মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প – ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ছোট গল্প

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প, মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী নতুন প্রজন্মের জন্য বই লেখার উদ্দেশ্য। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনেনি। আমার শৈশবের এলোমেলো স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মরণীয় কথা। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

লেখিকার কথা
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী নতুন প্রজন্মের জন্য বই লেখার উদ্দেশ্য। যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি। মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনেনি। আমার শৈশবের এলোমেলো স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মরণীয় কথা। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচিতি। আমার বড় ভাই আবু তাহের। স্বামী মোঃ নূরুল ইসলাম। নওগাঁ জেলা তিলকপুর ইউনিয়ন, গ্রাম ডাকাহার। বড় ভাই আজিজুল আলম। বাঘা, কলিগ্রাম। রাজশাহী বড় ভাই হামিদুল হক এ্যাডভোকেট খয়ের হাট, বাঘা থানা, রাজশাহী। মোঃ মোজাম্মেল হক। ভবানীপুর। তিলকপুর, নওগাঁ জেলা ।
আমার বাবাকেও পাকবাহিনীরা হত্যা করেছিল। বাবার কথা স্মৃতিতে আসে না। লিখার ধারাবাহিক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এলোমেলো স্মৃতিতে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। তার জন্য পাঠকের নিকট ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আয়েশা ছিদ্দিকা
১৫ জানুয়ারি ২০১৭


মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প, ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ

১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ বাংলা ভাষা দাবী দিবস পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৪৮ সালে ৪ঠা জানুয়ারি শেখ মুজিবসহ অনেককে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে খাজা নাজিম উদ্দীন ১৫ই মার্চ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কারাবন্দি শেখ মুজিব ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচী পালনের লক্ষে ছাত্র আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা কর্মীদের পরামর্শ দেন। এরপর শেখ মুজিবকে ঢাকা কারাগার থেকে সরিয়ে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে বাংলাকে, বাংলা ভাষা রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সময়ে শোষণ, বঞ্ছনার গ্লানি থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে বাঙালীর মুক্তির সনদ হিসাবে ৬ দফা দাবী পেশ করেন। এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চ এর বজ্রকণ্ঠ ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলার আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করা হয়। তার ভাষণের মুল বক্তব্য ছিল এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম । এই ভাষণের পর গোটা বাঙালী জাতি একই সূত্রে সংগ্রামের ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ।

২৫ শে মার্চ এর কালো রাতে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায় এবং বাংলাদেশে অবস্থিত পাক বাহিনীদের বলে যে, ৩০ লক্ষ বাঙালী হত্যা করলে সব শান্ত হয়ে যাবে। প্রথমে ঢাকা পরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে বাঙালীদের উপর অত্যাচার। অগ্নি সংযোগ। গণহত্যা, নারী নির্যাতন শুরু করে।

আমাদের গ্রাম থেকে ৩ গ্রাম পর ফতেপুর গড়ের হাট নামক স্থানে ভোর রাতে হানাদার বাহিনী গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে এবং লুটতরাজ, অগ্নি সংযোগ করে এবং পাশের গ্রাম থেকে ১৯ জন যুবককে ধরে এনে সারিবদ্ধ করে গুলি করে হত্যা করে। এরপর নওগাঁ সদরে পার-নওগাঁয় একটি রূপ ছিল পাঠশালা স্কুলের পার্শ্বে একটি ঘর ছিল। পাক বাহিনীরা বিভিন্ন স্থাन থেকে ১৪ বৎসর থেকে ৩০/৩৫ বৎসরের যুবতী সুন্দরী নারী ধরে এনে পালাক্রমে ধর্ষণ করে পরে জবাই করে কূপে ফেলে দেয় এই সব ঘটনাগুলি শুনে ও দেখে আমার বড় ভাই আবু তাহের।

সে ছিল দেশপ্রেমিক। নওগাঁ জেলার তিলকপুর ইউনিয়নের ডাকাহার গ্রামের তার বাড়ী। ১৯৭১ সালে দেশমাতৃকা রক্ষার জন্য এবং সোনার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে ২/১ জন বন্ধুসহ নিজ বাড়ী হইতে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে ছোট খাটো ট্রেনিং। শেষ উত্তর প্রদেশের দেরাদুন জেলায় চাকরাতা মহকুমায় মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং শেষে নিজ দেশে ফিরে গ্রামের প্রায় ৩০০ জন তরুণ ছেলেকে রাতের অন্ধকারে ট্রেনিং দিয়ে শক্তিশালী দল গঠন করেছিলেন।

ইহা ছাড়া বিভিন্ন স্থানে শত্রু বাহিনীর সহিত যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সততার সহিত কাজ সমাধা করেছেন। তিনি ছিলেন বাহিনীর কমান্ডার, তার বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। ‘অভিস’ ও নির্ভিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমরা মঙ্গল কামনা করি। দেশ স্বাধীনের পর পরবর্তীতে নাটোর চিনি কলে চাকুরী গ্রহণ করেন। আবু তাহেরের ছোট ভাই নূর ইসলাম নুরু ভাইয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব অর্জন করে।

ফতেপুর গ্রামের এক রাজাকার পাকবাহিনীকে ক্যাম্পে খবর দিল । এই গ্রামে মুক্তিবাহিনী অবস্থান করছে। রাজাকারের কথা শুনে দুপুরের দিকে পাক বাহিনী আসতে শুরু করল। এ কথা শুনে গ্রামের নারী পুরুষ বৃদ্ধি বণিতা। যে যে অবস্থায় ছিল। কোন বাড়িতে রান্না হয়েছে, কোন বাড়িতে খাওয়া শুরু হয়েছে, কাহারো হাতের মুঠো ভাতের কাড়া নিয়ে দৌড়ে মাঠ পেরিয়ে ১ কিলোমিটার দূরে একটি নদীর পারে গিয়ে দাঁড়ায়ে কাড়াটি

খেয়েছিল। নদীর পারে জঙ্গলে সবাই লুকিয়ে পড়ল। ফতেপুর গ্রাম তখন পুরুটাই ফাঁকা হয়ে গেল। মাঝে মধ্যে দু’একটা বৃদ্ধ যাদের শারিরীক অবস্থা খুব খারাপ ছিল তারাই শুধু রয়ে গেল। তাদের মধ্যে একটি বউ যেতে না পারায় ঘরের মধ্যে খাটের নিচে লুকিয়ে পড়ল। ঐ ঘরের চালার উপর মুক্তিযোদ্ধারা ছিল। সেটা বউটি জানতো। রাজাকার পাক বাহিনীদের বাড়ীটি দেখে দেয়। হানাদার বাহিনী বাড়িতে ঢুকে বন্ধ ঘরের দরজায় গিয়ে বলতে লাগল।

দরজা খুলিয় ঘরমে কিয়া হো। সারা না পেয়ে লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢোকে বউটিকে বের করে জিজ্ঞেস করল। মুক্তি বাহিনী কাহাহো বল দিয়া। বউটি ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। তবে মুক্তি বাহিনীর কথা বুঝতে পারছিল। ওরা মুক্তি বাহিনীকে খুঁজছে। বউটি জানতো ঘরের উপরেই মুক্তি বাহিনী লুকিয়ে আছে। বউটি ভাবল আমার জীবন গেলেও মুক্তি বাহিনীদের খোঁজ দিব না।
বউটি বলল আমি জানিনা। তখন কুত্তাগুলি ধর্ষণ করে তার শরীর রক্তাক্ত করে চলে গেল ।

বউটি নিজে সম্মান দিয়ে, সোনার দেশের সোনার ছেলেদের বাঁচিয়ে দিল । আমার বড় ভাই আবু তাহের মুক্তিযুদ্ধাদের কমান্ডার ছিল। সে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে ও যুদ্ধ করেছে। জয়পুরহাট থেকে, তাহের ভাইকে আহ্বান জানায়। গ্রামের কয়েকজন মুক্তিবাহিনীদের বলল যেন সামাদ, রাজ্জাক, মোজাম্মেল সালামকে বলল, কাল যেতে হবে, সে কথা নূরুল ইসলাম নূর তাহের ভাইয়ের ছোট ভাই, নূরু বলল আমিও তোদের সঙ্গে যাব। নূরু ছিল সব ভাইবোনের ছোট্ ও আদরের। সব ভাই বোনেরা ওকে খুব ভালবাসে। তাহের ভাই বলল, তুই ছোট মানুষ ও তোকে যেতে হবে না। আমি ছোট হলেও সব অস্ত্র চালাতে পারি। তুই তো আমাকে ট্রেনিং দিয়েছিস। ওর জেদ সহ্য করতে না পেরে ওকেও সঙ্গে নিয়ে, ওরা জয়পুর জেলার গ্রামে গাজী ভাইয়ের বাড়ী আরো।

মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আশ্রয় নিল। ‘গাজী ভাইয়ের বাড়ী থেকে প্রায় এক/দেড় মাইল দূরৈ পাক বাহিনীদের ক্যাম্প, ঐ গ্রামে আকবর মুন্সী নামে এক রাজাকার পাক-বাহিনীদের দলে যোগ দেয়। আকবর মুন্সী গ্রামের

কোন কোন বাড়ীতে সুন্দরী যুবতী বউ মেয়ে আছে কোন বাড়ীর ছেলেরা মুক্তিযোদ্ধা, সেই সব খবর পাক বাহিনীর ক্যাম্পে বলে দেয়। আকবর মুন্সী পাক বাহিনীদের নিয়ে নিজ গ্রাম ও আশে পাশের আমে গিয়ে সুন্দর সুন্দর যুবতী বউ ঝিদের ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে কোথায় যে গুম করে ফেলে, তা কেউ বলতে পারে না। আকবর মুন্সী গ্রমের ধনী গরিব সবাইকে ভয় দেখিয়ে কারো কাছে ছাগল, কারো কাছে মুরগী হাঁস কারো কাছে দুধ ডিম কলা, গ্রাম থেকে সব মুছে নিয়ে গিয়ে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে দিয়ে আসে ও নিজেও খায়। এইভাবে পশুগুলির পেট ভরাতো।

গ্রামে খুব গরিব বুড়ী মানুষ থাকে, বুড়ির দুই ছেলে, ছেলে দুটিও গরিব কোন জমা জমি নেই, দিনমজুরের কাজ করে কোনরকমে জীবন যাপন করে। ঠিকমত বউ ছেলে মেয়ে খাওয়াতে পারে না অনেক সময় অনাহারে দিন কাটে ছেলেদের কষ্ট দেখে নিজেই হাঁস মুরগী একটি দুধের গাভী আছে। দুধ খুব বেশি হয়না এ ২/১ কেজি দুধ হয় এই গুলি বিক্রি করে নিজের খাবার টুকু জুটিয়ে নেয়। তা থেকে টাকা বেঁচে গেলে সে গুলো দুই ছেলের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেয়। নির্দয় আকবর মুন্সী বুড়ীকেও ছাড় দিল না। বুড়ীকে ভয় দেখিয়ে হাঁস মুরগীর ডিম দুধ ২/১ দিন পর পরই এসে নিয়ে যেয়ে ক্যাম্পে দিত ও নিজেও খেত।

রাজাকারটা বুড়ীকে জ্বালিয়ে মারত। দুর্বলের প্রতি সবলের আঘাত একদিন বুড়ী গাভী দোয়াতে লাগল কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেদিন দুধ বের করতে পারল না। দুধ সব বাছুরে খেয়ে ফেলেছে। সেই দিন আকবর মুন্সী এসে বুড়ীকে বলল দুধ দাও, বুড়ী বলল, বাবা আজ দুধ হয়নি বাছুরে খেয়ে ফেলেছে, তুমি কাল এসে নিয়ে যাও। রাজাকারটি বিশ্বাস করল না। বুড়ীকে আবোল তাবোল কথা বলতে লাগল, বুড়ীর ছোট ছেলে বাড়ীতে ছিল। মায়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে, আকবর মুন্সী সঙ্গে তর্কাতর্কি করে আকবর মুন্সী চলে গেল। মনে হয় বাপের বাড়ীর ধন। পরদিন ক্যাম্পে গিয়ে হানাদার বাহিনীদের বলল, মেরা গ্রামছে মুক্তি বাহিনী আছে, আগে বাড়ী উপস্থিত হলো, বুড়ীকে বলল, তোর দুই ছেলেকে ডাকদে, বুড়ীর বড় ছেলে হাটে গিয়েছিল।

ছোট ছেলের জ্বর হয়েছে ও ঘরেই ছিল। আকবর মুন্সী আবার বলল, ছেলেকে ডাক দে, বুড়ী পাক বাহিনীদের দেখে ভয়ে থর থর করে কাঁপছিল আকবর মুন্সী পান চিবাতে চিবাতে ছাতাটা মাথায় দিয়ে, ফাটা চশমার ফাঁক দিয়ে বুড়ীর দিকে জুল জুল করে তাকিয়ে রইল। বুড়ী আকবর মুন্সীর দুটি পা চেপে ধরে বলল, বাবা তুমি আমাকে মেরে ফেল, আমার ছেলেদের কিছু বল না, আকবর মুন্সী খিল খিল করে হেসে লাথি মেরে ফেলে দিল। বুড়ী হানাদার বাহিনীর পা চেপে ধরে কেঁদে কেঁদে বলল, বাবারা তোমরা আমার ছেলেদের কিছু বল না ওদেরকে আমায় ভিক্ষা দাও।

আমাকেই মেরে ফেল ওদের ছেড়ে দাও আমি যে সইতে পারব না। পাক বাহিনী বলল, আকবর মুন্সী কিয়া বলিয়ে? আকরব মুন্সী বলল, ওর ছেলে মুক্তি বাহিনীতাই ভিক্ষা চাহিয়ে। আকবর মুন্সীর কথা শুনে পাক বাহিনী রেগে উঠে বুড়ীকে বলের মত সট মেরে ফেলে দিয়ে বন্ধুকের নল দিয়ে খোচাতে লাগল। আকবর মুন্সী বলল, হুজুর ঘরমে যায়েগা বলে বুড়ীর ছেলের ঘরে সবাই ঢুকে বুড়ির ছেলেকে ঘর থেকে টেনে এনে বাইরে গাছের সঙ্গে বেধে গুলি করে বুক ঝাঁঝরা করে দিয়ে চলে গেল। তাতেই ভাই। রাজ্জাক, নূরু, ছামাদ, গাজী ভাই এর বাড়ীতে খেত। গাজী ভাই ধনী লোক। এলাকার লোক জন তাকে সম্মান করে। তার বাড়ীতে আরও ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা খায়। আশে পাশের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা সব মিলিয়ে ১৫ জনের মত খায় ।

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

ওদের সাথে হাত মিলিয়ে তাহের ভাই এক সাথে কাজ শুরু করে। ঐ গ্রামের আলতাফ ভাই বলল, আজ রাতে নদীর পাড়ে আপনারা সবাই আসবেন ।
আলোচনায় বসতে হবে। আঁধারের মধ্যে দিয়ে সবাই মিলে একত্রিত হল। আলতাব ভাই বলল, এই গ্রামে মানুষদের উপর নয়। আশে পাশের গ্রামের মানুষেরাও ওদের অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছে। কয়েক গ্রাম মিলে ৮/১০ জন মেয়েদের ধরে নিয়ে গিয়ে গুম করেছে। তারপর বুদা চাচা, কালাম ভাই, হাফিজ ভাই, নারায়ণ কাকা, ইউনুছ মিয়া, কাবুল ভাই, গোপাল দা এমনকি পাগল ফেলুকে পর্যন্ত ছাড়ে নি। সবাইকে চোখ বেধে গুলি করে হত্যা করেছে। পশুর বাচ্চা, আকবর মুন্সীকে উচিৎ শিক্ষা দিতে হবে। শয়তানের বাচ্চা পশুদের মেয়ের লোভ মিটিয়ে দিতে হবে। ওদের মধ্যে খুব কম বয়স মুক্তি বাহিনীদের তাহের ভাই বলল, তোমাদেরকে মেয়ে সেজে পশুদেরকে শেষ করতে হবে। রতন বলল, কিভাবে? বুঝলাম না।

তোমরা ৮/১০ জন বোরকা পড়ে মেয়ে সাজতে হবে।
রতন বলল, খুব পারব।
মা খালাদের কাছ থেকে বোরকা আনতে পারব। আলতাব ভাই বলল,
একটি সাহসী মেয়ের প্রয়োজন।
রতন বলল, একজন মেয়ে আছে ।
আলতাব বলল, কে ।

রতন বলল, বুড়ীর ছোট ছেলেকে কয়েকদিন আগে গাছের সঙ্গে বেধে গুলি করল । সেই শফিক চাপার মেয়ে ফুলমতি ।
আলতাব ভাই বলল, ওকে বলে দেখ। আলোচনা শেষ করে রতন রাতের অন্ধকারে শফিক চাচার বাড়ী গেল। দরজায় শব্দ করতেই চাচি বলল কে?
চাচি আমি রতন। চাচি জানত, রতন মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। তাড়াতাড়ি রতনকে ঘরে টেনে নিয়ে বলল, বাবা তুই কি মনে করে এলি?
রতন, চাচি তোমাদের দেখতে এলাম । কেমন আছ ।

চাচি কেঁদে ফেলল, কেমন আর থাকব বাবা তোর চাচা নেই। চার ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমি নিজে সমুদ্রে ভাসছি।
রতন বলল, চাচি আর বেশী দেরি নেই। কুত্তার বাচ্চাদের দিন শেষ
হয়ে গেছে ।
চাচি বলল, বাবা চারটে সিদ্ধ ভাত খেয়ে যা।
রতন বলল, ঠিক আছে দাও ।

চাচি চলে গেল । রতন বলল ফুলমতি একটি কাজ করতে পারবি। কি কাজ?
রতন সব কথা বুঝিয়ে দিল। ফুলমতি বলর, খুব পারব। আমি বাবার রক্ত ছুঁয়ে শপথ করেছি। আমি ঐ শয়তান আকবর মুন্সী ও পশুগুলিকে মেরে বাবার প্রতিশোধ নিবই । তাতে আমার প্রাণও যদি দিতে হয়। দিব।

রতন চলে গেল ফুলমতি রতন চলে যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে রইল । ফুলমতি দেখতে যেন ফুলের মত সুন্দর। বয়স বড় জোর ১৬/১৭ হবে ও খুব সাহসী ও বুদ্ধিমতি। আকবর মুন্সী শকুনের মত শফিকের বাড়ীর উপর উড়ে বেড়ায়। সুযোগ পেলেই কিছু একটা নিয়ে যাবে।

ফুলমতি সেই সুযোগের অপেক্ষায় আছে। কখন শকুনটা আসে। এক বিকালে ঠিক ঠিক শকুনটা এসে ঘুরছিল। ফুলমতি সুযোগ মত সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আকবর মুন্সী ফুলমতিকে দেখে যেন ভয় ভয় করছিল। সেটা ফুলমতি বুঝতে পেরেছে। ভাবল হয়তো শকুনটা উড়ে যেতে পারে। তার চেয়ে ভাল আমি আগে কথা বলে ওর ভয় ভেঙ্গে দিই। ফুল মতি বলল, আকবর চাচা আমাদের খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে। তুমি আমাকে একটা কাজ জোগাড় করে দিতে পারবে?

কি কাজ করবি। এই মেলেটারিদের যদি কোন কাজ করতে হয় করব। আকবর মুন্সী বলল, কি কাজ করবি? তার চেয়ে ভাল কিছু মেয়ে মানুষ জোগাড় করে দিতে পারবি? তাহা হলে মেলেটারি অনেক টাকা দিবে। সেই টাকা দিয়ে তোরা অনেক দিন চালাতে পারবি। ফুলমতি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। বলল, কয়টা মেয়ে লাগবে। আমি দিতে পারব। আকবর আপাতত ৮/১০ জন হলেই চলবে। ফুল মতি বলল, ঠিক আছে। কাল তুমি বিকেলে মাঠের ধারে এসো। শকুনটা চলে গেল । ফুলমতি বাড়ী ফিরল।

রাতে আবার রতন ভাই ফুলমতির বাড়ী এলো। বলল, কি ফুলমতি, কাজ কত দূর এগিয়েছিস।
ফুলমতি বলল, সব ঠিক আছে। এখন তুমি রেডি হয়ে ৮/১০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মাঠের ধারে এসো।
পরদিন ফুলমতি গাজী চাচার বাড়ী গেল ।
চাচিকে বলল, আমাকে একটি বোরকা দাও ।

চাবি বলল, কি করবি? দরকার আছে। চাচি বুঝতে পারলো। ফুলমতি কিছু একটা করতে পারে।
ফুলমতি বোরখা নিয়ে ফিরে এলো। রতন গিয়ে ওর সমবয়সী ১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে বলল, তোরা রেডি হ। অপারেশানে যেতে হবে।

তাহের ভাই বলল, তোমরা খুব সাবধানে কাজ করবে যেন ওরা বুঝতে না পারে। ওরা জামার ভিতর এস এল আর কালো দু পাটা বোরখা পরে নিল, সবাই এক সঙ্গে ফুলমতির কথা মত সেই মাঠে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। ফুলমতি খুব সুন্দর করে সেজে মুখ বের করে রাখল। এবার আকবর আলী পলকের মধ্যে এসে গেল।
আকবর মুন্সী বলল, ফুলমতি তোকেআজ খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। তবে ওই ১০ জনের মুখ ঢাকা কেন?

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

ফুলমতি বলল, ওরা লজ্জা পাচ্ছে তাই ।
তুমি চিন্তা করনা সব ঠিক আছে।
তুমি যাও ক্যাম্পে গিয়ে খবর দাও। আমরা বিলের ধারে অপেক্ষা করছি। বিল থেকে প্রায় ১ কিলো দুরে পাকবাহিনীদের ক্যাম্প। আকবার মুন্সী চলে গেল। ক্যাম্প থেকে ১১ জন পাক বাহিনীকে নিয়ে বিলের ধারে এলো। সবাই এক সঙ্গে দাড়িয়ে ছিল। পাক বাহিনীরা ফুল মতিকে দেখে খুশি হলো, ফুল মতি বলল, চাচা তুমি এখন ফিরে যাও। বলে ফুলমতি বলল, তোমরা এসো, ফুলমতি সবার সামনে ছিল ওর পিছে সবাই লাইন ধরে হাঁটতে লাগল । ওরা বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে।

আকবর মুন্সী বলল, স্যার আপনারা ঐ মেয়েদের পিছে পিছে যান । আমি যাই ।
মুক্তিবাহিনীর সামনে বড় একটি ইক্ষুর খেত দেখতে পেল । পাকবাহিনীরা ক্ষেতের মাঝখানে আসতেই। মুক্তিবাহিনীরা পিছন ফিরে ওদের ব্রাশ ফায়ার করতে লাগল। পশূ গুলি মাটিতে লুকিয়ে পরল। মুক্তিবাহিনীরা পশু গুলিকে শিয়াল কুকুরে খাদ্য বানিয়ে ফেলে চলে গেল । ফুলমতি বাড়ী ফিরে মাকে জরিয়ে ধরে বলতে লাগল মা, আজ আমার অনেক আনন্দ, মা বলল কেন তোর আজ এত আনন্দ?

মা আজ আমি বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পেরেছি। আর একজনকে মারতে পারলে আমার জানটা ঠাণ্ডা হবে, মা ।
কে সে?

কুত্তার বাচ্চা আকবর মুন্সীকে।
গাজী ভাই খবরটা শুনে খুব বেশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাসি জবাই করে সবাইকে খেতে দিয়েছে দুইজন বাদে সবাই খেয়ে বাড়ীর পাশে
পুকুরপাড়ে বসেছিল ।

আকবর মুন্সী ক্যাম্পে গিয়ে বলল, গাজী মুক্তি বাহিনীদের দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছে ক্ষণিকের মধ্যে পাকবাহিনীরা গাড়ী নিয়ে আসতে লাগল । গাড়ীর শব্দ পেয়ে মুক্তি সেনারা লুকিয়ে পরল। পাকবাহিনীরা গাজীর বাড়ীল মধ্যে ঢোকে যে দুজন মুক্তিসেনারা খাচ্ছিল তাদের গুলি করে মেরে বাহিরে চলে গেল। আর ৩ জন পাক বাহিনী ভিতরে ছিল, সুযোগ বুঝে তাহের ভাই আলতাব ভাই নূরু আধারে মধ্যে বাড়ীর মধ্যে ঢোকে ঐ তিন জনকে গুলি করে মেরে ফেলে। পাকবাহিনীরা ক্যাম্পে ফিরে গেল। মুক্তিসেনারা সেই মাঠের মধ্যে একটি পুকুর পাড়ে। আলোচনায় বসল । আলতাফ ভাই বলল, আজ রাতেই যেন আকবর মুন্সীর শেষ রাত হয়। ওকে মারলেই পাক বাহিনীরা কিছুটা দুর্বল হবে।

তাহের ভাই বলল, রতন তুমি যাও ফুলমতি নিয়ে এসো । রতন ফুলমতির বাড়ী গিয়ে ডাক দিল চাচি,
কে?
খোল আমি রতন ৷
চাচি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিল রতন ঘরে ঢোকে গেল । চাচি বলল, বাবা গাজীর বাড়ীতে এশার নামাজের পর গোলাগুলি আওয়াজ শুনাগেছে। রতন বলল, ভয় নেই চাচি আমরাই গুলি করেছি?

ঐ কুত্তার বাচ্চারা আমাদের দলের দুই জ নকে মেরে ফেলেছে।
চাচি বলল ঐ দুজনের বাড়ী কোথায়?
রতন বলল, নওগা জেলার ফতেপুর গ্রামে ।
চাচি বলল, ঈষ কোন মায়ের বুক খালি হলো। চাচি এক গ্লাস পানি খাওয়াও চাচি পানি নিতে গেল ।

রতন বলল, ফুলমতি তোর বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাষ?
ফুলমতি বলল, অবশ্যই নেব, তবে চল। আজ রাতেই ওকে শেষ করতে হবে । চাচি পানি দিল রতন পানি খেয়ে বলল, চাচি আসি ।
বলে ঘর থেকে বাহির হতেই ফুলমতি বলল, রতন ভাই দাঁড়াও। আমিও যাব ৷

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

মা বলল, তুই আবার এত রাতে কোথা যাবি?
ফুলমতি, বাবার প্রতিশোধ নিতে। বলেই রতনের সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
রতন ফুলমতিকে নিয়ে পুকুর পাড়ে উপস্থিত হল।
নুরু বলল, ফুলমতি তুমি এত রাতে এখানে এলে তোমার ভয় করল না?
ফুলমতি বলল, না। কেন ভয় করবে ঐ পশুগুলির কাছে যেতেই ভয় করল না, আর আপনারা তো আমার ভাই ।

তাহের ভাই বলল, তোমাকে এক কাজ করতে হবে,
কি কাজ? তোমাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।
কোথায়?
আকবর মুন্সীর বাড়ী,
কেন?

তুমি আকবর মুন্সীকে ডেকে বাহিরে আনবে। বাকি কাজ আমরা করব। পারবে তো ।
কেন পারব না। আমিও তো লড়তে চাই
তোমার ভয় করবে না?

না ভয়কি বুঝিনা প্রয়োজনে নিজের জীবন দিয়ে দিব। ঐ কুত্তার বাচ্চা, আমার বাবার খুনি। ওর রক্তদিয়ে আমার গোসল করতে ইচ্ছে করে।
সাবাস তুমি বীরঙ্গনা। বলে তাহের ভাই ওর মাথায় হাত রেখে বলল, আল্লাহ তোমার আশা পুরো কুরুক। চলো এখন যাওয়া যাক ।
সবাই মিরে আকবর মুন্সী বাড়ীর একপাশে পুকুর পাড়ে লুকিয়ে থেকে ফুলমতিকে পাঠিয়ে দিল । রাত ১২ টা বাজে ।
আঁধার পা, টিপে টিপে পথচলা, ও ঠিক ঠাক আকবর মুন্সীর জানালার কাছে পৌঁছে গেল । জানালার কয়েক বার টোকা দিতেই বলল, কে? ফিস ফিস করে বলল, আমি ফুলমতি
এত রাতে কি দরকার?
ফুলমতি বলল, চাচা খুব জরুরী খবর আছে তুমি বাহিরে এসো।
বউ ঘুমিয়ে আছে । চুপি চুপি ঘর থেকে বাহিরে এলো ।

বল কি খবর?
আমি গোপন সূত্রে জানতে পেলাম আজ রাতেই তোমাকে মুক্তি
সেনারা ধরে ফেলবে।
বলল এই খবরটা তুই আমাকে বিকেলে দিতে পারলি না? এত রাতে এখন আমি কোথায় যাব? আগে জানলে না হয় ক্যাম্পে গিয়ে থাকতাম। ফুলমতি বলল, বির বির করে কি বলছ।
কিছু না ৷
চাচা আমাকে একটু এগিয়ে দাও ।
পারব না।

আকবর মুন্সী বলল, আমি চশমা ও টুপি পড়ে আসি ।
ফুলমতি বলল, গায়েত তোমার গেঞ্জি আছেই । চশমা তো চোখেই আহে । তুমি ভুল। বকছ না কি?
ও চোখে হাত দিয়ে দেখল।

চশমা চোখেই আছে। আর রাতের বেলায় ফাটা চশমা তোমার কি দরকার। এইতো দুই ধাপের পথ। আকবর মুন্সী এই বার রেগে উঠে বলল, দুই ধাপের রাস্তা তো তুই যা না। একা আসতে পারলি আর যেতে পারছিস না? ফুলমতি বলল, শুনেছি তোমাদের পুকুর পাড়ে নাকি ভূত থাকে। তুমি শুধু পুকুর পাড়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি চলে যাব । রেগে বলল, ঠিক আছে চল ।

ফুলমতি আগে আগে, আকবর মুন্সী পিছে পিছে ওর বুকটা ধকধক করছে। পা যেন আর উঠছে না। পুকুর পাড়ের মাঝ খানে যাওয়ার পর বলল, এখন তুই যা।
আমার পা হাত পা কাঁপছে আমি আর যেতে পারব না
ঠিক আছে আসতে হবে না । তুমি শুধু ওখানে একটু দাঁড়িয়ে থাক । আকবর মুন্সী ভাবছে ওকি সত্য বলে গেল? নাকি ভয় দেখিয়ে গেল । ক্ষণিকের মধ্যেই চার পাশ থেকে মুক্তিসেনারা ঘিরে ধরল, বলল, কে তোমরা? রতন বলল, তোর বাপ। আফতাফ বল, বেশি কথা না বলে চল,
কোথায় যাব?

রতন বলল, জাহান্নামে।
জাহান্নাম কোথায়?
গেলেই দেখতে পাবি ৷
নুরু বলল, মনে হয় স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।

তাহের ভাই বলল, ওকে এখন বেশি কথা বলতে না দেয়াই ভাল আলতাফ ভাই দলের মধ্যে বয়সে সবার বড় এবং শক্তিশালি ও লম্বা চওড়া। আলতাফ ভাই বলল, রতন গামছা দিয়ে ওর মুখ বেঁধে ফেল।

মুখ বেঁধে মাঠ পেরিয়ে নদীর পাড়ে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল । ফুলমতির চোখে ওর বাবার দৃশ্যটি ভেসে উঠল। বাবাকেও আকবর মুন্সী এইভাবে বেঁধে হত্যা করেছিল। আকবর মুন্সীই ইন্ধন যুগিয়েছিল । এই শয়তানটাই বাবার খুনি, আজ আমি নিজের হাতেই ওকে হত্যা করলে বাবার আত্মা শান্তি পাবে, আমিও শান্তি পাব। আলতাফ ভাই বলল, রাত ২টা বাজে আর দেরি করা ঠিক হবে না। এখনি কুত্তার বাচ্চাটাকে শেষ করা উচিৎ বলে রাইফেলটা উত্তোলন করতেই,
ফুলমতি দৌড়ে এসে বলল, না, না, আলতাফ তাই তুমি ওকে মেরো না । রাইফেলের সামনে দাঁড়াল । ফুলমতির আচরণে সবাই অবাক হয়ে গেল । আলতাফ ভাই বলল, কিরে তোর আবার কি হলো?

ফুলমতি রাইফেলটা কেড়ে নিয়ে বলল, আমি বাবার হত্যা, যত অসহায় নারীদের অসম্মান করা গ্রামের অসহায় মানুষদের বিনা দোষে হত্যা করা, তাদের প্রতিশোধ আমি একাই নেব। বলে রাইফেলটি উত্তোলন করতেই রতন দৌড়ে এসে রাইফেলটি ধরে ফেলে বলল, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে? ফুলমতি বলল, কেন? তুই কি রাইফেল চালানো জানিস নাকি? গুলিটা তোর নিজের বুকেই লাগতে পারে। ফুলমতি বলল, আমি নিজেই মারব। ওর জেদ দেখে আলতাব ভাই বলল, রতন তুমি ওকে হাত ধরে শিখিয়ে দাও। ফুলমতি রাইফেল হাতে উত্তোলন করল। তখন রাইফেলের টিগার চাপ দিয়ে শিখিয়ে দিল। ফুলমতি টিগারে চাপ দিতেই আকবর মুন্সীর বুক ঝাঝরা হয়ে গেল। আলতাব বলর, ওর বাধন খুলে গাছে ঝুলে দাও । রতন বলল, না না ঝুলিয়ে দেওয়া হবে না ।

তাহলে সকালে লোকেরা অক্ষত অবস্থায় পাবে ।
বলতেই দূরে জঙ্গলের মধ্যে শিয়াল ডাকছিল। ফুলমতি বলল, আলতাফ ভাই ঐ যে শোন শেয়াল ডাকছে। হয়তো ওরা সন্তানদের নিয়ে অনাহারে রয়েছে। যেমন আমরা থাকি। তার চেয়ে ভাল বাধন খুলে ঐখানে ফেলে রাখ । শিয়াল কুকুরের খাদ্য হিসাবে থাক ।

ফুলমতির কথা মত ঐখানেই ফেলে রেখে যে যার জায়গায় চলে গেল । তাহের ভাই ও আলতাব ভাই বলল, রতন তুমি ফুলমতিকে পৌঁছে দাও।
রতন বলল, ঠিক আছে।

রতন ও ফুলমতি পাশাপাশি পথ চলছিল। ফুলমতির বুক থেকে যেন একটি বিশাল পাথর নেমে গেল। সে আজ মুক্ত বিহঙ্গনা। মাথার উপর খোলা আকাশ, চারিদিকে খোলা মাঠ। সেখানে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়। আকাশে আধাভাঙ্গা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের জোস্নার আলোয় সবুজ ধানের মাঠগুলি যেন তার নতুন রূপ ফিরে পেয়েছে। ওরা দুজনে পথ চলছে। কারও মুখে কোন কথা নেই । হঠাৎ ফুলমতি বলে উঠল, দেখ দেখ রতন ভাই। জোস্নার আলোয় চারপাশ যেন আবার নতুন রূপে ফিরে এসেছে।

হ্যাঁ তুই ঠিক বলেছিস। খোলা মাঠগুলি চারপাশটা কেমন নিস্তব্ধ নিঝুম চাঁদের আলোয় উছলে পড়েছে। তার মাঝে স্নিগ্ধ বাতাস বয়ে চলেছে। তার আপন ঠিকানায়। বন জোস্নার আলোকে দু’জনে হেঁটে চলেছে। যেন সোনার বাংলার প্রকৃতরূপ আজ ওরা দেখে ফেলেছে। রতন বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। মনে হচ্ছে কত যুগ পর শান্তির নিঃশ্বাস নিলাম । ঠিক বলেছ। আকবর মুন্সীর জন্য গ্রামের লোকেরা কতই না অশান্তিতে ছিল ।

ফুলমতি বলল, রতন ভাই ভাল কাজে যে এতটা শান্তি লাগে আগে কখনও বুঝিনি। তুমি নিবে আমাকে তোমার সঙ্গি করে। আমিও তোমাদের সঙ্গে কাজ করতে চাই ।

রতন বলল, আমি চির জীবনের সঙ্গি করে নিব। যদি আমি বেঁচে থাকি ।
ফুলমতি বলল, তুমি এ কথা বল না। তুমি অনেক বৎসর বেঁচে থাক বলতে বলতে ওরা বাড়ী পৌঁছে গেল । রতন দরজায় শব্দ করতেই দরজা খুলে গেল ।

রতন বলল, চাচি এই নাও ফুলমতি কে।
চাচি বলল, তোরা এতক্ষণ কোথায় ছিলি ।
সে টা সকাল হলেই বুঝতে পারবে।

রতন চলে গেল। ফুলমতি বলল, মা আমার ঘুম পেয়েছে। ফুলমতি ঘুমিয়ে গেল। ফুলমতির মা ভাবছে আজকে সকালটা যেন নতুন মনে হচ্ছে।
সব গ্লানি ধুয়ে মুছে নতুন সূর্য উঠেছে। লোকজন আনন্দে ছুটাছুটি করছে। লোকেরা বলছে। মরেছে মরেছে। আকবর মুন্সী রাজাকার মরেছে। ফুলমতির ঘুম ভেঙ্গে গেল। ও উঠে দেখছে। লোকজন শান্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। মা এসে বলল, ফুলমতি শুনেছিস। আকবর মুন্সী মরেছে।

হ্যাঁ মা মরেছে। আমি নিজের হাতে বাবার প্রতিশোধ নিয়েছি।
মা ফুলমতিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের চোখ থেকে আনন্দ অশ্রু ঝরিয়ে পড়ছে।
ফুলমতি বলল, বাবার খুনীকে দেখতে চাও মা। চল নিজের চোখে দেখে এসো।

মা মেয়ে দুজনার সেখানে গেল। সেখানে যেন লোকের ঢল নেমেছে । কেউ কেউ বলছে, কে এমন মহত কাজ করল। তাকে একটিবার সালাম করতে ইচ্ছে করছে।
আর একজন বলল, আজ থেকে গ্রামের লোক শান্তি পাবে। কথাগুলি শুনে ফুলমতির খুব ভাল লাগছিল।

মায়ের হাত ধরে ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢোকে আকবর মুন্সীকে দেখার চেষ্টা করছিল। আকবর মুন্সীকে দেখে কারও চেনার ক্ষমতা নাই। শেয়ালেরা ওর শরীরটা খেয়ে ফেলেছে। শুধু দাঁড়ি ও মাথার চুল এবং হাড়গুলি পড়ে আছে। আর ফাটা চশমাটা ওর পাশে পড়ে রয়েছে।

আকবর মুন্সী ক্যাম্পে না যাওয়ার কারণে শত্রু পক্ষ কোন খরব পাচ্ছে না। সেই কারণে ওদের অত্যাচার অনেকটা কমে গেছে ।
আর বিভিন্ন স্থানে পাক বাহিনীরা পরাস্ত হচ্ছে। শুনে ওদের মনোবল কমে গেছে। আলতাব ভাই বলল, এখন আমাদের প্রথম কাজ হবে ক্যাম্পটি উড়িয়ে দেওয়া।

নুরু বলল, তাহের ভাই এক ঝাঁকা কলা সংগ্রহ করে। তারমধ্যে ডিনামাইট নিতে হবে। তবে খুব সাবধান ।
তাহের ভাই বলল, তুই ঠিক বলেছিস। এইভাবে শত্রুদের ধ্বংস করতে হবে। এই দায়িত্ব তাহের নিজেই নিল। পরদিন ৪ জন আবু তাহের, নুরু, মোজাম্মেল ও ছামাদ এবং আলতাব ভাই। ময়লা লুঙ্গি পরে মাথায় গামছা বেঁধে, ছিড়া শার্ট পরে মাথায় একটি করে ঝাঁকা নিয়ে ক্যাম্পের দিকে রওনা দিল। তাহের ভাই, আলতাব ভাই মোজাম্মেল এদের ঝাকায় ডিনামাইট ছিল । ছামাদ ও নুরু ক্যাম্পের সামনের দিক দিয়ে যেতেই পাক বাহিনী ডাক দিল। এধার মে আও । এরা ভাবল মেঘ না চাইতে জল ।

ছামাদ বলল, নুরু তাড়াতাড়ি চল। ওরা ঠিক ক্যাম্পের সামনে গিয়ে বসল। যাতে করে তাহের ভাই ও আলতাব ভাই ক্যাম্পের পিছনে ঠিক মত কাজ করতে পারে। নুরু বলল, স্যার কলা খাইয়ে ওরা তখন কলা নিয়ে ব্যস্ত। তাহের ভাই ও আলতাব ভাই ক্যাম্পের পিছনে ডিনামাইট রেখে চলে গেল।

ছামাদ লক্ষ করল । তাহের ভাই ও আলতাব ভাই কাজ সেরে চলে গেল ।
নুরু বলল, স্যার হামরা জাতা হু ।
ওরা বলল, ঠিক হ্যায় ঠিক হ্যায় ।

নুরু ও ছামাদ তাড়াতাড়ি ক্যাম্প থেকে চলে এসে সবাই এক জায়গায় একত্রিত হল। ওরা আনন্দ করছিল। ঠিক সেই সময় বিকট আওয়াজে ক্যাম্পটি উড়ে গেল । শত্রুদের পরাস্ত করে ওরা বাড়ি ফিরল ।

বাবা, মামা, খালা, নওগাঁ শহরে পাশাপাশি বাসায় বাস করত। ১৯৭১-এ পাক বাহিনীর ভয়ে চক আতিতা গ্রামে নানার বাড়ীতে পালিয়ে গেল। আমরা তিন ভাই তিন বোন। বড় ভাই এর বয়স ছিল ১৪ বৎসর। সব ছোট বোনটির বয়স ছিল ১ বৎসর। আমার বাবা ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছে। মায়ের অভাব তাকে সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াত । সব সময আল্লাহকে বলত আমাকে একটি কন্যা সন্তান দাও। যেন মা বলে ডাকতে পারি। পরপর তিনটি পুত্র সন্তান জন্ম নিল । বাবা খুব একটা খুশি হলেন না। আমি যেদিন জন্ম নিলাম, সেদিন বাবার মনে খুশির বন্যা বইছিল।

কোন দিন আমাকে মা ছাড়া নাম ধরে ডাকেনি। কখনো কোল থেকে নামাতো না। যেখানেই যেত সেখানেই সঙ্গে করে নিয়ে যেত। আমাকে খুব আদর করতো। কচি কচি ছোট দুটি হাতে কতই যে চুমু দিয়েছে তাতে বাবা ৬টি ছেলে মেয়েকে নিজের জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসতো। বাবা কাপড় ব্যবসায়ী ছিল পাক বাহিনীরা বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাসা বাড়ী আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। নানার বাড়ী ছিল একেবারে মাঠের শেষ প্রান্তে । আশে পাশে কোন বাড়ী ছিল না। চারিধারে গাছ গাছালী ও জঙ্গলে ভরা ছিল।

মাঠটি ছিল অনেক বড়। মাঠের এই পার থেকে ওই পারের গ্রামগুলি ঠিকমতো দেখা যায় না। মনে হয় সবুজের মায়ায় ঢাকা। মাঠগুলি ধূ ধূ করছে। পশুগুলি যখন গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিত। দূর থেকে কালো ধোঁয়াও আগুনের ফুলকি দেখা যেত। ঐ দৃশ্য দেখে বাবা শুধু হায় হায় করত এবং ছটছট করত। ভয়ে ছেলে মেয়েদের বুকে জড়িয়ে ধরে বলত, বাবারে তোদের কি করে বাঁচাব। এক দিন খবর পেল হানাদার বাহিনীরা নানার বাড়ির গ্রামের দিকে আসছে। বাবা সব সন্তানকে জড়িয়ে ধরে নানার বাড়ীর পিছনে বড় বাঁশ বাগান ও জঙ্গল ছিল। সেখানে সবাইকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ল। এইভাবে ৩ মাস কেটে গেল।

কিছু কিছু লোকেরা শহরে যেতে শুরু করল। বড় মামা খালু মামাতো ভাইদের ডেকে বলল, সবাই এক সঙ্গে শহরে গিয়ে দেখি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান । বাসাবাড়ী কি অবস্থায় আছে। ১৯৭১ সালে ২রা মে বেলা ১০টায় শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। ১২ টার দিকে শহরে পৌঁছল। বাসায় ঢুকে দেখতে পেল ঘরের দরজা, জানালা সব খোলা। ঘরের আসবাবপত্র একটিও নেই। সব লুটে নিয়ে গেছে। চার পাশে খা খা করছে। মামা বাসা থেকে বেরিয়ে সবাইকে বলল, কেউ যেন দল ছেড়ে কোথাও না যায়। সবাই দলবদ্ধভাবে থাকতে হবে ছোট মামার কাছে একটি সাইকেল ছিল। মামা সাইকেলটি আমার বড় ভাই এর হাতে দিয়ে বলল, সাইকেলটি যেন তোর বাবার হাতে দিস না। বলে মামা একটু দূরে পেশাব করতে গেলে, মুহুর্তের মধ্যে বাবা এসে ভাইকে বলল, বাবা সাইকেলটি আমাকে দাও ।

নানা, মামা, তোমাকে সাইকেল দিতে বারণ করেছে।
তখন দ্রুত বেগে সাইকেল নিয়ে হারিয়ে গেল। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, এদিক ওদিক খুঁজে দেখার সুযোগ ছিল না। সব দিকে হানাদার বাহিনীরা ছিল। কিছু বলা মাত্রই গুলি করে বুক ঝাঝরা করে দিবে। তবুও মামা সবাইকে এক স্থানে রেখে বাবাকে খোঁজার জন্য একটু ভিতরে যেতেই দেখতে পেল টিনের ঘর, ঘরটি তিন দিকে ঘেরা। সামনের দিকে ফাঁকা। সেখানে কয়েকজন পাক বাহিনী টেবিলের উপর বড় বড় মদের বোতল রেখে মদ পান করছে। কারো কারো হাতে তলোয়ার। চোখের পলকে চার পাঁচজন সামনের দিকে এসে মামাকে ঘিরে ফেলল। আর বলল, তোম এ ধারছে কাহা আয়েগা ।

মামা বলল, মেরা ভাইয়া এধারছে আগেয়া?
ওরা বলল, নাহি নাহি। এধারছে কোছ নেহি। জান বাছিলে তো ভাগ যাও। মামা জীবনের ভয়ে সবাইকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরল। শুধু বাবাই ফিরল না ।
যে যেখানে যা বলতো মামা সেখানেই খোঁজ-খবরের জন্য ছুটে যেত । গ্রামের হাটে ঘাটে মাঠে সব জায়গাতে খুঁড়ে বেড়াত। আমার ছোট ছোট দুটি ভাই হাত ধরে কোথায় কোথায় খুঁজতো। ছোট ছোট বুকের মাঝে কি বেদনা চেপে রাখতো কে বা বুঝতো ওদের কথা। সারাদিন না খেয়ে খুঁজে খুঁজে সন্ধ্যাবেলা শুকনো মুখে ফিরে আসতো। মা ভাইদের জড়িয়ে ধরে বলে বাবা তোরা কোথায় ছিলি। সারাদিন ধরে তোদের কত খুঁজেছি । ভাই বলতো বাবাকে খুঁজতে গিয়েছিলাম।

কত খুঁজলাম কোথাও পেলাম না ওরা শুকনা মুখে ভেজা চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মা কথা শুনে ওদেরকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল । মায়ের কান্না দেখে ৬ ভাই বোন এক সঙ্গে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে। আমাদের জন্য মা প্রাণ খুলে কাঁদতে পারে না। আমি তখন ততটা বুঝতে পারিনি। আমার ছোট ভাই বলতো আপা ছোট্ট বাচ্চার কথা নাকি সত্যি হয়। চল আমরা ছোট বোনের কাছ থেকে শুনি। বাবা ফিরবে কি না। আমরা বোনকে কোলে নিয়ে গাছ তলাতে গিয়ে বসে ১ বৎসরের বোনকে জিজ্ঞাসা করতাম, বল বাবা ফিরবে ও কথা বলতো না। তখন মাথা ঝোলাতো।

আমরা হেসে উঠতাম। আর যখন মাথা নেড়ে নানা বলতো ছোট ভাই ওর গালে চড় মারতো ও কেঁদে উঠতো। আমি বোনকে কোলে নিয়ে স্থীর করতাম। আমি মাকে বলতাম বাবা কখন ফিরবে জিলাপী কিংবা তিলের খাজা হাতে নিয়ে আমার কথার উত্তর মা সারা দুনিয়ার ভাষা খুঁজে পেত না। কষ্ট বেদনা চেপে রেখে আমায় জড়িয়ে ধরে বুকে রাখতো।

অশ্রু ঝরা চোখে। সব কিছু হারিয়ে মা শূন্য হাতে আমাদের আঁকড়ে ধরে দুঃখ কষ্ট, বেদনা, অভাব-অনটনের সঙ্গে সংগ্রাম করেও সততার সঙ্গে আমাদেরকে বড় করে তুলেছে। আমরা ৬ ভাই বোন নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে চলতে শিখেছি। তারপরও জীবন থেমে থাকেনি। দেশ শত্রু মুক্ত হয়ে গেল ।
স্বাধীন বাংলাদেশে বাবাকে খুঁজে আর পেলাম না। আজও বাবাকে খুঁজি। আমি যখন লিখতে শিখলাম । আমার কতাগুলি কবিতার মাঝে লিখে
রাখলাম-

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

“বাবা তোমায় খুঁজি” কবিতা
বুক ভরা স্নেহ নিয়ে ছিল বাবা ঐ
সেই বাবা আজ আমার গেল কই?
সবিই আছে আগের মত নেই বাবা তুমি
পাগল পারা হয়ে তোমার খুঁজি আমি
মা, বাবা, ভাইবোন কত প্ৰিয় ছিল ।
বাবার রক্ত দিয়ে ৭১ এর কালো রাত রাঙ্গিয়ে দিল
সেই সময় আরো কত স্বজন ছিল তাদের রক্ত দিয়ে
অপরাধের কালো হাতে নাম লিখে দিল ।
সেই কবে দেখেছিলাম সেই সোনা মুখ
২ রা মে এলে ভেঙ্গে যায় বুক।
রাক্ষসের গ্রাম করেছিল কালো থাবায়
ছিনিয়ে নিয়েছে ওরা আমার বাবায় ।
কত যে স্নেহের হাত দিয়েছে বেড়ে
সেই বাবাকে ওরা নিল যে কেড়ে।
কচি কচি ছোট এ দুটি হাতে
কত যে চুমু তুমি দিয়েছ তাতে
যে বুক ভরা ছিল মায়া মমতায়
কি করে গুলি ওরা বিধল সেথায়
একবার বল বাবা সেই কথাটি
আয়রে আমার কাছে আয় মা মণি
শ্রাবণের বৃষ্টি ঝরে রাশি রাশি
তারই মাঝে বাবা আমি তোমায় খুঁজি ।
মনে হয় বাবা আমার ডাকছে বুঝি
৭১ এ ২রা মে এলো মনে হয় ঐ দিন শুধু আমি রক্ত মুছি।
হাজার জনতার ভীড়ে বাবা আমি তোমায় খুঁজি
মনে হয় এখন বাবা আমায় ডাকছে বুঝি ।
সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে সেখানেও বাবা আমি তোমায় খুঁজি
আমার মনের আকাশে আষাঢ়ের কালো মেঘে ডাকা
সেখানে আমার বাবার আছে ছবি আঁকা ।

নওগাঁয় লিটন সেতুর উত্তর প্রান্তে ও বাণী ভবন নামে একটি বাড়ি ছিল। বাড়িটিকে হানাদার বাহিনীর দোসররা ভক্ষণ সেল হিসাবে ব্যবহার করত। স্বাধীনতার পর গ্রাম থেকে যুবকদের ধরে এনে বিভিন্নভাবে অত্যাচার করেছে। কখন কখন বুলিয়ে দিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার করে পরে তাদের হত্যা করে। নিচে যমুনা নদীতে ফেলে দিয়েছে। স্বাধীনতার পর নওগাঁ-বাসীরা বাড়িটি প্রদর্শন করে। ঘরগুলোতে প্রচুর ঝুলন্ত দড়ি। ব্লেড, চেইন, দেওয়ালে রক্ত ঝরা বৃষ্টির দৃশ্য দেখা গিয়েছে। কোন কোন দেওয়ালে অসংখ্য রক্তমাখা হাতের ছাপ দেয়া হয়েছিল। মনে হয় নরপিচাসগুলি অংক কষে রেখেছিল যে কতগুলি বাঙালিকে হত্যা করেছি।

নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলায় কালকাপুর ইউনিয়নের পাকড়া সদর থেকে দুর্গম এলাকায় গ্রামটি। আত্রাই উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে কুখ্যাত রাজাকার হানাদার বাহিনীদের নিয়ে গিয়ে ঐ আমে মুক্তিবাহিনীদের হত্যা করার জন্য আত্রাই পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনের কাছ থেকে হানাদার বাহিনীরা নৌকা নিয়ে ভোরে পাইকড়া আমে প্রবেশ করে। প্রথমে প্রায় ১০০ জন লোককে ধরে গ্রামের সরদার পাড়াতে দুই লাইন করে হিন্দু মুসলমানকে পরীক্ষা করে মুসলমানদেরকে ছেড়ে দেয়। পাইকড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে ৩০/৫০ জনকে একত্রিত করে।

এদের মধ্য থেকে ৫ম শ্রেণীর ছাত্রের বয়স ১২ বৎসর আজাহার আলী পালানোর জন্য জঙ্গলের দিকে দৌড় দেয়। জঙ্গলে বেতের কাটার সঙ্গে আটকে যায়। এই সময় হানাদার বাহিনীরা গুলি করে হত্যা করে। স্কুল মাঠে নিতাই চন্দ্র ওরফে মংলা মিস্ত্রী, সুবন্দ্রনাথ, গোপেশ্বর প্রায় ৩০ জনকে হত্যা করল । আর লাশ দিয়ে ছিরে হত্যা করল । গুলি পুকুরে ফেলে দেয়। হলধর চন্দ্র, ভবানী চরণ এই দুইজনকে কুড়াল বদল গাছী থানা গ্রামের শ্রী রামপুর গ্রামে একদিন ভোর রাতে হানাদার বাহিনীরা গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামে কয়েকটি বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয। কিছু কিছু ঘরে ঢুকে নারী নির্যাতন করে।

গ্রামের লোকেরা আতঙ্কে ছুটাছুটি করে পালাতে লাগল। মকু মিয়া তার পরিবারের ছেলে, ছেলের বউকে বলল, তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়। ছেলের বউ এর কোলে ২ মাসের শিশুকন্যা ছিল । দিশে না পেয়ে বাচ্ছাটিকে বিছানাসহ জড়িয়ে দলবদ্ধ হয়ে পলায়ন করতে গিয়ে একটি নদী পার হতে হল । বৈশাখ মাস নদীতে হাঁটু জল। নদী পার হয়ে একিট দুর্গম স্থানে গিয়ে সবাই বসল বউটি ভাবল। এখন বাচ্চাটি বের করে দুধ খাওয়াতে হবে।

জড়ানো কাপড়গুলি সরিয়ে দেখে বাচ্চা নেই। ভাল করে কাপড় গুলি ঝাড়তে লাগল। কিন্তু বাচ্চা আর পেলনা। বউটি আত্মনাদ করে কাঁদতে লাগল। বুঝতে পারল বাচ্চাটি নদীর পানিতে পড়ে গেছে। বগুড়া জেলার সিংড়া থানার এক গ্রামে আলীম ভাই এর বাড়ী, সে বিয়ে করেছে। প্রায় ১৫ বছর হবে তার সন্তান ছিল না। অনেক সাধনার পর তার একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করল। সেদিন আলীম ভাই ও তার স্ত্রীর মনে সারা পৃথিবীর আনন্দ যেন ওদেরকে জড়িয়ে ধরেছিল। পুত্রের নাম রাখল মানিক। মানিক দিনে দিনে বড় হতে লাগল। মানিক বাবার চোখের মনি মায়ের হৃদয়।

দেখতে যেন রাজপুত্রের মত ।
ছোট থেকে ও শান্ত ও ভদ্র। গ্রামের সব মানুষ ওকে ভালবাসে। তেমনি করেও সবাইকে আপন করে নিয়েছে। কোন মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। স্কুলের শিক্ষকরাও খুব ভালবাসে। লেখাপড়াতেও ভাল মানিকের চাচাতো ভাই রতন। ওরা একই ক্লাসে পড়াশুনা করে। দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব মিল। সে সারাদিন গ্রামের লোকদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কেউ অসুস্থ্য হল সেখানে মানিক। গ্রামের বড়দের সাহায্য করে। ঐ গ্রামের রহিম দাদা হাট থেকে একভার আলু নিয়ে বাড়ী ফিরছিল মানিকও হাট থেকে ফিরছিল। মানিক রহিম দাদাকে দেখতে পেয়ে বলল, দাদা একটু দাঁড়াও আমি আসছি। দাদা তুমি এত হাঁপাচ্ছ কেন?

রহিম দাদা বলল, এখন তো হাঁপানোর সময়, বয়স তো অনেক হলো। আগের মত শরীরে জোর পাইনা। মানিক বলল ভারটি আমাকে দাও। দাদা বলল ভাই তুইতো ছোট মানুষ ভার তো বইতে পারবি না মানিক, আমার গায়ে অনেক শক্তি আছে। বলে ভারটি নিজের ঘাড়ে নিয়ে
চলতে লাগল ।
মানিক বয়সে ছোট হলেও শরীরের দিক থেকে বড়সড় হয়েছে। ও সবে মাত্র ১০ম শ্রেণিতে উঠেছে। দাদা তুমি দেখে দেখে পা ফেল । গ্রামের পথ জায়গা উঁচু নিচু আছে। উঠুস খেয়ে পড়ে যেও না ।
রহিম দাদা প্রাণ ভরে অনেক দোয়া করল ।
দাদু ভাই তুই অনেকভাল ছেলে ।

তোর মত ছেলে যেন দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে জন্ম নেয়। ওরা কথা বলতে বলতে বাড়ী পৌঁছে গেল। মানিক ভারটি উঠানে রেখে দাদা আমি গেলাম। যদি কখনও প্রয়োজন হয়, তাহলে আমাকে ডেকো। দাদা বলল ভাই এখন যাসনে। একটু কিছু খেয়ে যা। মানিক না না দাদা অন্য দিন খেয়ে যাব। আমার এখন আর একটি কাজ আছে।

বলে ও শিমলতলীর মোড়ে দৌঁড় দিল। সেখানে চারদিকে বন জঙ্গল। বুড়ীর বয়স প্রায় ৯০ বছর হবে। শিমুল গাছের নিচের ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘর। সেই ঘরে একটি বুড়ি থাকে।
বুড়ির পুত্র কন্যা মিলে ৬ জন সন্তান ছিল। একরাতে কলেরা হয়ে ৫ জন মারা গেছে।

১টি কন্যা আছে তার বিয়ে হয়েছে বহু দূর সে ঠিক মত মায়ের খোঁজ খবর নিতে পারে না। বুড়ির জমা জমি স্বামী পুত্র কন্যা কেউ নেই । লোকের বাড়ি বাড়ি চেয়ে চেয়ে খায়। মানিক বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে বুড়িকে দেখে আসছে। মানিক বুড়িকে দেখলেই বলে তুমি আমাদের বাড়ি এসে থাক। এই জঙ্গলের মধ্যে কেন পড়ে থাক? বুড়ি অনেক দোয়া করে। বলে ভাই আল্লাহ তোকে ভাল রাখুক। মানিক রহিম দাদার বাড়ী থেকে দৌড়ে বুড়ীর ঘরের দরজায় এসে ডাকতে লাগল দাদি থিরকিটা খোল ।
বুড়ী, ভাই হাতেম তা থিরকিটা খোলায় আছে। বাবা আমি উঠতে পারছি না।

শরীরটা ভাল নেই। মানিক খিরকিটা ঠেলাদিয়ে ঘরে ঢোকে নিভে যাবে । দেখে বুড়ি শুয়ে আছে। মাটির প্রদীপটা নিভু নিভু করছে। যে কোন সময় মানিক, দাদি তোমার কি হয়েছে? দাদি ও কিছু না বাবা এই একটু শিত শিত করছে। মানিক বুড়ির কপালে হাত দিয়ে দেখে গায়ে অনেক জ্বর। মানিক ঘরে এক ফোটা পানিও দেখতে পেল না। কলসটা কাত হয়ে পরে আছে। মানিক ভাবল ঐ মোড়ের দোকানের পাশে একটি পানির কল দাদি মাথাটা ঘুরিয়ে শোও দাদি আছে, মানিক কলস নিয়ে দৌড় দিল সেখানে। মানিক পানি নিয়ে এলো।
কেন ভাই?
তোমার মাথাটা ধুয়ে দিই দাদি।

না না, ভাই তোকে কষ্ট করতে হবে না। আমার কিছু হবে না জমও সে আমাকে নিতে ভয় পায় ।
বুড়ীর ব্যাথা ভরা কথাগুলি শুনে মানিকের মন খারাপ হয়ে গেল । দাদি এমন করে বল না আমার শুনতে ভাল লাগছে না ।

স্বাধে কি আর বলছি ভাই লোকের দুয়ারে দুয়ারে কত আর দূর ছাই খাব। দাদির মাথাটা ধুয়ে দিয়ে, দাদি তুমি কি খেয়েছে, তাই আমার জন্য এত ভাবিসনে। দুই দিন হল চুলা জ্বালাতে পারিনি তাই ও কিছু হবে না। তুই একটু আমার কাছে বস তাহলেই আমার সব কষ্ট চ যাবে ভাই। দাদি তুমি এখন চুপ করে শুয়ে থাক আমি এখনি আসছি পু ঘুটে আঁধার মানিক বাড়ি ফিরছিল, পথে রতনের সঙ্গে দেখা, দাদা কে? ঠিক মত চেনা যায় না আমি রতন তুই এই রাতে কোথায় থেকে ফিরছিস?

ঐ শিমুল তলির দাদির শরীর খুব খারাপ। ঘরে এক মুঠো খাবার নেই। এমন কি এক গ্লাস পানিও নেই। আমি এক কলস পানি এনে দিয়েছি এখন মায়ের কাছ থেকে কিছু খাবার নিতে যাচ্ছি।

ঠিক আছে চল আমিও তোর সঙ্গে যাব ।
ওরা দুজনে বাড়ী ফিরল। মা, বাবা, বলল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি মানিক সব কথা মাকে বলল, মানিকের মা ও খুব ভাল মনের মেয়ে। মা, ঠিক আছে এখনি ভাত সেজে দিচ্ছি। মানিকের বাবা একজন গ্রাম ডাক্তার সব সময় ঔষধ বাড়ীতে থাকে, বাবা আমাকে জ্বরের ঔষধ দাও, বাবা, চমকে উঠে বলল, আয় দেখি আমার কাছে কি করে জ্বর বাধালি?

না, না, বাবা আমার জ্বর হয়নি, মানিক, বাবাকে সব কথা বলল, বাবা ঔষধ গুলি বুঝিয়ে দিল । মা আমাকে তাড়াতাড়ি খাবার দাও।
মা খাবারগুলি মানিকের হাতে দিয়ে বাবা তাড়াতাড়ি ফিরিস।
মানিক ও রতন বুড়ীর বাড়ি পৌঁছে গেল। বুড়ীর খিরকিটা খোলাই ছিল। ঠেলা দিয়ে ঘরে ঢুকে খাবারগুলি নিচে রেখে রতনের হাত থেকে কেরোসিনের বোতল নিয়ে প্রদীপে তেল ভরে জ্বালিয়ে দিল ।

দাদির কোনো সাড়াশব্দ নেই, আবার ডাকতে লাগল দাদি দাদি উঠ। বুড়ীর সাড়া না পেয়ে মানিক রতন দাদি কি মারা গেছে নাকি? বাহিরে কেমন ঘুটঘুটে আঁধার শিমুল গাছের মাথায় বসে কানা কুয়া পাখিটা কেমন করে ডাকছে। মনে হচ্ছে যেন পৃথিবীর সব অসুভকে ডেকে আনছে । মানিক আবার ডাকছে দাদি দাদি উঠ,
কি বাবা সোনার চাঁন ।

তুমি ঘুমিয়ে গেছ? তোমাকে ঔষধ খেতে হবে।
আমাকে নিয়ে ভাবিসনে বাপ আমার কিছু হবে না। মাথাটা ধোয়ার পর এখন অনেক ভাল লাগছে। তাইতো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
তুমি আগে ভাত খেয়ে নাও তারপর ঔষধে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। মানিক, দাদিকে খাওয়ায়ে ঔষধ দিল। দাদি আমি কি তোমার কাছে থাকব?
না ভাই তুই বাড়ী যা আমি একাই থাকতে পারব।

কাঁদছে। তোরা এখন বাড়ী যা ভাই। দাদি শোন, কুকুরগুলি কেমন করুণ সুরে
হ্যাঁ দাদু ভাই। কুকুর কাঁদা ভাল লক্ষণ নয় মানিক, কেন দাদি?
কুকুর কাঁদলে কি হয়?

শোন দাদু ভাই যে বছর দেশে মহামারি এসেছিল রাতারাতি মানুষ মরে সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেই বছরই তো আমার স্বামী ৫ সন্তান মরে গেল। বুড়ীর কথা শুনে মানিকের বুকের মধ্যে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল। দাদু ভাইয়েরা বাড়ী যা রাত অনেক হল । মানিক বাড়ী ফিরল, মা, বাবা তুই যে ঠিক মত খাওয়া দাওয়া ও করিসনে সারাদিন কি কাজে ব্যস্ত থাকিস?

রতন, মানিক স্কুল থেকে ফিরছিল, রতন দেখ আমাদের দেশটি কত সুন্দর না রে?
হ্যাঁ ।
চারপাশে সোনালী ধানে ভরা সরিষা খেত গুলিতে যেন হলুদ গালিচা বিছানো, তার মাঝে মাঝে সবুজ মটর শুটির গালিচা বিছানো, তার মাঝে মাঝে সবুজ মটর শুটির খেত, বিলের পানিগুলিতে যেন রূপালি চাদর বিছানো। তার মাঝে গোলাপি আর সাদা শাপলা ফুটে আছে, যেন সোনার দেশ । চল আমরা শাপলা তুলে আনি ।
না রে ঐগুলির জন্যই তো প্রকৃতি এত সুন্দর
চল তার চেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরি ।
বৈকালে রাধাদিদি যেতে বলেছে।
কেন রে?
জলপাই নামিয়ে নিবে।

ওরা গল্প করতে করতে বাড়ী ফিরল। মা, খেতে দিল। মানিক খেয়ে হিন্দু পাড়া গেল ওদের সঙ্গেই হিন্দু পাড়া ও রাধা দিদির কাছে নিয়ে দিদি আমাকে একটি ব্যাগ দাও । মানিক জলপাই, নামিয়ে দিল। ওখানে গীতা দিদি সিতা দিদি সন্ধ্যা দিদি সবাই একসঙ্গে ছিল। সবাইকে এক সঙ্গে দেখে মানিকের খুব ভাল লাগল, দিদি তোমরা ভাল আছ? সন্ধ্যা দিদি মানিক তোকে যে আর দেখাই যায় না রে ভাই ।

গীতা বলল, কেমন করে দেখবি আমাদের মানিক ভাই যে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। দিদি এমন করে বললে আর আসব না। গীতা দিদি, ঠিক আছে ভাই আর বলব না তুই আসিস।

ঠিক আছে দিদি তোমাদের না দেখে আমি কি ভাল থাকতে পারি?
মানিক দৌড়ে খেলার মাঠে গিয়ে সবাই মিলে বল খেলছিল। এ পথে সন্ধ্যা দিদির বাবা নরেন কাকা বাড়ী ফিরছিল। হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। মানিক দেখতে পেয়ে দৌড়ে গিয়ে ডাকতে লাগল, নরেন কাকা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে কিছুতেই সাড়া না পেয়ে, শফিক হাফিজ তোরা আমার সঙ্গে ধর, কাকাকে ডাক্তার খানায় নিতে হবে, সবাই মিলে নরেন কাকাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। মানিক, ডাক্তার বাবু, কাকাকে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা করুন, ডাক্তার বাবু কাকাকে একটি ইনজেকশন দিল। কিন্তু মানিক যে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছে না ।

মানিক আবার বলল, ডাক্তার বাবু ভাল করে কাকাকে দেখেন ।
ডাক্তার, ঠিক আছে তুমি এত ব্যস্ত হয়ো না । একটু ধৈর্য ধর। মানিক, আপনি কি বলছেন? ১ ঘণ্টা হয়ে গেল। তবু জ্ঞান ফিরছে না । আর বলছেন ধৈর্য্য ধর?
ডাক্তার আর একটি ইনজেকশন দিতেই নরেন কাকার জ্ঞান ফিরে এলো, নরেন কাকা, আমি এখানে কেন? ডাক্তার বাবু, আজ যদি মানিক

সেখানে না থাকত তাহলে তোমার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যেত, নরেন কাকা মানিককে বুকে জড়িয়ে ধরে, বাবা তুই আমাদের সোনার ছেলে, বাবা মানিক, কাকা আর এখানে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। এখন তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন, মানিক নরেন কাকাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে বাড়ী ফিরল। মানিকের কাছে হিন্দু খ্রিস্টান মুসলিম সবাই সমান। ও সবাইকে খুব ভাল বাসে। মানিক ছোটদের খুব স্নেহ করে, ওর খেলার সাথি ৫ থেকে ৩ বৎসরের শিশুরা। ওদের মধ্যে একটি ৪ বৎসরের ফুটফুটে একটি মেয়ে, ওর নাম পুতুল ও দেখতে খুব সুন্দর, ওকে মানিক নিজের বোনের মত ভালবাসে ও গঙ্গা কাকির মেয়ে।

পুতুল সারাক্ষণ মানিকের সঙ্গেই থাকে। মানিক সময় সময় মাকে বলে মা আমার যদি একটি পুতুলের মত বোন থাকত তাহলে কত ভাল হত। মা, নিজের বোন নেই তো কি হয়েছে। পুতুলইতো নিজের বোন, মানিক, ঠিক বলেছ মা, আমি পুতুলকে নিজের বোনের চেয়ে বেশি ভালবাসি । একদিন হাবুচাচার বউ উঠোনে বসে কাঁদছিল ছোট ছোট ৪টি ছেলে মেয়েকে কাছে নিয়ে। মানিক কান্নার শব্দ শুনে খোলা উঠন। গাছের নিচে ঘর, হাবু চাচা খুব গরিব, দিন মজুরের কাজ করে।

মানিক, চাচির কাছে গিয়ে চাচি তোমার কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?
চাচি, সে কথা শুনে কি করব বাপ? তোর চাচা সারাদিন ধরে খেটে খুটে দেড় কেজি চাউল এনেছিল । গামছার বাঁধা চালের পুঁটলিটা ঘরে রেখে আমি পানি নিতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি পুটলিটা কুকুরে নিয়ে গেছে। এদিক সেদিক কত খুঁজলাম কোথাও পেলাম না। সারাদিন ধরে এই ছোট ছোট ছেলে মেয়েগুলি না খেয়ে আছে। ভাবলাম রাতে ওদের একটু পেট ভরে খাওয়াব। সেটা আর হলো না ।

চাচি তুমি কেঁদনা এবার চোখ মুছ। আমি আসছি।
মানিক বাড়ী গিয়ে মাকে সব কথা বলে এক ব্যাগ চাউল ডাল ও কিছু আলু নিয়ে হাবু চাচার বাড়ী গিয়ে চাচিকে দিয়ে চাচি এইগুলি রান্না করে ছেলে মেয়েদের খাওয়াও নিজেও খাও ।

চাচি মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করল। বাপ আল্লাহ্ যেন তোকে অনেক আয়ু দেয়, এমন করে যেন সারা জীবন গরিবের বন্ধু হয়ে থাকতে পারিস। আজ থেকে তুই গরিবের বন্ধু ।

মানিক একটু হেঁসে, চাচি একটি মানুষের কতগুলি নাম হয়? আমার কতগুলি নাম তুমি যান? তবে শুনো বাবা মা, ডাকে মানিক বলে পূর্বপাড়ার চাচা চাচিরা ডাকে, হাতেম তাই বলে, হিন্দু পাড়ার কাকা কাকিরা ডাকে সোনার ছেলে বলে। আজ আবার তুমি আরো একটি নাম দিলে গরিবের বন্ধু । এখন তুমিই বল একটি মানুষের কতগুলি নাম হয় । হ চাচি, হয় বাবা হয় একটি মানুষের অনেকগুলি নামও অনেক সময় হয়ে যায়। মানুষের চরিত্র যখন যে রূপ ধারণ করে তখন সেই নাম হয়। মানিক বাড়ী ফিরল । পরদিন মানিক স্কুলে গেল। টিপিনের সময় স্যারের। মিটিং করছিল । মানিককে দেখতে পেয়ে হেড স্যার ডাক দিল, মানিক ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকল স্যার আমাকে ডেকেছেন স্যার?

হ্যাঁ বস তুমিও শোন যদি কোন বুদ্ধি হয়।
স্যার, চতুর্থ ক্লাশে একটি বড় বল্লার চাক লাগিতেছে, প্রতিদিন ২টা ৩টা ছাত্র ছাত্রীকে কামড়াচ্ছে। এ ব্যাপার নিয়ে আমরা চিন্তিত, এখন কি করা যায়?
এক স্যার বলল, যারা চাক কাটে তাদের বলে দেখুন ।

হেড স্যার তা আবার বলিনি? ওরা ভয় পাচ্ছে, ওরা নাকি এত বড় চাক কোন দিন কাটেনি। যদি এক সাথে ১০/১৫ বল্লা কামড়িয়ে দেয় তাহলে যে আমরা মারা যাব। ওরা না বলেছে। মানিক ভাবল ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ওরা ঐ ঘরে বসে যদি এক সঙ্গে কয়েকটি বল্লা কামড়িয়ে দেয়। তাহলে তো ওরা মারাই যাবে। ওরা তো আমার ভাইবোনের মত। তার চেয়ে ভাল হয় আমি একবার চেষ্টা করে দেখি। মানিক স্যার আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি একবার চেষ্টা করে দেখি। হেড স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল তুমি কি উপায়ে চেষ্টা করবে?

আমাকে গোটা ছয় সিমেন্টের বস্তা। কেজি কেরোসিনের তেল কিছু পুরাতন কাপড় দিতে হবে।

হেড স্যার পিওনকে টাকা দিয়ে বলল, এখনি তুমি এগুলি এনে দাও। কামাল পিওন সব এনে মানিককে দিল। কামাল চাচা আমাকে একটি ৮/১০ হাত লম্বা বাঁশ এনে দাও। কামাল একটি বাঁশও এনে দিল। তখন মানিক বাঁশের মাথায় কাপড়গুলি ভাল করে বেঁধে নিল, তিনটি বস্তার চোখের সামনে কেটে ফুটো করে মাথার মধ্যে ঢুকে দিয়ে হাত দুটি শুধু করে বেঁধে দাও। বের করে নিল কামাল চাচাকে বলল, চাচা আমার দুই হাতে বস্তা গুলি ভাল
কামাল বস্তাগুলি ভাল করে বেঁধে দিল ।
কামাল চাচা এখন হেড স্যারকে ডেকে দাও।

কামাল হেডস্যারকে ডেকে দিল। তার সঙ্গে অন্যান্য স্যারও এলো। উঠল । মানিককে দেখে স্যারেরা চিনতে পারলনা। সব স্যার একসঙ্গে হেসে
দিন। স্যার ছোট ক্লাশের ছাত্র ছাত্রীদের ছুটি দিন আর ঘরটি ফাঁকা করে মানিকের কথা মত ঘর খালি করা হলো। মানিক সেই ক্লাশের সামনে গিয়ে বাঁশটি নিচে রেখে ঘরের সব জালানা গুলি বন্ধ করে বাঁশের মাথায় বাঁধা কাপড় গুলিতে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বাঁশের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে মশালটি বল্লার চাকের মধ্যে ধরে রাখল । কিছু ক্ষণের মধ্যেই সব বল্লা মরে শেষ হয়ে গেল। মানিক দরজা খুলে বাহিরে এলো, সব স্যারেরা মানিকের জন্য অপেক্ষা করছিল। সব স্যার একসঙ্গে বলে উঠল মানিক তুমি কেমন আছ?

স্যার আমি ভাল আছি কিন্তু বল্লাদের সব খতম হয়েছে। এখন ঐ গুলি পরিষ্কার করলেই হবে ।
মানিকের সাহস ও সততা দেখে স্যারেরা খুব খুশি হল । ছাত্র ছাত্রীরা মানিককে নিয়ে আনন্দ মিছিল করতে লাগল। স্যারেরা সাব্বাস বেটা আজ থেকে তোমার নাম বীর ছেলে সেদিন থেকে স্কুলে মানিককে বীর ছেলে বলে ডাকতে লাগল ।

প্রতিদিনের মত বিকালে মানিক হিন্দু পাড়ার মাঠে খেলাছিল। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেল ঠিক, যেন গঙ্গা কাকির বাড়ীর সামনে থেকে আওয়াজ ভেসে আসছিল। মানিক বুঝতে পারল ঠিক কিছু একটা হয়েছে। মানিক শুধু খেলার সাথীদের বলল তোরা আয়, মানিক এক দৌড়ে গঙ্গা কাকির বাড়ীর সামনে এসে দাড়াতেই দেখতে পেল ভাঙা কুপের চারপাশে মেয়ে মানুষের ভিড়। আর গঙ্গা কাকি মাটিতে লুটিয়ে পরে চিৎকার করে কাঁদছে।

কাকি কি হয়েছে? কাঁদছ কেন?
সোনার ছেলে তোর বোন পুতুল কূপের মধ্যে পড়ে গেছে। বাপ এখন আমি কি করব?
কেমন করে পরল?

আমি বাসন মাঝছিলাম সেই সময় বালতিতে হাত ধুয়ে এখান থেকে সরে যায়। ও তখন বালতিটা কুপের মধ্যে নেমে দিতে গিয়ে বালতি সহ কূপের মধ্যে পরে গেছে ।
গীতাদি সীতাদি তোমরা এখনি কিছু শাড়ীর সঙ্গে শাড়ী গিট দিয়ে দিয়ে পুতুলের কাছে ছেড়ে দাও ।

গীতা দিদি, সীতা দিদি মানিকের কথা মত শাড়ীগুলি কূপের মধ্যে ছেড়ে দিল। পুতুল শাড়ী ধরে ভেসে রইল। দূর্গা কাকি মানিকের খেলার সাথীদের একে একে সবাইকে বলল, বাবারা তোরা একবার চেষ্টা করে দ্যাখ বাপ, কেহ রাজি হলো না। মানিক, দূর্গা কাকি তুমি আমাকে একটি লম্বা বাঁশ দাও ।

মানিক একটি লম্বা বাঁশ দিয়ে কূপের মধ্যে নেমে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে পুতুল তুই ভয় করিসনে আমি এখন তোকে উপরে তুলে দিচ্ছি। শাড়ীটা পুতুলের কোমরে বেঁধে দিয়ে গীতা দিদি তোমরা পুতুলকে টেনে তোল । ওরা পুতুলকে টেনে উপরে তোল সঙ্গে সঙ্গে মানিকও উঠে পড়ল । সব কাকিরা দিদিরা মানিককে ধন্য ধন্য করতে লাগল। গঙ্গাকাকি মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে, বাবা আজ তুই না থাকলে পুতুলকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলতাম তুই আজ দেবতার মত কাজ করলি ।

মানিক, কাকি তুমি আগে পুতুলকে সামলাও, ও খুব ভয় পেয়েছে। পুতুলের মাত্র ৪ বৎসর বয়স। পুতুলকে জড়িয়ে ধরে রাধাকাকি কাঁদতে লাগল। মানিক ভেজা গায়ে বাড়ী ফিরল। মা মানিক তুমি অসময়ে ভিজেছিস কেন? মা জান? পুতুল কূপে পড়ে গিয়েছিল, যদি সেই সময় গঙ্গাকাকি দেখতে না পেত, তাহলে আজ আজ পুতুল মরেই যেত। মা, তুই বুঝি কূপে নেমেছিলি?
হ্যাঁ মা ।

মা বলল, কেন তুই এত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলি? তোর যদি কিছু হয়ে যেত? তাহলে আমি কি করে বাঁচতাম?
আমার কিছুই হবে না মা। ভাল কাজে আল্লাহ সাহায্য করে। মানিক দেশকে, ও দেশের মানুষকে খুব ভালো বাসে, ও পুকুরে সাঁতার কাটতে ভালবাসে ও নদীতে নৌকা ঠেলতে ভাল বাসে। বিলে শাপলা তুলতে ভালো বাসে। ও কখনো ঘরে বসে থাকে না। ও সারা দিন গ্রাম বাংলার সঙ্গে মিশে থাকে। ও কথা বলে, আকাশ, বাতাস, প্রকৃতির সঙ্গেও কথা বলে শস্য শ্যামল সবুজের সাথে জড়িয়ে থাকে, ওর মন জুড়ে আছে বাংলার প্রতি ছবি । এই ভাবেই ওর দিন কেটে যেত ।

রতন মানিক বাজারে গেল। ওরা হাশেম চাচার চা স্টলে অনেক মানুষের সমারোহ দেখতে পেল। মানিক বলল, রতন চল। আমরা গিয়ে দেখি, ওখানে কি হচ্ছে?
ওরা গিয়ে দেখল সবাই রেডিওর সামনে বসে অপেক্ষা করছে। শুনে যাব । রেডিওতে নাকি শেখ মুজিবুরের ভাষণ হবে। মানিক বলল, রতন আমরাও
ওরা দাড়িয়ে গেল। একটু পর, ৭ই মার্চ এর বজ্রকণ্ঠের ভাষণ শুরু হলো। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি তোমরা রাস্তাঘাট · বন্ধ করে দেবে। ভাষণ শুনে মানিকের শিরায় শিরায় রক্ত বিন্দু গুলি চঞ্চল হয়ে উঠল। ওর বাড়ী ফিরতে ফিরতে মানিক বলল, রতন দেশে কি গণ্ডগোল শুরু হবে নাকি?
হতেও পারে।

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

মানিক বাড়ী ফিলল, মা, সারাদিন কোথায় থাকিস বলতো?
ঘরে কি তোর মন বসেনা ।
যানো মা? এখন থেকে বাহিরে লুকিয়ে থাকতে হবে।
কেন বাপ, কি হয়েছে?
দেশের অবস্থা ভাল না যে কোন সময় দেশে যুদ্ধ শুরু হতে পারে ।

বলতে বলতেই কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকাসহ সারা দেশব্যাপী শত্রুরা আক্রমণ করল। ওরা বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করতে লাগল। শহরগুলিতে লোকদেরকে নির্মমভাবে পাখির মত গুলি করে হত্যা করতে লাগল । শহর থেকে লোকজন রাতের অন্ধকারের বিভিন্ন দুর্গম গ্রামে পালিয়ে আশ্রয় নিতে লাগল । বিভিন্ন গ্রামের লোকেরাও পালিয়ে দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে লাগল। পশুগুলি বিভিন্ন গ্রামেও আসতে লাগল, গ্রামের পর গ্রাম অগ্নিসংযোগ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করতে লাগল।

গ্রামের যুবকদের মুক্তিবাহিনী ভেবে সারিবদ্ধ করে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করতে লাগল। পশুগুলি হিন্দুদের উপর, বেশি কঠোর হলো, ওরা হিন্দু মুসলিম পরীক্ষা করে মারতে লাগল । হিন্দু বউ ঝিরা সাঁকা সিঁদুর ছেড়ে মুসলমান মেয়েদের মত থাকতে লাগল । কিছু কিছু হিন্দু পুরুষরা ভয়ে মুখে দাড়ি মাথায় টুপি পাঞ্জাবী পায়জামা পড়তে লাগল। ঐ গ্রামের হাবিল বস্কু মুখে ছাগলা দাড়ি মাথায় টুপি পাঞ্জাবি পায়জামা পরে পরে গ্রামের মধ্যে ঘোরা ফেরা করতে লাগল। উর্দু কথা বলতে লাগল। ঐ গ্রামের ৮/১০ জন যুবক ছেলেদের, হ্যাপি, রশিদ, হানিক, সামাদ, ছাত্তার, শহিদুল, কারিম, বাক্কর সৈকত বলল, শত্রুদের সঙ্গে লড়তে হবে আগে, আমাদের অস্ত্র শিক্ষা নিতে হবে।

তার জন্য আমাদের ভারতে যেতে হবে। সেখানে মানিক ও রতন ছিল, মানিক ও রতন এক সঙ্গে বলল, আমরাও যাব। সৈকত বলল, না, না, তোরা ছোট মানুষ তোদের যাওয়ার দরকার নেই। তোরা গ্রামেই থাক । আর চোখ কান খোলা রাখবি কে, কি করছে দেখে রাখবি। ওরা ৮/১০ জন রাতের অন্ধকারে দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গেল । রতন ও মানিক গ্রামের মানুষের পাশে পাশে থাকতে লাগল। মানিক রতন বাজারে যাচ্ছিল পথে হাবিল বক্স মনে হয় কোথায় যাচ্ছিল, রতনকে দেখে কাছে এসে বলল, কিরে তেরা, তেরা কাঁহাজায়ে?

রতনের গা যেন বির বির করছিল ওর কথার উত্তর না দিয়ে পাশ কেটে যেতেই আবার সামনে পথ আগলে দাড়িয়ে দাঁড়ির মধ্যে হাত দিয়ে টানতে টানতে বলল, কিরে তোর বড় ভাই সৈকত কোথায় গেছে? ওকে তো দেখতে পাই না?
রতন কেন সৈকত ভাইকে এত দেখার ইচ্ছে করছে কেন?
মানিক বুঝতে পারল হাবিল বক্সর মতলবটা ভাল নয় ।

কে না জানেন দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ, যুবক ছেলেদেরকে দেখতে পেলে ওরা গুলি করে মেরে ফেলছে। তাই ওরা এখানে সেখানে লুকিয়ে থাকছে। হাবিল বক্স বলল, ভয় নেই আমি যতক্ষণ বেঁচে থাকব ততক্ষণ মিলিটারিরা কিছু করতে পারবে না ৷

রতন বলল, কেন চাচা তোমাকে মিলিটারিরা দেখে ভয় করে নাকি?
ভয় লাগবে কেন। ওরাতো আমাদের মত মানুষ আমার সাথে ওদের অনেক ভাব হয়েছে। ওরা আমার বন্ধু। ওরা আমাকে অনেক খাতির যত্ন করে। তোদের যদি কোনো প্রয়োজন হয় আমাকে বলিস।
মানিক বলল, ঠিক আছে ।

রতন বলল, কিরে তুই রাজাকারটার সাথে এত ভাল ব্যবহার করলি কেন?
জানিসনা কথায় আছে দুষ্ট লোকের সহিত মিষ্টি ব্যবহার করতে হয়। নইলে ওরা আমাদের অনেক সর্বনাশ করবে। ওরা বাড়ী ফিরলে মানিক খেতে বসে ঠিক মত খেতেও পারছে না। মা বুঝতে পেরেছে। মানিক কি যেন ভাবছে ।
মা বলল, বাবা তুই ঠিক মত খাচ্ছিস না। তোর কি হয়েছে। মা আমার কিছু ভাল লাগছে না। দেশের অবস্থা খুব খারাপ ।

ঠিক বলেছিস বাপ। কখন যে কার সর্বনাশ হবে তা বলা যাচ্ছে না। তুই সাবধানে থাকিস বাপ । প্রয়োজন একদিকে পালিয়ে যা।
মানিক বলল, ঠিক আছে মা। আমাকে নিয়ে ভেবো না ।

হাবিল রাজাকার এক গাড়ী মিলিটারী নিয়ে গ্রামে ঢুকেছে। মা খবর পেয়ে, রতন ও মানিককে বলল, তোরা মাঠ ভেঙ্গে নদী পেরিয়ে পালিয়ে যা। ওরা দু’ভাই পালিয়ে গেল। হাবিল রাজাকার যে যে বাড়ী থেকে মুক্তি বাহিনীতে নাম দিয়েছে। সেই বাড়ীর বাবা ও ভাইদের স্কুল মাঠে নিয়ে গেল। পাক বাহিনী বাবাদের জিজ্ঞাসা করছিল। বলিয়ে বলিয়ে তোমরা বেটা কাহা গিয়া। মুক্তিবাহিনী হুগিয়া। রাইফেল দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে মারল। বাবারা বলতে লাগল হুজুর আমরা কিছু জানিনা ।

হাবিল রাজাকার বলল, হুজুর এ বেটারা মিথ্যা বাত বলিয়ে। এরা সব জানতাহু। কই অদমীহে ছোড় নেই। খতম কর দিয়া তা। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে সারিবদ্ধ করে ব্রাস ফায়ার করে চলে গেল ।

রতন ও মানিক ফিরে এসে দেখে সারিয়া কান্তি গ্রামে রক্তের বন্যা বইছে। ঐ ১০/১২ জনের মধ্যে রতনের বাবাও ছিল। রতন ও মানিক হতভাগ হয়ে গেল। কোনরকমে বাবার সৎ কাজটি সেরে ফেলল। পুরা গ্রামটি থমথমে ভাব বিরাজ করছে। কারও মুখে কোন কথা নেই। কয়েক দিন পর রতন ও মানিক হিন্দু পাড়া গেল । সেখানেও একই রকম অবস্থা নরেন কাকা,শ্যামল কাকা, ধীরেন দা, শিতিষ কাকাকেও হত্যা করেছে। পাড়ার লোক ভয়ে গুটিয়ে গেছে। মানিক বলল, রতন চল এবার দিদিদের দেখে যাই। ওরা ওদের দরজায় গিয়ে রাধা দিদিদের ডাকতেই তিনজন বেরিয়ে এলো। রাধা দিদি, কাকাতো বোন গীতা দিদি, সন্ধ্যা দিদি, পূর্ণিমা দিদি। ৪ জন এক সঙ্গে বেরিয়ে এলো। ওরা বলল, রতন, মানিক তোরা কেমন আছিস ভাই।

কেমন আর থাকবো দিদি । সবইতো শুনেছ ।
দিদি তোমরা খুব সাবধানে থেকো। আমরা আসি।
ঠিক আছে ভাই তোরা ভাল থাকিস।
মানিক রতন পূর্বপাড়া দিয়ে বাড়ী ফিরল।

হানিফ চাচার মেয়ে লায়লা ও রোকেয়া। ওদেরকে সাবধান করতে হবে। ওরা সবাইকে সাবধান করল। মানিক ও রতন পথে যেতে যেতে রতনের বাবার কবরের দিকে চোখ পড়তেই রতন হু হু করে কেঁদে উঠল। মানিক বলল, কাঁদিস না। চাচার কবরটা খুব সুন্দর আছে। খেজুর পাতা তাহলে কি হয়? এখনও তাজা আছে। এক মাস হয়ে গেল। তাও কাচা আছে। রতন বলল,
তার মানে চাচা খুব ভাল আছে।
চল আমরা কবরে গিয়ে দোয়া করি।

রতন বলল, চল। দোয়া করা শেষ হলে মানিক কবরের বেড়া ধরে বলতে লাগল চাচা তোমাকে আজ কথা দিয়ে যাচ্ছি তোমার হত্যার প্রতিশোধ নিবই। রতন বলল, ঐ কুত্তার বাচ্চা হাবিল বক্স গ্রামের লোকদের জ্বালিয়ে মারল, সালার বেটাকে আগে শেষ করতে হবে। তুই ঠিক বলেছিস, এর মধ্যেই কিছু কিছু হিন্দুরা দেশের সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে গেল। হাবিল রাজাকার গ্রামের লোকদের ধমকি মেরে কারো ছাগল, কারো কাছ থেকে মোরগ, কারো পুকরের মাছ নিয়ে পাক বাহিনীদের পেট ভরাচ্ছে। একদিন হঠাৎ দুপুরে পর হাবিল বক্স মিলিটারীদের নিয়ে গ্রামে ঢুকল ।

গ্রামের লোকেরা আতঙ্কে যে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় গ্রাম ছেড়ে পালাতে লাগল । এক বুড়ার বয়স হবে প্রায় ৮০ বৎসরের মত সেই সময় পায়খানা করছিল। গ্রামে মিলিটারী ঢুকেছে শুনে লুঙ্গিটা বুকের উপর জড়িয়ে তুলে ন্যাংটা অবস্থায় ১ কিলোর বেশি দৌড়ে গিয়ে নদীপার হয়ে সবাই দাড়িয়ে পড়ল। সেই দিন বুড়ার ঐ অবস্থা দেখে, কষ্টের মধ্যেও সবাই হেসে ফেলেছিল। আর কিছু মানুষ পালাতে পারল না তারা জঙ্গল ঝোপ ঝাঁড়ে লুকিয়েছিল ।

হিন্দু পাড়ার বউ ঝিরা পালাতে পারল না। গঙ্গাকাকি ওর কোলের বাচ্চা শুধু কোলে নিয়ে দৌড়াতে লাগল। পুতুল ও মায়ের পিছু পিছু মা, মা করে দৌড়াচ্ছিল। ও কিছুতেই মায়ের হাত ধরতে পারছিল না। ওতো খুব ছোট মানুষ ৷ গঙ্গা ভাবল পুতুল তো খুব ছোট মানুষ ওকে মিলিটারিরা কিছু করবে না । গঙ্গা একটি ঝোঁপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। পুতুল মাকে আর খুঁজে পেল না।

পুতুল বাড়ী ফিরে এলো। কাউকে দেখতে না পেয়ে বাড়ীর চার পাশটায় ঘুরতে লাগল আর মা, মা করে কাঁদছিল। মিলিটারিরা পুতুলকে জিজ্ঞাসা করল, তেরা মা, কাঁহা যায়েগে।
পুতুল খুব ছোট মাত্র ৪ বছর বয়স। মিলিটারীদের কথা বুঝল না। রাজকারটা বলল, হুজুর এ লারকী হিন্দুকা বাচ্চা। বলার সাথে সাথে এক মিলিটারি দু পা ধরে গাছের সাথে বাড়ি মারার সঙ্গে সঙ্গে পুতুলের মাথাটা টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আরো কয়েকটি আঘাত করে থেতা করে ফেলে দিয়ে চলে গেল। হাবিল বক্স মিলিটারিদের নিয়ে ঘরে ঘরে ঢুকে ঢুকে সুন্দরী সুন্দরী বউ ঝিদের ধরে নিয়ে গেল।

ওরা যাওয়ার পর কেউ বাড়ীতে ঢুকার সাহস করছিল না রতনের মা স্বামী হারিয়ে সব সময় আতঙ্কের মধ্যে থাকে যখন শুনতে পেয়েছিল মিলিটারি গ্রাম ঢুকেছে, রতনকে ঘরের চালার উপর লুকিয়ে রেখেছিলা। মিলিটারি চলে গেলে ওকে নামিয়ে নিল। মানিক ছুটে এসে শুনল হিন্দু পাড়ায় পাকবাহিনী বেশি ক্ষতি করেছে। ও দৌড়ে হিন্দু পাড়ায় ঢুকে গেল। গনেশ কাকার সঙ্গে দেখা হতেই, কাকা কি খবর?

গনেশ কাকা মানিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাপ আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে ।
কি হয়েছে কাকা?
সোনার ছেলে, তোর দিদি, বউ দিদের ঐ হাবিল বক্স মিলিটারিদের নিয়ে বাড়ী বাড়ী ঢুকে বউ মেয়েদের তুলে নিয়ে গেছে।
কাকে কাকে নিয়ে গেছে?

আমাদের পাড়া থেকে গীতা, সিতা, সন্ধ্যা, রাধা, আরতী, ভারতী, পূর্বপাড়ার রোকেয়া, হামিদা, হাসিনা, খাদিজা, ওদের সবাইকে এক সঙ্গে ধরে নিয়ে গেছে। আর গঙ্গার মেয়ে পুতুলকে গাছের সঙ্গে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে
পুতুলের কথা শুনে মানিক ছুটে গেল গঙ্গার বাড়ি। কাকি জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রয়েছে। পুতুলকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখেছে। মানিক কাকিকে কি বলবে সে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, পুতুলকে দেখার জন্য কাপড়টা তুলতেই দৃশ্যটি দেখে মানিক জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল ।

সবাই ধরাধরি করে মুখে চোখে পানি ছিটাতেই মানিকের জ্ঞান ফিরে এলো। গোপাল কাকা মানিককে বাড়ী পৌঁছে দিল। হিন্দু পাড়া পুরোটায় যেন শ্মশান ঘাটে পরিণত হয়েছে। মানিক কোন ভাবেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। সারাক্ষণ পুতুলের ডাক শুনতে পাচ্ছে। মানিক দাদা তুমি মাসের কোথায়? রাধা দিদি ও গীতা দিদির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না।
এক বেশি হয়ে গেলো ।

কুত্তার বাচ্চা দিদিদের ফিরে দিল না। বারবার ক্ষত বিক্ষত দেহটি চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেদিন কিছুতেই পুতুলকে চিনা যাচ্ছিল কারো ছিল না । ওর মুখও মাথা এমন করে থেথলে দিয়েছিল। ওকে চিনার ক্ষমতা কারো ছিল না।

মানিকের হৃদয়ে শুধু প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। রতন এসে মানিকের কাঁধে হাত রেখে বলল, মানিক তুই এত ভেঙ্গে পড়িস কেন? নিজেকে শক্ত কর । নইলে শত্রুদের মোকাবেলা কি করে করবি। শক্ত হয়ে ওঠে দাঁড়া ।
তুই ঠিক বলেছিস। আর শোক নয় ।
এখন থেকে শুধু প্রতিশোধ ।
সৈকত ভাইয়েরা আসতে আর কত দেরী
জানিনা । হয়তো আজ ৷
কাল অথবা কিছুদিন দেরী হতে পারে।

মানিক বলল, আর কিছুতেই দেরী করা সম্ভব নয় । কুত্তার বাচ্চা হাবিল বক্সের অত্যাচার বেড়ে গেছে। আর বাড়তে দেওয়া যাবে না ।
তবে কি করবি?
যা করার তা আজই করতে হবে।
মানিক বলল, রতন তুই বলতে পারিস
হাবিল রাজাকার কখন বাড়ী ফিরে।
মনে হয় সন্ধ্যার আগেই ফিরে।
শিমুল গাছেল নিচে দাদির কাছ থেকে জেনে নিব
দাদীর ঘরের পাশ দিয়েই তো যায়
মানিক বলল, চল এক্ষণি গিয়ে শুনি।
ওরা দু’জনে দাদীর কাছে গেল ।
দাদী তুমি একটা কথা বলতে পারবে।
কি কথা তাই বল।
ঐ রাজাকারটা কখন বাড়ী ফিরে?

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

প্রতিদিন তো আমার দরজার সামনে দিয়েই যায়। সকালে যায় আর দুপুরে আসে। আর আছরের নামাজের পর বাড়ী থেকে বের হয়। এশার
নামাজের আগ দিয়ে আসে।
মানিক বলল, দাদী তোমার খাওয়া হয়েছে।
হ্যাঁ ভাই খেয়েছি।
তবে আমরা এখন আসি ।
রাতে তোমার খাবার নিয়ে আসব।
ওরা দু’জন চলে গেল।

কলা গাছ কেটে রাখল। সূর্য্য ডোবার সাথে সাথে রাজাকার আসবে। সেই পথে সাজিয়ে রাখল । আর গাছের নিচে হালকা গুছি দিয়ে রাখল । মানিক বাড়ী ফিরে মাকে বলল, মা দাদির জন্য খাবার দাও এখনি দিয়ে আসি ।
মানিক রতনকে বলল, চল খাবার গুলি দিয়ে দেখে আসি, কুত্তার বাচ্চাটা কেমন করে, মজাটা দেখে আসি ।

ওরা দুজনে ভাত নিয়ে দাদির কুঁড়ে ঘরে বসে রইল। একটু পরেই হাবিল বক্স ঐ কলা গাছের উপর উঠতেই গাছ গুলি গড় গড় করে গড়িয়ে গেল। রাজাকারটি ছিটকে খাদে পরে গিয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগল মনে হয় ওর চিৎকার কারো কানে পৌঁছায়নি।
দাদি শুনতে পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বলতে লাগল কে?

কে চিৎকার করছে? বলতেই মানিক রতন দৌড়ে এসে দাদিকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। দাদি তুমি চুপ করে থাক। দাদি বলল, মনে হয় ঐটা হাবিল বক্স চিৎকার করছে। করুক তোরা এখনি বাড়ী যা। মানিক রতন দৌড়ে বাড়ী ফিরল। রাজাকারটার চিৎকার চেচামেচি শুনে ওর বউ ছেলেরা এসে খাদ থেকে টেনে তুলে দেখে ওর মুখ থেকে রক্ত পড়ছে।

ওর দুটি দাঁত ও একটি হাত ভেঙ্গে গেছে। কয়েক দিন পর ঐ রাজাকারটির সঙ্গে রতন মানিকের পথে দেখা হলো। ওর ডান হাতে ব্যান্ডিজ, মানিক একটি লম্বা সালাম দিল, চাচা তোমার হাতে কি হয়েছে?

আর সে কথা কি বলব কদিন আগে রাতে বাড়ী ফিরছিলাম মনে হয় কেউ আমাকে ইচ্ছে করে ফেলে দিয়েছে তাই পড়ে গিয়ে হাতটি ভেঙ্গে গিয়েছে। শুধু হাতই ভাঙ্গেনি, দুটি দাঁত ও ভেঙ্গে গেছে। আমি একটু সুস্থ হয়ে তারপর আমি উল্কা কাণ্ড করে ছাড়বো। মানিক বলল, যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেল। এক মাস পর হাতের ব্যান্ডিজটা খুলল। আমার বন্ধুরা রেগে বলল তুমি এত ভাল একজন মানুষ, তোমাকে এভাবে কষ্ট দিল । এটা ভাল কাজ করেনি। হাবিল বক্স চলে গেল । রতন বলল, শালার শিক্ষা হয়েছে। মানিকের বুকের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন একটু কমেছে। ওর এমন কিছু হয়নি।

ওকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় হতে হবে। তবে সবার শান্তি হবে। ওরা দু’জন বাড়ী ফিরল। মানিকের মুখে কোন কথা নেই। ওর দু চোখে ভেসে উঠলো পুতুলের সেই দৃশ্যটি। মনে পড়ে গেল গীতা দিদি ও সীতা দিদিদের কথা ওরা তো আর ফিরে এলো না। হয়তো মেরে ফেলেছে। গীতা ও সীতা দিদি আমাকে কত ভালবাসতো। ওদের কথা মনে হতেই দুচোখে ছলছল করে উঠল ।

রতন বলল, কিরে কি ভাবছিস, কিছুনা। সৈকত ভাইয়েরা কবে আসবে? জানিনা, মানিক ও রতন লেখতে বসেছিল। রাত ৯টার মত হবে। হঠাৎ অন্ধকারের মধ্যে ৪ জন মানুষকে দেখতে পেল। পুরু শরীরটা কালো। ওদের কাধে রাইফেল মানিক রতনের দিকে এগিয়ে আসছিল। মানিক বলল, কে
একটি লোক ফিস ফিস করে বলল, জোরে কথা বলিস না।

আমি সৈকত। আর আকবর, রশিদ, ছামাদ, বাকিসবাই বাড়ী ফিরেছে। সৈকত বলল, তোরা তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যা। কেহ দেখে নিবে । ওরা তিনজন চলে গেল ।
মানিক সৈকতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। তাড়াতাড়ি বাড়ীর ভিতরে চল। এখানে নিরাপদ নয়। মানিক সৈকতের মাকে বলল, এসে
দেখ কে আসছে।

সৈকত আগে ওর বাবার খবরটা শুনেছে।
মা সৈকতকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল ।
বাবা আমাদের সর্বনাশ হয়েছে।
হাবিল বক্স মিলিটারী ডেকে এনে সবাইকে মেরে ফেলেছে। তুমি দেখ মা ওদের দিন ফুরিয়ে গেছে। ওরা এখন মরবে। তুই একটু জিরিয়ে নে।
মা, চলে গেল।
মানিক বলল, সৈকত ভাই আমাকেও তোমাদের দলে নাও ।
কেন ৱে ৷

আমিও যে শত্রুদের সাথে লড়তে চাই। তুই এখনও ছোট মানুষ। আমাকে অস্ত্র চালানো শিখিয়ে দাও। মানিক নাছড় বান্দা। কিছুতেই শুনতে চায় না। ঠিক আছে কাল স্কুলে মাঠে আসিস। ঠিক আছে সৈকত ভাই তাই হবে।

মানিক পরদিন চুপি চুপি আরও ৮/১০ জনকে নিয়ে মাঠে অপেক্ষা করছিল। সেই সময় রতন সৈকত এসে সবাইকে ট্রেনিং দিতে লাগল ।
কিছুদিনের মধ্যে ট্রেনিং শেষ হলো। সৈকত আমরা দু’চার দিনের মধ্যে শত্রুদের আক্রমণ করবো। মাঠ থেকে সবাই বাড়ী ফিরল । শত্রুদের শেষ করার আগে । হাবিল বক্সকে শেষ করতে হবে। নইলে যে কোন সময় পাক বাহিনীদের গ্রামে নিয়ে আসবে। হাবিল বক্স খুব অনুসন্ধান করছে। মুক্তি বাহিনী গ্রামে ঢুকেছে না কি। এমনিতে গ্রাম শ্মশানে পরিণত করেছে। তুই ঠিক বলেছিস। ওর অপরাধের ক্ষমা নেই । মানিক বলল, আজ রাতেই ওকে শেষ করতে হবে।

আমি নিজেই ওকে শেষ করে দিব
মানিক একটু শক্ত দড়ি সংগ্রহ করে একটা গাছের নিচে লুকিয়ে রাখল। তোমরা সন্ধ্যার পর শিমুল তলার মোড়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থেকো। আমি সিগনাল দিলেই তোমরা বেরিয়ে এসো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আধার এসেছে। মানিক, রতন, দড়িটা নিয়ে রাস্তায় পার্শ্বে জঙ্গলের মধ্যে একটি গাছের সহিত ফাঁস করে ঝুলিয়ে রাখলো। তারপর ওরা চা দোকানের বসে রইল। এশার নামাজের আগে হাবিল বক্স ক্যাম্প থেকে ফিরে চা স্টলে বসে, হাকিম এক কাপ চা দে ।

মানিক, রতন তোরা চা খাবি?
না আমরা খেয়েছি হাবিল বক্স চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে বলল, রতন
মানিক তোরা বাড়ী যাবি না?
এখন যাব না ।
কেন, খবর শুনে যাবি?
খবর শুনে কি হবে।
যা হবার তা তো হবেই।
তুমি চলে যাও।
হাবিল বক্স বলল, তবে খবর শুনে যাই। খবর শুরু হল ।

বিভিন্ন থানা গুলিতে শত্রুরা আত্মসমর্পণ করছে। শুনে মানিক চিৎকার করে উঠল। হাবিল বক্স যেন মানিকের চিৎকারে ভেঙে পড়ল। মানিক তোরা যাবি। কেন, তুমি একা যেতে পারছ না। কেন পারবো না। এক সঙ্গে গেলে ভাল লাগে। চল যাওয়া যাক। হাবিল বক্স বলল, আজ একটু দেরী হয়ে গেল । হয়তো একটু ভয় লাগছে । কেন?
গ্রামে নাকি মুক্তি বাহিনী ঢুকেছে।

তাতে কি হয়েছে । তোমার তো শক্তিশালি বন্ধুরা আছে ।
ওরা কথা বলতে বলতে জঙ্গলের কাছে এসে গেল। মানিক রতন সিগন্যাল দিল এবং বলল, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি। মোরা একটি ফুলের জন্য অস্ত্রধরি। বলতে হাবিল বক্স রেগে গেল। এই শালার বেটার জন্য দেশে এত অশান্তি । থাম থাম । এইগান গাইতে হবে না। হাবিল বক্সের কথা শুনে মানিকের মাথা গরম হয়ে গেল। ওর দৃষ্টিতে ভেসে উঠল, পুতুলের মত বিক্ষত রক্ত মাখা মুখ গুলি। রতন গান ধর। আবার গান ধরতেই সৈকত সহ সবাই বেরিয়ে এলো।

রতন টুল আন জলদি। রতন দৌড়ে গিয়ে দাদীর ঘরে থেকে একটি টুল আনতে হাবিল বক্স বলে উঠল, টুল কি করবি। বলে ছটফট করছিল। মানিক বুঝতে পারল হয়তো হাবিল দৌড়ে পালাতে পারে। তাই খপ করে দাড়িটা চেপে ধরল । রতন তুই জায়গা মত টুলটি রেখে দে । হাবিল বলল, টুল কি হবে। টুলে দিয়ে তোমাকে পুঁজা করা হবে ।

হাবিল বক্স বুঝতে পারল হয়ত আজ আমাকে শেষ করে ফেলবে।
ও বলতে লাগল বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে আমাকে ক্ষমা কর।
আমার জীবনটা ভিক্ষে দাও। মানিক দাড়ি ধরে টেনে টুলের উপর তুলতে তুলতে বলল, ক্ষমা পরে হবে আগে বল । পুতুলকে কে মেরেছে?
মিলিটারিরা, মারার জন্য কে উসকিয়ে ছিল? আমি, গীতা, সীতা দিদি সন্ধ্যাদিকে ফিরিয়ে দিতে পারবি?
না।
কেন?

ওদের কোথায় রেখেছে যানি না। তবে প্রথমে এই ক্যাম্পে রেখেছিল । পরে গাড়ীতে করে কোথায় যেন নিয়ে গেছে। আমি যানি না। সৈকত বলল, মানিক কুত্তার বাচ্চার মুখটি বেঁধে ফেল ওকে আর সুযোক দেয়া যাবে না। দেশের অনেক ক্ষতি করেছে দেশের মানুষদের মেরে ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে গামছা দিয়ে মুখবেধে ফেলল, আর ফাঁসটি গলার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে পায়ে নিচ থেকে টুলটি টান দিতেই হাবিল বক্স ঝুলতে লাগল ।

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

মানিক বলল, রতন টুলটি দাদিকে দিয়ে আয় ।
সৈকত বলল, আমরা শান্তিতে বুক ভরে গেল ।
রতন বলল, আমারও ।

হাবিল বক্সকে মেরেও মানিকের শান্তি হলো না । ওর মনে প্রতিশোধের আগুন আরো বেশি জ্বলতে লাগল। মানিক বলল, সৈকত ভাই আমাকে একটি মাইন দিবে?
কি করবি?
আমি ঐ পশুগুলির ক্যাম্পটি উড়িয়ে দিব।
সাবাস তুই পারবি।
তাহলে তুমি কাল আমাকে একটি মাইন দিও ।

ঠিক আছে দেব, তার আগে ক্যাম্পে গিয়ে ঠিক ঠাক পজিশন দেখে আসতে হবে। তুই আর রতন, কিছু নিয়ে ক্যাম্পে যাবি। সৈকত ভাই ঐ কুত্তার বাচ্চাদের ফ্রেশ কলা ও পেয়ারা দেয়া যাবে না
তবে কি করতে চাস?

কলার মধ্যে ৩টি করে ঘুমের বড়ি গুলে সিরিজ দিয়ে কলার মধ্যে
ঢুকাতে হবে তুই ঠিক বলেছিস,
কোথায় পাবি?
বাবার কাছে।

তাহলে নিয়ে আসিস, বাবা আমাকে দেবে না। তুমি বাবার কাছ থেকে নিয়ে এসো, ঠিক আছে তোমাদের কিছু করতে হবে না, আমি ওসব ব্যবস্থা
করে দিব।
সৈকত মানিকের বাবার কাছে গিয়ে বলল, চাচা কয়েক পাতা ঘুমের বড়ী দাও ।

কি করবি?
ঐ কুত্তার বাচ্চাদের বেহুস করে রাখতে হবে, তাহলে কাজ করতে
সুবিধা হবে।
চাচা কয়েক ডজন ঘুমের বড়ি দিল।
ওই বড়িগুলি গুলে সিরিজ দিয়ে কলার মধ্যে ভরে দিল ।

মানিক রতন কলা ও পেয়ারার ঝাঁকাগুলি মাথায় নিয়ে ক্যাম্পের আসে লাগল । পাশে ঘুরছিল। দুজন মিলিটারি রতন মানিককে দেখতে পেয়ে ডাকতে
এ লারকা এ ধারমে আয় এ। মানিক রতন সেই অপেক্ষায় ছিল ডাকা মাত্রই ওরা ক্যাম্পে ঢুকে গেল । সঙ্গে সঙ্গে সব মিলিটারিরা ওদের ঘিরে ধরল । একজন বলতে লাগল এয়া কিয়াহ্, এয়া কেতনা লাগত । রতন স্যার খাইয়ে বহুত আচ্ছা লাগতেই
একজন খেয়ে বলল, বহুত আচ্ছা মিঠা লাগত ৷

বলতেই সবাই হুমড়ি খেয়ে এসে নিমেসের মধ্যে খেয়ে শেষ করল, একজন মানিককে বলল, তোমতো খুব সুরত হায়, তো কিয়া কাজ করতা। স্যার মেরা বহুত ভোখার? একাজ না করলে কি করে খাব?
তোম মেরা সাথ থাকিয়ে। মানিক ভাবল এদের সাথে মিল লাগিয়ে
কাজ করতে হবে।
বলল স্যার আমি আপনাদের সাথেই থাকব ।

কি করতে হবে বলুন ।
মিলিটারিটা বলল, আয় এ মেরা সাথ ।
বলে ওদের সব ঘুরে দেখতে লাগল। আর বলল, এই জায়গাগুলি পরিষ্কার করে রাখতে হবে। মানিক ও রতন এই সুজুগে সব কিছু দেখে নিল । বলল, স্যার এখন যাই কাল আসব। ঠিক হায়। ঠিকা হায় ।

বলে ওদের হাতে ৫০০ টাকা নোট দিয়ে দিল।
ক্যাম্পের সামনে ও পিছনে ভাল করে দেখতে লাগল। ক্যাম্পের পিছন দিকে একটি খাড়ি রয়েছে তাতে বড় বড় ঘন কচুরি পানা ভরা। মানিক বলল, রতন দেখেছিস?
কি?
খাড়িতে কত বড় বড় কচুরি ।
তাতে কি হবে?
আমাদের কাজ করতে সুবিধে হবে।
ঠিক বলেছিস।

মানিক ও রতন ফিরে এসে সৈকতের কাছে গেল। সৈকত ভাই আমাদের যা করার তা আজ সন্ধ্যার পরই করতে হবে । ঠিক আছে ।
তোরা রেডি হয়ে আয় ।

বিকালে মানিক, রতন, সৈকতের কাছে এলো। মানিক সৈকত ভাই তাড়াতাড়ি মাইনটা আমাদের বেঁধে দাও, আমার যে তর সইছে না। শালার বেটাদের শেষ করে দেব, ঠিক আছে দিস, তার আগে ভাল করে দেখে নিবি, আমরাও থাকব তোমাদের সাথে। তোমাদের থাকতে হবে না আমি একাই ওদের শেষ করব, ঠিক আছে।
কতটা পারিস দেখব, ঠিক আছে দেখে নিও
মানিক রতনের তল পেটে গামছা দিয়ে মাইনটা শক্ত করে বেঁধে দিল । ওরা রওনা দিল ক্যাম্পের দিকে।

ক্যাম্পে থেকে বেশ কিছুটা দূরে খাড়ির পাড়ে একটি জঙ্গলের মধ্যে সৈকত সহ সবাই লুকিয়ে পড়ল মানিক ও রতন কচুরী ভরা খাড়িতে নেমে পড়ল। ওরা ডুবিয়ে ডুবিয়ে ক্যাম্পের পিছনে এসে উপস্থিত হল। ওরা আস্তে আস্তে উপড়ে উঠে চার পাশটা একবার ভাল করে দেখার চেষ্টা করতেই দেখে এখানে সেখানে মিলিটারীগুলো বসে কেউ শুয়ে ঝিমাচ্ছে, মানিক বলল, দেখ রতন বেটাদের ঔষধ কাজে লেগেছে। হ্যাঁ ঠিক বলেছিস।

যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ওরা মাইন গুলি খুলে ঠিকঠাক জায়গাতে রেখে তাড়াতাড়ি কচুরির মধ্যে নেমে পড়ল। ওরা আবার ডুবিয়ে ডুবিয়ে ঐ জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই, বিকট শব্দে ক্যাম্পটি উড়ে গেল। সৈকত ওর সঙ্গিরা মানিক ও রতনকে দেখতে না পেয়ে অস্থিরভাবে ক্যাম্পের দিকে জয় ধ্বনি দিতে দিতে এগুতেই সৈকতই যেন আনন্দের মধ্যেও অস্থিরভাবে চলছে। তাই একবার মনের অজান্তে মানিক, রতন বলে চিৎকার করে উঠতেই ওরা দুজন কচুরীর মধ্যে থেকে চিৎকার করে বলে উঠল তোমরা চিন্তা করনা আমরা ঠিক আছি। বলে ওরা দৌড়ে উপরে উঠে এলো সৈকত দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাই তোরা ঠিক আছিস তো? রতন বলল, খুব ঠিক আছি ভাই ।

মা বোনদের প্রতিশোধ নিয়েছি । আজ আমার অনেক আনন্দ আমার বাবার হত্যার এবং আমার গ্রামের
মানিক বলল, আমিও বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি, আজ আমার পুতুলের ও দিদিদের আত্মা শান্তি পেল । বাঘা থানার খায়ের হাঁট গ্রামে বড় ভাই হামিদুল হকের বাড়ী। ১৯৭১-এ তিনি মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। বগুড়া জেলার সিংড়া থানার সৈকত ভাই হামিদুল ভাই এর বন্ধু ওনারা এক সঙ্গে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসেন সৈকতের ছোট ভাই মানিক আবদুল্লাহপুর স্টেশনের পাশে পাকবাহিনীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য হামিদুল ভাই সৈকতকে আহ্বান জানায় । সৈকত ওর গ্রামের ৪ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেই।

সেই খবর মানিকের কানে পৌছাতেই মানিক ছুটে এলো সৈকতের কাছে, ও খুব জেদ ধরল যুদ্ধে যাওয়ার জন্য। সৈকতের পিছ কিছুতেই ছাড়ছে না ও সৈকতকে বলল, ভাই আমাকে একটি বার তোমার সঙ্গে নিয়ে চল। সৈকত বলল, সে অনেক দূরের পথ তুই ছোট মানুষ যেতে পারবি না। তার চেয়ে ভাল তুই রতনের সাথে গ্রামেই থাক । মা তোকে কিছুতেই যেতে দিবে না। মানিক কি যেন বুঝে থেমে গেল। সৈকত ওর সঙ্গিদের নিয়ে রওনা দিল। প্রায় আধা কিলো পথ যাওয়ার পর পিছন থেকে মানিকের ডাক শুনতেই সৈকত পিছে ফিরে দেখে মানিক সৈকত ভাই বলতে বলতে দৌড়ে আসছে।

ও সৈকতকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমাকে নিয়ে চল। সৈকত কি আর করবে বাধ্য হয়ে ওকে সঙ্গে নিয়ে আব্দুলপুর পৌঁছে গেল। আব্দুলপুর মিলিটারী ক্যাম্প থেকে বেশ কিছু দূর হবে। সেখানে বিশাল বড় জঙ্গল ছিল। সেদিন ঐ যুদ্ধে হামিদুল ভাইসহ সৈকত, মানিক আরও অনেকে ছিল। সকাল থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। সেদিন পাকবাহিনীদের সঙ্গে বীর পালোয়ানের মত যুদ্ধ করেই চলছে মুক্তি বাহিনীরা।

ওদের দল নেতা ছিল হামিদুল ভাই। সেদিন ওদের দলের প্রায় ২০/২২ জন মুক্তি সেনাছিল। সেদিন কেন যেন মানিকের মনটা ভারছিল। মানিকের বয়স খুব কম। সবে মাত্র দশম শ্রেণিতে উঠেছে। সৈকতের ছোট ভাই (চাচাতো) মানিক। মা বাবাকে না বলে সৈকতের সাথে যুদ্ধে যোগদান করেছিল। তাই বুঝি ওর মনটা খারাপ লাগছে। সৈকত একবার মানিককে জিজ্ঞেস করল কি রে তোর শরীরটা খারাপ লাগছে?

না আমি ঠিক আছি। আজ মানিকের মনের মনি কোঠায় কত কথা কত স্মৃতি ভেসে উঠছে।
গীতাদি, রোকেয়া, সন্ধ্যা যিদি পুতুলের ক্ষত বিক্ষত মুখটি ভেসে উঠছে। মানিকের কেন জানি আজ মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
হঠাৎ কয়েকটি গুলি মানিকের বুক ভেদ করে বেরিয়ে গেল। মানিক চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সৈকত ও হামিদুল ভাই ছুটে এলো। সৈকত মানিকের মাথাটা কোলে তুলে নিল, মানিকের বুক থেকে তীর বেগে রক্ত ছুটতে লাগল ।

হামিদুল ভাই নির্বাক দৃষ্টিতে মানিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মানিক বলল, সৈকত ভাই হামিদুল ভাই যাও তোমরা শত্রুদের সঙ্গে লড় আমার কাছে বসে থেকো না আমি ঠিক আছি। যাও শত্রুদের কবল থেকে আমার দেশকে মুক্ত কর। সৈকত ভাই মাকে দেখ। যাও তোমরা আমাকে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে দাও। বলে মানিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

মুক্তিযুদ্ধের অজানা গল্প

মানিককে পৃথিবীর প্রতিটি বস্তু যেন ডাকছে। সোনার ছেলে, তুমি আমাদের ছেড়ে যেওনা। আকাশ বাতাস নিস্তব্দ হয়ে গেল। অন্ধকার চারদিক ঢেকে গেল। আস্তে আস্তে শত্রুরা ও পিছে হটলো। কিছুক্ষণের মধ্যে শত্রুরা পালিয়ে গেল। হামিদুল ভাই বলল, মানিককে এখানে রেখে যাওয়া যাবে না। জঙ্গরের হিংস্র পশুরা খেয়ে ফেলবে। তোমরা পালি করে নিয়ে চল। হামিদুল ভাইয়ের নির্দেশ মত সৈকত বাক্কার সফিক, সামাদ মানিকের মৃত্যু দেহটি কাঁধে নিয়ে আঁধারে পথ চলতে লাগল। এই ভাবে ৪/৫ মাইল চলার পর ওরা একটা বিশাল বড় বিলে সোনার ছেলেকে সবাই মিলে ভাসিয়ে দিল।

দৃশ্যটি দেখে এক মুহুর্তে জন্য হলেও সবার বুকের ভিতরটা হু হু করে কেঁদে উঠল ।
১৯৭১ সালে আমার বড় ভাই আবুল হোসেন রাজশাহী জেলার বাঘা থানার মুরশিদপুর গ্রামে ওনার বাড়ি। তিনি সেই সময় চাকুরিরত ছিলেন তিনি হেলথ সুপারভাইজার ছিলেন। তিনি সেই সময় পাক বাহিনীদের ভয়ে তাহার স্ত্রীসহ পরিবারকে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেন। সেই সময় তাহার সন্তান ছিল না । বর্তমানে তাহার এক পুত্র ও এক কন্যা ।

সেই সময় তিনি পরিবারকে ভারতে পাঠিয়ে একা হয়ে গেলেন । তিনি কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে কিছু কম নয়। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সূচিকিৎসা দিয়েছেন। তাদের খেতে দিয়েছেন তাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন এবং গ্রামের লোকদেরও চিকিৎসা, খাবার ও আশ্রয় দিয়েছেন। তার মনটা অনেক উদার। তিনি পরোপকারী। তিনি সবসময় দুঃখি মানুষের পাশে থাকেন। সেই সময় তিনি নওগাঁও চাকুরী করতেন। তার অফিসের সামনে একটি বাড়িতে একটি মা তার স্বামীকে হারিয়ে ছয় সন্তানকে নিয়ে বাস করত। আবুল ভাই প্রায় দেখতে পেতো ঐ বাড়ী থেকে একটি ৭ বছরের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে একটি ১ বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এদিক সেদিক ঘুরতো।

একদিন আবুল ভাই মেয়েটিকে ডেকে বলল, তোমার নাম কি? তোমরা কয় ভাই বোন? মেয়েটি বলল, আমরা তিন ভাই তিন বোন। তোমার বাবা কি করে? আমার বাবা? হারিয়ে গেছে। কত দিন আগে? প্রায় ছয় মাস হলো। তোমরা খোঁজ করনি? হ্যাঁ কত খুঁজেছি এখনো খুঁজি কিন্তু বাবাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। কে বলে হারিয়ে গেছে, কেহ বলেপাকবাহিনী গুলি করে মেরে ফেলেছে। বাবা আমাকে খুব ভালবাসে। আমি নাকি বাবার প্রান, আমাকে ছাড়া বাবা একদিনও কোথাও থাকতে পারতো না। তাহলে কেন বাবা আমাকে ছেড়ে আছে ? এখন আপনি বলেন তো বাবাকে কোথায় খুঁজলে পাওয়া যাবে ?

চারদিকে তো মিলিটারি ঘিরে আছে। বাবাকে না দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। আবুল ভাই ছোট্ট মেয়েটির কথাগুলি যেন বন্দুকের গুলির মতো হৃদয়টা ভেদ করে বেরিয়ে গেলো। ভাইয়ের চোখ দুটি ছলছল করে উঠল। মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না। মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল আমাকে একদিন তোমাদের বাড়ী নিয়ে যাবে? মেয়েটি আনন্দে হেসে বলল, ঠিক আছে এখনি আমার সাথে চলুন। আবুল ভাই, ঠিক আছে, যাব তুমি আগে মাকে বলে অনুমতি নিও।

ঠিক আছে বলে মেয়েটি চলে গেল। বাড়ী গিয়ে মেয়েটি মাকে সব কথা বলল, মা বলল, ঠিক আছে একদিন নিয়ে আসিস। একদিন মেয়েটি প্রাইভেট স্যার মেয়েটির মাকে বলল আবুল আমার বন্ধু ও আপনাদের দেখতে চায়। মা বলল ঠিক আছে তুমি একদিন নিয়ে এসো। স্যার আবুল ভাইকে মেয়েটির বাড়ীতে নিয়ে এলো এবং মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। মার কাছে থেকে সব ঘটনা শুনে ভাইয়ের মন ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেল ।

ভাইয়ের চোখ দুটি ছলছল করে উঠল
আবুল ভাই সেদিন মেয়েটির মাকে, মা বলে ডেকেছিল। বলেছিল আপনি আজ থেকে আমার মা, আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন আমি আপনার ছেলে হয়ে থাকব। আর বলেছিল আমার একটি আবদার আপনাকে মানতে হবে? কি আবদার বাবা বলো? ভাই মেয়েটিকে হাত ধরে কাছে নিয়ে বলল এই মেয়েটিকে আমায় দেন, আমার এখনো সন্তান হয় নাই, ওকে নিজের সন্তানের স্থান দেব।

ও আজ থেকে আমার ছোট মেয়ে। মা আর কিছু বলতে পারল না। শুধু বলেছিল বাবা তোমার মত ছেলে যেন বাংলার ঘরে ঘরে জন্ম নেয় এবং অনেক দোয়া করেছিল। সেই দিন থেকে ভাই ঐ পরিবারের অনেক আপন হয়ে গেল। ভাই সেই দিন থেকে ছোট্ট বোনটিকে তার মনের মণিকোঠায় আজও সাজিয়ে রেখেছে। মেয়েটি স্বাধীনতার ৪৫ বৎসর পরও ভাইয়ের আদর স্নেহের কথা ভুলতে পারেনি। তার সব স্মৃতি এখনো প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ে।

আর চোখের জলে বুক ভেজায়। ভাই বেঁচে আছে বলে মেয়েটির মনে এখনো অনেক বল। সেভাবে ভাই একসময় আমাদের মাথার উপর ছাতার মত ছিল। ভাই এখন ঠিক মত হাঁটতে পারে না তাই বোনটিকে আর দেখতেও আসতে পারে না। বোনটি অপেক্ষায় থাকে ভাই কবে আসবে তার কাছে। আর শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করে ভাইকে আমার ভাল রেখ। বাঁচিয়ে রেখ শত বছর ধরে।

বায়া থানার আজিজুল আলমের বাড়ী, ওনি আমার বড় ভাই ১৯৭১ এ কিছু কিছু মুক্তিযোদ্ধারা কাজ করেছে যারা নৌবাহিনী তাদেরকে আত্মঘাতি বলা হয়। ওরা নিজের জীবন বিপন্ন করে কাজ করেছে। আজিজুল ভাই নৌবাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। ওনি নৌযুদ্ধে ভূমিকা রাখেন ওনি নৌবাহিনীর দল নিয়ে সুন্দর বনে প্রবেশ করেন। ওনারা ১৫ ই আগস্ট রাতে হিরণ পয়েন্ট নঙ্গর করা পাকবাহিনী জাহাজ ৪টি বন্দরে চট্টগ্রাম, মংলা, নারায়ণগঞ্জ, সেই সময় দুটি গানের মাধ্যমে সংকেত দেওয়া হত। গানের কথা ছিল। আমি তোমার যত শুনিয়ে ছিলাম গান।

এই গানের সংকেত ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেয়া দ্বিতীয় গানটি ছিল। আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ী প্রতিটি দলে একটি করে রেডিও ছিল। গানটি রেডিওতে বাজার সঙ্গে সঙ্গে একযোগে সব বন্দর থেকে আক্রমণ শুরু হয়। এবং সেই রাতে ২৪টি জাহাজ ধ্বংস হয়। সে দিন অসাধারণ সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে । সফলতায় পাকিস্তানী সৈন্যদের মনোবল ভেঙ্গে যায় সেই দিনের ঘটনা নৌ বাহিনীদের যুদ্ধের কৌশল ছিল, ওরা যখন যুদ্ধে নামত ছোট একটি প্যান্ট পরে নিত। তল পেটে গামছা দিয়ে শক্ত করে গ্রেনেড টি বেঁধে নিয়ে পানিতে ডুব দিয়ে শুধু নাক ও চোখ দুটি জেগে থাকত।

এইভাবে যুদ্ধ করেছে। কখন কখন জাহাজের ধ্বংস করার জন্য নিজেকে আত্মঘাতি হতে হয়েছে। নৌবাহিনীরা সারারাত সাগরে ডুবে থাকত ভোরের আলো ফোঁটার আগেই পানি থেকে উঠে পড়ত। দিনের বেলা সুন্দর বনে লুকিয়ে থাকত। অনেক সময় জাহাজ ধ্বংস করতে নিজেরাও ধ্বংস হয়ে যেত। সমুদ্রের গর্ভে চির তরে ঘুমিয়ে রয়েছে। এক দিন ওরা কর্ণফুলি নদীতে অপারেশনের জন্য রাত ১২টার সময় নদীতে নেমে পরল,সারা রাত নদীতে থেকে ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই নদী থেকে উঠে পরল।

কিন্তু আজিজুল ভাইয়ের এক বন্ধু তার নাম জি এন মওলা সে আর উঠল না আমার সোনার দেশের সোনার ভাইয়েরা কত যে ভেসে গেছে সমুদ্রের উত্তল ঢেউয়ের মাঝে। নৌ বাহিনীরা রাতে ছোট্ট ছোট্ট ডেঙ্গি নৌকা নিয়ে পানিতে ভেসে থাকত। ১৬ই ডিসেম্বরে বেলা ৪, ৫ টার সময় নৌবাহিনীর দল নিয়ে আজিজুল ভাই চট্টগ্রামে টাইগার পাশ ক্যাম্পে হামলা করে। পাক বাহিনীরা আত্মসমর্পণ করে তারপর পাক বাহিনীদের ট্রাক ভরে ভরে পাঠিয়ে দেওয়া হল।

আজিজুল ভাইয়েরা একটি তালা বদ্ধ দরজা দেখতে পেল ওরা স্বজোরে আঘাত করে তালা ভেঙ্গে ফেলে দেখতে পেল মর্মান্তিক দৃশ্য সে এক হৃদয়বিদারক গল্প নিজের চোখকেও বিশ্বাস করা যায় না। সেই কক্ষটি বিশাল বড় লম্বা দেওয়াল থেকে ঐ দেওয়াল দেখা যায় না। সেই কক্ষটি ভর্তি অন্তত দুই থেকে ২৫০ সুন্দরী যুবতী নারী, ছিল। কারো পরিধানে কাপড় ছিল না। সবার উলঙ্গ অবস্থা ছিল সবার চুলগুলি ছোট্ট ছোট্ট করে কেটে দিয়ে ছিল ।

ওরা ধর্ষিতা হয়ে ছিল। ওদের এই অবস্থা দেখে নৌবাহিনী ভাইয়েরা সেদিন তাদের অশ্রু ধরে রাখতে পারেনি। ওরা চোখ বন্ধ করে ওদের গা থেকে গেঞ্জি শার্ট যার যা ছিল, সব ঐ মা, বোনদের দিকে ছুড়ে দিয়ে ছিল। ওরা কোন রকমের লজ্জা স্থানগুলি ঢেকে ছিল। তারপর সবাইকে কাকলি নামক স্থানে ট্রাক ভরে ভরে পাঠিয়ে দিল। আরো কিছু পাকিস্তানী বাহিনী ছাড়া পড়েছিল।

আজিজুল ভাই তার সঙ্গীদের নিয়ে ওদের বেদুম পিটিয়ে মনের কষ্ট জ্বালা মিটিয়ে ছিল। তারপাশে একটি কক্ষ দেখতে পেয়ে ঢুকে পরল কক্ষের মধ্যে একটি হাত পা বাধা যুবক দেখতে পেল। আজিজুল ভাই যুবকটির কাছে গিয়ে দেখে যুবকটি আর কেই নয়। সেই আজিজুল ভাইয়ের ডুবে যাওয়া বন্ধু জি এন মওলা ওকে বাঁধন মুক্ত করে বলল, তুই এখানে কি করে এলি?

আমি নদীতে জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম, আমাকে পাকবাহিনী তুলে আনে। জি এন মওলা বলল, পাশের ঘরে একটি মেয়ে আছে মেয়েটির প্রতি ওরা এত নির্যাতন করেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। ওকে উদ্ধার কর। মেয়েটির নাম ঝর্ণা। জি এন মওলার ঘরে মধ্যে একটি জানালা ছিলো একটি পাল্লা খোলা ছিল। ওরা জানালা দিয়ে দেখে মেয়েটি মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। মেয়েটি কে উদ্ধার করে বাহিরে আনল।

মেয়েটি বলল, আমি জানালা দিয়ে দেখেছিলাম যে দিন মওলা ভাইকে অজ্ঞান অবস্থায় এনেছিলেন সে দিন। বেদম মার মেরে, ফেলে রেখে চলে যায়। পশুগুলি বুঝতে পেরেছিল মওলা ভাই নৌবাহিনী ।

ওরা তলপেটে কি যেন একটি বস্তু গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। ওটা খুলে নিয়ে, অজ্ঞান অবস্থা ফেলে রেখে যায় যখন মওলা ভাইয়ের জ্ঞান ফিরে এলো ওরা আবার দু পা ফ্যানের সঙ্গে বেঁধে ফ্যান ছেড়ে দিয়েছিল । তখন মওলা ভাই ঘুরতে থাকে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় নাক কান মুখ দিয়ে রক্ত পরছিল। তখন ওরা মওলা ভাই কে ফ্যান থেকে নামিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। ঐ ভাবে দুই দিন পড়ে থাকার পর জ্ঞান ফিরে এলো কথাগুলি শুনে সবার অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল ।

আজিজুল ভাই ঝর্ণাকে বলল, তোমার বাড়ি কোথায় বলো, তোমাকে পৌঁছে দেব। ঝর্ণা অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে । তুমি কোথায় যাবে? যানি না বলে ঝর্ণা কাঁদতে লাগল ।
আজিজুল ভাই বলল, তুমি কার কাছে যাবে বল?

এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আমার বাবা মা, ভাই, বোনকে আমার সামনে হত্যা করেছে বলে ঝর্ণা কাঁদতে লাগল। ঝর্ণার সঙ্গে মওলার ভাব হয়েছিল। পশুগুলি যখন চলে যেত ওরা মাঝখানের জানালা দিয়ে কথা বলত। একে অন্যের প্রতি মায়ার বাধনে জড়িয়ে ছিল । মওলা বলল, তুই চিন্তা করিস না। আমি ঝর্ণাকে নিয়ে যাব। এবং ওকে স্ত্রীর মর্যাদা দিব। বলে মওলা ঝর্ণাকে নিয়ে চলে গেল। আজিজুল ভাইয়েরা দেশকে মুক্ত করার আনন্দে বাড়ী ফিরল। সারাদেশে কান্না-হাসি, দুঃখ, বেদনার মধ্যে দিয়ে আনন্দ মুখর হয়ে উঠল।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু রবে আনন্দ
মিছিলে সারাদেশ ভরে উঠল।

Read More: Quiz Bangla

Scroll to Top