরুমে অক্ষো করছেন।

সাইফুল বলর, তুই যা, আমি তৈরি হয়ে আসছি।
নাজনীন ফিরে গিয়ে আম্মাকে অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে বলে তাকে সাহায্য করার জন্য তার কাছে রইল। নাজনীন তখন ভাবছে, আন্টিও এসেছে দেখলাম । আন্টিকে দেখে মামা কি করবেন এবং মামাকে দেখে আন্টি কি করবেন কি জানি।
কিছুক্ষণের মধ্যে সাইফুল ড্রইংরুমে এল।
তাকে দেখে অফিস স্টাফরা দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

সাইফুল সালামের উত্তর দিয়ে সবাইকে বসতে বলে নিজেও বসল। তাকে দেখে সকলের চোখে পানি এসে গেল ।
আপ্যায়নের পর সবাইকে বিদায় দিল । তাই দেখে সাইফুল তাদেরকে প্রবোধ দিয়ে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করল। তারপর ঝর্ণা সকলের সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে হতবাক হয়ে গেছে। অনেকখানি জায়গার মাঝখানে খুব সুন্দর মডেলের দোতলা বাড়ি।

গেটের উপরে বড় বড় অক্ষরে ‘ঝর্ণালজ’ লেখা। তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছে সকলের পিছনে এসে ড্রইংরুমের এক কোণের দিকে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ সাইফুলকে দেখছিল। তার চেহারার অবস্থা দেখে ঝর্ণা চোখের পানিতে বুক ভাসাচ্ছিল। বোরখা পরা ছিল বলে কেউ তা দেখতে পায় নি। সাইফুল বোরখা পরা ঝর্ণাকে দেখেছে।

প্রথমে সে মনে করেছিল, বুবুর জানাশোনা কোনো পর্দানশীন মহিলা তাকে দেখতে এসছে। সকলে চলে যাওয়ার পরও মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, কে আপনি? এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? বসুন। তবু তাকে চুপ করে সেই অবস্থায় থাকতে দেখে সাইফুল দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের রুমে চলে গেল।

নাজনীন কিছুক্ষণ আগে এসে দরজার পর্দা ফাঁক করে সব কিছু দেখছিল। মামাকে আসতে দেখে সরে গেল । মামা চলে যাওয়ার পর ড্রইংরুমে ঢুকে ঝর্ণার কাছে এসে বলল, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন । তারপর জিজ্ঞেস করল, মামার সঙ্গে পরিচয় হয়েছে?

সাইফুল যখন ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল তখন সে শত চেষ্টা করেও কথা বলতে পারে নি। কে যেন তার গলা চেপে ধরেছিল। শুধু চোখের পানি অবিরল ধারায় পড়ছিল। সাইফুল চলে যাওয়ার পরও তার চোখ থেকে পানি পড়ছে। নাজনীনের কথা চল, পরিচয় করব। শুনে সামলে নিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, না।

আমাকে তোমার মামার রুমে নিয়ে নাজনীন আসুন বলে তাকে নিয়ে এসে মামার রুমের দরজার বাইরে দাঁড়াতে বলে সে ভিতরে গিয়ে মামাকে বলল, আমাকে পড়াবার জন্য যাকে তুমি ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিলে, তিনি তোমার সঙ্গে পরিচয় করতে এসেছেন।
সাইফুল বলল, এখানে নিয়ে আয় ।

নাজনীন দরজার পর্দা ফাঁক করে বলল, আন্টি ভিতরে আসুন। ঝর্ণা ভিতরে আসার পর নাজনীন বেরিয়ে এসে দরজার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল ।
সাইফুল তাকে দেখে বুঝতে পারল, ড্রইংরুমের সেই মেয়েটি। বলল, ড্রইংরুমে আপনার পরিচয় জানতে চাইলাম, বললেন না কেন? চেয়ারের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, বসুন ।

ঝর্ণা নিজেকে সামলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করল। কি করবে বা কি বলবে ভেবে ঠিক করতে পারল না। তার শরীর কাঁপতে লাগল।
তাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাইফুল আবার বলল, পরিচয় করতে এসে কথা বলবেন না তো এসেছেন কেন?
ঝর্ণা কোনো রকমে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মুখের নেকাব সরিয়ে দিয়ে বলল, সাইফুল, তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পার না?

নাজনীনকে পড়াতে এসে তোমার পরিচয় জানার পর থেকে অনুশোচনার আগুনে পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছি। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। কথা শেষ করে সে তার পায়ে দু’হাত রেখে বলল, বল, আমাকে তুমি ক্ষমা করেছ? তারপর সে সামলাতে পারল না, ফুপিয়ে কেঁদে উঠল ঝর্ণা মুখের নেকাব সরাতে সাইফুল তাকে চিন্তে পেরে প্রথমে চমকে উঠেছিল এখন তার কথা ও কার্য্যকলাপ দেখেশুনে খুব অবাক না হলেও আনন্দে তার মন ভরে উঠল।

বিলেতে ঝর্ণার চিঠি পাওয়ার পর সে যেন নবজনা লাভ করে। ভেবেছে, সত্যি সত্যি ঝর্ণা কি এই চিঠি দিয়েছে? এখন তার এহেন ব্যবহারে নিশ্চিত হয়ে হাত ধরে তুলে ভিজে গলায় বলল, এতদিন পর আমার শেষ সময়ে তুমি কেন এলে ঝর্ণা? তোমাকে পাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে দেখে ভেবে ঠিক করলাম, তোমার স্মৃতি নিয়ে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেব। ভাগ্যের লিখন একেই বলে। তুমি ক্ষমা চাইছ কেন?

আমার ঝর্ণার অন্যায় কখনো চোখে পড়ে নি। আমি সর্বদা তার সুখ শান্তি কামনা করে এসেছি। তাইতো তার শত অন্যায় অপরের চোখে ধরা পড়লেও আমার চোখে পড়ে নি। আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে যত আনন্দ পেয়েছ, আমিও তার থেকে কম পাই নি । তাইতো তোমার অন্যায়গুলো আমার কাছে অমৃতের মতো মনে হয়েছে। তাকে কাঁদতে দেখে বলল, তুমি কেঁদ না।

তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারছি না। তোমার সুখ ও শান্তির জন্য আমি আমার সমস্ত কামনা-বাসনা ত্যাগ করে বিদেশ চলে গিয়েছিলাম । সেই একই কারণে তোমার চিঠি পেয়ে ফিরে এসেছি। প্লীজ ঝর্ণা কেঁদ না। হাত জোড় করে বলছি কেঁদ না। আমি তোমাকে স্কুল জীবন থেকে অনেক বিরক্ত করেছি সেজন্য ক্ষমা চাইছি। আবার বলছি, তুমি কেঁদ না। যদি কান্না থামাতে না পার, তা হলে চলে যাও। তারপর সে আর কথা বলতে পারল না, কান্নায় তার গলা বন্ধ হয়ে এল ।

ঝর্ণা কাঁদতে কাঁদতেই তার দুটো হাত ধরে বলল, তুমি অসুস্থ আর কথা বলো না। আমি চলে গেলে তুমি যদি শান্তি পাও, তবে নিশ্চয় চলে যাব। তবে তার আগে দু’একটা কথা বলতে চাই ।
সাইফুল বলল, বল কি কথা বলবে।
তুমি যে আমাকে চলে যেতে বলছ, আমি তো যাওয়ার জন্য আসি নি ।
সাইফুল আশুভরা চোখে বলল, তা হলে কিসের জন্য এসেছ?

তুমি আমার চিঠি পেয়ে ফিরে এসেছ তা আমি সিওর। তবু যখন চলে যেতে বলছ তখন যাব। কিন্তু জেনে রাখ, আমার যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই একমাত্র আত্মহত্যা ছাড়া। আমিনের কাছ থেকে চলে আসার পর অনেকবার সেই পথে যেতে চেয়েছি। কিন্তু আল্লাহর কঠিন হুঁশিয়ারীর কথা মনে করে সে পথে যেতে পারি নি । তোমার দুয়ার খোলা আছে জেনে এসেছি। তুমিও যদি সেই দুয়ার বন্ধ করে দাও, তা হলে আল্লাহর হুশিয়ারী আগ্রাহ্য করে সেই পথ বেছে নেব। তার আগে একটা অনুরোধ করব রাখবে?

সাইফুলকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বলল, আমি না হয় তোমার কাছে অপবিত্র হয়ে গেছি। কিন্তু যে ঝর্ণা তোমার হৃদয়ের রক্তের সঙ্গে অহরহ প্রবাহিত হচ্ছে, সেই ঝর্ণার মাত্র একটা অনুরোধ রাখবে না?
সাইফুল আর সামলাতে পারল না। তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি যদি দেখ, আমি তোমার আদেশ মানি কি না? সত্যি আর ফিরে যাওয়ার জন্য এসে না থাক, তবে অনুরোধ করবে কেন?

আদেশ করে ঝর্ণা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল, এবার তুমি মদ ছেড়ে দিয়ে একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে কর। তা হলে তুমি তোমার সেই ঝর্ণাকে ভুলে যেতে পারবে। আর আমি দূর থেকে তোমাদেরকে দেখে শান্তিতে মরতে পারব সাইফুল আবার তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ঝর্ণা আমার এই অবস্থায় তুমি এত কঠিন কথা বলে বুকে ছুরি মারতে পারলে? তার চেয়ে সত্যিকার ছুরি মেরে একেবারে শেষ করে দিলে শান্তিতে মরতে পারতাম। মরার সময় ভাবতাম আমার ঝর্ণা আমাকে তিলে তিলে যন্ত্রণা না দিয়ে মেরে মুহূর্তের মধ্যে ঝর্ণা তাকে কথাটা শেষ করতে দিল না।

সাইফুলের মুখে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বলল, প্লীজ, চুপ কর। ওয়াদা করছি, আমি আর ওরকম কথা বলব না। ঝর্ণা ভুলে গেল, বিয়ের আগে এরকম আলিঙ্গনবদ্ধ হওয়া ইসলামে হারাম। সেও তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে সাইফুলের বুকে মাথা রেখে আবার বলল, ঐ কথা বলা আমার অন্যায় হয়েছে। মাফ করে দাও বলে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল ।

নাজনীন এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল, আম্মাকে মামার জন্যে একগ্লাস দুধ নিয়ে আসতে দেখে মামা বলে ডেকে উঠল। নাজনীনের গলা পেয়ে ঝর্ণা আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে আঁচল দিয়ে প্রথমে সাইফুলের ও পরে নিজের চোখ-মুখ মুছে ফেলল ।
মনিরা দরজার কাছে এলে নাজনীন ফিস ফিস করে বলল, একটু দাঁড়াও। আন্টি মামার সঙ্গে কথা বলছে। তারপর আম্মার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে বলল, তুমি এখন যাও, পরে আন্টির সঙ্গে কথা বলো।

আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি মনিরা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কিছু না বলে চলে গেল ।
নাজনীন আরো একটু অপেক্ষা করে বলল, মামা তোমার দুধ নিয়ে এসেছি।
সাইফুল বলল, আয়, নিয়ে আয় ।
নাজনীন ভিতরে এলে ঝর্ণা এগিয়ে এসে তার হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে
বলল, তুমি এখন যাও ।

নাজনীন তাদের দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ।
ঝর্ণা দুধের গ্লাস সাইফুলের মুখের কাছে ধরে বলল, খেয়ে ফেল ।
দুধ খেয়ে সাইল বলল, এখনও কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। কবে
আমিনের সঙ্গে তোমার ছাড়াছাড়ি হল?
সব বলব, এখন একটু বিশ্রাম নাও। অনেক কথা বলেছ ।
এতদিন কোথায় আছ?
এক বান্ধবীর বাসায় ।
নাজনীনকে কত দিন পড়াচ্ছ?

এবারে যতদিন তুমি বিলেতে ছিলে।
তা কি করে হয়? আমি তো যাওয়ার আগের দিন আমার বন্ধু জায়েদের অনুরোধে তার স্ত্রীর এক বান্ধবীকে নাজনীনকে পড়াবার ব্যবস্থা করে যাই।
আমিই তোমার বন্ধুর স্ত্রীর সেই বান্ধবী। আমিনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে যেদিন তাদের বাসা থেকে চলে আসি, সেদিন থেকে ওদের বাসায় আছি।
আমিন তা হলে তোমার ওপর খুব অত্যাচার করত?

ঝর্ণা ঝলছল নয়নে বলল, সে সব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি বলতে পারব না । শুদু এতটুকু জেনে রাখ, সে পশুর চেয়ে অধম, নরকের কটী । তারপর চোখ মুছে বলল, আর কোনো কথা নয়, চুপ করে বিশ্রাম নাও। আমি তোমার বন্ধুর বাসায় ফোন করে দিই। নচেৎ শিরীন দেরি দেখে চিন্তা করবে। তারপর ফোন করে শিরীনকে বলল, নাজনীনের মামা আজ এসেছে। আমি তার কাছে আছি। না ফিরলে চিন্তা করিস না তোর ডাক্তার ভাই জিজ্ঞেস করলে কি বলব?

যা সত্য তাই বলবি
তোদের মধ্যে সমঝতা হয়ে গেছে তা হলে?
আল্লাহপাকের রহমতে ও তোদের দো’য়ার বরকতে হয়েছে
শিরীন আলহামদুল্লাহ বলে বলল, এবার ছাড়ি তা হলে?
ঝর্ণা হ্যাঁ ছাড় বলে লাইন কেটে দিল ।
সাইফুল জিজ্ঞেস করল, শিরীন কে?

তোমার বন্ধুর স্ত্রী আর আমার বান্ধবী। এবার চুপ করে শুয়ে থাক তো বলে ঝর্ণা তাকে শুইয়ে দিয়ে মাথার কাছে বসে তার চুলে হাত বুলোতে লাগল। আসরের আযান শুনে বলল, আমি বুবুর রুমে গিয়ে নামায পড়ে আসি। তুমি কি নামায পড়বে?
মদ ধরার পর থেকে নামায ছেড়ে দিয়েছি।

ঝর্ণা তার মুখের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করল, আমার জন্যই আল্লাহর হুকুম অমান্য করে চলেছে। তার চোখে পানি এসে গেল। ভিজে গলায় বলল, আমি নামায পড়ে আসি তা হলে?
এস ।
ঝর্ণা নামায পড়ে এসে সাইফুলের মাথার কাছে বসল ।
তোমার কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।

ঝর্ণা ছলছল নয়নে বলল, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? কত দূর থেকে এসেছ, তোমার বিশ্রাম দরকার ।
মনের বিশ্রাম না হলে, দেহের বিশ্রাম হবে কি করে? তোমার সব কিছু জানার জন্যে মনে অশান্তির ঝড় বইছে। তুমি বল, আমার কোনো অসুবিধে হবে না ।
সেই নরপিশাচের কথা জিজ্ঞেস করতে একটু আগে নিষেধ করলাম। তবু যখন সেই সব কথা শোনার জন্য তুমি অশান্তি ভোগ করছ তখন বলছি শোন, তারপর ঝর্ণা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে সব কথা বলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল ।

সাইফুল একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কাঁদছ কেন? ভাগ্যে যা লেখা থাকে তা ঘটবেই। তাকে রোধ করার ক্ষমতা কারুর নেই। অতীতের কথা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর। তোমার এই পরিণতি দেখে কাঁদছি। তাই করেই তো বেঁচে আছি। আমি নিজের কথা ভেবে কাঁদছি না, আমার জন্য
তোমাকে আর পাব না জেনে এতদিন মৃত্যু কামনা করেছি। এখন তোমাকে দেখে আসবে না? আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।

বাঁচার জন্য আমার মন ব্যকুল হয়ে উঠছে। আমাকে বাঁচাবার জন্য তুমি কি এগিয়ে ঝর্ণা, সাইফুল বলে আবার তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি আমার প্রাণের বিনিময়েও তোমাকে বাঁচাব। সেইজন্যে তো এলাম, এই অপবিত্র দেহ নিয়ে কথা তোমার মুখ দিয়ে বার করালেন। তোমাকে কথাটা বলতে এতক্ষণ বিবেকে বাধছিল, তাই বলি নি। আল্লাহ আমার মনের সাইফুল তাকে মুক্ত করে ভিজে গলায় বলল, সারা জীবনের মধ্যে আজ সর্বপ্রথম তোমাকে এত কাছে পেয়ে আনন্দের উচ্ছাসে বিয়ের কথা বলে ফেলেছি।

আমি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। বিয়ে করে আবার তোমাকে দুঃখের সাগরে ভাসতে দেব না। মৃত্যুর সময় তোমার সেই দুঃখ আমি সহ্য করতে পারব না। তুমি চলে যাও প্রিয়তমা। আমি তোমাকে না পেলেও এবার শান্তিতে মরতে পারব। আল্লাহর কাছে সব সময় জানাতাম, মৃত্যুর আগে একবারের জন্য হলেও যেন আমার চিরকাঙ্ক্ষিত ঝর্ণাকে দেখতে পাই। তাই বোধ হয় তিনি তোমাকে এই শেষ সময়ে হাজির করেছেন। এমন সময় তার লিভারের যন্ত্রণা প্রচণ্ডভাবে আরম্ভ হল । সাইফুল যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে জ্ঞান হারাল ।

ঝর্ণা সাইফুলকে ছটফট করতে দেখে জড়িয়ে ধরেছিল। তাকে নিথর হয়ে যেতে দেখে ভয় পেয়ে ছেড়ে দিয়ে কয়েকবার নাড়া দিয়ে ডেকে সাড়া না পেয়ে আরো বেশি ভয় পেয়ে মনিরাকে ডাকার জন্য ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বারান্দায় নাজনীনকে দেখতে পেয়ে বলল, তাড়াতাড়ি তোমার আমবমাকে ডাক, তোমার মামা অজ্ঞান হয়ে গেছে । নাজনীন বলল, আপনি মামার কাছে যান, আমি আম্মাকে নিয়ে আসছি।

মনিরা শুনে হাতের কাজ ফেলে একজন চাকরকে ডাক্তার আনতে পাঠিয়ে মেয়ের সঙ্গে সাইফুলের রুমে এল ।
মনিরাকে দেখে ঝর্ণা বলল, আপা, শিঘ্রী কিছু ব্যবস্থা করুন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ছটফট করতে করতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।
মনিরা বলল, ডাক্তার আনতে পাঠিয়েছি। তারপর সাইফুলের মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করল ।

একটা ইনজেকসন দিয়ে ডাক্তার চলে গেল । ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বলল, এক্ষুনি হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন।
হাসপাতালে নেয়ার আগে সাইফুলের জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফেরার পর ছটফট করতে করতে বলল, টেবিলের ওপর ওষুধের প্যাকেট থেকে দুটো ট্যাবলেট দাও ৷
হাসপাতালে নিতে মনিরা তাকে ট্যাবলেট খাইয়ে বলল, ডাক্তার এনেছিলাম।

বলে গেল তোমাকে সাইফুল বলল, হাসপাতালে গিয়ে কি হবে? এখানকার ডাক্তাররা বই নকল করে পাশ করে। তারা আবার কি ডাক্তারী করবে? লন্ডনের হাসপাতালে কতদিন ছিলাম, তারাই কিছু করতে পারল না। আমি হাসপাতালে যাব না। ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলতে বলতে টাইম মতো ওষুধ খেতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই এরকম হল। এখন যন্ত্রণা কমেছে।

মনিরা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তবু তুই মদ ছাড়বি না। এবার দেখব কেমন করে মদ খাস? নাজনীনকে থাকতে বলে ঝর্ণার একটা হাত ধরে মনিরা বলল, তুমি আমার সঙ্গে এস। আম্মা ও আন্টি চলে যাওয়ার পর নাজনীন মামার মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, আম্মা আন্টির পরিচয় জেনে গেছে।

তুই জানিস নি?
হ্যাঁ জানি।
কবে জানতে পারলি?
তোমার অসুখের চিঠি পাওয়ার পর। জান মামা, আন্টি খুব ধার্মিক। আমাদেরকে কত কুরআন-হাদিসের কথা বলেন। আমাকে কুরআন ও নামায পড়া শিখিয়েছেন। দেখো, আন্টি তোমাকে আর মদ খেতে দেবেন না, আমিও দেব না। আর আম্মাও তো একটু আগে সে কথা বলেই গেল ।
তোরা ঘুমিয়ে পড়লে খাব ।

ঘরে থাকলে তো খাবে। তুমি যখন ঘুমিয়েছিলে তখন আম্মা তোমার ল্যাগেজ থেকে সব বের করে চাকরকে দিয়ে রাস্তায় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। তা ছাড়া এখন আর খাবেই বা কেন? আন্টি যখন তোমার কাছে রয়েছেন । আন্টিকে ভুলে থাকার জন্যে তো খেতে? তোর আন্টি কি চিরকাল আমার কাছে থাকবে?
কেন থাকবে না? থাকার জন্য তো এসেছেন ।

তুই কি করে বুঝলি?
তোমার চিঠি পাওয়ার পর আমি যেদিন তোমার অসুখের কথা আন্টিকে বললাম, সেদিন আমাকে নিয়ে ঐ বাসার তোমার রুমে গিয়েছিলেন। সবকিছু দেখে আন্টি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। আজ আবার আন্টির অবস্থা দেখে আমি বুঝতে পেরেছি আন্টির সঙ্গে তোমার সম্পর্কে কথা। আম্মা আগেই বুঝতে পেরেছিল ।

তুই তো দেখছি আমার আম্মার মতো হয়েছিস। জানিস, শুধু ছেলে বেলায় নয়, মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত আম্মা আমার সব কিছু বুঝতে পারত ।
এরা যখন মামা-ভাগ্নি কথা বলছে তখন মনিরা ঝর্ণাকে নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে বলল, তোমাকে আর আপনি বলব না। আমি তোমার ও সাইফুলের সম্পর্ক বুঝতে পেরেছি। যা বলছি মন দিয়ে শোন, এখন তোমার উপর সাইফুলের জীবন মরণ নির্ভর করছে।

অতীতে কি ঘটেছে, সে সব মন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কর। আমাদের মতো তুমিও নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ, তোমার জন্য সাইফুলের এই অবস্থা? তারপর তার দুটো হাত ধরে বলল, তুমি তোমার মন থেকে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্ধ ত্যাগ করে আমাদের বংশের ঐ একমাত্র বাতিকে বাঁচাবার চেষ্টা করবে না ভাই?

ঝর্ণা মনিরার চোখে পানি দেখে তাকে কদমবুসি করে উঠে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠে বলল, বুবু, আমিও যে তাই চাই। সেইজন্যেই তো লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে ছুটে এসেছি। তুমি দোয়া কর বুবু, আল্লাহ যেন আমাকে সেই শক্তি দেন।

করব। তোমার উদ্দেশ্য সাইফুল জেনেছে? মনিরা তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলল, ধৈর্য্য ধর বোন। দো’য়া তো নিশ্চয়
ঝর্ণা বলল, জেনেছে। জানার পর বলল, মৃত্যু পথযাত্রী হয়ে বিয়ে করে তোমাকে আমিও বাঁচব না । আবার দুঃখের সাগরে ভাসাতে পারব না। আমিও তাকে বলেছি, তোমার কিছু হলে মনিরা শুনে আলহামদুলিল্লাহ বলে তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, এবার তুমি সাইফুলের কাছে যাও, মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে গেছে। গিয়ে নাজনীনকে পাঠিয়ে দাও ওখানে নামাযের পাটি আছে, নামায পড়ে নিও।

সাইফুলের শত আপত্তি সত্ত্বেও মনিরা সেই রাত্রে কাজী ডেকে এনে কাবিন করে
তাদের বিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করল।
ঝর্ণা ফোন করে শিরীন ও জায়েদকে সব কথা জানিয়ে তাদেরকে আসতে বলল।
ঝর্ণা যখন শিরীনের বাসায় ফোন করে তখন জায়েদ ক্লিনিকে ছিল। শিরীন তাকে ক্লিনিকে ফোন করে বলল, তোমার বন্ধুর সঙ্গে আমার বান্ধবীর একটু পরে বিয়ে হতে যাচ্ছে। ঝর্ণা ফোন করে আমাদের তাড়াতাড়ি যেতে বলল । তুমি এক্ষুনি চলে এস।

জায়েদ স্ত্রীর কাছ থেকে জেনেছে। ঝর্ণার জন্যই তার বন্ধুর এই পরিণতি। ঝর্ণার বর্তমান মানসিক অবস্থার কথাও জেনেছে। লজ্জা পাবে মনে করে তাকে কিছু জিজ্ঞেস তাই নাকি? তা হলে তো এক্ষুনি যেতে হয়? করে নি। এখন তাদের বিয়ের কথা শুনে আল্লাহপাকের শোকর গুজারী করে বলল,
শিরীন বলল, হ্যাঁ, না গেলে তোমার বন্ধু যেমন তোমার উপর মনে কষ্ট পাবে, চলে এস। তারা দু’জনে ঠিক সময়মতো এসেছিল ।

তেমনি আমার বান্ধবীও আমার ওপর মনে কষ্ট পাবে। তুমি দেরি না করে তাড়াতাড়ি মামার নিষেধ উপেক্ষা করে নাজনীন যতটুকু পারল মামা-মামীর বাসর ঘর সাজিয়েছে। বাসর ঘরে ঢুকে সাইফুল বিয়ের পোশাক চেঞ্জ করে ঝর্ণার হাত ধরে খাট থেকে নামিয়ে জড়িয়ে ধরে তার সমস্ত মুখে, ঘাড়ে, গলায় ও বুকে বেশ কিছুক্ষণ পাগলের মতো চুমো খেতে লাগল। তারপর ঠোঁটে ঠোঁট রেখে ভিজে গলায় বলল, এতদিন পরে কেন তুমি আমার জীবনে এলে?

তোমাকে দেয়ার মতো আমার যে এখন আর কিছু নেই। তোমার স্মৃতি নিয়ে এই দুনিয়া থেকে চলে যেতে চেয়েছিলাম, সেটাই বোধ হয় ভালো হত। তোমার ছবি, তোমার স্মৃতি, আমার হৃদয়ে পাথরে খোদাই করার মতো খোদিত করে রেখেছি। তাই দেখে এতদিন বেশ কেটে যাচ্ছিল । কেন তুমি এই জীবন সায়াহ্নে এসে ধরা দিলে? মৃত্যু আমার শীয়রে দাঁড়িয়ে আছে জেনেও কেন যে তোমার কথায় রাজি হয়ে গেলাম, তা জানি না।

হয়তো আজীবনের সাধনার ফল হিসাবে তোমাকে পাব জেনে মনটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন অনুশোচনা হচ্ছে, জীবনের শেষ মুহূর্তে প্রিয়তমাকে পেয়ে কি লাভ হল? আমি তো কয়েকদিনের মধ্যে মরেই যাব। তবে কেন তোমাকে বিয়ে করলাম? কেন তোমাকে দুঃখের সাগরে ভাসাতে গেলাম? দীর্ঘ দিনের ঘৃণার পাত্রকে কেন তুমি বিয়ে করলে?

বল, বল প্রিয়তমা। আমি যে আর কিছু ভাবতে পারছি না। শুধু মনে হচ্ছে মৃত্যুর আগে আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? এমন সময় লিভারের তীব্র যন্ত্রণা আরম্ভ হতে ঝর্ণাকে আলিঙ্গণ মুক্ত করে শুয়ে পড়ে কাতরাতে কাতরাতে বলল, কি ভুলই না করে ফেললাম। এ নরক যন্ত্রণা থেকে আমি আর কোনোদিন আরোগ্য লাভ করব না। তুমি আমাকে একটু বিষ এনে দিতে পার? আর যে সহ্য করতে পারছি না। আমার জন্যে যদি তোমার অন্তরে একটু দয়া- মায়া থাকে, তবে একটু বিষ এনে দাও প্রিয়তমা।

আমি আমার প্রিয়তমার হাতের বিষকে অমৃত মনে করে খেয়ে; তার বুকে মাথা রেখে মরতে চাই ।
ঝর্ণা প্রথম দিকে স্বামীর কথায় যেমন মরমে মরে যাচ্ছিল, তেমনি দুঃখে ও অনুশোচনায় তার অন্তর ক্ষত বিক্ষত হচ্ছিল। পরে স্বামীর লিভারে যন্ত্রণা আরম্ভ হয়েছে বুঝতে পেরে সেও খাটে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরে দরবিগলিত চোখে স্বামীর সারা মুখে চুমো খেতে খেতে বলল, থাম প্রিয়তম এবার থাম।

আমি যে কত বড় অন্যায় করেছি, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। তোমার কষ্ট ও যন্ত্রণা আমাকেও সমভাবে কষ্ট ও যন্ত্রা দিচ্ছে। আমি কেন তোমাকে বিয়ে করেছি শুনবে? তোমার কষ্ট ও যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য। ইনশাআল্লাহ তোমাকে আমি ভালো করে তুলবই। এমন কি সে জন্যে যদি আমার জীবন উৎস্বর্গ করতে হয়, তাও করব। তবু তোমাকে আমি মরতে দেব না । তারপর কাউকে কিছু না বলে নিজে ড্রাইভারকে সঙ্গে করে ডাক্তার নিয়ে এল ।

ডাক্তার এসে সবকিছু শুনে তাকে একটা ঘুমের ইনজেকসান দিয়ে বললেন, এ রকম রুগী বাসায় রাখা ঠিক নয়। কখন কি হয় বলা যায় না । হসপিটালে ভর্তি করে দিন ।
ঝর্ণা কোনো কথা না বলে ডাক্তারকে বিদায় করে সারারাত স্বামীর পাশে বসে বসে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর রোগ মুক্তির জন্য আল্লাহপাকের দরবারে দোয়া চাইল ।

পরের দিন মনিরার সঙ্গে কথা বলে পিজির বড় বড় ডাক্তারদের কল দিয়ে বাসায় এনে একটা বোর্ড তৈরি করে স্বামীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করল ।
ডাক্তাররা বললেন, কোনো ওষুধপত্র খেয়ে এ রোগ ভালো হবে না। তবে মদ খাওয়া ছেড়ে দিলে কম থাকবে। সম্পূর্ণ ভালো করতে হলে অপারেশন করাতেই হবে । মদ আর ছুঁতে দেবেন না। আমরা ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করছি। একটু সুস্থ হওয়ার পর অপারেশন করাবেন ।

ডাক্তারদের বিদায় করার পর ঝর্না মনিরাকে বলল, বুবু, আমি ওকে নিয়ে সুইজারল্যান্ডে চলে যাব। সেখানকার আবহাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো। অপারেশন যদি করাতে হয়, তা হলে সেখানেই করাব ।
মনিরা বলল, বেশ, তুমি যা ভালো বুঝ করবে, আমি বাধা দেব না ।

আজ পনের দিন হল তাদের বিয়ে হয়েছে। মানসিক কিছুটা উন্নতি হলেও রোগের তেমন উন্নতি হয় নি। প্রথম প্রথম তিন-চার দিন সাইফুল দৈনিক এক বোতল মদের জন্যে ঝর্ণার কাছে কাকুতি-মিনতি করেছে। ঝর্ণা না দিয়ে বলেছে, ঐ বিষ আর তোমাকে খেতে দেব না। আল্লাহ ও তাঁর রাতূল (দঃ) যে জিনিসকে হারাম করেছেন, সে জিনিস কিছুতেই তোমাকে খেতে দেব না ।

সাইফুল রাগ সহ্য করতে না পেরে একদিন ঝর্ণার গালে একটা চড় মেরে বলল, যদি না দিতে পার, তা হলে আমার কাছে আর এস না, বুবুর কাছে থাকবে। চড় খেয়ে তার আমিনের কথা মনে পড়ল। সে মারত তাকে দিয়ে পাপ কাজ করিয়ে টাকা রোজগার করার জন্য। আর সাইফুল মারল, তাকে হারাম জিনিস খেতে দেই নি বলে । মারের আঘাতে ঝর্ণার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে পড়ল।

তবু হাসি মুখে বলল, ব্যাস, শুধু একটা চড় মেরে কি আর কাজ হয়? তবু কিন্তু এচফোটাও তোমাকে মদ দিচ্ছি না।
সাইফুল রাগের বসে মেরে মনে মনে অনুশোচনা করছিল। ঝর্ণার কথা শুনে মাথা নিচু করে ভিজে গলায় বলল, অসুস্থ শরীরে রাগের মাথায় কাজটা করে ফেলেছি। তারপর হাত দুটো ধরে চোখের দিকে তাকিয়ে বসস, অন্যায় করেছি। মাফ করে দাও।

ঝর্ণা সাইফুলের চোখে পানি দেখে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে চোখ মুছে দিয়ে বলল, স্ত্রীর কাছে স্বামীর মাফ চাইতে নেই। তুমি যেমন আমার কোন অন্যায়কে মনে না করে আনন্দ পাও তেমনি তোমাকে ভালবেসে আমিও তাই পাচ্ছি।
এই কয়েকদিনের মধ্যে স্বামীকে ঝর্ণা নামায ধরিয়েছে। তার আগে একদিন ঝর্ণা সকালের দিকে বিছানাঝেড়ে ঠিক করার সময় সাইফুলের বালিশের নিচে পাথর বসান একটা রুপোর আংটি দেখে অবাক হয়ে সেটা নিয়ে সাইফুলের হাতে দিয়ে বলল, এটা বালিশের নিচে পেলাম । কই,এই কদিন তো তোমার হাতে এটা দেখি নি?

আংটিটা দেখে সাইফুল চমকে উঠল। তখন তার সেই ফকিরের কথা মনে পড়ল। যে দিন ঝর্ণার বিয়ের কথা শুনে সারাদিন নামায না পড়ে রাত্রে মদ খেয়ে বাসায় ফিরছিল, তারপরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আংটি হাতে না দেখে অনক খুঁজাখুঁজি করেছে। কিন্তু পায় নি। তখন সে ভেবেছিল, গতকাল নামায পড়ি নি, তার ওপর মদ খেয়েছি, তাই ফকিরের কথামতো আংটি চলে গেছে। তারপর কথা একদম ভুলে গিয়েছিল। সেই আটি ফিরে পেলে ভাবল, আল্লাহ এতদিন অপকর্মের জন্য আমার উপর অসন্তুষ্ঠ ছিল।

ঝর্ণা এসে সে অপকর্ম বন্ধ করে দিয়েছে বলে আল্লাহ আবার সেই আংটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞ ও আনন্দে তার চোখ পানিতে ভরে উঠল । বলে আল্লাহ আবার সেই আংটি ফিরিয়ে দিয়েছেন। কৃতজ্ঞতার ও আনন্দে তার চোখ
স্বামীকে আংটির দিকে এতক্ষণ তাকিয়ে থেকে চিন্তা করতে দেখে ও তার চোখে পানি দেখে ঝর্ণা বেশ অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার, আংটিটা দেখে এত কি
ভাবছ? আর তোমার চোখে পানি কেন?

সাইফুল ঝর্ণার কপালে একটা চুমো খেয়ে বলল, তোমার এই কপালের গুনে আমার ভাগ্যকে ফিরে পেলাম ।
ঝর্ণা আরো অবাক হয়ে বলল, ব্যাপারটা খুলে বলবে তো?
সাইফুল আংটি কিভাবে পেয়েছিল এবং তারপর সে কি করে এই সাহেবের ছেলে আরজু হয়ে লেখাপড়া করল, তা সব বলল।
ছোটবেলা থেকে তো নামায পড়তে । ঝর্ণা বলল, সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছায় হয়ে থাকে। কিন্তু নামায ছাড়লে কেন?
ছিলাম না। সাইফুল বলল, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে জানতে পেরে আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না।

আজ সকাল থেকে সাইফুলের সহ্যমত লিভারের যন্ত্রণা হচ্ছে। যন্ত্রণা শুরু হওয়ার পর পরই ঝর্ণা ডাক্তার আনিয়েছিল। দুপুরের দিকে একটু কমতে তাকে ভাত খাইয়ে শুতে বলল। সাইফুল ঘুমিয়ে পড়তে যে ওষুধটা এখানকার দোকানে পাওয়া যায় নি, সেটা কেনার জন্য মিটফোর্ড গেল। সেখানেও অনেক দোকানে না পেয়ে আরো অনেক দোকানে খোঁজ করতে করতে শেষে একটা দোকানে পেল। বিদেশী ওষুধ, তার উপর মার্কেটে নেই।

দোকানদার তিন-চারগুণ বেশি দাম রাখল। ঝর্ণা তা বুঝতে পেরেও কিছু বলল না। ওষুধটা যে সে পেল এটাই সৌভাগ্য বলে মনে করল। তার ফিরতে বেশ দেরি হল। এদিকে জোহরের আযান শুনে সাইফুলের ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে নামায পড়ার সময় আবার লিভারের যন্ত্রণা শুরু হল। কোনো রকমে চার রাকায়াত ফরজ নামায আদায় করে বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগল, ঝর্ণা তুমি কোথায় গেলে, আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না। আল্লাহ গো তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আমার পাপের ফেকে স্বামীর কাতরানি শুনতে পেয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে আসার সময় সাবুর মায়ের সঙ্গে দেখা ।

সাবুর মা বলল, আপা জলদি যান, সাহেবের বোধ হয় আবার পেটের যন্ত্রণা হচ্ছে। কখন থেকে আপনাকে ডাকাডাকি করছেন ।
ঝর্ণা রুমে এসে তাড়াতাড়ি বোরখা খুলে ওষুধের শিশি থেকে দুটো ট্যাবলেট বের করে স্বামীকে খাইয়ে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলল, তোমাকে ঘুমাতে দেখে এই ওষুধটা আনতে মিটফোর্ড গিয়েছিলাম। তারপর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে লাগল, ইয়া আল্লাহ, তুমি সর্বজ্ঞ। তোমার অজানা কিছুই নেই। তুমি আমাদের দীলের খবর জান।

আমরা আমাদের কৃত গোনাহর জন্য মাফ চাইছি। তুমি মাফ না করলে আর কে করবে? তুমি গোনাহ মাফ করে দিয়ে আমার স্বামীকে আরাম দাও। তাকে আরোগ্য করে দাও। আমার জন্য আমার স্বামী এই রকম কষ্ট পাচ্ছে। তুমি আমার স্বামীর রোগ আমাকে দিয়ে তাকে ভালো করে দাও। তা না হলে আমাকে যত খুশী শাস্তি দিয়ে তার রোগের উপশম কর। আমি একমাস নফল রোযা রাখার ও একশত রাকাত নফল নামায পড়ার মানত করছি।

তোমার পেয়ারা রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) এর রওজা মোবারকে শত কোটী দরুদ ও সালাম জানিয়ে দোয়া করছি, তুমি আমার দোয়া কবুল কর, আমিন সুম্মা আমিন, তারপর সে স্বামীর মুখটা দু’হাত দিয়ে ধরে সারা মুখে চুমো খেতে খেতে বলল, তোমার জ্বিটা আমার মুখের মধ্যে দাও। আমি চুষবো, যাতে করে তোমার রোগটা আমার মধ্যে সংক্রামিত হয়। তোমার কষ্ট আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না, কথা শেষ করে স্বামীর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ঘষতে ঘষতে বলল, কই দাও না তোমার জ্বিবটা আমার মুখের মধ্যে।

সাইফুল স্ত্রীর কথা ও আচরণল আর কতদিন দিবে? ইয়া আল্লাহ, তুমি রহমানুর রহিম, আমার উপর রহম কর। সে খাটের উপর গড়াগড়ি দিতে দিতে আর ঐ সব বলে কাতরাতে লাগল ।
কাজের মেয়ে সাবুর মাকে মনিরা কয়েক দিন হল এই বাসায় রেখেছে। সে সাহেবের কাতরানির আওয়াজ পেয়ে রুমে এসে বলল, কিছু লাগবে সাহেব?
সাইফুল বলল, তোমার আপা কোথায়? জলদি তাকে ডেকে দাও ।

সাবুর মা বলল, আপা ওষুধ কিনতে গেছেন। যাওয়ার সময় আপনার দিকে আমাকে লক্ষ্য রাখতে বলে গেলেন ।
সাইফুল বলল, তুমি কি লক্ষ্য রাখবে? যাও এখান থেকে। তারপর কাতরাতে কাতরাতে আবার বলল, এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন? বাইরে গিয়ে দেখ, তোমার আপা আসছে কিনা ।

ঝর্ণা ফিরে এসে বারান্দা থ দেখেশুনে লিভারের যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে চিন্তা করল, ঝর্ণা আমাকে এত ভালবাসে? মনে হচ্ছে আমার কষ্ট দেখে ওর যেন আমার থেকে বেশি কষ্ট হচ্ছে। ওষুধ খাওয়ার ফলে যন্ত্রণাও আস্তে আস্তে কমে আসছে। বলল, আল্লাহ নিশ্চয় তোমার দো’য়ার বরকতে আমাকে ভালো করে দেবেন। অত অস্থির হয়ে পড়ছ কেন? তুমিই তো বলেছ কুরআনপাকে আছে ‘আল্লাহ সবুরকারীদের সঙ্গে থাকেন।’

ঝর্ণা স্বামীকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে শুনে বুঝতে পারল, তার যন্ত্রণা কমেছে। আলিঙ্গনমুক্ত হয়ে উঠে বসে স্বামীর চোখ-মুখ মুছিয়ে দিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, তুমি আমার সমস্ত অপরাধ মাফ করে পায়ে ঠাঁই দিয়ে আমাকে ধন্য করেছ। কিন্তু আমি যে তার প্রতিদানে কিছুই দিতে পারছি না। আমার প্রাণ উৎসর্গ করে যদি তোমাকে আরোগ্য করতে পারতাম, তা হলে আমার জন্ম সার্থক হত।

সাইফুল বলল, ঝর্ণা, এবার তুমি থাম। জীবন উৎসর্গ করার জন্য তোমাকে আমি বিয়ে করি নি। এত বছর সবুর করে তোমাকে পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে আকুল প্রার্থনা করেছি। তিনি আমার প্রার্থনা কবুল করে তাঁর এই নাদান বান্দাকে কৃতার্থ করেছেন। সেই জন্যে চিরকাল তাঁর পবিত্র দরবারে শুকরিয়া আদায় করতে থাকব। তুমি একটু আড়াল হলেই মনে হয়, আমার দেহে প্রাণ নেই। তোমার কিছু হলে আমি হার্টফেল করে মরে যাব। অনেক অপেক্ষা, অনেক তিতীক্ষার পর আল্লাহ তোমাকে মিলিয়েছেন। তুমি আর ঐসব কথা কোনোদিন মুখে আনবে না ।

ঝর্ণা স্বামীর উপর উপুড় হয়ে আবার সারা মুখে চুমো খেতে খেতে বলল, তুমি চুপ কর। তোমার মনের সব কথা জানি। তারপর তার পাশে বসে আবার বলল, মনে হয় আল্লাহপাকের রহমতে তোমার যন্ত্রণা একটু কমেছে। এবার ঘুমাবার চেষ্টা কর, আমি তোমার চুলে বিলি কেটে দিই
সাইফুল তার কোলে মাথা রেখে বলল, আমি ঘুমিয়ে গেলেও আমার কাছে থাকবে বল?

থাকব। শুধু নামায পড়ে ভাত খেতে যাব । তুমি নামায পড়েছ?
হ্যাঁ পড়েছি। তুমি নামায পড়ে এখানেই ভাত খাও। সাবুর মাকে ভাত দিয়ে যেতে বল । ঠিক আছে, তাই বলছি। তারপর সাইফুলের মাথার নিচে একটা বালিশ দিয়ে বাথরুম থেকে অযু করে এসে নামায পড়ে খেয়ে উঠে স্বামীর পাশে যখন বসল তখন সাইফুল ঘুমিয়ে পড়েছে।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, গরিব বলে যে সাইফুলকে স্কুল লাইফ থেকে ঘৃণা করে এসেছি, সেই সময় প্রেমের চিঠি দিয়েছিল বলে যাকে হেডস্যারের হাতে মার খাইয়ে দেশ ছাড়া করেছি, ইউনিভার্সিটিতে আলাপ করতে এলে কয়েকবার যাকে অপমান করেছি, যাকে অপমান করার জন্যে তার সামনে আমিনের সঙ্গে মাখামাখি করেছি এবং শেষে তাকে জব্দ করার জন্য আমিনকে বিয়েও করেছি, কিন্তু তবু সে আমার পিছু ছাড়ে নি। বিয়ের পর একদিন আমিনের অনুপস্থিতিতে তার বাসায় গিয়ে আমাকে বলেছিল, ‘ঝর্ণা, তুমি আমাকে অপমান ও জব্দ করার জন্যে যত রকমের চেষ্টা কর না কেন, তুমি আজীবন আমার বুকের মধ্যে আত্মার পাশাপাশি বাস করবে।

আত্মা ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না, তেমনি তোমাকে অথবা তোমার স্মৃতি না হলে আমিও বাঁচব না। আমি আমৃত্যু তোমার জন্য অপেক্ষা করব।’ তখন সাইফুলের কথা শুনে তার মনে হয়েছিল, ছেলেটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আর আজ সেই ঘৃণিত ও অবহেলিত সাইফুল যেন তার আত্মা। সাইফুলের কিছু কষ্ট হলে মনে হয় তারই বেশি কষ্ট হচ্ছে। এই সব ভাবতে ভাবতে ঝর্ণার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল । আসরের নামাযের আযান শুনে স্বামীকে জাগিয়ে দু’জনে নামায পড়ল ।

প্রতিদিন বিকেলে সাইফুলের ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে পল্টনের বাসায় গিয়ে মনিরা ও নাজনীনকে এই বাসায় নিয়ে আসে। আবার রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তাদেরকে সেই বাসায় পৌঁছে দেয়। এই সময়টা মনিরা ভাইয়ের সেবা যত্ন করে। নাজনীন কিছু সময় মামার কাছে কাটিয়ে মামীর সঙ্গে নানা রকম গল্প করে কাটায়। বিয়ের পর থেকে নাজনীন ঝর্ণাকে মামী বলে ডাকে।

সাইফুল ও ঝর্না নামায পড়ে বসে কথা বলছিল। এমন সময় মনিরা ও নাজনীন এল। সালাম বিনিময় করে মনিরা জিজ্ঞেস করল, তোদের দু’জনের মুখ এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন? আজ কি যন্ত্রণা বেশি হয়েছে।
ঝর্ণা বলল, হ্যাঁ বুবু সকাল থেকে যন্ত্রণা অল্প অল্প হচ্ছিল, দুপুরের পর বেশি হয়। আমি ডাক্তার এনেছিলাম। উনি বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে একটু তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে বলে গেলেন ।
তা কতদূর কি করেছ?

পি. জি. র ডাক্তাররা ব্যবস্থা করেছেন। প্রায় সব ঠিক হয়ে গেছে। ইনশাআল্লাহ সামনের সপ্তাহে রওয়ানা দেব।
নাজনীন বলল, আমি তোমাদের সঙ্গে যাব ।
সাইফুল বলল, এখন আর কি করে তা সম্ভব? আগে বললে ব্যবস্থা করা যেত ।
সুইজারল্যান্ডে ওরা প্রায় এক বছর হতে চলল এসেছে। সাইফুল এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। হাসপাতালে সাইফুল পাঁচ মাস ছিল। সাইফুলের যখন অপারেশন হয় তার এক সপ্তাহ আগে থেকে ঝর্ণা তার মানত করা রোযা রাখতে এবং নফল নামায পড়তে আরম্ভ করে।

আবার অপারেশন যাতে সাকসেসফুল হয়, সে জন্যও ঐ সবের মানত করে। সাইফুল হাসপাতালে থাকার সময় সে সব মানত পূরণ করেছে। সাইফুল প্রথমে অপারেশন করাতে রাজি হয় নি। ঝর্ণা তাকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছে। সাইফুল রাজি হওয়ার আগে তাকে বলেছে, কেন অপারেশন করতে চাচ্ছি না জান? যদি এ্যাকসিডেন্টলি আমি মরে যাই, তা হলে তোমার যে কষ্ট হবে, তা কি তুমি সহ্য করতে পারবে? আমার আশা আল্লাহ পূরণ করেছেন। এখন তাঁর ইচ্ছায় যদি কিছু হয়, তা হলে আমার এখন আর কোনো খেদ নেই। শুধু তোমার কথা ভেবে রাজি হচ্ছি না।

ঝর্ণা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বলেছে, আল্লাহ না করুন, যদি তোমার কিছু হয়ে যায়, তা হলে নির্ঘাৎ আমিও দম ফেটে মারা যাব। এবার আমি কেন করাতে চাচ্ছি শোন, প্রতিদিন তুমি যে কষ্ট ভোগ করছ, তোমার হায়াৎ যতদিন থাকবে ততদিন সেই কষ্ট ভোগ করতে হবে। আল্লাহ হায়াৎ-মউতের মালিক। তিনি যতদিন তোমার হায়াৎ রেখেছেন, ততদিন অপারেশন করালেও বাঁচবে আর না করালেও বাঁচবে।

আল্লার উপর বিশ্বাস হারাচ্ছ কেন? জান না বুঝি, পাঁচটা জিনিস আল্লাহপাকের হাতে। সেগুলোতে মানুষের কোনো এখতিয়ার নেই। সেগুলো হল-হায়াৎ, মউত, রেযেক, ধন-দৌলত ও মান-ইজ্জৎ। যদিও বা আমরা অনক সময় দেখি, মানুষ নিজের চেষ্টায় সৎভাবে হোক বা অসৎভাবে হোক এগুলোর কোনো একটায় সফলতা অর্জন করেছে, তা হলে বুঝতে হবে সেটা তার তকদিরে ছিল। প্রত্যেক মুসলমানের তকদিরকে বিশ্বাস করতেই হবে। তুমি জান কি না জানি না, সাতটা জিনিসের উপর পূর্ণ বিশ্বাস না করলে কেউ খাঁটি মুসলমান হতে পারে না ।

সাইফুল জিজ্ঞেস করল, সেগুলো কি কি?
ঝর্ণা বলল, (১) আল্লাহ, (২) ফেরেস্তাগণ, (৩) আসমানী গ্রন্থসমূহ, (৪) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষগণ, (৫) কেয়ামত, (৬) তকদির অর্থাৎ আল্লাহপাক ভালোমন্দ নির্দ্ধারনকারী, (৭) মৃত্যুর পর পূর্ণজীবন। কথা শেষ করে সাইফুলকে তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, অমন করে কি দেখছ?

সাইফুল বলল, আজকের ঝর্ণাকে কয়েক বছর আগের ঝর্ণার সঙ্গে মিলিয়ে দেখছি। ঝর্ণা ছলছল চোখে বলল, কি দেখলে?
সাইফুল বলল, তাদেরকে একই দেখলাম, শুধু আগের ঝর্ণার দ্বীনি এলেম ছিল না । ঝর্ণা চোখের পানি মুছে বলল, যদি আল্লাহ আমাকে সেই সময় দ্বীনি এলেম দান করতেন, তা হলে দু’জনকে এত কষ্ট ভোগ করতে হত না ।

তারপর অনেক বুঝিয়ে ও কান্নাকাটি করে তাকে রাজি করিয়ে অপারেশন করিয়েছে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সাইফুলের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এবং সেখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য ও জলবায়ু ভালো লাগায় তারা এতদিন রয়েছে। সাইফুল তার প্রিয়তমা স্ত্রী ঝর্ণাকে নিয়ে পাহাড়ী ঝর্ণা দেখে বেড়াচ্ছে। তাকে সঙ্গে নিয়ে পাহাড়ের কোলে ঝর্ণার ধারে বসে গল্প করে। আল্লাহর অপূর্ব সৃষ্টি মহিমার গুণকীর্ত্তন করে। আর ঝর্ণা তার প্রতি সাইফুলের প্রেম ও ভালবাসা উপলব্ধি করে নিজেকে স্বামীর মধ্যে বিলীন করে দিয়েছে মাঝে মাঝে যখন একা থাকে তখন কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়ে ভেবেছে, আমি হীরের টুকরো পায়ে ঠেলে একজন ঘৃণ্য, ইতর ও শয়তানের পিছনে ঘুরেছি।

একদিন কথায় কথায় ঝর্ণা বলল, ভার্সিটিতে পড়ার সময় শুনেছিলাম, তুমি বিখ্যাত কুংফু মাস্টার। সে সব ছেড়ে দিলে কেন?
সাইফুল বলল, যে কারণে আমি মদ ধরেছিলাম, সেই একই কারণে কুংফু মাস্টারী ছেড়ে দিয়েছি। এমন সময় হোটেলের পিয়ন একটা চিঠি দিয়ে গেল। সাইফুল চিঠিটা দেখে বুঝতে পারল বুবু দিয়েছে। সে ঝর্ণাকে পড়তে বলল ।

ঝর্ণা জোরে জোরে চিঠিটা পড়ে বলল, বুবু বারবার চিঠি দিচ্ছে ফিরে যাওয়ার জন্য। অনেক দিন হয়ে গেল, এবার ফেরা দরকার। তা ছাড়া ব্যবসাপত্র কি ভাবে চলছে, সেটাও চিন্তা করা উচিত সাইফুল তাকে আলিঙ্গনবদ্ধ করে বলল, আমি ক্লাস সিক্স থেকে আল্লার কাছে শুধু তোমাকে চেয়েছি। বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসাপত্র কিছুই চাই নি। তোমাকে দেয়ার আগে তিনি ঐ সব দিয়ে আমার প্রেমকে পরীক্ষা করেছেন।

তোমার যখন বিয়ে হয়ে গেল তখন কুরআন-হাদিসের ভালো জ্ঞান না থাকায় দতা বুঝতে না পেরে নামায-রোযা ছেয়ে তোমাকে ভুলে থাকার জন্য মদ ধরি। তারপর তাঁরই করুনায় আমাকে শাস্তি দিয়ে তোমাকে আমায় দান করলেন এবং আমার জ্ঞানের চোখ খুলে দিলেন। সেই জন্যে তাঁর পাক দরবারে কোটি কোটিবার শুকরিয়া আদায় করছি এবং আজীবন করতে থাকবো। তোমাকে ছাড়া এ দুনিয়ায় আমার আর কোনো কিছু কাম্য ছিল না, এখনও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না।

স্বামীর কথা শুনতে শুনতে ঝর্ণার চোখ দিয়ে পানি পড়া বলল, তুমি যে আমাকে এত ভালবাস, আমি কি তার উপর আমি কি ে কণামাত্র প্রতিদান দিতে পারছি?
সাইফুল তাকে আলিঙ্গন মুক্ত করে দু’হাতে তার মাথা চুমোয় ভরিয়ে দিয়ে বলল, তোমার কাছ থেকে কতটুকু কি না পেলাম, সেদিকে কখনো খেয়াল করি নি। তোমায় পেয়ে আমার আশা-আকাংখা পূর্ণ হয়েছে, সেটার আমার কাছে সব থেকে বড় পাওয়া। তবু তুমি আমার জন্য যা কিছু করছ, তাতে করে আমার মনে হয়, পৃথিবীর কোনো মেয়েই বোধ হয় তার স্বামীকে এত ভালবাসে না, এত প্রেমও দেয় না। দেশে ফিরে ব্যবসা দেখতে গেলে, সারাদিন তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে মনে করলে ফিরতে ইচ্ছা করে না।

ঝর্ণা স্বামীর মাথা ধরে সারা মুখে প্রতিদান দিয়ে বলল, টপ, প্লিজ সাপ। তোমার প্রেমের তুলনায় আমারটা কোটি কোটি ভাগের এক ভাগও নয়। আমাকে ছেড়ে সারাদিন ব্যবসার জন্য বাইরে থাকার কথা যে বললে, তা ঠিক নয়। রুরুষত্ব থাকতে হবে। বৌয়ের কাছে সব সময় থাকলে পোকে পৈ বলবে। তা হওয়া তোমার চলবে না। আমি আমার প্রিয়তম স্বামীকে পুরুতম দেখতে চাই। আমার জন্য লোকে তোমায় নিন্দে করবে, তা আমি সহ্য করতে পারব না। তা ছাড়া আল্লাহপাকের রহমতে ভবিষ্যৎ বংশধর আসছে। তার জন্য তোমার কি কিছু করা উচিত না?

সাইফুল ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে আনন্দে তাকে পাঁজাকোলা করে ভুলে দু’তিন পাক ঘুরপাক খেয়ে আদর-সোহাগে অস্থির করে তুলল।
ঝর্ণা প্রতিদান দিতে দিতে বলল, এই কি হচ্ছে? প্লীজ, ছেড়ে দাও। এই সময় এই রকম করা ঠিক নয়।
সাইফুল তাকে খাটে বসিয়ে বলল, তুমি ঠিক কথা বলেছ, আমার সে কথা মনেই নেই। তারপর আবার বলল, তুমি মা হতে চলেছ, এতদিন বলনি কেন বলে তাকে শুইয়ে তার ঠোঁটে একটু জোরে কামড়ে দিয়ে বলল, অন্যায়ের শাস্তি দিলাম। তারপর তার বুকে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করল, ক’মাস ?

ঝর্ণা তাকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল, অত জোরে কামড়ালে ব্যথা লাগে না বুঝি? সাইফুল বলল, লাগবার জন্যই তো কামড়ালাম। বললাম না, অন্যায়ের শাস্তি? এখন যা জিজ্ঞেস করলাম বল।
যাও বলব না, আমার লজ্জা করছে।
পাক লজ্জা, তবু বল ।
বলব না ।

সাইফুল তার হাত দুটো ধরে মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, বল বলছি, নচেত
কামড়ে ঠোঁট ফুলিয়ে দেব।
ব্যাথা পাব না বুঝি?
সেই জন্যে তো কামড়াব। তুমি বলছ না কেন?

চোখ বন্ধ করে নিল । তিন মাস বলে ঝর্ণার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে তাকিয়ে থাকতে না পেরে সাইফুল তার হাত ছেড়ে দিয়ে আলতো করে তার ঠোঁটে চুমো খেয়ে বলল, এবার তা হলে দেশে ফিরতেই হয় কি বল?
ঝর্ণা স্বামীর মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ইনশাআল্লাহ ফিরব। এবার একটা কথা বলি?

বল।
একটা কথা ভেবেছি।
কি ভেবেছ বলবে তো।
আমি তো তোমার অফিসের ম্যানেজারের এতদিন পি. এ. ছিলাম। দেশে ফিরে
অফিসের সাহেবের পি.এ. হতে চাই ।
সাহেবের স্ত্রী হয়ে থাকতে বুঝি আর ভালো লাগছে না?
সাহেব যে বলল, সে তার স্ত্রীকে ছেড়ে সারাদিন অফিসে থাকতে পারবে না।

হলে তো সেই একই কথা । পি. এ. হলেও তো সাহেবের কাছে থাকতে পারছ না। পাশের রুমে থাকবে। তা
তা কেন? সাহেব যলন ইচ্ছা ডেকে কাজের বাহানায় সামনে বসিয়ে রাখবে। বাহানায় ডেকে খোশ গল্প করে । আজকাল তো অফিসের বসরা সুন্দরী যুবতী মেয়ে স্টাফদের যখন তখন কাজের সাইফুল বুঝতে পারল, ঝর্ণা আগের অভিজ্ঞায় তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে। বলল,দেখ, বেশি ফাজলামী করলে কামড়ে গালের মাংস তুলে নেব। তখন টের পাবে । তারপর একটু আহত স্বরে বলল, আমি ঐসব নোংরা ফাজলামি ভালবাসি না।

করে ফেলেছি, দয়া করে মাফ করে দাও ।
ঝর্ণা নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাত জোড় করে বলল, অজ্ঞানতার কারণে অন্যায়
তার সঙ্গে ফাওটাও দিচ্ছি বলে সাইফুল তাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেতে লাগল ।
দীর্ঘ এগার মাস পরে তারা ফিরে এল । মনিরা ও নাজনীন ঝর্ণার প্রেগনেন্সির কথা শুনে খুশী হল । সাইফুল ভবিষ্যৎ বংশধরের চিন্তা করে ব্যবসায় মন দিল ।

মাসখানেক পর মনিরা একদিন সাইফুলকে বলল, আমরা সবাই এ বাড়িতে চলে আসি। ওখানে আমার একদম মন টিকে নি। অত বড় বাড়িতে নাজনীনকে নিয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। শুধু শুধু আমাদের দু’জনের জন্য বাড়িটা ফেলে রাখবি কেন? তারচেয়ে ভাড়া দিয়ে দে। এ বাড়িতে কত রুম খালি পড়ে আছে। তা ছাড়া তুই তো সারাদিন অফিসে থাকিস ঝর্ণার পেটে বাচ্চা। ওকে এখন সাবধানে রাখতে হবে। ওর দিকে লক্ষ্য রাখবে কে?

সাইফুল বলল, বুবু, তুমি ঠিক কথা বলেছ। সেই ব্যবস্থাই করব।
মনিরা বলল, আর একটা কথা, তোরা দু’জনেই ছেলে মানুষ। তাই বলছি, ঝর্ণাকে নিয়ে তুই একবার দেশে যা। তোর শ্বশুর-শাশুড়ীকে সালাম করে ওনাদের দোয়া নেয়া কর্তব্য। তা ছাড়া ঝর্ণা ওনাদেরকে যেমন অনেক দিন দেখে নি, তেমনি ওনারা মেয়েকে ঘর থেকে বের করে এতদিন মানষিক যন্ত্রণায় ভুগছেন। যত তাড়াতাড়ি পারিস ওনাদের সঙ্গে দেখা করে আয়। আর সেই সঙ্গে আব্বা জহুর চাচাকে আমাদের ঘরে রেখে যে সমস্ত আবাদি জমি-জায়গা ভাগ চাষে দিয়ে এসেছিল, সেসবের হিসাবপত্র করে আমদের পাওনা আদায় করবি।

সাইফুল বলল, তুমি খুব ভালো কথা বলেছ, এটা করা একান্ত উচিত। তোমরা কালকেই গোচগাছ করে এখানে চলে আস। আমি দু’একদিনের মধ্যে ঐ বাড়ির সব মালপত্রও এখানে নিয়ে চলে আসব। তারপর সামনের মাস থেকে ভাড়া দেয়ার ব্যবস্থা করব।
মামা-মামী দেশে যাবে শুনে নাজনীন বলল, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাব ।
ঝর্ণা বলল, নিশ্চয় যাবে। তারপর মনিরাকে বলল, বুবু তুমিও চল না ।

মনিরা বলল, আগে তোরা ঘুরে আয়, তারপর কাউকে নিয়ে আমি পরে যাব। বাসায় একজনকে থাকতে হবে না?
মনিরা ও নাজনীন গুলশানের বাসায় চলে আসার এক সপ্তাহ পর সাইফুল ঝর্না ও নাজনীনকে নিয়ে গাড়ি করে রওয়ানা দিল। নাজনীন সামনে সিটে বসেছে। আর ওরা দু’জন পেছনে ।

পথে একসময় সাইফুল ঝর্নাকে বলল, তোমার বাবা ও ভাইয়ারা আমাকে চেনেন । যদি আমাকে অপমান করেন?
ঝর্ণা বলল, বুবু যেদিন দেশে যাওয়ার কথা তোমাকে বলল, সেই দিনই আমি আব্বাকে চিঠি দিয়ে সব কিছু জানিয়েছি। আর সেই সঙ্গে নাজনীনকে নিয়ে আমরা যে আজ রওয়ানা দেব, সে কথাও টেলিগ্রাম করে জানিয়েছি।

সাইফুল বলল, সত্যি মাঝে মাঝে আমি তোমার বুদ্ধি দেখে অবাক হয়ে যাই। সে জন্যে তোমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
নাজনীন শুনতে পেয়ে বলে উঠল, মামা, ধন্যবাদে আমারও কিছু অংশ পাওনা আছে। টেলিগ্রাম করার বুদ্ধিটা আমি মামীকে দিয়েছিলাম ।
সাইফুল হেসে উঠে বলল, তুইও তো দেখছি বেশ বুদ্ধিমতী হয়ে উঠছিস?

বহুদিন পর মেয়ের চিঠি পেয়ে হামিদ সাহেবের চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল । সেসময় রাগের মাথায় যা তা বলে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন ঠিক; কিন্তু দিনের পর দিন তার খোঁজ না পেয়ে খুব অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলেন।
আফসানা বেগম ভাত খেয়ে বিছানায় একটু কাত হয়েছিলেন। অসময়ে স্বামীকে একটা খাম হাতে করে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে বসে এতক্ষণ স্বামীর দিকে চেয়েছিলেন । চিঠি পড়া শেষ করে তাকে পাঞ্জাবীর খুঁটে চোখ মুছতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কার চিঠি? তোমার চোখে পানি কেন?

হামিদ সাহেব সরাসরি স্ত্রীর কথার উত্তর না দিয়ে ভিজে গলায় বললেন, জान আসারের মা, কয়েকদিন ধরে বার্ণার কথা বড্ড মনে পড়ছিল। মেয়েটার কথা চিন্তা করে মনটাও খারাপ হয়েছিল। আল্লাহপাকের দরবারে শুকরিয়া জানাই, তিনি সেই দুঃশ্চিন্তা থেকে আমাকে রেহাই দিলেন। তারপর তিনি চুপ করে গেলেন।

আফসানা বেগম স্বামীকে চেনেন। ভীষণ রাশ ভারি মানুষ। একটা কথা দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করলে রেগে যায়। নিজের ইচ্ছায় কিছু না বললে, একটা কথারও উত্তর দেয় না। স্বামীকে চুপ করে থাকতে দেখে ভাবলেন, আজ হঠাৎ ঝর্ণার কথা বলল কেন? তা হলে এই চিঠি কি সে দিয়েছে? সে কথা ভেবে আফসানা বেগমের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। প্রায় রাত্রে শুয়ে শুয়ে মেয়ের জন্য কাঁদেন। একমাত্র মেয়েকে সেদিন তাড়িয়ে দিতে আফসানা বেগমের স্বামীর উপর প্রচণ্ড অভিমান হয়েছিল। সেই জন্য কোনোদিন তিনি স্বামীকে বা ছেলেদেরকেও ঝর্ণার খোঁজ নিতে বলেন নি। আজ স্বামীর মুখে মেয়ের কথা শুনে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

হামিদ সাহেব এতক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। স্ত্রীর কান্নার আওয়াজ শুনে সম্বিত ফিরে পেয়ে বললেন, কাঁদছ কেন? আল্লাহপাকের ইচ্ছার ঝর্ণা ভালো আছে। দু’একদিনের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে আসছে। তারপর তিনি বারান্দায় এসে চেয়ারে বসে একটা কাজের মেয়েকে দিয়ে তিন ছেলে ও তিন বৌকে ডেকে পাঠালেন। তারপর একজন চাকরকে বললেন, বৈঠকখানা থেকে ছ’সাতটা চেয়ার এখানে নিয়ে এস।

মাত্র কয়েকদিন আগে হামিদ সাহেবের ছোট ছেলে সবুজ স্ত্রী ও এক ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছে। সবুজের স্ত্রী এলিসার বাংলাদেশ দেখার খুব সখ । তাই স্বামীর সঙ্গে এসেছে। এলিসা খুব ভালো মেয়ে। বিয়ের পর স্বামীর কাছে বাংলা শিখেছে। বাংলা কিছু কিছু বোঝে এবং ভেঙ্গে ভেঙ্গে বলতেও পারে। খুব বুদ্ধিমান মেয়ে, এই ক’দিনে বাড়ির সকলের সঙ্গে বেশ এ্যাডজাস্ট করে ফেলেছে।

মারুফ অসুস্থ হয়ে দু’তিন দিন হল রংপুর থেকে বাড়িতে এসেছে। সবাই একে পিছনে এসেছেন। একে বারান্দায় এসে বসল । আফসানা বেগম আগেই নিজের রুম থেকে স্বামীর পিছনে সকলে আসার পর হামিদ সাহেব বললেন, আল্লাহ যার তকদিরে যা লিখেছেন তা হৰেই । তাকে প্রতিহত করার ক্ষমতা কারো নেই। ঝর্ণা এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে।

সে যত বড় অন্যায় করুক না কেন, তার তকদিরে যা ছিল তাই হয়েছে মনে করে তাকে দু’একদিনের মধ্যে আসছে। আমাদের ক্ষমার চোখে দেখা উচিত। সে চিঠি দিয়েছে জামাইকে সঙ্গে নিয়ে চিঠিটা পড়ে শোনাও না । শুনে আফসানা বেগমের চোখে পানি এসে গেল, আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
হামিদ সাহেব বড় ছেলে আবসারকে চিঠিটা দিয়ে পড়তে বললেন ।

আবসার চিঠিটা খুলে পড়তে লাগল-
আব্বাজান ও আম্মাজান, (আসসালামু আলায়কুম)
আদব তসলিমৎ বহুৎ বহুৎ সালাম পাক কদমে পৌঁছে। ভাইয়াদের ও ভাবিদের সালাম এবং তাদের ছেলেমেয়েদের আন্তরিক দো’য়া ও স্নেহাশীষ জানাচ্ছি। বাদ আরজ এই যে, আজ প্রায় পাচ বছর হতে চলল তোমাদের সবাইয়ের মনে কষ্ট দিয়ে চলে এসেছিলাম। স্বল্প জ্ঞানের কারণে তখন আমি যে ভুল করেছিলাম, সে জন্যে তোমরা যেমন অশান্তি ভোগ করেছ তেমনি আমিও চরম অশান্তি ভোগ করেছি। আল্লাহপাকের অপার মহিমায় তিনি আমার দিকে করুণার দৃষ্টি দিয়ে কুরআন-হাসিদের জ্ঞান দান করে সেই পথে পরিচালিত করেছেন। সেই সঙ্গে আমাকে আমার অন্যায় কাজের সংশোধন করিয়ে নতুন জীবন দান করে ধন্য করেছেন। সেই জন্যে তাঁর পাক দরবারে হামেশা শুকরিয়া আদায় করছি।

আব্বা, তোমরা জেনে কি মনে করবে জানি না, যাকে বিয়ে করে তোমাদের সকলের মনে কষ্ট দিয়েছি এবং তুমি সে সময় তার সম্বন্ধে যা কিছু বলে গালাগালি করেছিলে, ঢাকায় ফিরে এসে তার সেই সব রূপ দেখলাম । টাকা নিয়ে আসতে পারিনি বলে প্রথম দিকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দিত। তারপর অত্যাচারের উপর অত্যাচার চালিয়ে টাকার ব্যবস্থা করতে বলে। শেষে টাকা রোজগারের জন্য আমার ইজ্জতের উপর হামলা চালায়।

আমি রাজি না হতে ভীষণ মারধোর করে তাড়িয়ে দেয়। এটাই আমার ভুলের শাস্তি আল্লাহপাক নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। তারপর সেই করুণাসিন্ধু, যাঁর করুণা সারা বিশ্বে সর্বদা বর্ষিত হচ্ছে, আমার দিকে করুণার দৃষ্টি দান করে তার রহমতের ছায়ায় নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় দিলেন। এক বছর সেই আশ্রয়ে থাকার পর আল্লাহর এক খাস বান্দার সঙ্গে তাঁরই ইচ্ছায় আমার দ্বিতীয় বিয়ে হয়। তাকে দেখলে তোমরা চিনতে পারবে। তোমাদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, তোমাদের জামাইকে কোনোরকম অসম্মান করবে না। আমি তার এতটুকু অসম্মান সহ্য করতে পারব না।

সম্মান দেখাতে না পারলেও অসম্মান করবে না। শুধু এইটুকু মনে রেখ, ওকে স্বামী হিসাবে পেয়ে আমি এত সুখ শান্তি পেয়েছি, তা তোমাদের বোঝাতে পারব না। তাই আবার অনুরোধ করছি, তাকে অসম্মান করে আমাকে অশান্তির আগুনে তারিখ নাগাদ রওয়ানা দেব। তোমরা কে নিক্ষেপ করো না। আমরা ইনশাআল্লাহ কেমন আছ জানি না । আশা করি, আল্লাহপাকের রহমতে ভালো আছ। আমরাও তাঁরই করুণায় ভালো আছি। সবশেষে তোমাদের পবিত্র কদমে সালাম জানিয়ে এবং আল্লাহপাকের দরবারে তোমাদের সকলের সহিসালামতের জন্য দোয়া চেয়ে শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ’।

ইতি
তোমাদের অবাধ্য মেয়ে ঝর্ণা

চিঠি পড়া শেষ করে আবসার সকলের দিকে তাকিয়ে দেখল, সবাই আব্বার দিকে তাকিয়ে আছে।
হামিদ সাহেব চোখ বন্ধ করে রয়েছেন। ওনার দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।

সবুজের আমেরিকান বৌ এলিসা শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলল, আপনি কাঁদছেন কেন? আজ তো আনন্দের দিন। আমি আপনার ছেলের কাছে ঝর্ণার কথা কিছুটা শুনেছিলাম। এখন তার সমস্ত ঘটনা জেনে বুঝতে পারলাম। সে প্রথম স্বামীর কাছে অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন দ্বিতীয় স্বামীর কাছে সুখে-শান্তিতে আছে। বর্তমান স্বামীকে আপনারা চেনেন লিখে জানিয়েছে। সে যেই হোক না কেন, ঝর্ণা তাকে পেয়ে যখন সুখী হয়েছে তখন তাকে আমাদের সাদরে গ্রহণ করা উচিত । আমার বিবেক তাই বলে ।

হামিদ সাহেব বিদেশী বিদেশী বৌয়ের কথা শুনে চোখ মুছে বললেন। তারপর আল্লাহর শোকর আদায় করে বললেন, আল্লাহপাকের ইচ্ছা বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারে না। তিনি যা কিছু করেন বান্দার মঙ্গলের জন্য করেন। জামাই যেই হোক না কেন, সবাইকে মনে সে এ বাড়ির জামাই । তাকে সেরকম সম্মান দেখাতে হবে। একবার ভুল করেছি, তার পুনরাবৃত্তি আর করতে চাই ।

ঝর্ণার ভাইয়েরাও এবার বোনের জন্য একদিন অশান্তি ভোগ করছিল। তার বলল, ঝর্ণাকে ও তার স্বামীকে কোনো খবর জেনে খুব খুশী । আব্বার কথা শুনে তারাও আল্লাহর শোকর আদায় করে বলল, ঝর্ণা ও তার স্বামীকে কোন রকম অসম্মান করব না।

চিঠি পাওয়ার পরের দিন টেলিগ্রাম পেয়ে হামিদ সাহেব ছেলেদেরকে বললেন, আগামী কাল সন্ধ্যের দিকে ওরা এসে পড়তে পারে। তোমরা এর মধ্যে সমস্ত আত্মীয়- স্বজন ও গ্রামের মানুষকে সংবাদটা আনিতে দাওয়াত করে তাদের খাওয়াবার ব্যবস্থা কর। আমি সবাইয়ের সামনে মেয়ে-জামাই ঘরে তুলব।

গ্রামের মানুষ ও আত্মীয়-স্বজনেরা শুনেছিল, চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে ঢাকার পড়াশোনা করতে করতে প্রেম করে বিয়ে করেছিল বলে তিনি মেয়ের কোনো খোঁজ-খবর রাখেন নি। এখন তারা বলাবলি করতে লাগল, হাজার হোক একমাত্র মেয়ে, কতদিন আর রাগ করে থাকবেন।

ঐদিন চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে দাওয়াত খেতে গ্রামের বহু লোকজন এসেছে। আত্মীয়-স্বজনে ঘর ভরে গেছে। সন্ধ্যের পর থেকে বাওয়ান হচ্ছে। এক সময় রাত সাড়ে আটটার দিকে একটা ট্যাক্সী চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির সামনে এসে থামতে দেখে ছোট বড় অনেকে গাড়ির চারপাশে ভীড় করে দাঁড়াল।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে পিছনের গেট খুলে দিলে সাইফুল আগে নেমে সবাইকে সালাম দিল। তারপর ঝর্ণা ও নাজনীন নেমে সাইফুলের পাশে দাঁড়াল।
পড়ে ফিরছিরেন। বড়রা সালামের উত্তর দিয়ে অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। একটা ছেলে ছুটে গিয়ে হামিদ সাহেবকে খবর দিল। তিনি তখন মসজিদ থেকে এশার নামায পড়ে ফিরছিলেন।

খবরটা শুনে তিনি হন্তদন্ত হয়ে তাদের কাছে এসে সাইফুলের দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ততক্ষণে ঝর্ণার ভাইয়েরাও শুনে সেখানে এসেছে।
নাজনীন তাকে অনুসরণ করল । সাইফুল তাদেরকে চিনতে পেরে সালাম দিয়ে কদমবুসি করতে গেলে ঝর্না ও হামিদ ‘সাহবে অনেক দিন আগে সাইফুলকে দেখেছেন। তিনি স্কুলের সেক্রেটারী ভালো ছাত্র হিসাবে তাকে স্নেহ করতেন। ঝর্নাকে চিঠি দিয়েছিল বলে সেই সময়ে তিনি রেগে গিয়েছিলেন।

কিন্তু পরীক্ষা না দিয়ে নিরুদ্দেশ হওয়ার কথা শুনে তার ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা ভেবে মনে একটু দুঃখও পেয়েছিলেন। জামাইকে দেখে সাইফুলের কথা মনে পড়ল। ভাবলেন, জামাই অনেকটা সাইফুলের মতো দেখতে। সাইফুল কদমবুসি করে দাঁড়াতে হামিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ওসমানের ছেলে সাইফুল না?

সাইফুল জি বলে লজ্জা পেয়ে মাথা নীচু করে নিল । হামিদ সাহেব তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, এতে লজ্জা পাওয়ার কি আছে। আমাদের গ্রামের একজন সামান্য লোকের ছেলে হয়ে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় নিজের চেষ্টায় এত বড় হয়েছ, এটা তো গর্বের কথা। দেশের ছেলেদের উচিত তোমার আদর্শ অনুসরণ করা ।

তারপর ঝর্না কদমবুসি করতে তাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমো খেয়ে বললেন, তোদেরকে পেয়ে আমার যে কত আনন্দ হচ্ছে তা আল্লাহপাক জানেন। সেদিন রাগের মাথায় তোকে যা তা বলেছিলাম, সে সব মাফ করে দিয়েছিস তো?

ঝর্না ছলছল নয়নে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, আব্বা, একি কথা বলছ? ছেলেমেয়ে দোষ করলে বাপ-মা তো রাগারাগি করবেই। আমি বরং সেদিন তোমার কথার অবাধ্য হয়ে অন্যায় করেছি। সেজন্য সকলের কাছে মাফ চাইছি। নাজনীন ওনাকে সালাম করতে ঝর্না বলল, আমার বড় ননদের মেয়ে।
হামিদ সাহেব তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে দোয়া করলেন।

তারপর ছেলেদেরকে বললেন, তোমরা দাঁড়িয়ে রয়েছ কেন? এদেরকে ঘরে নিয়ে যও। ভিতরে এসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর শ্বশুর-শাশুড়ী কেমন আছে? ঝর্ণা বলল, আমার বিয়ের আগে ওনারা মারা গেছেন ।
হামিদ সাহেব “ইন্না নিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন’ পড়ে বললেন, আল্লাহ তাদের রুহের মাগফেরাত দান করুক । তোর শ্বশুর খুব সৎ ও ধার্মিক লোক ছিল।

গ্রামের লোকজন ওসমানের ছেলের অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেল। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে লাগল, একেই বলে ভাগ্য। আল্লাহ কার ভাগ্যে কি রেখেছে, তা কেউ বলতে পারে না ।

পরের দিন গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে গেল, ওসমানের ছেলে খুব বড়লোক হয়ে চেয়ারম্যানের মেয়েকে বিয়ে করে দেশে ফিরেছে। অনেকে সাইফুলকে এক নজর দেখার জন্য হামিদ সাহেবের বাড়িতে ভীড় করতে লাগল। সাইফুল ছোট-বড়, গরিব- ধনী সকলের সঙ্গে হাসিমুখে আলাপ করে বিদায় দিল ।
এদিকে ঝর্নার সঙ্গে তার ভাবি এলিসার খুব ভাব হয়ে গেল। এলিসা ঝর্ণাকে জিজ্ঞেস করে তার সব ঘটনা শুনে বলল, তুমি খুব ভাগ্যবতী। কোনো ছেলে কোনো মেয়েকে সাইফুল ভাইয়ের মতো ভালবাসতে কখনো শুনি নি ও দেখি নি ।

সাইফুল ঘুরে ঘুরে গ্রামের সকলের সঙ্গে দেখা করে তাদের খোঁজ-খবর নিতে লাগল । এক সকালে বন্ধু মোরসেদের বাড়িতে গিয়ে সালাম ও কুশলাদি বিনিময় করল । মোরসেদ বলল, আমি গতকাল রংপুরে গিয়েছিলাম। আজ ফিরে তোর কথা শুনেছি। বিকেলে তোর সাথে দেখা করতে যাব ভাবছিলাম। তা তুই একা এলি যে? তোর বৌ কোথায়?

সাইফুল বলল, মসজিদ থেকে ফজরের নামায পড়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম। অন্য একদিন নিয়ে আসব ।
মোরসেদ ফুপাতো বোন নাফিজাকে বিয়ে করেছে। সে পুকুরঘাটে হাঁড়ী বাসন মাজতে গিয়েছিল। ফিরে এসে খরব পেয়ে তাদের কাছে এসে সালাম দিয়ে বলল, সাইফুল ভাই, কেমন আছেন? একা কেন? ভাবি কই?

নাফিজাকে সাইফুল স্কুলে পড়ার সময় থেকে মোরসেদের ফুপাতো বোন হিসাবে চেনে। সাইফুল ও মোরসেদ যখন ক্লাস টেনে তখন নাফিজা সেভেনে পড়ত । সালামের জবাব দিয়ে সাইফুল বলল, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি। তারপর তাদের সঙ্গে গল্প করে, নাস্তা খেয়ে সাইফুল ফিরে এল। ঝর্ণা স্বামীর অপেক্ষায় এখনো নাস্তা খাই নি। বেলা দশটার সময় সাইফুল ফিরে এখনো খাওয়া হয় নি । এলে বলল, এত বেলা পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে অসুখ করবে তো।

তোমার জন্য আমার সাইফুল অনুতপ্ত সুরে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে। তুমি নাস্তা খেয়ে নাও। আমি মোরসেদের বাড়িতে খেয়ে এসেছি। খেয়ে এসে ঝর্ণা বলল, সকলের সঙ্গে যে দেখা করে বেড়াচ্ছ, আসবার সময় বুবু কি বলে দিয়েছিল মনে নেই বুঝি?
আছে, আজ বিকেলে যাব ।
আমিও তোমার সঙ্গে যাব। শ্বশুর বাড়ি দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।
বেশ তো যাবে । আমি কি ভেবেছি জান?
না বললে জানব কি করে?

ভেবেছি, এবার এখানে একটা বাড়ি করব। পুকুর কাটার। পুকুরের পাড়ে নানা আর ফল পাকড় খাওয়াও হবে । রকম ফলের গাছ লাগাব। আমরা প্রতি বছর আম, কাঁঠাল খেতে আসব । বেড়ানও হবে ঝর্ণা হেসে উঠে বলল, তোমার কথা শুনে একটা প্রবাদ বাক্য মনে পড়ল- বিবি ফল পাকড় খেতে আসবে। বাড়তে বাড়তে মিয়া খতম।’ প্ল্যানটা এখনও তোমার মনে । আর বলছ কিনা প্রতি বছর মিয়া খতমের ব্যাপারটা আল্লাহর হাতে। বিবি বাড়তে বাড়তে মিয়া বেঁচে থাকতেও পারে।

তবে হয়তো বুড়ো হয়ে যাবে। আর বুড়োরা যে কচি জিনিস খেতে ভালবাসে, সে কথা তুমি বোধ হয় জান না। মানুষ যত বুড়ো হয় তাদের মনটা তত কচি হয়। আমরা যদি মরেও যাই, আমাদের ছেলেমেয়েরা তো খেতে পারবে। আর আল্লাহ যদি হায়াতে রাখেন তখন বুড়ো হয়ে গেলেও কচি মনে খেয়ে আনন্দ পাব ।

আমি এমনি কথাটা বলেছি। আসলে তোমার প্লানটা খুব ভালো ।
বিকেলে সাইফুল ঝর্ণাকে নিয়ে তাদের বাড়িতে রওয়ানা দিল। নাজনীনেরও আমাকে নিয়ে অন্য একদিন যেতে হবে কিন্তু । যাওয়ার কথা। দুপুর থেকে তার জ্বর। তাই যেতে পারল না। সে মামাকে বলল,
সাইফুল বলল, তুই ভালো হয়ে গেলে নিয়ে যাব ।

গাড়ির রাস্তা নেই বলে ওরা হেঁটে চলল। হাঁটতে হাঁটতে ঝর্ণার ছেলেবেলার অনেক কথা মনে পড়তে লাগল । ঐ সময়ে এদিকে এসেছিল কিনা তার মনে নেই ৷ সাইফুলের বাড়ির কাছাকাছি এসে ঝর্ণা দেখতে পেল, টিনের চালের দু’কামরা বেড়ার ঘর। সামনে বেশ অনেকখানি উঠোন। উঠোনের চারদিকে নানারকম ফলের গাছ। একপাশে একটা গাভী ঘাস খাচ্ছে। তার আদলা বাছুরটা বাঁটে মুখ দিয়ে দুধ খেতে শ্যামলা রঙের তরুণী উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। খেতে মাঝে মাঝে গুঁতো দিচ্ছে। এক পাশে হাঁস-মুরগী থাকার খোঁয়াড়। একটা
উঠোনে এসে সাইফুল তরুণীটিকে বলল, তুই তারানা না?

তারানা আগের থেকে দেখতে পেয়ে ঝাঁট দেয়া বন্ধ করে তাদের দিকে তাকিয়েছিল। সাইফুলকে চিনতে পেরে বলল, সাইফুল ভাই আপনি? তারপর ঝর্ণাকে দেখিয়ে বলল, নিশ্চয় ভাবি?
সাইফুল বলল, বুঝতেই যখন পেরেছিস তখন বরণ করে ঘরে তুলবি তো। নতুন বৌ শ্বশুর বাড়ি এল, তুই ননদ হয়ে যদি কিছু না করিস, তবে কে করবে? চাচি কোথায় ?

তারানা ঝাঁটাটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে দু’জনকে কদমবুসি করল। তারপর ঝর্ণার একটা হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বলল, আম্মা পাশের বাড়িতে গেছে।
সাইফুল বলল, চাচা এখনও মাঠ থেকে ফেরে নি?
আজ শরীর খারাপ বলে মাঠে যাই নি। একটু আগে পাগারের জমিটা দেখতে গেল । ঘরে এনে চৌকির উপর তাদের বসতে বলে বলল, তোমরা বস, আমি আম্মাকে ডেকে আনি।

তারানা চলে যেতে ঝর্ণা ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, এরা কারা?
সাইফুল বলল, তারানার আব্বা জহুর আমার চাচা আব্বার দূর সম্পর্কের ভাই। ঢাকায় যাওয়ার সময় এদের উপর ঘর দুয়ার দেখার দায়িত্ব এবং জমি-জায়গা ভাগ চাষে দিয়ে যায়। তখন তারানা আরো ছোট ছিল।

তারানার মা সেতারা বানু স্বামীর মুখে সাইফুল ও ঝর্নার কথা জেনেছে। এখন মেয়ের মুখে তাদের আসার কথা শুনে তাড়াতাড়ি করে এসে তাদের ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করল। তারপর ঝর্ণার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে চুমো খেয়ে বলল, বেঁচে থাক মা, সুখী হও। তোমরা গল্প কর, আমি তোমাদের জন্য নাস্তা করি ।
সাইফুল বলল, আমরা নাস্তা খেয়ে বেরিয়েছি, ওসব কিছু লাগবে না, তারানা কোথায় গেল?
সিতারা বানু বলল, সে তোমার চাচাকে ডাকতে গেছে ।

একটু পরে তারানা আব্বার সঙ্গে ফিরে ঝর্ণাকে পাশের রুমে নিয়ে এসে গল্প করতে লাগল । জহুরকে দেখে সাইফুল সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, চাচা কেমন আছেন?

জহুর সালামের উত্তর দিয়ে বলল, আল্লাহ এক রকম রেখেছে বাবা। তা তোমাদের সব খবর ভালো? তোমার বাপ-মা সেই যে ঢাকায় গেল আর ফিরল না। আল্লাহ তাদেরকে তুলে নিল। কান্নায় তার গলা বুজে এল। জামার হাতায় চোখ মুছে বলল, মনিরা, নাজনীন কেমন আছে? ওরা এল না কেন?
বুবু পরে আসবে। নাজনীন এসেছে। আজ দুপুর থেকে জ্বর; তাই আসতে পারল না। আসার সময় বুবু বলে দিয়েছিল দু’তিন বছরের আমাদের কত কি পাওনা হিসাব করে নিয়ে যেতে। কিভাবে তা দেবেন বলুন?

জহুর বলল, তুমি যেভাবে নিতে চাইবে, সেইভাবে দেব। তবে এখন হয়তো পুরোটা দিতে পারব না। অভাবের সংসারে কিছু খেয়ে ফেলেছি। তোমরা যদি প্রতি
বছর আসতে তা হলে এরকম হত না।
সাইফুল বলল, যেটা খেয়ে ফেলেছেন সেটা আর দিতে হবে না। তবে এবার থেকে সব ঠিকঠাক রাখবেন। কিছুদিন পর আমি বুবুকে নিয়ে আসব, তখন নেব ।

এখানে একটা বাড়ি করার ইচ্চা করেছি। একটা পুকুরও কাটাব। আপনারা আবার দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আপনাদেরকে এখান থেকে চলে যেতে বলব না। আপনারাই ঐ বাড়িতে থেকে দেখাশোনা করবেন। আমরা মাঝে মাঝে এসে বেড়িয়ে যাব।
সাইফুলের আব্বা ওসমান ক্ষেতে-খামারে কাজ করলে কি হবে, সৎ ও ধার্মিক ছিল বলে গ্রামের প্রায় সকলে তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করত, জহুরও করত।

সাইফুলের কথা শুনে আবার তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠল। বলল, তোমার আব্বা ও আম্মার মতো লোক এযুগে খুব কম দেখা যায়। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতি করুক। তুমিও তোমার বাপের মতো হয়েছ। তোমাকে আল্লাহ বড় করেছে, আরো করুক। তোমাদেরকে সুখী করুক।
সিতারা বানু সরু চাকলি করে দুধ চিনিতে ভিজিয়ে মেয়েকে ডেকে বললেন, কিরে শুধু গল্প করবি নাস্তা খাওয়াবি না?
তারানা বলল নাস্তা তৈরি করতে তোমারই তো দেরি হল । দাও নিয়ে যাই।

নাস্তা খেয়ে আসরের নামায পড়ে সাইফুল ঝর্ণাকে নিয়ে তিস্তা নদীর পাড়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বট গাছের তলায় বসল। কিছুক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, জান ঝর্ণা; স্কুলে পড়ার সময় এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। প্রতিদিন বিকেলে এখানে বসে সন্ধ্যে পর্যন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতাম, আর তোমার কথা ভাবতাম ।
তুমি কবে থেকে আমার কথা ভাবতে?

স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম যেদিন ক্লাসে গেলাম, সেদিন তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগল। তারপর তোমার পরিচয় পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু মনকে মানাতে পারি নি। তাই তোমার দিকে যখন তখন হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। মাঝে মাঝে তোমার চোখে চোখ পড়ে গেলে তুমি রাগে মুখ ফিরিয়ে নিতে।

তোমাকে দেখলেই আমি রেগে যেতাম এবং আমার ঘৃণা হত, একথা জানার পরও এভাবে চিঠি দিলে কেন? তখন তোমার ভয় করে নি?
প্রথম দিকে ভালবাসা-টালবাসা তো বুঝতাম না। ছোটবেলা থেকে আমি সুন্দর জিনিষ খুব ভালবাসি। তাই তোমাকে খুব সুন্দরী দেখে শুধু দেখতাম। নাইনে উঠার পর তোমাকে ভালবেসে ফেললাম। তখন মনে হত তোমাকে ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে বিয়ে করতে পারব না। সে সময়ে ভয়ে তোমাকে কিছু জানাতে পারি নি।

তারপর পরীক্ষার পর তোমাকে আর দেখতে পাব না মনে করে ভালবাসার কথা জানাবার জন্য আমার মন পাগল হয়ে উঠেছিল। আর একটা কথা মনে হয়েছিল, আমি তোমাকে ভালবাসি জানার পর তুমি হয়ত একটু নরম হবে। তাই সাহস করে চিঠি দিয়েছিলাম 1 হেডস্যারের হাতে যার বাওয়ার পর আমার ওপর তোমার রাগ হয় নি? অথবা আমার প্রতি তোমার ভালবাসা ছুটে যায় নি?
যদি তাই হত, তা হলে তোমাকে কি আজ পেতাম?

ঝর্ণা অশ্রুভরা চোখে বলল, সেসব কথা মনে হলে আমি মরমে মরে যাই। আমার মনের মধ্যে যে কি রকম অনুশোচনা ও কষ্ট হচ্ছে তা আল্লাহকে মালুম। চোখ মুছে আবার বলল, সেসবের জন্যে তুমি যদি কিছু শাস্তি দিতে, তা হলে হয়ত কিছুটা শান্তি পেতাম ।
আমি শাস্তি দেয়ার আগেই তো কাঁদছ। শাস্তি দিলে কি করবে তা হলে? তোমার কোনো ব্যবহারই আমার মনে প্রতিহিংসা জাগাতে পারে নি। কারণ আমি আমার ভাগ্যকে সব সময় মেনে নিয়ে সবর করে থাকি।

তাই আল্লাহ সেই সবরের ফলস্বরূপ চিরকাঙ্ক্ষিত ঝর্ণাকে দান করে আমাকে না করেছেন। পরে তুমিও তোমার ভুল বুঝতে পেরে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে পাওয়ার জন্য সবর করেছিলে। তাই তিনি তোমারও মনের আশা পূরণ করেছেন। একটা কথা জেনে নাও, ‘সবরের গাছ খুব তীতা আর ফল খুব মিষ্টি।’ আমরা সবর করার দরুন তিনি আমাদের মনের আশা পূর্ণ করেছেন। সেজন্যে আমরা চিরকাল তাঁর শোকর গোজার করতে থাকব।
খুব খাঁটি কথা বলেছ। এবার চল মাগরিবের নামাযের সময় হয়ে আসছে।

ঝর্ণার ভাবিরা ননদের পেটে বাচ্চা আছে জানতে পেরে মহা খুশী। তারা শাশুড়ীকে সে কথা বলতে আফসানা বেগম আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বামীকে জানালেন। হামিদ সাহেব শুনে শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে হাসি মুখে বললেন, ওকে দেখে আমি সেই রকমই অনুমান করেছিলাম। আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে।

আফসানা বেগম বললেন, শুধু আনন্দ পেলে চলবে? মেয়ে জামাইকে একদিন ভালো করে খাওয়াতে হবে।
হামিদ সাহেব বললেন, ওরা কি রোজ খারাপ খাচ্ছে?
আফসানা বেগম হেসে উঠে বললেন, তুমি অত জ্ঞানীলোক হয়ে আমার এই সামান্য কথা বুঝতে পারলে না। মেয়েদের পেটে প্রথম বাচ্চা এলে তাকে নানারকম পিঠে-পাঠা ও ভালো-মন্দ জিনিস করে খাওয়াতে হয়, বুঝেছ?

হামিদ সাহেবও হেসে উঠে বললেন, আবসার যখন তোমার পেটে ছিল তখন তোমার আব্বা-আম্মা বুঝি তাই করে খাইয়েছিলেন?
আফসানা বেগম কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, খাইয়েছিলেন বইকি। ফিরে আসার সময় আমাদেরকে নতুন জামা-কাপড়ও পরিয়ে বিদায় করেছিলেন। তুমি সেসব ভুলে গেলে কি করে? আমাদেরকে এখন সেইসব করতে হবে।
হামিদ সাহেব বললেন, ওসব মেয়েদের ব্যাপার, আমাদের মনে থাকে না । যা করার তাই কর। তোমাকে নিষেধ করেছে কে?
আফসানা বেগম বললেন, তাতো করবই ।

পনের দিন পর ওরা ঢাকায় ফিরে এল। ঢাকায় ফেরার কয়েকদিন পর একদিন বেশ রাত করে সাইফুল বাসায় ফিরলে ঝর্ণা জিজ্ঞেস করল, আজ এত দেরি হল যে? আজ অফিসে একটা পার্টি দিয়েছিলাম, সেই জন্য দেরি হল ।
পার্টির কথা শুনে ঝর্ণার আমিনের পার্টির কথা মনে পড়ল । ভাবল, সে রকম পার্টি নয় তো?
মনে হচ্ছে কিছু যেন ভাবছ?
পার্টিতে মেয়ে মানুষ থাকে তাই না?
সাইফুল হেসে উঠে বলল, মদ, মেয়ে মানুষ না হলে পার্টিই হয় না। এটা পার্টির প্রধান উপকরণ । হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করলে কেন?

পার্টির কথা মনে হলে, প্রচণ্ড ঘৃণা ও ভয় হয়।
আমাকে কি তুমি অবিশ্বাস কর?
যেন আমার মৃত্যু হয়। ঝর্ণা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ভিজে গলায় বলল, তোমাকে অবিশ্বাস করার আগে
সাইফুল তার পিঠে আদরের চপেটাঘাত করে বলল, এরকম কথা বলতে নিষেধ করেছি না। তারপর তাকে খাটে বসিয়ে বলল, প্রথম ব্যবসায় নেমে পার্টিতে মদ ও মেয়ে মানুষের দিকে কোনো নজর দিই নি। তোমার বিয়ের পর মদের দিকে ঝুঁকে পেয়ে মদও ছেড়েছি। পড়লেও তোমার স্মৃতি মেয়ে মানুষের নেশা থেকে রক্ষা করেছে। আর এখন তোমাকে এর ফলে তোমার ব্যবসায় ক্ষতি হয় না?

আমি তো জানি ব্যবসায় বড় বড় অর্ডার আদায়ের জন্য ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্ত্রীকে ডানাকাটা পরীর মতো সাজিয়ে হত্তাকত্তাদের মন জুগিয়ে কাজ হাসিল করে। তোমার জানাকে অস্বীকার করব না। আজকাল শতকরা নিরানব্বই জন ব্যবসায়ী তাই করে। তারা এই জন্য করে, তাদের কাছে ধর্মের চেয়ে টাকাটা বড়। আমিও প্রথম প্রথম মেয়ে মানুষ ভাড়া করে এনে লাভারের ভূমিকায় অভিনয় করে কাজ হাসিল করেছি।

এখন পার্টি করলেও মদ ও মেয়েমানুষ বাদ দিয়ে করছি। তোমার সান্নিধ্যে এসে আল্লাহ আমাকে জানিয়েছেন, টাকার চেয়ে ধর্ম বড়। সেইজন্যে মনে হয়, আল্লাহ মদ ও মেয়ে মানুষ ছাড়াই আমার কাজ হাসিল করিয়ে দিচ্ছেন। তাই পার্টি শেষে মসজিদে এশার নামাযের দু’রাকাত শোকরানার নামায পড়ে এলাম ।
ঝর্ণা শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলে স্বামীর দুটো হাত ধরে বলল, তোমাকে পার্টির ঐ সব কথা জিজ্ঞেস করে অন্যায় করে ফেলেছি। মাফ করে দাও।
সাইফুল দুষ্টুমী করে বলল, যদি না করি?

তা হলে পায়ে ধরে কাদব।
আগে তাই করে দেখাও, তারপর চিন্তা করব ।
ঝর্ণা তার হাত ছেড়ে দিয়ে বসে তার পায়ে হাত দিতে গেলে সাইফুল তাকে ধরে বুকে জড়িয়ে বলল, যাও, মাফ করে দিলাম। তারপর বলল, তোমার কোনো অন্যায় হয় নি। আমি তোমার সঙ্গে একটু জোক করছিলাম। তোমার পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে যে জিজ্ঞেস করেছ, তা আমি বুঝতে পেরেছি। তা ছাড়া তোমার কথা তো মিথ্যে না। এখন চল খেতে দেবে। খিদে পেয়েছে।

ওমা, পার্টি থেকে এসে খেতে চাচ্ছ, সেখানে কিছু খাওনি?
খেয়েছি, তবে সামান্য ।
কেন?
তোমার সঙ্গে না খেলে আমার তৃপ্তি হয় না। তা ছাড়া আমি না খেলে, তুমি না
খেয়ে থাকবে যে ।
আবার অন্যায় করে ফেললাম, মাফ করে দাও ।
বারবার তুমি অন্যায় করলে মাফ করতে পারব না। শাস্তি পেতে হবে।

শাস্তি যা ইচ্ছা দাও, তবু মাফ চাই ।
তা হলে আমাকে একটু আদর সোহাগ কর।
ঝর্ণা স্বামীকে জড়িয়ে আদর সোহাগ করে অস্থির করে তুলল ।
সাইফুল ঝর্নার আদর সোহাগে উত্তেজিত হয়ে তাকে পাঁজাকোলা করে চুমো খেতে খেতে বলল, তোমাকে নিয়ে বিছানা…

ঝর্ণা তাকে কথাটা শেষ করতে দিল না। তার মুখে হাত চাপা দিয়ে মেকী চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, ভালো হবে না বলছি। তাকে খাটে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে দেখে কাকুতি- মিনতি করে বল, প্লীজ এখন ছেড়ে দাও। তুমি এসেছ সাবুর মা জানে। সে হয়তো বুবু ও নাজনীনকে খবরটা দিয়ে ডাইনিং টেবিল রেডী করে ফেলেছে। দেরি হলে সাবুর মাকে বুবু ডাকতে পাঠাবে। সময় তো পালিয়ে যাচ্ছে না।
সাইফুল তাকে ছেড়ে দিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করার সময় বলল, তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। ঝর্ণা স্বামীকে লুংগি দিয়ে তার জামাকাপড় ব্র্যাকেটে রাখার সময় বলল, মনে কিছু করলে?

করেছি। তবে তুমি যদি পালিয়ে যাওয়া সময়টা ধরে এনে আমার কাছে ধরা দাও, তা হলে মনে কিছু করব না।
হয়েছে হয়েছে, অত ন্যাকামু করতে হবে না। কখনো ধরা দিতে আপত্তি করেছি? তা অবশ্য করনি, তবে এখন পেটে বাচ্চা তো, তাই যদি শরীরে না কুলোয় ।
তোমার কি মুখে কোন লাইসেন্স ট্যাক্স নেই?
একদিন ছিল । তোমাকে বিয়ে করার পর আল্লাহ সে সব মওকুফ করে দিয়েছেন । আচ্ছা, কি লোক তুমি বল তো?
কেন? ঝর্ণার স্বামী ।

ঝর্ণা স্বামীর কোমর জড়িয়ে বলল, আর দুষ্টুমী নয়, খেতে চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে । সাইফুলও স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে বলল, চল ।
সেরাতে আমিন ঝর্ণাকে মারার পর পার্টিতে গিয়ে সাহেবকে মিথ্যে করে বলল, গতকাল থেকে আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ তাই আসতে পারে নি ।
আজিজ সাহেব শুনে খুব রেগে গেলেন। কিন্তু লোকজনের সামনে বাইরে ‘তা প্রকাশ করলেন না। বুঝতে পারলেন, মেয়েটা জেনেশুনে ইচ্ছা করে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে এল না। ভেবে রাখলেন, দেখবো কতদিন অজুহাত দেখিয়ে আমাকে ফাঁকি দিতে পারে।
আমিন মদে চুর হয়ে বাসায় ফিরল।

শায়লা বেগম ছেলেকে কোনো দিন মদ খেয়ে বাসায় ফিরতে দেখেন নি। আজ দেখে খারাপ লাগলেও কিছু বললেন না। ভাবলেন, যাওয়ার সময় বৌটাকে মারধোর করে গেছে, মন খারাপ, তাই হয়তো মদ খেয়ে এসেছে।
আমিন রুমে এসে নিজের খাটে ঘুমিয়ে পড়ল। তার তখন কোনো দিকে খেয়াল করার মতো অবস্থা ছিল না।
শায়লা বেগম বৌ যে চলে গেছে, সে কথা প্রথম জানতে পারেন নি। মনে করেছিলেন, মার খেয়ে হয়তো রাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছে। খাওয়ার সময় কাজের মেয়েকে বললেন, আমিন আজ বাইরে খেয়ে আসবে। তুমি বৌমার ভাত তার ঘরে দিয়ে এস।

কাজের মেয়ে ভাত নিয়ে গিয়ে ঝর্ণাকে দেখতে না পেয়ে টেবিলের উপর চাপা দিয়ে রেখে এসে বলল, আপাকে তো ঘরে দেখলাম না ।
শায়লা বেগম চিন্তিত হয়ে ছেলের রুমে এসে দেখলেন, আজ বৌ যে শাড়িটা পরেছিল, সেটা খাটের উপর জমা করা রয়েছে। ভাবলেন, তা হলে কি বৌ চলে গেছে? না কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে? তাড়াতাড়ি বাথরুম খুলে দেখলেন, নেই। কাজের মেয়েকে সব বাথরুম খুলে দেখতে বললেন।

ছোট ছেলেদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, আমরা জানি না। কাজের মেয়ে ফিরে এসে বলল, কোথাও নেই। শায়লা বেগম ভাবলেন, নিশ্চয় চলে গেছে। আমিন ফিরলে তাকে কথাটা বলার জন্যে এত রাত জেগে ছিলেন। ছেলের অবস্থা দেখে আর বললেন না ।
সকালে ঘুম থেকে জেগে আমিনের গত রাতের সব ঘটনা মনে পড়ল । স্ত্রীর খাটের দিকে তাকিয়ে শাড়িটা দেখে মনে সন্দেহ হল। তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে মাকে ডাকতে ডাকতে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার বৌ কোথায়?

শায়লা বেগম বললেন, তুই চলে যাওয়ার পর বৌ ঘরেই ছিল । তারপর আর বার হয় নি। রাতে খাওয়ার সময় খোঁজ নিয়ে দেখি নেই । কত খোঁজাখুঁজি করলাম, পেলাম না। মনে হয় চলে গেছে।
আমিন ক্রুদ্ধ বাঘের মতো গর্জন করে উঠল, তোমরা এতলোক থাকতে সে চলে গেল, তোমরা জানলে না?
শায়লা বেগম বললেন, আমরা যে যার রুমে রয়েছি। কে কখন কোথায় যাচ্ছে, জানব কি করে?

আমিন মাকে আর কিছু বলল না। নিজের রুমে আসার সময় গজ গজ করে বলল, যাবে কোথায়? যেখানেই যাক না কেন খুঁজে বের করবই। রুমে এসে বসে বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে লাগল, কার কাছে যেতে পারে? ঝর্ণা যে সত্যি সত্যি চলে যাবে, এটা সে ভাবতেই পারছে না। এক এক করে তার বান্ধবীদের কথা মনে করতে লাগল। বাব- মার কাছে যে যাবে না, সে কথা নিশ্চিত। আর যদি গিয়েও থাকে, তা হলে তো খুব ভালই হবে। মাস খানে পরে গিয়ে পরিচয় দিয়ে তাদেরকে বলবে, আপনাদের মেয়ে রাগ করে চলে এসেছে।

তাকে নিয়ে যেতে এসেছি। আবার ভাবল, ঝর্ণা যদি তার অত্যাচারের কথা বাবা-মা ও ভাইয়েদেরকে বলে দেয়, তা হলে তো বিপদ? কিন্তু তা বলে তো ঝর্ণাকে হাতছাড়া করা চলবে না। যেখানেই থাক না কেন ছলচাতুরি করে মাফ চেয়ে বুঝিয়ে সুজিয়ে আনতেই হবে। নচেৎ ব্যবসারও যেমন ক্ষতি হবে তেমনি ভবিষ্যতে তার বাবা ও ভাইদের কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারবে না। কা মারটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। তাই হয়তো রাগ করে কোনো বান্ধবীর বাসায় চলে গেছে। দু’চার দিন পর রাগ পড়লে ফিরে আসবে।

কিন্তু এক এক করে চার-পাঁচ মাস পরেও যখন ঝর্ণা ফিরল না তখন আমিন একজন লোককে তাদের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে খবর নিল সেখানে যায় নি। তারপর ঝর্ণার বান্ধবীদের অনেকের কাছে খোঁজ নিয়ে কোনো খবর পেল না। শেষে মাস ছয়েক পরে উকিলের ডির্ভোসের চিঠি পেয়ে বুঝল, সে ঢাকাতেই আছে। ডিভোর্সের দিন কোর্টে আমিন ঝর্ণার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হতে পারল না। কোর্ট থেকে ফিরে সে দু’টো গুণ্ডার সঙ্গে কন্ট্যাক্ট করল ঝর্ণাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসার জন্য।

গুণ্ডারা খোঁজ নিয়ে দেখল, খুব জাঁদরেল লোকের আশ্রয়ে ঝর্ণা থাকে। আমিন ৫ দু’টোকে ঝর্ণার ফটো দিয়েছিল। ঝর্ণা বাইরে বেরোবার সময় বোরখা পরে বের হয়। সেই জন্যে তারা ঝর্ণাকে চিনতে পারে না ।
বছর খানেক পর আমিন জানতে পারল, ঝর্ণা যাকে কামলার ছেলে বলে ঘৃণা করতো, সে এখন বড় ব্যবসায়ী এবং ঝর্না তাকেই বিয়ে করেছে। জানার পর তার মাথা গরম হয়ে গেল । গুণ্ডাদেরকে সাইফুলের বাসার ঠিকানা দিয়ে বলল, সাইফুলকে মার্ডার করে হলেও তোমরা ঝর্ণাকে আমার কাছে এনে দাও। তাতে যদি তোমাদের সঙ্গে যা কন্ট্যাক্ট হয়েছে তার দ্বিগুণ টাকা লাগে দেব।

গুণ্ডারা উঠে পড়ে লাগল । কিন্তু তারা শত চেষ্টা করেও সুযোগ সুবিধে করে উঠতে পারল না। তবু তারা হতাশ না হয়ে সুযোগের অপেক্ষায় রইল, ঝর্ণাকে কিডন্যাপ করার জন্য। আমিন গুণ্ডাদের কাছ থেকে সব খবর রাখছে। নিজেও লোক দিয়ে সাইফুলের অফিস থেকে তাদের অবস্থানের খবর নিয়ে গুণ্ডাদের জানাচ্ছে। বিদেশ থেকে ফেরার পর সাইফুল অফিসে আজ পার্টি দিচ্ছে জানতে পেরে আমিন গুণ্ডাদের সেই কথা জানাল ।

গুণ্ডারা সারাদিন সাইফুলের বাসার দিকে লক্ষ্য রাখল । সাইফুল পার্টি থেকে ফেরার পর তারা গেটে এসে ছল চাতুরী করে দারোয়ানকে গেট খোলাল। ঢুকেই একজন দারোয়ানের কানের গোড়ায় জুড়োর চাপ মেরে অজ্ঞান করে ফেলল। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে লাইলনের রশি বের করে হাত-পা বেঁধে গেটের আড়ালে শুইয়ে রাখল ।

তার মুখটা একটা বড় রুমাল দিয়ে বাঁধতে ভুলল না। দারোয়ানকে রেখে তারা বারান্দায় এসে কলিং বেলে চাপ দিল।
একজন বয়স্ক চাকর একটু আগে সাহেবকে দরজা খুলে দিয়েছে। সাহেব ঢোকার পর দরজা বন্ধ করে নিজের রুমে এসে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেল। সে দরজার পাশের রুমে থাকে। তার কাজই হল, দরজা খোলা এবং বন্ধ করা। সেই জন্যে সে সাহেবের অপেক্ষায় জেগে বসে ছিল । আবার বেল বাজতে শুনে বিরক্ত হয়ে ভাবল, এতরাতে আবার কে এল?

যেই সে দরজা খুলেছে অমনি তথা দুটো একসঙ্গে তাকে আক্রমণ করে অজ্ঞান করে দারোয়ানের মতো বেঁধে ফেলল। তারপর তাকে তার রুমে বন্ধ করে ভিতর বারান্দায় দুটো থামের আড়ালে দু’জনে আত্মগোপন করে সুযোগের অপেক্ষায় রইল।
ঝর্ণা ও সাইফুল যখন কোমর ধরাধরি করে রুম থেকে বেরিয়ে বারান্দা দিয়ে তাদের দিকে পিস্তল তাক করে বলল, হান্ডস আপ। ডাইনিং রুমের দিকে যাচ্ছিল তখন গুণ্ডাদের একজন থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে সাইফুল কংফু মাস্টার ছিল।

বিপদের সময় কি করা উচিত তার জানা। পিছন দিক থেকে কথাটা শুনেছে। ঝর্ণাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে পঁ করে ঘুরে গুণ্ডাটাকে দেখে সেখান থেকে জাম্প করে উড়ে এসে তার উপর পড়ল। গুণ্ডাটার চোখে ধাঁ ধাঁ লেগে গেল । তার মনে হল ভেল্কী দেখছে। ঘোর কাটিয়ে ওঠার আগেই সাইফুল তার উপর পড়তে দু’জনে মেঝেয় পড়ে গের। পিতলটা গুণ্ডাটার হাত থেকে ছিটকে পড়ে দেয়ালের কাছে চলে গেল। সাইফুল তার গর্দানে কয়েকটা চাপ মারতে সে জ্ঞান হারাল।

অন্য গুণ্ডাটা থামের আড়াল থেকে দেখে তার চোখেও ভেল্কী বলে মনে হয়েছিল। সাথির অবস্থা দেখে সে সাবধান হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি থামের আড়াল থেকে বেরিয়ে ঝর্ণার একটা হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে সাইফুলের দিকে পিস্তল তাক করে বলল, খবরদার, আর একচুল নড়বেন না, নচেৎ গুলি করতে আমার সঙ্গে। বাধ্য হব। তারপর ঝর্ণাকে বলল, আপনার স্বামীকে যদি বাঁচাতে চান, তা হলে চলুন ঝর্ণা তখন ভয়ে থর থর করে কাঁপছে। সে সাইফুলের দিকে তাকিয়ে কি করবে না করবে ভাবতে লাগল ।

গুণ্ডাটা অধৈর্য স্বরে বলল, কুইক ।
দেরি দেখে মনিরা কাজের মেয়েটাকে সাইফুল ও ঝর্ণাকে ডাকতে পাঠিয়েছিল। তারপর দৌড়ে ফিরে গিয়ে ব্যাপারটা মনিরাকে জানাল । সে বারান্দায় এসে ঐরকম ঘটনা দেখে প্রথমে খুব ভয় পেয়ে থতমত খেয়ে যায়।

শুনে নাজনীন বলল, আম্মা তাড়াতাড়ি থানায় ফোন করে দাও, আমি ওদিকে দেখছি। কথা শেষ করে নাজনীন যখন বারান্দার দরজার পর্দা ফাঁক করে উঁকি মারল, কুকুরের মত গুলি করে মারব। তখন গুণ্ডাটা ঝর্ণাকে তাগিদ দিয়ে বলছে, আমার সঙ্গে না গেলে আপনার স্বামীকে ঝর্ণা সাইফুলের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। বুঝতে পারল, সে তাকে ইশারা করে যেতে বলছে। ঝর্ণা ধীরে ধীরে পা পা করে এগোচ্ছে, এমন সময় নাজনীনকে মেঝেয় দেওয়ালের কাছে পড়ে থাকা পিস্তলটার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সাইফুল বলল, নাজ, তুই তোর হাতের লাঠিটা দিয়ে গুণ্ডাটার মাথায় খুব জোরে আঘাত কর ।

গুণ্ডাটার পিছনের দিকে থেকে নাজনীন আসছিল। সেদিক তাকিয়ে সাইফুলকে কথা বলতে শুনে সত্য-মিথ্যা দেখার জন্য গুণ্ডাটা একবার মুখ ঘুরিয়ে দেখতে গেল । সাইফুল এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। জাম্প করে উড়ে তার কাছে আসতে চাইল। কিন্তু এই গুণ্ডাটা আগেরটার চেয়ে বেশি চালাক। পিছনে এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে সাইফুলকে উড়ে আসতে দেখে পরপর তিনটে গুলি করল ।

প্রথম দুটো মিস হলেও শেষেরটা সাইফুলের পেটে পাগল। ততক্ষণে ছাইফুল তার ঘাড়ের উপর এসে পড়ে পিস্তলটা কেড়ে নিয়ে নাজনীনের দিকে ছুঁড়ে বলল, থানায় জলদি ফোন করে দে । তারপর গুণ্ডাটার কানের নীচে ও তলপেটে কয়েকটা ঘুষি অজ্ঞা করে ফেলল ।
তখন সাইফুলের রক্তে জামা কাপড় ভিজে মেঝেয় পড়িয়ে পড়ছে। গুন্ডটা অজ্ঞা হয়ে যেতে বসে পড়ে একহাতে পেট ধরে একটা চাকরকে দেখতে ফেয়ে বলল, রশি দিয়ে এদের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেল।

ঝর্ণা এতক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল। স্বামীর রক্ত দেখে হাউমা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আল্লাহ গো একি হল? তুমি রহম কর। নাজনীনকে বলল, জলদি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বল, এক্ষুনি মেডিকেল নিয়ে যেতে হবে।
নাজনীন ছুটে বেরিয়ে গেল ড্রাইভারকে গাড়ি বের করার কথা বলতে।

মনিরা থানায় ফোন করে এসে সাইফুলের রক্ত দেখে সেও তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, কই দেখি কোথায় গুলি লেগেছে?
সাইফুল গুলি খাওয়া জায়গাটা দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে, তবু রক্ত গল গল করে বেরোচ্ছে। সে ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগল। হাঁপাতে হাঁপাতে ঝর্ণাকে তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি, ওর পেটে বাচ্চা আছে, ওদেরকে তুমি দেখো। তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে বলল, আল্লাহপাক, তোমার ইশারা ছাড়া কোন কিছু হয় না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো। এদের সবাইকে হেফাজত করো।

ঝর্ণা স্বামীকে বুকে করে ধরে রেখে বলল, কথা বলতে তোমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি এবার চুপ কর ।
সাইফুল ঝর্ণার গালে গাল ঠেকিয়ে বলল, প্রিয়তমা আমার, তোমাকে নিয়ে বেশি দিন ঘর সংসার করা আমার ভাগ্যে নেই। তাই আল্লাহ আমার সমস্ত কামনা বাসনা পূরণ করে দুনিয়া থেকে তুলে নিচ্ছেন। ঝর্ণাকে কাঁদতে দেখে বলল, কাঁদছ কেন? তাঁর ইচ্ছায় চলে যেতে হচ্ছে। আল্লাহর কাছে ধৈর্য ধরার ক্ষমতা চাও। এবার কান্না থামিয়ে আমাকে বিদায় দাও প্রিয়তমা।

ঝর্ণা ভুলে গেল এখানে বড় ননদ, নাজনীন ও চাকর-চাকরানীরা রয়েছে। সে স্বামীর মাথা দু’হাত দিয়ে ধরে তার সারা মুখে চুমো খেয়ে বলল, বিদায় তোমাকে আমি নিতে দেব না, যেমন করে হোক ইনশাআল্লাহ বাঁচাবই। তারপর নাজনীনকে দেখে বলল, ড্রাইভার এখনও গাড়ি বার করে নি?

ড্রাইভার গাড়ি বের করে সাহেবকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঘরে ঢুকে ঝর্ণা কথা শুনতে পেয়ে বলল, তাড়াতাড়ি চলুন ।
সাইফুল টেনে টেনে বলল, শুধু শুধু তোমরা আমাকে মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছ। তারপর ঝর্ণাকে বলর, খুব পিয়াস লেগেছে, পানি দাও।
নাজনীন শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এক গ্লাস পানি নিয়ে এল।

ঝর্ণা গ্লাসটা স্বামীর মুখে ধরতে সাইফুল বিসমিল্লাহ বলে খেয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে জ্ঞান হারাল।
সাইফুলকে চুপ করে যেতে দেখে সবাই মিলে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে মেডিকেলে রওয়ানা দিল। চাকর-চাকরানী ছাড়া সবাই মেডিকেলে গেল ।
যাওয়ার সময় মনিরা চাকরদের বলল, পুলিশ এলে তাদেরকে ঘটনাটা বলে এদেরকে নিয়ে যেতে বলবে।

মেডিকেল আসার পর ডাক্তারা সাইফুলকে পরীক্ষা করে বলল, হি ইজ ডেড। শুনে মনিরা ও নাজনীন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আর ঝর্ণা প্রথমে কয়েক সেকেণ্ড থ করে হয়ে দাঁড়িয়ে রইল তারপর না…. বলে স্বামীর বুকের উপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারাল।

Read More: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top