রাসূল (সঃ)-কে হত্যার ব্যর্থ পরিকল্পনা – নেক আমল বই #11

রাসূল (সঃ)-কে হত্যার ব্যর্থ পরিকল্পনা

ইসলামের ধারাবাহিক সফলতা দেখে আবু জাহল, ওৎবা, শায়বা অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ব্যথিত ও দুঃখিত হল। ইসলামের দৈনন্দিন অগ্রগতি তাদের হৃদয়ে ভয়ানক ক্ষতের সৃষ্টি করল। তারা নবী করীম (সঃ)-কে খতম করে দেয়ার ইন চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল। একদা নবী করীম (সঃ) নামাজ আদায় করছিলেন । মানব জাতির রুশদ ও হিদায়াতের জন্য দরবারে ইলাহীতে ফরিয়াদ জানাচ্ছিলেন। আবূ জাহল এটাকে একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে করে, মস্ত বড় এক পাথর কাঁধে নিয়ে খুবই সতর্কাবস্থায় মহানবী (সঃ)-এর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।

আবু জাহল যখন নবী করীম (সঃ)-এর প্রায় কাছে চলে গেল তখন সে দেখতে পেল এক মস্তবড় উট মুখ খুলে তার দিকে আগ্রসর হচ্ছে। মনে হয় যেন তাকে খেয়ে ফেলবে। ঐ অবস্থা দেখে তার হৃদয় স্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। পাথর ফেলে দিয়ে কোন ক্রমে হাঁপাতে স্বীয় পাপিষ্টদের সাথে মিলিত হল। তার সঙ্গী-সাথীরা তাকে তিরস্কার করে বলতে লাগল, হে আবুল হেকাম! তুমি এ কেমন কাপরুষতা দেখানে। এমন সুবর্ণ সুযোগ তুমি হাত ছাড়া করলে। প্রতি উত্তরে আবু জাহল উটের ঘটনা বর্ণনা করল।

রাসূল (সঃ)-কে হত্যার ব্যর্থ পরিকল্পনা

মহানবী (সঃ)-এর বিরুদ্ধে কাফেরদের অবরোধ

ইসলাম ও মুসলমানদের উন্নতি দেখে প্রতি হিংসায় প্রজ্জ্বলিত কাফেররা মহানবী (সঃ)-এর শ্রদ্ধের চাচা আবু তালিব কাছে গিয়ে প্রস্তাব পেশ করল যে, আপনি আমাদের সরদার! আপনার সাথে আমরা অসদাচারণ করতে চাই না! কিন্তু আপনি যদি আপনার ভাতীজাকে আমাদের হাতে উঠিয়ে না দেন তবে আমরা সকলেই একেযোগে আপনার পরিবার ও আপনাদের শুভাকাঙ্খীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করব এবং আপনাদের সাথে আমাদের ওঠা-বসা, চলা-ফেরা, বেচা-কেনা সবকিছুই বন্ধ করে দিব। অতএব, আপনি আপনার ভাতীজাকে নতুন ধর্ম প্রচার হতে বিরত রাখুন। অন্যথায় আমাদের হাতে তুলে দিন। নতুবা আপনাদের সাথে চূড়ান্ত অবরোধ করব।

আবু তালিব এ প্রস্তাব শুনে খুবই চিন্তিত হলেন। কিন্তু পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন যে, “মরতে হয় মরব তবুও আমাদের মান-ইজ্জত নষ্ট করে আমার ভাতীজাকে ওদের হাতে তুলে দিব না।” তাই তিনি তাদেরকে সাফ জবাব দিয়ে ফেললেন, তোমাদের যা করার করতে পার কিন্তু আমি আমার ভাতীজাকে তোমাদের হাতে সমর্পণ করব না এবং তাঁকে তাঁর কাজ করতে বাধাও প্রদান করব না।

খাজা আবু তালিবের এ কথা ন কাফেররা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। তারা বনী হাশিম ও বনী আব্দুল মুত্তালিবের সকলের সাথে সকল প্রকার সম্পর্কের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলল। আর এক অঙ্গিকার নামা লিখে কা’বার দ্বারে টানিয়ে দেয়া হল। এ অঙ্গিকার নামার লেখক ছিল মানস বিন আকাম। আল্লাহ্ তায়ালা তার হাতকে অবশ করে দিয়েছিলেন।

এক পাহাড়ের উপত্যকায় হযরত মুহাম্মদ (সঃ) ও তার সকল বন্ধু-বা আত্মীয়-স্বজন, কাফির-মুসলিম ভেদাভেদ ব্যতিরেকে সকলকেই অবরুদ্ধ করা হল। তিন বছর পর্যন্ত বহু দুঃখ কষ্টে দিনাপিত করার পর নবী করীম (সঃ)-এর মু’জেজা ও কতিপয় লোকের অঙ্গিকার ভঙ্গের ফলে এ অবরোধ তুলে নেয়া হল।

মহানবী (সঃ)-এর চিন্তার বৎসর

হাজার নির্যাতন ভোগের পরও নবী করীম (স) দ্বীনের অমিয় সুধায় জনগণকে সায়লাব করেই চলতে লাগলেন। নবুওয়াতের দশম বৎসর খাজা আবু তালিব বিরামহীনভাবে হুজুর (সঃ)-এর সাহায্য সহযোগীতা নিজেকে ব্যাপৃত রাখলেন। কিন্তু নবুওয়াতের দশম বর্ষে রাসূল (সঃ)-এর সম্মনিত চাচার তিরোধান হয়। আর এ বিরহ-বেদনা শেষ হওয়ার আগে আগেই মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে সহধর্মিনী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)ও ইহধাম ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমালেন। এতে নবী করীম (সঃ) হত বিহবল ও বিমূর্ষত হয়ে পড়লেন। আর এ কারণেই নবী করীম (সঃ) এ বছরকে ‘আমূল হুঝ্‌ন’ বলে আখ্যায়িত করলেন। যার অর্থ হল চিন্তার বছর।

প্রিয় নবী (সঃ)-এর তায়েফ গমন

হিজরীর দশম বছর। খাজা আবু তালিবের ইন্তেকাল হয়ে গেল। রাসূল (সঃ)-কে কষ্ট দেয়া থেকে আর কে রুখতে পারে কাফেরদের! সকলেই নবী করীম (সঃ)-কে নানাভাবে কষ্ট দিতে আরম্ভ করল। রাসূল (সঃ) তায়েফে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করলেন এবং হযরত যায়েদ বিন হারেছা (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে একসময় পাড়ি জমালেন সবুজ-শ্যামল, সুজলা-সুফলা, তায়েফ ভূমিতে। তাদের দাওয়াত দিলেন একত্ববাদের তাওহীদের। আর বললেন, তোমরা বল-না ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তবেই তোমরা মুক্তি পেয়ে যাবে।

বর্বর তাফেফবাসী রাসূল (সঃ)-এর মায়াবী আহ্বানে তো সাড়া দিলই না, তাঁকে নির্যাতন করার জন্য উঠে পড়ে লাগল তারা। তারা প্রস্তরাঘাতে রাসূল (সঃ)-এর সমস্ত দেহ মোবারককে জর্জরিত করে ফেলল। পবিত্র বদন ফেটে ফুয়ারার ন্যায় রক্তের ঝর্ণা প্রবাহিত হল। তবুও নবী করীম (সঃ) তাদের জন্য সামান্য একটু বদদোয়া ও করলেন না। শুধু বললেন-

উচ্চারণ : আল্লাহুম্মাগ ফিরলী ক্বাওমীফাইন্নাহুম লা ইয়ালামুন)
অর্থ : হে, আমার প্রতিপালক! ক্ষমা করে দিন আমার সম্প্রদায়কে। তারা তো বুঝছে না । তারাতো আমায় চিনছে না। একাধারে এক মাস বিভিন্ন কষ্ট, নির্যাতন, জ্বালাতন ভোগের পর নবী করীম (সঃ) ফিরে এলেন পূণ্য ভূমি মক্কায় ।

মহানবী (সঃ)-এর বিশেষ পুরষ্কার

নবুওয়াতের দশম বর্ষ। আঘাতে আঘাতে জর্জরিত রাসূল (স)-এর সহধর্মিনীর ওফাত। চাচা আবু তালিবের তিরোধান। তায়েফবাসীদের নির্যাতন। মক্কার কাফিরদের উৎপীড়ন। সব মিলিয়ে রাসূল কষ্ট ও হতাশার সাগরে হাবুডুবু যাচ্ছিলেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন। তাকে বিশেষ পুরষ্কারে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। তাঁকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করতে চাইলেন জিব্রাঈল আমীন (আঃ)-কে পাঠিয়ে দিলেন, মহানবী (সঃ) আকাশে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

নবুওয়াতের দশম বর্ষের রজব মাসের সাতাইশ তারিখ। নবী করীম (সঃ) হাতিমে কাবায় শায়িত। জিব্রাঈল আমীন (আঃ) এসে উপস্থিত। বললেন, হে রাসূল! আপনি উঠুন। চলুন আমার সাথে। আপনার বন্ধু আপনাকে আহ্বান করেছে। আপনার প্রতীক্ষায় তিনি অপেক্ষা করছেন। রাসূল (স) ওজু করে জিব্রাঈল আমীন (আঃ)-এর সাথে বোরাকে চড়ে বসলেন। ক্ষণিকের মধ্যেই পৌঁছে গেলেন বায়তুল মাকদিসে। মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মাকদিসে মোযেজা স্বরূপ সকল আম্বিয়ায়ে কেরামকে জমায়েত করা হল । জিব্রাঈল আমীন (আঃ) আযান ফুকালেন।

সকলেই নামাজ আদায়ের জন্য কাতারবন্দি হলেন। জিব্রাঈল আমীন (আঃ) রাসূল (স)-এর হাত ধরে সামনে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি ইমামতি করলেন সকল আম্বিয়ায়ে কেরামের। দু’রাকাত নফল নামায আদায় করে উর্দ্ধগমন করলেন ।
প্রথম আকাশে পৌঁছে হযরত জিব্রীল (আঃ) আকাশের দরজায় নক করলেন। গেট প্রহরীরা জিজ্ঞাসিল, কোন সত্তার আগমন ঘটল! জিব্রীল (আঃ) বললেন, তোমরা যার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছ! সে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ (সঃ)-এর মুবারক আগমন ।

ছাল্লাল্লাহু আলা মুহাম্মাদ (সঃ)। প্রথম আকাশে মিছিলে মিছিলে মুখরিত করে সকলেই নবী করীম (সঃ)-এর পেছনে চলতে লাগল । এভাবেই একে একে সপ্তাকাশ পর্যন্ত আরোহণ করলেন। পথিমধ্যে প্রথম আকাশে হযরত আদম (আ), দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা ও ইয়াহ্ ইয়াইয়া (আ), তৃতীয় আকাশে হযরত ইউসুফ (আঃ), চতুর্থ আকাশে হযরত ইদ্রীস (আঃ), পঞ্চম আকাশে হযরত হারুন (আঃ), ষষ্ঠ আকাশে হযরত মুসা (আঃ) ও সপ্তম আকাশে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর সাক্ষাৎ হয়, এবং নবী করীম (সঃ) সকলকেই সালাম বিনিময় করেন ও তাদের সাথে কথা-বার্তা বলেন ।

এরপর নবী করীম (সঃ) সিদ্রাতুল মুনতাহার দিকে অগ্রসর হলেন। পথিমধ্যে দৃষ্টিগোচর হল হাউজে কাউসার ও বেহেশত। এরপর তাঁকে দেখান হল দোযখ। যাতে হচ্ছিল ভীষণ আযাব । দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুন। তিনি তথায় দেখতে পেলেন একদল লোক! যারা মানুষের গোশত ভক্ষণ করছিল। রাসূল (সঃ)-এর কারণ জিজ্ঞাসিলেন। জিব্রাঈল (আঃ) বললেন, এরা মানুষের গীবত করে বেড়াত । তাই তারা মরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করছে।

প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন গীবত কত বড় জঘন্য অপরাধ। আর বর্তমান যুগে আমরা গীবতকে কোনরূপ দোষই মনে করি না। গীবত বলা হয়- কার এমন দোষ তার অনুপস্থিতিতে অন্যের কাছে বর্ণনা করা যা তার মধ্যে রয়েছে। আসুন আজ হতেই আমরা গীবতকে ছেড়ে দেই, এবং দোযখের ভয়াবহ শাস্তি হতে নিজেকে রক্ষা করি ।
এরপর নবীয়ে করীম (সঃ) সিদরাতুল মুনহার দিকে অগ্রসর হন, এবং আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সাথে সরাসরি কথোপকথন শেষে আবার পৃথিবীর বুকে চলে আসেন ।

আর এ ঘটনা দুনিয়ার হিসেবে এক রাতেই সংঘটিত হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে সময় অনেক লেগেছিল। কিন্তু নবী করীম (সঃ)-এর এ সফর যখন শুরু হয়েছিল। তখন নব মণ্ডল ভূ-মণ্ডলের সকল বস্তু স্বীয় কাজ কর্ম ছেড়ে তার সম্মানার্থে আপন গতি-বিধিকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল । তাইতো মহানবী (সঃ) পুনরায় হাতীমে ফিরে এসে দেখলেন যে, অজুর পানি গড়িয়ে পড়ছে । যদিও এটা বাস্তবে অসম্ভব। কিন্তু আল্লাহর কাছে সম্ভব ।

মদীনায় হিজরত

নবুওয়াতের ত্রয়োদশ বৎসর। পরপর দু’বছর হজ্জ মওসুমে মদীনার লোকজন মক্কায় এসে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নিল । তারা মহানবী (সঃ)-কে তাদের ভূমিতে আশ্রয় নেয়ার আমন্ত্রণ জানাল। মহানবী (সঃ) তাদেরকে সম্মতি দিয়ে আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় রইলেন। ইতিমধ্যে একরাতে মক্কার প্রতিটি সম্প্রদায় থেকে এক একজন করে যুবক রাসূল (সঃ)-কে হত্যা করার জন্য একত্রিত হয়ে মহানবীর (স)-এর বাড়ি ঘেরাও করল। এদিকে আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল (সঃ)-কে হিজরতের নির্দেশ দিলেন। হজুর (সঃ) সুরায়ে ইয়াসীন তেলাওয়াত করলেন। যখন-

আয়াতে পৌঁছলেন তখন এ আয়াতটি কয়েকবার পাঠ করে এক মুষ্ঠি ধূলি বাইরে নিক্ষেপ করলেন।
আয়াতটি বাংলা উচ্চারণ : ফাআগ শাইনাহুম ফাহুম লা ইউবছিরুন।
অর্থ : ফলে আমি তাদের চোখে আবরণ ঢেলে দিলাম ফলে তারা দেখতে পেল না ।

নবী করীম (সঃ) স্বীয় পালঙ্কে হযরত আলী (রাঃ)-কে শুইয়ে দিয়ে, তার কাছে গচ্ছিত সকল আমানত তাকে বুঝিয়ে দিয়ে, তিনি দ্বার খুলে শত্রুদের মাঝখান দিয়ে পৌঁছে গেলেন সিদ্দীকে আকবর হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর গৃহে। তাঁর দু’জনে চললেন মদীনার দিকে।

সওর গুহায় অবস্থান

এদিকে রাত ফুরিয়ে গেল। পাখির কিচির আওয়াজ ও কলরবে সকলের নিদ্রা ভঙ্গ হল । অপেক্ষমান শত্রু বাহিনী নবী করীম (সঃ)-এর ঘরে প্রবেশ করে তাঁকে না পেয়ে তাঁর অনুসন্ধানে সকলেই বেরিয়ে পড়ল। এদিকে নবী করীম (সঃ)-এর পাকড়াওকারী-কে একশত উট পুরষ্কার দেয়ার লোভনীয় ঘোষনা মক্কার অলিতে-গলিতে পৌঁছে দেয়া হল । রাসূল (সঃ) সিদ্দীকে আকবর (রাঃ)-কে নিয়ে সওর পর্বতের একটি আত্মগোপন করে রইলেন ।

মদীনায় প্রস্থান ও সুরাকা মালিকের সাক্ষাৎ

গারে ছওরে তিনদিন অবস্থানের পর নবী করীম (সঃ) মদীনা অভিমুখে রওনা হলেন। তাঁরা দুটি উটে আরোহণ করে গন্তব্যের দিকে চললেন। হঠাৎ দেখা গেল দূর থেকে কে যেন ঘোড়া ছুটিয়ে দ্রুত বেগে আসছে। সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) রাসূল (স)-কে লক্ষ্য করে বললেন, রাসূলুল্লাহ্! ঐ তো আমাদের ধরার জন্য কে যেন আসছে। নবী করীম (সঃ) সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে কুরআন তেলাওয়াত করতে লাগলেন ।

দেখা গেল সুরাকা বিন মালিক (রাঃ) (পরবর্তীতে তিনি মুসলমান হন) তাঁদের এত কাছে এসে পৌঁছেছে যে, সে রাসূল (সঃ)-এর কোরআন তেলাওয়াতও শুনতে পাচ্ছিল । নবী করীম (সঃ) তখন তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন । সাথে সাথেই উত্তপ্ত মরুভূমিতে তাঁর ঘোড়া দেবে গেল । আর সে ঘোড়া হতে ছিটকে প্রায় দশ গজ দূরে কাতরাতে লাগল । নিরুপায় হয়ে সে নবী করীম (সঃ)-এর কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইল । দয়ালু নবী (সঃ) তাকে ক্ষমা করে দিলেন।

কুবায় অবস্থান

কুরা মদীনার কাছাকাছি অবস্থিত একটি জায়গা। কয়েকদিনের বিরামহীন ভ্রমণের পর নবী করীম (সঃ) সন্ধ্যার সময় কুরায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। এদিকে রাসূল (সঃ)-এর মদীনায় আগমনের খবর শুনে মদীনাবাসী প্রত্যেক কুবায় এসে তাঁর জন্য সারাদিন অপেক্ষা করে সন্ধ্যা বেলায় চলে যেতেন, আজও তাই হল। তাদের প্রায় সকলেই প্রতীক্ষার প্রহর গুনে চলে গেছেন। শুধু রয়ে গেছেন নবী প্রেমে উন্মাদ কতিপয় ব্যক্তিবর্গ, তারা কুবার সু-উচ্চ চূড়ায় আরোহণ করে এদিক-সেদিক তাকিয়ে রাসূল (সঃ)-এর আগমনের প্রতিক্ষা করছিলেন।

হঠাৎ দেখা গেল মরুভূমির অপর প্রান্তে সাদা পোষাকধারী দু’জন লোক উটে বহু প্রতিক্ষীত আরোহন করে আসছেন। তাদের আর বোঝার বাকি রইল না যে, ইনি তাদের সে মহা মানবটি ।
তারা সেখান থেকে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করতে লাগল-ওহে মদীনাবাসী! তোমরা যার প্রতিক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছ, সে দয়ালু নবী আমাদের মাঝে আসছেন। তোমরা তার অভ্যর্থনা জ্ঞাপন কর। এর আওয়াজ শোনামাত্রই মদীনায় অলি-গলিগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলেই মিছিল সহকারে কুবার দিকে ছুটে চলল।

তাঁরা মহানবী (সঃ)-কে প্রাণঢালা অভিনন্দন জ্ঞাপন করল। বহু দিনের বিনিদ্র আখিগুলো সর্বশেষ নবী (সঃ) দর্শন লাভের মাধ্যমে তাদের নয়ন জুড়াল। আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রবাহিত হল অজস্র আনন্দাশ্রু ধারা। নবী করীম (সঃ) পৌঁছে গেলেন নিরাপদ নিরালয়ে নিরাপদ ভূমিতে।

হিজরীসনের সূচনা

কুবায় চৌদ্দদিন অবস্থানের পর নবী করীম (সঃ) রবীউল আউয়াল মাসের জুমাবারে মদীনায় গমন করেন এবং এরই মধ্যে কুবাতে একটি মসজিদে নির্মাণ করেন। যা ছিল ইসলামের ইতিহাসের সর্বপ্রথম মসজিদ। যেহেতু হিজরতের পরিকল্পনা মুহাররম মাসে নিয়েই তাই হযরত উমর (রাঃ) মুহাররম মাসকে বছরের প্রথম মাস গণনা করে ইসলাম পঞ্জিকা তথা হিজরী সনের সূচনা করেন।

মসজিদে নব্বীর ইতিহাস

মদীনায় পৌঁছে বনী সালেম বিন আউফের বাড়ির কাছে জুমার নামাজের সময় হয়ে গেল । হুজুর (সঃ) উট থেকে নেমে জুমুআর নামাজ আদায় করেন। এরপর উটকে ছেড়ে দেয়া হল। উট যেখানে গিয়ে বসে পড়ল, সে জায়গাটিকে ক্রয় করে কাঁচা ইটের দেয়াল ও খেজুর গাছের ডাল দিয়ে ছাদ বানিয়ে নির্মাণ করা হল-মসজিদে নব্বী। আর মজিদের সাথে দুটি হুজরা তৈরি করা হল। যার একটি ছিল হযরত আয়শা সিদ্দীকাহ্ (রাঃ)-এর জন্য । আর অপরটি হযরত সাওদাহ্ (রাঃ)-এর জন্য ।

হযরত উমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মসজিদে নব্বীর নির্মাণ কাঠামো পূর্বের মত রেখে এর জায়গা আর সম্প্রসারণ করা হয়। এরপর হযরত উসমান (রা)-এর খেলাফতকালে এতে ব্যাপক পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়। বিরাট এলাকা সম্প্রসারণ করা হয়। দেয়ালগুলো নকশী পাথর, চাঁদীর নকশা ও থামগুলো নকশাযুক্ত পাথরের। আর ছাফ শাল কাঠ দিয়ে তৈরি করা হল ।

এরপর হযরত উমর বিন আব্দুল আজীজ (রঃ)-এর রাজত্বকালে তারই নির্দেশে এতে আর পরিবর্তন পরিবর্ধন করা হয় এবং উম্মুল মুমীনদের বাসস্থান এতে সংযুক্ত করা হয়। এরপর ১৬০ হিজরীতে খলীফা মাহ্দী ও ২০২ হিজরীতে আল মানুন এতে আর পরিবর্তন পরিবর্ধন করেন এবং এর ভিত্তি খুবই মজবুত করে গড়ে তোলেন। এরপর উসমানিয়া সুলতানগণ একে আরও সুন্দর ও চিত্তাকর্ষকরূপে নির্মাণ করে এর শ্রীবৃদ্ধি করেন। এরপর থেকেই যুগে যুগে সেই ভিত্তির উপর তাকে আর সুনিপূণ ও সুচারুরূপে গঠন করা হয়েছে।

ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও জিহাদের সূচনা


মদীনা মুনাওয়ারাহ্ ইসলামের নিরাপদ ভূমি। রাসূল (সঃ) তথায় গিয়ে সর্বপ্রথম মদীনায় বসবাসরত অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথে চুক্তি করলেন, সর্বাবস্থায় পরস্পর সাহায্য-সহযোগীতা করার। এরপর তথায় প্রতিষ্ঠা করলেন ইসলাম অনুশাসন কিন্তু মক্কার কাফেররা রাসূল (সঃ)-কে বিতারিত করেই ক্ষান্ত হয়নি। বরং তার মদীনা আক্রমণের জন্য বিভিন্নভাবে শক্তি সামর্থ সংগ্রহ করছিল এবং তরে তলে মদীনার ইয়াহুদীদেরকে রাসূল (সঃ)-এর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছিল। এ কারণেই নবী করীম (সঃ) বিভিন্ন সময় কুরাইশদের মোকাবেলায় সৈন্য প্রেরণ করেছেন এবং কোন কোন যুদ্ধে তিনি নিজেও অংশ গ্রহণ করে অত্যন্ত সাহসিকতা ও দক্ষতার সাথে সেনাবাহিনী পরিচালনা করেছেন।

উল্লেখ্য যে, যে সকল যুদ্ধে হুজুর (সঃ) নিজে অংশ নিয়েছেন ইতিহাসে একে “গযওয়া” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর যেগুলোতে তিনি কোন সাহাবীকে আমীর নিযুক্ত করে পাঠিয়েছেন একে “সারিয়্যাহ্” বলা হয়। গাযওয়ার সংখ্যা ২৩টি এবং সারিয়্যার সংখ্যা মোটামুটি ভাবে ৪৩ টি ।

প্রথম হিজরী

প্রথম হিজরীতে দুটি সারিয়্যাহ্ প্রেরণ করা হয় যার একটির নেতৃত্ব দেন হযরত হামযাহ্ (রাঃ)। আর অপরটির হযরত উবাদাহ্ ইবনুল হারিস (রাঃ)।

দ্বিতীয় হিজরী

এ বর্ষে মোট পাঁচটি গযওয়া সংঘটিত হয়-(১) গযওয়ায়ে আবওয়া যাকে উদ্দানও বলা হয়। (২) গযওয়ায়ে বুয়াত (৩) গযওয়ায়ে বদরে কুবরা (৪) গাযওয়ায়ে বনী কায়নুকা (৫) গযওয়ায়ে সাবিক। এছাড়াও তিনটি সারিয়্যাহ্ প্রেরণ করা হয়। যার প্রথমটির নেতৃত্ব দেন হযরত আব্দুল্লাহ্ বিন জহশ (রা)। দ্বিতীয়টির আমীর ছিলেন হযরত উমায়ের (রা) শেষটির আমীর নিযুক্ত হয়েছিলেন হযরত সালেম (রাঃ)।

দ্বিতীয় হিজরীর উল্লেখযোগ্য গযওয়া ছিল বদর যুদ্ধ । মদীনা হতে প্রায় আশি মাইল দূরে বদর নামক একটি কূপ রয়েছে। এ যুদ্ধ ঐ কূপের নিকট সংঘটিত হওয়ার কারণেই এটাকে ইতিহাসে বদর যুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয় ।

যুদ্ধের কারণ

কুরাইশদের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান অংশ মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেয়া হত । তাই তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিহত করা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ হতে একটি প্রধান কাজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসে নবী করীম (সঃ) জানতে পারলেন কুরাইশদের এক ব্যবসায়ী দল সিরিয়ার ব্যবসা শেষে মক্কায় প্রত্যাবর্তন করছে। তাই তাদের প্রতিহত করার জন্য দ্বিতীয় হিজরীর রমজান মাসের বার তারিখে তিনশত চৌদ্দজন সাহাবীর এক বাহিনী নিয়ে তাদের তাড়া করার জন্য মদীনা হতে বের হলেন ।

এদিকে কুরাইশ নেতা এখবর জানতে পেরে রাস্তা পরিবর্তন করে নদীর পার দিয়ে নিরাপদে দেশের দিকে রওনা হল । আর একজনকে এ সংবাদ দিয়ে মক্কায় প্রেরণ করল যে, মক্কাবাসী যেন তাদের ব্যবসায়ী কাফেলাকে মুহাম্মদ (সঃ) হাত থেকে রক্ষা করে। মক্কায় মুশরিকগণ এ খবর শুনামাত্রই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল। প্রতিশোধের লেলিহান শিখা তাদের হৃদয় কন্দরে জেগে উঠল। সহস্রাধিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী বদর প্রান্তে পৌঁছে গেল ।

ফলাফল

বদর প্রান্তে পৌঁছে নবী করীম (সঃ) জানতে পারলেন কুরাইশদের ব্যবসায়ী কাফেলা চলে গেছে। আর বদরের অপর প্রান্তে এক বিরাট বাহিনী মুকাবেলার জন্য অপেক্ষা করছে। নবী করীম (সঃ) সাহাবায়ে কেরামের সাথে মশওয়ারাহ্ করে যুদ্ধের জন্য কাতার বন্দি করলেন। যুদ্ধ হল । আল্লাহ পাকের গায়েবী মদদে মুষ্টিমেয় সহায় সম্বল মুসলমানের বিজয় সূচিত হল। কাফেরদের সত্তর জন ধৃত হল। নিহত হল আর সত্তর জন্য। যার মধ্যে কট্টরপন্থী আবু জাহল ওতবা, শায়বা সহ বড় বড় নেতৃবন্দ ছিল।

তৃতীয় হিজরী

এ হিজরীতে কাফেরদের বিরুদ্ধে মহানবী (সঃ) তিনটি জেহাদে অবতীর্ণ হন। * গযওয়ায়ে গাতফান * গযওয়ায়ে ওহুদ * গযওয়ায়ে হামরাউল আসাদ
এবং দুটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ায়ে যায়েদ বিন হারিস (রাঃ) (২) সারিয়ায়ে মুহাম্মাদ বিন মুসলিমা (রাঃ) এ হিজরী সনের উল্লেখযোগ্য গাযওয়া হল-গযওয়ায়ে ওহুদ ।

চতুর্থ হিজরী


এ হিজরীতে দুটি গযওয়া সংঘটিত হয়। (১) গযওয়ায়ে বনী নজীর। (২) গযওয়ায়ে বদরে সুগরা, এবং ৪টি সারিয়া প্রেরণ করা হয় (১) সারিয়ায়ে আবু সালমা (রাঃ)। (২) সারিয়ায়ে আব্দুল্লাহ বিন ওনাইস (রাঃ) (৩) সারিয়ায়ে মুনজির (রা) (৪) সারিয়ায়ে মুরহিদ (রাঃ)। এ হিজরীর উল্লেখযোগ্য গযওয়া হল গযওয়ায়ে বনী নজীর ।

পঞ্চম হিজরী


এ বৎসর ৪টি গযওয়া সংঘটিত হয়। (১) গযওয়ায়ে জাতুর রেকা। (২) গযওয়ায়ে দাওমাতুল জন্দল। (৩) গযওয়ায়ে বনী মুসতালাক (৪) গযওয়ায়ে খন্দক। এর মধ্যে গযওয়ায়ে খন্দক উল্লেখযোগ্য।

ষষ্ঠ হিজরী

এ বৎসর তিনটি গযওয়া সংঘটিত হয়- (১) গযওয়ায়ে বনী লিয়ান । (২) গযওয়ায়ে গাবা । (৩) গযওয়ায়ে হুদায়বিয়া এবং এগারটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ায়ে মুহাম্মদ বিন মুসলিমা (রাঃ) কারতা অভিমুখে। (২) সারিয়ায়ে উককাশা (রাঃ) (৩) সারিয়ায়ে মুহাম্মদ বিন মুসলিমা, জিল কিস্সা অভিমুখে (৪) সারিয়ায়ে যায়দ বিন হারিসা (রাঃ) বনী সোলামান অভিমুখে। (৫) সারিয়ায়ে আব্দুর রহমান আউফ (রাঃ) (৬) সারিয়ায়ে আলী (রাঃ) (৭) সারিয়ায়ে যায়িদ বিন হারিসা (রা) উম্মে কাযফা অভিমুখে। (৮) সালিয়ায়ে আব্দুল্লাহ্ বিন রওয়াহা (রা) (৯) সারিয়ায়ে আব্দুল্লাহ্ বিন আতীক (রাঃ) (১০) সারিয়ায়ে কুরজ বিন জাবের (রাঃ) (১১) সারিয়ায়ে আমরূদ দমরী (রাঃ)। এ বৎসরের উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ হল-হুদায়বিয়ার জিহাদ ।

হুদায়বিয়া পরিচিতি

হুদায়বিয়া একটি কূপের নাম। মক্কা মোয়াজ্জমার এক মঞ্জিল তথা ১৬ মাইল অদূরে এর অবস্থান। এ নামে একটি গ্রামও প্রসিদ্ধ রয়েছে। হুদায়বিয়াতে কোন যুদ্ধ হয়নি, বরং হয়েছিল মক্কার কুরাইশদের সাথে একটি সন্ধি । যেহেতু হুদায়বিয়া নামক স্থানে এটি সংঘটিত হয়েছিল তাই একে হুদায়বিয়ার সন্ধি বলা হয়ে থাকে।

ঘটনার সূত্রপাত

মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদীনায় গমনের প্রায় ছ’টি বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলল। সাহাবায়ে কেরাম ও রাসূল (রাঃ) দুনিয়ার প্রথম ঘর বায়তুল্লাহর জিয়ারত হতে বঞ্চিত। রাসূল (সঃ) উমরার নিয়তে ইহরাম বেঁধে মক্কা অভিমুখে রওনা হলেন। হুদায়বিয়ায় পৌঁছে মহানবী (স) হযরত উসমান (রাঃ)-কে মক্কায় প্রেরণ করলেন। কাফেররা তাঁকে গ্রেফতার করে ফেলল। এদিকে মুসলমানদের মাঝে রটে গেল । হযরত উসমান (রাঃ) শাহাদত বরণ করেছেন। তাই সকলেই রাসূল (সঃ)-এর হাতে জিহাদের বয়আত গ্রহণ করলেন। পবিত্র কুরআনে একে “বয়আতে রেজওয়ান” বলা হয়েছে। প রবর্তীতে জানা গেল ঘটনা মিথ্যে, বরং কুরাইশগণ সন্ধির জন্য সুহায়ল বিন আমরকে সন্ধি করার জন্য প্রেরণ করছে। মহানবী (সঃ) নিম্নলিখিত শর্তগুলো মেনে নিয়ে দশ বৎসরের জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেন।

চুক্তির শর্তসমূহঃ-

*মুসলমানগণকে এ বছর উমরা আদায় না করে ফেরত যেতে হবে।

  • আগামী বছর হজ্জে এসে মাত্র তিন দিন অবস্থান করে চলে যেতে হবে।
  • কেউ অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আসতে পারবে না। যদি অস্ত্র থাকে তবে তা কোষ বদ্ধ থাকবে ।
  • মক্কা থেকে কাউকে মুসলমান বানিয়ে মদীনায় নিয়ে যেতে পারবে না। তবে কোন মুসলমান যদি মক্কায় থাকতে চায়। তবে বাধা দেয়া যাবে না।
  • যদি কেউ মক্কা থেকে পালিয়ে মদীনায় চলে যায় তবে তাকে ফেরত দিতে হবে। আর যদি কেউ মদীনা হতে মক্কায় চলে আসে তবে তাকে ফেরত দেয়া হবে না।

এ সকল শর্তগুলো যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছিল। তবুও আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন এ সন্ধিকে ‘ফাতহুম মুবীন’ বা প্রকাশ্য বিজয় বলে অভিহিত করেছেন।

হিজরী আট

এ বৎসর ইসলামের ইতিহাসের স্মরণীয় চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার প্রত্যেকটিতে নবী করীম (সঃ) নিজে জিহাদে অংশ গ্রহণ করেছেন। (১) গাযওয়ায়ে মূতা। (২) মক্কা বিজয়। (৩) গযওয়ায়ে হুনায়ন (৪) গযওয়ায়ে তায়েফ এবং দশটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ায়ে গালিব (রাঃ), বনী মলূহ অভিমুখে (২) সারিয়ায়ে গালিব, ফিদাক অভিমুখে। (৩) সারিয়ায়ে সূজা (রাঃ) (8) সারিয়ায়ে কাব (রাঃ) (৫) সারিয়ায়ে আর ইবনুল আস (রাঃ) (৬) সারিয়ায়ে আবু উবায়দাহ্ ইবনুল জররাহ্ (রাঃ) (৭) সারিয়ায়ে আবূ কাতাদাহ (রাঃ) (৮) সারিয়ায়ে খালিদ (রাঃ) (৯) সারিয়ায়ে তোফায়েল বিন আমর দূসী (রাঃ) (১০) সারিয়ায়ে কাতাবাহ (রা)।

মক্কা বিজয়ের কারণ

ষষ্ঠ হিজরীতে সংঘটিত হয়ে যাওয়া চুক্তি পরিপূর্ণভাবে মুসলমানগণ পালন করতে লাগলেন। কিন্তু মাত্র দু’বছর না পেরুতেই কাফেররা সে চুক্তি ভঙ্গ করে বসল। নবী করীম (সঃ) দূত মারফৎ কয়েকটি নতুন শর্তারোপ করে তাদের কাছে এ ফরমান দিয়ে পাঠালেন।যদি এ শর্তগুলোকে চুক্তিতে অন্তরভূক্ত না করা হয় তবে ধরে নেয়া হবে আজ হতে দশ বছর মেয়াদের চুক্তির যবনিকা হল । কাফেররা চুক্তি ভাঙ্গনটাই পছন্দ করল ।

সন্ধি চুক্তি ভাঙ্গার পর মহানবী (সঃ) ৮ম হিজরীর ৮ই রমাজানুল মুবারকে দশ হাজার সাহাবায়ে কেরামের এক বাহিনী নিয়ে মক্কা বিজয়ের অভিযানে বের হলেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে কোন রক্তপাত ছাড়াই মহানবী (সঃ) মক্কা বিজয় করলেন। আর চির শত্রু মক্কার কাফেরদেরকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মাফ করে দিলেন।

পবিত্র বায়তুল্লাহ শরীফে তখনও ৩৬০ মূর্তির আস্তানা ছিল-হুজুর (সঃ) কাবা গৃহে প্রবেশ করে হাতের ছড়ি দিয়ে এক একটি মূর্তির দিকে ইশারা করার সাথে সাথেই উহা দুমড়ে-মুচড়ে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। প্রিয় নবী (সঃ)-এর পবিত্র জবান মুবারক হতে তখন পবিত্র কুরআনের এই আয়াতটি উচ্চারিত হচ্ছিল।
অর্থ : সত্য সমাগত, মিথ্যা বিতারিত মিথ্যা তো বিতাড়িত হবারই।

নবম হিজরী

এ বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গযওয়া সংঘটিত হয়। আর তা হল।গযওয়ায়ে তাবুক । এছাড়াও তিনটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ারে আল কামাহ্ (রাঃ) (২) সারিয়ায়ে আলী (রাঃ) (৩) সারিয়ায়ে উক্কাশা (রাঃ)।

হিজরী দশ

এ বছর মাত্র দুটি সারিয়া প্রেরণ করা হয়। (১) সারিয়ায়ে খালিদ বিন ওযাযিল (রাঃ) (২) সারিয়ায়ে আলী (রাঃ) এবং এ বছরই হুজুর (সঃ) বিদায় হজ্জ আদায় করেন এবং আরাফাতের ময়দানে মানব জাতির চির কল্যাণের জন্য এক হেদায়াত ও উপদেশ পূর্ণ বক্তৃতা দেন। যার কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরা হল।

ওহে মানব জাতি! তোমরা আমার কথা শ্রবণ কর! আমি তোমাদের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় বিষযগুলো বর্ণনা করছি। আমি জানিনা আগামী বছর তোমাদের সাথে মিলিত হতে পারি কিনা। তোমরা আজ যারা এখানে উপস্থিত আছ তারা, যারা উপস্থিত নেই তাদের কাছে যেন একথাগুলো পৌঁছে দেয়।
ওহে আমার অনুচর বৃন্দ! অপরের জান-মাল ও সম্মান তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত এমনভাবে হারাম করা হল-যেমনিভাবে এ দিন (আরাফার এ মাস জিলহজ্জ) ও এ শহর মক্কার সম্মান রক্ষা করা হয়েছে। তাই কার কাছে যদি অন্য কারর আমানত থাকে তবে সে যেন তার আদায় করে ।

হে, আমার প্রিয় সঙ্গী-সাথিগণ! তোমাদের উপর তোমাদের স্ত্রীদের কিছু হক রয়েছে এবং তাদের উপর ও তোমাদের হক রয়েছে। হে, লোক সকল! মুসলমান সব ভাই ভাই। হে লোক সকল! কারর জন্য তার ভাইয়ের মাল তার সন্তুষ্টি ছাড়া বৈধ নয় । ওহে মুসলিম জাতি! আমার পর তোমরা পুনরায় তোমাদের পুরাতন ধর্মে ফিরে যেওনা। ফলে তোমরা নানা ধরনের কলহ-বিপদে লিপ্ত হবে । আর একে অন্যকে হত্যা করবে। এই জন্যই আমি তোমাদের জন্য আল্লাহর কিতাব কুরআন কারীমে ও তার রাসূলের (সঃ) হাদীস রেখে যাচ্ছি। যতি তোমরা এ দুটি জিনিষকে ভালভাবে আঁকড়ে ধরতে পার তবে কখন পথ ভ্রষ্ট হবে না।

অতঃপর মহানবী (সঃ) বললেন॥ওহে, লোক সকল! তোমাদের প্রভু বা পালনকর্তা এক অদ্বিতীয়। তোমাদের পিতা এক, তোমরা সকলেই হযরত আদম (আঃ)-এর সন্তান। আর তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে মাটি থেকে। তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানী ঐ ব্যক্তি — যদি সবচেয়ে বেশী খোদাভীরু । কোন আরবের খোদা ভীরুতা ছাড়া অনারবের উপর শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর মনে রেখ আল্লাহর বাণী আমি তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। হে, আল্লাহ্! তুমি সাক্ষী থাক। হজ্জ সমাপন করে দশদিন মক্কা মুয়াজ্জমায় অবস্থান করে মহানবী (সঃ) মদীনায় চলে আসেন

একাদশ হিজরী

সারিয়ায়ে উসামা বিন যায়দ (রাঃ) ও মৃত্যু ব্যাধি। এ হিজরীর ২৬শে সফর মহানবী (সঃ) হযরত উসামাহ বিন যায়দ (রা)-এর নেতৃত্বে একটি সারিয়া প্রেরণের প্রস্তুতি নেন । যা রাসূল (সঃ)-এর ওফাতের পর প্রেরণ করা হয় ।

মৃত্যু ব্যাধি

একাদশ হিজরীর ২৮শে সফর নবী করীম (সঃ) জ্বরাক্রান্ত হন। ক্রমেই এ জ্বর বাড়তে থাকে এবং একটানা তের দিন জ্বরাক্রান্তভাবে দুনিয়ার কষ্ট ভোগের অবশেষে ১২ই রবিউল আউয়াল রাহমাতুল আলামীন বিশ্ববাসীকে শোকের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে প্রিয় হাবীব আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন।

Read More: নেক আমল বই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top