নেক আমল বই #5 জানাযার নামাজ – কবরে ছওয়াল হইতে মুক্ত ব্যক্তিগণ

জানাযার নামাজ,

জানাযার নামাজ

কাফন

কাফন
মৃত্যুর পর যে কাপড় পরায়ে মানুষকে কবরস্থ করা হয় তাকেই কাফন বলা হয়। পুরুষের কাফনে সাত হতে সাড়ে সাত গজ কাপড়ের প্রয়োজন হয় । আর মহিলাদের দশ হতে সাড়ে দশ গজ কাপড়ের জরুরত হয়।

পুরুষের কাফন

পুরুষের কাফন
পুরুষের কাফনের ৩টি কাপড়ের প্রয়োজন হয় (১) চাদর, এর দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে চার হাত। এর দ্বারা পা হতে মাথা পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হবে। (২) ইযার, এর মাথা হতে পা পর্যন্ত হবে। এর দৈর্ঘ্য সাড়ে তিন হাত হবে। (৩) জামা বা কোর্তা ইহা সেলাই বিহীন হওয়া আবশ্যক। এতে আস্তিন বা কল্পি কিছুই থাকবে না। শুধু মাঝখানে মাথা ঢুকানোর জন্য একটু ছিড়া থাকবে। কোর্তা দ্বারা গলা হতে হাটুর নিচ পর্যন্ত ঢাকতে হবে। এর দৈর্ঘ্য হবে ছয়হাত।

মেয়েদের কাফন

মেয়েদের কাফন
মেয়েদের কাফনের জন্য পাঁচটি কাপড় হওয়া জরুরী। ১। চাদর । এর দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে চার হাত (২) এর, ইহার দৈর্ঘ্য হবে সাড়ে তিন হাত। (৩) কোর্তা, এর দৈর্ঘ্য হবে ছয় হাত। মাঝখান দিয়ে মাথা প্রবেশ করানোর জন্য ফাড়া থাকতে হবে। (৪) মাথা বন্দ বা উড়না । এটা দৈর্ঘ্যে তিন হাত হবে এবং প্রস্থে দেড় হাত বা তার চেয়ে সামান্য বেশি। এরদ্বারা মহিলাদের মাথা ও চুল বেঁধে চুলগুলো বুকের উপর দিয়ে দিতে হবে। (৫) সিনাবন্দ এটা বগল হতে উরু পর্যন্ত লম্বা হতে হবে এবং প্রস্থে চাদরের মতই হবে। এটা দিয়ে বুক ও স্তন বাঁধতে হবে।

বিঃ দ্রঃ যদি কোন কারণ বশতঃ পুরুষের জন্য তিনটি কাপড় ও মেয়েদের পাঁচটি কাপড় পাওয়া না যার তবে যতটুকু পাওয়া যাবে তার দ্বারাই কাফন দিলেই যথেষ্ট হবে ।

শিশুর কাফন

শিশুর কাফন
যদি কোন বাচ্চা জীবিত জন্ম নিয়ে পরে মারা যায়, তবে তার নাম রাখতে হবে, তাকে কাফন দাফন করতে হবে ও তার জন্য জানাযার নামাজ পড়তে হবে।
আর যদি শিশু মৃত জন্ম হয় তবে তাকে কাপড় পেঁচিয়ে দাফন করবে তার জানাযা পড়া হবে না, নিয়মানুযায়ী তাকে তিনটি কাপড়ও পড়ান হবে না । তদ্রুপ যদি কার অকাল গর্ভপাত এবং কোন অংগ যথা, মাথা, হাত, পা ইত্যাদি প্রকাশ না পায় তবে তাকে নামকরণ করতে হবে না। নিয়মানুযায়ী কাফন ও জানাযা পড়া হবে না ।

জানাযার নামাজ

জানাযার নামাজ
মৃতের প্রতি জীবিতদের শেষ দায়িত্ব হল তার নামাজে জানাজা পড়ে তাকে কবরস্থ করা। মৃতের জন্য নামাজে জানাযা ফরজে কেফায়াহ্। যদি কোন একজন তা আদায় করে দেয় তবে সকলের পক্ষ হতে এটা কোন একজন তা আদায় করে দেয় তবে সকলের পক্ষ হতে তা আদায় হয়ে যাবে, আর যদি কেউ না পড়ে তবে তাই সকলেই উচিত জানাযায় শরীক হওয়া । সকলেই গোনাহগার হবে। জানাযার নামাজের অর্থ হল মৃতের জন্য দোয়া করা।

জানাযার নামাজের শর্ত

জানাযার নামাজের শর্ত
জানাযার নামাজের জন্য শর্ত হল-(১) জায়গা পাক হওয়া (২) কাপড় পাক হওয়া (৩) সতর ঢাকা (৪) কেবলামুখি হওয়া (৫) মৃত ব্যক্তি পুরুষ না মহিলা তা জেনে নিয়ত করা, (৬) ইমাম প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া (৭) মাইয়েত মুসলমান হওয়া, (১১) মৃতের সতর ঢাকা থাকা (৮) শবদেহ পবিত্র হওয়া (৯) কাফন পবিত্র হওয়া (১০) মৃতের খাট মাটির
উপর থাকা ।

জানাযার ফরজ ওয়াজিব ও সুন্নতের বর্ণনা

এর ফরজ মাত্র দুটি-(১) দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করা (২) চার তাকবীর বলা
জানাযার নামাজের ওয়াজিব হল – মৃতের জন্য দোয়া করা ।
জানাযার নামাজের সুন্নত হল-(১) ছানা পড়া (২) দরূদ পড়া (৩) দোয়া পড়া।

যে সকল লোকের জানাযা অবৈধ

(১) কোন কাফের বা মুশরিক যদি ঈমান না এনে মারা যায় (২) ডাকাত যদি ডাকাতির অবস্থায় মারা যায় (৩) ন্যায় বিচারক মুসলিম বাদশাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহকালে মারা গেলে । (৪) যে সন্তান পিতা বা মাতার হত্যার অভিযোগে নিহত হয়েছে (৫) যে আত্মহত্যা করে। এদের জানাযার নামাজ এজন্য পড়া অবৈধ যেন অন্যান্যরা এটা দেখে এ সকল অসৎ কাজগুলো ছেড়ে দেয়। আর যদি একান্তই এদের জানাযা পড়তে হয় তবে সে এলাকার বড় আলেম তার জানাযায় অংশ গ্রহণ করা হতে বিরত থাকবেন। তদ্রুপ যদি কোন ইসলাম বিদ্বেষী ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তবে তারা জানাযায়ও বড় আলেমগণ অংশ গ্রহণ হতে বিরত থাকবেন ।

কবর যিয়ারত

কবর যিয়ারত
কোন কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলে এ দোয়া পাঠ করতে হয়।

(আস্সালামু আলাইকুম ইয়া আহলালকুবৃর)
অর্থ : হে কবর বাসীগণ! তোমাদের উপর শান্তিবর্ষিত হোক। এরপর কবর যিয়ারতের নিয়ত থাকলে দাঁড়িয়ে সর্ব প্রথম এ দোয়া পড়বে-

উচ্চারণ : আসসালামু আলাইকুম ইয়া আতালদিয়ারি মু’মিনীনা ওয়াল মু’মিনাতি ওয়াল মুসলিমীনা ওয়ার মুসলিমাত ওয়া ইন্না ইনশা আল্লাহু বিকুম লাহিকুনা নাসআলুল্লাহা লানা ওয়া লাকুমুল আফিয়াহ ।

এরপর দরূদ শরীফ, সূরায়ে ফাতেহা, ইখলাছ, নাছ, ফালাক, কাফিরুন ইয়াসিন, ও সূরায়ে মূলক ইত্যাদি সূরা এবং কোরআনের অন্যান্য আয়াত যতটুকু সম্ভব হয় তিলাওয়াত করে তার ছওয়াব তাদরে রুহের মাগফিরাতের জন্য দান করে দিবে। যদি কেউ ইচ্ছে করে তবে হাত উঠিয়ে স্বীয় মনোবাঞ্ছা আল্লাহর কাছে বলতে পারে, তবে কবরস্থানে হাত না উঠিয়ে দোয়া করাই ভাল ।

এছাড়াও নফল নামাজ, রোযা ক্ষুধার্তকে অন্ন দান মসজিদ ও মাদ্রাসায় দান করার মাধ্যমেও মৃতের জন্য ছওয়াব বেশি করা যায়। আল্লাহ্ তায়ালা আমাদেরকে তার প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।

রূহসমূহের পারস্পরিক দেখা সাক্ষাৎ

হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলেন, কেহ কোনও সংবাদ লইয়া আসিলে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ করার জন্য লোকেরা যেমন আগ্রহ লইয়া আসে, তদ্রূপ কোনও মো’মেন ব্যক্তির রূহ কবজ করা হইলে, আল্লাহ্র অন্যান্য মৃত নেক বান্দাগণের রূসমূহ উহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসে। আগন্তুক রূহগুলির একটি অপরটিকে তখন বলিয়া যাকে ইহাকে একটু অবসর দাও। কেননা উহা সবেমাত্র মহা বিপদ হইতে উদ্ধার হইয়া আসিয়াছে। অতঃপর অন্যান্য রূহগুলি সেই রূটিকে জিজ্ঞাসা করে, অমুক ব্যক্তি কেমন আছে? অমুকের বিবাহ হইয়াছে কিনা?

উহারা যদি এমন কোন ব্যক্তির সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে যাহার মৃত্যু হইয়াছে, তাহা হইলে এই রূটি বলে- তাহার মৃত্যুত আমার মৃত্যুর পূর্বেই হইয়াছে। এই সংবাদ শুনিয়া সেই রূগুলি বলে- “ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন’! সে নীচের ঠিকানায় (গুনাহ্গারদের রূহসমূহের নিকট) চলিয়া গিয়াছে। উহা নিতান্ত মন্দ জায়গা! অতঃপর তিনি (দঃ) বলিলেন : তোমাদের আমলনামা তোমাদের মৃত আত্মীয়গণকে দেখানো হয়। যদি তাহারা তোমাদের নেক-আমল দেখিতে পায়, তাহা হইলে এই বলিয়া দোয়া করে- “ইয়া আল্লাহ্! ইহা তোমার দয়া এবং রহমতই। তুমি তাহাদের প্রতি আরও অধিক রহমত বর্ষণ কর এবং তোমার রহমতের উপর রাখিয়াই তাহাদের দুনিয়ার জীবন শেষ কর।” আর যদি তোমাদের মন্দ আমল দেখে, তবে এই বলিয়া দোয়া করিলে তুমি সন্তুষ্ট হও।” করে- ‘ইয়া আল্লাহ্! তাহাদিগকে এমন আমলের তৌফিক দাও, যে আমল

হযরত লবীরা (রা.) হইতে বর্ণিত-বিশ্ব নামক এক ব্যক্তির মৃত্যুতে তাহার মাতা অত্যন্ত শোকাতুরা হইয়া পড়িল। একদা সে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হইয়া আরজ করিল : ইয়া রাসূলুল্লাহ (দঃ) প্রায়ই আমার বংশের লোক মারা যায়। আচ্ছা, তাহাদের একজনের রূহ্ কি অন্যের রূকে চিনিতে পারে, তাহা ইলে ভবিষ্যতে যে ব্যক্তি মরিবে, তাহার মউতের সময়ে আমি তাহার মারফত আমার পুত্র বিশর-এর নামে সালাম পাঠাবো। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিলেন : হাঁ, একজনের রূহ-এর সঙ্গে অপর জনের রূহের পরিচয় আছে। আমি আল্লাহ্র কছম করিয়া বলিতেছি, রূগুলি একটি অপরটির সহিত এইরূপ ঘনিষ্টভাবে পরিচিত, যেমন বৃক্ষশাখার পক্ষীকূল একে অন্যের সহিত পরিচিত। হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ)-এর এইকথাটি শ্রবণ করার পর, বিশ্ব-এর বংশের কাহারও যখন মৃত্যু-মুহূর্ত উপস্থিত হইত, তখন বিশ্র-এর মাতা তাহার নিকট যাইয়া বলিত : আমার পুত্র বিশ্বকে আমার সালাম বলি ও

হযরত আবু কাতাদা (রা.)-এর ইনতেকালের পনের দিন পর তাঁহার কন্যা উস্কুল বানীন মৃত্যু-শয্যায় শায়িত এমন সময় আবদুল্লাহ্ ইবনে আনীস তাঁর শয্যাপার্শ্বে যাইয়া তাঁহাকে বলিলেন : চাচাজান! আমার আব্বাকে আমার সালাম জানাইবেন। (ইমাম বোখারী ইহা রেওয়ায়েত করিয়াছেন।)

হযরত আবু হোরায়রা (রা.) হইতে বর্ণিত হযরত রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলেন, মো’মেন ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাহার রূটি যখন, আসমানে যাইয়া পৌঁছে তখন অন্যান্য মো’মেনদের রূহ্ উহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসে এবং উহার নিকট দুনিয়ার আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিত ব্যক্তিদের সংবাদ জিজ্ঞাসা করে। যদি এই রূহটি এই বলিয়া সংবাদ দেয় যে, আমি অমুককে দুনিয়ায় ফেলিয়া আসিয়াছি, তাহা হইলে সেই রূগুলি খুশী হয়।

আর যদি বলে যে অমুকের মৃত্যু হইয়াছে, তাহা হইলে উহারা আফসোস করিয়া বলে যে, আহা। সে আমাদের নিকট আসিল না! এইভাবে তাহাদের পরিত্যক্ত ঘরের বিড়ালটির সম্পর্কেও তাহারা সংবাদ জিজ্ঞাসা করে।

আবু নঈম (রা.) বলেন : হযরত ইমাম হাসান (রা.) মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্তে রোগ-যন্ত্রণায় যখন ছটফট করিতেছিলেন, তখন এক ব্যক্তি তাঁহাকে বলিলেন : আপনি এইরূপ অস্থির হইতেছেন কেন?

যদি আপনার ইনতেকাল হয়, তবে আপনি আপনার পিতা হযরত আলী (রা.) এবং মাতা হযরত ফাতেমা (রা.)-এর সঙ্গে, নানাজী হযরত রাসূরুল্লাহ্ (দঃ)-এর সঙ্গে নানীজী হযরত খাদীজা (রা.)-এর সঙ্গে, চাচা হযরত হামযা (রা.) ও হযরত আব্বাস (রা.)-এর সঙ্গে এবং মামু হযরত কাছেম, তাইয়েব, তাহের ও ইবরাহীমের সঙ্গে এবং খালা রোকাইয়া, উম্মে কুলছুম ও জয়নবের সঙ্গে তো মিলিত হইবেন। অতএব ঘাবড়াইবার কোনই কারণ নাই ।- এই কথাগুলি শুনিয়া হযরত হাসান (রা.) শান্ত হইয়া উঠিলেন ।

কবরের চাপ

হযরত হোযায়ফা (রা.) বর্ণনা করেন : একদা একব্যক্তির জানাযা নামাজ পড়ার উদ্দেশ্যে আমরা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ)-এর সঙ্গে রওয়ানা হইলাম । অতঃপর তাহার কবরের পার্শ্বে পৌছিয়া হযরত (দঃ) উহার ভিতরের দিকে তাকাইতে লাগিলেন, আর বলিলেন : মো’মেন ব্যক্তিকে ইহার ভিতরে এইরূপ কঠোর চাপের সম্মুখীন হইতে হয়, যাহার ফলে তাহার ঘাড়, সীনা এবং পাঁজরের হাড়গুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায়। আর কাফেরদের জন্য উহা তো আছেই, তদুপরিকবরগুলি আগুন দ্বারা ভর্তি করিয়া দেওয়া হয়।

হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলেন : কবরের এইচাপ নিশ্চয়ই হইবে। কেহই উহা হইতে রক্ষা পাইবে না। যদি কেহ উহা হইতে নাজাত লাভ করিতে পারিত তাহা হইলে সাআ’দ ইবনে মাআ’স্ (রা.) অবশ্যই নাজাত পাইত । (সাআদ এর জানাযায় সত্তর হাজার ফেরেশতা শরীক হইয়াছিলেন)

হযরত জাবের (রা.) হইতে বর্ণিত-হযরত সাআ’দ ইবনে মাআ’যকে কবরে দাফন করার পর হযরত রসূলুল্লাহর (দঃ) কিছুক্ষণ তাসবীহ পাঠ করিলেন। সাহাবীগণ তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে তাসবীহ পাঠ করিলেন। অতঃপর হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিলেন- আল্লাহু আকবার। সাহাবীগণ তাঁহার সঙ্গে আল্লাহু আকবার ধ্বনির প্রতিধ্বনি তুলিলেন। অতঃপর সাহাবীগণ আরজ করিলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আপনি তাসবীহ পাঠ করিলেন কেন?

হযরত রাসূলুল্লাহ উত্তর দিলেন ঃ যখন তাহার রূহ্ আরশে মোআ’ল্লার নিকট পৌঁছিল, তখন উহাকে দেখিয়া আরশ আনন্দের আতিশয্যে দুলিতে আরম্ভ করিল এবং তাহার জন্য সপ্তকাশের দরজা খুলিয়া দেওয়া হইল। তাহার জানাযায় সত্তর হাজার ফেরেশ্তা শরীক হইয়াছেন, অথচ তাহাকে দাফন করার পর তাহার কবরটি চারিদিক হইতে সংকীর্ণ হইয়া আসিয়া মিলিয়া গেল । এই অবস্থা দেখিয়া আমি তাবীহ্ পাঠ প্রশস্ত করিয়া দিলেন ।

করিলাম এবং আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করিলাম। ফলে, তিনি তাহার কবরটিকে হযরত আনাছ্ (রাঃ) বর্ণনা করেন : নবী-দুলালী হযরত জয়নাব (রা.)-এর ইতেকাল হইলে, আমরা তাঁহার লাশ লইয়া কবরস্থানে গমন করিলাম । কন্যার বিয়োগ ব্যাথায় হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) পবিত্র চেহারায় পেরেশানীর ছাপ পরিলক্ষিত হইতেছিল। হযরত জয়নবকে দাফন করা হইলে হযরত (দঃ) কিছুক্ষন তাঁহার কবরের পার্শ্বে বসিয়া রহিলেন এবং বরাবর আমানের দিকে তাকাইলেন । ইহার কিছুক্ষণ পর তিনি কবরের ভিতর প্রবেশ করিলেন।

আমরা দেখিলাম, এইবার তাঁহার পবিত্র চেহারা পূর্বাপেক্ষা অধিক মলিন হইয়া পড়িয়াছে। এইভাবে কিছু সময় কাটিবার পর হঠাৎ তাঁহার পবিত্র চেহারায় খুশীর আভা ফুটিয়া উঠিল । সাহাবীগণ ইহার তাৎপর্য জানিতে চাহিলে, তিনি বলিলেন : কবর সংকীর্ণ হইয়া পড়ায় এবং জয়নবের দুর্বলতার কথা স্মরণ করিয়াই আমি খুব চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলাম এবং আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করিলাম, যেন তিনি তাহার প্রতি আসানী করেন।

তিনি আমার দোয়া কবুল করিয়া তাহার প্রতি অনুগ্রহ করিলেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও তাহার কবরটির চারিদিক হইতে সংকীর্ণ হইয়া আসিয়া মিলিয়া যাওয়ার ফলে যে প্রচণ্ড ধ্বনি উত্থিত হইয়াছে, মানবজাতি এবং জিন জাতি ব্যতীত আর সকল প্রাণীই উহা শুনিতে পাইয়াছে ।

একদা হযরত রাসুলুল্লাহ্ (দঃ) একটি বালিকার জানাযা পড়িলেন। অতঃপর তিনি বলিলেন ঃ কেহ যদি কবরের আজাব হইতে মুক্তি লাভ করিতে পারিত, তাহা হইলে এই বালিকাটি অবশ্যই নাজাত পাইত ।

একদা হযরত আয়শা সিদ্দীকা (রাঃ) হযরত রাসূলুল্লাহকে (দঃ) বলিলেন ঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ্! যে দিন আপনি আমাকে মুস্কার-নাকীরের ছওয়াল এবং কবরের চাপ সম্পর্কে সতর্ক করিয়াছেন, উহার পর হইতে দুনিয়ার কোন কাজ বা বস্তুই আর আমার কাছে ভালো লাগে না। এইকথা শুনিয়া হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিলেন : হে আয়শা!

মো’মেন ব্যক্তিদের কানে মুনকার-নাকীরের আওয়াজ এতই সহজ, যেমন চক্ষে সুরমা লাগানো; আর কবরের চাপ তাহাদের নিকট এইরূপ অনুভূত হইবে, যেমন শিশুর মাথা-ব্যথা উপস্থিত হইলে, স্নেহময়ী মাতা স্নেহভরে নরম হাতে তাহার মাথা টিপিয়া দেয়। কিন্তু আয়শা! উহা তাহাদের জন্যই ভয়ংকর, যাহারা আল্লাহ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে। ভারী পাথর দ্বারা ডিম পিষিবার মত কবর তাহাদিগকেও পিষিয়া ফেলিবে ।

আবুল কাসেম সা’দী ‘কিতাবুর রূহ’ নামক গ্রন্থে বলেন, কোন নেক্কার লোকও কবরের চাপ হইতে নিস্তার পাইবে না। তবে ব্যবধান এইটুকুই যে, কবর কাফেরগণকে সর্বদাই চাপাইতে থাকে, আর মো’মেনদের প্রতি সামান্য কতকক্ষণ চাপ দিয়াই পুনরায় প্রশস্ত হইয়া যায় ।

আল্লামা সুৰ্‌কী (রহ.) ‘বারুল্ কালাম’ গ্রন্থে বলেন, যে মো’মেন আল্লাহ্র একান্ত অনুগত, তাহার প্রতি কবর আজাব হইবে না, তবে কবরের চাপ দেওয়া হইবে। ইহা শুধু এইজন্য যে দুনিয়ায় সে আল্লাহ্র অসীম নে’মত, ভোগ করিয়াছে, অথচ উহার পুরাপুরি শোকরিয়া আদায় করিতে পারে নাই।

হাকীম তিরমিযী (রহ.) বলেন : মো’মেনদের প্রতি যে কবরের চাপ দেওয়া হয়, তাহা এইকারণেই যে, বান্দা যত বড় নেক্কার হউক, একেবারে নিষ্পাপ হইতে পারে না-সামান্য ত্রুটি হইলেও তাহার দ্বারা ঘটিয়া যায়, আর কবরের চাপের ফলে তাহার সেই ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতিপূরণ হইয়া যায় এবং উহার পরমুহূর্ত হইতেই তাহার প্রতি আল্লাহর অশেষ রহমত নাযিল হইয়া থাকে । তবে পয়গাম্বরগণের প্রতি মুনকার-নাকীর-এর ছওয়াল কিংবা কবরের চাপ কোনটিই হইবে না। কেননা, তাঁহারা সম্পূর্ণ নিষ্পাপ ।

যে ব্যক্তি তাহার মৃত্যুর পর জমীনের উপরেই থাকিয়া যায় অর্থাৎ কবরে দাফন করা না হয়, সে যদি পচিয়া গলিয়াও যায়, কিংবা পশু-পক্ষী তাহার মৃতদেহ ভক্ষণ করিয়া ফেলে, অথবা যে ব্যক্তিকে শুলী বা ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলাইয়া নিহত করা হয় এবং জুলন্ত অবস্থায় কিছুদিন রাখা হয়, তাহার প্রতিও এই চাপ দেওয়া হয়। তবে জমীনের পরিবর্তে প্রবল বায়ু তাহাকে এমনভাবে চাপ দেয় যে তাহার অস্থি চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া যায়। কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা উহাকে আমাদের দৃষ্টির হইতে গোপন করিয়া রাখিয়াছেন । অগোচরে রাখিয়াছেন।

যেমন তিনি ফেরেশতাগণ এবং শয়তানকে আমাদের চক্ষু
হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিয়াছেন ঃ যে ব্যক্তি রোগ-শয্যায় শায়িত অবস্থায় stall as ji (কুলহু ওয়াল্লাহু আহাদ) পাঠ করে আর সেই রোগেই মারা যায়, সে কবর-আজাব হইতে মুক্ত থাকিবে এবং কবরের চাপও তাহার উপর আছান হইবে। কিয়ামতের দিন ফেরেশতাগণ নিজের হাতে তাহাকে পুলছেরাত্ পার করাইয়া বেহেশতের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিবেন

মৃত ব্যক্তির সহিত কবরের বাক্যালাপ

হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলেন : যখন মো’মেন বান্দাকে কবরে দাফন করিয়া আসা হয়, তখন কবর তাহাকে লক্ষ্য করিয়া বলে- “আমার এইখানে তোমার শুভাগমন! জমীনের উপর দিয়া যাহারা চলাফেরা করিত, তন্মধ্যে তুমিই ছিলে আমার সর্বাদিক প্রিয়ব্যক্তি। এখন তুমি আমার নিকট আসিয়াছ এবং তোমাকে আমার হাতে সোপর্দ করা হইয়াছে। এইবার দেখিতে পাইবে; আমি তোমার সহিত কিরূপ ভাল ব্যবহার এবং কিরূপ মেহেরবানী করি।”

এইকথা বলিয়াই কবরটি প্রশস্ত হইয়া পড়ে এবং উহার দিকে জান্নাতের দরজা খুলিয়া দেওয়া হয় আর যখন বদ্‌কার অথবা পাপী বান্দাকে কবরে রাখিয়া আসা হয়, তখন কবর তাহাকে বলিয়া থাকে- “আমার এইখানে তোমার আগমন অবাঞ্ছিত ইহাতে কোনরূপ মঙ্গল নিহিত নাই। আমার পিঠের উপর দিয়া যে-সকল লোক চলাচল করিয়াছে, তন্মধ্যে তুমিই ছিলে নিকৃষ্টতম। আজ তুমি আমার মুঠোর মধ্যে আসিয়াছ, এখন আমার ব্যবহার একটু দেখিয়া লও।”

এই বলিয়া কবরটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া যায় । চারিদিক হইতে এইরূপ সংকীর্ণ হইয়া আসে যে, উহার চাপে মৃতের অস্থি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিয়াছেন : মুরদাকে দাফন করিয়া আসিলে কবর তাহাকে বলে- ‘তুমি কি এইকথা জানিতে না যে, আমি দুঃখ-কষ্ট ও শাস্তির গৃহ, আমি নির্জনতার আঁধার কুটির, আমি সাপ-বিচ্ছু ইত্যাদির গৃহ? হে আদম-সন্তান! তুমি বড়ই অলসতার মধ্যে ডুবিয়াছিলে। তুমি অহংকারে মত্ত হইয়া আমার পিঠের উপর দিয়া ধপ্ ধপ্ করিয়া চলিয়াছিলে।”

মৃত ব্যক্তি নেক্কার হইলে, ফেরেশ্তাগণ তাহার পক্ষ হইতে কবরকে বলিয়া থাকেন- “হে কবর, বলত, যদি এই ব্যক্তি নিজে নেককার হয় এবং লোকদিগকে সৎকাজের দিকে উৎসাহিত ও মন্দ কাজ হইতে বিরত করিয়া থাকে, তবুও কি তুমি তাহাকে আজাব দিবে? তদ্দুত্তরে কবর বলে- এইরূপ ব্যক্তির জন্য তো আমি সুবর্ণ উদ্যান। আর অমনি কবরটি তাহার জন্য একটি মনোরম বাগিচায় পরিণত হইয়া যায় এবং তাহার চেহারা স্বর্গীয় আলোকে উদ্ভাসিত হ‍ইয়া উঠে।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমায়ের (রা.) হইতে বর্ণিত-মৃতকে দাফন করার পর কবর তাহাকে বলিয়া থাকে- আমি আঁধার গৃহ, আমি নির্জনতার গৃহ। যদি তুমি জীবনে আল্লাহ্র নির্দেশের তাবেদারী করিয়া থাক, তবে আমি তোমার জন্য রহমত স্বরূপ। আর যদি তুমি আল্লাহ্ না-ফরমানী করিয়া থাক, তাহা হইলে আমি তোমার জন্য আজাবের গৃহ।

আমি সেই গৃহ-যাহাতে আল্লাহ্র আদেশের অনুগত কোনও বান্দা আসিবে, সে আমার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হইয়া কিয়ামতের দিন আনন্দোজ্বল চেহারা লইয়া পুনরুত্থিত হইবে। আর যে আল্লাহ্ না-ফরমানী করিয়া আমার নিকট আসিবে, সে আমার হাতে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হইয়া কিয়ামতের দিন উঠিবে।
মুহাম্মদ ইবনে ছাবীহ্ (রা.) হইতে বর্ণিত, মুরদাকে দাফন করার পর যখন তাহার উপর কবর-আজাব আরম্ভ হয়, তখন আশে-পাশের মুরদাগণ তাহাকে ডাকিয়া ডাকিয়া বলে- “হে অমুক

! তুমি যখন জীবিত ছিলে, তখন তোমার সম্মুখেই তোমার ভাই-বেরাদার ও আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই দুনিয়া হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু তুমি উহা হইতে কোনও শিক্ষা গ্রহণ কর নাই । আমরাও তোমার চক্ষের সামনেই দুনিয়া ত্যাগ করিয়া আসিয়াছিলাম। ইহা দেখিয়াও তুমি নিজের আমল দুরুস্ত কর নাই-নিজের চরিত্র সংশোধন কর নাই।’ অপর কবরস্থানের জমীন চতুর্দিক হইতে তাহাকে ডাকিয়া বলে- “হে অলস!

তোমার পরিজনবর্গকে দুনিয়া তোমার সম্মুখেই প্রবঞ্চিত করিয়াছে এবং তোমার পূর্বেই মৃত্যু তাহাদিগকে কবরের রাস্তা দেখাইয়াছে। তোমার চোখের সামনেই তাহাদিগকে দুনিয়া হইতে উঠাইয়া লওয়া হইয়াছে এবং কবরের মধ্যে রাখিয়া আসা হইয়াছে; আর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলেই তাহার জন্য শোক করিয়াছে; কাঁদিয়া বুক ভাসাইয়াছে। এত সবকিছুই তোমার চোখের সামনেই ঘটিয়াছে। কিন্তু তুমি উহা হইতে উপদেশ গ্রহণ কর নাই। আজ তোমার ও কাতরতার কোনই মূল্য নাই। এমন আর ইহা তোমার কোনও আহাযারী উপকারে আসিবে না ।”

কবরে ছওয়াল-জওয়াব

হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ্ (রা.) বর্ণনা করেন- হযরত রাসূলুল্লাহ্ (স.) বলিয়াছেন ঃ মো’মেন মৃতকে কবরে দাফন করিয়া আসা হইলে, কবরের মধ্যে চক্ষু খুলিয়াই সে এইরূপ আলো-ছায়া দেখিতে পায়, যাহাতে সে এ সময়টিকে সূর্যাস্তের অল্পক্ষণ পূর্ব বলিয়া মনে করে। অতঃপর সে শায়িত হইতে উঠিয়া বসে যেন এইমাত্র সে ঘুম হইতে জাগিয়াছে । তখন মুনকার-নাকীর ফেরেশতাদ্বয় তাহার সহিত ছওয়াল জওয়াব করিতে আসেন। কিন্তু সে বলিয়া তাঁহাদের জওয়াব দেয়-“এখন আমার সাথে কোন কথা বলিও না। কেননা, সময় অতি সংকীর্ণ, আমাকে আছরের নামাজ পড়িতে হইবে।”

অবস্থা হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) বলেন- একদা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন : ওমর! যখন তুমি চার হাত দীর্ঘ গভীর কবরে যাইবে এবং মুনকার-নাকীর এর সাক্ষাৎ পাইবে, তখন তোমার কি অবস্থা হইবে? আমি আরজ করিলাম : ইয়া রাসূলুল্লাহ্! মুনকার-নাকীর কাহারা? তিনি বলিলেন : তাঁহারা হইলেন কবরে মুরদাদের পরীক্ষা গ্রহণকারী ফেরেশ্তা। তাঁহারা নিজেদের দাঁত দ্বারা জমীনকে ছিন্ন-ভিন্ন করিয়া কবরে আসিবেন ।

তাঁহাদের আওয়াজ বজ্রের ন্যায় প্রচণ্ড হইবে এবং চক্ষু বিদ্যুতের মত চমকাইতে থাকিবে এই দুইজন কবরে আসিয়া তোমাকে শায়িত অবস্থা হইতে বসাইয়া দিয়া ভীতি-প্রদর্শন করিবেন। তাঁহাদের সঙ্গে বিরাট লৌহদণ্ড থাকিবে। তাঁহারা তোমাকে কয়েকটি প্রশ্ন করিবেন। যদি তুমি সে-সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পার, তাহা হইলে তাঁহারা তোমাকে এইরূপ নির্মমভাবে প্রহার করিবেন, যাহার ফলে তোমার দেহ ছাইয়ের মত উড়িয়া যাইবে। এই পর্যন্ত শোনার পর আমি আরজ করিলাম : ইয়া রাসূলুল্লাহ্! তখন কি আমার দ্বীন ও ঈমানের প্রতি দৃঢ়তা ও জ্ঞান বর্তমানের মত থাকিবে?

তিনি বলিলেন : হ্যাঁ। তখন আমি বলিলাম : তবে আর সক্ষম হইব । ভয়ের কারণ নাই । খোদা চাহেন ত, তাঁহাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য আমি উন্মুল্ মো’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন : একদা একটি ইয়াহুদী মহিলা ভিক্ষা মাগিতে মাগিতে আমার ঘরের দরজায় আসিয়া বলিল : আমাকে কিছু খাবার দাও। আল্লাহ্ তোমাদিগকে দাজ্জালের উৎপাত এবং কবরের আজাব হইতে রক্ষা করিবেন। আমি নানা কথা পাড়িয়া ভিখারীণিকে বিলম্ব করাইতে লাগিলাম। ইতিমধ্যে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বাহির হইতে ঘরে ।

আমি তাঁহাকে বলিলাম : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! এই মহিলাটি দোয়া করিয়াছে, যেন আল্লাহ্ আমাদিগকে দাজ্জালের ফেতনা এবং কবর আজাব হইতে নাজাত দান করেন। এইকথা শুনিয়াই হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) দুইহাত তুলিয়া আল্লাহ্র দরবারে এই দুইটি বিষয় হইতে পানাহ্ চাহিলেন। অতঃপর তিনি বলিলেনঃ দাজ্জালের ফেতনা এতই মারাত্মক হইবে যে আমার পূর্ববর্তী সকল পয়গাম্বরই নিজ নিজ উম্মতকে তাহার সম্পর্কে সতর্ক করিয়া দিয়াছিলেন। আমিও তাহার সম্পর্কে লোকদের সতর্ক করিয়া দিতেছি। আর আমি তাহার পরিচিতিস্বরূপ এমন একটি চিহ্ন বলিয়া দিতেছি, যাহা আর কোন পয়গম্বরই বলিয়া যান নাই।

তাহা এই যে, তাহার ডা’ন চক্ষু কানা হইবে। কপালে ‘কাফ্’ ‘ফে’ এবং ‘রে’-এই তিনটি অক্ষর (অর্থাৎ কুফ্) লেখা থাকিবে। তাহাকে দেখিয়াই মো’মেন লোকেরা উহা পড়িয়া লইবে। আর কবরের ‘ফেনা’ হইল এই যে উহাতে সকল মো’মেনেরই পরীক্ষা লওয়া হইবে এবং আমার সম্পর্কেও সকলকে জিজ্ঞাসা করা হইবে। যে ব্যক্তি নেক্কার হইবে, সে শান্তিমত শায়িত অবস্থা হইতে উঠিয়া বসিবে । অতঃপর তাহাকে প্রশ্ন করা হইবে- তোমার ধর্ম কি ছিল? সে উত্তর দিবে ইসলাম। তারপর প্রশ্ন করা হবে- তিনি কে ছিলেন যাঁহাকে তোমাদের নিকট প্রেরণ করা হইয়াছিল? সে উত্তর করিবে-হযরত মুহাম্মদ (দঃ) আল্লাহ্র রাসূল ।

হযরত ছুফিয়ান চওরী (রহঃ) হইতে বর্ণিত, যখন মৃতব্যক্তিকে কবরে প্রশ্ন করা হয়- তোমার প্রভু কে? তখন শয়তান লোকটির নিকটে আসিয়া নিজের দিকে ইশারা করিতে থাকে (অর্থাৎ শয়তানই তাহার প্রভু, এইকথা তাহার দ্বারা বলাইতে চায়)। যেমন, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) কোনও মৃতকে দাফন করার সময়ে বলিয়াছিলেন : : : | ইয়া আল্লাহ্!

তুমি তাহাকে শয়তানের হাত হইতে রক্ষা কর। সুতরাং বুঝা যায় যে, মানুষের মৃত্যুর পরও শয়তান তাহাদের নিকট আসিয়া থাকে। যদি না আসিত, তাহা হইলে হযরত রাসূলুল্লাহ (দঃ) এই দোয়া করিতেন না ।

ইবনে শাহীন ‘কিতাবুস্ সুন্নাহ্-এর মধ্যে রাশেদ (রা.) হইতে বর্ণনা করেন যে, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিতেন : তোমরা ভালভাবে কবরের দলীল (অর্থাৎ মুনকার-নাকীরের প্রশ্নের উত্তর) শিখিয়া লও । কেননা, এইসব কথা তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হইবে। মদীনার আনুছারগণের নিয়ম ছিল যে, কোনও ব্যক্তির মৃত্যু-মুহূর্ত উপস্থিত হইলে, তাঁহারা তাহাকে কবরের দলীল শিখাইয়া দিতেন; আর তাঁহাদের ছেলে-মেয়েদের মুখে বুলি ফুটিলে, তাঁহারা তাহাদিগকে শিক্ষা

দিতেন- যদি কেহ তোমাকে জিজ্ঞাসা করে যে, তোমার ‘র’ কে? তাহা হইলে তুমি বলিও আল্লাহ্ আমার ‘রব’। যদি জিজ্ঞাসা করে যে, তোমার ধর্ম কি? তাহা হইলে তুমি বলিও আমার ধর্ম ইসলাম। আর যদি জিজ্ঞাসা করে যে, তোমার নবী কে? তবে তুমি বলিও আমার নবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ)
সহল ইবনে আম্মার (রা.) বলেন : ইয়াযীদ ইবনে হারূন-এর মৃত্যুর পর একদা আমি তাঁহাকে স্বপ্নে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম : আল্লাহ্ তায়ালা আপনার সহিত কিরূপ ব্যবহার করিয়াছেন? তদুত্তরে তিনি বলিলেন : আমার কবরে পাষাণপ্রাপ্ত ও ভয়ংকর চেহারার অধিকারী দুইজন ফেরেশতা আসিয়া আমাকে প্রশ্ন করিলেন-তোমার ‘রব’কে তোমার ‘দ্বীন’ কি? এবং তোমার নবী কে? তখন আমি আমার সাদা দাড়িগুলি ধরিয়া তাঁহাদিগকে বলিলাম : আপনারা আমাকে এমন প্রশ্নই করিতেছেন, যাহার উত্তর আমি আশি বৎসর যাবৎ মানুষকে শিক্ষা দিয়াছি। আমার এইকথাটি শুনিয়া ফেরেশতাদ্বয় বিদায় হইয়া গেলেন ।

যে ব্যক্তি অধিক গুণাহ্ করিয়াছে, তাহাকে কবরে রাখিয়া সকল লোক কবরস্থান হইতে চলিয়া যাওয়ার পর তাহার সহিত ছওয়াল-জওয়াব করা হয়,-যেন সে নির্জনতা ও নিঃসঙ্গতা দেখিয়া অধিক ভয় পায় এবং তাহার প্রতি অধিক কঠোরতা প্রদর্শন করা যায়। আর যে ব্যক্তি নেক্কার ঈমানদার লোকদের কবরস্থান হইতে না যাইতেই তাহাকে ছওয়াল করা হয়, যেন সে নিঃসঙ্গতার দরুন মনোবল হারাইয়া না ফেলে এবং আসানী ও দৃঢ়তার সহিত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে । আর নেক্কার লোকদের নিকট প্রশ্ন করার জন্য একজন ফেরেশতা আসেন। কেননা, দুইজনের তুলনায় একজনকে দেখিলে সাধারণতঃ ভয়ের মাত্রা কম হইয়া থাকে। আর গুনাহগারদিগকে ভীত ও আতংকিত করার জন্য দুইজন ফেরেশ্তা আসিয়া থাকেন। অবশ্য কোন কোন আলেম বলেন যে, সকলের কবরেই দুইজন ফেরেশতা আসেন, তবে তাঁহাদের একজনেই মুরদাকে প্রশ্ন করিয়া থাকেন।

কবরে ছওয়াল হইতে মুক্ত ব্যক্তিগণ

ছহী হাদীস সমূহে বর্ণিত আছে যে, কোন কোন মৃতের কবরে কোনরূপ আজাব হইবে না এবং তাহাদের নিকট মুনকার-নাকীরও আসিবে না। তিন প্রকারের লোক এই সৌভাগ্যের অধিকারী।

(১) যে ব্যক্তি এইরূপ নেক-আমল করিয়াছে, যাহার ফলে আল্লাহ্ তায়ালা তাহার কবর আজাব এবং মুনকার-নাকীরের ছওয়াল মাফ করিয়া দিয়াছেন। যেমন- জেহাদের ময়দানে শাহাদাত বরণ করা।

(২) ঐ ব্যক্তি, যাহাকে মৃত্যুর সময়ে খুব কষ্ট দেওয়া হইয়াছে, আর সেই কষ্টের প্রতিদান হিসাবে তাহার কবর আজাব ও মুনকার-নাকীরের ছওয়াল রহিত করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

(৩) যে ব্যক্তি এমন কোন দিনে বা রাত্রিতে মৃত্যু বরণ করিয়াছে যে রাত্রে বা দিনে মৃত্যু বরণ করিলে কবর আজাব এবং ছওয়াল জওয়াবের সম্মুখীন হইতে হয় না। যেমন- জুমার দিনে কিংবা জুমার রাত্রিতে মৃত্যু হওয়া।

হযরত আবু আইয়ুব আনছারী (রা.) হইতে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিয়াছেন : যে ব্যক্তি ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য জেহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হইয়া বীরত্বের সহিত যুদ্ধ করিয়া শেষ পর্যন্ত শাহাদাত বরণ অথবা বিজয় গৌরব অর্জন করিয়াছে, তাহাকে কবরের মধ্যে আজাব দেওয়া হইবে না।

হযরত ছালমান ফারছী (রা.) বলেন : আমি হযরত রাসূলুল্লাহকে (দঃ) বলিতে শুনিয়াছি যে, শত্রুদের মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে ‘দারুল ইসলাম অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত-প্রহরীরূপে একদিন অবস্থান করা এক মাসকাল রোযা রাখার এবং এক মাস পর্যন্ত রাত্রি জাগরণ করিয়া এবাদত করার চাইতে উত্তম । যদি কোনও ব্যক্তি সীমান্তে অবস্থানকালের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে, তাহা হইলে যে নেক-আমল সে করিয়াছে, কিয়ামত পর্যন্ত তাহার আমলনামায় উহার ছওয়াব লিপিবদ্ধ হইতে থাকিবে, আল্লাহ্র দরবার হইতে সে বিশেষ ধরণের রিযিক পাইবে এবং মুনকার-নাকীরের ছওয়াল হইতে নিরাপদে থাকিবে।

‘নাছায়ী’ শরীফে আছে, একদা এক ব্যক্তি হযরত রাসূলুল্লাহকে (দঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ্! সকল মো’মেনকেই কবরে ছওয়াল করা হইবে এবং কোন কোন লোকের প্রতি কবরে আজাবও হইবে, অথচ শহীদ ব্যক্তিগণকে না কোনরূপ প্রশ্ন করা হইবে, আর না কোন রকম আজাব দেওয়া হইবে- ইহার কারণ কি? হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিলেন : তাহার মাথায় যে শত্রুপক্ষের তরবারির আঘাত পড়িয়াছে। উহাই তো যথেষ্ট। ছওয়াল-জওয়াব বা অন্য কোনও আজাবের প্রয়োজন নাই ।

হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) হইতে বর্ণিত- যে ব্যক্তি (ইন্নী আ-মাতু বিরাব্বিকুম মাছমাউন) আয়াতটি সর্বদা পড়িবে, আল্লাহ্ তায়ালা মুনকার-নাকীরের ছওয়াল-এর জওয়াব দেওয়া তাহার জন্য সহজ করিয়া দিবেন।

হযরত ওমর (রাঃ) হইতে বর্ণিত- হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিয়াছেন ও মো’মেন ব্যক্তি জুমার রাত্রিতে কিংবা জুমার দিনে মৃত্যু বরণ করে, আল্লা
তায়ালা তাহাকে কবর আজাব হইতে নাজাত দান করেন।

হযরত আতা ইবনে ইয়াসার (রা.) হইতে বর্ণিত-হযরত রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন : যে মুসলমান পুরুষ কিংবা স্ত্রীলোক জুমার দিনে কিংবা জুমার রাত্রিতে মরিবে, সে কবরের আজাব এবং মুনকার-নাকীরের সওয়াল হইতে নিরাপদে থাকিবে। কিয়ামতের দিন তাহার নিকট হইতে হিসাব-নিকাশ লওয়া হইবে না এবং তাহার আমল বেহেশতী হওয়ার পক্ষে সাক্ষ্যদান করিবে। শৈশবে অথবা বাল্যকালে যাহারা মারা যায়, মুনকার-নাকীর ফেরেশতাগণ তাহাদিগকেও ছওয়াল করিবেন কি না, এই বিষয়ে এখতেলাফ রহিয়াছে।

কেহ কেহ বলেন যে, তাহাদেরও ছওয়াল করা হইবে। ইমাম করতবী (রঃ) বলেন, হ্যাঁ, বাচ্চাদের ছওয়াল করা হইবে; তবে ছওয়াল করার সময়ে তাহাদিগকে বয়স্ক লোকদের মত পূর্ণ-জ্ঞান দান করা হইবে, যেন তাহারা নিজেদের নেতির কথা উপলব্ধি তায়ালা তাহাদের অন্তরে জাগাইয়া দিবেন । করিতে পারে; আর তাহাদিগকে যে প্রশ্ন করা হইবে, উহার জওয়াবও আল্লাহ্ হযরত জুয়াইবার (রা.) বলেন : যোহাক্ ইব্‌নে মোশাহেম-এর ছয়দিন বয়স্ক একটি শিশুর মৃত্যু হইল।

তিনি লোকদের বলিলেন : আমার শিশুকে যখন তোমরা কবরে রাখিবে, তখন তাহার কাফনের গিরাগুলি খুলিয়া তাহার চেহারা অনাবৃত করিয়া দিবে । কেননা তাহাকে বসাইয়া ছওয়াল করা হইবে । তাঁহার এ কথাটি শুনিয়া আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম : মাত্র ছয়দিনের শিশু তাহারও আবার ছওয়াল হইবে? সে তো কোনই গুনাহ্ করে নাই।

তিনি বলিলেন : ‘রোযে-আযলে’ আল্লাহ্ তায়ালা আদম (আ.)-এর পৃষ্ঠদেশ হইতে সমস্ত রূহকে বাহির করিয়া উহাদের নিকট হইতে নিজে একমাত্র মাবুদ হওয়ার স্বীকৃতি আদায় করিয়াছেন, কবরে শিশুদের সেই স্বীকৃতি সম্পর্কে ছওয়াল করা হইবে। কোন কোন আলেম বলেন যে, শিশুদেরকে ছওয়াল করা হইবে না। কেননা ছওয়াল-জওয়াব তো তাহাদের সঙ্গেই হওয়া উচিত, যাহাদের বিবেক-বুদ্ধি আছে, অথচ শিশুদের তাহা নাই । ইমাম নাছাফী (রহ.) ‘বাহরুল কালাম’ গ্রন্থে বলেন, আম্বিয়া আলাইহিসস্ সালাম এবং মোমেনের ঘরে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের জন্য মুনকার-নাকীরের প্রশ্ন কবর-আজাব কিংবা হাশরের দিনের হিসাব নিকাশ কোন
কিছুই হইবে না ।

‘বলুল মা-উনফী ফলিত্‌ তাউন’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে : যে মুসলমান ব্যক্তি প্লেগ রোগ হইয়া মারা যায়, তাহাকে কবরে ছওয়াল করা হইবে না। যে ব্যক্তি প্লেগ মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখিয়াও নিজের বাসস্থান ছাড়িয়া অন্যত্র চলিয়া যায় না, বরং আল্লাহ্র দরবারে ছওয়াবের আসা করিয়া এবং যত বিপদ-আপদ সবই আল্লাহ্র পক্ষ হইতে আসে বলিয়া বিশ্বাস করিয়া ধৈর্যের সহিত কালযাপন করিতে থাকে, সে যদি সেই মহামারীতে কিংবা মহামারীর সময়ে অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুবরণ করে, তাহা হইলে সে কবরের ছওয়াল এবং আজাব হইতে মুক্তি লাভ করিবে এবং সে ঐ ব্যক্তির মতই, যে ইসলামী রাজ্যের সীমান্তে কাফের মুশরিকদের সহিত জেহাদের উদ্দেশ্যে অবস্থান করে।

তিনি আরও লিখিয়াছেন- যে ব্যক্তি জুমার দিনে মৃত্যু বরণ কর, আল্লাহ্ তায়ালা তাহার মৃত্যুর পূর্ব-মুহূর্তে তাহার দৃষ্টির সম্মুখ হইতে পরদা সরাইয়া দেন। ফলে মরিবার আগেই সে তাহার নিজের সেই মরতবা দেখিয়া লয়, যাহা আল্লাহ্ তায়ালা নির্ধারিত করিয়া রাখিয়াছেন। ইহা এইজন্যই যে, জুমার দিনে দোয়া আগুন প্রজ্বলিত করা হয় না এবং এই দিনে উহার সমস্ত দরজা বন্ধ করিয়া রাখা হয়, আর দোযখের দারোগাও সেইদিন ছুটি ভোগ করিয়া থাকেন। সুতরাং যে বান্দার রূহ্ জুমার দিন কজ করা হয়, ইহা তাহার সৌভাগ্য এবং ‘খাতেমা বিশ্ খায়ের’-এরই প্রমাণ ।

কবরে মুরদাগণের বিভিন্ন অবস্থা

হযরত ওসমান (রা.) যখন কোনও কবরের নিকট যাইতেন, তখন এইরূপ রোদন করিতেন যে, চোখের পানিতে তাঁহার দাড়ি ভিজিয়া যাইত। একদা লোকেরা তাঁহাকে প্রশ্ন করিল : বেহেশত-দোযখের আলোচনা শুনিয়া তো আপনি কখনও কাঁদেন না, অথচ কবর দেখিলে এইরূপ রোদন করেন কেন? তিনি বলিলেন : আমি হযরত রাসূলুল্লাহকে (দঃ) বলিতে শুনিয়াছি যে, কবর, আখেরাতের মযিলসমূহের প্রথম মনযিল। যে ব্যক্তি এইখানে মুক্তি পাইবে, অন্যান্য মযিলগুলিও তাহার জন্য আরও সহজ হইবে। কিন্তু যে এই প্রথম মযিলেই ঠেকিয়া যাইবে, পরবর্তী মযিলগুলি তাহার জন্য কঠিন হইতে কঠিনতর হইবে ।

হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) এরশাদ করিয়াছেন : কবর দোজখের একটি গর্ত অথবা জান্নাতের একটি বাগিচা অর্থাৎ কাফের ও বদকারদের জন্য কবর দোযখের একটি গর্ত স্বরূপ। উহাতে তাহাদিগকে নানারকম আজাব দেওয়া হইবে। আর মো’মেন নেক্কারদের জন্য উহা যেন বেহেশতের একটি বাগিচা” উহাতে তাহারা সীমাহীন আরাম ও আনন্দ উপভোগ করিবে হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন- মো’মেন ব্যক্তিগণ কবরের মধ্যে সুবর্ণ উদ্যানে বাস করে। তাহাদের কবরগুলিকে সত্তর গজ প্রশস্ত করিয়া দেওয়া হয় এবং উহাতে পূর্ণিমার রাত্রির মত অত্যুজ্জ্বল জ্যোৎস্না বিরাজ করিতে থাকে। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) হইতে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে যে, মো’মেন ব্যক্তির কবরকে চল্লিশ গজ চওড়া করিয়া দেওয়া হয়।

কবর আজাব সম্পর্কীয় কয়েকটি ঘটনা

হযরত জায়েদ ইবন ছাবেত (রা.) হইতে বর্ণিত, একদা হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) খচ্চরের পৃষ্ঠে সোয়ার হইয়া বনী-নাজ্জারদের একটি বাগানে গমন করিলেন। তিনি খচ্চরের পৃষ্ঠে সোয়ার ছিলেন; আমরা তাঁহার সঙ্গে ছিলাম এমন সময়ে হঠাৎ খচ্চরটি ভয় পাইয়া লাফাইয়া অন্যদিকে সরিয়া গেল । ইহাতে রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) মাটিতে পড়িয়া যাওয়ার উপক্রম হইয়াছিল। নিকটে পাঁচ-ছয়টি কবর ছিল। রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন : কেহ কি বলিতে পার, এইগুলি কাহাদের কবর?

তখন একজন ছাহাবী বলিলেন : হ্যাঁ, আমি জানি । হযরত (দঃ) প্রশ্ন করিলেন : কোন অবস্থায় তাহারা মরিয়াছে? সেই ছাহাবী জওয়াব দিলেন : মুশরেক অবস্থায় মরিয়াছে। অতঃপর হযরত (দঃ) বলিলেন, যদি ইহারা দাফনকৃত অবস্থায় না থাকিত, তাহা হইলে আমি আল্লাহ্র দরবারে দোয়াকরিতাম, যে তিনি তোমাদিগকেও কবর আজাবের আওয়াজ শোনাইয়া দেন, যেমন আমি শুনিতে পাইতেছি।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বলেন : একদা আমি ঘটনাক্রমে বদর-এর কবরস্থানে গমন করিলাম । এমন সময় একটি কবর ফাটিয়া উহা হইতে গলায় লোহার বেড়ী পরিধানকারী এক ব্যক্তি বাহির হইয়া আসিল । সে আমাকে ডাকিয়া বলিল : হে আবদুল্লাহ! আমাকে একটু পানি পান করাও। এইকথা শুনিয়া আমি আশ্চর্য অনুভব করিতে লাগিলাম । এমন সময় হাতে চাবুক লইয়া এক ব্যক্তি সেই কবর হইতে বাহির হইয়া আসিল এবং বলিল : হে আবদুল্লাহ্! ইহাকে পানি পান করাইও না।

কারণ, এই লোকটি কাফের।-এইকথা বলিয়াই • সে তাহাকে চাবুক মারিতে মারিতে আবার কবরের মধ্যে হাঁকাইয়া লইয়া গেল । অতঃপর আমি হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) দরবারে উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিকট এই ঘটনাটি বর্ণনা করিলাম । তিনি (দঃ) বলিলেন : তুমি যাহাকে দেখিয়াছ, সে চলিতে থাকিবে। ছিল আল্লাহ্র দুশমন আবূ-জেল! কেয়ামত পর্যন্ত এইভাবে তাহার উপর আজাব হযরত ইবনে মাসউদ (রা.) হইতে বর্ণিত- হযরত রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন ঃ একস্থানে একজন মস্তবড় মুত্তাকী পরহেযগার ছিল।

তাহার মৃত্যুর পর তাহাকে দাফন করিয়া লোকেরা বিদায় হইয়া চলিলে, আল্লাহ্ তায়ালা আজাবের ফেরেশতাকে নির্দেশ দিলেন, যেন তাহাকে চাবুক মারা হয়। সুতরাং সেই ফেরেশতা আল্লাহ্র হুকুম তামীলের জন্য তৎক্ষণাৎ তাহার কবরে আসিয়া তাহাকে চাবুক মারিতে চাহিলেন। কিন্তু লোকটি তখন বলিল : আমি আল্লাহ্র একজন তাবেদার ও এবাদতগোযার বান্দা। আমাকে শাস্তি দিও না। -এই বলিয়া সে শাস্তি মাফ পাওয়ার জন্য আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করিল। তখন এই বলিয়া উত্তর আসিল : মাত্র পঞ্চাশটি কোড়া মার। সে আবার দোয়া করিতে লাগিল ।

এইভাবে কয়েকবার দোয়া করার ফলে কোড়ার সংখ্যা হ্রাস করিয়া দেওয়া হইল এবং তাহাকে মাত্র একটি কোড়া মারার জন্য ফেরেশ্তাকে হুকুম করা হইল । ফেরেশ্তা তখন তাহাকে একটি কোড়া মারিলেন, আর অমনি তাহার কবরটি আগুনে ভরিয়া গেল এবং সে কবর-আজাবে পতিত হইয়া সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িল । কিছুক্ষণ পর তাহার সংজ্ঞা ফিরিয়া আসিলে সে ফেরেশ্তাকে জিজ্ঞাসা করিল, কোন গুনাহের শাস্তিস্বরূপ আমাকে কোড়া মারা হইল? ফেরেশ্তা উত্তর দিলেন : একদিন তুমি বিনা-ওযুতে নামাজ পড়িয়াছিলে, আর একদিন এক মজলুম ব্যক্তি তোমার নিকট সাহায্য চাহিয়াছিল, কিন্তু তুমি তাহার ফরিয়াদের প্রতি কর্ণপাত কর নাই ।

‘মান্ আ’শা বা’দাল মাউত’ নামক কিতাবে আবদুল্লাহ্ হইতে বর্ণিত, একদা তিনি কয়েকজন সঙ্গীসহ কিতিযোগে কোথাও যাইতে ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ প্রবল ঝড় বহিতে লাগিল, কালো মেঘে সমগ্র আকাশ ছাইয়া ফেলিল। প্রবল ঝড় এবং ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কয়েক দিন পর্যন্ত তাঁহাদের কিতি চলার পর হঠাৎ একদিন আকাশ পরিষ্কার হইয়া উঠিল, ঝড়-ঝঞ্ঝা থামিয়া গেল, কিশতিখানি একটি জনপদের নিকটে যাইয়া পৌছিল ।

বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ্ বলেন : আমি কিতি হইতে তীরে উঠিয়া পিপাসায় পানির সন্ধানে বাহির হইয়া গেলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর আমি দরজা বন্ধ একটি বড় বাড়ী দেখিতে পাইলাম। নিকটে জন-মানবের কোনরূপ সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না, কেবল উহার ভিতর হইতে প্রবল বেগে বায়ু প্রবাহিত হওয়ার মত শোঁ শোঁ শব্দ শোনা গেল ।

তবুও আমি আওয়াজদিলাম, কিন্তু কোনই উত্তর পাইলাম না। ইহার কয়েক মুহূর্ত পরেই দুইজন অশ্বারোহী সাদা চাদর পরিহিত অবস্থায় আমার সম্মুখে আসিয়া বলিলেন : হে আবদুল্লাহ্! এই পথে আরও কিছুদূর গেলে তুমি একটি হাউজ দেখিতে পাইবে। উহার পানি তুমি পান করিও। তবে, সেইখানে যাইয়া যদি আশ্চর্যজনক কিছু দেখিতে পাও, তবে ভয় পাইও না ।

অতঃপর আমি সেই দুইজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম ঃ এই বিরাট বাড়ীটি কাহার? তাঁহারা বলিলেন ; এই ঘরের মধ্যে মুরদাদের রূহসমূহকে রাখা হইয়াছে। আমি তাঁহাদের কথামত অগ্রসর হইয়া একটি হাউজের তীরে উপস্থিত হইলাম। সেইখানে আমি দেখিলাম, হাউজটির মাঝখানে পানি হইতে সামান্য উপরে পা বাঁধা অবস্থায় নীচের দিকে মাথা ও উপরের দিকে পা দিয়া একব্যক্তি শূন্যে ঝুলিতেছে, আর হাত বাড়াইয়া পানির নাগাল পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করিতেছে।

আমাকে দেখিয়াই সে বলিতে লাগিল : হে আবদুল্লাহ্! আমাকে একটু পানি পান করাও। তাহার দুরবস্থা দেখিয়া আমার মনে দয়ার উদ্রেগ হইল । আমি একটি পেয়ালায় পানি লইয়া উহা তাহার হাতে দিতে ইচ্ছা করিলাম, আর অমনি হাত অবশ হইয়া পড়িল । আমি তাহাকে পানি পান করাইতে পারিলাম না। আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম : হে খোদার বান্দা! তোমার পরিচয় কি? সে উত্তর দিল : আমি হইলাম হযরত আদমের পুত্র কাবীল ।

আমি আমার ভ্রাতাকে হত্যা করিয়া দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম হত্যাকাণ্ডের অনুষ্ঠান মধ্যে এই রেওয়ায়েতটি উল্লেখ করিয়াছেন।) করিয়াছিলাম।- (ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ূতী ‘তাফসীরে দোররে, মাসূর’-এর মদীনার কোন এক ব্যক্তি তাহার বোনের মৃত্যুর পর তাহাকে দাফন করতঃ গৃহে ফিরিয়া আসার পর তাহার মনে পড়িল, কবরের মধ্যে ভুলক্রমে সে একটি টাকার তোড়া ফেলিয়া আসিয়াছে।

সে তখন অপর এক ব্যক্তিকে সঙ্গে লইয়া বোনের কবরের নিকট গেল এবং কবর খুঁড়িয়া টাকার তোড়া বাহির করিয়া আনিতে গেল। সে নিজেই বর্ণনা করিয়াছে : অতঃপর আমি আমার সঙ্গীকে বলিলাম- তুমি একটু সরিয়া দাঁড়াও, আমি একটু দেখিয়া লই, কবরের মধ্যে আমার বোনের কি অবস্থা হইতেছে। আমি তখন একখানি কাঠ উঠাইয়া দেখিতে পাইলাম, সারাটি কবর আগুনে ভরিয়া রহিয়াছে। এই অবস্থা দেখিয়াই আমি তাড়াতাড়ি কাঠখানিকে যথাস্থানে রাখিয়া কবরের মুখ বন্ধ করিয়া দিলাম। বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া আমি আমার মায়ের নিকট এই বিষয়ে আলোচনা করিলে তিনি বলিলেন : সে নামাজ পড়িত বটে, কিন্তু একেবারে শেষ সময়ে

পড়িত, আর মাঝে মাঝে বিনা ওযুতেও পড়িত; এবং প্রতিবেশীদের ঘরে দেয়ালের সহিত কান পাতিয়া থাকিয়া তাহাদের গোপন কথা জানিয়া আসিয়া মানুষের নিকট উহা বলিয়া দিত ৷ ইবনে কাইয়ূম্ (রহ.) ‘কিতাবুর রূহ্’-এর মধ্যে বর্ণনা করিয়াছেন ঃ একদা এক ব্যক্তি কতকগুলি লৌহ-পেরেক বিক্রয়ের জন্য বাগদাদ শহরে কর্মকারদের বাজারে লইয়া গেল। একজন কর্মকার তাহার সেই পেরেকগুলি ক্রয় করতঃ বাড়ীতে যাইয়া সেইগুলিকে গলাইয়া অন্য কোন কিছু প্রস্তুত করার জন্য আগুনের বাটিতে ফেলিয়া উত্তাপ দিতে লাগিল ৷

কিন্তু আগুন উহার উপর কোনই ক্রিয়া করিল না, পেরেকগুলি আগুনের ভীষণ উত্তাপের মধ্যেও লাল বর্ণ ধারণ করিল না; এমন কি একটু নরমও হইল না। বিরাট হাতুড়ী দ্বারা সে ঐগুলিকে খুব পিটাইল, তাহাতেও কোন ফল হইল না। সে নিজের সকল চেষ্টার ব্যর্থতা দেখিয়া, শেষ পর্যন্ত পেরেকগুলির বিক্রেতার খোঁজ করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল : বল ত তুমি এই পেরেকগুলি কোথায় পাইয়াছ?

সে প্রথমে টালবাহানা করিয়া এই প্রশ্নের উত্তর এড়াইয়া যাইতে চাহিল, কিন্তু কর্মকারের জোর অনুরোধে বাধ্য হইয়া অবশেষে বলিল : একদা একটি কবরস্থানের নিকট দিয়া গমনের সময় আমি দেখিলাম, একটি পুরাতন কবরের মুখ খুলিয়া রহিয়াছে, আর এই পেরেকগুলি সেই কবরের মৃতের শরীরের হাড়ের সহিত বিদ্ধ রহিয়াছে আমি প্রথম অনেকক্ষণ পর্যন্ত টানাটানি করিয়াও হাড় হইতে এই পেরেকগুলি খুলিতে পারি নাই। পরে হাড়গুলিকে গুঁড়া এই গুলি বাহির করিয়া আনিয়াছি ।

মুরদাগণ যেয়ারতকারীদিগকে চিনে

হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিয়াছেন : যখন কোনও ব্যক্তি তাহার পরিচিত মুসলমান ভ্রাতার কবরের নিকট দিয়া গমন করার সময় তাহাকে সালাম করে, তখন কবরের মুরদাও তাহাকে চিনিয়া থাকে, তাহাকে প্রিয় মনে করে, এবং তাহার সালামের উত্তর দিয়া থাকে। আর যদি এমন কোন মৃত্যুকে সালাম করে, যাহার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ছিল না, সেও সন্তুষ্ট হয় এবং সালামের উত্তর দিয়া থাকে।

হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন-একদা আবু রযীন (রা.) হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) খেদমতে আরজ করিলেন : ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমাকে মাঝে মাঝে করবস্থানে যাইতে হয়। সেইখানে আমার কি করা উচিত? তদুত্তরে হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিলেন : যখন তুমি কবরস্থানে যাইবে, তখন সালামের পর দোয়া করিবে ।

অতঃপর আবু রযীন (রা.) আরজ করিলেন : ইয়া রাসূলাল্লাহ্! মুরদাগণ বি আমাদের সালাম শুনিতে পায়? তিনি (দঃ) বলিলেন : হাঁ শুনিতে পায় এবং উত্তরও দিয়া থাকে, কিন্তু তোমরা তাহা শুনিতে পাও না ।

বর্ণিত আছে, হযরত রাসুলুল্লাহ্ (দঃ) ‘ওহুদ’ হইতে প্রত্যাবর্তনের শহীদানের কবরের নিকট তশ্রীফ নিলেন এবং মোছ্আব ইবনে উমায়ের এর কবরের পার্শ্বে দাঁড়াইয়া বলিলেন : আমি সাক্ষ্য দিতেছি যে, তোমরা আল্লাহর দরবারে জীবিত আছ। এইকথা বলার পর তিনি সাহাবীগণকে সম্বোধন করিয়া। বলিলেন : তোমরা ইহাদের কবর জেয়ারত করিও এবং ইহাদিগকে সালাম করিও। সেই পাক-জাতের কছম যাঁহার হাতে আমার জীবন, কোন ব্যক্তি ইহাদের সালাম করিলে, ইহারা তাহার সালামের উত্তর দিয়া থাকে। এইভাবে কিয়ামত পর্যন্ত যখন কেহ সালাম করিবে, তখনই তাহারা উহার উত্তর দিবে।

ইমাম বায়হাকী, মুহাম্মদ ইবনে ওয়াসে হইতে বর্ণনা করেন-তিনি বলিয়াছেন : আমি এই সংবাদ জানিতে পারিয়াছি যে, হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিতেন : যে ব্যক্তি জুমার দিনে কিংবা উহার একদিন পূর্বে অথবা উহার একদিন পরে কোনও মৃত্যের কবর জেয়ারত করে, তাহাকে সেই মৃত্যব্যক্তি চিনিতে পারে ৷

পৌছিয়া তিনি মুরদাদের ডাকিয়া বলিলেন :- একদা হযরত আলী (রা.) মদীনার কবরস্থানে গমন করিলেন । সেইখানে “হে কবরের অধিবাসিগণ! তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক এবং আল্লাহ্র রমত ও বরকত নাযিল হউক । তোমরা কি তোমাদের হাল-অবস্থা আমাদিগকে শুনাইবে, নাকি আমাদের অবস্থা শুনিতে চাও? তাঁহার এই কথার উত্তরে একটি কবর হইতে আওয়াজ আসিল : ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতুহু। হে আমীরুল মো’মেনীন! আপনিই বলুন, আমাদের বিদায়ের পর কি কি হইয়াছে । তখন তিনি তাহাদিগকে অনেক কথা বলিলেন ।

আতাফ্ বলেন : আমার খালা একদা শহীদানে-ওহুদ-এর জেয়ারত করেন। তিনি তাঁহার সোয়ারীর পশুর যত্ন লওয়ার জন্য দুইজন গোলাম সঙ্গে লইয়া যান। শহীদানের মাজারের নিকট যাইয়া তিনি দুই রাআত নামাজ পড়েন। অতঃপর শহীদগণকে সালাম করেন এবং শহীদগণের পক্ষ হইতে উহার উত্তর পান তা ছাড়া শহীদগণ তাঁহাকে বলেন- ‘আমরা একে অন্যকে যেইরূপ চিনিয়া থাকি, তদ্রূপ তোমাদিগকেও চিনি।”

রূহসমূহের বাসস্থান

ইহজগত এবং পরজগতের মাঝখানে আর একটি জগত রহিয়াছে, উহার নাম ‘আলমে বরযখ্। সেই জগতটি দুনিয়ার তুলনায় বড় এবং আখেরাতের তুলনায় ক্ষুদ্র। সেইখানেও বিভিন্ন শ্রেণী বা স্তর রহিয়াছে। মৃত ব্যক্তিগণের আমলের তারতম্য অনুসারে তাহাদের রূগুলিকেও বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন অবস্থায় রাখা হয় ।
কতকগুলি রূহ্ বেহেশতের দ্বারদেশে অবস্থান করিয়া থাকে। কতক লোকের রূহ্ কবরে থাকে । আবার কতকের রূহকে সপ্তস্তর জমীনের নীচে বন্দী করিয়া আজাব দেওয়া হয়। সেইগুলি হইল কাফের-মুশরেকদের রূহ্ ।

কতক রূহকে আগুনের বাটিতে আবার কতককে রক্তের স্রোতে ফেলিয়া আজাব দেওয়া হয় । মোট কথা, পয়গাম্বর এবং শহীদগণের রূহ্ বেহেশতে বাস করে এবং আল্লাহ্ তায়ালার অনুমতিক্রমে উহারা যেইখানে ইচ্ছা সেইখানেই যাইতে পারে । এই দুই সম্প্রদায় ব্যতীত আর সকলের রূহ ‘আলমে বরযখে’ অবস্থান করে এবং কবরের লাশের সহিত উহাদের এক বিশেষ ধরনের সম্পর্ক থাকে এবং সেইখানে উহারা আমলের তারতম্য অনুসারে বেহেশতের আরাম উপভোগ করে অথবা দোযখের শাস্তি ভোগ করে ।

‘আছাহ্’ গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, মো’মেনদের রূহ্ বিভিন্ন অবস্থায় থাকে । যেমন কোন কোনটি পক্ষীর আকার ধারণ করিয়া বেহেশতের বৃক্ষশাখায় অবস্থান করে। তন্মধ্যে আবার কতক রূহ্ সবুজ পক্ষীর এবং কতক সাদা পক্ষীর রূপ ধারণ করিয়া থাকে । আবার কতক রূহ্ আরশের নিম্নদেশে ঝুলন্ত ফানূস সমূহের মধ্যে অবস্থান করে। আবার কোনটি জান্নাতী মানুষের আকৃতি ধারণ করে। আবার কতকগুলিকে নূতন কোনও আকৃতি দান করা হয়, আর উহারা নেকআমলের পরিমাণ অনুসারে দুনিয়ায় ভ্রমণ করিয়া বেড়ায়।

কোন কোন সময় রূহ্ তাহার দেহে আসিয়া প্রবেশ করে। আবার কতক রূহ্ অন্যান্য রূহের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করিয়া সময় অতিবাহিত করে। কতকগুলি রূহ্ হযরত মীকাঈল ফেরেশ্তার, কতকগুলি হযরত আদম (আ.)-এর, আবার কতকগুলি হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর তত্ত্বাবধানে থাকে ।
হযরত ইবনে আব্বাছ (রা.) বর্ণনা করেন- হযরত রাসূলুল্লাহ্ (দঃ) বলিয়াছেন : শহীদগণের রূহ্ সবুজ চিড়িয়ার মধ্যে থাকে এবং বেহেশতের নহর সমূহের তীরে এবং বাগানসমূহে ভ্রমণ করে। উহারা উড়িয়া উড়িয়া এই বাগান হইতে সেই বাগানে যাইয়া নানারকম সুস্বাদু মেওয়া ভক্ষণ করে।

বেহেশ্ত অবস্থান করে। ভ্রমণের পর আরশের তলদেশে স্বর্ণ-নির্মিত ফানুস সমূহের মধ্যে যাইয়া উহারা হযরত ওয়াহাব ইবনে মুনাব্বাহ্ (রা.) হইতে বর্ণিত, সপ্তামাকাশে ‘বায়দা’ নামে একটি স্থান আছে। সেইখানে মো’মেনদের রূহগুলি একত্রিত হয়। দুনিয়ার কোনও মো’মেনের মৃত্যু হইলে, তাহার রূহকেও এইস্থানে লইয়া যায়া হয়। তখন অন্যান্য রূহ্ এই রূহটির নিকট দুনিয়ার সংবাদ জিজ্ঞাসা করে, যেমন কোনও তাহার সফরের অবস্থাদি জিজ্ঞাস করিয়া থাকে।

ব্যক্তি বিদেশ হইতে বাড়ীতে ফিরিয়া আসিলে, পরিবারের লোকেরা তাহাকে হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) হইতে বর্ণিত-মো’মেনদের রূহগুলিকে হযরত বলেন-কিয়ামত পর্যন্ত তোমরা এইখানেই অবস্থান কর। জিব্রাঈল (আ.)-এর নিকট উপস্থিত করা হইলে তিনি উহাদিগকে হযরত ওয়াহার্ ইবনে মুনাব্বাহ্ (রা.) বর্ণনা করেন- মো’মেনদের রূগুলিকে একজন ফেরেশ্তার নিকট লইয়া যাওয়া হয়। তাঁহার নাম ‘রূমাঈল’তিনি মো’মেনদের রূসমূহের তত্ত্বাবধায়ক। আর কাফেরদের রূহগুলি যে ফেরেশ্তার তত্ত্বাবধানে থাকে, তাঁহার নাম দিওমাহ্ ।

হযরত আলী (রা.) হইতে বর্ণিত, তিনি বলেন- মো’মেনদের রূহ্ যমযম কূপের মধ্যে রহিয়াছে। আল্লাহ্র দৃষ্টিতে হায়া মউতের ময়দানটি হইল নিকৃষ্টতম ময়দান। কেননা, উহাতে কাফেরদের রূহ্ একত্র করা হয় ৷ উহাকে‘বারহৃত’ও বলা হয় ।

হযরত আলী (রা.) হইতে বর্ণিত অপর একটি রেওয়ায়েতে আছে যে, দুনিয়ার সমস্ত ময়দান অপেক্ষা মক্কার ময়দান সর্বোত্তম, আর হায়া মউতের ময়দান সর্বনিকৃষ্ট । কেননা, উহাতে কাফেরদের রূগুলি জমা হয় ।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন- কাফেরদের রূহ্ হায়া রূহ্ একত্রিত হয় “জাবিয়াহ’ নামক স্থানে । মউতের ময়দানে অবস্থিত ‘বারহৃত’-এর মধ্যে একত্রিত হয়, আর মো’মেনদের ইয়ামন প্রদেশের হায়ামউত শহরের অদূরে ‘ছাআ’ নামক একটি নিম্নভূমি আছে। উহাকে ‘বারহূত’ এবং ‘বী’রে বারহূত’ও বলা হয়। কাফের-মুশরেকদের রূগুলিকে সেইখানে একত্রিত করা হয়। ঐস্থানটি জাহান্নামের সহিত সংযুক্ত। ‘বারুল্ কালাম’ কিতাবে বর্ণিত আছে যে, এই ‘বারহৃত’ -এর নিম্নদেশেই জাহান্নাম্ অবস্থিত।

আর শামদেশে ‘জাবিয়াহ’ (৬) নামক একটি স্থান আছে। উহার অপর নাম ‘আরীহা’। সেইখানে মো’মেনদের রূহ্ একত্র হয়। বারহূত এবং আরীহা, দুইটি স্থানেই ‘আলমে বরযখ রহিয়াছে।

আমদ ইবনে মুহাম্মদ নিশাপুরী তাঁহার রচিত গ্রন্থে হামেদ ইবনে ইয়াহ্ইয়া হইতে বর্ণনা করেন : খোরাসানের এক ব্যক্তি মক্কা শরীফে বাস করিতেন। মক্কায় তাঁহার ‘আমানতদারী’র (বিশ্বস্ততার) বেশ খ্যাতি ছিল। লোকেরা তাঁহার নিকট টাকা-পয়সা আমানত রাখিত, আবার প্রয়োজন মত তাঁহার নিকট হইতে উহা ফেরত লইয়া যাইত । একবার একব্যক্তি বার হাজার আশ্রাফি (সোনার মোহর) তাঁহার নিকট গচ্ছিত রাখিয়া গেল।

তিনি এই মোহরগুলিকে ঘরের মধ্যে একস্থানে মাটির নীচে পুঁতিয়া রাখিলেন। ইহার কয়েকদিন পরেই তাঁহার মৃত্যু হইল । তাঁহার মৃত্যুর পর আশ্রফির মালিক আসিয়া তাঁহার পুত্রগণের নিকট উহা চাহিলে, তাহারা এই বলিয়া উত্তর দিল : আমরা উহার খবর জানি না। আব্বাজান নিজে কোথায় রাখিয়া গিয়াছেন বা কি করিয়াছেন, তাহা আমাদের কিছুই জানা নাই ৷

অতঃপর তাঁহার পুত্রগণ স্থানীয় আলেমদের নিকট যাইয়া জানিতে চাহিলে এই অবস্থায় কি করিয়া লোকটির আমানত আদায় করিয়া মরহুম পিতাকে দাবীমুক্ত করা যায়। আলেমগণ বলিলেন : আমরা জানি, তোমাদের পিতা একজন নেক্কার লোক ছিলেন। আর আমরা এই সংবাদ জানিতে পারিয়াছি যে, নেক্কার ব্যক্তিগণের রূহ্ যম্যম্ কূপের মধ্যে অবস্থান করে। সুতরাং তোমরা অর্ধরাত্রির পর যমযমের তীরে উপস্থিত হইয়া তোমাদের পিতাকে ডাকিবে । নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের কথার উত্তর দিবেন। তখন তোমরা তাঁহার নিকট আশ্রফির কথা জিজ্ঞাসা করিও।

আলেমদের পরামর্শ অনুসারে খোরাসানীর পুত্রগণ যমযমের তীরে যাইয়া একাধিক্রমে তিনদিন পর্যন্ত তাহাদের পিতাকে ডাকিল, কিন্তু কোনই উত্তর পাইল না। সুতরাং তাহারা পুনরায় আলেমগণের নিকট যাইয়া এই অবস্থা বর্ণনা করিল । তাহাদের বর্ণনা শুনিয়া আলেমগণ ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন” পাঠ করিয়া বলিলেন : তোমাদের পিতা জাহান্নামী হইয়া গিয়াছে। তোমরা ইয়ামনের ‘বারহৃত’ ময়দানে গমন কর । সেইখানে একটি কূপ আছে এবং উহাতে জাহান্নামীদের রূগুলিকে রাখা হয়। সেইখানে যাইয়া অর্ধরাত্রির পর তোমরা তোমাদের পিতাকে ডাকিও। অতঃপর ছেলেরা সেইখানে যাইয়া পিতাকে ডাকিলে, তৎক্ষণাৎ উহার উত্তর আসিল ।

Read More: নেক আমল বই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top